অদ্ভুত আসক্তি পর্ব -২৭+২৮

#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_২৭ (মৃত্যুদিন)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“আপনাকে ক্ষমা করার একটা সুযোগ দিলেন না বাবা?”

কথাটি বলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আরহান এতো মানুষের ভীড়েও আমার মুখখানি তার বুকের মাঝে আগলে ধরলেন। আমাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে উনার বলা আশ্বাস বাক্য,“হুশ! কেঁদো না। উনার হায়াত এটুকুই ছিলো। এটা তোমাকে মানতেই হবে।”

আমি কান্না থামিয়ে দিলাম। আরহানের দিকে আশা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,“বাবাকে ফেরানোর আর কোনো উপায় নেই?”

পরপর আমার গলা কেঁপে উঠলো। কণ্ঠ ভিজে এলো। কান্না ভেজা স্বরে মায়ের দিকে আঙুল তুলে বললাম,“মা কি তবে সব পেয়েও হারিয়ে ফেললো? দেখেন না! কিভাবে নির্বাক বসে আছে?”

আমি মার কাছে এগিয়ে গেলাম। উৎকন্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “ও মা! মা! তুমি কাঁদছো না কেনো?”

মায়ের নিষ্প্রাণ নয়ন আমার পানে এসে ঠেকলো। বুক কেঁপে উঠলো আমার। আমি কিছু বলতে পারলাম না আর। যেনো সে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা আমাকে চুপ করিয়ে দিলো।

আজ সকালে খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই মীরা আপুর কল এলো। এই একটা কলে যেনো আমার দুনিয়া থমকে গেলো। মীরা আপুর কল দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মীরা আপুর কান্না ভেজা স্বরে বলা,“আব্বু আর নেই” কথাটি যেনো আমার দম আটকে দিলো। এসে শুনলাম, কালকের অতিরিক্ত স্ট্রেসে বাবা রাতেই স্ট্রোক করেছেন। সকালে অফিসে যায়নি দেখে মীরা আপু বাবাকে ডাকতে এসেছিলো। কিন্তু বাবা আর উঠেনি।

নিজেকে ভীষণ দায়ী মনে হচ্ছে আমার। আজ আমি চাইলেই সব ঠিক রাখতে পারতাম। কাল যদি বাবার সাথে একটু কথা বলতাম! যদি বাবার চিন্তার বোঝাটা একটু কমাতে পারতাম! কান্নারা সব আজ আমার সাথে সখ্যতা করতে এসেছে। এতকালের না পাওয়া সব একসাথে পেয়ে যাওয়াতে আমার খুশি উপচে পড়ছিলো গতকাল। ভাগ্য বড্ড নিষ্ঠুর। এই আমাকে সব ফিরিয়ে দিলো, তো এক নিমিষেই সব ধূলিসাৎ করে দিলো। আশা, কল্পনা সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিলো।

আমার বাবার সাথে আমার সখ্যতা ছিলো সেই ছোট্টবেলায়। এরপর! এরপরের কথা নাইবা বললাম। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে আমার জন্য নিষিদ্ধ, তা পুনরায় প্রমাণিত হলো। হ্যাঁ, আমার জীবনের আঠারোটি বছর আমার বাবার জন্য নষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু, একসময় যার হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল ধরে চলতে চলতে, সর্বশেষে আমি এই ধরার বুকে স্বকীয় কদম একাকী রাখতে শিখেছি, তার অবর্তমানতা কী করে মেনে নেবো? মানতে পারছি না।

একবার চোখ তুলে মায়ের পাশে বসে থাকা দীপ্তিকে দেখলাম। মনে পড়ে গেলো কালকের দিনটা। দীপ্তি যখন বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রথম ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করেছিলো! তখন ওর চোখ দুটি ছলছল করে উঠেছিলো। একটা মেয়ের তার বাবার সাথে কাটানো অনেক স্মৃতি থাকে। আমি পেয়েছিলাম এমন কিছু স্মৃতি, যা ভুলতে চাইতাম বারবার। অন্যদিকে আমার বোনটার স্মৃতি তৈরির আগেই সব শেষ হয়ে গেলো।

