গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ৮
সারাদিন জুনায়েদের ফোনের অপেক্ষায় থাকল পিউ। দুপুরে সুজানদের সাথে আড্ডা জমালেও তার মন পড়ে থাকল মোবাইলের দিকে। মোবাইলটা সে এক সেকেন্ডের জন্যও হাতছাড়া করল না। একেকবার রিং বাজতেই হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ল মোবাইল ফোনের উপর। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফোনকলটাই এলো না। সে জানে, জুনায়েদ ফোন করবে না। নতুন অফিসে কাজের সময় মোবাইল ব্যবহার করা নিষেধ। তাই সে মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখে। কেউ কল করলেও রিসিভ করে না। পিউকে বলে রেখেছে, খুব বেশি জরুরী হলে যেন মেসেজ পাঠায়। তবু অপেক্ষা করল জুনায়েদের ফোনকলের। বিকেলের দিকে নিজেই ফোন করল কয়েকবার। জুনায়েদ রিসিভ করল না। “কখন ফিরবে” মেসেজটা পাঠাবার প্রায় আধঘন্টা পর ফিরতি মেসেজ এলো, “দেরি হবে। তুমি ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়ো।”
পিউ ডিনার করল না। সুজানদের বিদায় দেবার পর মোবাইল হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল বসার রুমে। দুপুরে খাওয়া হয়নি তার। কেন যেন জুনায়েদকে ফেলে খেতে ইচ্ছে করেনি। যদিও জুনায়েদ দুপুরবেলায় বাসায় খায় না। সকালে অফিসে যাবার সময় লাঞ্চ নিয়ে যায়। আজ তো লাঞ্চ নেয়নি। দুপুরে কী খেয়েছে কে জানে। একবার যদি ফোনে কথা বলত, একবার যদি বলত সে দুপুরবেলায় ঠিকমতো খেয়েছে, তাহলে পিউয়ের গলা দিয়ে খাবার অবশ্যই নামত। বন্ধুবান্ধবরা খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করেছে অনেক। সে শারীরিক অসুস্থতার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছে। লম্বা সময় ধরে না খেয়ে থাকার কারণে ক্ষিধেয় ছুঁচো নাচতে শুরু করেছে পেটে। শরীরও কাহিল লাগছে। আবার ঘুমেও চোখ ঢুলুঢুলু করছে। তবু সে জোরজবরদস্তি বসে রইল জুনায়েদের অপেক্ষায়। রাত দশটায় দেখা গেল, বসার রুমের সোফায় হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে সে। তারপর কখন ঘুমিয়ে গেল, টেরই পেল না।
গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে আবিস্কার করল দোতলার বেডরুমে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসতেই নিচতলায় খুটখাট শব্দ শুনে বুঝল, জুনায়েদ ফিরেছে। ঘুম-ঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে নিচতলায় নামল সে। জুনায়েদ মনোযোগ দিয়ে রান্নাঘর পরিস্কার করছিল। হঠাৎ পেছন ফিরতে পিউকে দেখে চমকে গেল। বলল,
– এখানে কী করো তুমি? উঠে আসছ কেন?
– তোমার জন্য ওয়েট করতে গিয়ে ঘুমায় পড়ছিলাম।
– আমার জন্য ওয়েট করতে হবে কেন? আমি তো মেসেজ দিলামই আমার লেট হবে। মেসেজ পাও নাই?
– পাইছি।
– তাহলে?
– (নিশ্চুপ)
– ডিনার করছ?
– না।
– কেন?
– (নিশ্চুপ)
– যাও, টেবিলে বস। আমি হাতের কাজটা সেরে খাবার দিতেছি টেবিলে।
পিউ বসল না। ফ্রিজ থেকে খাবারের বক্স বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করতে দিল। তারপর সালাদ বের করে কাঁটতে শুরু করল। জুনায়েদ হাতের কাজ সেরে টেবিলে চলে এলো। খাবারের বক্স খুলে প্লেটে খাবার তুলতে শুরু করল। বলল,
– লাঞ্চে কী খাইছ তোমরা?
– সুজানদের জন্য লাঞ্চবক্স অর্ডার করছিলাম সাতটা।
– কয়জন আসছিল?
