#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৬
#তাশরিন_মোহেরা
টং এ বসে খুব আয়েশ করে চা খাচ্ছি আমি আর রূপক ভাই। সে নিয়েছে এক কাপ রঙ চা আর আমি নিয়েছি দুধ চা। টংয়ের ছাউনির আড়ালে বহু মানুষের গমন দেখছি আর টুকটাক কথা বলছি আমরা দুজন। টং এ চা খাওয়ার অপূর্ব অনুভূতি বোধহয় আর দুটোতে নেই। টং টার পেছনে দোকানদারের ঘর দেখা যাচ্ছে। আমি হালকা উঁকি মেরে দেখলাম মধ্যবয়সী একজন মেয়ে ভেতরে কাজ করছেন। দোকানদারের স্ত্রী হবেন বোধহয়। আমাকে উঁকি দিতে দেখে দোকানদার বেশ বিনয়ের সাথে বললেন,
‘আপনেরা হেইদিকে চাইয়েন না। দরজা নাই তাই ভিত্রে সব দেহা যায়।’
আমার খানিক লজ্জা হলো। এভাবে একটা মানুষের প্রাইভেসি নষ্ট করে দিলাম আমি। ভেবে খুবই খারাপ লাগলো। আমি এবার রূপক ভাইকে নিয়ে বিপরীতে বসলাম। এমন সময় ফোন বেজে উঠে আমার। হাতে নিয়ে দেখি আব্বার ফোন। চটজলদি ধরে বললাম,
‘জ্বি আব্বা, আসসালামু আলাইকুম।’
আব্বা সালামের উত্তর দিয়েই বললেন,
‘মা, তুই একটু এখনই বাসায় আসতে পারবি?’
আমি হাতঘড়িটা দেখে বললাম,
‘আব্বা, আমার তো ১২ঃ৩০ এ প্র্যাক্টিক্যাল আছে, জরুরি!’
আব্বা তখন ঘনঘন শ্বাস নিয়ে বললেন,
‘মা, আমার একদমই ভালো লাগছে না রে!’
আমি খুব ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আব্বার প্রেশারটা খুব সহজেই উঠানামা করে। আর তখন তিনি খুব বেশিই অস্থির হয়ে পড়েন। আমি তাড়া দিয়ে বললাম,
‘সুমি কি পাশে নেই আব্বা?’
‘আছে। কিন্তু আমার তাও কেমন যেন লাগছে রে! তুই একটু আয়, মা!’
‘ঠিক আছে, আব্বা! আমি এখনি আসছি।’
কল কেটেই আমি রূপক ভাইকে বললাম,
‘রূপক ভাই, আমি এখন আসি। আব্বার শরীরটা ভালো লাগছে না। ক্লাসটা আর এটেন্ড করা হলো না।’
রূপক ভাই বললো,
‘দেখিস কিন্তু! আঙ্কেল তো একটুতেই আবার অনেক অস্থির হয়ে পড়েন।’
আমি তাকে বিদায় দিয়ে সরাসরি একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি রওনা দিলাম। বাসায় এসে বারকয়েক কলিংবেল বাজালাম। পরপর পাঁচবার বেল বাজার পর সুমি (আব্বার অসুস্থতার জন্য রাখা মেয়েটি) দরজা খুললো। আমি তাকে ধমকে বলে উঠলাম,
‘কি হলো? দরজা খুলতে তোর এতো সময় লাগে?’
সুমি বিরক্ত হয়ে বললো,
‘আপনের বাপের ফায়ফরমাশ খাটতেই দেরি হইয়া গেছে।’
আমি ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম আব্বা আরামে বসে টিভি দেখছেন। সাথে আছে এক বয়াম মুড়ি। আব্বাকে দেখেই কোমড়ে দু’হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাশ থেকে সুমি ফোড়ন কাটলো,
‘আপনের আব্বার ইকটু গরম লাগতাছিলো। হেইল্লাইজ্ঞা টাইনা আপনারে লইয়া আনছে পড়া থাইকা। কেন যে এই মানুষটার কথা হুইনা-ই দৌঁড় দেন, আফা!’