মুহূর্তেই বুকটা অনেক ভারী অনুভূত হলো। চিনচিন এক ব্যাথা হচ্ছে। আমার ডান পাশে আরহান দাঁড়িয়ে ছিলেন। উনি নিশ্চুপ হয়ে আছেন। হয়তো আমাকে সান্তনা দেবার আর কোনো ভাষা উনার জানা নেই। আবারও বিছানায় আমার বাবার মৃত দেহকে দেখে নিলাম। পাশে মা আর দীপ্তি বসে। মীরা আপুও কান্না করছে না। কেমন ‘থ’ মেরে বসে আছে। কষ্ট লাগছে আপুর জন্য। সে কাল নিজের মাকে হারালো, আজ বাবাকে।

___________________
যোহরের ওয়াক্তে বাবার দাফন কার্য সম্পন্ন হবে। বাড়ির সামনে খাটিয়ায় বাবার লাশ রাখা আছে। সাধারণত মরা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে। কিন্তু এই বাড়িতে কেউ কাঁদছে না। সব যেনো পাথর বনে গিয়েছে। এদিকে মা! সে তো এক দৃষ্টিতে বাবাকে দেখেই যাচ্ছে।

পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষ। মামারাও এসেছে। মামা যখন মাকে দেখলো! সে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছে। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে। পরমুহুর্তে আরহান তাকে সবটা বুঝিয়ে বলেছে।

আমি শক্ত করে আরহানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বুক ভারী করার মতো কিছু অনুভূতি অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করে ফেলছে আমাকে। মাথা তুলে আরহানের দিকে তাকালাম। উচ্চতায় আমি আরহানের কাঁধ অবদি। চোখাচোখির জন্য দৃষ্টি উঁচুতে রাখা আবশ্যক।
উপরোক্ত পন্থা অনুসরণ করে আমি আরহানের দিকে তাকালাম। আরহান আমার দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলাম,“সব উল্টে পাল্টে গেলো। এবার কী হবে?”

আরহান নম্র কণ্ঠে বললেন,“সৃষ্টিকর্তা সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী।”

আমি আর কিছু বলতে যাবো তখনই আরহান আমার হাত ধরে দ্রুত গতিতে আমাকে সরিয়ে দিলেন। ততক্ষণে আমি খেয়াল করলাম, আমার পেছনের কাঁচের জানালার কিছুটা অংশ ভেঙ্গে গিয়েছে। শব্দে ইতিমধ্যে এখানকার সবার দৃষ্টি এদিকেই। আরহান আমাকে “আন্টির পাশে দাঁড়িয়ে থাকো” বলেই সোজা বরাবর রাস্তায় ছুটলেন। ততক্ষণে কালো মুখোশ পরিহিত লোকটা দৃষ্টিগোচর হয়ে গিয়েছে।

আরহান ফিরে এলেন। আকস্মিক ঘটনায় আমি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুই আমার অবুঝ মস্তিষ্কে ঠেকছে না। আরহান আমার নিকটবর্তী হলেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হলো এটা?”

আরহান পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে আমার প্রশ্নের জবাবে বললেন, “সাম ওয়ান ওয়ান্টেড টু শুট ইউ…”

ফোনে রুদ্রকে কল দিয়ে বললেন,“অ্যারেঞ্জ টাইট সিকিউরিটি হেয়ার, কুইকলি।”

মস্তিষ্কে পুরনো ঘটনা চলে এলো। নতুন না। প্রায়শই হয় এটা। কেউ আমাকে মারতে চায়। এবার বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন পুলিশের সাথে আগমন ঘটলো ছোট মায়ের। একদিনেই চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে তার। পরনে সাদা শাড়ি। মীরা আপু ছোটমাকে দেখেই হামলে পড়লো তার উপর। কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আ’আম্মু! আমি একা হয়ে গেলাম তো! তুমিও নেই। আব্বুও চলে গেলো আমাকে ছেড়ে।”

