অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব -৩২+৩৩

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

তরীদের বাড়ির সামনে এসে থামলো মাহমুদদের গাড়ি। ভাড়াটে লোকেরা অনেকেই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন। কেউ কেউ পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে আয়েশা সুলতানার সাথে কথা বললেন। তিনি ও হাসলেন, কথা বললেন। সিঁড়ি বেয়ে চারতলা বিল্ডিং এর উপরতলায় উঠলো সবাই। তরীর বাবার ফোনের পর বড়ো ভাইয়া আর ভাবিও সকালে এখানে ছুটে এসেছে।

তরী সকাল থেকেই ব্যস্ত। মামির হাতে হাতে সব সামলাচ্ছে। সাথে মিঠুও সাহায্য করছে। যদিও সে অগোছালো থাকতে পছন্দ করে, তবুও আজ সকাল থেকে গোছগাছের দায়িত্ব নিলো। অরু বারবার এটা-ওটা প্রশ্ন করছে। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে মামি তরীকে গোসলে পাঠিয়ে দিলেন।
-“তুই গিয়ে গোসল করে নে। বাকিটা আমি সামলে নিতে পারবো। সবাই বোধহয় এসে পড়েছে।”

তরীর আজ ভীষণ লজ্জা হচ্ছে, সাথে ভয়। বাবার মত না যেন পাল্টে যায়! মামির কথায় বাধ্য মেয়ের মতো গোসলে চলে গেল।
তরীর বাবা দরজা খুলে দিলেন। সবার সাথে সালাম বিনিময় হলো। সাথে তরীর মামাও আছেন। ইরা তরীর ঘরে সোজা ঢুকে পড়লো। রামি মিঠুর ঘরে ঢুকলো। দেখলো বেচারা বিছানার চাদর পরিবর্তন করে নতুন চাদর বিছিয়ে নিতে ব্যস্ত। রামি দাঁত কেলিয়ে হাসলো। যেই ছেলে অগোছালো থাকে, সে আজ কাজে ব্যস্ত। ব্যাপারটা রামিকে আশ্চর্য করলো না, তবে মজা পেল খুব। ক্লান্ত মিঠু বিরক্ত ঝেড়ে বলল,
-“এমন হাসছিস কেন? মুখ বন্ধ কর। তোর মুখ দিয়ে দুর্গন্ধ আসছে আর দাঁত দেখে তো মনে হয় এক সপ্তাহ ধরে ব্রাশ করিস না।”

রামি রাগলো না। উল্টো গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল,
-“তোর ধারণা ভুল। আমি এক সপ্তাহ নয়, বরং একমাস যাবত দাঁত ব্রাশ করছি না। তুই ঘটা করে আমার বিয়াই হবি, দুর্গন্ধযুক্ত মুখে চুমু খেয়ে তোকে অভ্যর্থনা জানাবো। তারপর এখান থেকে তোর ব্রাশ দিয়ে দাঁত ব্রাশ করে বাসায় যাবো। আমার শরীর শুঁকে দেখ, এক সপ্তাহ যাবত গোসলও করছিনা। শুধু তোর জন্য। আজ এখান থেকে ব্রাশ, গোসল দুটোই সম্পন্ন করে যাবো। তুই তো উদার, জমিদার। নিশ্চয়ই তোর সাবান, ব্রাশ ব্যবহার করলে কিছু মনে করবি না!”

মিঠু নাকমুখ কুঁচকে বমি করার ভান করে বলল,
-“তোকে দেখেই তো আমার বমি পাচ্ছে। আমার ব্রাশ তোর ওই লাল দাঁতে প্রবেশ করলে বোধহয় আমার শেষকার্য সম্পন্ন করেই তোকে ফিরতে হবে।”

রামির চোখ চড়কগাছ। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলল,
-“আস্তাগফিরুল্লাহ মিঠু, তোর বমি পাচ্ছে কেন? তাছাড়া আমি ছেলে হলেও তুই তো মেয়ে নয়! বল কোন মেয়ের সাথে প্রেম করে নিজের এত বড়ো সর্ব*নাশ করেছিস?”

