অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব -০৮+৯

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৮
#তাশরিন_মোহেরা

মুগ্ধের স্কুলের এসে প্রধান শিক্ষকের জন্য দাঁড়িয়ে আছি আমি আর মুখর। স্কুলের ছোট বাচ্চারা এভাবে অন্যদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবে আর তা মেনে নেওয়া হবে এ তো ঠিক না! আজ দুজন মুগ্ধের সাথেই স্কুলে এসেছি। মুখর আমাকে আসতে বারণ করলেও আমি এসেছি। আর যা-ই হোক, মুগ্ধ আমার আদরের ছাত্র। তার সাথে স্কুলে এমন অপ্রীতিকর ঘটনার পরও আমি চুপ করে বসে থাকতে পারিনা। মুগ্ধের ক্লাসে গিয়ে ছেলেগুলো সম্বন্ধে জেনেছি। এই ছেলেগুলো নাকি ক্লাসের অনেকের সাথেই এমনটা করে। অকারণে মারামারি, ক্লাসে মজা করার নামে ক্লাস নোংরা করা, গালাগাল দেওয়া এসব তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। শুনে ভীষণ খারাপ লাগলো আমাদের। এরা এমন একটা পরিবেশ তৈরি করেছে ক্লাসে যে এদের জন্য অন্যদের উপরও একটা খারাপ প্রভাব পড়ছে। উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ খুবই দরকার। নয়তো এরা বিভিন্ন ভাবে খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে যা থেকে পরবর্তীতে মুক্ত হওয়া অসম্ভব।
ছেলেগুলোর কাছ থেকে তাদের অভিভাবকের ফোন নাম্বার নিয়ে তাদের আসতে বললাম। অভিভাবক ছাড়া এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ হবে না।

বেশ খানিকক্ষণ পর, প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করার সুযোগ মিললো আমাদের। আমি আর মুখর রুমে ঢুকেই দেখলাম একজন আধবুড়ো লোক বসে আছেন তার চেয়ারে। চেহারাতে বেশ একটা সুশীল ভাব ফুটে উঠেছে। মুখে আছে একগুচ্ছ সাদা দাড়ি। আমাদের ঢুকতে দেখেই তিনি লম্বা একটা হাসি দিলেন। বেশ প্রাণবন্ত সেই হাসি, যা দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল দুজনের। আমরা একটা সালাম দিয়ে তার ইশারায় সামনে বসলাম। মুখর হাত বাড়িয়ে বললো,

‘হ্যালো, আমি মুখর শিকদার।’

প্রধান শিক্ষকও কুশল বিনিময় করে বললেন,

‘আমি আজিজুর ইসলাম।’

এরপর তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,

‘হ্যালো, মিসেস.মুখর!’

আজিজুর সাহেবের মুখে ‘মিসেস.মুখর’ শব্দটি শুনেই ক্ষীণ চমকালাম আমি। তড়িৎ পাশ ফিরি, দেখি মুখরও একই ভাবে চমকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।মানুষটা আমাদের বিবাহিত দম্পতি ভাবছেন। আমি বুঝতে পারলাম না আজিজুর সাহেবকে তার ভুলটা সংশোধন করে দেওয়া উচিৎ কি না! মুখরকে দেখেও বুঝলাম সেও একই ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে। ব্যাপারটা আর না ঘেটে আমি অপ্রস্তুত এক হাসি হাসলাম। তাকে বুঝালাম আমরা আসলেই দম্পতি। ব্যাপারটা ভীষণ অস্বস্তিকর হলেও এই পরিস্থিতিটা মোটেও ভুল শোধরানোর মতো নয়! আজিজুর সাহেব এবার সরাসরি কাজের কথায় চলে গেলেন। ব্যাপারটা তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পর তিনি বেশ আহত হলেন বলে মনে হলো। আহত সুরেই বললেন,

‘আমি স্কুলটাকে ভীষণ ভালোবাসি। স্কুলের সকল শিক্ষার্থীদের ভালোবাসি। আমি কখনোই চাই না কচি এসব ফুলগুলো অকালেই ঝরে যাক। কিন্তু দিনশেষে আমি হয়তো ব্যর্থ।’