মীরা আপু বাবার সন্তান না হলেও, প্রচুর আদর পেয়েছে। শুরুতেই একবার বলেছিলাম না! নিজ বাড়িতে আমি চাকরানীর মতো ছিলাম। রাজ করতো সৎবোন। বাবা অনেক আদর করতেন আপুকে।

এদিকে আমার শাশুড়ি মা ও নিশাও এসে গিয়েছে। কিছুক্ষন বাদে রুদ্র ও এলো। রুদ্র এসেই আরহানের কাছে এগিয়ে এলো। মুখ ফুটে “স্যার!” বলতেই আরহান থামিয়ে দিলেন। নিশাকে ডেকে বললেন, “স্টে উইথ ইউর সিস্টার-ইন-ল”

এরপর রুদ্রকে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। নিশা আমার কাছে এসে শান্তনা দেবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পারছে না। হচ্ছে না ওর দ্বারা। কিছু মানুষ আছে, যারা অল্পতেই কেঁদে দেয়। কারো কান্না দেখলেই কেঁদে ফেলে। কারোর কষ্ট সহ্য করতে পারে না। নিশা ঐ ধরনের মানুষ। আমাকে কী শান্তনা দেবে! উল্টো নিজে কান্না করে বসেছে।

শাশুড়ি মা এগিয়ে গিয়ে আমার মায়ের কাছে গেলেন। মাকে সান্তনা দিতে লাগলেন। তখন সেখানে আগমন ঘটলো তৃষ্ণার। আমার সামনে দিয়ে সোজা মায়ের কাছে চলে গেলো। কোথাও খেয়াল নেই তার। আশেপাশের কিচ্ছুটি ভাবছে না। মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।
খানিক সময় বাদে বললো,“সে তোমাকে একসময় প্রচুর ভালো বেসেছিলো। হয়তো সময়ের সাথে সেই ভালোবাসায় দূরত্ব বেড়েছিলো। কিন্তু তুমি তো জানোই, সে তোমাকে কতো ভালো বেসেছে! আর কিছু না হোক, সেই ভালোবাসা টুকু মনে রেখো। এতকালের সব দূরত্ব চুকিয়ে শেষ বারের মতো কেঁদে নাও মামনি। সে তোমাকে ভালোবাসতো, বিশ্বাস করো খুব ভালোবাসতো।”

তৃষ্ণার কথা টুকু শেষ হতেই মা শব্দ করে কেঁদে ফেললো। ঠোঁট উল্টে কান্না থামানোর প্রচেষ্টা করে বললো, “ও আমাকে ভালোবাসতো?”

তৃষ্ণার নীরস উত্তর,“হু।”

মা আবারও কেঁদে দিয়ে বললো,“তাহলে কেনো ছেড়ে গেলো? আমি কী খুব খারাপ? আগেও তো রাগ করতাম আমি। ও আমাকে মানানোর জন্য কতো কিছু করতো! আজ কেনো করলো না?”

মা আর কিছু বলতে পারছে না। কথাগুলো গলায় আটকে গিয়েছে। কিছুটা সময় নিয়ে আবারও বলা শুরু করলো, “মানলাম আমার এবারের রাগটা অনেক বেশি ছিলো। কিন্তু ও একটু চেষ্টা করলেই তো এই রাগ গলে যেতো। আমি তো শুধু ওকে একটু শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম।”

তৃষ্ণা বড় একটা শ্বাস নিয়ে বললো,“সবসময় জীবন আমাদের পরিকল্পনা মাফিক চলে না মামনি।”

মা হাউমাউ করে কেঁদে বললো,“তাই বলে উল্টো আমাকেই শাস্তি দিলো? এতটা সেলফিশ ও? নিজে এই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না বলে, নিজেরটার সাথে এক্সট্রা কষ্ট আমাকে দিয়ে চলে গেলো। একবারও আমার কথা ভাবলো না? আমি এই কষ্ট নিতে পারবো কী পারবো না?”

“কেউ তার সহ্যের অতিরিক্ত কষ্ট পায়না। নিজেকে সামলে নাও। তোমার সেই একটি মানুষ ছাড়াও দীপ্তি আর আমি আছি। তোমার আরো একটা মেয়ে আছে।”

তৃষ্ণার কথা শেষ হতেই পাশ থেকে আমার শাশুড়ি মা বলে উঠলো, “তৃষ!”

