অদ্ভুত আসক্তি পর্ব -৩৩ ও শেষ

#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_৩৩ (উপন্যাসের উপসংহার —প্রথম অংশ)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“ইদানিং শরীরটা ভালো লাগছে না রুদ্র। জানি, প্রেগন্যান্সিতে এটা স্বাভাবিক। আমি যেদিন শুনলাম, মা হবো। সেদিন থেকে আমি প্রেগন্যান্সি নিয়ে অনেক স্টাডি করেছি। একটা মেয়ের কাছে সবচেয়ে আনন্দের দুটো মুহূর্ত হলো প্রিয় মানুষটাকে নিজের করে পাওয়া এবং তার অংশকে নিজের মাঝে পাওয়া। আলহামদুলিল্লাহ! দুটোই পেয়েছি।

প্রতিদিন আমি অনুভব করি, আমার ভেতরে একটা প্রাণ বড় হচ্ছে। জানেন রুদ্র? আমি ওর সাথে সারাদিন গল্প করি। আপনার-আমার কাহিনী শোনাই আমার সোনাটাকে। তারও জানার অধিকার আছে, তার মা-পাপাই এর এই লুকোচুরি প্রেমের ইতিহাস। মাঝে মাঝে আমার সোনাটাকে আমি ঘুম পাড়াই। অনেক আদর করি। আরো বেশি করতে ইচ্ছে হয়। জানেন রুদ্র? প্রতি রাতে যে আপনি আমার পেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আমি খুব শান্তি পাই। আমার অগোচরে, তার সাথে কত্ত কথা বলেন আপনি। আমি কিন্তু ঘুমাই না তখন। আপনার সব কথা শুনি। এইযে, কাল রাতে বললেন, খুব ইচ্ছে আপনার, একটা পিচ্চি আসবে। তার ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল ধরে হাঁটা শিখাবেন। তাকে নিয়ে খেলবেন। আরো কতো কিছু!
আমার না, খুব ইচ্ছে, আমারও একটা হ্যাপি ফ্যামিলি হবে। এই যেমনটা ভাইয়া আর ভাবির হয়েছে। তারা কত্ত সুখী। আমারও এমন একটা হ্যাপি ফ্যামিলি চাই। কিন্তু…. ইদানিং অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে। অনেক জায়গায় শুনেছি,অনেক প্রেগন্যান্সিতে কম্পলিকেশন হয়। মা, বাচ্চার যেকোনো একজন বাঁচে। আচ্ছা, যদি আমার বেলায় এরকম কিছু হয়ে যায়? আমি আপনার থেকে আপনার বাচ্চাকে কেড়ে নিতে পারবো না আগেই বলছি। এই সাধ্য আমার নেই। তবে কি আমিই আপনার থেকে দূরে সরে যাবো?

রুদ্র! কেমন যেনো লাগছে আমার। খুব ইচ্ছে হচ্ছে, আপনাকে কিছু কথা বলতে। অনেক তো আপনার কাহিনী শুনলাম। কিভাবে আমার মায়ায় জড়িয়ে গেলেন? কিভাবে আমায় ভালোবাসলেন!
আজ না হয় আপনাকে আমার কাহিনী বলি! শুনবেন আমার কাহিনী? আপনার সামনে কখনোই এসব বলতে পারবো না। মাঝে মাঝে ঝগড়া করি ঠিক আছে। রাগ করি, মন খারাপ করি, লজ্জা পাই। সব করতেই পারি। কিন্তু কেনো যেনো আমি আপনাকে ভালোবাসার কথা বলতে পারিনা।

একদম বাচ্চা ছিলাম আমি। আপনি আমাদের বাড়িতে এলেন। বাচ্চা আমিটা কিছু বুঝতাম না। তবে, আপনার আশে পাশে থাকতে ভালো লাগতো ভীষণ। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম আমি। বয়স তখন সবে ষোলো আমার। ভাইয়ার সাথে লন্ডন থেকে ফিরলেন। সেদিন আপনাকে দেখে আমার মনে অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিলো। দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলাম আমি। এই বয়সটাই এরকম। ক্লাসের সব বান্ধবীর সাথে এই নিয়ে আলোচনা করলাম।
তারা এক বাক্যে বলে দিলো,“নিশা! তুই প্রেমে পড়ে গিয়েছিস।”

তবে আমার কাছে মনে হতো না, এটা প্রেমে পড়া। ওরাও তো সেই বয়সে অনেকের কথাই বলতো। তাদের কথার মূল বিষয়বস্তু ছিলো, তারা ছেলেকে বাহ্যিক ভাবে দেখে পছন্দ করেছে। তবে, আমার মনে আপনার জন্য অনুভূতি গুলো অন্যরকম লাগতো।

সময় এগোতে লাগলো। আপনার সব পছন্দ-অপছন্দ জেনেছি। সেদিন, একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। আপনার আর আমার পছন্দ-অপছন্দের বেশ অমিল আছে। ভাবনায় পড়ে গেলাম। এতো অমিলে, মিল কী করে হবে? তারপর, হুট করেই একটা আইডিয়া চলে এলো।

