অতঃপর তুমি আমি পর্ব ৬

গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ৬
অনেকক্ষণ যাবত এয়ার টাউন সেন্টারে স্কটিশ দেশপ্রেমিকের স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিউ। একটু সামনে এগোলেই জুনায়েদের অফিস। মূল গেট দিয়ে যারা যাওয়া-আসা করছে, তাদের এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। পিউ অপেক্ষা করছে কখন জুনায়েদ বের হবে অফিস থেকে। ক্রিসের দেয়া তথ্য অনুসারে রাত আটটায় তার কাজ শেষ হয়। দশ-পনের মিনিটের মধ্যেই অফিস থেকে বেরিয়ে যায় সে। অথচ এখন রাত সাড়ে আটটা বাজে, জুনায়েদের টিকিটি দেখা যাচ্ছে না। সে কি এখনো কাজ শেষ করেনি? নাকি আজ অফিসেই আসেনি? পিউ বুঝতে পারছে না এখানে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। ওর বন্ধুরা সবাই বিচে, বনফায়ার উদযাপন করছে। সে কি ফিরে যাবে ওখানে নাকি আরেকটু সময় অপেক্ষা করবে? একবার অফিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে ভালো হতো। কিন্তু ওদিকে পা বাড়ানোর মতো অবস্থা নেই। প্রচুর শীত লাগছে ওর। গায়ে জ্বর তো আছেই, সাথে সাগর পাড়ের ঠান্ডা বাতাস শরীরের ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। হাড্ডিগুলো জিরজিরে হয়ে যাচ্ছে।
আচমকাই কেউ একজন পেছন থেকে জাপটে ধরল পিউকে। সে চিৎকার দেবার আগেই হেঁচকা টান মেরে তাকে নিয়ে গেল স্ট্যাচুর পেছনে। সামনের দিকে স্ট্রিটলাইটের নিয়ন আলো থাকলেও পেছন দিকটায় আবছা অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেই একজোড়া চোখ দেখল সে। তখনই চিৎকারটা আটকে গেল গলায়। নিজেকে আবিস্কার করল প্রিয় বাহুডোরের উষ্ণতায়। জুনায়েদের ততক্ষণে ওকে নিজের ওভারকোটের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলেছে। ওভাবেই বোতামগুলো লাগিয়ে পিউকে জাপটে ধরল সে। পিউ কাঁপছে কান্নার দমকে আর বাতাসের তীব্রতায়। জুনায়েদ ওর কাঁপাকাঁপি আর শরীরের উত্তাপ টের পেল। জ্বর বাধিয়েছে এই মেয়ে! এত্ত বড় ধাড়ি সে, অথচ নুন্যতম কমনসেন্সটুকু তার নেই। নিমেষেই ক্ষেপে গেল সে। ধমকের সুরে বলল,
– তোমার কি কখনো বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না? সারাজীবন কি বাচ্চাই থাকবা? তোমার শরীর গরম, ঠান্ডায় কাঁপতেছ। তারপরেও কী ভেবে এখানে আসছ পাতলা একটা সোয়েটার পরে? এখানে কী কাজ তোমার? তুমি জান, রাতের বেলায় বাইরে ঘুরাঘুরি করাটা একদমই পছন্দ করি না আমি। তারপরেও রাতের বেলায় বাইরে বের হইছ! তাও আবার এত দূরে! আমার কথা কি কানে ঢোকে না তোমার? নাকি তুমি পণ করে বসছ কখনোই আমার কোনো কথা কানে তুলবা না?
এই ধমকটার জন্যই অপেক্ষা করছিল পিউ। এবারে আর কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করল না। ফুঁপিয়ে উঠে জুনায়েদের বুকে মুখ গুঁজল সে। চোখের পানি মুছল জুনায়েদের শার্টে। জুনায়েদ আবারও ঝাঁঝের সুরে বলল,
– কথা বলো না কেন? কী করতেছ তুমি এইখানে? কী এমন কাজ এইখানে তোমার? কেন আসছ?
পিউ কান্নাভেজা সুরে বলল,
– আমার ফ্রেন্ডরা বিচে বনফায়ার ক্যাম্প করতে আসছে।
– এই বন্ধুবান্ধব আর ছাড়লা না তুমি!
– (নিশ্চুপ)
– ওরা আসলেই তুমি আসবা কেন? কতবার বলছি ওরা আর তুমি এক না। ওরা স্কটিশ আর তুমি বাঙ্গালী। ওরা যা করে, তোমাকে তাই করাটা মানায় না। এই সহজ কথাটা কেন বুঝতে চাও না তুমি? না বুঝার মতো একদম ছোট তো না এখনো।
– আমি আসতে চাই নাই। সুজান আমাকে জোর করে নিয়ে আসছে।
– বাহ! কী সুন্দর কথা! সুজান তোমাকে জোর করল আর তুমিও ধেই ধেই করে চলে আসলা! গায়ে জ্বর নিয়ে এই রাতের বেলায় তুমি বিচে আসছ বনফায়ার ক্যাম্প করতে! বাহ, কী আনন্দের লাইফ। আমি নাই, এই চান্সে পাখনা গজাইছে তোমার। যা খুশি তাই করে বেড়াইতেছ। কেউ কিচ্ছু বলার নাই, কেউ বাধা দেবার নাই…
– না না, আমি… আমি তো তোমার সাথে দেখা করতে আসছি।
– মিথ্যা কথা বলবা না। তুমি জান, আমি মিথ্যা কথা একদমই সহ্য করতে পারি না।
– মিথ্যা বলি নাই তো। একদম সত্যি। তোমার সাথেই দেখা করতে আসছি।
– আমি যে এখানে আছি, সেটা তো তোমার জানার কথা না।
– কিন্তু আমি জানি। আমাকে ক্রিস বলছে।
– ক্রিস কে? তোমার বয়ফ্রেন্ড? আমি নাই এই চান্সে…
– সু-সুজানের বয়ফ্রেন্ড।
– তার সাথে তোমার কী রিলেশন?