মিঠুর মেজাজ খা*রা*প হলো। পেছন থেকে রামির কোমরে লা*থি বসিয়ে ক্ষান্ত হলো।
-“বে*টা অ*স*ভ্য। আমি কি তোর মতো না-কি? পারলে আমার সাথে কাজ কর। নয়তো চারতলা থেকে নিচে ধা*ক্কা দিয়ে ফেলে দেবো।”

রামি কথা বাড়ালো না। মিঠুর হাতে হাতে কাজ করলো। সুযোগ বুঝে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে নেবে। হাতে হাতে কাজ করে মিঠুকে বলল,
-“এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।”

মিঠু নিজেও ক্লান্ত। কাজ না করা মানুষ আজ এতটুকুতেই হাঁপিয়ে উঠেছে। তারও পানি খাওয়া দরকার। রামির জন্য পানি আনতে চলে গেল সে। রামি সুযোগ বুঝে উঠে পড়লো। ভিলেনের মতো তার ঠোঁটের কোনে লেপ্টে রইলো শয়তানি হাসি। আস্তে ধীরে মিঠুর আলমারি খুললো। তার ইউনিফর্ম বের করে কফ, থুতু মিশিয়ে রেখে দিল। কাল পর্যন্ত ইউনিফর্ম দুর্গন্ধ হয়ে থাকবে। স্কুলে পরে যেতে পারবেনা। কোমরে লা*থি মা*রা*র শোধ স্যার তার পাছায় বেত ভেঙে নিয়ে নেবে।
কাজ শেষ করে দ্রুত খাটে গা এলিয়ে দিল। মিঠু পানি এনে দিতেই তিন চুমুক খেয়ে রেখে দিলো।

★★★

ইরা বসে বসে তরীর অপেক্ষা করছে। বাথরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ বন্ধ হলো অনেকক্ষণ। খট করে দরজা খুলেতেই তাকালো ইরা। তরী চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছে, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। হুট করে ইরার দিকে দিকে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। ইরা দুষ্টু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“খুব খুশি লাগছে, তাই না? মাহমুদ কে পাঠাবো?”

তরীর মাঝে পুরোনো লজ্জা ফিরে এলো। লজ্জায় আলুথালু চেহারা। চোখদুটো এলোমেলো ভাবে দৃষ্টি ফেলছে। জড়োসড়ো হয়ে তরী বলল,
-“ধুর ভাবি।”

-“ধুর? মাহমুদ আসলে ঠিকই খুশি হতে।”

তরী ফের লজ্জা পেয়ে বলল,
-“যাও তো।”

তরী আলমারি থেকে একটা জামা বের করতে নিলেই ইরা বাঁধা দিলো। বলল,
-“আজ একটা শাড়ি পরো।”

ইরা নিজেই বেছে বেছে একটা কালো শাড়ি বের করে নিলো। তরীর কমবেশি শাড়ি আছে, মাঝেমাঝে মায়ের শাড়ি পরেও বান্ধুবীদের সাথে বের হতো। সিল্কের শাড়িটি ইরা সুন্দরভাবে পরিয়ে দিল। মানাসই একটা সাজ দিয়ে বের করে নিয়ে গেল সাথে। তরী মাথানিচু করে রেখেছে। মামি নাস্তা পানি দিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজেও এসে বসেছেন সবার সাথে। আয়েশা সুলতানা তরীকে উনার আর ইরার মাঝখানে বসালেন। মাহমুদ তাদের ঠিক বিপরীতে নয়, তবে আড়াআড়ি সোফায় বসা৷ একবার আড় চোখে তাকাতেই তরী বিষম খেলো। মাহমুদের তন্ময় চোখজোড়া ঘুরেফিরে তাকে দেখতেই ব্যস্ত। সবার মাঝে উপস্থিত থাকায় তরীর অস্বস্তি হলো। কখন না জানি কার নজর পড়ে যায়, আর তাকে লজ্জায় পড়তে হয়। তরী আরেকবার তাকালো। মাহমুদের দৃষ্টি এখনো আগের মতোই অবিচল। ইরা মিটিমিটি হাসছে। ব্যাপারটা তার দৃষ্টি এড়ায়নি। তরীকে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“দুজনকে উঠে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবো?”