আমি না! আগে সবজি পছন্দ করতাম না। বিশেষ করে করলা। কিন্তু যখন শুনলাম আপনি সেটা পছন্দ করেন! আমি সেদিনই খেয়েছি। এরপর থেকে প্রায়ই খাই। এখনো করলা পছন্দ করিনা। তবুও খাই।
সেদিন জানলাম, আপনি নীল পছন্দ করেন। আমার আবার নীল রং দেখলেই মনে হতো, এমা! এ তো বিষের রং! এটা আবার কার পছন্দ হয়?
আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা। যেদিন জানলাম এটা আপনার পছন্দ, সেদিনই আমার রুম স্কাই ব্লু কালারে পেইন্ট করিয়েছি। পুরো রুম ব্লু ফার্নিচারে ডেকোরেশন করিয়েছি। ইন ফ্যাক্ট, আমার ওয়াড্রপের সব কাপড় সরিয়ে শুধু ব্লু কিনে রেখেছি। এতটা পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি।

আপনি যখন বাড়িতে আসতেন! লুকিয়ে লুকিয়ে আপনাকে দুচোখ ভরে দেখতাম। সারারাত আপনাকে নিয়ে ভাবতাম আমি। বিভিন্ন স্বপ্ন তৈরি করতাম। ধীরে ধীরে আমি অন্যরকম হয়ে যাই। ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডস কারো সাথে আগের মতো কথা বলিনা। আমার দিবা রাত্রি শুধু আপনার কল্পনায় বিভোর হয়ে কাটে। আপনি সামনে এলে আমার সবকথা আওলিয়ে যেতো। কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে যেতো। কথা বলতে পারতাম না। হৃদপিন্ডের অন্তঃস্থলে কেমন যেনো হাঁসফাঁস অনুভূতি হতো।

ধীরে ধীরে সময়ের কাটা এগোতে লাগলো। আপনাতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে একটা কথাই ছিলো,“এই শ্যামপুরুষ আমার”। খুব করে চাইতাম আপনাকে। আপনাকে এক ঝলক দেখার জন্য মরিয়া হয়ে যেতাম। আমার এসব অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ-তো আগেই হয়েছে। কিন্তু অবুঝ আমিটা বুঝতে পারিনি এর পরিচয়। তবে পরে জেনে নিলাম এর নাম। আপনি ছিলেন আমার কাছে এক নেশা দ্রব্যের ন্যায়। তাই তো আপনিনামক নেশাদ্রব্যে অনেক বাজে ভাবে নেশাক্ত হয়ে যাই। ভালোবাসার এই নেশায় বড্ড অদ্ভুত ভাবে আসক্ত হয়ে যাই।

কিন্তু মাঝপথে ভুল বোঝাবুঝি আমাদের থেকে কেড়ে নিলো একটা বছর। যন্ত্রণার সাথে সাক্ষাৎ করালেন আপনি আমায়। যেভাবে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন, সেভাবেই কষ্টের সাথে পরিচয় করালেন। এমন একটা দিন নেই, আমার বুকটা শূন্য শূন্য লাগেনি। সবসময় মনে হতো, কী হতো? যদি আমি আমার প্রিয় মানুষটাকে পেয়ে যেতাম! চাওয়াটা তো অন্যায় না। ভালোই তো বেসেছি।
কেনো এরকম হচ্ছে?

জানেন রুদ্র? আমি সব মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু আপনার অবহেলা সহ্য করতে পারতাম না। আর সেটাই হতো। প্রচন্ড মন খারাপ হতো। মাঝে মাঝে পাথরের মতো বসে থাকতাম। আবার মাঝে মাঝে হাউমাউ করে কাঁদতাম। এসব কেনো করতাম জানিনা আমি। শুধু জানতাম, আমার বুকটা পুড়ে যাচ্ছে। এতো কষ্ট! এত্তো কষ্ট! আমি নিতে পারতাম না।

কিন্তু, আমার ভাগ্যে আপনি ছিলেন। এজন্যই তো সব ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে, আপনাকে পেয়ে গেলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী জানেন? আপনি আমার হয়েছেন। আমার নিজস্ব একটা মানুষ।”

​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​
ডায়েরির এটুকু অংশ পড়লো রুদ্র। সময় অনেকটা পেরিয়েছে। আটটা ক্যালেন্ডার পুরনো হয়েছে। নিশার মৃত্যুর আজ আট বছর। পাল্টেছে সবার কাহিনী। শুধু থেমে রয়েছে রুদ্র। কারন তার কাহিনী তো তার নিশাপাখিতেই সীমাবদ্ধ। নিশার মৃত্যুর পরপর রুদ্র কিছুদিন পাগলের ন্যায় ছিলো। ছোট্ট শিশুকে সামলাতে অনেক কষ্ট হয়েছে। মা ছাড়া একটা সন্তান। সহজ তো ছিলো না। রুদ্রকে এরপর থেকে এ বাড়িতেই রাখা হয়। মাস যেতে না যেতেই রুদ্রের হাতে এই ডায়েরি এসে যায়। যেখানে লেখা ছিলো, নিশার অব্যক্ত সব অনুভূতি। প্রকাশ করা কি এতোই সহজ ছিলো? এজন্যই তো লিখে রাখা। যাতে মনটা সামান্য হলেও হালকা হয়।

পাতা ঝাপটালো রুদ্র। আবারো পড়া শুরু করলো। এই নিয়ে কতবার যে পড়েছে! তার হিসেব নেই। রুদ্র নাকি এই ডায়েরিতে নিশাকে খুঁজে পায়। অতঃপর পরের পৃষ্ঠায় ছিলো—