– কোনো রিলেশন নাই। আমি তোমাকে খুঁজতেছিলাম। ক্রিস আমাকে হেল্প করছে।
– তাই? কীভাবে হেল্প করল? ক্রিস কীভাবে জানল আমার হোয়্যারঅ্যাবাউটস? সে তো আমাকে চেনে না। কোনোদিন দেখাও হয় নাই।
– আমি ওকে একটা ছবি দিছিলাম তোমার।
– ছবি দেখেই জেনে গেছে আমি এখানে আছি?
– না না, ক্রিসের এক আংকেল আছেন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। উনাকে তোমার ছবি…
– তুমি আমার পেছনে স্পাইং করছ?
– না মানে…
– একটা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হায়ার করতে কত পাউন্ড লাগে, জান তুমি?
– সুজান বলছিল, উনার ফি নাকি ছয়শ পাউন্ড।
– ছয়শ পাউন্ড! তুমি আমার সমস্ত টাকা উড়াইতেছ বসে বসে!
– না না, তুমি আমার কথা শুনো। ক্রিসের আংকেলের তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া লাগে। কিন্তু আমি কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই নাই। ক্রিসের পরিচিত বলে আমার কাজটা আনঅফিশিয়ালি করে দিছে। বলছে, তাকে দুইশ পাউন্ড দিলেই চলবে।
– দুইশ পাউন্ড কি কম মনে হইতেছে তোমার কাছে? দুইশ পাউন্ড মানে কত টাকা বাংলাদেশে, তুমি জান?
– ইয়ে, বিশ হাজারের মতো।
– বিশ হাজার টাকায় আমার চাচার সংসার খরচ চলছে একসময়, তুমি জান? এমনকি এখনো বাংলাদেশে বিশ হাজার টাকায় পুরো মাস চলে যায়, এমন ফ্যামিলি খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে।
– কিন্তু এছাড়া আর কেমনে তোমাকে খুঁজে পাইতাম? এতদিন ধরে খুঁজতেছি। ফেসবুক, ইমেইল, মোবাইল কোনোভাবেই তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি নাই।
– সেজন্য তুমি আমার সেভিংসে হাত দিবা?
– না না, সেভিংস থেকে একটা পাউন্ডও তুলি নাই। এমনকি তোমার স্যালারি থেকে যেটা আসে, সেটাও ওভাবেই পড়ে আছে অ্যাকাউন্টে। আমার তো অত খরচ লাগে না। আমি একলা মানুষ। সরকারের বেনিফিট থেকেও জমছে অনেকটা। দুইশ পাউন্ড ওখান থেকেই দিতে চাইছিলাম।
– সেমিস্টার ফি পাঠাইছিলাম, সেটা জমা দিছ?
– না ওটাও অ্যাকাউন্টে আছে।
– কেন?
– আমি আর পড়াশুনা করব না।
জুনায়েদ হতবাক সুরে বলল,
– পড়াশুনা করবা না মানে কী?
– মানে পড়াশুনা ছেড়ে দিছি। ক্লাসে যাই না আর।
– মাথা খারাপ হইছে তোমার? দুইটা বছর কষ্ট করে তোমাকে পড়াইলাম আমি। আর ফাইনাল ইয়ারে এসে তোমার মাথায় শয়তান ঢুকছে! তুমি এখন পড়াশুনা ছেড়ে দিছ! থাপ্পড় খাইতে মন চাইছে?
– না না, আমি অবশ্যই পড়াশুনা করব। ফাইনাল ইয়ার কমপ্লিট করব। কিন্তু তার আগে আমার একটা কন্ডিশন আছে।
– কীসের কন্ডিশন?
– আমি এখন থেকে পড়াশুনার পাশাপাশি সংসার সমস্ত কাজকর্ম করব। তোমার সব কথা শুনব। তুমি যেভাবে বলবা, সেভাবে চলব।
– কিন্তু তুমি তো আমার কথামতো চলতেছ না। তোমাকে আমি বলছিলাম, রাতের বেলায় বাইরে ঘুরঘুর করা আমার পছন্দ না।
– আমি সারাদিনেও বাসা থেকে বের হই না। আর রাতের বেলায় তো দুরে থাক। আমার তো ভয় লাগে রাতের বেলায়। বাইরে ঘুরঘুর করব কেন? কিন্তু আজকে আসছি তোমার সাথে দেখা করতে। তুমি এখন আমার সাথে যাবা।
– কোথায়?
