অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব -১৮+১৯

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

শরৎ এর কোমল, স্নিগ্ধ বিকেলে আকাশে কালো মেঘ জমলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি প্রেমময় অনুভূতির বার্তা পাঠালো। মাহমুদের সামনে সাদা জামায় আচ্ছাদিত এক লাজুক রমণী। লজ্জায় হেলেদুলে পড়া রমণীকে মুহূর্তেই কাশফুল মনে হলো। যে মৃদু বাতাসে নিপুণ তালে হেলেদুলে নেচে ওঠে। কাশফুল শুভ্রতার প্রতীক। তরীও ঠিক শুভ্রতায় মোড়ালো নিজেকে। আঁটসাঁট করে বাঁধা চুলগুলো খানিকটা ঢিলে হয়ে কানের পাশ গড়িয়ে বেরিয়ে এলো। তরী হাত বাড়িয়ে সেগুলো কানের পাশে গুঁজে নিলো। সামনেই মাহমুদ তাকে দেখে চলেছে। অথচ সে মাহমুদকে ডেকে আনার যথাযথ কারণটি বলতে পারছেনা। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকা মাহমুদ কোন তাড়া দেখালোনা। তরী ঠোঁট ভেজালো। নিজেকে ধাতস্থ করে শক্ত গলায় বলল,
-“কাল তিয়াস ভাইয়া কল দিয়েছেন।”

মাহমুদের দৃষ্টি নড়ে উঠলো। ভুরু উঁচিয়ে শুধালো,
-“তিয়াস কে?”

তরী শান্ত চোখে তাকালো মাহমুদের চোখে। হুট করেই কেমন তার সাহস বেড়ে গেল৷ আজকাল মাহমুদকে দেখলেই তার অস্বস্তি হয়না। তবে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। আজ তেমন কিছুই ঘটছেনা। স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,
-“বাবা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন! মানে আমার কাজিন।”

মাহমুদের চোয়ালে কঠিন হয়ে উঠলো। কপালের পাশ ঘেঁষে নীল রঙা রগগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শান্ত, শক্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
-“কী বলেছে?”

-“তুই থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।”

শান্ত মাহমুদ রা*গ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় নামলো। চোখ বুজে হেলান দিয়ে বসলো। মিনিট দুয়েক পার হতেই ধপ করে চোখের পাতা খুলে বসলো। একেবারে শান্ত, যেন কিছুই হয়নি। মাহমুদ বলল,
-“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

তরীর রা*গ হলো। মানুষটা কিভাবে এতটা শান্ত আছে! তার কী রাগ বলতে কিছুই নেই? ফোঁস করেই নিশ্বাস ছাড়লো। মাহমুদকে আর কিছুই বলার প্রয়োজন মনে করলোনা। কফি প্রায় ঠান্ডা হয়ে এসেছে। তরী ঢকঢক করে গিলে নিলো। মাহমুদ শান্তভাবে তাকিয়ে আছে। তাকে কিছু না বলেই তরী হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো কফিশপ থেকে। মাহমুদ পিছুপিছু গেলোনা। বসে রইলো আরও ঘন্টাখানেক।

★★★

বেলা গড়াবার সাথে সাথে দূর দিগন্তে সূর্য ডুবি ডুবি। নীল আকাশে সাদা-কালো মেঘের ভেলায় ঝুপ করেই ছড়ালো লালিমা আস্তরণ। এগিয়ে এলো সন্ধ্যা। ঘন হলো অন্ধকার। মাগরিবের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বের হলেন তরীর বাবা। পাশাপাশি এগিয়ে এল মাহমুদ। সালাম বিনিময় করে ভালোমন্দ খোঁজ নিলো।
তরীর বাবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। রাশভারি গলায় বললেন,
-“কিছু বলতে চাও? তরীর ব্যাপারে হলে আমি শুনতে চাইছিনা।”

মাহমুদ দুর্বোধ্য হাসলো। পথটা সুন্দরভাবে পরিষ্কার হয়ে গেল। তাকে কোন ছুতা খুঁজতে হলোনা। তরীর বাবা নিজেই তরীর কথা তুললেন। মাহমুদ নম্র ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
-“তরীর নাকি বিয়ে ঠিক?”

-“হ্যাঁ, শোনোনি তোমার মায়ের কাছে?”

