অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব -৩৬+৩৭

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

আজ এক জায়গায় দাওয়াত পড়েছে বিধায় মাহমুদের বড়ো ভাইয়া তরীকে সাথে নেওয়ার জন্য তরীর বাবাকে ফোন করলেন। দাওয়াতের মূল উপলক্ষ্য মাহমুদ আর তরীর বিয়ে। তাদের নিয়েই পরিবারসহ দাওয়াত পড়েছে। বড়ো ভাইয়া ফোন হাতে নিয়ে বসে আছেন। রিং হলেও কোন রেসপন্স নেই। ইরা পাশেই জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখছে।

সকালে বাবার ফোন বেজে উঠলো। বাবাকে আশেপাশে না দেখে ছোট্ট অরু চোখ ডলতে ডলতে ফোন রিসিভ করে কানে তুললো।
-“হ্যালো কে?”

-“আমি তোমার বুড়ো বর বলছি গো, সুন্দরী বউ।”
কন্ঠস্বরে সম্পূর্ণ ঠাট্টার সুর টের পেলো অরু।

সকাল সকাল তার মেজাজ খা*রা*প হয়ে গেলো। চেঁচিয়ে বললো,
-“এই কে বলছেন?”

হাসির শব্দ ভেসে আসছে। অরুর নাকের পাটা ফুলে উঠলো। সাথে গাল দুটোও ক্রমশ ফুলে উঠছে। নিমিষেই বুঝে গেল ফোনের ওপাশের মানুষটি কে!
বড়ো ভাইয়া বললেন,
-“আমি তোমার বর বলছি গো, বর।”

অরু রাগ ঝেড়ে বলল,
-“হি হি করে হাসছেন কেন? দাঁত ব্রাশ করেছেন?”

করুন সুর ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
-“না, টুথপেষ্ট, ব্রাশ কিছুই নেই। তুমি কিনে দেবে?”

অরু বুঝলো সত্যিই ব্রাশ, টুথপেষ্ট নেই। সাথে সাথে নাক চপে ধরলো। দুর্গন্ধ লাগছে প্রকাশ করতেই “উঁহ”
শব্দ করলো।
তরী এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কার সাথে কথা বলছিস, অরু?”

অরু নাকে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,
-“নাও, মাহমুদ ভাইয়ার ভাই। তুমিও নাকে হাত দাও। উনি ব্রাশ করেন নি। প্রচুর দুর্গন্ধ আসছে।”

তরী হাসতে হাসতে ফোন হাতে নিলো। মুঠোফোনেও যে কারো মুখের দুর্গন্ধ টের পাওয়া যায়, তা অরু না বুঝালে সে বুঝাতোই না।

ফোন কানে তুলে সালাম দিলো তরী।
ভাইয়া সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
-“আঙ্কেল কোথায় তরী? আজ আমাদের দাওয়াত আছে সকলের। তুমি আর মাহমুদ যাচ্ছো। সেটা বলতেই আঙ্কেলকে ফোন করলাম।”

তরী মৃদুস্বরে বলল,
-“বাবাকে দেখছিনা। ঘরে ফিরলে কল ব্যাক করতে বলবো।”

ভাইয়া মেনে গেলেন।
নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রাখতেই বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল। মাহমুদও বেরিয়ে এসেছে। মিঠু ঘুমাচ্ছে। সে ছাড়া সকলেই টেবিলে উপস্থিত। তরী বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
-“বড়ো ভাইয়া কল দিয়েছেন, বাবা। তোমার সাথে কথা বলবে।”

মাহমুদ বলল,
-“আমাদের আজ দাওয়াত আছে। আপনার পারমিশন নিতেই বোধহয় ভাইয়া কল দিয়েছেন!”