এটুকু বিড়বিড় করতে করতে সুমি রান্নাঘরে চলে গেল। আব্বা আমার দিকে তাকিয়েই মুচকি হেসে বললেন,
‘মা, আজ একটু খিচুড়ি রাঁধিস! তোর খিচুড়ি খেতে আমার ভারী মন চাইছে।’
রাগে আমার মাথার রগ উঠানামা করলো কয়েকবার। আমার আব্বাটা এমনই! তার অতিরিক্ত ভালোবাসা আর আহ্লাদে আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। ঠিক এ কারণেই আমাকে একা রেখে ঠিক দশ বছর আগে আম্মা পালিয়ে যায় সুদুরে! সবকিছুতে আব্বার আহ্লাদ আর সন্দেহ আম্মাকে আমার কাছ থেকে দূরে পাঠিয়েছে। ব্যাপারটা তখন না বুঝলেও এখন ঠিকই বুঝি! মানুষটা আমার একটুও কদর করে না। শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবে! আমি হতাশ হয়ে গা এলিয়ে দিলাম সোফায়। মুহূর্তেই কান্না পেয়ে গেল আমার। কান্না পেলেও তা গলাতেই আটকে যায়। এতে অস্বস্তি আরও বেড়ে যায় আমার। আব্বা মানুষটা আমাকে এতো বছর আগলে রেখেছে তাই তার উপর রাগ দেখাতেও আমার সংকোচ হচ্ছে! নিঃশব্দে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম আমি।
জানালার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। বাইরের জনবহুল প্রকৃতিটাও আমায় ক্ষণে অস্থির করে তুললো। তাই বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিয়ে ভাবছি! জীবন কেন আমার সাথেই বারংবার নিষ্ঠুর হয়?
ছোটকাল থেকেই বাবা-মায়ের দ্বন্দ্বের মাঝে বড় হয়েছি। টানা দশ বছরের একটি দিনও এমন যায়নি যেদিন আমি আব্বা-আম্মার ঝগড়া দেখিনি। আব্বা সবকিছু নিয়েই মাকে সন্দেহ করতেন। মুখে বলতেন তিনি তাকে ভালোবাসেন বলেই নাকি সন্দেহ করতেন। আম্মা তখন বারবার একটা কথা-ই বলতেন, ‘আমি যদি আজ পরিবারের অবাধ্য হয়ে পালিয়ে বিয়েটা করতাম তবে আপনার মতো জঘন্য একটা মানুষের সাথে হয়তো আমার জীবন কাটাতে হতো না। আমি মুক্তি চাই! মুক্তি দিন আমায়।’
কিন্তু আব্বা মাকে মুক্তি দেয়নি। বরং দিন যত যেতে থাকে আব্বা হয়ে উঠে আরও উন্মাদ। আম্মার পালিয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি সর্বদা আম্মাকে আটকে রাখতেন একটা রুমে। বয়স বাড়তে থাকলে তিনি আমাকেও আটকে রাখতে থাকেন। একটা বদ্ধ ঘরে কেঁদেকেটে অস্থির হতাম তখন। আব্বাকে কতো ডেকেছি, ক্ষুধায় কাতরে মরেছি! কিন্তু আব্বা শোনেননি। তার সব ধ্যান ছিলো আম্মাকে নিয়ে! একদিন আব্বার স্বপ্ন সত্যি করে আম্মা ঠিকই চলে যান পালিয়ে। আমার বয়স তখন দশ ছুঁইছুঁই। আম্মা চলে যাওয়াতে আব্বা আমাকে ধরে অঝোরে কেঁদেছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে ফুলে উঠেছিলো। কিন্তু সেদিন একটিবারের জন্যও নিজের চোখ বেয়ে কান্না বের করতে পারিনি আমি। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে সব দেখেছি। কি করবো? আমার অনুভুতিরা যে তখন ক্ষয়ে গিয়েছিলো! বিলীন হয়েছিলো সময়ের গর্ভে।
চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রুপাত শেষমেশ করলাম। ফ্যানের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে ভাবছি, এ মুহুর্তে এই ফ্যানে নিজেকে ফাঁস দিয়ে দিলে কেমন হয়? কয়েক সেকেন্ডেই কেল্লাফতে! তবে আচমকা-ই আমার চোখে ভেসে আসে দুটি পরিচিত মুখশ্রী! মুগ্ধ আর মুখর। মনের কোথাও হঠাৎ বলে উঠে, ‘তিথি! এদের জন্য হলেও তুই বেঁচে থাক, আজীবন।’
নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে উঠি। খানিক লজ্জাও পেলাম। ক্ষণিকের দেখা সাক্ষাৎে এরা এতো আপন কবে হলো?পরক্ষণেই মুখরের উপর ভীষণ অভিমান হলো আজকের ঘটনা নিয়ে। ছেলেটা তাকে কথায় কথায় অপমান করে! সে কি এতো অপমানের যোগ্য আদৌও?
