অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব -৩০+৩১

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বাড়ির পরিবেশ থমথমে। দুদিন যাবত বাবা কথা বলছেন না, ঘরে খাচ্ছেন না। তরী উদাসী ভঙ্গিতে বসে রইলো। যতবার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, ঠিক ততবারই নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ছোটো থেকেই তো ভালোবাসা দিয়ে এই বাবা নামক মানুষটি বড়ো করে এসেছেন। মাথায় ছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন। এখনো তাদের কথা ভেবে লোকজনের বিয়ে নামক উস্কানিমূলক বাক্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। সে কি-না বাবার অনুমতি বিহীন বিয়ে করে নিলো? মাহমুদকে সে যেমন ভালোবাসে, বাবাকে তারচেয়ে বেশি ভালোবাসে। সে কি পারতোনা ভয়ডর কাটিয়ে একটিবার বাবার সাথে কথা বলতে! হয়তো বাবা মেনে যেতেন। একটু নয়, অনেকখানিই কষ্ট করতে হতো তাদের। তরী ভাবতে পারলোনা কিছুই। বাবা আজও না খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সাহস করে বাবাকে খেতে বলল তরী। তিনি উপেক্ষা করলেন। যেন কিছুই শুনতে পাননি। এই দুঃসময়ে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সাহায্য করতে পারেন না। তরী অজু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইলো বাবাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। আজ তার বোধদয় হল। মুনাজাতে কাঁদল অনেকটা সময়। মায়ের জন্য দোয়া করলো।

-“হে আল্লাহ, আপনি বড়ো দয়ালু। উত্তম পরিকল্পনাকারী। আমার মতো গুনাহগার বান্দাকে আপনার দরবারে কবুল করুন। সকল কবর বাসীর সাথে সাথে আমার মা’কে ও জান্নাতের উচ্চ মকাম দান করুন। পিতামাতার অবাধ্যতার জন্য আপনি আমায় ক্ষমা করুন। আমার বাবাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুস্থতা দান করুন আল্লাহ। আমার ছোটো ছোটো ভাই-বোন দুটোর কষ্ট কমিয়ে দিন। দিনরাত মায়ের জন্য তাদের আহাজারিতে আমার অন্তর ফেটে যায়। আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারছিনা। আমি জানি আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করুন আমায়। হিদায়াত দান করে আপনার পথে চলার তাওফিক দান করুন। আপনি যা জানেন, আমি তা জানিনা আল্লাহ। আপনি জানেন কিসে আমার ভালো আর কিসে মন্দ। আপনার পরিকল্পনা, নিয়ামতের অপেক্ষায় আছি আমি। যতটুকু নিয়ামত দান করেছেন তার জন্য হাজার হাজার শুকরিয়া। যা বলে শেষ করার সাধ্য আমার নেই।”

টপটপ করে চোখের পানিতে কপোল জোড়া ভিজে গেল। এখন একমাত্র ভরসা আল্লাহ। সে বাবাকে যেমন চায়, তেমন স্বামীকেও চায়। আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে আছে। নিশ্চিয়ই তিনি যা কিছু করেন, বান্দার ভালোর জন্যই করেন।

★★★

রাত নয়টার পর কলিংবেলের শব্দ হলো। বাবা বাসায় আটটার পরই চলে আসেন। মিঠুও ঘরে। তরী মাথায় কাপড় দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে দরজা খুলে দিল। অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার শব্দ ভান্ডার যেন ফুরিয়ে এসেছে। আয়েশা সুলতানা হাসিমুখে ভেতরে ঢুকলেন। সাথে আরও চারজন মানুষ আছে। মাহমুদ সবার পেছনে দাঁড়ানো। ইরা, বড়ো ভাইয়া আর রামিও এসেছে। তরী নিরবতা কাটিয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। নম্র ভাবে ভেতরে আসার আহবান জানালো সবাইকে। বাবা সামনের রুমেই বসা ছিলেন। আয়েশা সুলতানাকে পরিবার সমেত দেখে তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। তবে কিছুই বললেন না। ভাবগতি গাম্ভীর্যপূর্ণ। যেন তিনি ধারণা করে ফেলেছেন আয়েশা সুলতানার আসার উদ্দেশ্যটা কী!

