অতঃপর সন্ধি পর্ব -২২+২৩

#অতঃপর_সন্ধি (২২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

চুলোর আচঁ কমিয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে তানজিফের অভিমুখে বিকীর্ণ করে সূঁচালো আর তীক্ষ্ণ চাহনি।

‘আমার সবটা জুড়ে তুই থাকলেও তোর কোথাও আমি নেই। হয়তো কখনো জায়গা করেও নিতে পারবো না। এতগুলো বছরেও তোর মনে জায়গা করে নিতে পারলাম না। আমার মতো অভাগা ক’জন আছে বল? তোর মাঝে এখনো মায়ান মিশে আছে। তার মায়া জড়িয়ে আছে তোকে আষ্টেপৃষ্টে। এই মায়া আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে কাটাতে পারবো না। তুই চলে যা। তুই যত আমার চোখের সামনে থাকবি তত আমার আকাঙ্ক্ষা বাড়বে।’

তানজিফের অনর্গল বলা একেকটা বাচ্য শুনে গেলো পুষ্পিতা। বহুকষ্টে সে হজম করছে এসব লজিকলেস কথাবার্তা । দাঁতে দাঁত চেপে। রাগে শাড়ি খামচে ধরলো। রাগে, ক্ষোভে গা রিঁরিঁ করছে শরীর।

‘কি লাভ বল এমন একটা সম্পর্কে বাঁধা থেকে? তার চেয়ে ভালো আলাদা হয়ে যাই। নামেমাত্র সম্পর্ক কেবল যন্ত্রণা বাড়ায়। ভালোবাসা পাওয়ার চাহিদা বাড়ায়। অনুভূতি প্রখর হয়। আমি তোদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি। তুই আমার কখনো ছিলি না পুষ্প। কবুল বলেও আমি তোকে পাইনি।’

‘তোর কেন মনে হলো মায়ান এখনো আমার সাথে জড়িয়ে আছে?’ অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলো পুষ্পিতা। চুলোর আচঁ সম্পূর্ণ বাড়িয়ে নিমেষহীন ফুটন্ত দুধের দিকে চেয়ে রইলো।

‘মায়ানের দেওয়া উপহার পেয়ে তোর চোখেমুখে আমি যেই হাহাকার দেখেছি তাই সব প্রমাণ করে। তুই মায়ানকে বিয়ে করে নে। আমি মায়ানকে বলবো যে আমাদের মাঝে কোনোরকম স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ছিলো না। সবটাই বন্ধুত্ব আর অভিনয় ছিলো। আমাদের মনের দূরত্ব কমেনি কোনোকালেই।’

দুধ উতলে চুলো নিভে গেলো। দুধের পোড়া গন্ধ নাকে আসলো তীব্রভাবে। পুষ্পিতা ঠাস করে চুলো বন্ধ করলো। দাঁতে দাঁত পিষল।

‘বাহ্! বেশ ভালো সিদ্ধান্ত। তা কবে আমাকে মায়ানের হাতে তুলে দিবি? এমন একটা সুযোগের আশায় তো ছিলাম আমি। যেন সাপও ম’রে আর লাঠিও না ভাঙে।’

কান্না দলা পাকিয়ে গেলো গলায়। নিজের দূর্বলতা দেখাতে চায় না তানজিফ। পুষ্পিতা কত অবলীলায় বলে দিলো, এই সুযোগের আশায় ছিল। ঘনঘন পলক ফেলে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা চালায় সে। সফলও হলো।

‘তোর আর আমার বিচ্ছেদ হয়ে গেলেই।’

সহ্য আর ধৈর্য্যের মাত্রা অতিক্রম করলো পুষ্পিতা। এসব গা জ্বালানো কথা আর নিতে পারলো না সে।ঠাস করে পায়েসের হাড়ি উল্টে ফেলে দিলো মেঝেতে। ছিটকে পায়ে এসেও পড়লো পুষ্পিতার। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো। মেজাজের উত্তাপের কাছে এই উত্তাপ কিছুই না।