ইরার কথায় চমকে উঠলো তরী। ঝটপট মাহমুদের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসলো।
তরীর বাবা সবার দিকে নাস্তা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“নিন।”

আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“নাস্তা পরে হবে। আগে আমি এই ঘটা করে নিমন্ত্রণের কারণ শুনতে চাই। আশা করি এবার হয়তো আমাদের নিরাশ হতে হবে না।”

খানিকক্ষণ চুপ থেকে তরীর বাবা মুখ খুললেন।
-“আমি ভেবে দেখলাম ছেলেমেয়ে দুটো যখন কাজটা করে ফেলেছে, তখন আর আমাদের বাঁধা দিয়ে লাভ নেই। মেয়েটা আমার। আমি যতই সন্তানদের শাসন করি, রাগ দেখাই না কেন? বেশিদিন তাদের উপর রাগ ধরে রাখতে পারিনা। রাগ পড়লে একদিন ঠিকই মেয়েকে বুকে টেনে নিতাম। সে সময়টা একদিন না হয়ে এখন হলে তো ক্ষতি নেই।”

সকলের মুখে প্রশান্তির হাসি। তরীর বাবা বুঝতে পেরেছেন, এটাই বা কম কিসে? আয়েশা সুলতানা “আলহামদুলিল্লাহ” বলে মিষ্টি তুলে নিলেন। দুটো সুখী পরিবারের মিলনের দৃশ্য এক মনোরম সৌন্দর্য সৃষ্টি করলো। বিয়ের কথাবার্তা চলবে। ইরা বুদ্ধি করে তরী, মাহমুদকে কথা বলার সুযোগ করে দিল। কেননা সেই কখন থেকেই মাহমুদের চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা চোখজোড়া তার নজরে এসে নিবদ্ধ হয়েছে। ইরা বলল,
-“এখানে যেহেতু বিয়ের কথা চলবে, তরী আর মাহমুদ না থাকাই ভালো। তারা বরং নিজেদের মধ্যে আরেকবার কথা বলে নিক।”

তরীর বাবা না করলেন না। তবে হ্যাঁ ও বললেন না। মামা বললেন,
-“হ্যাঁ, এখন যেহেতু বিয়ের কথাবার্তা চলবে। ওদের দুজনের এখানে না থাকাই ভালো।”

মাহমুদ মনে মনে খুশি হলেও তরীর কাজে খানিক বিরক্ত হলো। মেয়েটা গাঁট হয়ে সবার মাঝখানে এখনো বসে আছে। লজ্জা পাচ্ছে তরী। তাই মাহমুদ ইরাকে চোখে ইশারা দিল। বাকিটা ইরা সামলে নিল। তরীকে ঠেলে শব্দ করেই বলল,
-“যাচ্ছো না কেন তরী? না-কি নিজের বিয়ের কথা শোনার জন্য বসে আছো।”

তরী থতমত খেয়ে উঠে পড়লো। ইরা একইভাবে মাহমুদকে বলল,
-“তুমি যাচ্ছো না কেন?”

মাহমুদ ভাবির বুদ্ধি দেখে মনে মনে হাসলো। তবে বেশ সন্তুষ্ট হলো ভাবির প্রতি। সে ও তরীর পেছন পেছন বেরিয়ে গেল। দরজা ছাড়িয়ে সিঁড়ি ঘরে পা রাখতেই তরীর হাতে টা*ন পড়লো। আঙ্গুলের ভাজে আঙ্গুল গুঁজে দিল মাহমুদ। পাশাপাশি সিঁড়ি বেয়ে উপরে চললো। তরীকে হুটহাট সাজে দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে ছিল মাহমুদ। সেই রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তরীর চোখে চোখরেখে কন্ঠ খাদে নামিয়ে ভীষণ গভীরভাবে বলল,
-“আমায় পাগল করে দিচ্ছো কেন, তরী?”

তরী অপলক মানুষটিকে দেখে গেল। কতশত মুগ্ধতার ছড়াছড়ি ওই দৃষ্টি জোড়ায়। তরীরও যেন দেখার সাধ মেটে না। সেও বিভোর হয়ে তাকিয়ে রয়। সময় কাটে, বাক্যহীন, মনে মনে গভীর পেমের আদান-প্রদান ঘটে। মাহমুদ তরীর নরম হাতের পিঠে বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
-“কবে তোমায় খুব কাছে পাবো, তরী? তুমি যে আমায় ভীষণভাবে টানছো!”