.
মুগ্ধের পড়ার রুমে ঢুকতেই দেখলাম মুখর পাশের রুমে মুগ্ধকে কিছু একটা নিয়ে ভীষণ কথা শোনাচ্ছে! আমি চুপচাপ মুখরের কথা শুনছি। সে মুগ্ধকে ধমকে বললো,
‘কি সমস্যা তোর? স্কুলে এতো কি করিস যে ডেইলি তোর স্কুলের জামাটা এতো ময়লা হয়? সাথে তো ব্যাগটারও নাজেহাল অবস্থা! প্রতিদিন তুই আমাকে তোর স্কুলড্রেস ধোয়াবি, মুগ্ধ?’
মুখর অনবরত প্রায় এক মিনিট বকবক করেছে। তার উত্তরে মুগ্ধ কিচ্ছু বলেনি। কিছুক্ষণ পর মলিন মুখে মুগ্ধ ফিরে আসে পড়ার রুমে। আমার সামনে বসতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি ব্যাপার, মুগ্ধ সাহেব? সাতসকালে বকা খেলেন যে?’
মুগ্ধ আগের মতোই বিরসমুখে বসে আছে। আমি বললাম,
‘বলবেন না?’
সে দুদিকে মাথা দুলিয়ে বোঝালো সে বলবে না। মুখরের বকা খেয়ে তার এতো পেট ভরেছে যে কথা-ই বের করতে পারছে না সে আর। আমি হালকা কেঁশে তাকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম,
‘আজ বোধহয় তোমার দিনটা-ই খারাপ যাবে, মুগ্ধ!’
সে বিড়বিড় করে ক্ষীণস্বরে বললো,
‘প্রতিদিনই খারাপ যায়।’
আমি কথাটা শুনেও তাকে কিছু বললাম না। কিছুটা খটকা লাগলো আমার। আজ বেশ চুপচাপ ভাবেই পড়েছে মুগ্ধ। বাড়তি কোনো কথা-ই সে মুখ থেকে বের করেনি। তার মন খারাপ দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো। সে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে যাবে, আমি তাকে খুশি করার জন্য বললাম,
‘আজও আমি তোমায় স্কুলে নিয়ে যাবো, মুগ্ধ! মজা হবে, তাই না?’
কিন্তু মুগ্ধের মুখের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে আগের মতোই মনমরা হয়ে বললো,
‘আচ্ছা!’
সে তৈরি হতে গেলে আমি তাকে মনে মনে বললাম,
‘তোমাকে মোটেও তোমার ভাইয়ের মতো চুপচাপ থাকাটা মানায় না, মুগ্ধ! তোমার ভাই তো একটা বোরিং মানুষ!’
তখনই রুমে ঢুকলো মুখর। আমার সাথে চোখাচোখি হওয়াতেই মনে মনে তওবা খেলাম। সে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে একবার দেখলো। মনে হলো যেন আমার মনের কথাটা তার কর্ণগোচর হলো। আমি ঘাবড়ে নড়চড়ে বসলাম। ছেলেটার চাহনিতে মাঝে মাঝে আমি খুব শিউরে উঠি! আজও তাই! যেন আস্ত গিলে খেয়ে ফেলবে কুমিরের মতো। আমি তাকে আরেকবার তীক্ষ্ণ চোখে দেখে মন মধ্যে বললাম,
‘নাহ! আপনি কুমির নন, আপনি হলেন পেঁচা।’#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৭
#তাশরিন_মোহেরা
মুগ্ধের স্কুল গেইটের সামনে আসতেই দেখলাম তার গতকালের বন্ধুগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে গেইটের ধারে। আমি একবার মুগ্ধের দিকে তাকালাম। সে এতোটা সময় ধরে একটা কথাও বলেনি। কেমন চুপসে গিয়েছে। মনে মনে প্রচন্ড রাগ হলো মুখরের উপর আমার। সকাল সকাল এমন করে বকতে হয় এটুকু একটা ছেলেকে? বেচারা এখনো কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। তার বন্ধুদের দেখেই মুগ্ধ থমকে যায়। এরা সামনে এগিয়ে এসে মুগ্ধের কাঁধ জড়িয়ে ধরে। তিনজনের একজন তার ব্যাগটা খুলে নেয়, অন্যজন তার মাথায় জোরে একটা চাপড় মারে। এরপর বলে,
‘কিরে বন্ধু? আসতে এতো দেরি করেছিস যে?’