এরপরই তিনি আশ্বাসের সুরে বললেন,

‘আপনারা চিন্তা করবেন না মি. এন্ড মিসেস.মুখর। আমরা এখন থেকে আরও সতর্কতার সহিত ব্যাপারগুলো দেখবো। আমাদের উপর একটু আস্থা রাখবেন।’

আমরাও টুকটাক কথা বলে বেরিয়ে পড়লাম। তবে বেরিয়েই মুখর এবং আমি দুজনেই দুজনের দিকে অস্বস্তির চাহনিতে চেয়ে রইলাম। চোখাচোখি হতেই অস্বস্তিটা আরও গাঢ়তর হলো। মুখর ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললো,

‘বলেছিলামই তো না আসতে। তাও আসতে গেলেন কেন?’

আমি চুপচাপ মুখরের পাশে হাটছি। বাইরে হিমেল হাওয়া বইছে। সে হাওয়ায় বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে পরিবেশ। আমার মনটাও হুট করে ফুরফুরে হয়ে উঠলো। আমি মনে মনে বললাম,

‘বেশ করেছি এসেছি, মুখর সাহেব। এসেছি বলেই তো আপনার পাশে এভাবে হাঁটতে পারছি। পরিবেশটা সুন্দর নাহ? হ্যাঁ! পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর, সাথে আপনিও!’

.

পড়ার টেবিলে বই খুলে বসে আছি। একগাদা প্র‍্যাক্টিক্যাল পড়ে আছে। কিন্তু হাত চলছে না কিছুতেই। মনটা অন্য কোথাও পাড়ি জমিয়েছে। অদ্ভুত এক কল্পনায় সে উড়ে বেড়াচ্ছে ইদানীং। কল্পনার আনাচে কানাচে শুধু মুখরই বিরাজ করছে। মুহুর্তেই লজ্জা লাগছে আবার মুহুর্তেই রাগ! মুখরকে নিয়ে এলোপাতাড়ি ভাবনারা আমায় বারবার জানান দিচ্ছে যে আমার তার প্রতি একটা মোহ জন্মেছে। আর এ মোহ কতদূর যায়, তা-ই দেখার বিষয়। কিন্তু আমি কিছুতেই মানুষটার মুখশ্রী আমার চোখ থেকে সরাতে পারছি না। এদিকে আমার কানে একটাই শব্দ বেজে যাচ্ছে কিছুদিন ধরে, ‘মিসেস.মুখর!’
ইশ! কি লজ্জার কথা! বিবেকটা হঠাৎ সচল হলো। বললো, ‘এসব কি আজেবাজে চিন্তা করছিস, তিথিয়া! ছেলেটা তোর ছাত্রের ভাই। আর তার বয়স দেখেছিস? তোদের মধ্যাকার ব্যবধান পাক্কা সাত বছর! অথচ, তুই কিনা তোর সমবয়সী কাউকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখেছিলি! ওসব কই গেল, হ্যাঁ? বল!’

আমি সাথে সাথেই বিড়বিড় করলাম,

‘সে অনেক কাল আগের কথা। এখন আমার এই সাত বছরের বুড়ো পেঁচাকেই চাই!’

কথাটা বলে আপনাআপনি লজ্জায় ডুব দিলাম। পড়ার টেবিল থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে লজ্জায় গড়াগড়ি করলাম কিছুক্ষণ। ক্ষণেই আবার জানালার ধারে গিয়ে আকাশ কুসুম ভাবতে লাগলাম। তবুও কোথাও মন টিকলো না। লোকে বলে, প্রথম প্রেমানুভূতির লগ্নে কিছুই যেন ভালো লাগে না। হাঁসফাঁস লাগে, অস্থির লাগে। কথাটা হারে হারে টের পাচ্ছি আমি। মাথায় চাপড় মেরে নিজেকে বললাম, ‘তুই গেছিস, তিথি! গঙ্গায় ভেসেছিস তুই!’

.