তরীর বাবা মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও মুখে প্রকাশ করলেন না। তারা চাইলেই এখন তরীকে তার বাবার পারমিশন ছাড়া যেকোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। অথচ ভদ্রতা বজায় রেখে পারমিশন চাইতে কল করেছেন। নাস্তা করার আগেই তরীকে বললেন,
-“আমার ফোন এনে দে, তটিনী।”

তরী ফোন বাড়িয়ে দিতেই বাবা কল দিলেন মাহমুদের বাসায়। ওদের যাওয়াতে তিনি আপত্তি করেননি। মাহমুদ হাসলো। তার হাসি অগোচরেই থেকে গেল। চাইলে শুধু সে নিজেই পারমিশন নিতে পারতো। তবুও ভাইয়াকে দিয়ে কল করালো। দুজন পারমিশন চাওয়াতে প্রকাশ না করলেও তরীর বাবা যে সন্তুষ্ট হলেন তা বোঝাই যাচ্ছে। এভাবেই একটু একটু করে মনে জায়গা করে নেবে সে। একজন বড়ো ছেলের অভাব সে পূরণ করবে। জানেনা কতটা পারবে, তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে।
তরী অরুকে খাইয়ে দিচ্ছে। মাহমুদ অরুকে রাগিয়ে দিতেই বলল,
-“বাবা, অরু আর ভাইয়ার বিয়েটা কবে দিচ্ছেন?”

অরুর খাওয়া থেমে গেল। সে চোখ পাকিয়ে তাকালো মাহমুদের দিকে। তরী, বাবা সকলেই মিটিমিটি হাসছেন। আজ অরুকে রাগাতে তরীও যোগ দিল। বলল,
-“হ্যাঁ বাবা। আমরা দু-বোন এক বাড়িতে থাকবো। অরুকে নিয়ে তোমারও আর বাড়তি চিন্তা থাকলো না।”

অরু টুকটুক চোখে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে তেজী গলায় বলল,
-“তুমি আমায় ও বাড়ি কেন নিতে চাইছো, আমি বুঝিনা ভেবেছো?”

তরী না বোঝার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেন?”

অরু আরেকটু তেজ ঢেলে বলল
-“তুমি পায়ের উপর পা তুলে খাবে আর আমাকে দিয়ে কাজ করাবে। আমি সব জানি। আমিতো ছোটোবোন, তুমি আদেশ করলেও না করতে পারবোনা। তাই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছো।”

তরীর চোখ চড়কগাছ। সাথে বড্ড হাসি পেলো। মাহমুদ ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-“তরী, অরুকে সবকাজ শিখিয়ে দিও। আমাদের বাড়ি গেলে তো তাকে আবার কাজ করতে হবে।”

-“আমি কাজের মেয়ে না। কতটা স্মার্ট আমি, তুমি দেখেছো?”
অরুর রাগ বাড়িয়ে সকলেই আনন্দ পাচ্ছে। বাবা অরুর রাগকে কান্নার দিকে যেতে দেখে আদুরে স্বরে বললেন,
-“কে বলেছে আমার মা’কে বুড়োলোকের সাথে বিয়ে দেবো? তার জন্য ঘোড়ায় চড়ে সুদর্শন রাজকুমার আসবে।”

অরুর কান্না খানিকটা রোধ হয়ে এলো। যোখান থেকে শুরু হলো, সেখানেই থেমে গেল। সাথে তরী আর মাহমুদের সাথে বড্ড রাগ করলো।

★★★

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছে তরী। একটুপরই তারা বের হবে। মাহমুদ ফ্রেশ হয়ে তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো। চেয়ারের উপর তোয়ালে ছুঁড়েই তরীর কাছাকাছি ঘেঁষলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আয়নার মাঝেই তরীর দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। তরী জমে গেল। নড়চড় করলো না। গালদুটো ক্রমশ আরক্তিম হলো। ভীষণ ভালোলাগা মুহূর্তেও তার ভয়ঙ্কর লজ্জা হচ্ছে। ঢোক গিলে মাহমুদের কাছ থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলো। সরতে পারলোনা। শক্ত হয়ে আটকে রইলো মাহমুদের হাতের বন্ধনে। দুল খানিক সরিয়ে কানে শব্দ করে চুমু খেলো মাহমুদ। তরী চোখজোড়া আবেশে বন্ধ করে নিলো। ঘন হয়ে এলো মাহমুদের শ্বাস।
গভীর স্বরে বলল,
-“তুমি এই দুদিনেই ভীষণ ভয়ঙ্কর সুন্দরী হয়ে উঠেছো, তরী। আগের তুলনায় তোমাকে আমার আরো বেশি পেতে ইচ্ছে করে।”