মাহমুদ মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো,
-“জি শুনেছি।”
অতঃপর প্রশ্ন করলো,
-“তরী কি বিয়েতে রাজি?”

তরীর বাবার এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা বিরক্তি এবার রা*গে পরিণত হলো। রাগত স্বরে বললেন,
-“সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তরী আমার মেয়ে। ওকে চিনি আমি। আমার উপর কখনো কথা বলবে না আমার মেয়ে।”

মাহমুদ হালকা হাসলো। তরীর বাবা জ্বলে উঠলেন।
-“হাসছো কেন?”

-“এই যে আপনার কঠিন আত্মবিশ্বাস নিজের প্রতি! যে আত্মবিশ্বাসের বলে সন্তানের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন। একবারও তার মতামত জানার প্রয়োজন মনে করলেন না। আপনি জানেন আপনার মেয়ে কখনো আপনার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলবেনা। এটাকে পুঁজি করেই যা ইচ্ছে করতে পারবেন, কিন্তু ভেতর থেকে মেয়েটাকে পড়তে পারবেন না। একসময় নিজের দুঃখগুলো বলার জন্যেও তখন মেয়েটা আপনাদের ভরসা করবে না।”

-“আমি তরীর বাবা। তার জন্য যেকোন সিদ্ধান্ত আমি অনায়াসে নিতে পারি। তাছাড়া তোমার সমস্যা কোথায়, আমি বুঝলাম না।”

-“ভুল কিছু বলে থাকলে ক্ষমা করবেন আঙ্কেল।
তরীকে আমি পছন্দ করি। তাই তার মতামত জানাটা আমার জন্য জরুরি।”

তরীর বাবার মনে হলো এতদিন নম্র-ভদ্র ছেলে বলে যাকে জানতেন, সে এক নি*র্ল*জ্জ ছেলে। কিভাবে মুখের উপর বলে দিলো সে তরীকে পছন্দ করে! বি*স্ফো*রণ ঘটলো যেন!
মাহমুদ মাথানিচু করে আছে। এতটুকু নি*র্ল*জ্জ না হলে যে তরীকে আর পাওয়া হবে না।
তরীর বাবা চোয়াল শক্ত করে বললেন,
-“তুমি কি আমার মেয়ের বিয়েতে বাঁধা দিতে চাইছো?”

-“আমি শুধু তরীর মতামত জানতে চেয়েছি।”

তরীর বাবা তীব্র আ*ক্রো*শে ফেটে পড়লেন। নিজেকে ঠান্ডা রা*খা*র চেষ্টা করে বললেন,
-“তোমার সাথে আমাদের কোন শ*ত্রু*তা নেই। শুধু শুধু ঝা*মে*লা করোনা। দ্রুত অন্য বাসা দেখো।”

লম্বা কদম ফেলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পার করে নিলেন তরীর বাবা। মাহমুদ অলস ভঙ্গিতে ঘরে ফিরলো।
তরীকে শান্তনা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতি যে হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। তরীর বাবা নিজ জায়গা থেকে ঠিক। ভাইকে কথা দিয়ে তার খেলাপ করতে পারবেন না তিনি। কিন্তু অন্যদের চোখে উনার একটা ত্রুটি স্পষ্ট। সেটা হলো মেয়ের মতামত না নেওয়া।
মাহমুদ বুঝলো খুব সহজে তরীর বাবা মানবেন না। তবে সেও এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না। অজান্তেই তরী তার হয়ে বসে আছে। মাহমুদের দায়িত্ব তাকে ধরে রাখা। শক্ত বন্ধনে আটকে রাখা।

★★★

ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলো তরী। বাসার পরিবেশ বেশ রমরমা। বড়ো চাচা-চাচি সহ অনেকেই উপস্থিত। তরীকে দেখে চাচি এগিয়ে এলেন। আদুরে স্বরে আফসোস করলেন,
-“আমার মেয়েটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দেখো ঘামে ভিজে কী অবস্থা!”

তরী সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেল। অন্য সময় হলে চাচির এই আদরটুকু সে অনায়াসে লুফে নিতো। এখন কেমন যেন স্বা*র্থ মনে হয় সবকিছু।
গোসল সেরে বসতেই মিঠু হুড়মুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। তরী ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
-“কী হয়েছে?”