তৃষ্ণা মাথা ঘুরিয়ে ডাক অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। নীলাভ নয়ন জোড়া দেখেই শাশুড়ি মা আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলো। এদিকে তৃষ্ণাও।

কিছুক্ষণ বাদে মা, তৃষ্ণাকে ছেড়ে বললেন,“কই ছিলি তুই? তোকে কতো খুঁজেছি জানিস? হঠাৎ সেদিন কলেজ থেকে ফিরে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলি? তোকে আর পেলাম না কেনো?”

তৃষ্ণা মিষ্টি হেসে বললো,“সিলেট চলে গিয়েছিলাম আন্টি। কয়েকমাস আগেই ফিরেছি।”

“আরহানের সাথে দেখা করেছিস?”

“ওর সাথে দেখা না করে থাকতে পারবো? করেছি।”

_________________
দাফনের কাজ শেষ। সবাই বাড়িতে অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে আছি। কারো মুখে শব্দ নেই। ছোটমাকেও পুলিশ পুনরায় নিয়ে গিয়েছে। মীরা আপু সেন্সলেস হয়ে আছে। দীপ্তি, মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমি এক কোনায় আরহানের পাশে বসে আছি।

নিস্তব্ধ বাড়ির মাঝে হুট করেই আরহানের ফোন বিকট শব্দ করে বেজে উঠে। আমি তাকালাম আরহানের দিকে। হোয়াটস অ্যাপে কল এসেছে। স্ক্রিনে ‘রূপ’ নামটা ভেসে উঠেছে। এই কয়েক মাসে রূপ আপুর কোনো কল আসেনি। আজ হঠাৎ! আরহান রিসিভ করতে যাবে, তখনই কেটে গেলো। হয়তো জরুরি, এটা মনে করে আরহান কল ব্যাক করলো। ঢুকলো না। অতঃপর নাম্বারে কল দিলো, নট রিচেবল এলো। কপাল কুঁচকে ফেললো আরহান। এই না কল দিলো!

আরহানের মা আমাকে, দীপ্তিকে, তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“তোরা খেয়ে নে। এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবি তো।”

পুনরায় নিশা,রুদ্র আর আরহানকেও বললেন,“তোরাও আয়।”

কারো খাবার পরিস্থিতি নেই। তবুও জোর করেই খেতে গেলাম। মায়ের দিকে তাকালাম একবার। সে এখনও কেঁদে যাচ্ছে। প্লেটে খাবার বেড়ে, মায়ের কাছে গেলাম।

মা আমার উপস্থিতি পেয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,“খাবে না?”

“ইচ্ছে করছে না।”

“আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

___________________________
রাতেই এই বাড়িতে ফিরেছি। মা আমাকে আরহানের সাথেই পাঠিয়ে দিলো। আজ মায়ের কাছে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে এই পরিস্থিতিতে আরহান ছাড়া আর কেউ সামলাতে পারবে না দেখে পাঠিয়ে দিলো। উদাস মন নিয়ে চলে এলাম। পুরোটা রাস্তা থেমে থেমে কেঁদে এসেছি।

রাতে আরহান অনেক জোর করেই খাইয়ে দিয়েছেন। পুরোটা রাত আমার নির্ঘুম কাটলো। শেষ হতে চাচ্ছে না এই রাত। আর ঘুমও আসছে না। রাতের শেষ ভাগে আরহানের ফোন বেজে উঠলো। নির্ঘুম আমিটার সাথে জেগে ছিলেন আরহানও। পাশ হাতড়িয়ে ফোন রিসিভ করে কানে তুলতেই আরহান মুখশ্রীর ভাব পাল্টে গেলো। অনেক বাজে কোনো খবর পেয়েছে, এমন।
পুরো ঘটনার আগা গোড়া না বুঝে আমি আরহানকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”

“রূপ সুইসাইড করেছে।”

চলবে..!#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_২৮ (জুনিয়র আসছে)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