মুগ্ধ কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তন্মধ্যে একজন আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আপু, আপনি এখন যেতে পারেন।’
এই বলেই ছেলেগুলো মুগ্ধসহ ভেতরে প্রবেশ করলো। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক হলেও আমার কেন যেন ভালো লাগলো না। সেদিনের মতো ব্যাপারটা নিয়ে আমি অতো ঘাটলাম না। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো এর পরের দিন। তাকে পড়াতে গিয়ে দেখলাম চোখের পাশে একটা গভীর ক্ষত। ঠোঁটের কোণেও আঘাত পেয়েছে সে। আমি ব্যস্ত কণ্ঠে বললাম,
‘কি হয়েছে মুগ্ধ? এমন করে ব্যাথা পেলে কিভাবে?’
সে আজও চুপ। তার এমন চুপসে যাওয়াটা আমার ভীষণ সন্দেহজনক লাগলো। এই ছেলে তো এমন চুপ করে থাকে না কোনো সময়! তবে আজ কেন? আমি মুগ্ধকে আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো, মুগ্ধ! বলো আমায় এভাবে ব্যাথা পেলে কেন? কেউ মেরেছে তোমায়?’
মুগ্ধ মাথা নিচু করে তার চেয়ারে বসে আছে। ক্ষীণ স্বরে জবাবা দিলো সে,
‘সিড়িতে নামার সময় পড়ে গিয়েছি।’
আমার এই উত্তরে মন ভরলো না। প্রতিদিন ছেলেটার কাপড় আর ব্যাগ নোংরা হওয়া, সাথে তার বন্ধুদের অদ্ভুত আচরণ আর এখন তার এমন আহত হওয়া এ সবকিছুই আমায় ভীষণ ভাবাচ্ছে। মুগ্ধ সত্যি বলছে না এটা তার আচরণ দেখে বেশ বুঝতে পারছি আমি। আমি এবার তার মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে বললাম,
‘স্কুলে কেউ তোমায় ডিস্টার্ব করছে? আমায় নির্দ্বিধায় বলতে পারো, মুগ্ধ! কিছু হলে আমি তোমায় সাহায্য করবো, সত্যি। আমায় একটু খুলে বলো কি হয়েছে তোমার? প্রতিদিন এভাবে চুপসে থাকো কেন ইদানীং? বলো বাবা, কি হয়েছে তোমার?’
মুগ্ধ হঠাৎ আমার হাতটা চট করে সরিয়ে দেয়। রক্তলাল চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েই চিৎকার করে বলে উঠে,
‘বলেছি তো সিড়িতে পড়ে ব্যাথা পেয়েছি। কিচ্ছু হয়নি আমার, বুঝেছেন?’
তার এমন আচরণে হঠাৎ আমার বুকটা কেঁপে উঠে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে মুগ্ধকে দেখছি। ছেলেটা এই ক’দিনে এমন পাল্টে গেল কি করে? মুগ্ধের চিৎকার শুনে ভেতর হতে মুখর দৌঁড়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হয়েছে মিস.তিথিয়া? মুগ্ধ! ম্যামের সাথে এ কি বেয়াদবি করছো তুমি? বড়দের সাথে এভাবে কেউ চিল্লায়? এ শিক্ষা দিয়েছি তোমায় আমি?’
মুগ্ধ এবার আগের চেয়ে দ্বিগুণ রাগ নিয়ে বলে,
‘এক কথা বারবার শুনতে আমার ভালো লাগে না! তারপরও কাল থেকে তোমরা এক প্রশ্ন বারবার করে যাচ্ছো আমায়। বললাম তো সিড়িতে পড়ে ব্যাথা পেয়েছি আমি। আমার বন্ধুরা আমাকে মারেনি, ওরা আমার কাপড়ে ময়লা পানি ঢালেনি, আমার ব্যাগ দিয়ে নিজেদের বেঞ্চ মুছেনি। তাও তোমরা আমায় বিশ্বাস করছো না কেন?’