কিছুদিন পর,

মুগ্ধকে পড়ানো শেষ করে বসে আছি। সে স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে। এখন থেকে প্রতিদিনই সে আমার সাথে স্কুলে যায়। বেশ একটা সময় কাটে রাস্তায় আমার মুগ্ধের সাথে। কতো শত আবদার আর প্রশ্নবিদ্ধ যে হতে হয় ঐটুকু একটা ছেলে হতে। এখন আর দুষ্টু ছেলেগুলো আমার ছাত্রকে ডিস্টার্ব করে না। এমন এক শিক্ষা পেয়েছে, সাত জন্মে আর এসব করার সাধ্যি নেই এদের!

তখনি দেখলাম, মুখর পড়ার রুমের সামনে অদ্ভুতভাবে পায়চারি করছে। আমাকে যেন কিছু বলতে চায়! আমিও অধীর আগ্রহে বসে আছি মুখরের কথা শোনার জন্য। কিন্তু সে একবার রুমের সামনে আসছে পরক্ষণেই আবার পেছন ফেরে নিজের রুমে চলে যাচ্ছে। বারকয়েক সে এরকমই করলো। আমি এবার আর বসে থাকতে না পেরে বললাম,

‘মুখর সাহেব, কিছু বলবেন?’

মুখর খানিকক্ষণ ইতস্তত করার পর আমার সামনে আসলো। হাতে আছে একটা টাই আর তার ফোন। আমি উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছি। আমি ভ্রুকুটি করে বললাম, ‘কি হয়েছে?’

সে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বললো,

‘টাই বাঁধতে পারছি না। ইউটিউব দেখে কয়েকবার চেষ্টা করলাম তাও হলো না।’

আমি তার দিকে চেয়ে বললাম,

‘আপনি এইটুকু একটা ব্যাপার আমাকে আগে বলতে পারলেন না?’

সে ঈষৎ লজ্জা পেল। আমিও কাঁপা হাতে তার টাইটা নিলাম। কাছে গিয়ে টাইটা মুখরের কাঁধে জড়িয়ে দিলাম। আমার হাতখানা খানিক কাঁপছে। এই ক’টা মাসে মুখরের এতো কাছে আমি কখনো যায়নি। শুধু মুখর কেন? আমার একুশ বছরের জীবনে কোনো ছেলের এতো কাছে যাওয়ার সুযোগই কখনো হয়নি। আর এখন? নিজের পছন্দের মানুষের ঠিক মুখোমুখি, খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবতেই সর্বাঙ্গে শিউরে উঠলো। মুখরও আমার মতোই খানিক ইতস্তত করতে লাগলো। তার নিশ্বাস আমার চুলে পড়ছে। তাতেও আমি ক্ষীন কেঁপে উঠলাম। ছেলেটাকে দেখতে অতোটা লম্বা না লাগলেও সে আমার থেকে বেশ খানিকটা লম্বা! আমি টাইটা ঠিক করেই মাথাটা উপরে তুলতে গিয়ে মুখরের থুতনিতে হালকা বারি খেলাম। ক্ষীণ ‘উহুঃ’ শব্দ করলাম। তখনই মাথায় কারো আলতো স্পর্শ অনুভব হলো। পাশে তাকিয়ে দেখি মুখর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বেশ সাবধানে। আলতো করে বললো,

‘বেশি ব্যাথা পেয়েছেন?’

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েই খেই হারিয়ে ফেলি। মানুষটা বারবার আমাকে এতো অবাক করছে কেন? মুখরকে কখনো তো এমন কোমল হতে দেখিনি আমার প্রতি! তবে আজকে এ কেমন চাহনি তার? আমি লোভে পড়ে মাথা দুলিয়ে বুঝালাম ব্যাথা পেয়েছি। এতে সে মাথাটা আরো আলতো করে বুলিয়ে দিলো। কাঁপা গলায় বললো,

‘সরি!’

তার দুঃখিত বলাটা আমার যেন বহু আকাঙ্ক্ষিত কিছু মনে হলো। মাথা নিচু করে তার আদরটুকু নিয়ে নিলাম সন্তপর্ণে। কখনো কিছু নিয়ে লোভ হয়নি আমার। তবে ছেলেটার হাতে পাওয়া ভালোবাসার লোভ আমায় চেপে ধরেছে এখন! আমি এখন একজন লোভী মানুষ। ভীষণ লোভী!
এমন সময় পেছন থেকে কারও আওয়াজে চমকে উঠলাম দুজনেই। কিছুটা চিৎকার করে বললো আগন্তুক,

‘মুখর, কি করছো তুমি?’#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৯
#তাশরিন_মোহেরা

আগন্তুকের চিৎকারে আমি আর মুখর চমকে তাকাই। মুখর সামনে এগিয়ে উৎফুল্ল চিত্তে বলে উঠে,

‘রূপন্তী, তুমি?’

আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি ভার্সিটির সেই বড়লোকের দুলালি সিনিয়র রূপন্তী। যাকে কিছুদিন আগে একগাদা এসাইনমেন্ট করে দিয়েছি আমি আর রূপক ভাই। রূপন্তীকে দেখেই আমার ঠোঁটজোড়া একে অপর হতে আলাদা হয়ে গেল। সাথে আমার বুকটা আচমকা দ্রিমদ্রিম গতিতে বাজতে লাগলো। এই সিনিয়র আপু মুখরের বাড়িতে কি করে? মুখরই বা একে চেনে কিভাবে?

রূপন্তী মেয়েটাও আমাকে দেখে ভীষণ রকমের চমকালো। আমার দিকে তেড়ে এসে বললো,

‘এই মেয়ে, তুমি? তুমি এখানে কি করো?’

মুখর তার পেছন পেছন এসে বললো,

‘রূপন্তী, তুমি উনাকে চেনো?’

রূপন্তী এবার মুখরের দিকে ঘুরে আহ্লাদ নিয়ে বলতে থাকে,

‘হ্যাঁ, মুখর। এই মেয়েটা আমাদের ভার্সিটিরই। জানো মেয়েটা আমার সাথে অনেক বেয়াদবি করেছে, আমায় যা তা বলেছে!’

মুখর আমার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমি বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি রূপন্তীর দিকে। মেয়েটা পেয়েছেটা কি হ্যাঁ? একে তো আমার আর মুখরের রোমাঞ্চকর মুহুর্তটা নষ্ট করেছে তার উপর এখন আমাকে মুখরের সামনে খারাপ বানাতে চাইছে! রাগে শরীর গিজগিজ করছে আমার। মেয়েটা মুখরের পাশ ঘেঁষে তার এক হাত জড়িয়ে পূর্বের মতো আহ্লাদ নিয়ে বললো,

‘মুখর, এই মেয়েটা তোমার ঘরে কি করছে? মেয়েটাকে তুমি কিভাবে চেনো? ওকে এখনি এখান থেকে পাঠিয়ে দাও। মেয়েটা নিশ্চয়ই তোমার সাথেও খুব বেয়াদবি করেছে!’

মুখর প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। আমার রাগটা আরও বাড়লো। মুখর কি বুঝছে না মেয়েটা আমাকে নিয়ে যা তা বলছে! আমি কখনোই মুখরের কথার উপর কথা বলিনি এটা কি মুখর দেখেনি? তবে কেন কিছু বলছে না মুখর? নিজের মুখে নিজের কথা বলতে তো আত্মসম্মানে লাগে না কি! হাত দুটো মুট করে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি মুখরের পানে। কিন্তু কি অদ্ভুত! ছেলেটা একটাবারের জন্যও আমার দিকে দেখলো না। যেন তার সামনে আমার মতো কোনো জনপ্রাণীই নেই। রূপন্তী মুখরকে তার সাথে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

‘চলো, মুখর! আমার বাইরে কোথাও ঘুরে আসি। পাপা তার কারটা আজকের জন্য আমাকে দিয়েছেন। তাই আমিও চলে এসেছি তোমার সাথে ঘোরার জন্য।’

মুখর ইতস্তত হয়ে কিছু একটা বলতে চাইলেও রূপন্তী তাতে বাধ সেধে বললো,

‘আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না, মুখর। তুমি আমার সাথে যাবে, এটাই শেষ কথা।’

এ বলেই দুজন বেরিয়ে পড়লো। তাদের আহ্লাদ দেখে তাচ্ছিল্য করে হাসলাম আমি। এরা কি নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা? সাতসকালে এমন আহ্লাদ করতে বাঁধছে না এতো বড় দুই নর-নারীর? মুগ্ধ তখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিরক্তিতে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে সে বলে উঠলো,

‘মেয়েটা আবার এসেছে! উফ! ভালো লাগে না।’

আমি মুগ্ধকে তাড়া দিয়ে বললাম,

‘চলো, এবার তুমিও বেরিয়ে পড়ো। স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে যে!’