দেখতেই দেখতে আজ অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেলো। সময় যেনো ছুটছে হাওয়ার বেগে। দিনগুলো কাটছে, নাহ্! দৌড়চ্ছে। আজ ছয় মাস পেরিয়ে গেলো। আর সবচেয়ে মজাদার ব্যাপার হচ্ছে, আর তিনদিন বাদেই আরহান আর আমার বিয়ের প্রথম বছর পূর্ণ হবে।

এইতো সেদিন! সেদিন না আরহান আমাকে জোর করে, ভয় দেখিয়ে বিয়ে করলো! এতো দ্রুত সময় পেরিয়ে যায়! কেউ একজন বলেছিলো, সুখের সময় নাকি হাওয়ার বেগে ফুরোয়। সে আসলেই সত্যিই বলেছিলো।

হুট করেই মন খারাপ ছেয়ে গেলো। আজ বাবা নেই, ছয় মাস হয়ে গেলো। সাথে নেই, রূপ আপু। সে কেনো সুইসাইড করেছে, কেউ জানে না। অনেক চেষ্টার পরেও কোনো কারণের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অবশ্য মাহী বলেছিলো, রূপ আপু নাকি অনেক ডিপ্রেসড ছিলো। আসল কারণ হিসেবে এটাও ফাঁস হয়েছে, রূপ আপু আরহানকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। হ্যাঁ! পাগলের মতোই। সে যেমনই ছিলো, তার ভালোবাসা যে খাঁটি ছিলো। তা বুঝতে পারা কারোর জন্যই কষ্টসাধ্য হয়নি।
কথায় আছে, প্রেম মানুষকে যেমনটা শক্তিশালী চরিত্রের অধিকারী বানায়; ঠিক তেমনই, সময় পড়লে ছ্যাঁচড়া হওয়াটাও শিখিয়ে দেয়। অতীব সুন্দর ভাবে।

ছোট মায়ের সাত বছরের জেল হয়েছে। তবে তার অপরাধের শাস্তি আরো কাম্য ছিলো। তার জন্যই বিগত আঠারোটি বছর আমাদের নষ্ট হয়েছে। আমি তাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না।

এদিকে মীরা আপু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। সে এতো কিছু সইতে পারেনি। এখন মানসিক হাসপাতালে আছে। সে ঠিক হবে কবে? এই আশায় কেউ বসে নেই। তার যে আসলেই কেউ নেই। তার মামার বাড়ির সবাই আগেই সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। আর তার আসল বাবার বাড়ি থেকে তো চলেই এসেছে। সেখানে কোনো দাম নেই।

কিছুদিন আগে রুশীর একটা মেয়ে সন্তান হয়েছে। নাম রেখেছে অরু। পরিবারের সবার সাথে নিজের মেয়েকে নিয়ে দিন ভালোই কাটছে। আমাকে প্রায়শই ভিডিও কল দেয়। বাড়ি থেকে বিনা প্রয়োজনে বের হবার সুযোগ নেই ওর। এদিকে আমিও যেতে পারবো না। তাই কলেই কথা হচ্ছে।

অয়নের এখনও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। জলজ্যান্ত একটা মানুষ হুট করেই এভাবে গুম হয়ে গেলো, এটা কল্পনাতীত ব্যাপার লাগে আমার কাছে।

এই কয় মাসে আমি তৃষ্ণা সম্পর্কে আমার মা ও শাশুড়ি মায়ের কাছে জেনেছি। শাশুড়ি মা বলেছিলেন,“স্কুল ও কলেজ লাইফে তৃষ্ণা আরহানের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। একে অপরের কলিজা বলা যেতো। প্রখর মেধাবী ছিলো দুজনেই।
দুজনের ভাবনা চিন্তাও এক ছিলো। কিন্তু তৃষ্ণার একটু ফ্যামিলি প্রবলেম ছিলো। এরপর একদিন কলেজ থেকে বাড়ি গিয়েছিলো। পরেরদিন শুনি, তৃষ্ণার বাবা-মা মারা গিয়েছে। সেদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে আর ওকে খুঁজে পাইনি। শুনেছি ওরা, ওখান থেকে চলে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে! তা জানতে পারিনি।”