– বাসায়… মানে এডিনবরায়।
– কেন?
– আমি… আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। সত্যি।
তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল জুনায়েদের মুখে। হাসিটা ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখে সে বলল,
– তুমি আমাকে ভালোবাস?
– হ্যাঁ, খুব ভালোবাসি। প্লিজ, চলো আমার সাথে। আমি সত্যিই তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।
কিছুক্ষণ পিউয়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জুনায়েদ। তারপর ওর কপালে আলতো চুমু দিয়ে বলল,
– আমি যাব না, পিউ। কোথাও হুট করে মুভ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। অনেক কষ্টে এই জবটা পাইছি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর আমার একেকটা দিন কীভাবে কাটছে তুমি জান না। আমার থাকার জায়গা ছিল না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াইছি।পাগলের মতো জব খুঁজছি। এখন এখানে নতুন করে লাইফ শুরু করছি। এখানেই ভালো আছি। তাছাড়া আর মাত্র এক মাস পর আমাদের ডিভোর্স…
– তুমি আমাকে এখন আর ভালোবাস না, তাই না?
– ভালোবাসার কথা আসতেছে কেন? তুমি আমার সাথে থাকতে চাও না বলেই তো ডিভোর্সের অ্যাপ্লিকেশন করছ।
– আমি তখন বুঝতে পারি নাই। আমাকে সোশ্যাল ওয়ার্কার কীসব বলছে। আমি… তখন কী করা উচিত আমি বুঝতে পারি নাই। অ্যাম সরি। তুমি আজকে চলো আমার সাথে। কালকে সকালেই লইয়ারের অফিসে গিয়ে ডিভোর্স অ্যাপ্লিকেশন উইথড্র করে ফেলব।
– উহু, তুমি চলে যাও। এক মাস পর ডিভোর্স হয়ে গেলে ভালো হয়। পড়াশুনাটা কমপ্লিট করো। তারপর নতুন কারো সাথে নতুনভাবে লাইফ শুরু করো।
– কেন? ওই মেয়েটা কি আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে তোমাকে?
– কোন মেয়েটা?
– যার সাথে এক বাসায় থাক তুমি। একসাথে ঘুরাঘুরি করো। উইকেন্ডে একসাথে কাজ করো।
– তোমাকে কে বলল এইসব কথা?
– কে বলছে সেটা তোমার না জানলেও চলবে। আগে তুমি বল, ওই মেয়েটা তোমাকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে কীনা। ওকে পাইছ বলেই আমাকে ভুলে গেছ তুমি। একটাবার আমাকে ফোন করো নাই। আমি কেমন আছি সেইটা জানার দরকার মনে করো নাই। ওকে নিয়ে ভালোই ফুর্তিতে আছ।
– এই দেশে ফুর্তি এত সস্তা না। ফুর্তি করতে পাউন্ড লাগে। সেই পাউন্ড পাব কই? আমার যা কিছু আছে, সবই তো তোমার দখলে। জব করি, স্যালারির অর্ধেকটা পাও তুমি। বাকি অর্ধেক থেকে আমি নিজে চলি। আমাকে তো আর সরকার বেনিফিট দেয় না। নিজের খরচ চালাই, তোমার সেমিস্টার ফি দেই। বাড়ির লোন শোধ করতেছি। বাসায় তো খুব আরামে থাক। বাতাস লাগে না গায়ে। গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি টপআপ করে কে? ইন্টারনেট বিল কে দেয়? আর কাউন্সিল ট্যাক্স? স্কাইয়ের বিল? কোনো খবর রাখ তুমি এসবের? এগুলা সব আমার পকেট থেকে যাইতেছে। ওভারটাইম করি অফিসে। উইকেন্ডে পার্টটাইম জব করি। তারপরও একটা পেনি সেভ করতে পারি না। সব ঢালতেছি তোমার পেছনে।এরপর আবার ফুর্তি করার পাউন্ড পাব কই?
– ফুর্তি করার পাউন্ড না থাকলে প্রতিদিন ডেট করো কেমনে? অফিস শেষ করে ওই মেয়ের সাথে এদিক-সেদিক ঘুরঘুর করো। সুপার মার্কেট থেকে শপিং করো একসাথে। উইকেন্ডে একসাথে কাজ করো। পকেট খালি থাকলেও এইসব ভালোভাবেই চালাইতেছ। ওই মেয়ের সাথে আবার এক বাসায় থাক তুমি! এরপরেও গলাবাজি করতেছ। লজ্জ্বা করে না তোমার? ঘরে বউ রেখে আরেকজনের সাথে প্রেম করতেছ!
– তোমার লজ্জ্বা করে না?
– আমি কারো সাথে প্রেম করি না।
– আমিও করি না।
– অবশ্যই করো। না করলে কি ক্রিস বেহুদাই মিথ্যা কথা বলছে তোমার নামে?