বাবার রাগের ব্যাপারে তরী মাহমুদকে জানিয়েছিল বটে। তবে সে যে হুট করে পরিবার নিয়ে এভাবে চলে আসবে এটা ভাবেনি!

আয়েশা সুলতানা গলা ঝাড়লেন। ভদ্রমহিলা ভদ্রভাবেই কথার শুরু করলেন।

-“কেমন আছেন ভাই সাহেব?”

তরীর বাবার থমথমে চেহারায় জবাব এলো,
-“সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়! আমার বিপদের সময় আপনারা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তাতে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। তবে ছেলেমেয়েকে এভাবে প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে আমি আপনাকে সাপোর্ট দিতে পারছিনা।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আয়েশা সুলতানা। বললেন,
-“আপনার মতো প্রথমে আমিও ব্যাপারটি জানতাম না। যখন জেনেছি তখন সত্যি বড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছি। আমি নিজেও ওদের এভাবে বিয়েটাকে সাপোর্ট করিনা। ছেলেমেয়ে দুজন-দুজনকে পছন্দ করে। অথচ আমরা অবিভাবক কেউই অবগত ছিলাম না। তারা দুজনে মিলে আমাদের সাথে খোলাখুলি আলোচনায় বসতে পারতো। তরী আপনার মেয়ে। তাকে সবার চেয়ে আপনি ভালো চিনবেন। আপনার মেয়ে ভীতু প্রকৃতির। তার এই ভীরুতার কারণেই আজ আপনিও কষ্ট পাচ্ছেন। অবশ্য তার ভয় পাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনার মতো কঠোর ব্যক্তিত্বের একজন বাবার কাছে নিজের পছন্দ জাহির করার মতো সৎ সাহস তার ছিলনা। এখন হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম। ভুল তো করেই ফেলেছে। আমরাই বাবা-মা। আমরা ছাড়া আর ওদের বুকে টেনে নেওয়ার মতো কে আছে?”

মেজাজ এমনিতেই দুদিন যাবত খা*রা*প হয়ে আছে। রাগ সামলাতে না পেরে হাঁকিয়ে উঠলেন তরীর বাবা। রুক্ষ গলায় বললেন,
-“তাই বলে এভাবে বাবা মায়ের সম্মান নিয়ে খেলবে? তখন ওর রিং পরানো হয়ে গিয়েছে আর সে বিয়ে করে বসে আছে। আমার সম্মানটা কোথায় গেল ভেবে দেখেছেন?”

উত্তেজিত হয়ে পড়লেন তরীর বাবা। এতোদিনের সবার উপর জমানো রাগ, অভিমান, কষ্ট একসাথে ঝেড়ে ফেলছেন।
আয়েশা সুলতানা ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েই শান্ত গলায় বোঝালেন,
-”বিয়ের ঠিক করার আগে মেয়ের মতামত চাইলে নিশ্চয়ই আপনার সম্মান খুঁইয়ে যেত না! সন্তানের বিয়েতে যেমন বাবা মায়ের মতামতের প্রয়োজন আছে, তারচেয়ে বেশি মতামত প্রয়োজন সন্তানের। কারণ সংসারটা তার। পুরো একটা জীবনের ব্যাপার। আপনি বাবা। আজ আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। একমাস, দুমাস কিংবা এক বছর পর হলেও মেয়ের জন্য আপনারই মন পুড়বে। আর কারো পুড়বেনা। আপনাদের বিপদের মুহুর্ত টুকু না হয় মনে করুন। তখনও আপনার সন্তানদের কাছে থাকার মতো কেউ ছিলনা। এখনও থাকবেনা। দিন শেষে বাবা সন্তানদের জন্য আর সন্তান বাবার জন্যই আছেন। তাহলে কার উপর এতটা অভিমান জমিয়ে রেখেছেন?”