মিঠু একবার পেছনে দরজার দিকে তাকালো। দরজা ভিড়িয়ে সাবধানে এসে দাঁড়ালো তরীর পাশে। সরল চোখে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি কিছু বলবে না?”

তরীর বোধগম্য হলো না মিঠুর কথা। জিজ্ঞেস করলো,
-“কী বলবো?”

-“তুমি কি সত্যিই তিয়াস ভাইয়াকে বিয়ে করে নিবে? তাহলে মাহমুদ ভাইয়া?”

তরী আৎকে উঠলো। মিঠু কি মাহমুদের কথা জেনে গিয়েছে? তপ্ত শ্বাস ছেড়ে পাশে বসলো মিঠু। হুট করেই কেমন বড়ো হয়ে গেল ছেলেটা। ভরসার গলায় বলল,
-“আমি বাবা-মাকে কিছু বলিনি আপু।”

তরী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
-“কী করবো আমি? বাবা যদি জানে আমিও মাহমুদকে পছন্দ করি, তাহলে আরও আগেই মানবেন না। প্রেম-ভালোবাসার বিয়ে বাবার পছন্দ নয়।”

-“তাই বলে চুপ করে থাকবে? আজ বড়ো চাচা আর চাচি কেন এসেছে জানো?”

তরী প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। মিঠু বলল,
-“বাবা খবর দিয়ে এনেছেন। আজ না-কি তোমাকে রিং পরিয়ে যাবে।”

তরীর দুনিয়ায় ঘুরে উঠলো। চোখেমুখে বিস্ময়ের সাথে সাথে স্থান নিয়েছে আতঙ্ক।
হঠাৎই মায়ের আগমন।
-“দুজন এখানে কী গল্প জুড়েছিস? তরী একটা নতুন জামা পরে তৈরি হয়ে বাইরে আয়। মিঠু তোকে তোর বাবা ডাকছে।”

মিঠু বেরিয়ে যেতেই মা আলমারি থেকে একটা জামা বের করে দিলেন। তরী এখনো ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মায়ের সাথে জামা পরে বেরিয়ে এল বসার ঘরে। এক এক জনের আদর ভালোবাসা আজ আদিখ্যেতা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। চাচি তরীর হাত টে*নে রিং পরিয়ে দিলেন বিনা বাক্যে। তরী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। সবার দু-একটা কথা কানে বেজে চলেছে। তার মধ্যে চাচি বেশ হেসে হেসেই বললেন,
-“আমাদের তরীটা যে এখনো ছোটোবেলার মতোই লাজুক রয়ে গিয়েছে। তিয়াসের সাথে কথা বলতেও নাকি লজ্জা পায় মেয়েটা। সমস্যা নেই। সামনের সপ্তাহে ফোনে বিয়েটা হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তরীর বাবা বললেন,
-“হ্যাঁ আপাতত বিয়েটা হয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত। তিয়াসও দেশে ফিরুক আর তরীরও পড়াশোনা শেষ হোক। তখন নতুন করে সব আয়োজন করা যাবে। আজকাল মানুষের বিশ্বাস নেই। তিনতলার ছেলেটা হয়তো ঝা*মে*লা বাঁধাতে পারে!”

তরীর আজ চমকে যাওয়ার দিন। একের পর এক শক সে নিতে পারছেনা। সামনের সপ্তাহে বিয়ে মানে কী?
মাথা ঘুরে উঠলো তার। তরী কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। মা ব্যাপারটি খেয়াল করে জিজ্ঞেস করলেন,
-“শরীর খা*রা*প লাগছে?”

তরী হ্যাঁ সূচক মাথা দুলালো। বড়ো চাচা বললেন,
-“মেয়েটা জার্নি করে এসেছে। যাও বিশ্রাম নাও।”

তরী উঠে গেল। সন্ধ্যা নাগাদ সবাই বাসায় ফিরে গেলেন। মিঠু অনেকক্ষণ ধরেই বাসায় নেই। মাহমুদকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। রিং হচ্ছে কিন্তু রেসপন্স নেই। রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়লো তরী। সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাদে উঠলো। বুকের ভেতর হাউমাউ কান্নার শব্দ হলো। বাইরের জগতের কাকপক্ষী ও জানতে পারলোনা। নিরবে চোখের জল গড়ালো। পেছন থেকে শান্ত স্বর শোনা গেল,
-“কাঁদছেন কেন, তরী?”