তরীর গাল দুটো আরক্তিম হলো। চোখের দৃষ্টি নিচু হয়ে গেল মুহুর্তেই। দৃষ্টি ঘুরিয়ে পাশের ছাদে তাকাতেই মাহমুদ বলল,
-“আমার দিকে তাকাও না, প্লিজ!”

★★★

আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“বিয়ে যেহেতু হয়ে গিয়েছে তাই আর দেরি করা উচিত হবে না। দ্রুত শুভ কাজ সেরে নেওয়াই ভালো। আপনাদের কী মতামত? ”

তরীর বাবা নিজেও ভাবলেন, দ্রুত বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। কারণ আশেপাশের মানুষের বি*শ্রী কিচ্ছা একবার যদি আয়েশা সুলতানার কানে যায়, নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলাও লজ্জায় ঘর ছেড়ে বের হবেন না! ইসলামি শরিয়তে ব্যাপারটি জায়েজ হলেও খুবই লজ্জাজনক আর বি*শ্রী ব্যাপার মনে হয় তরীর বাবার কাছে।
তাই সপ্তাখানেকের মাঝেই সব কিছুর আয়োজন করতে চান। তরীর মামা বলল,
-“আমাদের প্রথম মেয়ের বিয়ে, একটু সময় নিয়ে তারপর কাজ এগোলে ভালো হতো। সবটা সুন্দরভাবে করতে চাই আমরা।”

তরীর বাবা বাঁধা দিলেন। বললেন,
-“আমি দেরি করতে চাই না। বিয়ের কাজটা এক সপ্তাহের মাঝে হয়ে গেলেই ভালো হয়। তাছাড়া আমার ভাই ঝামেলা করতে পারে!”

তিয়াসের বাবার কথা মাথায় আসতেই মামাও দ্রুত বিয়েতে একমত হলেন। বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো এক সপ্তাহ পর। অরু মাহমুদের বড়ো ভাইয়াকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিচ্ছে। তিনিও বারবার অরুর দিকে তাকিয়ে চোখ মারছেন। অরুর রাগ লাগছে। সে মুখ ভেংচি কাটলো। বড়ো ভাইয়া অরুরকে রাগিয়ে ভীষণ মজা পাচ্ছেন। তিনি মুখে হাতের উল্টো পিঠ রেখে চুপিচুপি হাসছেন। ফের অরুকে জ্বালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

#চলবে……#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩৩ (ইদ সালামি)
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হলো সাতদিন পর। সাথে আরো টুকটাক আলাপচারিতা চললো। সবাই দুপুরের খাবার এখানেই খাবেন। মামি আয়োজন করলেন। ইরাকে ইশারায় তরীকে ডেকে দিতে বললেন।
ইরা ইশারা পেয়ে উঠে গেল। সিঁড়ি ঘরে পা রেখে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে।

প্রকৃতি থেকে এখনো শীতের রেশ কাটেনি। দখিনা হাওয়ায় শরীর কাটা দিয়ে উঠলো তরীর। মাথানিচু করে নিলো মেয়েটা। হুট করেই ভীষণ লজ্জা লাগলো তার। মাহমুদের সাথে সহজ হয়ে যাওয়া সম্পর্কে আবারো লজ্জারা বেড়াজাল টানলো। অস্থিরতায় বারবার চোখের পলক ঝাপটালো। মাহমুদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরোখ করলো তাকে। নিঃশব্দে ঠোঁটের কোন প্রসারিত হলো। আবারো আদুরে সরে ডাকলো,
-“তরী!”

তরী কথা খুঁজে পেলো না। অস্বস্তি নিয়ে বলল,
-“আমাদের নিচে যাওয়া উচিত।”
পা ঘুরিয়ে হাঁটতে গিয়েই হাতের কব্জিতে টা*ন পড়লো। মাহমুদ আলতো হেসে বলল,
-“পালাচ্ছো কেন, তরী? আর তো মাত্র কিছুদিন। তারপর কী করবে?”