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল জুনায়েদ। নিজেকে সামলে নিয়ে গলার স্বরে পালটে বলল,
– আমি প্রেম করলেই বা কী? তোমার এত জ্বলে কেন? সেপারেশনে আছি এখন। চাইলে প্রেম করতেই পারি। আর এক মাস পর আমাদের ডিভোর্স…
– হ্যাঁ সেই আনন্দেই তো আছ। ডিভোর্সের পর আমার কাছ থেকে ফ্রি হয়ে যাবা। ওই মেয়েকে নিয়ে নতুন লাইফ শুরু করবা।
– তুমিও তো ফ্রি হয়ে যাবা। তোমাকে আর কেউ বকবে না। কোনো বাধা-নিষেধ থাকবে না তোমার লাইফে। যা ইচ্ছা তাই করতে পারবা।
পিউয়ের চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে গেল।সে জুনায়েদের বুকে মুখ গুঁজে চাপা স্বরে বলল,
– চুপ, একদম চুপ।
– তবে আর যাই করো, পড়াশুনাটা চালায়ে যাও। লাইফে সার্টিফিকেটের অনেক দাম। এর জোরেই তুমি সেলফ-ডিপেন্ডেন্ট হতে পারবা। জব করতে পারবা। আর সেভিংস তো আছেই তোমার অ্যাকাউন্টে। বাড়িটাও তোমারই থাকবে। গাড়িটা সেল করে দিতে পার। নয়তো ড্রাইভিংটা শিখে এরপর তুমি ইউজ করতে পার।
– তুমি না থাকলে এই টাকাপয়সা, পড়াশুনা দিয়ে আমি কী করব? আমি শুধু তোমাকে চাই।
জুনায়েদ শান্ত সুরে বলল,
– এই ধরনের ডায়লগ দেয়া বন্ধ করো। বাংলাদেশে থাকতেও তুমি এই কথাই বলছিলা।
– হ্যাঁ বলছিলাম। এখন আবার বলতেছি। প্লিজ, তুমি চলো আমার সাথে। ব্রেকআপ করো ওই মেয়েটার সাথে। আই প্রমিজ, আমি একদম তোমার মনমতো চলব, যেমনে তুমি বলবা। সংসারের সব কাজ করব। তোমাকে খুব ভালোবাসব।
– এত সহজ?
– আমি তো এখন সবই করি বাসায়। সব একলাই করতে হয় আমার। তুমি ফিরলেও করব। হেরফের হবে না কোনো। প্লিজ, আমার লাইফে তুমি ছাড়া আর কাউকে দরকার নাই। নো ফ্রেন্ড, নো বডি। কেউ আমাকে ফোন করবে না। আমিও মোবাইল ইউজ করব না। ল্যান্ডনাম্বার পাল্টে ফেলব। তুমি যদি চাও আমি পড়াশুনা কন্টিনিউ করি, তাহলে ক্যাম্পাসও চেঞ্জ করব। নতুন ক্যাম্পাসে কোনো ফ্রেন্ডশিপ পাতাব না। প্লিজ… প্লিজ… তুমি যা বলবা, তাই হবে। তোমার কথার বাইরে এক পাও দিব না আমি। প্লিজ… আমাকে এভাবে একা করে দিও না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। প্লিজ…
অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে পিউ। আশপাশে কয়েকজন অবাক ভঙ্গিতে লক্ষ করছে ওদের। জুনায়েদ ওকে থামাতে চেষ্টা করল প্রথমে। না পারতে ওর ঠোঁটজোড়া দখল করে নিল।
কিছুক্ষণ পর বলল,
– আমার পক্ষে মুভ করা সম্ভব না, পিউ। তুমি একাই চলে যাও।
– কেন? তুমি কি ওর সাথে খুব বেশি ইনভলভড হয়ে গেছ? ওই মেয়েটাকে ছাড়া চলবে না তোমার?
– কার কথা বলতেছ?
– তোমার গার্লফ্রেন্ড।
– মার্গারেট ওর নাম। আমার গার্লফ্রেন্ড না সে।
– তাইলে? এই মেয়ের সাথে তোমার এত খাতির কীসের?
– আমাদের নেইবারের কাজিন সে। এখানে থাকে। একদিন দেখা হইছিল। তারপর…
– অ্যান্ডির কাজিন?
– না, সামনের দিকে দুইটা বাড়ি পরে। তোমার মনে আছে, গতবার উইন্টারে একটা ছেলে আমার গাড়ি জাম্প স্টার্ট করে দিয়েছিল?
– হ্যাঁ, উইলসন নাম ওর।
– উইলসনের কাজিন।
– তার সাথে তোমার এত খাতির কীসের? তার সাথে এক বাসায় থাক কেন তুমি? অফিসের পর তার সাথে ঘুরে বেড়াও। একসাথে শপিং করো। কেন? এত ঘুরাঘুরি করার কী আছে তার সাথে?