“প্রেগন্যান্সির মাস যতো এগোচ্ছে, টেনশন আমার ঠিক ততোই বাড়ছে। বারবার আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমি পারছি না এসব নিতে। বড্ড খারাপ একটা অনুভুতি হয়। শুনেছি, মানুষ তার মৃত্যুর আগে কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। তবে সেসব খেয়ালে নেয়না। আমারও ওরকম অনুভূতি হচ্ছে রুদ্র। আমি কী তবে সত্যিই..?
রুদ্র! আমি আপনার সাথে পুরোটা জীবন চাই। আমি বড্ড লোভী রুদ্র। আপনার ভালোবাসা আমার একার। আমি এর ভাগ দিতে পারবো না। রুদ্র! প্লিজ! আমি থাকি বা না থাকি, আমার হয়ে থাকবেন,প্লিজ! আপনাকে ভালোবাসি। অদ্ভুত রকম ভাবে ভালোবাসি। এই ভালোবাসায় অসম্ভব রকমের সুখ আছে, তার চেয়েও বেশি আছে হারানোয় ভয়।

রুদ্র! একটা রিকুয়েস্ট। আমি জানিনা এটা কখনো আপনার হাতে পড়বে কি না! কিংবা প্রয়োজন হবে কি না। তবুও বলে যেতে চাই, আমার বেবির ভালোবাসায় একটুও কমতি রাখবেন না। তার জন্য আবার নতুন কাউকে আনার প্রয়োজন নেই। বেশি মাতব্বরি করতে যাবেন না। মেয়ে মানুষের থেকে দূরে থাকবেন। আমি মরে গেলেও আপনার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারবো না। রুদ্র। ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে। ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। আর খুব শীঘ্রই আপনাকে প্রপোজ করবো। আমি চাইনা দেরি হয়ে যাক। তাই খুব জলদি আপনাকে প্রপোজ করে দেবো।

আমার কথাগুলো মাথায় রাখবেন। নয়তো ভূত হয়ে ঘাড়ে চেপে বসবো। আপনি আমার। শুধু আমার। আপনার পাশে নিজের ছায়াকেও সহ্য হয়না। কেমন যেনো লাগে। আচ্ছা! কাজ আছে। পরে আবার লিখবো।”

​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​
এরপরের পৃষ্ঠাগুলো ফাঁকা। আর লেখার সময় হয়নি। সুযোগ হয়ে উঠেনি নিশার। তার আগেই তো চলে গেলো সব মায়া ছেড়ে। মায়াবিনী সব মায়া ভুলে পরলোক গমন করলো।

রুদ্র ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পড়ছিলো এটা। চোখ জোড়া তার ছলছল করছে। কিন্তু পানি গড়িয়ে পড়ে না। কোনোবারই না। নিষ্ঠুর এই ধরণীতে সন্ধ্যে নেমেছে। নিষ্ঠুর! হ্যাঁ, নিষ্ঠুর-ই তো। কারণ এই ধরণী, নিশার শেষ ইচ্ছে পুরন করলো না। বড্ড নিষ্ঠুর ভাবে কেড়ে নিলো, রুদ্রের কাছ থেকে তার পিচ্চি পাখিকে। ইশ! কি নিদারুণ যন্ত্রণা!

রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“ভালোবাসি নিশা। তোমার সব কথা শুনেছি আমি। কিন্তু তুমি আমার কথা ভাবলে না। একবারও না। তুমি না! বড্ড সেলফিশ। কেনো এরকম করলে? তুমি জানো না? তোমাকে ছাড়া আমি একটা মুহূর্ত কল্পনা করতে পারতাম না, সেই তুমি আমাকে বাকিটা জীবন তুমিহীনা ছাড়লে। জানো? আত্মহত্যা যদি মহাপাপ না হতো, তবে তোমাকে একা ছাড়তাম না। আমিও চলে আসতাম তোমার কাছে।
আমার না! এখন কষ্ট হয়না। খারাপ লাগে না। প্রথম প্রথমের মতো অত কান্না আসে না। তবে এই যে বুকে। এই বুকের বা পাশটায় খালি খালি লাগে। মনে হয় কী জানো পাখি? তুমি গেছো, সাথে তুমিনামক প্রতিটি স্পন্দন নিয়ে গেছো। এই স্পন্দন গুলোতো তোমার নামেই ছিলো।
দিব্যি ঘুরছি, ফিরছি, খাচ্ছি, নিশ্বাস নিচ্ছি। কিন্তু… কিন্তু তুমি ছাড়া আমি? আমি নেই। আমার আমিটা নেই। আমিতো যন্ত্র হয় গেছি। তুমি কি ফিরে আসতে পারো না? আমি ভালো নেই তোমাকে ছাড়া। একটুও ভালো নেই। তবে আমি বেঁচে আছি কী করে জানো? আমাদের মেয়েকে দেখে। একদম তোমার মত হয়েছে। ভেবেছিলাম শুধু তোমার চেহারা পেয়েছে। নাহ্! অভ্যেস গুলোও তোমার মত। ওর মাঝে তোমাকে দেখি।
কিন্তু নিশা পাখি! তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য। ভেবেছিলাম তুমি আমার সুখপাখি। তবে তুমিই তো সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিলে। সমস্ত সুখ আমার জন্য হারাম করে, তুমি চলে গেলে। আফসোস রয়ে গেলো জানো? তোমার মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শোনার সৌভাগ্য আমার হলো না। এটা কতটা কষ্টের জানো? আমার সাথে না থাকতে পারলে কেনো আমার জীবনে এলে তুমি? শুরুতেই দূরত্ব ভালো ছিলো না? কেনো আসক্তি হয়ে গেলে আমার।
নিশা! ভালোবাসি তোমাকে। মৃত্যু তোমার হলো। মরণ যন্ত্রণা আমি অনুভব করছি। করতে করতেই ভালোবাসছি। শেষ নিশ্বাস অবদি ভালোবাসবো পাখি।”

​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​
তখনই পেছন থেকে নীরু দৌড়িয়ে এসে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। রুদ্র উত্তেজিত হয়ে হাতের ডায়েরিটা ডিভানের উপর ফেলে নীরুর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বললো, “কী হয়েছে আমার মামনিটার? এভাবে কাঁদছে কেনো?”