এরপর আমার মায়ের কাছে শুনেছি সেই ভয়ংকর অতীত। সেদিনের ঘটনা। তৃষ্ণার ঘটনা। এসব শুনে সত্যিই ভীষণ খারাপ লেগেছে। আসলেই, একটা গল্পের,অনেক পর্ব থাকে। প্রতিটি পর্ব, একটার সাথে অন্যটা কানেকটেড। এক পর্ব মিস গেলে, গল্পের মানেটা আমাদের কাছে অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। জীবনটাও কোনো গল্পের চেয়ে কম না।

আমি সব মিলিয়ে তৃষ্ণার জীবনের গল্প জেনেছি। প্রতিটি পর্ব মিলিয়ে জেনেছি। একটা মানুষ কখনোই খারাপ পথে যায়না। সময় ও পরিস্থিতি সবটা করিয়ে দেয়।

ভাবতে ভাবতেই আরহানের নম্বর থেকে কল এলো। এখন বাজে রাত এগারোটা। আরহান কিছু কাজে দেশের বাহিরে গিয়েছেন বেশ কয়েকদিন হলো। মন খারাপ করেছে আমার। তবে সব মানিয়ে নিয়েছি আমি। আরহান আমার কাছে না থেকেও যেনো সারাটা ক্ষণ আমার পাশেই আছে। এইযে বুকের বা পাশে যেই যন্ত্রটা আছে, সেটা আমাকে আরহানের উপস্থিতির আভাস দেয়।

মুচকি হেসে ফোন তুলে কানে নিলাম। আরহান শুরুতেই জিজ্ঞেস করলেন, “খেয়েছো রাতে?”

“হুম। আপনি?”

“এখন এখানে কেবল বিকেল পাঁচটা।”

“ওহ্, হুম। কী করছেন?”

“শুকতারাকে তার চাঁদ গভীর ভাবে মিস করছে।”

“এমা! তাই? তবে চাঁদ আর তারা তো একই আকাশে থাকে। এতো ডিপলি মিস করছে কেনো?”

“হুম। তবে নয়নে নয়নে সাক্ষাৎ হচ্ছে না। সাক্ষাৎকারের সময়টুকুতে যখন শুকতারার অবাধ্য-অগোছালো চুলগুলো মুখের সামনে এসে বিরক্ত করবে, সেটা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে না।”

“এটা আপনার ফ্যাভারিট স্টাইল বুঝি?”—ভাবুক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম।

“হুম, বলতে পারেন।”

আরহানের কথাটা বলতেই আমি তাকে ডাকলাম,“আচ্ছা শুনছেন!”

“বলো, শুনছি।”

“আসবেন কবে?”

আরহান ওপাশ থেকে হাসলেন। শব্দহীন হাসি। তবে অজ্ঞাত কারণবশত বুঝতে পেলাম, উনি হাসছেন। জিজ্ঞেস করবো? কেনো হাসছেন?

আমার জিজ্ঞেস করার আগেই আরহান বললেন,“মিস করছিলে বুঝি?”

হুট করেই হৃদপিন্ড কেঁপে উঠলো। শূন্যতা অনুভব করলো। সারাদিন দিব্যি চলছিলো আমার। তবে হঠাৎ এমন কেনো?
লজ্জা পেয়েছি। হ্যাঁ লজ্জারই কথা।

তবুও মুখ ফুটে বললাম,“মিস করছি কি না জানিনা, তবে অনুভব করছি। প্রখর ভাবে।”

“প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতি, তাকে অনুভব করায় শুকতারা। আমিও করছি। যেমনটা তুমি করছো, তার চেয়েও কয়েক গুন বেশি। তোমার ভাষায় ‘প্রখর ভাবে’। বুঝতে পারছো কি?”

_______________________
ইদানিং শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে। দুর্বলতা দিনকে দিন অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করছে। আজিব স্মেল ভালো লাগছে। খাবার খেতে ইচ্ছে হয় না। আবার অসময়ে অনেক উল্টা পাল্টা খাবারের বায়না ধরে বসি। আমার এসব বায়না এখন নিশা সামাল দিচ্ছে। গতমাসে পিরিয়ডও মিস গিয়েছে। সব লক্ষণ আমার কাছে একটা জিনিস বোঝাচ্ছে। যদি সত্যি তাই হয়?