– সে আমাকে অনেক বড় একটা ফেভার করছে, পিউ। আমাকে একটা বাসা খুঁজে দিছে, যেখানে কম ভাড়ায় থাকা যাবে। উইকেন্ডে যেখানে জব করি, সেখানে ওর মাধ্যমেই কাজ পাইছি। আর এটা একটা ছোট টাউন। এখানে যারা থাকে, তাদের সাথে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয় আমার। মার্গারেটের সাথেও দেখা হয়। শি ইজ লাইক অ্যা ফ্রেন্ড। তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরাঘুরি করো, বনফায়ার সেলিব্রেশন করতে এডিনবরা থেকে এয়ার পর্যন্ত চলে আসতে পারছ। আর আমি মার্গারেটের সাথে ঘুরতে গেলে দোষ?
– শুধু ঘুরলে তো দোষ হইত না। তুমি ওকে সাথে নিয়ে শপিং করো।
– কারণ, ওর গাড়ি আছে। দুই হাত ভর্তি বাজার নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় যাওয়াটা অনেক টাফ। এইখানে রাতের বেলায় প্রচুর ঠান্ডা পড়ে। বছরে তিনশ পয়ষট্টি দিনই এখানকার মানুষ ওভারকোট পরে চলাফেরা করে। মার্গারেটের গাড়ি আছে। ও আমাকে বাজার-সদাইশুদ্ধ ড্রপ করে।
– তাই বলে একসাথে থাকতে হবে কেন?
– তোমার ফ্রেন্ডের বয়ফ্রেন্ডের আংকেল কী আমার বাসার ভেতরে ঢুকে দেখে আসছে আমি মার্গারেটের সাথে রুম শেয়ার করি?
– এক বাসায় থাক এইটা বলছে। কেন থাক? আর কোনো বাসা নাই? মার্গারেটের সাথে এক বাসায় থাকবা কেন তুমি?
জুনায়েদ হেসে বলল,
– আর ইউ জেলাস?
– আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
– এক বাসায় থাকি না আমরা। আমি যেখানে থাকি, সেটা মার্গারেটের শ্বশুরের বাসা। ভদ্রলোকের ওয়াইফ মারা গেছেন। উনি একা থাকেন বলে একজন পেয়িং গেস্ট বা সাবলেট ট্যানেন্ট খুঁজতেছিলেন। আমি ভাড়া নিছি। আর মার্গারেট প্রায়ই ওর শ্বশুরের বাসায় আসে। শ্বশুরের তদারকি করতে।
– ওই মার্গারেট কি ম্যারিড?
– ইয়েস, উইথ ফোর কিডস! হাজব্যান্ডও আছে তার। ডাবলিনে জব করে।
এতক্ষণ জোর গলায় কথা বলছিল পিউ। এবারে মিইয়ে গেল কিছুটা। নরম সুরে বলল,
– ওহ! আমি তো ভাবছিলাম তোমার গার্লফ্রেন্ড।
– হ্যাঁ তুমি তো ওরকমই ভাববা। তুমি নিজে যেরকম…
– আমি কীরকম? থমাসের সাথে কোনো রিলেশন নাই আমার। অনলি ফ্রেন্ডশিপ।
– ফ্রেন্ডশিপেরও একটা লিমিট থাকে, পিউ! তোমার আর থমাসের ভাবসাব দেখে মনে হয় না তোমাদের মধ্যে শুধু ফ্রেন্ডশিপ।
– কী বলতে চাও তুমি? আমি থমাসের সাথে প্রেম করি?
– আমার তো সেটাই মনে হয়। আমি তোমার মোবাইলের কললিস্ট চেক করলেই দেখতাম, দিনে-রাতে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বার ঘন্টাই থমাস তোমাকে কল দেয়। শুধু ফ্রেন্ড হইলে কি এতবার কল দিত? তুমি বাহানা দেখাও, স্টাডির ব্যাপারে কল দেয়। আমার প্রশ্ন হলো, স্টাডির ব্যাপারে শুধুমাত্র তোমাকেই কেন কল দিতে হবে? আর কেউ নাই তোমাদের ক্লাসে?
– আছে।
– তাহলে তাদেরকে কল দেয় না কেন?