নীরু কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“পাপাই! মেরেছে ও আমাকে।”

“কে মেরেছে মামনি?”

“নিহান ভাই মেরেছে আমাকে।”

____________________
“অরু! আম্মু রেডি হয়ে নাও জলদি।”

“আম্মু! আব্বু যাবে না?”

“না সোনা। আব্বুর কাজ আছে তো।”

অরু মন খারাপ করে বসলো। রুশী এগিয়ে গেলো। মেয়েটা বড্ড জেদি। বয়স দশের কোঠায় নেমেছে। ভীষণ চঞ্চল। এই বয়সেই প্রচুর গান শোনে। গান গায়। সুযোগ পেলেই নিজের গিটার নিয়ে ছাদে গিয়ে গান গায় মেয়েটি। সিঙ্গার ‘এ জে’ এর বিশাল বড় ভক্ত অরু। এই ‘এ জে’ এর চেহারাতো দূরের কথা, নামটাও পুরোটা জানে না কেউ। আজ তারই একটা কনসার্ট আছে। আর প্রথম বারের মতো সেখানে, জনসম্মুখে আসবে সে। সেখানেই যাবার জন্য বায়না ধরেছিলো অরু।

অজ্ঞাত এক কারণবশত রুশী না করে দেওয়ায় তার বাবার কাছে বলেছে। সে রাজি হয়ে গিয়েছে। এজন্যই যাচ্ছিলো সবাই মিলে। কিন্তু হঠাৎ করে মারুফের কিছু কাজ পড়ে যাওয়ায়, সে যেতে পারবে না।

রুশী, অরুর দিকে এগিয়ে গেলো। চেহারায় একদম রুশী ছাপ পেয়েছে। তবে স্বভাবে অন্যরকম। রাগী, জেদি, গম্ভীর ও খানিকটা উষ্কখুষ্ক মেজাজের অধিকারিণী অরু। এসব তো সেই একজনেরই ছিলো।
রুশীর মাথায় খেলে না। দুজন মানুষের স্বভাবে এত মিল কী করে হয়?

“এখন কি যাওয়া ক্যানসেল?”

অরু এতক্ষণ অন্যদিকে মুখ ফুলিয়ে থাকলেও, এখন রুশীর দিকে তাকালো। ফুলো মুখেই বললো,“যাবো তো।”

রুশী হেসে দিয়ে বললো, “আসো, তবে জলদি রেডি করিয়ে দেই।”

চলবে..#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_৩৩ (উপন্যাসের উপসংহার —শেষাংশ)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

ঘড়িতে বাজে সন্ধ্যে সাতটা। অরু আর মুন্নিকে (মারুফের বোন) নিয়ে রুশী চলে এসেছে গন্তব্যস্থলে। রুশী এমনিতে সব জায়গায় যায়। তবে এখানে আসতে চাইছিল না। কারণ একটাই। ‘এ জে’ এর আজকের কনসার্টটি সেই ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যেটিতে রুশীর ফেলে যাওয়া স্মৃতি ও হারিয়ে যাওয়া এক অ-প্রেমিকের কাহিনী আছে। যেগুলো ছেড়ে রুশী এগিয়ে এসেছে বহু দূরে। এগারোটি বছর পেরিয়েছে। এগোবে না?

অরু আর মুন্নিকে নিয়ে রুশী পুরো ক্যাম্পাসটা ঘুরে এলো। শেষে গিয়ে তাকালো ঐ বকুল গাছ তলায়। হুট করেই তার মস্তিষ্কে কয়েক বছর আগের ঘটনা গুলো হুবহু চলে এলো। একসাথে তিনজনের আড্ডা দেওয়া, অয়নের গান গাওয়া, রুশীর দিকে প্রায়শই নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা, ঝগড়া,খুঁনসুটি সব তো এখানেই ছিলো। এখানেই তো! এখানেই তো না হওয়া এক কাহিনীর পরিসমাপ্তি টেনেছিলো রুশী। নিজ হাতে নিজের ভালোবাসার দাফন করেছিলো ঠিক এই জায়গাটিতেই। এখানেই তো রুশী চলে যাবার পর অয়ন কেঁদেছে। রুশী কিছুটা দুর গিয়ে যখন পিছে মুড়েছিলো, তখন অয়নকে কাঁদতে দেখেছে। রুশীর তো হৃদয়টা ছিঁড়ে যাচ্ছিলো।

নজর সরিয়ে নিলো। অরু তার মায়ের অশ্রুসজল নয়ন দেখে জিজ্ঞেস করলো,“আম্মু? তোমার খারাপ লাগছে? কান্না করছো কেনো?”