তরীর ঠোঁটে লজ্জালু হাসি। মুখ লুকাতে এদিক ওদিক তাকালো। মাহমুদ তরীর এলেমেলো দৃষ্টিতেও মুগ্ধতা খুঁজে পাচ্ছে। তরী কেবল মাহমুদের ক্ষীণ চোখজোড়ায় ব্যাকুলতা টের পাচ্ছে। এতটা কাছে থেকেও মানুষটা কতটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে। লম্বা শ্বাস নিলো তরী। এবার নিজ থেকেই মাহমুদের উপর শরীরের ভর ছেড়ে দিল। সরে যাওয়ার জন্য বিন্দুমাত্র ছটফট করলোনা। মৃদু স্বরে বলল,
-“আমি তো আপনার কাছেই আছি। যতটা কাছে হলে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা, ঠিক ততটা কাছে।”

মাহমুদের স্বর গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। তরীর ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলল,
-“যেই তটিনীতে একদিন ভেসে গিয়েছিলাম, সেই তটিনীতে এবার আকন্ঠ মুগ্ধতায় ডুবে থাকতে চাই।”

তরী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মাহমুদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে শার্টের কলারে আলতো হাত রাখলো। হুট করেই এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। মাহমুদের গলায় অধর ছুঁইয়ে ঝটপট সরে দাঁড়ালো। মাহমুদ আর তার নাগাল পেলোনা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষণেই হিসহিসিয়ে হেসে বলল,
-“অসময়ে বড্ড জ্বালাচ্ছো, তরী। এই মুহূর্তে বের হতে না হলে জমের কাছে তোমার রক্ষা থাকতো না।”

তরীও হেসে বলল,
-“যেই জমের কাছে প্রেম আছে, তার কাছ থেকে রক্ষা পেতেও চাই না।”

চোখজোড়া ক্ষীণ করে রগঢ় করে মাহমুদ বলল
-“তাই না? খুব প্রেম পাচ্ছে?”

তরী জবাব না দিয়ে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তৈরি হয়ে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তরী আর মাহমুদ বের হলো। অরুকে কোলে তুলে আগে আগে সিঁড়ি ধরে নামলো মাহমুদ। গাড়িতে চড়েই একহাতে তরীর হাত আঁকড়ে ধরলো। এদিকে অরুকে কোলে নিয়ে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে।

★★★

রামি আর মিঠু দুজনই ক্লাসে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন টিচার তাদের দুজনকে দুষ্টুমির জন্য ওয়ার্নিং দেন। আজ একেবারে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। রামি মাঝেমাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছে স্যারের দিকে। তিনিও আবার ওদের দুজনের দিকে চোখ রাখছেন। কান থেকে হাত সরিয়ে নিলো মিঠু। বেচারার হাত প্রচন্ড ব্যথা হয়ে আছে। তা দেখে স্যার তেড়ে এসে মা*রতে গেলেন। মিঠু বেঞ্চ ছেড়ে দৌঁড়ে টিচার ডেস্কের সামনে চলে গেল। স্যার পূর্বের জায়গায় ফিরে ডেস্কের উপর দিয়ে মা*র*তে যেতেই ডেস্কসহ মিঠুর গায়ে পড়তে নিলেন। দু’হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে মিঠু। স্যার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। তিনি ওভাবে থেকেই মিঠুকে আঘাত করতে চাইলেন। স্যার সহ ডেস্ক ধরে রাখার শক্তি না পেয়ে ডেস্ক ছেড়ে একপাশে সরে গেল মিঠু। স্যার ধপ করে ডেস্ক নিয়ে পড়লেন। ছাত্র-ছাত্রী সকলেই মুখ চেপে হাসছে। সবাই উনাকে” জম “স্যার বলে ডাকে। সেই জম স্যারকে জমের মুখে পড়তে দেখে কেউই মজা নিতে বাদ রাখলোনা। কারো হাসিরই শব্দ হলোনা। রামিটা একটু আওয়াজ করে হেসেই নিজের সর্ব*নাশ ডেকে আনলো। ক্ষেপা বাঘ মিঠুকে ছেড়ে রামির দিকে তেড়ে এলেন। যতদূর হাত চলেছে, রামিকে বেতের আঘাত করলেন। মিঠু নিজেই স্যারের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো।
-“স্যার ওর ভুল হয়ে গিয়েছে। আমরা দুজন আর কাল থেকে দুষ্টুমি করবোনা। এভাবে মা*র*লে রামি অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