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মুগ্ধকে আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘মেয়েটাকে তোমরা কিভাবে চেনো, মুগ্ধ?’

মুগ্ধ সামনে তাকিয়েই বললো,

‘কোন মেয়েটা? ঐ রূপন্তী আপুকে?’

আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম,

‘হুম!’
‘আমরা আগে ওদের প্রতিবেশী ছিলাম। মেয়েটা সারাক্ষণ আমাদের বাসায় এসে বসে থাকতো আর মুখর ভাইয়াকে ডিস্টার্ব করতো। সবসময় ভাইয়ার পেছন পেছন ঘুরতো। এখনো ঘুরে, কি বিরক্তিকর! কি ঢং করেই না ভাইয়ার সাথে কথা বলে!’

আমি মাথা নিচু তার কথাগুলো শুনতে লাগলাম। কিছুই ভালো লাগছে না! মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেছে আমার। মুগ্ধ আমার দিকে ফিরে হঠাৎ উৎসুক হয়ে বললো,

‘ম্যাম, আমার কি মনে হয় জানেন?’

আমি বিরসমুখে বললাম,

‘কি?’

সে বিজ্ঞদের মতো দু’হাত ভাঁজ করে বললো,

‘আমার মনে হয়, মেয়েটা ভাইয়াকে পছন্দ করে। সবসময় ভাইয়ার পেছনে ঘুরে, ভাইয়াকে নিয়ে এখানে ওখানে যায় আরও কত কি!’

মুগ্ধের কথাটা শুনে হঠাৎ ভীষণ রাগ হলো। মনের বিতৃষ্ণাটা আরও বেড়ে গেল। বিষাদে ভরা মন নিয়ে শরীর আর চলতে চাইলো না। এ মেয়ে এসে আমার কাছ থেকে মুখরকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে! মুহুর্তেই আমার কান্না পেয়ে গেল ভীষণ! আমার সাথেই কেন বারবার এমনটা হয়? জীবনে একজনকে দেখে আমার মন মাঝে প্রজাপতি উড়া শুরু হয়েছিলো, আর এখন? এ মেয়ে এসে এক এক করে আমার সব প্রজাপতিদের ছিঁড়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিচ্ছে!

ভাবনার মাঝপথে মুগ্ধ ডেকে উঠলো। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল আমার। পাশে তাকাতেই দেখলাম মুগ্ধের স্কুলে চলে এসেছি। স্কুল মাঠে খেলছে তার সেই খারাপ সহপাঠীরা। এখন অবশ্য এদের খারাপ বলা যায় না! আগের চেয়ে বেশ শুধরেছে! মুগ্ধকে আসতে দেখে এরা মুচকি হাসলো। মুগ্ধও তাদের হাত
নাড়িয়ে ‘হাই’ জানালো। মুগ্ধকে বিদায় দিয়ে চলে যেতে নিলেই সে আমার কাপড় টেনে ধরে হালকা। আমি তার দিকে ফিরি। সে আমাকে ইশারায় আমার কানটা বাড়িয়ে দিতে বললো। ফিসফিস করে বললো,

‘ম্যাম, আমি কি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?’

কি নিঃসংকোচ আবেদন তার! গোমড়া মুখে এবার আমার হাসি ফুটলো। তার এই আবেদনকে না করা যায় না। তাই হাত দুটো দু’দিকে প্রসারিত করে ইশারায় হ্যাঁ জানালাম। মুহুর্তেই মুগ্ধ ঝাপটে পড়লো আমার বাহুতে। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,

‘আমার মুগ্ধ তো দেখছি হঠাৎ আবার বাচ্চা হয়ে গেল!’

মুগ্ধ আদরের সহিত আমাকে জানালো,

‘ম্যাম, আপনাকে হাসলে খুব সুন্দর লাগে। আর গোমড়া মুখে একদম খারাপ! আমার মতো সবসময় হাসবেন, কেমন?’