রুশী আলগোছে নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে হালকা হেসে বললো,“কিছু না সোনা। চলো ওদিকটায় যাই।”

মুন্নির এসবে পাত্তা নেই, মাত্র কল আসার দরুন সে ফোনে কথা বলতে ব্যাস্ত ছিলো।

তখনই অ্যানাউন্সমেন্ট শুরু হয়। কনসার্ট শুরু হবে এখনই। রুশী, অরুকে আর মুন্নিকে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। প্রচুর ভিড় এখানে।

চারিপাশে আলো থাকলেও স্টেজের দিকটায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। নিরবতা সবজায়গায়। ভিড় অনেক। তবে কথা নেই।

হুট করেই গিটারের সাউন্ড ভেসে এলো। সাথে এজে এর ভয়েসে সবার আকাঙ্খিত গান। সবাই তার তালে তালে গাচ্ছে—

এই অবেলায়, তোমারি আকাশে,
নিরব আপোষে ভেসে যায়।
সেই ভীষন শীতল ভেজা চোখ
কখনো দেখাইনি তোমায়।
কেউ কোথাও ভালো নেই যেন সেই,
কতকাল আর হাতে হাত অবেলায়?
কতকাল আর ভুল অবসন্ন বিকেলে
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।
সেই কবেকার ভায়োলিন,
বেজে যায় কতদিন
প্রানে চাপা ঢেউ, দেখেনি আর কেউ।

কখনো অভিমান, অবাধ্য পিছুটান
জানিনা কি কষ্টে এই অবেলায়।
তবুও নির্বাসন বাসর সাজিয়ে,
ঠোঁটে চেপে ধরা থাক ভালোবাসায়।

তখনই পুরো স্টেজ আলোকিত হয়ে গেলো। চারিপাশে সবার চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো। মুখে একটাই কথা। এ জে। স্টেজে দাঁড়ানো লোকটির দিকে তাকাতেই রুশী চমকিত হলো। চারিপাশে ভুলে এক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তেই চোখ দুটো ভিজে এলো তার। আজ কত বছর! কতো বছর হবে? আজ এগারো বছর পর তাকে দেখলো রুশী। সেখানেই দেখলো, যেখানে এই কাহিনীর সমাপ্তি হয়েছে। অয়ন চোখ তুলে নি। নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হালকা হাসলো। রুশীর বুকের বা পাশে চিনচিনে এক ব্যাথা হচ্ছে। হুট করেই নিজেকে অসুস্থ লাগছে। রুশীর অস্থির লাগছে। ভীষন। দৌড়িয়ে অয়নের কাছে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। ইশ! এমন লাগছে কেনো?

অয়ন আবারও গাওয়া শুরু করলো,

ঘুনে খাওয়া মেঘে কালো হয়ে যায় হৃদয় যখন
একা একা শুধু অকারণেই ঝরে বৃষ্টি এমন।
আজও তাই, অবাক রঙে এঁকে যাই
সাদাকালো রঙ মাখা ফানুসের মুহুর্ত রাঙাই।
ভীষণ কালো মেঘ,
পুড়ে ছাই আবেগে আজও তাই,
অবাক জোছনায় পোড়া চোখ তবুও সাজাই।

অয়ন পুনরায় থামলো। দৃষ্টি মাটি থেকে শূন্যে তুললো। হুট করেই চোখাচোখি হয়ে গেলো, অয়ন রুশীর। রুশীর চোখ দুটো ছলছল করছে। এদিকে অয়ন যেনো থমকে গিয়েছে। কথা নেই। গান গাচ্ছিলো যে সে, সেটাও ভুলে গিয়েছে।
খানিকক্ষণ ওভাবেই থেকে, রুশীর চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে আবারও বললো,

এই সন্ধ্যায়, দুচোখ সাগরে,
বুকের পাঁজরে ভেসে যায়।
অবাক জোছনায় লুকিয়ে রেখেছি
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।

সকলের হই হুল্লোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। অয়ন পাথরের মতো স্তব্ধ রুশীর পানে তাকিয়ে রয়েছে। রুশীও স্থান ত্যাগ করলো অতি দ্রুত। বুক ফেঁটে যাচ্ছে রুশীর। চলে গেলো অরুকে মুন্নির কাছে রেখে ক্যাম্পাসের পেছনের দিকটায়।

অয়ন নিঃশব্দে স্টেজের পেছনের দিক থেকে নেমে গেলো। সেও গেলো সেই বকুল ফুল গাছ তলার উদ্দেশ্যে। পেছন দিক দিয়ে গিয়েছে, বলে কেউ খেয়াল করেনি।
​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​
ভারী অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। শাড়ি পরিহিতা রুশীকে কি যে সুন্দর লাগছে! তা দেখে হালকা হাসলো অয়ন। অয়ন জুবায়ের তার পুরো নাম। সবার সামনে আসতে চায়নি বলেই শর্ট ফর্ম ব্যবহার করেছে। তবে… আজ সব লুকোচুরির অবসান ঘটালো। সেদিন অয়ন শহর ছেড়েছিলো। খালি পকেটে ঢাকা চলে গিয়েছিলো। মসজিদে থেকেছে। দিন মজুরের কাজও করেছে। এভাবেই এগিয়েছে। গানের প্রতি নেশা ছিলো। সেটাকে হাতিয়ার বানিয়েছে। এখন সে অনেক বড় যোদ্ধা। নামকরা সিঙ্গার। একনামে সবাই চেনে।

অয়ন রুশীর দিকে অগ্রসর হলো। কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে গেলো। দীর্ঘ এগারো বছর পর সে তার প্রিয় মানুষকে, উহু! প্রিয় মানুষ হতে হতে অন্য করো ঘরণী হয়ে যাওয়া সেই মেয়েটিকে ডাকলো,“রুশী!”