মুগ্ধের কথায় মুখর এবার আমার দিকে ফিরলো। আমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। মুগ্ধ ভুলবশত সত্যি কথাটা বলে দিয়েছে। কথাগুলো বলতে বলতেই সে কেঁদে দিলো। মুখর তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। সে মুহুর্তে করুণ চোখে মুখর তাকায় আমার দিকে। মুখরের চোখে তখন ধরা দেয় একরাশ কষ্ট আর রাগের মিশ্রণ। মুগ্ধের কষ্ট সে সহ্য করতে পারছে না। অথচ এই ছোট ছেলেটা মনে মনে এতোকিছু সহ্য করে আসছে। স্কুলে তার উপর হওয়া নির্যাতনের কথা কাউকে বলেনি সে। মুগ্ধ শক্ত হতে জড়িয়ে ধরে আছে তার ভাইয়াকে। যেন হাত ফসকালেই দূরে চলে যাবে সে। সেকেন্ড খানেক কাটার পর মুখর বন্ধন ছিন্ন করে মুগ্ধকে চেয়ারে বসালো। আমি তার পাশে গিয়ে হাতে থাকা রুমালটা নিয়ে মুগ্ধের সামনে হাটু গেড়ে বসলাম। রুমালটা দিয়ে ভালো করে তার চোখ মুছে দিলাম। এরপরই তাকে আলতোভাবে জিজ্ঞেস করলাম,
‘স্কুলের ছেলেগুলো তোমায় বেশি ডিস্টার্ব করে, তাই না? ওদের আমরা উচিৎ শিক্ষা দেবো, বাবা! তুমি আর কেঁদো না।’
মুগ্ধের কান্নারা আজ বাধ মানছে না। বাধাহীন গড়িয়ে পড়ছে তার কপোল বেয়ে। তাদের আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে সে নাক টেনে যাচ্ছে। এরপর কাঁপা গলায় বলতে থাকে,
‘ওরা আমাকে অনেক মেরেছে, ম্যাম! অনেক! আমিও ওদের মারতে চেয়েছি কিন্তু ওদের তিনজনের কাছে আমি একজন হেরে গিয়েছি। ওরা প্রতিদিন আমার গায়ে কিছু না কিছু নোংরা জিনিস ফেলে, আমার ব্যাগ দিয়ে ফ্লোর আর নিজেদের ময়লা বেঞ্চ মুছে।’
মুগ্ধ এটুকু বলে আবারো বাধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙে পড়লো। বারবার চোখ মুছে যাচ্ছে দু’হাতে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। আমি মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুমি কেন আগে তোমার ভাইয়া বা আমাকে কিছু বলো নি?’
মুগ্ধ এবার বেশ কষ্টে তার কান্না থামিয়ে বললো,
‘ভাইয়া একবার আমাকে বলেছিলো ছেলেদের কখনো নিজের কষ্ট দেখাতে নেই। যা-ই হোক, মনে মনে সব সহ্য করে নেয় ছেলেরা। আমিও চেয়েছিলাম ছেলে হয়ে এমন কিছু করতে। ভেবেছি সবাইকে আমার কষ্ট বলে দিলে সবাই আমাকে লজ্জা দেবে। কিন্তু, ম্যাম জানেন? কষ্টগুলো নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা অনেক কঠিন। সবার সামনে না কেঁদে হাসাটাও অনেক কঠিন।’
ছেলেটার এমন কথা শুনে নিজের কান্নাদেরও থামাতে পারলাম না আমি। আপনাআপনিই তা চোখ বেয়ে নিচে পড়তে লাগলো। মুখরের দিকে একবার তাকাতেই দেখলাম সে গোপনে চোখ মুছছে। মুগ্ধকে গাট্টা মেরে সে বললো,
‘আমার কথাটা এভাবে মাথায় নিয়ে নিবি জানলে কখনোই এগুলো বলতাম না তোকে আমি। গাধা!’