– সাতজন।
– তাইলে সাতটা লাঞ্চবক্স কেন? তোমার নিজের জন্য অর্ডার করো নাই? তুমি কী খাইছ?
– আমি কিছু খাই নাই।
– কিছু খাও নাই মানে?
– খাইতে ভালো লাগতেছিল না।
– আর তোমার ফ্রেন্ডরা তোমাকে ছাড়াই খেয়ে ফেলল?
– ওদেরকে বলছিলাম ক্ষুধা লাগে নাই। খাইতে ভালো লাগতেছে না।
– ওরা মানল?
– না মানার কী আছে? আমার ক্ষুধা লাগে নাই। আমি খাই নাই। সিম্পল।
– সকালে কী খাইছ?
– কিছু না।
– সারাদিন ধরে না খেয়ে আছ!
– (নিশ্চুপ)
– ডিনার করো নাই কেন?
– তুমি বাসায় ফিরলে একসাথে খাব ভাবছিলাম।
– এটা কোনো কথা হইলো? আমি তোমাকে মেসেজ দিলাম যে আমার ফিরতে দেরি হবে। আর তুমি না খেয়েই ঘুমায় গেছ।
– একা খাইতে ইচ্ছা করতেছিল না। তুমি সারাদিন বাইরে থাক। আমার একলা ভালো লাগে না বাসায়।
– সারাদিন বাসায় থাকার কী দরকার? বাইরে ঘুরতে যাও। একলা অথবা তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে।
এও এক অষ্টমাশ্চর্য পিউয়ের কাছে। ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলা, ঘোরাফেরা করার বেলায় জুনায়েদ ছাড় দিয়েছে। বলা যায়, তাকে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা দিয়েছে। এমনকি থমাসকে নিয়েও কোনো আপত্তি নেই তার। জুনায়েদের এই উদারতাকেই বেশ ভয় পিউয়ের। বুকের ভেতরটা কামড়ে উঠল। ঠিক নেই, কিচ্ছু ঠিক নেই!
পিউ মৃদুস্বরে বলল,
– তুমি কি আমার উপর রাগ করে আছ?
– নাহ, রাগ করব কেন?
– তাহলে এমন করতেছ কেন?
জুনায়েদ অবাক হলো। বলল,
– কেমন করতেছি?
পিউ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
– তোমাকে আগে বলি নাই। আজকে থমাসও আসছিল বাসায়। অ্যালস্টার নামে আরেকটা ছেলেও আসছিল।
– থমাসকে তো আগেই চিনি। অ্যালস্টার কি তোমাদের সাথেই পড়ে?
– আমাদের ডিপার্টমেন্টে কিন্তু অন্য ব্যাচে। থমাসের নেইবার সে। ওর সাথে আসছে।
– ও!
– আমাকে আগেই বলছিল থমাস, ওকে নিয়ে আসবে। এখন একটা মানুষ ফ্রেন্ডস গেট টুগেদারে আসতে চাইছে, মানা করি কেমনে?
– মানা করার দরকার কী? তোমাদের ডিপার্টমেন্টেরই সে। বাইরের কেউ তো না।
– হ্যাঁ সেজন্যই। তুমি কি রাগ করলা?
– বারবার রাগ করার কথা বলতেছ কেন? রাগ করার মতো কি কিছু হইছে?
– না মানে, আমার ফ্রেন্ডরা বাসায় আসল। আবার ওদের জন্য লাঞ্চ কিনলাম। তুমি শুনে তো কিছুই বললা না।
– তোমার ফ্রেন্ডরা বাসায় আসছে। আসতেই পারে। আর বাসায় কেউ আসলে তাকে খাওয়াতে হয়। এটাই নিয়ম। তুমি রান্নাবান্না করতে পারবা না। তাই বাইরে থেকে কিনে আনছ। এখানে কিছু বলার কী আছে?
– আগে তো সবসময় মানা করছ ফ্রেন্ডদের সাথে মিশতে। ওদের কথা শুনলেই তুমি তেলেবেগুনে জ্বলে যাইতা। আমি ওদের সাথে কোথাও যাইতে চাইলে আমাকে যাইতে দিতা না। আর এখন…
– আগে তুমি ছোট ছিলা। তাই মানা করতাম ওদের সাথে মিশতে। এখন বড় হইছ। এখন ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতেই পার। এটা কোনো ব্যাপার না।
– এই কয়েকমাসেই বড় হয়ে গেলাম?