রুশী কেঁপে উঠলো। চোখের পানি সব মুছে নিলো। অতীতের সম্মুখীন হওয়া কি এতোই সহজ? রুশী নিজেকে ধাতস্থ করে পিছু মুড়লো।

দেখা হয়ে গেলো দুজনের? এতো সহজেই? দুজনের কারো মুখে কোনো কথা নেই। রুশী অয়নকে অবলোকন করলো। গায়ের উজ্জ্বলতা একটু হ্রাস পেয়েছে। চাপ দাঁড়িতেই যেনো অয়নকে সবচেয়ে সুন্দর লাগছে। চুলগুলো কপালের সামনে লেপ্টে আছে। পরনে সাদা শার্ট।

রুশী হাসলো। রুশীর সাদা রং খুব পছন্দ। এজন্য আগে থেকেই অয়ন এই রংটা বেশি ব্যবহার করতো।

রুশীকে হাসতে দেখে অয়ন নিজেও হাসলো। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে দুজন হাসলো। রুশী হুট করেই সব ভুলে গেলো। যেনো কিছুই হয়নি। ফিরে গেলো, সেই এগারো বছর আগে।

কথা বলতে চাচ্ছে রুশী। কিন্তু প্রচন্ড উত্তেজিত হবার দরুন প্রশ্নেরা সব আওলিয়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ বাদে রুশী শুধালো,“কেমন আছিস?”

অয়নের স্পষ্ট কথা,“যেমনটা রেখে গেছিস।”

রুশীর মুখের হাসি উবে গেলো। অয়ন আবারও বললো,“বিধ্বস্ত! এলোমেলো! নিঃস্ব! অপূর্ন।”

রুশী মাথা নিচু করে রইলো। কিছু বলার নেই তার। সে অন্যায় করেছে। ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই। দুজন নিঃশব্দে, হারিয়ে যাওয়া অতীতের উপহার দেওয়া এক সন্ধ্যে উপভোগ করছে। মাত্র একটা সন্ধ্যেই তো! এরপর আবারও আলাদা। দুজনের রাস্তা। দুজনের মন।

তখন সেখানে মুন্নি আর অরু চলে এলো। অয়নকে এভাবে দেখে মুন্নি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।

অরু দৌড়িয়ে বললো,“তুমি এ জে? রাইট?”

অয়ন হালকা হেসে বললো, “হ্যাঁ।”

অরু মিষ্টি হাসলো। অয়ন কপাল কুঁচকে ফেললো। সেই হুবহু মুখের অবয়ব। সেই হাসি। সেই চোখ। একবার রুশীর দিকে তাকালো অয়ন। পুনরায় অরুর পানে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি?”

“আমি অরু।” —বলেই অরু, রুশীকে জড়িয়ে ধরলো। রুশীও অরুকে এক হাতে জড়িয়ে অয়নের চোখে চোখ রেখে বললো,“আমার মেয়ে।”

অয়ন অবিশ্বাস্য নয়নে তাকালো রুশীর পানে। পরপর হালকা হাসলো। মনে মনে আওড়ালো, “অরু! অ রু!”

অরু বললো,“জানো? আমি আর আম্মু তোমার সব গান শুনি। আর আমিও গাই। তোমার মত সিঙ্গার হতে চাই।”

তখন মুন্নির ধ্যান ভাঙলো। এগিয়ে এলো অয়নের দিকে। সোজা জিজ্ঞেস করলো,“আপনি সিঙ্গেল?”

অয়ন বিষম খেলো। এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি কোনোদিন। হালকা হেসে বললো,“চৌদ্দ বছর আগেই একজন আমাকে বুক করে নিয়েছে। তার হয়েই আছি। বাকিটা আজীবন থাকবো।”

রুশী অশ্রুসজল নয়নে অয়নের পানে তাকালো। চৌদ্দ বছর আগে! হ্যাঁ, চৌদ্দ বছর আগেই তো ওদের প্রথম দেখা হয়েছিলো। অপ্রকাশিত ভালোবাসার, ভালোবাসাময় এক সময় ছিলো। দুটো আলাদা মন, এক হয়ে যাবার পথে ছিলো। কিন্তু হুট করেই এক দমকা হাওয়া এলো। দুটো মনকে এক হবার পথ থেকে, চিরতরে আলাদা করে দিলো। রুশী লুকিয়ে নিজের চোখের কার্নিশের অশ্রুকণা মুছে নিলো।

অয়নের কথা শুনে মুন্নি আফসোসের শুরে “ধ্যাৎ” বললো। সঙ্গে সঙ্গে আবারও বললো,“একটা অটোগ্রাফ দিন প্লিজ!”

