#অনপেখিত
#পর্ব_২২
লিখা: Sidratul Muntaz
মেহেকের মনে হলো তার শরীরটা বড্ড হালকা হয়ে যাচ্ছে। সে বিরাট উঁচু কোনো জায়গা থেকে নিচে পতিত হচ্ছে। তার দেহটা ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করে ফেললেই সে আর বাঁচবে না। সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। সমাপ্তি ঘটবে তার অভিশপ্ত জীবনের। শরীরটা ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করতেই তীক্ষ্ণ একটা ঝাঁকুনি অনুভব হলো। মেহেকের চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। দৃষ্টি মেলে তাকাতেই সে নিজেকে পরিচিত একটি রুমে আবিষ্কার করল। ফারদিন বসে আছে তার বরাবর। সাথে উর্মি দাঁড়িয়ে। মেহেকের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল উর্মি। মেহেক বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠতে নিয়েই পায়ে ব্যথা পেয়ে গেল। ‘আহ্’ করে কঁকিয়ে উঠলো। উর্মি কাছে এসে বলল,” সাবধানে আপা, পাঁয়ে ঔষধ লাগাইসি। ঔষধ মুইছেন না। জ্বলুনি আস্তে আস্তে কইমা যাইবো।”
মেহেক তাকিয়ে দেখল তার দুই পায়ে সাদা মাখনের মতো ঔষধ লাগানো। পায়ে তেলে চিটচিট করছে। যন্ত্রণাও হচ্ছে প্রচুর। পা দু’টি কি তার পুড়ে গেছিল? মেহেক উর্মির দিকে একবার, ফারদিনের দিকে একবার তাকাল। ফারদিন চেহারা শক্ত বানিয়ে চোখের দৃষ্টি কটমট করে চেয়ে আছে। ক্রমান্বয়ে রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে। মেহেক আর্তনাদের মতো উচ্চারণ করল,” আমি এখানে কিভাবে আসলাম? কেন এখনও বেঁচে আছি আমি? মরে গেলাম না কেন?”
মেহেক কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই ফারদিন আকস্মিক বেগে তেড়ে এসে তার গালে একটা ঠাটানো চড় মারল। চড়ের দমকে মেহেক বিছানায় ছিটকে পড়ল। ফারদিন তীব্র চিৎকারে ফেটে উঠলো,” মরার খুব শখ হয়েছিল তাই না?”
মেহেক নির্বাক দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। মুখ দিয়ে টু শব্দ করতে পারল না। উর্মি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। ফারদিন কাছে এসে শীতল কণ্ঠে বলল,” আর কখনও এতোবড় সাহস দেখালে ভয়ংকর শাস্তি দিবো, বুঝেছো?”
শেষ শব্দটা সে ধমকে উচ্চারণ করল। মেহেক কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। ফারদিন হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মেহেক গালে হাত রেখে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল। তার সাথেই কেন বার বার এমন হয়? নিজের ইচ্ছায় কি সে মরতেও পারবে না? এই অশান্তির জীবন নিয়েই তাকে জোর করে বেঁচে থাকতে হবে! এ কেমন অবিচার! উর্মি কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” ভাইয়ার মাথাগরম হয়ে গেসে আপা। আপনি কষ্ট পাইয়েন না। আপনার শরীরে আগুন দেইখা ভাই ঘাবড়ায় গেসিল। আমি পাইপ খুইলা পানি ঢাইলা সাথে সাথে আগুন নিভাইসি। কিন্তু আপনি জ্ঞান হারায় ফেলসিলেন। আচ্ছা এইটা একটা কাজ করলেন আপা? ক্যান শরীরে আগুন দিতে গেলেন? আমি যদি তখন ওইখানে না থাকতাম তাইলে তো এতোক্ষণে পুইড়াই যাইতেন।”
” বেশ হতো। পুড়ে গেলেই ভালো হতো! মরতে পারতাম!”
” এইগুলা কি কন আপা? ক্যান মরতে চান আপনি? আপনার কিসের কষ্ট? যত কষ্ট তো আমাদের জীবনে। তাও আমরা বাঁইচা আছি না? আপনি এতো সুন্দর দেখতে, আপনাগো সয়-সম্পত্তির অভাব নাই। স্বামীও পাইসেন মনের মতো। তাও আপনার কিসের এতো দুঃখ?”