স্যার মিঠুকেও আচ্ছামতো পি*টি*য়ে শান্ত হলেন। দুই বন্ধু মা*রে*র দাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বের হলো। মাঠে ঘাসের উপর বসেই একে অপরকে পানি এগিয়ে যত্ন নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পরক্ষণেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে স্যারের কথা মনে করে হেসে কুটিকুটি হয়ে পড়লো। কেউ দেখলে বলবেই না একটু আগে দুজনকে স্যার বেধড়ক মা*র মে*রে*ছে।

★★★

দাওয়াত থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল। তরীর ভীষণ মাথা ধরেছে। অরু আর তরীকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো মাহমুদ। ভাইয়া আর ভাবি কাল তাদের নিজের বাসায় চলে যাবেন।
অরুকে কোলে নিয়েও তরীর মাথাটা আলগোছে নিজের ঘাড়ের দিকে টে*নে নিলো মাহমুদ। অরুর আড়ালেই ভীষণ যত্নে তরীর মাথায় চুমু খেলো। পিঠের উপর হাত নিয়ে বলল,
-“ভালো হয়ে যাবে ব্যথা। তুমি চুপটি করে চোখ বুজে থাকো।”

#চলবে…….#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ফেব্রুয়ারি মাসে রাতের আবহাওয়া ঠান্ডা হলেও দিনের আবহাওয়া বেশ খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে থাকে। মালামাল বহনকারী গাড়ি থেকে আসবাবপত্র নামাচ্ছে মাহমুদ। শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। তরী তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মানুষটিকে পরোখ করলো। তার ক্লান্ত চাহনিতেও কী যেন এক মায়া খুঁজে পেলো। মোহ কাটিয়ে দেওয়া গেলেও মায়া কাটানো সহজ নয়। তরী তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রয়। চেয়ে দেখে তার ব্যক্তিগত মানুষটিকে। হুট করেই তার বড্ড হাঁসফাঁস লাগে। ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি আর লেবু বের করে নেয়। যত্ন করে সবার জন্য শরবত বানিয়ে রাখে। মাহমুদ সবটা নামিয়ে লোক নিয়ে তিনতলায় তুলে নেয়। তরী শরবতের মগ আর গ্লাস হাতে উপর থেকে তিনতলায় নেমে আসে। আয়েশা সুলতানার দিকে এক গ্লাস বাড়িয়ে উপস্থিত লোকজনকে গ্লাসে ঢেলে পরিবেশ করে দেয়। তারা নেমে যেতেই মাহমুদের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। আয়েশা সুলতানা নিজের ঘরে জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পড়লেন।
মাহমুদ এক টুকরো চুমুক বসিয়ে তরীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। তরী সাবধানী চোখের দৃষ্টি চারদিকে বুলিয়ে শান্ত হয়। কোথাও আয়েশা সুলতানা নেই। মাহমুদের বাড়িয়ে দেওয়া গ্লাস থেকে পরপর তিন চুমুক পান করেই ফিরিয়ে দেয়। আলতো হেসে বাকিটা মাহমুদ নিজেই গিলে নেয়। গ্লাস রেখে তরীর মাথায় টোকা মে*রে ফের নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তরী মেকি রাগ দেখিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
-“আমাকে নির্যাতনের অপ*রাধে আপনার ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ”

মাহমুদ যেতে নিয়েও পা থামিয়ে দেয়। ঘর্মাক্ত শার্টের বোতাম সরিয়ে খানিকটা ফুঁ দিয়ে তরীর নাক টে*নে দিলো। অতঃপর রগঢ় করে বলল,
-“আমি দরজায় দাঁড়িয়ে বিরক্ত করবো। চলবে?”

তরী ফের মেকি রাগের সুরে বলল,
-“তবে পা*গ*ল বলে পাবনায় রেখে আসবো।”

মাহমুদ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
-“অবশ্যই পাবনা মেন্টাল হসপিটালের দুটো সিট বুক করবে। আমি যেখানে থাকবো, আমারও বউও সেখানেই থাকবে। আমি আবার তাকে ছাড়া থাকতে পারিনা। বুঝোইতো!”

তরী তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে খানিক বাদেই হেসে ফেললো। বলল
-“খুব ফ্লার্ট করছেন, না?”