মুগ্ধের কথা শুনে কান্নারা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইলো আমার। এমন আদুরে উক্তি শুনেছি আজ বহুদিন হলো! পৃথিবীতে তবে কেউ একজন আছে যে আমার খারাপ লাগাকে প্রাধান্য দেয়! আমার মুখে হাসি ফোটাতে সে আদরে জড়িয়ে ধরে আমায়। আমি মুগ্ধের গালটা দু’হাতে আকড়ে ধরে বললাম,

‘তুমি কি জানো, মুগ্ধ? এ মুহুর্তে তোমায় আমার বড় ভাই লাগছে। খুবই কুল একজন বড় ভাই!’

মুগ্ধ তার নাকটা হালকা টেনে বুক ফুলিয়ে বললো,

‘দেখতে হবে না স্টুডেন্টটা কার?’

আমি তার সামনের চুলগুলোতে বিলি কেটে হেসে উঠলাম বেশ শব্দ করে। পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় কোনো ছোট ভাইবোনের সঙ্গ কখনো অনুভব করিনি। তবে এই কয়মাসে সে অনুভুতিটাও বেশ উপভোগ করছি! এই ছেলেটা যেন আমার রক্ত সম্পর্কের ভাই থেকেও হাজার গুণ বেশি দামি! তাই একে আমি মন কুঠিরে বেশ সযত্নে আগলে রাখতে চাই। যাকে কখনোই হাতছাড়া হতে দেবো না!

.

মুখর আজ বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। মুগ্ধের কাছ থেকে জানলাম গতকাল রূপন্তী তাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে অনেক ভাজাপোড়া খাইয়েছে। যেহেতু মুখরের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে তাই খাবারে একটু অনিয়ম হলেই তার পেটব্যথা শুরু হয়ে যায়। যা এ মুহুর্তে ভোগ করছে সে। গতকাল রাতে এসেই ঔষধ না খেয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। কাল মধ্যরাত থেকেই যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। মুখরের অসুস্থতার কথা শুনতেই আঁতকে উঠলাম আমি। তার রুমে গিয়ে দেখি সে পেটে এক হাত আর মাথায় আরেক হাত দিয়ে চোখ মুখ খিঁচে শুয়ে আছে। ঘাম ছুটছে তার শরীর বেয়ে। মুগ্ধ তার পাশে বসেই কাঁদোকাঁদো হয়ে আমাকে বলছে,

‘ম্যাম, মুখর ভাইয়ার কিছু হবে না তো? রাতে অনেক কেঁদেছে ভাইয়া!’

মুখর অস্ফুটে বলছে,

‘আমি কাঁদিনি, মিস.তিথিয়া! ওর কথা শুনবেন না।’

এ মুহুর্তে কথাটা বলা কি এতোই জরুরি? ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেল না! যন্ত্রণায় মৃতপ্রায় অবস্থা অথচ দাঁতে দাঁত চেপে তা সহ্য করে যাচ্ছে। মুখ ফুটে কিছু বলছেই না! তার এমন কান্ডে হাসবো না কাঁদবো বুঝলাম না। আমি মুখরের পাশে গিয়ে তার মাথায় হাত দিতে যাবো তখনি থমকে গেলাম। এর আগে কখনো মুখরকে আমি ছুঁয়ে দেখিনি। তাই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বেশ সংকোচ লাগছে আমার। পরক্ষণেই চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে মুখরের মাথায় বিলি কেটে দিলাম। মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কিছু খেয়েছে?’

মুগ্ধ মলিন মুখেই বললো,

‘যা খাচ্ছে সবই বমি করে দিচ্ছে, ম্যাম! এসব কিছুই ঐ রূপন্তী আপুটার জন্য হয়েছে। আমার ভাইয়াকে কি খাইয়েছে কি জানি?’