এহেম কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে গেলো তানজিফ। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো পুষ্পিতার মুখেপানে। পুষ্পিতা ধুপধাপ পা ফেলে তানজিফের মুখোমুখি দাঁড়াল।

‘এগুলো পরিষ্কার করে তারপর রুমে আসবি।’

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবারও ফিরে এলো।

‘ওহ্ ধন্যবাদ, আমার এতো বড় উপকার করার জন্য। আপনার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।’

গটগটিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হতেই হন্তদন্ত হয়ে এলেন সুমনা এহমাদ। আতঙ্কিত গলায়।

‘ পায়ে ফেলে দিয়েছিস পায়েস? আমি আগেই বলেছি দরকার নেই আমি রান্না করবো। শুনলি না আমার কথা। তা শুনবি কেন? আমি কে?’

পুষ্পিতাকে ড্রয়িং রুমে আর তানজিফকে রান্নাঘর দোরগোড়ায় দেখে দ্রুত কদমে সেদিক গেলেন।

‘নিশ্চয়ই তুই ফেলেছিস? মেয়েটা কত শখ করে বলেছিলো পায়েস রান্না করবে। পায়ে পড়েছে?’

‘কারো কিছু হয়নি মামনি। আসলে আমার ভাগ্য খারাপ। এগুলো তোমার ছেলে পরিষ্কার। তুমি হাত লাগাবে তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।’ থমথমে মুখে কথা গুলো বলে রুমে চলে গেলো।

সুমনা এহমাদ বুঝলেন দু’জনের মনমালিন্য হয়েছে। কৌতুহল মনে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলেন না। শ্বাশুড়ি হয়ে স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যপারে নাক গলানো দৃষ্টি কটু। তপ্ত শ্বাস ফেলেন। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন। আধ সিদ্ধ চাল আর দুধে মাখামাখি মেঝে।

পুষ্পিতার স্বাভাবিক এর মাঝে অস্বাভাবিক আচরণ দেখে তাজ্জব বনে গেলো তানজিফ। স্তব্ধ, বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলো পুষ্পিতার যাওয়ার পানে। পুষ্পিতা এমন আচরণ কি হিসেবে গ্রহণ করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ঠান্ডা মাথায় নিজের রাগ জাহির করে গেলো মেয়েটা। পুষ্পিতার এই জেদ কি সুখকর কি কিছু?’

____________________

লাগেজ টানতে টানতে নিচে এলো পুষ্পিতা। কঠিন, গম্ভীর মুখ। ড্রয়িংরুমের মাঝটায় এসে দাঁড়ায়। রান্নাঘর থেকে মাত্রই বের হলো তানজিফ। লাগেজ সমেত পুষ্পিতা কে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।

পুষ্পিতা গলা উঁচিয়ে ডাকল সুমনা এহমাদকে। ব্যস্ত পায়ে কক্ষ হতে বেরিয়ে এলেন তিনি। পুষ্পিতার মতিগতি ভালো ঠেকল না উনার কাছে। বিশাল আকারের লাগেজ নজরে আসতেই তিনি ব্যতিব্যস্ত গলায় প্রশ্ন করেন,

‘এই রাত্তিরে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’

তানজিফের দিকে কঠিন অক্ষপাত করে পুষ্পিতা। দাঁতে দাঁত পিষে রুক্ষ, খর্খরে স্বরে বলে,

‘বাবা বাড়ি। সারাজীবনের জন্য।’

‘কিসব অলক্ষুণে কথাবার্তা। গেলে বাড়াতে যাবি। সারাজীবনের জন্য যাবি কেন?’

‘তোমার ছেলে যেমন আমাকে পাগল পাগল হয়ে সবার মাথা নষ্ট করে বিয়ে করেছে তেমনি বছর ঘুরতেই সব ভালোবাসা উবে গিয়েছে। এখন আর আমাকে ভালো লাগে না। তাই বলেছে আমি যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।’

ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল সুমনা এহমাদের।

‘পুষ্পিতা ঠিক বলছে তানজিফ?’