নিজের ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে এগিয়ে দিলো অয়নের পানে। অয়ন অটোগ্রাফ দিলো। হয়তো আরো কিছু মুহূর্ত এদের দুজনের নয়নে নয়নে সাক্ষাৎকারের সময়সীমা রূপে বরাদ্দ ছিলো। এর বেশি তো নয়।

অতঃপর দুজনেই দুজনের রাস্তা মাপলো। আজ এতগুলো বছর বাদে দুজনের পুনরায় দেখা হয়েছিলো। কিন্তু রাস্তা আলাদা হয়েছে বহুবছর আগেই। কাজেই মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।

রুশী ভালো থাকুক নিজের সংসার নিয়ে। আর অয়ন নিজের গান নিয়ে। সব সম্পর্কের পূর্ণতা পায়না। কিছু সম্পর্ক অপূর্ণ-ই রয়ে যায়। এগুলো সুন্দর। একবুক দীর্ঘশ্বাস নিয়েও সুন্দর। মানুষটাকে একসময় ভালোবাসতাম। তার জন্য এখনও মনের কোণে কিছু একটা আছে। সেটা ভালোবাসা কি না জানিনা। এই টাইপের অনুভূতি গুলো দারুন হয়। তবে আজ অয়ন-রুশীর দেখা হওয়াটা কষ্টের ছিলো। কিছু অপ্রাপ্তি ছিলো। না হওয়া একটা কাহিনী ছিলো।

___________________
রুদ্র নীরুকে জিজ্ঞেস করলো, “কী করেছো তুমি?”

নীরু ঠোঁট উল্টিয়ে উত্তর দিলো,“কিছুই করিনি। আমিতো খেলছিলাম। তখনই নিহান ভাই এসে, আমাকে মারলো।”

ঠিক তখনই সেখানে নিহান এলো। নীরুর কথা শুনে বললো,“ছোট আব্বু! আমি তো আর এমনি এমনি মারিনি।”

“হুম অবশ্যই। কী করেছে ও?”

নিহান, নীরুর দিকে রাগী চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,“ও আবিরের সাথে খেলছিলো। ওকে বারবার মানা করেছি, অন্য কারো সাথে মিশতে। ও তাও আবিরের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করেছে।”

নীরু ফুঁপাতে বললো,“আমার যার সাথে ইচ্ছে হবে, আমি খেলবো। যার সাথে ইচ্ছে হবে, ফ্রেন্ডশিপ করবো। তোমার কথা কেনো শুনবো?”

“কারণ তুই শুধু আমার পরী। মাম্মাম তোকে ছোট বেলায়, একমাত্র আমার জন্য এনেছিলো। মাম্মানি তোকে, আমার কাছে রেখে গেছে।”—কথাটি বলেই নীরুর হাতে চিমটি কেটে সেখান থেকে দৌড়িয়ে চলে গেলো নিহান।

নীরু সেখানেই কাঁদতে লাগলো। রুদ্র মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হাসতে লাগলো।

ড্রয়িং রুমের সোফার কুশন গুলোর কাভার চেঞ্জ করছিলাম। পাশে আমার দুইমা বসে পান চেবোচ্ছে। মা এই বাড়িতেই থাকে। যেহেতু দীপ্তির বিয়ে হয়ে গিয়েছে আর ও ওর শ্বশুর বাড়িতেই থাকে। সেহেতু ফাঁকা বাড়িতে মায়ের একা থাকার মানে নেই।

তখনই নিহান দৌড়িয়ে এলো। আমার সামনে বললো, “মাম্মাম! মাম্মাম!”

আমি হাতের কুশনটা সোফায় রেখে বললাম, “হ্যাঁ বাবা, বলো।”

“মণি ফোন করেছে।”

“কথা বলেছো তুমি?”

“হ্যাঁ। তোমার সাথে কথা বলবে।”—কথাটি বলেই নিহান ওর হাতের ফোনটি আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি ফোন নিয়ে মুচকি হেসে কানে তুললাম।

ওপাশ থেকে দীপ্তি বললো,“কেমন আছিস আপু?”

“এইতো ভালো। তুই?”

“ভালো।”

“আদি কেমন আছে?”

দীপ্তি মুচকি হেসে বললো,“ভালো আছে রে। তবে প্রচুর দুষ্টুমি করে।”

“এই বয়সেই তো করবে। তাইনা?”

“হুম।”

“খেয়েছিস দুপুরে?”

“হ্যাঁ। তুই?”

“হ্যাঁ।”

“মা কেমন আছে?”

“ভালো। কথা বল নে।” —এটা বলেই ফোনটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিলাম। পাঁচ বছর আগে দীপ্তির বিয়ে হয়েছে। আমার সেই পিচ্চি বোনটাও এক বাচ্চা ছেলের জননী। দুই বছর আগেই মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করেছে।

সবার জীবনই পরিপূর্ণ। হ্যাঁ। অপূর্ণতার মাঝেও পরিপূর্ণ। তারা হয়তো নিজের প্রিয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলছে কিংবা কল্পনায় নিয়ে। ভালোবাসা কোথাও কম নেই। ভালোবাসা মানেই তো ভালোবাসা। এর আবার কম-বেশি হয় নাকি?