মেহেক মনে মনে হাসে। আফসোসের হাসি। আপাতদৃষ্টিতে তাকে দেখলে মনে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েটি। অথচ তার ভেতরটা যে কত রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, তা কেউ জানবে না। বুঝবে না। এজন্যই হয়তো বলে, টাকা থাকলেই সুখী হওয়া যায় না। সৌন্দর্য্যও মানুষের জীবনে সুখ আনতে পারে না। বরং মাঝে মাঝে তো সৌন্দর্য্যই সুখের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এই জগৎ সংসার বড়ই বৈচিত্রময়। নাহলে একজনের কাছে যেটা সুখের নাম অন্যজনের কাছে সেটাই কেন অভিশাপ? দুনিয়ার প্রত্যেকটি উপাদানই কি তাহলে আপেক্ষিক? উর্মি বলল,” আপনি যখন আমাদের ঘরে কেরোসিনের বোতল নিতে আসছিলেন তখনি আমি বুঝছি আপনের মতলব ভালো না। তাই কেরোসিনের বোতলে কইরা পানি দিসিলাম। ভাগ্যিস তখন এই বুদ্ধিটা মাথায় আসছিল নাইলে আজকে আপনেরে আমি বাঁচাইতে পারতাম না। আপনি ক্যান এমন করলেন আপা? ক্যান করলেন?”
উর্মির চোখ দিয়ে গলগল করে পানি বেরোচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে তার চোখ,নাক,গাল। মেহেক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” এই পাগলী, তুই এতো কাঁদছিস কেন?”
” জানি না। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি আপা। আপনের জন্য আমি জানও দিতে পারি।”
” আমার তোর জান লাগবে না। আমি তোর জান দিয়ে কি করবো?”
” জানি না। কিন্তু যদি কখনও প্রয়োজন হয়, আপনার জন্য আমি জান দিয়া দিমু। আপনি কখনও আমাদের ছাইড়া যাইতে পারবেন না আপা। আমি তাইলে খুব কষ্ট পামু।”
আহারে! মেহেকের মনটা খুব খারাপ হলো। তার এই ক্ষুদ্র পরিসরের সর্বনাশা জীবনটাকে বাঁচাতে অন্য একজন তার জান দিয়ে দিতে চাইছে! এতো ভালোবাসা কোথায় পাবে মেহেক? উর্মিকে এই মুহুর্তে কিছু একটা দিতে খুব মন চাইছে। মেহেক বলল,
” উর্মি, তুই আমার কাছে এখন বড় কিছু একটা চেয়ে ফেল তো। সাধ্য থাকলে আমি তোর চাওয়া পূরণ করবো।”
” আপাতত আমি চাই আপনি শুয়ে থাকেন, আরাম করেন। আর কখনও এমন করতে যাইবেন না কইলাম।”
উর্মি যেন তাকে চোখ বড় করে হুমকি দিচ্ছিল। মেহেক হেসে বলল,
” আচ্ছা, যাবো না যাহ্। তোর চাওয়া পূরণ করলাম।”
উর্মি চোখের পানি মুছে খুব আনন্দের সাথে হাসল। ভোরের আযানের সুর ভেসে আসছে। উর্মি বলল,” আপনি থাকেন আপা। আমি নামাযটা শেষ কইরা আসতাসি।”
” ঠিকাছে।”
উর্মি বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই ফারদিন ভেতরে এলো। তার চোখমুখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে৷ ইতস্তত করে সে আড়ষ্ট গলায় ডাকল,” মেহেক।”
মেহেক সাথে সাথে উল্টোদিকে ঘুরে গেল। এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তার। ফারদিনের দিকে তাকাতেও মন চাইছে না। মেহেকের ডানগাল এখনও উত্তপ্ত হয়ে আছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। ফারদিন বলল,” স্যরি, মাথাগরম হয়ে গেছিল। আমার আচরণে তোমার হয়তো খারাপ লেগেছে।”
মেহেক তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নির্দেশ দেওয়ার মতো বলল,
” আমার ঘুম আসছে। আপনি লাইটটা নিভিয়ে দিলে আমি একটু ঘুমাবো।”
” তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে চাইছো না মেহেক?”
” না।”
” স্যরি বললাম তো। আর তুমি কি বোকার মতো কাজ করতে যাচ্ছিলে এটা? যদি কিছু হয়ে যেতো?”
” তাহলে কি হতো?”
” কি হতো মানে? তুমি বুঝতে পারছো না কি হতো?”
” হ্যাঁ। আমি মরে যেতাম। কিন্তু তাতে আপনার কি হতো?”
” আমার কি হতো মানে? তুমি মরে গেলে আমার কিছু না?”