কথা বলার জন্য একটু সুযোগ পেতেই হাত ছাড়া করতে চাইলো না তানজিফ।

‘আমি তো এজন্য বলিনি।’

‘তুই ওকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিস কিনা?’

মাথা নুইয়ে ফেলে তানজিফ। তানজিফকে কয়েকটা কঠিন কথা বলতে গিয়েও বললেন না তিনি। পুষ্পিতার কাছে এগিয়ে গেলেন। পুষ্পিতার দু’টো মুঠোবন্দি করে আদুরে স্বরে বললেন,

‘ও বলেছে বলে চলে যেতে হবে নাকি? বাড়িটা ওর? ও বানিয়েছে? এটা তোর বাড়ি। তুই থাকবি না কে থাকবে?’

‘যার হাত ধরে এবাড়িতে এসেছি সে বলেছে চলে যাওয়ার কথা। হাজারটা অজুহাত দেখালেও আমি থাকবো না। তোমার ছেলের যাকে চোখে ধরেছে, যেখানে তার মন আটকেছে তাকেই বিয়ে করতে বলো।’

নিজের হাত দু’টো ছাড়িয়ে সদর দরজার পানে পা বাড়ায় সে। তানজিফ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। সে ভেবেছিলো কি ঘটনা পুরো হয়ে গেলো উল্টো। নির্বোধ, বোকার মতো চেয়ে রইলো।

সুমনা এহমাদ কি করবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। তাজওয়ার নওশাদও এখনো ফিরেননি। দ্রুত পায়ে তানজিফের কাছে গেলেন।

‘মৌচাকে ঢিল ছুড়তে মজা লাগে কিন্তু সামলানোর ক্ষমতা নেই। মেয়েটাকে আটকা না হয় পিছু পিছু যা।’

সুমনা এহমাদের কথায় পা থেমে গেলো পুষ্পিতার।

‘কেউ আমার পিছু পিছু এলে গাড়ির নিচে মাথা নিতে আমি দু’বার ভাববো না।সারাজীবনের মতো সবাইকে মুক্ত করে দিয়ে যাবো।’

_________________

কলিংবেল চাপার সাথে সাথে খুলে গেলো দরজা। আফসানা হক যেন কলিংবেল বাজার অপেক্ষায় ছিলেন।

‘ছেলেটার সাথে কি নিয়ে ঠুকাঠুকি লেগেছিস?

চৌকাঠ মাড়াতেই পা থেমে গেলো পুষ্পিতার। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে গেলো।

‘মামনি নিশ্চয়ই বলেছে? আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?’

‘মেয়েদের এতো জেদ ভালো না।’

‘ওবাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে এসেছি। এখন এবাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবো নিজেও জানি না। ফিরে গেলে কিন্তু সারাজীবনেও খুঁজে পাবে না।’

দরজা সরে দাঁড়ালেন তিনি। পুষ্পিতা লাগেজ ঠেলতে ঠেলতে ভেতরে গেলো। দরজা আটকে চাপা স্বরে বললেন,

‘রাতের বেলা কাউকে সাথে না নিয়ে চলে এলি। রাস্তায় কোনো বিপদ হলে? দিনকাল এমনি ভালো না।’

‘বিপদ হয়নি তো? শুন মা, মেয়েরা জেদ সব সময় করে না। কিছু কিছু কথা শুনলে মনের সুপ্ত জেদটাকে আর দমিয়ে রাখা যায় না।’

______________

মোবাইল সুইচঅফ করে রুমের মধ্যে ঘাপটি মে’রে বসে আছে পুষ্পিতা। তানজিফের কথাগুলো মনে পড়লেই মাথার মধ্যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ইচ্ছে করছে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিতে। যদি রাগটা একটু কমে। ওই ঘড়ি কবে সে ও বাড়িতে নিলো সেটাই মনে করতে পারছে। ধীরে ধীরে রাগটা গিয়ে জমা হচ্ছে মায়ানের উপর। ক্ষণিকের ভালো লাগা এখন যত যন্ত্রণা আর অশান্তির কারন। এই একটা মানুষ তার জীবনটাকে উলোটপালোট করে দিলো।