– কারণ তারা সবাই ওর ফ্রেন্ড না। আমার সাথে ভালো ফ্রেন্ডশিপ…
– তোমার সাথে ভালো ফ্রেন্ডশিপ বলে তোমার কনজুগাল লাইফেও সে ইন্টারফেয়ার করবে? সে জানে তুমি ম্যারিড। তুমি তোমার হাজব্যান্ডের সাথে থাক। সে এটাও জানে, বিকেল পাঁচটার পর আমি বাসায় থাকি। তারপরেও সে কল দেয় ওই সময়ে। একবার ভাবে না, তুমি এই সময়ে তোমার হাজব্যান্ডের সাথে বিজি থাকতে পার। আমি প্রতিটা দিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি, তুমি ফোনে ক্যাচর-ক্যাচর করে বেড়াচ্ছ। কখনো সুজান, কখনো ক্যাথি, কখনো থমাস। তোমার ফ্রেন্ডদের মাথায় এতটুকু কমনসেন্স নাই যে একটা ম্যারিড মেয়ে কখনোই তাদের মতো সিঙ্গেল হয় না। তার আলাদা একটা লাইফ আছে। আলাদা একটা সময় আছে। একদিন তো থমাস তোমাকে রাত দশটায়ও কল দিয়েছে।
– আর্জেন্ট কথা ছিল বলেই…
– স্টাডি আমিও করছি, পিউ। তোমার মতো এরকম একটা স্টাডি লাইফ একসময় আমারও ছিল। তখন আমি তোমার মতো ম্যারিড ছিলাম না। সিঙ্গেল লাইফ লিড করতাম। তবু আমার কোনো ফ্রেন্ড আমাকে রাত দশটায় কল দিত না। ক্যাম্পাস থেকে বের হবার পর তাদের সাথে কোনো কন্টাক্ট করতাম না আমি।
– কারণ তুমি তখন জব করতা। ক্লাসের পর বাকি সময়টা জবে থাকতা।
– জব তোমারও আছে। সংসার করাটা কি কোনো জব না? পার্থক্য এখানেই যে, আমার জবটা বাইরে আর তোমার জবটা ঘরে। আমাকে আমার কাজের জন্য বসের কাছে এনসার করতে হয়, একটু উনিশ-বিশ হইলে বসের কথা শুনতে হয়। কিন্তু তোমার ওসব ঝামেলা নাই। তুমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পার। কিন্তু সেটা করো না। বেশি আরাম পেয়ে তোমার স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে। তাই সংসারের প্রতি কোনো মনোযোগ নাই। তুমি সারাদিন তোমার ফ্রেন্ডদের নিয়ে পড়ে থাক।
– (নিশ্চুপ)
– থমাসের প্রতি তোমার কোনো ফিলিংস না থাকলেও থমাসের আছে। খুব ভালোভাবেই আছে। এবং তুমি সেটা জেনেবুঝেও ওকে লাই দিচ্ছ, এখানেই আমার অবজেকশন।
– আমি তো শুধু নোটস আর লেকচারগুলো বুঝে নেবার জন্য…
– পিউ, মানুষের লাইফে একটা রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে আরেকটা রাস্তা খুলে যায়। কোনোকিছু কারো আটকে থাকে না। এই যেমন, তুমি কখনো একা থাক নাই। আগে বাবা-মায়ের সাথে থাকছ। এরপর আমার সাথে ছিলা। একা থাকার অভ্যাস তোমার নাই। কিন্তু তুমি গত এগার মাস ধরে একা ছিলা। কিছু কী আটকে গেছে আমার জন্য? আটকায় নাই। আমি সবকিছু ফেলে এখানে চলে আসছি একদম খালি হাতে। তবু আমার দিন আটকে যায় নাই। আমি একটা জব হারাইছি, এরপর আরেকটা পাইছি। এক বাসা থেকে অন্য বাসায় মুভ করছি। এক শহর থেকে অন্য শহরে… হ্যাঁ, কিছুদিন কষ্ট হইছে। কিন্তু আটকে থাকে নাই। সেরকম থমাসের সাথে ফ্রেন্ডশিপ না থাকলেও তোমার স্টাডি আটকায় থাকবে না।
পিউয়ের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগছে। আবার জুনায়েদের ওভারকোটের ভেতর থেকে বের হতেও মন সায় দিচ্ছে না। এই সাগর পাড়ের ঠান্ডা যে কতটা মারাত্মক, সেটা কিছুক্ষণ আগেই টের পেয়েছে। মুখটা ওভারকোটে ঢাকা নেই বলে সমস্ত ঠান্ডা যেন মুখের উপর আছড়ে পড়তে চাচ্ছে। মুখের চামড়া অবশ হয়ে যাচ্ছে। তাই সে জুনায়েদের বুকে মুখ গুঁজল। ফিসফিস করে বলল,
– অ্যাম স্যরি। এখন থেকে থমাসের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখব না। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমার মাথায় কাচের বোতল দিয়ে মারতে চাই নাই। হুট করে লেগে গেছে। আমি তখন ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমি… অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি।
– ইটস ওকে।
– এখন থেকে তুমি যেমনে বলবা, ওভাবেই চলব। তুমি চলো।