তরীর মৃদু লজ্জা ভুরভুর করে কঠিন লজ্জায় পরিণত হলো। নিজেকে আড়াল করার প্রচেষ্টায় নামতে কার্পণ্য করলোনা। কঠিন ধমক দিতে গিয়েও নরম হয়ে এলো স্বর। বলল,
-“হাত ছাড়ুন। আশেপাশে অনেকেরই বাসা আছে। লোকে দেখলে কী বলবে?”

মাহমুদ কথা বাড়ালোনা। তরীর কথা অনুযায়ী আস্তে করে ছেড়ে দিল হাত। কপালের একপেশে তিলটা ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
-“এটা মাঝখানে হলো না কেন?”

তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। এই পর্যন্ত মাহমুদ কতবার যে তার তিলটা ছুঁয়ে দিয়ে একই কথা বলেছে, তা গুণে শেষ করতে পারবে না সে। এটা কি তার হাতে নাকি? সবইতো উপরওয়ালার সৃষ্টি। তরীর চোখেমুখে আষাঢ় নামলো। তার এই একটা জিনিস বুঝি মাহমুদের খুব অপছন্দ!
তরীর দৃষ্টি দেখে মাহমুদ আবারও হেসে ফেললো। এবার অল্পস্বল্প শব্দ হলো। তরীকে রাগিয়ে দিতে তার ভালোই লাগে। সে অরুর মতো ফটাফট উত্তর দেয় না, কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মাহমুদ বারবার কথার ছলে তিলটা ছুঁয়ে দেখে। অথচ তরীর কাছে প্রকাশ করেনা। সে এতে ভালোলাগা খুঁজে পায়।

হুট করেই ছাদে ইরার আগমন। নিচে নামার জন্য তাড়া দিলো দুজনকে। তরী আর দেরি করলোনা। ত্রস্ত পায়ে নেমে পড়লো। মাহমুদ ধীরেসুস্থে সিঁড়ি ধরে পা ফেলছে। ইরা পেছন থেকে বলল,
-“নতুন করে প্রেমে পড়লে নাকি আজ আবার?”

মাহমুদ হাসলো। বলল,
-“এ আর নতুন কী? আমি তো রোজই তার প্রেমে পড়ি। ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবীতে প্রেম বেঁচে আছে। যদি ভালোবাসার অস্তিত্ব না থাকতো, তবে এই প্রেম, সংসার কিছুই বোধহয় স্থায়ী হতো না!”

ইরা মলিন হেসে বলল,
-“সত্যিই বলেছো। ভালোবাসা আছে বলেই এখনো আমি তোমাদের পরিবারে, তোমার ভাইয়ের জীবনে আছি। নয়তো সেই কবেই আমার ঠাঁই হতো বাবার বাড়িতে।”

মাহমুদ পা জোড়া আরো ধীর করলো। একটু থেমে পেছনে ইরার মুখোমুখি তাকালো। নরম স্বরে বলল,
-“নিজেকে শক্ত করো ভাবি। আল্লাহ একদিন ঠিকই মুখ ফিরিয়ে তাকাবেন।”

ইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় আট বছর হতে চললো বিয়ের। অথচ এখনো সন্তানের মুখ দেখেনি। মাঝেমাঝে নিজের ভাগ্যকে দো*ষা*রো*প করে। আবার ভাবে, ভাগ্য যদি খা*রা*প*ই হতো, তবে সে নিসন্তান হয়ে এই বাড়িতে টিকতে পারতো না।

★★★

বড়ো ভাইয়া গলা ঝেড়ে বললেন,
-“তরী আর মাহমুদের বিয়ের কথা তো হলো। এবার আমার আর অরুর বিয়ের কথাটাও বলুন।”

অরু দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে আছে। সবাই মুখ চেপে হাসছে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনিও হাসছেন। এবার অরুর সবচেয়ে বেশি রাগ হলো। অভিমানে বাবার কাছ থেকে সরে গেল। মাহমুদের বড়ো ভাইয়ার উদ্দেশ্য বললো,
-“নিজের চেহারা দেখেছেন? আমার মতো সুন্দরী মেয়ে তো জীবনে দেখেন নি, তাই লাফাচ্ছেন। আমি কোন বুড়োলোককে বিয়ে করবো না। আমার কি রূপ নেই না-কি?”