দরজায় কড়াঘাতে চমকে উঠলো সে। বাইরে থেকে আফসানা হক ডেকে চলেছেন।

‘একদম বিরক্ত করবে না মা। মন মেজাজ এমনিতে ভালো নেই।’

‘ও বাড়িতে থেকে ফোন করেছে।’

‘বলে দাও আমি এসে গিয়েছি।’

‘বলেছি বিশ্বাস করছে না। তোর সাথে কথা বলতে চায়।’

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দরজা খুলে দিলো পুষ্পিতা। আফসানা হকের হাত থেকে মোবাইল ছু মে’রে নিয়ে ঠাস করে দরজা আঁটকে দিলো।

মোবাইল কানে ঠেকালো। ফুস ফুস শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তানজিফ নত স্বরে বলল,

‘স্যরি!’

নির্বাক রইলো পুষ্পিতা। তানজিফের সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র স্পৃহা তার নেই। আজকের এই সুন্দর দিনে তার মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ এই ছেলেটা।

‘আসলেই তুই উনার দেওয়া উপহারটা হাতে কাঁদছিলি তো তাই।’

‘তো? তাই তুই তোর মনগড়া কাহিনি বানিয়ে নিলি। ভেবে নিলি আমি এখনো মায়ানের জন্য দিওয়ানা। পাগল হয়ে আছি উনাকে পাওয়ার জন্য। তাই তো?

নিস্তব্ধ রইলো তানজিফ। এখন কিছু বললে পুষ্পিতা আরো রেগে যাবে।

‘শুন তানজিফ, আমার চোখ বেয়ে যত ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছে আর যত সেকেন্ড ব্যয় করে আমি এ বাসায় এসেছি সব কড়ায় গণ্ডায় হিসেব করে রেখেছি। সবকিছুর শোধ আমি তুলবো। পরপুরুষের হাতে বউকে তুলে দেওয়ার তোর বড্ড শখ না? আমি পুষ্পিতা দেখে নিবো তোর সহ্য ক্ষমতা ঠিক কতটুকু।’

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।#অতঃপর_সন্ধি (২৩) (বোনাস)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘আচ্ছা শোধ তুলিস। তোর পায়ে হয়তো গরম পায়েস পড়েছে। বার্ন মলম লাগিয়েছিস?’

‘মনের ভেতর যে জ্বলন শুরু হয়েছে সেই জ্বলন সহ্য করতে গিয়ে বাহ্যিকটা টের পাইনি।’

তানজিফকে আর কিছু বলতে দিলো না। তার আগেই কল কে’টে দিলো। ধুপধাপ পা ফেলে মা বাবার কক্ষের দিকে গেলো সে।

শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন আফসানা হক আর আশহাব শেখ। মায়ের হাতে মোবাইল দিয়ে তেজি কন্ঠে বলল,

‘আমাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যপারে একদম নাক গলাবে না কেউ।’

‘তুই ভুল করলেও আমরা চুপচাপ থাকবো?’ চোখ রাঙিয়ে বললেন আফসানা হক।

‘হ্যা, থাকবে।’ সহজসরল স্বীকারোক্তি পুষ্পিতার। বলে আর দাঁড়াল না সে। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো কক্ষ হতে।

‘তুমি তোমার মেয়েকে কিছু বলবে না?’

মশারী গুঁজছিলেন আশহাব শেখ। স্ত্রীর কথায় শির উঁচিয়ে চাইলেন।

‘কি বলবো?’