মুগ্ধ এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কান্না নিয়েই বললো,
‘দেখলে তুমি এখন আমাকে লজ্জা দিচ্ছো, ভাইয়া! ম্যাম, এখন সবাই আমাকে লজ্জা দেবে।’
এই বলে সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতেই থাকলো। কান্নার মাঝেও ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘আমার ছাত্র খুব সাহসী! প্রাউড অব ইউ, মাই বয়।’
মুগ্ধ আরও কিছুক্ষণ কাঁদলো। একসময় কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। এই সকালবেলা ঘুমুতে দেখে ভাবলাম বেচারা হয়তো রাতে ভালো করে ঘুমুতে পারেনি। খুব মায়া হলো আমার! তাকে ঘুমাতে দিয়েই আমি বাগানের দিকে গেলাম। দেখলাম সেখানে আপনমনেই বসে আছে মুখর। আমি তার পাশে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে বসি। সেও আমার আশায় কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। কিছুক্ষণ আমাদের মাঝে এক গভীর নিরবতা বিরাজ করে। নিরবতা ভেঙে মুখরই বলে উঠে,
‘আমার কারণে মুগ্ধকে কতোটা কষ্ট পেতে হলো দেখলেন?’
আমি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে ফিরলাম। বললাম,
‘আপনার দোষটা কোথায়?’
মুখর প্রত্যুত্তরে বললো,
‘দেখলেন না, আমি তাকে ছেলে নিয়ে সব অদ্ভুত শিক্ষা দিতে গিয়ে সবটা মনের মধ্যেই সহ্য করে নিলো সে। আমি আসলে বড় ভাই হিসেবে ব্যর্থ!’
মুখর দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলো। আমি হঠাৎ হেসে দিলাম। হাস্যরসাত্মক কিছু হয়েছে এমন করে বললাম,
‘আপনি এখন বাচ্চার মতো কথা বলছেন, মুখর সাহেব। এখানে আপনার দোষ হতে যাবে কেন বলুন তো!’
মুখর গম্ভীরমুখে বসে আছে। ব্যাপারটা তাকে মানাচ্ছে ভীষণ! সে অনুশোচনায় ভুগছে। নিতান্তই বাড়তি অনুশোচনা! আমি আবারো তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আপনিও মনে মনে অনেক কিছু চেপে রেখেছেন, তাই না মুখর সাহেব? অনেক বেদনা, অনেক কান্না এবং হয়তো অনেক রাগ!’
মুখর আকাশের পানে চেয়ে বললো,
‘এটুকু বয়সের একটা ছেলের কাছে আর কিইবা আশা করছেন আপনি, মিস.তিথিয়া!’
আমি তার কথায় পাশ ফিরলাম। দেখি মুখর পলকহীন চেয়ে আছে ঐ পরিষ্কার আকাশটার দিকে। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলাম মুখরের সারা মুখজুড়ে ছোট ছোট কিছু কালো দাগ। এতে তার মায়া যেন আরও বেড়েছে। গায়ের রংটা একটু চাপা, কিন্তু সূর্যের ক্ষীণ আলোয় তার এই চাপা রঙটাও অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলেরা হালকা উড়ছে। আমিও তার মতো পলকহীন তাকিয়ে আছে তারই পানে। ধরা গলায় হালকা করে বললাম,
‘সুন্দর!’
মুখর এবার চোখ সরিয়ে আমার দিকে চাইলো সরাসরি। সাথে সাথেই যেন শিউরে উঠলাম আমি। সে জিজ্ঞেস করলো,
‘কিছু বলেছেন?’
মুখরের চোখে ভালো করে চোখ রাখতেই দেখলাম আজকের চাহনিটা মোটেও আগেরকার মতো নয়। বরং আজকের চাহনিতে আমি কোথাও যেন একগুচ্ছ কোমলতা খুঁজে পেলাম। তার চোখ দুটো সবসময়ই ঘুমঘুম মনে হয়ে আমার কাছে। যা এতোদিন বেশ বিরক্ত লাগলেও আজ ভীষণ ভালো লাগছে। মন চাইছে সারাটা দিন মুখরের চোখে চোখ রেখে বসে থাকি। মুখরের ডাকে এবার আমার সম্বিৎ ফিরলো,
‘মিস.তিথিয়া! কিছু বলেছিলেন?’
আমি পরক্ষণেই সামনে ফিরে অস্ফুটে বললাম,
‘যা বলেছি তা আপনার আপাতত না জানলেও চলবে, সাহেব!’
(চলবে)
(চলবে)
(সুখবর! পর্বটা পোস্ট করেই দিলাম। পাশে থাকবেন সবাই! আর মুখর-তিথিয়া জুটি কেমন লাগছে জানাবেন।❤️)