তবে, একটা কথা বলতেই হয়। “ভালো থাকুক সব ভালোবাসা পেয়ে যাওয়া মানুষেরা। না পাওয়ার যন্ত্রণা বড্ড পোড়ায়। আর পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা! সে তো ভস্ম করে দেয়।”

___________
গভীর রজনী। ছাদের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে আছি আমার ব্যক্তিগত চাঁদের সাথে। আজ পূর্ণিমা তিথি। চাঁদের আলোয় পরিবেশ মুখরিত। চন্দ্রবিলাস করছি দুজন। আরহানের নজর আকাশ পানে। আমার নজর উনার পানে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তাকে দেখতে যে বড্ড ভালো লাগে। শান্তি লাগে।

আরহান হুট করেই আমার দিকে তাকালেন। বড্ড অদ্ভুত সেই দৃষ্টি। অধর কোণে নেশাক্ত এক হাসি দৃশ্যমান।

আরহান এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন। আমার কোলে মাথা রেখে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লেন। মিষ্টি করে হাসলেন।

খানিকক্ষণ নীরব থেকে বলা শুরু করলেন,“তুমি আমার আঁধার জীবনের এক চিলতে আলো শুকতারা। তোমাকে কষ্ট দেবার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবি না। যদি ভুলেও কোনোভাবে কষ্ট পেয়ে যাও, তোমার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা আমার হয়। তোমার চোখের এক ফোঁটা অশ্রু পাতে আমার বুকের ঠিক এখানে (বুকের বা পাশে হাত রেখে) রক্তক্ষরণ হয়। তোমার ঠোঁটে হাসি দেখলে, হাজার বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগে। জানো শুকতারা? তোমাকে দেখলেই শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।”

আমি মুচকি হাসলাম। আরহানের মাথার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর মনের মাঝে একটা প্রশ্ন উঁকি দিলো। অত কিছু ভাবলাম না। প্রশ্নের মানেটা অবদি বুঝলাম না।

সঙ্গে সঙ্গে শুধালাম,“আপনি আমার থেকে কিছুই লুকোননি, তাইনা?”

আরহান চুপ মেরে গেলেন। এতক্ষণের হাস্যজ্জ্বল মুখটা নিমিষেই আঁধার কালো হয়ে গেলো। খানিক বাদে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলেন,“আমাকে বিশ্বাস করো তো?”

না ভেবে বলে দিলাম,“আপনার ভালোবাসার চেয়ে আমার বিশ্বাসের পাল্লা ভারী।”
আরহান বাঁকা হাসলেন। এভাবেই কাটলো আরো কিছু মুহূর্ত। অনেকটা সময় চোখ বুজে রইলেন। আমিও তার দিকেই তাকিয়ে আছি।

ভালোবাসা বড্ড অদ্ভুত। কেউ কেউ ভালোবাসি বলার আগেই আলাদা হয়ে যায়। কেউবা এক হয়েও একা ছেড়ে যায়। আর কেউ কেউ, মিথ্যে বলেও আজীবন পাশে রয়ে যায়। কিছু মিথ্যে নিয়েই থাকতে হয়। কিছু সত্য আড়ালে থাকাই শ্রেয়। সত্য তেতো হয়। সবাই তেতো সত্য গ্রহণ করতে পারে না।

এই যেমন আমিই। আরহান হয়তো ভেবেছেন, উনার কালো সত্যিটা জানিনা আমি। জানলে উনাকে মেনে নেবো না। দূরে সরে যাবো। তবে উনি কি জানেন? আমি সব জেনেও অবুঝের মতো থাকি। বহু বছর আগেই সব সত্যি আমার সামনে এসেছে।

জেনেছি উনিই সেই আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মাফিয়া কিং ‘এএকে’। আরহান আফসাদ খানকে, সবাই ‘এএকে’ নামেই চেনে। উনার উপর নজর রেখেছি। উনার সত্যিটা জানতে আদা জল খেয়ে নেমেছিলাম। এন্ড, ফাইনালি জানলাম। উনি রক্ত নিয়ে খেলেন। সেই হিংস্র ছায়া মানবটা আমারই প্রাণ প্রিয় স্বামী। ভীত হয়ে গিয়েছিলাম ভীষণ। উনার স্পর্শে শরীরের রক্ত টগবগ করতো। খুব করে চাইতাম, উনি যেনো বলেন, এসব উনি করেননি। কিন্তু এরকমটা হলো না।

সত্যিটা আমার কাছে আরো পরিষ্কার হলো। তবে, আমি এও জানলাম, উনি কোনো নির্দোষকে মারেননি। উনি কখনো কারো ক্ষতি করেননি। সমাজের কিছু নিকৃষ্ট কীটকে শায়েস্তা করেন। যদিও বেআইনি ভাবেই করেন। তবুও…
তৃষ্ণার সাথে আরহানের সাক্ষাৎ ও এই নিয়েই হয়েছিলো।

আমি হালকা হাসলাম। আরহান আমাকে হারানোর ভয় পান বলেই তো সত্য লুকোচ্ছেন। আচ্ছা! থাক না। কিছু সত্য গোপন থাকাই উচিত।

আমার ভাবনার মাঝেই আরহানের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

“কখনো ভুল বুঝোনা প্লিজ!”

মুচকি হেসে বললাম,“কখনো না।”

পুনরায় বললাম,“ভালোবাসি আপনাকে চাঁদ। ইশ! আমার স্বপ্ন এভাবেই পূরণ হলো! আমার ব্যক্তিগত চাঁদের শুকতারা হয়েছি আমি। ভাগ্য আমায়ও এমন এক প্রহর দিয়েছে, যেই প্রহরে আমি আমার ব্যক্তিগত চাঁদের সাথে চন্দ্রবিলাস করছি।”

আরহান হাসলেন। অতঃপর বললেন,“ভালোবাসা একটা নেশা। ভালোবাসার মানুষটি নেশাদ্রব্যের ন্যায়। তবে সময়ের সাথে মানুষের নেশা কেটে যায়। সেটা যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেনো। কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা অদ্ভুত। তুমি বড্ড অদ্ভুত, আমার অদ্ভুত আসক্তি।”
​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​
​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

•সমাপ্ত•

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here