মাহমুদ সম্মত না হয়ে বলল,
-“উঁহু, ফ্লার্ট করছিনা। ভালোবাসছি।”

★★★

অরু সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো। ভেতর থেকে হাট করে দরজা খোলা দেখে প্রবীণদের মতো কোমর ভেঙে হেঁটে চললো। তরীর হাতে হাতে সব গোছানোর চেষ্টা করছে। কাজ তো ঠিকমতো হচ্ছেই না, তবুও তরীর মনে হলো তাকে অন্তত সঙ্গতো দিচ্ছে।
আয়েশা সুলতানাও কাজে লেগে পড়লেন। তরী সবার জন্য আগে থেকেই রান্না করে রেখেছে। অরু হাতের কাজ এলোমেলো করে তরীকে বলল,
-“আমাকে আরেকটা কাজ দাও। কতদিন হলো কাজ করিনা। এভাবে শুয়ে-বসে কাটালো হবে?”

তরী হেসে ফেললো অরুর কথা শুনে। যেন পূর্বে কত কাজ করে এসেছে!
তরী বলল,
-“তোর কাজ করা লাগবেনা। পরে বলবি আমি পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছি আর তোকে দিয়ে খাটাচ্ছি।”

অরু মুক ভেংচি দিয়ে বলল,
-“হুহ, লাগবেনা তোমার কাজ দেওয়া।”
ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে নিজেদের ঘরে চলে এলো। সেদিন মাহমুদ তাকে একটা পুতুল কিনে দিয়েছিল, তাকেই কোলে নিয়ে খেলছে। বিড়বিড় করে আদর করছে। এই পুতুলটা পাওয়ার পর থেকেই সে পুতুলের মা হয়ে গিয়েছে। জড় পুতুলটির নড়াচড়া করার শক্তি পর্যন্ত নেই। তবুও অরুর মতে পুতুলটি কাঁদে, হাসে। সে পুতুল কোলে নিয়ে বলল,
-“একদম কাঁদে না। মা এখন তোমায় গোসল করিয়ে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়াবো। এখন কাঁদলে বড়ো একটা কুমির এসে তোমায় নিয়ে যাবে। আমার তুন্নুর তুন্নুর পাখি। তুমি কাঁদলে মায়ের ভালোলাগে?”

অতঃপর গলা চড়িয়ে বলল,
-“এখন কান্না না থামালে মা*র*বো কিন্তু।”
অরুর মতে তার বাচ্চা তার কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাই তার গালে আদর দিয়ে বলল,
-“মা একটুও বকা দেবোনা, আমার তুন্নুর তুন্নুর পাখিকে।”

মিঠু স্কুল থেকে ফিরে আড়লে দাঁড়িয়ে বোনের খেলা দেখছে। ব্যাগ রেখে পকেটে দুটো চকলেট নিয়ে অরুর পাশে এসে বসলো। তার কোল থেকে পুতুল কেড়ে নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে বলল,
-“তোর বাচ্চাকে ঘর থেকে বের কর। সারাদিন ম্যা ম্যা করে বিরক্ত করে ফেলে।”

অরু ভীষণ ক্ষেপে গেল। নাক ফুলিয়ে ফোঁসফোঁস করে মিঠুর দিকে এগোচ্ছে। মিঠু এক নাম্বার বিপদ সংকেত টের পেয়ে নড়তে গিয়েও রক্ষা পেলোনা। অরু আগেই তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। এলোপাতাড়ি কয়েক ঘা লাগিয়ে মিঠুর বুকের উপর থেকে নেমে পুতুল কোলে তুলে নিলো। তাকে শুনিয়ে বলল,
-“মামা ভীষণ পঁচা। মা তোমাকে বের করে দেবো না। তুমি তো মায়ের তুন্নুর তুন্নুর পাখি। মামাকে বের করে দেবো বাসা থেকে, ঠিক আছে?”