বড়ো ভাইয়া আরেকটু রাগিয়ে দিলেন অরুকে। বললেন,
-“কিন্তু আমার তো তোমাকেই পছন্দ হয়েছে। ইরাকে দেখেছো? কেমন বুড়ি হয়ে গিয়েছে। তাই তোমার মতো একটা সুন্দরী বাড়ি নিয়ে যাওয়া দরকার। বলো বিয়ে করবে না আমায়?”

রামি আতঙ্কিত স্বরে বলল,
-“এই কু*ট*নি বুড়িকে বাড়িতে নিলে সর্ব*নাশ হয়ে যাবে। সারাদিন সবার সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে।”

রামিকে ধমক দিলো অরু,
-“তুমি চুপ থাকো। আমি কি তোমার সাথে কথা বলেছি? সব জায়গায় নাক গলিয়ে বসি থাকে।”

রামিও এবার ভাইয়ার দলে যোগ দিলো। বলল,
-“তোর মতো লঙ্কার জন্য আমার ভাইয়ের মতো বুড়োলোকই ঠিক আছে। ভাইয়া ওকে নিয়ে যেও। যেতে না চাইলে আমাকে বলো, বস্তা খুঁজে নিচ্ছি। হাত-পা বেঁধে বস্তা ভরে নিয়ে যাবো।”

অরুর চোখে পানি টলমল করছে। বাবা, আপু, মিঠু কেউই তার পক্ষে কথা বলছে না। সবাই চুপটি করে আছে। ক্রমশ নাকের পাটা ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। কেঁদে ফেলে চিৎকার করে বলল,
-“তোমায় বস্তা ভরবো। আমাদের বাসা থেকে বের হও।”

তরী বোনকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গেল কোলে নিতে। অরু হাত পা ছড়ানো শুরু করলো। তরীকে ধমক দিয়ে বলল,
-“ধরবে না আমায়।”

বাবা এসে ধরতে গেলেন। অরু ফের সরে দাঁড়ালো। হুট করেই অভিমানী স্বরে বলল,
-“তুমিও আমায় ধরবে না। আমার আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই।”

সবার কাছে অরুর কথাটি হাস্যকর লাগলেও তরীর বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠলো। মায়ের অনুপস্থিতিতে মেয়েটাকে সামলাতে বড্ড কষ্ট হয়েছে তার। সেই পুরোনো অরুকে ফিরে পেতে প্রচুর সময় লেগেছে। এখনো একা একা মন খা*রা*প করে বসে থাকে। মন খা*রা*পে*র কারণ জিজ্ঞেস করলে মায়ের নামে একগাদা অভিযোগ নিয়ে বসে। মা কেন তার কাছে আসে না?
তরীর ভাবনার মাঝেই ছোট্ট, অবুঝ অরু বলল,
-“আমি ম*রে গেলে আমাকে আমার মায়ের পাশে ক*ব*র দিয়ে দিও।”

চমকে উঠলেন তরীর বাবা। হাসিহাসি, আনন্দে পরিপূর্ণ ঘরে বিষাদ নামলো। বাবা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে অরুকে কোলে তুলে নিলেন। সারা মুখে চুমু দিয়ে বললেন,
-“এমন কথা বলে না মা। তাহলে বাবা কী নিয়ে থাকবো?”

অরু বাবার কাঁধ জড়িয়ে হেঁচকি তুলে বলল,
-“তোমার ছেলেমেয়ে আছে না? তাদের নিয়ে থাকো। আমাকে মা বলতে হবে না।”

বাবা অনেক কষ্টে অরুর অভিমান কমাতে সক্ষম হলেন। আয়েশা সুলতানা আশার সময় বুঝ করেই এসেছেন। যদি সুখবর হয়, তবে তিনি আসার পথেই তরীকে রিং পরিয়ে আসবেন। ঠিক সেটাই করলেন। বাক্স খুলে তরীর হাতে রিং পরিয়ে দিলেন। বাবার হুট করেই তিয়াসের বাবামায়ের দেওয়া রিং এর কথা মনে পড়লো। তরীকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তোর চাচার দেওয়া রিংটা কোথায়?”