#চলবে……..#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

তরীর কান্না থেমে গেল। পেছন ঘুরে তাকাতেই স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো এক পুরুষ অবয়ব। মাহমুদ পায়ের গতি বাড়িয়ে দূরত্ব কমালো। চাঁদের নরম আলোয় ক্রন্দনরত তরীর মুখখানা দেখে ম্লান হাসলো। কোন সতেজতা নেই সেই হাসিতে। নিস্তেজ কন্ঠে শুধালো,
-“বললেন না যে! কাঁদছেন কেন, তরী?”

তরী ফুঁপিয়ে উঠলো। মাহমুদ বলল,
-“আপনার বিয়ে হচ্ছে, এটা তো খুশির খবর। হাতে রিং ও পরেছেন। দেখি তো কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে আপনার হাত!”

মাহমুদের কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান টের পেল তরী। কান্না রোধ করার চেষ্টা করলো। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
-“আমার কিছু করার ছিলো না।”

মাহমুদ হাসলো।
-“সত্যিই কি কিছু করার ছিলোনা? আপনি নিজের অপছন্দ মা-বাবাকে জানাতে পারতেন, তরী। প্রচন্ড ভীতু আপনি। আপনি আমায় বলুন তো, আপনি ঠিক কী চান?”

তরীর চোখমুখ লাল হয়ে আছে। ফিসফিস গলায় আওড়ালো,
-“আপনাকে চাই।”

-“আপনি ভুল বললেন, তরী। আমাকে চাইলে বাবা-মাকে অন্তত নিজের অপছন্দ জানাতে পারতেন। বলতে পারতেন আপনি তিয়াসকে বিয়ে করতে চান না!”

তরী কান্নায় ভেঙে পড়লো। হেঁচকি তুলে বলল,
-“আমি বাঁধা দিতে গেলেই সমস্যা আরো বেড়ে যেতো। বাবা তখনই বিয়ের ব্যবস্থা করে আমায় ঘর থেকে বের হওয়ার পথ বন্ধ করে দিতেন। এতটুকু পর্যন্ত আসার রাস্তা থাকতো না। আমি চিনি আমার বাবাকে। সেজন্যই তখন আমি কিছু বলিনি। চুপ ছিলাম। আমার বাবা খা*রা*প মানুষ নন। কিন্তু তার একরোখা মনোভাবের জন্যই সবাই তার কাছ থেকে দূরে সরে যান। বাবা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতেই অটল থাকবেন। ছোটোবেলা থেকেই আমি বাবার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলিনি। বাবা এখনো তেমনটা ভেবেই বড়ো চাচ্চুকে কথা দিয়ে ফেলেছেন। তাছাড়া তিনি মনে করেন ভাইকে কথা দিয়ে কথা ফিরিয়ে নেওয়া মানে ভাইকে অপ*মান করা। তিনি ইমেজ ধরে রাখার জন্য আমার মতকে কখনোই গুরুত্ব দেবেন না। তখন রিং পরানোতে বাঁধা দিলে আমি এই মুহুর্তে ছাদে আসতে পারতামনা।”

-“ভালো থাকুন, তরী।”
বলে পেছন দিকে পা বাড়ালো মাহমুদ। তরী ধপ করে নিচে বসে পড়লো।
-“আপনি আমায় কেন বুঝতে চাইছেন না! আমি আপনাকে চাই।”

মাহমুদ সিঁড়ি ঘরে পা রাখতে গিয়েও তরীর কথায় থেমে গেল। কদম বাড়ালো তরীর দিকে। একেবারে নিকটে এসে হাঁটু মুড়ে বসলো। থুতনিতে হাত রেখে তরীর মুখখানি তুলে ধরলো। ভীষণ যত্নে মুছে দিলো চোখের জল। তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। থেকে থেকে হেঁচকি তুলছে। মাহমুদ শান্ত স্বরে বলল,
-“আমাকে চাইলে যে সাহসী হতে হবে, তরী। পারবেন আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে?”

তরী কান্নামাখা চোখে বারকয়েক উপর নিচ মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে খুব পারবে। মাহমুদ লম্বা শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তরীকে নিয়ে। চিকন হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
-“চলুন।”

তরী অবুঝের মতো প্রশ্ন করলো,
-“কোথায়?”