তরীর চোখে পানি টলমল করছে। মাহমুদ আজ কোন কথা বলছেনা। তার বিবেকহীন কাজের জন্য সে নিজেও লজ্জিত। তাই মাথানিচু করে বসে রইলো। অবশ্য তখন এটা ছাড়া তার মাথায় আর কোন বুদ্ধি কাজ করেনি। ইরা মলিন হেসে বলল,
-“দেখুন না আঙ্কেল, আমার বাবা নেই। তাই আমি জানি বাবা হারানোর ব্যথা কী! আপনি থাকা সত্ত্বেও যখন মেয়েকে পর করে দেবেন, আমার চেয়েও বেশি কষ্ট আপনারা দুজনই পাবেন। কারণ দুজন জীবত থাকা সত্ত্বেও একে অপরের কাছে মৃ*তে*র মতো থাকবেন। এটা কি ভালো হবে? শান্তি পাবেন আপনি? নাকি তরী শান্তিতে থাকবে?”

মাহমুদের বড়ো ভাইও মুখ খুললো,
-“আমার ভাইয়ের মাঝে কি কোন কমতি আছে? আপনার যদি তার কোন কাজ অপছন্দ হয়, তবে সে নিজেকে শুধরে নেবে।
শুধু একটা ভুলের জন্য বাবা-মেয়ে কিংবা ওদের দুজনকে আলাদা করবেন না। আপনার কাছে এই একটাই অনুরোধ।”

তরীর বাবার চেহারার থমথমে ভাব কিছুটা কমে এসেছে। তিনি কিছু একটা ভাবছেন বোঝা যাচ্ছে। রামি ছটফট করছে কখন তরীর বাবার মুখ দিয়ে রাজি শব্দটি শুনবে! তবে বড়োদের মাঝে কোন কথা বলছেনা।

সবাই তরীর বাবার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। তিনিও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“আপনার সময় লাগলে আপনি সময় নিন। আমাদের আপত্তি নেই।”

অগত্যা তরীর বাবা জবাব দিলেন।
-“আমি ভেবে জানাবো আপনাদের।”

সকলের মুখে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখা গেল। বাবা তরীর সাথে কথা বললেন।
-“সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা কর, তটিনী।”

তরীর চোখে আনন্দের অশ্রু। চোখে পানি নিয়ে উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে ছুটে গেল রান্নাঘরে। পেছন পেছন ইরাও উঠে গেল।
রামি, মিঠু দুজনই ছুটে মিঠির ঘরে গেল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কোলাকুলি করলো দুজন। বাবার ভেবে দেখাকে মিঠু যে করেই হোক হ্যাঁ তে পরিণত করবে। মা যাওয়ার পর এই বোনই তো দ্বিতীয় মা হয়ে তাদের আগলে রেখেছে। রাতে শুয়ে পড়ার পর এই বোনই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। মিঠু টের পেলেও ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকতো। সেই বোনকে কষ্ট পেতে দেয় কী করে?

★★★

তরীর হাতে হাতে কাজ করতে গিয়ে ইরা বলল,
-“চিন্তা করো না, তরী। তোমাকে আমার জা করে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হবোনা।”

তরী আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। আল্লাহ কতটা দয়ালু। তার কাছে চাইলেই সব পাওয়া যায়। বাবা তার সাথে কথা বলেছে, আপাতত এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই। ঘন্টা খানেক পূর্বেও যে দুনিয়াকে বিষাক্ত মনে হয়েছে, সেই দুনিয়াকে এখন আনন্দের মেলা, সুখের সমুদ্র মনে হচ্ছে। অল্পতেই নিরাশ হলে হয়না। আল্লাহকে ভরসা করে ধৈর্য ধরলে আল্লাহ তার বান্দাকে নিরাশ করেন না। আপনি আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তিনি দেবেন, যা আপনার জন্য উত্তম। সময় মতো আপনি আপনার পাওনা পেয়ে যাবেন। ধৈর্য হারালে চলবেনা।

সবার রাতের খাবার দুজনে মিলে তৈরি করে নিচ্ছে হাতে হাতে।
অরু মাহমুদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। মাহমুদ ইশারায় কাছে ডাকলেও গেল না। উঠে পড়লো মাহমুদ। অরুকে কোলে তুলে নিলো। সে গাল ফুলিয়ে রেখেছে। মিঠুর কাছে শুনেছে তার আপুকে নাকি মাহমুদ ভাইয়া নিয়ে যাবে। তাই অরু ভীষণ রেগে আছে। মাহমুদ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“অরু পাখির মন খা*রা*প কেন? কেউ বকেছে?”