মেহেক এইবার শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখ সরু করে কাটকাট কণ্ঠে বলল,” ভুল করেও করুণা দেখাতে আসবেন না আমাকে। আমি কারো করুণার পাত্রী হয়ে বাঁচতে চাই না। এতোদিন তো আমি মরে গেলেও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাহলে এখন হঠাৎ দরদ উতলে উঠছে কেন? আমার দুঃখের গল্প শুনে মায়া লেগেছে? ভাবছেন আপনার করুণা ভিক্ষা নেওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই? তাহলে জেনে রাখুন আপনি ভুল ভাবছেন। কারণ মেহেক কারো দয়ার পাত্রী হয়ে বাঁচার মতো মেয়ে না। আমি কালকেই আমার গ্রামের বাড়ি চলে যাবো। তারপর আপনার সাথে আমার সমস্ত হিসাব শেষ। আপনি আমাকে চুক্তির জন্য বিয়ে করেছিলেন না? আপনার বাগানবাড়ি আপনার কাছেই থাকবে। শুধু আমি আপনাকে মুক্তি দিবো। নিশ্চিন্ত থাকুন।”
ফারদিন চট করে কিছু বলতে নিচ্ছিল তখনই মেহেক হাতজোড় করল,” প্লিজ, নো সিম্প্যাথি। আমি সিম্প্যাথি পাওয়ার জন্য আপনার কাছে এসব শেয়ার করিনি বিশ্বাস করুন। আপনি জানতে চেয়েছিলেন তাই জানিয়েছি। এখন দয়া করে আমাকে দয়া দেখাতে আসবেন না। আমার এই দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবন নিয়ে আমাকে একাই থাকতে দিন। শান্তিমতো বাঁচতে দিন।”
” আর আমি? আমি কিভাবে বাঁচবো?”
ফারদিনের প্রশ্ন শুনে মেহেক ভ্রু কুচকালো। ফারদিন কাছে এসে তৃষ্ণার্তের মতো বলল,” পুরো ছয় ছয়টি দিন, তোমাকে আমি প্রচন্ড মিস করেছি মেহেক। কতটা কষ্ট পেয়েছি সেটা শুধু আমি জানি৷ এতো কাছে থাকার পরেও মনে হচ্ছিল তুমি আমার চেয়ে যোজন যোজন দূরে আছো। আমি সেই দূরত্বটা মেনে নিতে পারছিলাম না। তাহলে যখন সত্যিই তুমি দূরে চলে যাবে, আমার কি অবস্থা হবে একবার ভাবো? আমি তো মরেই যাবো!”
ফারদিন খুব কষ্টে ঢোক গিলছে। তার মায়াবী চোখ দু’টি পানিতে টইটম্বুর হয়ে যাচ্ছে। মেহেক নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করল,” এর মানে কি? কি বলতে চাইছেন?”
” মানেটা খুব পরিষ্কার। তুমি আমাকে ছেড়ে কখনও কোথাও যেতে পারবে না।”
” আপনি কি আমাকে জোর করে আটকে রাখতে চাইছেন?”
” জোর করে নয়, জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখতে চাইছি।”
” কেন চাইছেন? আপনার তো আমার কথা বিরক্ত লাগে, আমার দুষ্টুমি,খুঁনসুটিকে বাচ্চামি মনে হয়। আমি তো ইমম্যাচিউর।”
” আমার ইমম্যাচিউরিটিই পছন্দ। ”
” আপনার সাথে আমার মেন্টালিটি মিলবে না।”
” মেন্টালিটি চুলোয় যাক। আমি শুধু বেঁচে থাকতে চাই। প্রতি মুহুর্তে স্বস্তিভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য হলেও আমার তোমাকে দরকার। আমার স্বস্তিটা হচ্ছো তুমি।”
ফারদিন মেহেকের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল। মেহেক ঝট করে হাত ছাড়িয়ে বলল,
” ছাড়ুন আমাকে। আপনার তো সুজি আপুকে বেশি পছন্দ। সে আপনার পাশে থাকলে আপনি আমাকেও ভুলে যান।”
” কিসের সুজি?এখন থেকে তুমি পাশে থাকলে আমি দুনিয়া ভুলে যাবো। নিজেকেও ভুলে যাবো।”
” সব মিথ্যে কথা। আপনি মিথ্যে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আমাকে।”
” না মিথ্যে নয়। সত্যি বলছি!”
” আপনি তো আমাকে ভালোই বাসেন না।”
ফারদিন এই কথা শুনে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। মেহেক বিস্মিত হয়ে তাকালো। ভালোবাসার কথা শুনে কি ফারদিন পিছিয়ে যাচ্ছে? অর্থাৎ এখনও তাকে ভালোবাসে না? তাহলে এতোক্ষণ এগুলো কেন বলল? ফারদিন আকুলতা নিয়ে প্রশ্ন করল,” আমার ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়ার জন্য আমাকে কি করতে হবে মেহেক?”
মেহেক তখন মনে মনে তৃপ্ত, পরিতুষ্ট। প্রিয় মানুষটির কাছে নিজের জন্য আকুতি দেখার মাঝে যে এতোটা শান্তি তা সে আগে জানতো না! আজকে তার সৌভাগ্যের দিন। চরম খুশির দিন। সে কিভাবে এই খুশি উদযাপন করবে? ফারদিনকে কি করতে বলা উচিৎ?
চলবে
( শুধুমাত্র আপনাদের টেনশন মুক্ত করার জন্য এই পর্বটা দিলাম। আমার ১ তারিখ থেকে পরীক্ষা। আমি আবার কবে গল্প দিতে পারবো জানি না। কেউ প্লিজ অপেক্ষা করবেন না। স্যরি!💔)