ভেবেই আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠলাম। আরহান আসবেন কালকে। পাশ হাতড়িয়ে ফোন নিলাম। এখন বাজে সকাল নয়টা। আগে কতো সকালে উঠতাম! আর এখন কী অলস হয়ে গিয়েছি!

দীপ্তির নম্বর ডায়াল করলাম। কল রিসিভ করতেই জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় আছিস?”

সময়ের বিবর্তনে আমাদের সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়ে গিয়েছে। এখন ওকে আমি ‘তুই’ সম্বোধন করি, আর দীপ্তিও করে।

দীপ্তি বললো,“এইতো বাড়ি আছি।”

“মা কী করছে?”

“মা অফিসে আছে রে। খেয়েছিস আপু?”

“আর খাওয়া! উঠিইনি। আসবি না?”

এই কয়মাসে, দীপ্তি যেনো বেশির ভাগ সময় এই বাড়িতেই, আমার সাথে কাটিয়েছে। আমি জানতাম বোন মানে তার বেস্ট ফ্রেন্ড। সে ছোট থেকে সাথে থাকে। আমাদের ক্রাইম পার্টনার হয়। সেজন্য আমাদের সব জানে। কিন্তু আমি একটা জিনিস ভুল ভাবতাম। ছোট থেকে একসাথে থাকাটা জরুরি নয়। এটা দীপ্তি বুঝিয়েছে। এই ছয়মাসে আমার সাথে ওর এমন একটা সম্পর্ক হয়েছে, কেউ বুঝতেই পারবে না, আমাদের পরিচয় মাত্র কয়েক মাসের।

দীপ্তি হালকা হেসে বললো,“হ্যাঁ, আসবো তো।”

“কখন আসবি?”

“এইতো, আর দুই ঘণ্টার মতো।”

আমি “আচ্ছা” বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। এরপর বললাম, “শোন না!”

“হুম। বল।”

“আসার সময় একটা প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে আসিস।”

___________________
নিস্তব্দ, কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে বসে আছি আমি। মুখে কথা নেই। এদিকে সামনে দীপ্তি একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। কেনো এটা আনলাম, কী হয়েছে? ইত্যাদি প্রশ্ন ওর মুখে লেগেই আছে। অথচ আমার বলার কোনো ভাষা নেই।

মস্তিষ্কে অনেক কথারা ভিড় জমাচ্ছে। অথচ শব্দগুলো মুখে আসছে না। সব আওলিয়ে যাচ্ছে। আমার জীবনের মোড় ঘুরেছে।

হাতের প্রেগন্যান্সি কিটটা দীপ্তির দিকে এগিয়ে দিলাম। লাল দাগ দুটো জ্বলজ্বল করছে। হাতে নিয়ে তা দেখতেই দীপ্তি চকিতে চাইলো। আমার চোখ ছলছল করছে। এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কম্পণরত হাতটা নিজের পেটের উপর রাখলাম। একবার নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে, পুনরায় দীপ্তির দিকে তাকালাম।

“আমি মা হবো? আমিই?”
কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্নটি করে ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে দিলাম। এ যেনো পরম সুখের এক কান্না।

দীপ্তি স্থির কিছুক্ষণ কিটের দিকে তাকিয়ে হুট করেই মুখ উজ্জ্বল করে ফেললো। খুশিতে নাচতে শুরু করলো আমাকে নিয়ে। তারপর আমাকে ছেড়ে মাকে কল দিলো।

রিসিভ করতেই বললো,“মা! তুমি নানুমা হতে যাচ্ছ।”

ওপাশের মায়ের কথা আর শুনলো না। ফোন রেখেই রুমের বাইরে ছুটলো। ওর চিৎকারে মা-নিশাও ওখানে চলে এলো। আমিও এগিয়ে গেলাম। দীপ্তি উত্তেজিত কন্ঠে বললো,“খালামণি হবো। খালামণি হবো আমি।”