আফসানা হক আঙুল দিয়ে নিজের মাথার দিকে ইশারা করলেন।

‘আমার মাথা বলবে আমার মাথা।’

‘আচ্ছা, তোমার মাথা।’

‘দেখো?বাজে বকে আমার মেজাজ খারাপ করবে না।’

স্ত্রীর কথায় তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন আশহাব শেখ। মশারীর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।

‘একটু আগে পুষ্পিতা কি বলে গেলো? যেন ওদের দু’জনের ব্যপারে যেন নাক না গলাই। ছেড়ে দাও না ওদের। নিজেদের ব্যপার নিজেরা সামলাক। স্বামী স্ত্রীর মাঝে মনমালিন্য হয়। আবার ভাবও হয়। নিজেদের ব্যপার নিজেরা মিটিয়ে নিবে। আমরা সবাই মিলে ঘাটাঘাটি করলে খুব খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে।’

‘তুমি যেমনটা ভাবছো তেমনটা নাও হতে পারে।’

‘একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করি আফসানা। একেক স্টুডেন্ট একেক রকম। একেক টিচার একেক রকম। মাথা ঠান্ডা সবকিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়া লাগে। রাগের মাথায় মানুষ সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলাম। রাগ দেখালাম৷ এতে ও ভুল কিছু করে বসলে?’

রুমের দরজাটা আটকে আসলেন আশহাব শেখ। স্ত্রীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে পুনরায় বললেন,

‘মাথা ঠান্ডা হলে দেখবে নিজে এসেই সব বলবে। তোমার আর আমার মাঝে কি কখনো ঝগড়া হতো না বলো? আমরা কি কেউ কাউকে ছেড়ে গিয়েছি? এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে দুই পরিবারের মিষ্টি সম্পর্কটা তিক্ততায় রূপ নিবে।’

আশহাব শেখের বলা প্রতিটা কথা ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাবলেন আফসানা হক। সহসা উৎকন্ঠিত স্বরে বললেন,

‘মেয়েটা না খেয়ে এসেছে। এখানেও কিছু খায়নি।’

‘এখন ডাকলে আরো রেগে যাবে। মাথা ঠান্ডা যখন খিদে অনুভব হবে তখন ঠিক খেয়ে নিবে।’

___________________

বাসায় থমথমে পরিবেশ। তাজওয়ার নওশাদ বাইরে থেকে এসে পোশাকও ছাড়ার সময় পেলেন না। চড়া মেজাজ উনার। সারাদিন পরিশ্রমের পরে বাসায় এসে এমন খবর পেলে কার মাথা ঠিক থাকে? অপরাধীর মতো নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে তানজিফ।

‘বিয়েটাকে তোমার ছেলেখেলা মনে হয়?’

মাথা উঁচু করার সাহস পেলো না তানজিফ।

‘আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি তানজিফ।’ গর্জে উঠলেন তাজওয়ার নওশাদ।

কেঁপে উঠল তিতির। ভয়ে সুমনা এহমাদ আঁচল চেপে ধরলো। এর আগে বাবাকে এতো রাগতে সে কখনো দেখেনি।

‘বিয়ের আগে বলেছি ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নাও। এটা বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। যে চাইলাম আর বিয়ে করলাম।আবার চাইলাম ছেড়ে দিলাম। প্রতিটা মানুষকে দৌড়ের ওপরে রেখে বিয়ে করেছো। বছর ঘুরতেই মেয়েটাকে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সাহস পাও কোথা থেকে? এই সাহস কে দিলো তোমায়?’

উষ্ম শ্বাস ছাড়লেন তিনি। পুনরায় বললেন,

‘মেয়েটাকে কিভাবে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে তুমি জানো। কিন্তু আমার পুত্রবধূ যেন এই বাড়িতে ফিরে আসে।’

নিজের রুমের দিকে এগিয়ে তিনি।

‘আজ তোদের বিবাহবার্ষিকী। সেজন্য মেয়েটা কত উৎফুল্ল ছিলো। কত শখ করে এসে বলেছিল, ‘মামনি আজকের দিনটার হয়তো তোমার ছেলে ভুলে গিয়েছে কাজে চাপে। চলো না ছোটখাটো আয়োজন করে ওকে সারপ্রাইজ দেই।’ উল্টো নিজে সারপ্রাইজ পেয়েছে।’