অরু ফোলা ফোলা গালে থমথমে স্বরে জবাব দিলো,
-“আমার আপুকে তোমায় নিয়ে যেতে দেবো না।”

মাহমুদের বড়ো ভাই অরু গাল টে*নে বলল,
-“আমরা সাথে তোমাকেও নিয়ে যাবো। আমার দুটো বউ লাগবে। একটা আছে, আরেকটা তুমি হবে। তোমাকে ও বিয়ে করবো।”

অরু গাল থেকে হাত সরিয়ে নাকমুখ কুঁচকে বলল,
-“তুমি বুড়ো। আমি বুড়োলোক বিয়ে করবোনা।”

হো হো করে হেসে উঠলেন বড়ো ভাইয়া। ওদিকে মিঠু আর রামির বেশ আলাপ চলছে চুপিসারে। একজনও ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না।
সবার রাতের খা*বা*র শেষ হতেই মাহমুদরা বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। আজ অরু এখন পর্যন্ত ঘুমায়নি। সবাই বেরিয়ে যেতেই সে দরজা ধরে দাঁড়ালো।

-“যাও বের হও। আমার আপুকেও নিতে দেবোনা। আমিও বুড়োলোক বিয়ে করবোনা।”
বলেই ঠা*স করে সবার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল অরু।
বাইরে দাঁড়িয়ে তিন ভাই উচ্চ স্বরে হাসলো।

★★★

অনেকদিন পর তরীর মামা ফোন করেছেন। তরীর বাবা মাহমুদ আর তরীর বিয়ের ব্যাপার নিয়ে খোলাখুলি কথা বললেন। মামা বললেন,
-“বিয়ে যেহেতু করে নিয়েছে তখন আর বাঁধা হয়ে লাভ কী দুলাভাই। তাছাড়া ছেলে অনেকগুলো মাস আপনার চোখের সামনে চলাফেরা করেছে। আপনার নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে ধারণা আছে। সবটা ঠিকঠাক হলে আমার মনে হয়না বাঁধা দিয়ে কোন লাভ হবে। মেয়ে যদি সুখী হয় তখন আপনি নিজেও তৃপ্তি পাবেন।”

শা*লা*র সাথে কথা বলেও বেশ অনেকক্ষণ ভাবলেন তরীর বাবা। পরদিন বাইরে আরো কয়েকজনের সাথে বিষয়টি আলোচনা করলেন। অনেকেই মাহমুদ -তরীর বিয়ের পক্ষেই মতামত দিলেন। কয়েকজন অবশ্য খোঁচা দিতে ছাড়লেন না। কিছু পরনিন্দাকারী, টক্সিক মানুষ না থাকলে কি দুনিয়া চলে!
বাইরে আলোচনা হওয়ায় তিয়াসের বাবার কান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছালো। সব ভালোর মাঝে তিনি এক বি*শ্রী কাহিনী রটানোর চেষ্টায় নামলেন। আশেপাশের অনেককেই তরীর বাবার সঙ্গে মাহমুদের মায়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা তুলতে উস্কে দিলেন। ব্যাপারটা কানে আসতেই লজ্জায় টেকা গেলনা। তরীর বাবা আগের মতোই গম্ভীর হয়ে গেলেন।
তরীর মনে পূনরায় আতঙ্ক ভর করলো। তার জীবনের সুখটা পেতে পেতে না আবার হারিয়ে ফেলে!