_________________
এখন বাজে রাত এগারোটা চল্লিশ। বাড়ির সবাই আমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে জানার পর থেকে আমার ব্যাপারে আরো সচেতন হয়ে উঠেছে। রূপ আপুর মৃত্যুতে যেমন বাড়িতে শোক ছেয়ে গিয়েছিলো, জুনিয়রের আগমনের সংবাদে এখন শোকের রেশ মাত্র নেই।

তন্মধ্যে আমি এক ভয়াবহ কাজ করে ফেলেছি। এই বিশাল এক নিউজটা আমি আরহানের কাছ থেকে লুকিয়েছি। কাউকে বলতে নিষেধ করেছি। কাল, যখন আরহান আসবে, তখন আমি নিজেই তাকে বলবো এটা।

আচ্ছা কীভাবে বলবো? বলতে পারবো? উনি সামনে থাকলেই আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। কথা বলতে পারিনা। কিছুই পারিনা আমি। মূর্তি বনে যাই।

তখন সেখানে নিশা এলো। এই বাড়িতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে নেয়। সে হিসেবে নিশাও। আজ হয়তো আমার কাছে থাকবে। দীপ্তি অনেক হৈ হুল্লোড় করে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।

নিশা এগিয়ে এসে ডাকলো,“ভাবি!”

আমি মুচকি হেসে বললাম,“হুম!”

“ছাদে চলো।”

“এখন? এই টাইমে?”

নিশা মেকি হেসে, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,“রাতের বাতাস অনেক ভালো। চলো যাই।”

আমি আর কিছু বললাম না। ওর সাথেই ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। শেষ সিঁড়িতে এসে খেয়াল করলাম, নিশা আমার সাথে নেই। বেশ অন্ধকার। এখন নিচে যেতে গেলে, পড়ে যাবো। এজন্য ছাদের দিকে অগ্রসর হলাম।

সম্পূর্ন অন্ধকার ছাদ দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। লাইট জ্বালানো নেই কেনো? কিছুদূর এগোতেই আমার পেছনে কারো অস্তিত্ব পেলাম।

আমি দ্রুত বেগে পিছু ঘুরতে গেলাম। তার আগেই সম্পূর্ণ ছাদ আলোকিত হয়ে গেলো। চারিপাশে দেখে বিস্ময়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। পুরো ছাদ ডেকোরেশন করা। এসব কে করলো? কেনো করলো?

সবকিছু ভাবনাতেই হুট করেই কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেলো।

“৩…২….১..”
শেষ হতেই সম্পূর্ণ আকাশ জ্বল জ্বল করে উঠলো। বিস্ময়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছি। পেছনের মানুষটি তখন আরো কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমার কাঁধে থুতনী ঠেকিয়ে বললো,“হ্যাপি এনিভার্সারি শুকতারা।”

আমি আরহানের আওয়াজ পেয়ে দ্রুত উনার দিকে ফিরলাম। আমাকে উনার দিকে তাকাতে দেখেই, আরহান মুচকি হেসে বলা শুরু করলো,“আমার জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ। আমার জীবনকে ঠিক এভাবেই আলোকিত করার জন্য ধন্যবাদ। আমাকে ভালোবাসার জন্যেও।”

আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,“এই হাত কখনো ছাড়বো না, আই প্রমিজ।”

আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না, কী হচ্ছে! উনার তো কাল আসার কথা! তবে আজ কী করছেন? এতো ভেবেও কিছু পেলাম না। খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম।

মুহূর্তেই মাথায় এলো, আরহানকে জানাতে হবে। কীভাবে জানাবো?

পা উঁচু করে দাঁড়ালাম। আরহানের হাতটি আমার পেটে রেখে উনার কানে বললাম,“শুভ বিবাহ বার্ষিকী আমার সন্তানের বাবা।”

তারপর একটু সরে গেলাম। আরহান বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো বুঝে নিয়েছেন। আরহানের চোখে চোখ রেখে বললাম,“উই’ল বি প্যারেন্টস। জুনিয়র আসছে।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here