-” বিয়ে করব আমরা।”

তরীর পা থেমে গেল। বিস্ময়ে হতবাক তরীর মুখ ফোটে শব্দ বের হলোনা। মাহমুদ মলিন হেসে বলল,
-“আজ যদি এই হাত ছেড়ে যান, তবে আর কখনো আমায় পাবেন না তরী।”

তরীর মাথায় বাজ পড়লো। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো সে। মাহমুদ ফের বলল,
-“নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিতে শিখুন, তরী। দেখবেন সবটা সহজ হয়ে যাবে।”

হুট করেই এক শীতল হাওয়ায় ভেসে গেল তরী। কেমন করে যেন তার সাহস বেড়ে গেল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহমুদের হাত।
তুষ্ট হলো মাহমুদের হৃদয়। ঠোঁটের কোন জুড়ে মোহনীয় হাসির ঢেউ। তরীর হাতে হাত রেখে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। পকেটে হাতড়ে ফোন বের করে কাকে যেন কল দিলো। তরীকে নিয়ে রওনা হলো। গন্তব্য তরীর জানা নেই। সে নির্ভয়ে মাহমুদের সাথে এগিয়ে গেল। কারো সিদ্ধান্তকে পরোয়া করলো না মাহমুদ। ঘড়ির কাঁটা রাত নয়টার ঘরে পৌঁছাতে ঢের বাকি। হুট করেই মনে পড়লো কিছু জিনিস প্রয়োজন। তরীকে ঘরে পাঠালো তার নিবন্ধন কার্ডের জন্য। এক ফাঁকে নিজের কাগজপত্র গুলো নিয়ে বেরিয়ে এলো। ভাগ্যিস মিঠু তাকে সবটা জানিয়েছে।

তরী ভয়ে ভয়ে নিবন্ধন কার্ড লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসতেই মায়ের সামনে পড়লো।
-“রাতের বেলা কোথায় যাচ্ছিস?”

তরী তোতলানো শুরু করলো,
-“ছা… ছাদে।”

মায়ের ভুরু কুঁচকে গেল। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“ছাদে কী করতে যাচ্ছিস?”

তরী হুট করেই বলে দিলো,
-“তিয়াস ভাইয়া কল দিয়েছেন। অরু ঘুমাচ্ছে তো, তাই ছাদে যাচ্ছি।”

মায়ের শরীরটা খা*রা*প লাগছে। তিয়াসের কথা বলায় মনে মনে খানিকটা খুশি হলেন। বললেন,
-“বারান্দায় কথা বললেই পারিস। যাচ্ছিস যখন ছাদে বেশিক্ষণ থাকার দরকার নেই। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।”

-“আচ্ছা।” বলে তরী বেরিয়ে পড়লো। দরজার বাইরে বেরিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো। এখনো বুক ধড়ফড় করছে। হুট করে তার মাথায় এত বুদ্ধি কোথা থেকে এলো, ভেবে পেলো না। মাহমুদ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“কোন সমস্যা হয়েছে?”

তরী মায়ের কথা খুলে বলতেই মাহমুদ তরীকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। সিএনজি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যেতেই তরীর ভয় হলো। আবারও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো। একবার মনে হলো লুকিয়ে এভাবে বিয়ে করা কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আবার মনে হলো এভাবে না হলে সে কখনো মাহমুদকে পাবেনা।
তরীর ভয়কাতুরে চেহারায় তাকিয়ে মাহমুদ তার হাতটি শক্ত করে ধরলো। চোখে চোখ রেখে ভরসার গলায় বলল,
-“আমি আছি তো, তরী।”

তরী ভরসা পেলো। নতুন এলাকায় মাহমুদের নতুন কিছু চলার সঙ্গী হলো। তারমধ্যে একজন তার কলিগ। সাক্ষী হিসেবে তারা থাকবে।
বিয়ে পড়ানোর সময় যখন তরীর অনুমতি চাওয়া হলো তখন তরী টলমল চোখে বসে রইলো। বুক কাঁপছে তার, হাত কাঁপছে থরথর করে। তরী কিছুই বলছেনা। মাহমুদের চেহারা মলিন হয়ে এলো। বলল,
-“আপনি না চাইলে আমরা বিয়েটা করবো না, তরী। চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই।”