মায়ের কথায় ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো তানজিফ।

_________________

রুমে এসে রাগে গিজগিজ করছে তানজিফ। একবার রুমের এ মাথায় যাচ্ছে তো আরেকবার রুমের ওই মাথায়। আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগলো।

‘ বিয়ের আগে আমাকে আল্টিমেটাম দিলো সাতদিনের। শুন তানজিফ, তোকে সাতদিন সময় দিলাম। সাতদিনের মাঝে বিয়ে করলে আমি তোর। না হয় আর কখনো পাবি না । লাজ শরমের মাথা খেয়ে নিজের বিয়ের কথা নিজেই গিয়ে বললাম বাপের কাছে। এতগুলো দিন বাদে প্রাক্তনের উপহার হাতে নিয়ে বসে বসে কাঁদবে। আমি কিছু বললাম ওমনি সমস্ত দোষ আমার। কেউ জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতেও পারি না। উল্টো ঝারি খেতে হয়। এসব কথা বলা যায় কাউকে? কি বলবো? আমার বউ তার প্রাক্তনের জন্য কাঁদে। আমি যখন বললাম কথাগুলো তখন তো কিছু বলতে পারতি? না উল্টো সব ছেড়ে ছুড়ে বাপের বাড়ি চলে গেলো। আশ্চর্য।’

স্থির হয়ে খাটে বসল সে।

‘শহরের প্রতিটা কোণায় কোণায় সাইনবোর্ড লাগানো উচিত। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা দরকার, হে পুরুষজাতি, তোমরা তোমাদের জীবনের সমস্ত সুখ বিয়ের আগেই ভোগ করে নাও। কেনন বিয়ের পর সকল সুখ শান্তি স্ত্রীরা হরন করে নেয়।’

মায়ের কথাটা মনে পড়তেই প্রশস্ত হাসলো সে আসলেই তার মনে ছিলো না তার জীবনের স্মরণীয় দিনটার কথা। এইতো পুষ্পিতার জন্য সেদিনও কত পাগলামি করলো। এর মাঝে একটা বছর শেষ। ভাবতেই অবাক লাগে। পুষ্পিতার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাটার দিকে তাকায় তানজিফ।

‘গেলি তো গেলি আমার নিদ্রা সঙ্গে করে নিয়ে গেলি। দুচোখের পাতা যে আর আজ এক হবে না।’

______________________

ভোরের আলো চারিদিকে ফুটতে শুরু করেছে। সারারাত মাথার অসহ্য যন্ত্রণার পরে মাত্রই চোখে ঘুম নেমেছিল পুষ্পিতার। কলিংবেলের অসহ্যকর শব্দে ঘুম হালকা হয়ে গেলো। সাথে বিগড়ে গেলো মেজাজও। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে দরজা খুলতেই ঘুম উবে গেলো পুষ্পিতার।

উসকোখুসকো চুল আর ফোলা ফোলা চোখমুখ নিয়ে হাজির তানজিফ। পরনে কালকের পোশাক আশাক। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো পুষ্পিতা। দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছেই। তানজিফ একের পর এক কলিংবেল চেপেই গেলো। সহ্য করতে না পেরে আবারও দরজা খুলে সে।

‘দেখ? এটা ভদ্রলোকের এলাকা। সাতসকালে কোনো প্রকার সীন ক্রিয়েট করবি না। আমার বাবার একটা সম্মান আছে।’

হামি দিতে দিতে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন আফসানা হক। পুষ্পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এতোবার কলিংবেল বাজায় কে? কে এসেছে পুষ্পিতা?’

দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই দৃষ্টিগোচর হলো তানজিফের অসহায় চেহেরা। পুষ্পিতাকে ধমকে উঠলেন তিনি।

‘ছেলেটাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন?’

‘ও কে যে ভেতরে ঢুকতে দিবো?’