মিঠু অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো। ভাইয়ের দাম নেই। তাকে মে*রে পুতুল নিয়ে বাড়াবাড়ি, বাহ্!
মিঠুর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কা*ট*লো অরু।
মিঠু পকেটে হাত দিয়ে চকলেট দুটো নাড়াচাড়া করতেই অরু ভাবভঙ্গি পাল্টে সোজা মিঠুর সাথে ভাব জমাতে চলে এলো। ততক্ষণে পুতুল দূরে ছুঁ*ড়ে চলেও এসেছে। মিঠুর সাথে ভাব জমিয়ে চকলেট খাওয়া শেষ হতেই মিঠুর দিকে থুতু ছিটিয়ে পুতুল কোলে নিয়ে তরীর কাছে তিনতলায় চলে এলো। তপ্ত শ্বাস ছাড়লো মিঠু। এ জীবনে এই ঝগড়ুটে বুড়ীর সাথে সে পেরে ওঠেনি। সবসময় তাকে কুপোকাত করে অরু জিতে যায়। জীবনে আর পারবেও না।

★★★

তরীর আগের তুলনায় ব্যস্ততা বেড়েছে৷ নিজের আর বাবার দু-সংসারেই তাকে সময় দিতে হচ্ছে। অরু তার কাছেই সারাদিন থাকছে। বাবা বাসায় এলে তখন বাবার কাছে চলে যায়।
মাষ্টার্সের প্রিপারেশন চলছে তরীর। মাহমুদ রোজকার মতো কলেজ আসা যাওয়া করছে। চলছে তাদের গভীর প্রেম-নিবেদন, হাসিকান্না, খুনসুটি।
রামি, মিঠু, তরী-মাহমুদ, অরু, আয়েশা সুলতানা, সবাই ভালো আছে। তবুও সবার এই ভালো থাকায় তরী কোথাও একটা কমতি টের পায়। মায়ের কমতি। মায়ের অনুপস্থিতি তাকে যতোটা না পোড়ায়, তারচেয়ে অধিক পোড়ায় বাবার মায়া, ভালোবাসায়। এখনো মৃ*ত স্ত্রীর জন্য তিনি কাঁদেন। তরী একদিন মধ্যরাতে জেগে গুণগুণ কান্নার শব্দে থেমে গেল। উৎস বরাবর এগিয়ে গিয়েই থমকে গেল। মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো বাবা জায়নামাজে বসে তাহাজ্জুদ পড়ে কাঁদছেন। নিজের জন্য, সন্তানদের জন্য, স্ত্রীর জন্য দোয়া করছেন। স্পষ্ট শব্দ ভেসে এসে তার কর্ণকুহরে বাড়ি খাচ্ছে। তরী খেয়াল করে দেখলো বাবা আর আগের মতো নেই। ভেঙে গিয়েছেন। শারীরিক, মানসিক দুদিক থেকেই তিনি ভেঙেছেন। চোয়াল ভঙ্গুর হয়ে চোখ কোটরে গিয়ে ঠেকেছে। আগের সেই আভিজাত্য এখন আর নেই। পুরো মানুষটাই কেমন জীর্ণশীর্ণ হয়ে থাকেন।

তরী বড়ো মেয়ে, বড়ো সন্তান। হুট করেই সে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। সে মেয়ে, বাবার সবটা খেয়াল করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কিছু কিছু ব্যাপারে প্রতিটি মানুষেরই একান্ত ব্যক্তিগত মানুষের দরকার পড়ে। তার জন্য যেমন মাহমুদ আছে, ঠিক তেমনই। সে সিদ্ধান্ত নিলো চাচা আর মামার সাথে কথা বলে বাবাকে বিয়ে করাবে। মায়ের জায়গাটা নিয়ে কষ্ট পেলেও বাবার কষ্টটাও উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো। চাচা আর মামা দুজনের সাথে কথা বলেই বুঝতে পারলো তারা সম্মত আছেন। মাহমুদ নিজেও চাইছে তরীর বাবা ভালো থাকুক। সেও তরীর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালো। সকলেই একজোট হলো। একান্তভাবে কথা বলার জন্য মামা আর চাচা বাড়িতে এলেন। বাবার সাথে আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে ইনিয়েবিনিয়ে বিয়ের কথা তুলতেই বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
-“এই সম্বন্ধে আমি কথা বলতে চাইনা। আমার বাচ্চাদের নিয়ে আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”