– এমন ভাব করতেছ জানি কখনো ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে যাও নাই। এগারো মাস যে একা থাকলা, তখন কী তোমার ফ্রেন্ডরা তোমার বাসায় আসেনাই? তখন তুমি ওদের সাথে ঘুরতে যাও নাই?
– গেছি।
– তাহলে সমস্যা কোথায়?
– তুমি তো আমাকে কিছু বলো নাই।
– আমি কী বলব?
– ক্যাম্পাস পাল্টাইতে চাইলাম। তুমি মানা করলা।
– আমি বুঝতেছি না ফাইনাল ইয়ারে তুমি ক্যাম্পাস কেন পাল্টাতে চাচ্ছ। আর একটা বছরও নাই!
– কিন্তু তুমি তো আগের থেকে অনেক পালটে গেছ। সারাদিন কাজ আর কাজ নিয়ে থাক। আমার দিকে একবার ভালোভাবে তাকাও না, ভালোভাবে কথা বলো না। এমনও দিন যায় তোমার সাথে আমার দেখাটাও হয় না। কথাও হয় না।
– এখানে পালটায় যাবার কিছু হয় নাই, পিউ। আমি আগের মতোই আছি। এই অফিসে এমনিতেই কাজের চাপ বেশি। তার উপর নতুন জয়েনিং আমার। এইসময়ে অফিসে ভালো পারফরম্যান্স না দেখাইলে জব পার্মামেন্ট হবে কেমনে?
– তাই বলে কী তুমি একটাবারও ফোন করতে পার না অফিস টাইমে? আমি সারাদিন বাসায় কেমনে থাকি, কী করি জানতে ইচ্ছা করে না তোমার?
জুনায়েদ ততক্ষণে টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে। পিউ চেয়ার ছেড়ে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরল দুই হাতে। ওর বুকে মুখ গুঁজে বলল,
– কী হইছে তোমার? কেন এমন করতেছ তুমি?
– আমার তো মনে হচ্ছে, তোমারই কিছু একটা হইছে। সমস্যাটা কী?
– তুমি আমাকে সময় দাও না। সারাদিন অফিস নিয়ে থাক। বাসায় আসো খালি ঘুমাইতে।
– বললাম তো, অফিসে কাজের চাপ বেশি। মাঝেমধ্যে ওভারটাইম করা লাগতেছে।
– অজুহাত দিবা না কাজের। সত্যিটা বলো।
– সত্যিটা কী বলব? আমি বুঝতেছি না…
– বলবা না আমাকে?
পিউকে ঠেলে সরিয়ে দিল জুনায়েদ। বলল,
– উফফ, সরো তো। আজাইরা প্যাচাল শুনার সময় নাই। খেয়েদেয়ে ঘুমাইতে হবে তাড়াতাড়ি। সকালে তাড়াতাড়ি উঠা লাগবে। আজকে দেরি হয়ে গেছিল অফিসে।
পিউয়ের চোখে নোনা পানি টলমল করছে। অনেক কষ্টে কান্নাটা আটকে রাখল সে। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বসে পড়ল চেয়ারে। জুনায়েদ ওর প্লেটে ভাত, ভাজি আর তরকারি তুলে দিল। তারপর নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর লক্ষ করল, পিউ ঠায় বসে আছে চুপচাপ। একবার জিজ্ঞেস করতে চাইল, না খাওয়ার কারণ। পরক্ষণেই মত পাল্টাল। খেয়ে-দেয়ে ঘুমুতে হবে। প্রচন্ড ক্লান্ত সে। শরীর চলছে না আর একদন্ড। তাই পিউয়ের কাছে সরে এসে নিজের প্লেট থেকেই খাইয়ে দিতে শুরু করল ওকে।
ডিনার শেষ করে দুজনই গেল দোতলায়। কোনোরকমে অফিসের জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল জুনায়েদ। পিউয়ের চোখে ঘুম নেই। সে ধীরে ধীরে জুনায়েদের কাছে গিয়ে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজল। তারপর কাঁদতে শুরু করল নিঃশব্দে। কান্নার কোনো আওয়াজ না থাকলেও ওর শরীর কাঁপছিল ফোঁপানির কারণে। তাতে জুনায়েদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে ভয়ার্ত সুরে জিজ্ঞেস করল,
– কী হইছে পিউ? এমনে কাঁদতেছ কেন?