পরের কথাগুলো বেশ রাগ নিয়ে বললো মুগ্ধ। বোঝা-ই যাচ্ছে মুগ্ধও ঠিক আমার মতোই মেয়েটাকে ঘৃণা করে। মন মাঝারে আমিও ঐ রূপন্তীকে বেশ বকলাম। আর যা-ই হোক, মুখরের অসুস্থতা সহ্য হবে না আমার পক্ষে। আমি চটজলদি রান্নাঘরে গিয়ে বহুকষ্টে একটা ভেজিটেবল স্যুপ বের করলাম। তা গরম গরম রেঁধে মুখরের সামনে নিয়ে গেলাম। কিন্তু মুখর স্যুপটা দেখেই বাচ্চাদের মতো আকুতি করলো,

‘আমি খাবো না, মিস.তিথিয়া। প্লিজ নিয়ে যান।’

মুগ্ধ আমার দিকে চেয়ে করুণ সুরে বললো,

‘ভাইয়া স্যুপ একদমই পছন্দ করে না, ম্যাম। তারউপর ভেজিটেবল স্যুপ বলে কথা!’

আমার হাসি পেল। এমন শক্ত খোলসে আবদ্ধ করে রাখা মানুষও অনেক সময় বাচ্চার মতো শুরু করে! আমি স্যুপটা ফু দিয়ে ঠান্ডা করতে করতে বললাম,

‘কাল থেকে পেটে অনেক কিছু পড়েছে আপনার। তাই এমন খারাপ লাগছে। কিন্তু এই ভয়ে কিছু না খেয়ে বসে থাকলে তো শরীর আরও খারাপ হবে। এইটুকু স্যুপটি খেয়ে নিন, এরপর ঔষধ খেয়ে নেবেন।’

মুখর তার মাথার উপর বালিশ গুঁজে কিছুটা গুঙিয়ে বলে উঠে,

‘প্লিজ, আমি স্যুপ খেতে পছন্দ করি না, মিস.তিথিয়া। কেন বুঝছেন না?’

পরপরই পেটব্যথায় গুঙিয়ে কেঁদে উঠলো মুখর। মুখরের এই অযথা জেদ আমার একদমই ভালো লাগছে না। তাই ধমকের সুরে বললাম,

‘মুখর সাহেব, জেদ দেখাবেন না। আপনার সুস্থতা নিশ্চিতের জন্যই স্যুপটা আপনার খেতে হবে। দেখি, উঠে বসুন, বসুন বলছি!’

আমার ধমকে কিছুটা রয়েসয়ে উঠে বসলো মুখর। তার চুলগুলো ভীষণ অগোছালো হয়ে আছে। ঠোঁটটা শুকিয়ে কাঠ আর চেহারাটাও এই একরাতে কেমন খারাপ হয়ে গেছে! মুখরের চোখেমুখে স্যুপটার জন্য বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। সে আড়চোখে একবার স্যুপটা দেখে নিলো। এরপরই মুখে দু’হাত গুঁজে আমায় বৃথা অনুরোধ করলো স্যুপটা না খাওয়ার। তবে তার এই অনুরোধ আমার জেদের কাছে বেশিক্ষণ টিকলো না। আমি স্যুপটা তার মুখের সামনে তুলে ধরে বললাম,

‘বাচ্চাদের মতো করবেন না, মুখর সাহেব। মুগ্ধ আপনার এসব বাচ্চামো দেখছে! তাই চুপচাপ স্যুপটুকু খেয়ে শেষ করুন।’

এই বলে ধীরে ধীরে তাকে স্যুপটা খাইয়ে দিলাম আমি। প্রথমে কিছুটা সমস্যা করলেও পরে সবটা খেয়েছে মুখর। তাকে স্যুপটা খাইয়ে দিয়ে এন্টাসিডটা দু চামচ খাওয়ালাম। এখন তার জন্য পানি গরম করতে দিয়েছি। কুসুম গরম পানিটা পেটে দিয়ে রাখলে ভালো লাগবে। মুগ্ধ আমার পেছন পেছন এসে বললো,

‘ম্যাম, মনে হচ্ছে আপনি মুখর ভাইয়ার আম্মু আর ভাইয়া একটা ছোট বাচ্চা। হিহি!’

আমি মনে মনে বললাম,

‘আমি মুখর সাহেবের আম্মু নই, স্ত্রী হতে চাই। এভাবেই সারাজীবন খেয়াল রাখতে চাই গো, আমার ছাত্র!’

তবে আমার এই ইচ্ছেটা কেউ শুনলো না। শুনলাম শুধু আমি আর আমার সৃষ্টিকর্তা।

(চলবে)

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here