– আমি সত্যিই মুভ করতে পারব না, পিউ। বুঝতে চেষ্টা করো। এখানে মার্গারেট ইনভলভড না কোনোভাবে। প্রবলেমটা আমার নিজের। আমার চাকরি এখানে। এই মুহূর্তে চাকরি ছাড়া সম্ভব না। আর এত হুট করে বাসাও ছাড়তে পারব না। বাসা ছাড়ার কমসে কম দুই সপ্তাহ আগে মার্গারেটের শ্বশুরকে জানাতে হবে। আমার সবকিছু এখানে।
– এখানে তো আমি নাই।
– এগার মাস পার হয়ে গেছে, পিউ। তুমি এতদিন আমাকে ছাড়া থাকতে পারছ। আর এক মাস বাকি। আমার মনে হয় ডিভোর্সটা হয়ে গেলেই ভালো।
– না। আমি মানব না।
– আমার কথা শোন। তুমি এখন আর ছোট নাই। বড় হইছ, বুঝদার হইছ। তুমি এখন বুঝ, আমাদের মধ্যে প্রবলেমটা আসলে কোথায়। আমরা অ্যাডজাস্ট করে চলতে পারতেছি না। আমাদের বনিবনা হইতেছে না। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত মারামারির পর্যায়ে চলে গেছে। এভাবে একসাথে চলা যায় না। একদিন দেখবা কোনো একটা অঘটন ঘটে গেছে। হয় তুমি আমাকে মেরে ফেলবা, নয়তো আমি তোমাকে। একজনকে মেরে অন্যজন জেলের মধ্যে পঁচে মরব। তার থেকে ভালো হয়, আমরা আলাদা থাকি। দূরে থাকি, নিজেদের মতো করে ভালো থাকি। তুমি চাইলে ডিভোর্সের পরেও আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পার। তোমার যে কোনো প্রবলেম বা বিপদ-আপদে আমাকে ডাকলেই আমি আসব।
– না…
– চট করে “না“ বলে দিও না। একটু ভাব। আমার মনে হয় এটাই আমাদের জন্য পারফেক্ট সলিউশন।
– আমি তোমাকে ছাড়া থাকতেই পারব না।
– এটা তোমার ভুল ধারণা। তুমি অলরেডি আমাকে ছাড়াই এগার মাস ছিলা। প্লিজ, ছেলেমানুষি কইরো না। তুমি এখন আর পনের-ষোল বছরের পিচ্চি মেয়ে না। বাংলাদেশ থেকে আসার আগে তোমার আমি এটাই বুঝাইতে চাইছিলাম যে আমরা চাইলেও একসাথে থাকতে পারব না। আমাদের মধ্যে অনেক বেশি পার্থক্য। কিন্তু তুমি তখন বুঝ নাই। জিদ করছ। জিদ করেই এখানেই আসছ আমার সাথে। এখন অন্তত আগের মতো ওরকম জিদ কইরো না। ঠান্ডা মাথায় একবার ভাব। ধরো আমি মরে গেলাম। তখন তো তোমাকে একাই থাকতে হবে। তখন আমাকে কোথায় পাবা?
পিউ আতঙ্কিত সুরে বলল,
– মরে গেলাম মানে কী? কেন মরবা তুমি? কী হইছে তোমার?
– আমার কিছু হয় নাই। জাস্ট কথার কথা বললাম। হায়াত-মউতের তো ঠিক নাই কারো।
– প্লিজ, এরকম কথা বইলো না। আমার ভয় লাগে। তুমি মরে গেলে আমি তোমার কবরের পাশে বসে থাকব। তাও একলা থাকব না। আমার খুব ভয় লাগে।
– কবরস্থানে আরো বেশি ভয় লাগবে।
– তুমি মরবাই না। আমি তোমাকে মরতে দিবই না। তোমার কিছু হইলেই আমি নাইন নাইন নাইন কল করব। অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে।
– পিউ, আমার কথা শুনো।
পিউ অভিমানী সুরে বলল,
– শুনব না। তুমি… তুমি এখন অন্য কাউকে নিয়ে লাইফ শুরু করতে চাও। নিশ্চয়ই তোমার কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে। নিশ্চয়ই অন্য কাউকে পছন্দ হইছে। মার্গারেট না হইলেও অন্য কেউ… নাইলে ডিভোর্সের জন্য এত উতলা হইছ কেন তুমি?
– আচ্ছা ধরে নাও, আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। এই সময়ে আমার একটা গার্লফ্রেন্ড থাকলে কি সেটা খুব অন্যায় হবে? তোমারও কাউকে ভালো লাগতে পারে। আজকে তুমি সিঙ্গেল। কালকে বয়ফ্রেন্ড জুটে যাইতে পারে। হু নোজ… এই দেশে তো এটাই নরমাল।
– সত্যিই কি গার্লফ্রেন্ড আছে তোমার? সত্যি করে বলো।
– পিউ…
– তুমি আমাকে ভুলে যাইতে পারবা? আমার জন্য একটুও কষ্ট লাগবে না তোমার? আমার কথা কখনো মনে পড়বে না?
– তোমাকে সারাজীবন মনে রাখব আমি।
– আমাকে সারাজীবন মনে রাখতে পারবা। অথচ আমাকে তোমার লাইফে রাখতে পারবা না?
– তোমার ভালোর জন্যই বলতেছি।
– চাই না এইরকম ভালো। আমি সুইসাইড করব। তুমি আমার সাথে না গেলে আমি মরব।
– আবারও ফালতু কথা বলতেছ!