তরী চমকে তাকালো। মাথায় একটা ভাবনাই ঘুরপাক খেলো। এখান থেকে এভাবে ফিরে যাওয়া মানে তিয়াস ভাইয়ার সাথে জুড়ে যাওয়া, মাহমুদকে হারিয়ে ফেলা। তার সাধ্য নেই বিয়েটা আটকানোর। কেউ তার কথা শুনবেনা। তরী হুট করেই সম্মতি দিয়ে বসলো। মাহমুদ অবাক হওয়ার পাশাপাশি প্রশান্তি অনুভব করলো। সুখ সুখ অনুভূতি হলো। সাদামাটা ভাবে বাসার জামা পরেই বিয়েটা হয়ে গেল। সবাইকে বিদায় জানিয়ে তরীকে নিয়ে গাড়ির খোঁজে ফুটপাত ধরে হাঁটলো মাহমুদ। তার ইচ্ছে হলো আজ রাতটা তরীকে নিয়ে শহরের আনাচকানাচে ঘুরবে। কিন্তু এখন বাসায় না গেলে তারীকে বি*প*দে পড়তে হবে। আপাতত পরিস্থিতি ঘোলাটে না করাই ভালো।

তরীর এই মুহূর্তে ভীষণ লজ্জা লাগছে। হুট করে তো বিয়েটা করে নিলো, এখন কিভাবে মাহমুদের চোখে চোখ রাখবে? কিভাবে কথা বলবে ভেবেই অস্থির হয়ে উঠলো। শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসছে। মৃদু মৃদু শরীর কাঁপছে। মাহমুদের হাতের মুঠোয় থাকা নরম হাতের কম্পন টের পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মাহমুদ। সরাসরি চোখ রাখলো তরীর লজ্জায় আরক্তিম মুখে। মাথা নিচু, চোখের পাপড়ি পলক ঝাপটাবার সাথে সাথে নড়েচড়ে উঠছে। মাহমুদ এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। তরীর হাত ছেড়ে নিজের দুহাতে কোমল গালজোড়া আলতোভাবে স্পর্শ করলো। গভীর চুম্বন করলো তরীর কপালে। তরী শক্ত হয়ে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো। তা দেখে হাসলো মাহমুদ। তাদের পবিত্র স্পর্শের সাক্ষী হলো ল্যামপোস্টের আলো, শাঁ শাঁ গতিতে চলমান গাড়ি, আকাশের চাঁদ।

তরী কাঁপা স্বরে বলল,
-“মা আমার খোঁজ করবেন।”

মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালো। পেলব কন্ঠে শুধালো,
-“আপনি খুশি তো, তরী?”

তরী মুখে জবাব দিলো না। সেদিনের মতো আজও মাহমুদের কনিষ্ঠ আঙুল মুঠোয় পুরে নিলো। ঠোঁটের কোনে লেপ্টে আছে লজ্জালু হাসি। মাহমুদ স্বস্তি পেলো। তরী তার। একান্তই তার। শত বাঁধা আসলেও সে লড়ে যাবে, শুধু তরীকে তার পাশে চাই। মাহমুদ ভাবলো হুট করেই কেমন মেয়েটার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লো সে। প্রথম প্রথম লজ্জা পাওয়া মেয়েটাকে আরেকটু লজ্জা দিয়ে ভড়কে দিতে দারুণ লাগতো। সেই দারুণ লাগা থেকেই তার বুকে ভয়*ঙ্কর প্রেমনদী তৈরি হলো।
সময়ের অভাবে দুজনের একসাথে আর খাওয়া হলোনা, সময় কাটানো হলোনা। তরীকে চারতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মাহমুদ তিনতলায় নেমে পড়লো। বাবা আর মা এখনো জেগে আছেন। ঘড়ির কাঁটা এগারো এর ঘর পেরিয়েছে। বাবার চোখমুখ শক্ত। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

তরী ঢোক গিললো। মা যেহেতু পাশে আছে, তারমানে ছাদ চেইক করে এসেছেন। সে তো মাকে ছাদে যাচ্ছে বলেই বেরিয়ে গেল। বাবাকে এখন কী জবাব দেবে?

#চলবে………

(অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন আমার শরীর কেমন আছে? আলহামদুলিল্লাহ এখন আগের তুলনায় ভালো আছি। তবে ঘুম হচ্ছে প্রচুর। যখন-তখন ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে যাই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here