তরী মাথানিচু করে জবাব দিলো,
-“আছে, খুলে রেখেছি।”

বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন,
-“আমি সন্ধ্যায় বের হওয়ার সময় দিয়ে দিস। ওদের রিং ফেরত দিয়ে দেবো।”

তরী মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো।
বাবার আর সন্ধ্যায় বের হওয়া হলোনা। শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ায় বিশ্রাম নিলেন। তাই রিং তরীর কাছেই রয়ে গেল।

★★★

আপনমনে গুণগুণ করতে করতে ইউনিফর্ম বের করলো মিঠু। কেমন দুর্গন্ধ ঠেকছে নাকে। তবে দুর্গন্ধের উৎস খুঁজে পেলোনা। শার্টের বোতাম খুলতে গিয়ে হাতে পিচ্ছিল কিছু লাগলো। মিঠু নাকমুখ কুঁচকে জিনিসটা পরোখ করে দেখতেই আন্দাজ করে ফেললো কফ আটকে আছে শার্টে। কাছে আনতেই নাকে ভুরভুর করে গন্ধ ঢুকে গেলো। দূরে শার্ট ছুঁড়ে ফেলে হাত ধোঁয়ার জন্য ওয়াশরুমে দৌঁড়ে গেল মিঠু। ভেবে পেলো না তার ইউনিফর্মে এসব আসবে কোথা থেকে! অরু এমনটা কখনোই করবেনা। বরং সে মিঠুকে অপরিষ্কার বলে নাক কুঁচকায়। হিসেব মেলাতে গিয়ে রামির কথা মনে পড়লো। কোমরে লা*থি খেয়েও কেমন শান্ত ছিলো গতকাল। তার আর বুঝতে বাকি রইলোনা এসব কার কাজ। রান্নাঘর থেকে পলিথিন এনে শার্টটি ভরে স্কুল ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। তরী ফ্রিজ পরিষ্কার করছে। মিঠুর মাথায় বুদ্ধি খেলে যেতেই সে ওয়াটার পটে ফ্রিজ ধোয়া পানি ভর্তি করে নিলো। অন্য একটা শার্ট পরে বেরিয়ে গেল স্কুলের উদ্দেশ্যে। পথেই রামির সাথে দেখা। সে ঠোঁট টিপে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“ইউনিফর্মে কী হয়েছে? কাক এসে বসেছিল বুঝি?”

মিঠু খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল,
-“বুঝতে পারছি না। শার্টে দেখি কফ, দুর্গন্ধ। তাই অন্যটা পরতে হলো।”

রামিও আর ঘাটালোনা। মিঠু তার ব্যাপারটা ধরতে পারেনি ভেবেই চুপ রইলো। বারবার হাসছে। রামির আবার যখন-তখন পানি পান করার অভ্যেস। মিঠুকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তোর কাছে পানি আছে?”

মিঠু বলল,
-“যা এখান থেকে। তুই সব পানি শেষ করে দিস।”

-“আরে ভাই দে।” বলে রামি ওয়াটার পট কেড়ে নিলো। মুখ খুলতে খুলতে বলল,
-“পানি এতো ঠান্ডা কেন?”
অতঃপর এক কুলি মুখে নিয়েই আর গলাধঃকরণ করতে পারলোনা। নাকে কেমন কাঁচা মাছ, মাংসের গন্ধ লাগলো। মুখের পানি ফেলে দিলো সাথে সাথে। বলল,
-“পানি থেকে এমন মাছের গন্ধ আসছে কেন?”

মিঠু হো হো করে হেসে উঠলো। ব্যাগ থেকে পলিথিনে মোড়ানো শার্ট বের করে বলল,
-“আজকের দিনের ভেতর আমার শার্ট ভালো করে ধুয়ে দিবি। কী ভেবেছিস তুই, তমি কিছু বুঝিনা, না?”

রামি রেগে বলল,
-“আগে বল, এগুলো কিসের পানি?”

মিঠু দাঁত কেলিয়ে বলল,
-“আপু ফ্রিজ পরিষ্কার করছিলো। সেখান থেকেই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”

-“তবে রে..।”
মিঠু আর দাঁড়ালোনা। ছুট লাগালো। পেছন পেছন রামি দাঁত কিড়মিড় করে দৌঁড়ে আসছে। আজ মিঠুকে ধরতে পারলে তার খবর টিভির হেডলাইনে দেখিয়ে ছাড়বে।

#চলবে…..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here