– হ্যাঁ বলতেছি। যা বলতেছি, তাই করব। আগেরবার তো বাংলাদেশে থাকতে টের পেয়ে গেছিলা। হাসপাতালও তোমার বাসার কাছে ছিল। এখন তাও পারবা না। এখন আমি একলা বাসায় থাকি। তোমার এখান থেকে অনেক দূরে। আমি…
কথা বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে পিউ। চোখ ভরে গিয়েছে নোনা পানিতে। ওর মুখ চেপে ধরল জুনায়েদ। কড়া সুরে বলল,
– চুপ! একদম চুপ। আর একবার যদি এইসব কথা বলছ, তাইলে কিন্তু তোমার কপালে খারাবি আছে। তোমাকে আমি এমন মাইর দিব…
– একশবার বলব। আমাকে মারলেও আমি বলতেই থাকব। যতক্ষণ না আমার সাথে যাইতেছ, ততক্ষণ বলতেই থাকব।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ ভঙ্গিতে জুনায়েদ বলল,
– প্লিজ, একবার ঠান্ডা মাথায় ভাব। ভাবতে তো কোনো সমস্যা নাই। আজকে এডিনবরায় চলে যাও। কয়েকটা দিন চিন্তাভাবনা করো। তারপর যদি তোমার মনে হয় আমাকেই লাগবে…
– অতকিছু ভাবার নাই। তোমাকেই লাগবে আমার। তুমি সত্যি করে বলো তোমার কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে কীনা। নাইলে তুমি ডিভোর্সের জন্য পাগল হইছ কেন? আমার তো এখন তোমাকে সন্দেহ লাগতেছে। নিশ্চয়ই তুমি…
দুহাতে পিউয়ের গাল চেপে ধরে ওর ঠোঁটে আলতো চুমু দিল জুনায়েদ। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
– রাত হয়ে গেছে। তুমি ফিরবা কেমনে? তোমার ফ্রেন্ডরা কখন ফিরবে?
– ওরা এখানে থাকবে। ক্যাম্প করছে বিচে।
– তুমিও থাকবা ওদের সাথে?
– না, আমি বাসায় যাব।
– তাইলে চলো তোমাকে ট্রেনে তুলে দেই। লাস্ট ট্রেন আর কিছুক্ষণ পরেই ছাড়বে।
– তুমিও যাইতেছ আমার সাথে।
– পিউ, আর কতবার বলব আমার পক্ষে এখান থেকে কোথাও মুভ করা সম্ভব না? কালকে সকালে আমার অফিস আছে। তাছাড়া আমার উপর পুলিশের অর্ডারও আছে। ডিভোর্স ফাইনাল হবার আগে আমি এডিনবরায় যাইতে পারব না।
– ডিভোর্স উইথড্র করে ফেলব তো।
– আগে ডিভোর্স উইথড্র করতে হবে তোমাকে। এরপর কোর্ট থেকে আমার কাছে চিঠি আসবে। সেই চিঠি দেখায়ে আমি পুলিশের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে পারব। তারপর এখানের জব ছাড়তে হবে। বাসা ছাড়তে হবে। অনেক সময়ের ব্যাপার…
– তাইলে আমাকে নিয়ে চলো তোমার বাসায়। আমি এখন থেকে এখানেই থাকব, তোমার সাথে।
– আমার বাসায় থাকার জায়গা নাই। ব্যাচেলর বাসা, তার উপর আমার রুমটা সিঙ্গেল। সিঙ্গেল বেডে দুইজন ঘুমাব কেমনে?
– আমার জায়গা লাগবে না। আমি তোমার বুকের উপর ঘুমাব।
– আর কোনো কথা না। যা বললাম, সেটাই ফাইনাল। আমার ওভারকোটের ভেতর থেকে বের হও। এক্ষুণি স্টেশনে গিয়ে এডিনবরার ট্রেন ধরবা, বুঝলা?
ওভারকোটের বোতাম খুলে পিউকে বের করল জুনায়েদ। বলল,
– চলো, তোমাকে সুপার মার্কেট থেকে একটা ওভারকোট কিনে দেই। সেটা পরে এডিনবরায় যাও। নাইলে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাবা। প্যারাসিটামলও কিনে দিব। দুইটা প্যারাসিটামল খেয়ে রওনা দিবা। চলো, দেরি করলে ট্রেন মিস হবে।
– লাগবে না কোট। আমি চলে যাইতেছি এডিনবরায়। তুমি আসবা না স্টেশনে। আমি একাই যাইতে পারব। গুড বাই।
বলেই স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করল পিউ। জুনায়েদ কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দৌড়ে গিয়ে ওর রাস্তা আটকাল। পরনের ওভারকোট খুলে ওর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল,
– এটা পরো। বোতাম লাগাও। মাথায় হুড তুলে দাও।
– লাগবে না কোট।
– আমার সাথে জিদ দেখাবা না, পিউ। কোট লাগবে নাকি লাগবে না সেইটা আমি তোমার কাছ থেকে শুনব না। আর তুমি এখন এডিনবরায় যাইতেছ না, ওকে? সিনক্রিয়েট কইরো না পাবলিক প্লেসে।
– তাইলে কোথায় যাব?
– আমার সাথে যাবা, আমার বাসায়।
হাসি ফুটল পিউয়ের মুখে।সে দাঁত কেলিয়ে বলল,
– এই তো, লাইনে চলে আসছ।
– তোমাকে দিয়ে ঠিক নাই কোনো। একা বাসায় আবার কোন অঘটন ঘটাবা…
– গুড, আমাকে বিশ্বাস না করাই ভালো। আমি যে কোনো সময় অঘটন ঘটাইতে পারি।
– এজন্যই তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাইতেছি। এখন থেকে এখানেই থাকবা, আমার কাছে।
– ইয়েসসস, এত্তগুলা ভালোবাসি, এত্ত বেশি।
হাসল জুনায়েদ। পিউয়ের নাকে নাক ঘষে বলল,
– পাগল একটা! (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here