পিউ এবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। জুনায়েদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– তুমি এরকম পাল্টায় গেছ কেন? কেন এরকম করতেছ আমার সাথে? আমি কি কোনো অন্যায় করছি? নাকি কোনো কারণে তুমি আমার উপর রাগ করে আছ?
জুনায়েদ হতাশ সুরে বলল,
– পিউ, আমি অনেক টায়ার্ড। আজকে অফিসে অনেক খাটুনি গেছে। প্লাস বাসায় এসে অনেক কাজ করছি। এখন আর চোখে দেখতেছি না কিছু। তোমার এইসব আজগুবি কথাবার্তা আমার মাথায় ঢুকতেছে না। কালকে কথা বলি? কালকে তোমার সব কথা শুনব।
– কালকে কখন? তুমি তো সেই সকালে যাবা আর…
– কালকে অফিস শেষ করে বাসায় আসি, তারপর।
– তুমি বাসায় আসো অনেক দেরি করে। ততক্ষণ তো আমি জেগে থাকতে পারি না।
– উফফফ পিউ, এত কথা শুনতে ভালো লাগতেছে না।
– কিন্তু…
– তুমি এখানে ঘুমাও। আমি পাশের রুমে গেলাম। খবরদার আমার পিছু নিবা না। আই নিড অ্যা সাউন্ড স্লিপ।
পাশের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিল জুনায়েদ। আর পিউ যেভাবে বসেছিল বিছানায়, ওভাবেই রইল চুপচাপ। চোখ উপচে নোনা পানির ঢল নেমেছে ততক্ষণে। কান্নার দমকে হেচকি উঠছে বারবার। কাঠের বাড়িতে কোনোরকম শব্দ হলে বাড়ির যে কোনো প্রান্ত থেকে শোনা যায়। তাই কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করল সে। না পারতে রুম থেকে বেরিয়ে নিচতলায় গেল। রান্নাঘরে গিয়ে বাগানের দরজা খুলল। শীত চলে গিয়ে বসন্ত চলে এসেছে। তবু বাইরে অনেক ঠান্ডা। বিশেষ করে রাতের বেলায় ঠান্ডার প্রকোপ অনেক বেশি থাকে। পিউ বসার রুম থেকে সোফার কম্বলটা নিয়ে এলো। সেটা গায়ে জড়িয়ে দোলনায় বসল। জুনায়েদ যে রুমে ঘুমিয়েছে, সেটার জানালা বাগানের দিকে। বাগান থেকে জানালাটা দেখা যায়। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল পিউ। রুমটা অন্ধকার। হয়তো বেঘোরে ঘুমুচ্ছে জুনায়েদ। টের পায়নি, সে নিচতলায় এসে বাগানের দোলনায় বসেছে। তাহলে পিছু নিয়ে চলে আসত এখানে। এই রাতের বেলায় বাগানে বসে আছে কেন, এই নিয়ে ধমকাধমকি করত। আবার হতে পারে, টের পেয়েছে কিন্তু নিচে নামেনি। এখন সে পাল্টে গেছে। তাকে দিয়ে অসম্ভব অনেক কিছুই এখন সম্ভব। পিউ খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে, জুনায়েদের এমন পাল্টে যাবার পেছনে কোনো না কোনো কারণ অবশ্যই আছে। হয়তো ডিভোর্সের ব্যাপারটা নিয়ে এখনো আপসেট। কিন্তু এই নিয়ে তো অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে। অনেকবার স্যরি বলেছে। জুনায়েদও ক্ষমা করেছে। ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে গেছে। জুনায়েদ এয়ার থেকে চলে এসেছে। সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে গেছে। তবু কেন এমন হচ্ছে? সমস্যাটা কোথায়? (চলবে)