‘আমার বান্ধবীর ছেলে।’

দাঁতে দাঁত পিষে মায়ের পানে চাইলো পুষ্পিতা। দরজা ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

তানজিফ বাসার ভেতরে ঢুকতে পেরে রাজ্য জয়ের হাসি দিলো। গা জ্বলে উঠে পুষ্পিতার। নিজের রুমে যেতে যেতে বলল,

‘বান্ধবীর ছেলেকে বান্ধবীর ছেলের মতো ট্রিট করবে।একদম জামাই আদর করবে না। আর তোমার ওই বান্ধবীর সো কল্ড ছেলে যেন আমার রুমের চারপাশে ঘুরঘুর না করে। আমাকে যেন ডাকাডাকি না করে। খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।’

‘তোকে বলে আমি আমার জামাইকে আপ্যায়ন করবো?’

____________________

সকাল দশটা!

আশহাব শেখ বেরিয়ে গিয়েছেন অনেকক্ষণ। ফারদিনও স্কুলে। অবলা শিশুর মতো সেই কখন থেকে সোফায় বসে আছে তানজিফ। নাস্তাও করেনি। আফসানা হক তানজিফের দিকে তাকাচ্ছে
একটু বাদে বাদে। মাথায় শৈশবের মতো দুষ্টু বুদ্ধি আসতেই রান্নাঘরের দিকে গেলেন। কন্টেইনার থেকে গোটা শুকনো মরিচ গুলো বের করলেন। তানজিফের সামনে গিয়ে বললেন,

‘মরিচ গুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে। ছাদে গিয়ে একটু রোদ দিয়ে আসি। ভেতর থেকে দরজাটা আটকে দে তো। আমার আসতে দেরি হবে।’

পুরো বাসায় কেউ নেই তানজিফ আর পুষ্পিতা ছাড়া। ফাঁকা ঢুক গিলে গুটি গুটি পুষ্পিতার রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। শান্ত স্বরে ডাকল পুষ্পিতাকে। সাড়া দিলো না। আরো একবার ডাকতেই চেঁচিয়ে উঠলো পুষ্পিতা।

‘এই সমস্যা কি?’

শুষ্ক অধর যুগল জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো তানজিফ।

‘আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি।’

‘তো আমি কি করবো? আমি তোকে নিষেধ করেছি নাকি তোর চোখে ধরে রেখেছি। নাকি ঘুমশালা এটা?’

‘বিছানার বা পাশ আর বুকের বা পাশ দু’টোই তো খালি। ঘুম আসবে কি করে।’

একেবারে চুপসে গেলো পুষ্পিতা। কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না।

‘খুল না দরজাটা।’

‘খুলবো না। বাড়ি চলে যা।’

‘মানুষের হায়াত-মউত এর কথা বলা যায় না। তোর আর আমার যদি আর কখনো দেখা না হয়?’

অন্তঃস্থলে ছ্যাঁৎ করে উঠলো পুষ্পিতার। এমনটা ভাবতেও যে তার ভীষন কষ্ট হয়।

খট করে দরজা খুলে গেলো। তানজিফ এমনটা না বললে পুষ্পিতা কখনো দরজা খুলবে না। তাই কাল বিলম্ব না করে দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। নিজের বলিষ্ঠ হাতের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো নিজের প্রিয়তমাকে।

নিজের হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে তানজিফকে ধাক্কাতে লাগল পুষ্পিতা। তানজিফ তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

‘ছাড় আমাকে। একদম ছুবি না আমায়। তোর কোনো অধিকার নেই আমাকে ছোঁয়ার।’

এক পর্যায়ে না পেরে একবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো পুষ্পিতা। তবুও তানজিফ ছাড়লো না। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

‘উহু! ছাড়বো কেন? একদম ছাড়বো না। এই মানুষটার উপর সমস্ত অধিকার তো আমারই। ভালোবাসি তো ভীষণ।’

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এই যে নেন আপনাদের বোনাস। যারা বোনাসের জন্য চিল্লাচিল্লি করছো তাদের কমেন্ট না পাইলে খবর আছে। আর হ্যা মায়ান অবশ্যই আসবে। মায়ান আসার পর্ব তে যেয়ে নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here