মামা বললেন,
-“রুবিনা আমার বোন। তার শূন্যস্থান পূরণ করতে আমি নিজেই চাইছি আপনি বিয়ে করুন দুলাভাই। কোন ভাই কিন্তু এটা চাইবেনা। আমি চাইছি। কেন শুনুন! তরীর এখন সংসার আছে। সে এসে সারাদিন আপনার সংসারে পড়ে থাকলে তো হবে না। হয়তো কেউ কিছুই বলবেনা। কিন্তু এক সময় মনে মনে ঠিকই বিরক্ত হবে। মেয়েটার কথাও ভাবুন। দু-সংসারে মন দিতে গিয়ে তার জিরোবার ফুরসত টুকু থাকেনা।। তাছাড়া আপনার শেষ বয়সে দেখার জন্য হলেও একটা মানুষ দরকার।”

তরীর বাবা গম্ভীর হলেন,
-“আর কয়েক বছর। তারপরই ছেলে উপযুক্ত হবে। তাকে বিয়ে করাবো। তখন পুত্রবধূ সংসার সামলাবে। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি আমি। এখন আমার বিয়ের সময় না।”

তিয়াসের বাবা বললেন,
-“মিঠুর কত বছর বয়স? তুই এমনভাবে বলছিস, যেন তিন বছর পরই বিয়ে করিয়ে দিবি। যদি জামাইয়ের বদলি হয়ে যায় অন্যকোথাও, তখন তো তরীকেও যেতে হবে। সংসার সামলাবে কে?”

তরীর বাবা এক কথায় জানিয়ে দিলেন,
-“আমি কোন বিয়েসাদী করবোনা। খবরদার এসব যেন আমার ছেলেমেয়েদের কানে না যায়! তারা যেন বিন্দুমাত্র কষ্ট না পায় বলে দিলাম আমি।”

বাবার হুমকিতে মামা মনে মনে হাসলেন। মেয়ে নিজেই বাবাকে বিয়ে করানোর জন্য মাঠে নেমেছে। অথচ বাবা বলছে “ছেলেমেয়ে যেন না জানে”।
তরী এদিকটায় আসার চেষ্টাও করেনি। মামার কাছ থেকে পরে বাবার সিদ্ধান্ত শোনা যাবে। অরু আর মিঠুর জন্য সে আছে। কিন্তু বাবাকে দেখার জন্য, দুটো কথা মন দিয়ে শোনার জন্য কেউ নেই। তরী অন্তত বিয়ের পর এইটুকু বুঝতে পেরেছে। মাহমুদকে ছাড়া একরাত বাবার বাসায় থাকলেও তার ছটফট লাগে। আর বাবা মানুষটা এতগুলো বছর যেই সঙ্গীর সাথে কাটিয়ে দিয়েছেন, সে সঙ্গীকে হারিয়ে কতটুকু কষ্টে আছেন তরী একটু হলেও বুঝতে চেষ্টা করে।

★★★

রামি, মিঠু দুই দুষ্টু আজ ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছে। স্যার সামনে থেকে দ্রুত কথা বলায় থুতুর ছিটে এসে মুখে পড়লো রামির। দাঁতে দাঁত চেপে সবটা হজম করে আছে সে। মিঠু শব্দহীন শরীর দুলিয়ে হাসছে। নিজেকে কন্ট্রোল করার বৃথা চেষ্টা হিসেবে বারবার রামির প্যান্ট খামচে ধরছে। অগ্নি চক্ষু নিক্ষেপ করলো রামি। কাজ হলোনা। তার দৃষ্টি দেখে মিঠু আরো হেসে কুটিকুটি। স্যারের নজর পড়লো মিঠুর উপর। তিনি কলম ছুঁড়ে মা*র*লে*ন তার দিকে। মিঠু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী? সমস্যা কী তোমার? আমি পড়া বুঝাচ্ছি সেই খেয়াল আছে? তুমি বোধহয় সবটা পারো। দাঁড়াও, আজ সামনে গিয়ে আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে তুমি সবাইকে পড়া বুঝিয়ে দেবে।”

মিঠু ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। স্যার আরো কিছু কথা শুনিয়ে ক্লাস শেষ দিয়ে চলে গেলেন। ছুটির পরও মিঠু রামির মুখে থুতু পড়া নিয়ে হেসে গড়াগড়ি দেবার মতো অবস্থা করছে। রাগ হলো রামির। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“ইনসাল্ট কাকে বলে? স্যার আজ তোর ইনসাল্টের বেইজ্জতি করে ছেড়ে দিয়েছেন। তাটপরও ব্যাটা নির্লজ্জের মতো হাসে।”

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here