#চলবে………#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

তরীর বাবা সকালে বের হতেই একজন ইনিয়েবিনিয়ে বিয়ের কথা তুললেন। সাথে আরো কয়েকজন সঙ্গ দিয়ে মাহমুদের মায়ের কথা তুললেন। আকাশ থেকে পড়লেন যেন তিনি। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ! মেয়ের শাশুড়ীকে নিয়ে এমন নিম্ন মানসিকতার চিন্তাভাবনা মানুষের কোথা থেকে আসে? অবশ্য তরী মাহমুদের বিয়ের ব্যাপার তিনি এখনো খোলাসা করেন নি। শুধু মেয়ের জন্য পাত্র হিসেবে মাহমুদ কেমন হবে, এতটুকুই আলোচনা করেছিলেন পরিচিত কয়েকজনের সাথে। রেগে গেলেন তরীর বাবা। রুক্ষ গলায় বললেন,

-“আজেবাজে কথা বলা থেকে দূরে থাকুন। কে দেয় আপনাদের এমন বুদ্ধি? উনি আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। এখন উনার ছেলের সাথে মেয়ের জন্য সমন্ধ নিয়ে আলোচনা চলছে। সেটা জেনেও কী করে এমন ধরনের কথা বলতে পারেন?”

একজন বললেন
-“আহা! রাগ হচ্ছেন কেন ভাই? মেয়ের বিয়েও দিলেন, সাথে আপনার ঘরও পূর্ণ হলো। তখন মেয়ে শাশুড়ী নয়, মা পাবে। আপনি বরং বড়ো ছেলে পাবেন। আমরা আপনার ভালোর কথা ভেবেই বলছি।”

অতিরিক্ত রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তরীর বাবার। চোখের রং পরিবর্তন হয়ে সফেদ অংশে লালছে আভা দেখা দিল। হুংকার ছাড়লেন তিনি,
-“আমার ভালো আপনাদের ভাবতে বলিনি। নিজের ভালোমন্দ আমি নিজেই বুঝি। বিপদের সময় আপনাদের পাইনা। অথচ মানুষ যখন একটু সুখে থাকতে চায়, সেখানে ব্যাঘাত ঘটাতে তখনই আপনাদের দেখা যায়। উস্কানিতেতো খুবই উস্তাদ আপনারা। আর যদি দোকানপাট, কিংবা বাজার-ঘাটে এই সমস্ত আলোচনা শুনি, তবে মা*ম*লা করতেও আমার দিল কাঁপবে না। নয়তো যার মুখে শুনবো তাকে ধরেই পায়ের জুতা খুলে পে*টা*বো। কিছু বলিনা বলে আস্কারা পেয়ে যাচ্ছেন খুব, তাইনা?”

লোকগুলো কিছুটা দমে গেল। কেটে পড়ার ভঙ্গিতে একজন বলল,
-“আজকাল মানুষের ভালো করতে নেই। থাক বাবা আমাদের দরকার নেই। নিজের জীবন নিয়ে ভেবেই কুল পাই না।”

তরীর বাবা দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। সারাদিন ব্যাপারটা নিয়ে মনের মাঝে খচখচানি ভাব ছিলো। যতই হোক তিনি তো জানেন মেয়ের শাশুড়ী হয় আয়েশা সুলতানা। কতটা লজ্জার ব্যাপার। বাসায় এসেই গম্ভীরমুখে বসে রইলেন।

তরী বাবার এই গাম্ভীর্যের কারণ সম্পর্কে অবগত। বিকেলেই ছাদে এক ভাড়াটিয়া আন্টি তাকে বাবার সাথে হওয়া ঘটনা খুলে বললেন। উনার স্বামীও নাকি সেখানে ছিলেন। যদিও সবকিছু শুনেন নি। যতটুকু শুনেছেন ঠিক ততটুকুই স্ত্রীকে এসে বলেছেন। আর সেটাই তরীকে জাননো হলো। একটা কথা এক কান থেকে দুকান তারপর তিন কান পর্যন্ত এসে হুবহু আগের ঘটনা থাকেনা। পরিবর্তন হয়ে যায় অনেকটাই। তরীও সম্পূর্ণ না জেনেই আতঙ্কিত হয়ে আছে। বাবা যদি মান সম্মানের কথা ভেবে তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখা টুকু ও বাদ দিয়ে দেন! তরী পাগল হয়ে যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই প্রেম তাকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। সে জানে মাহমুদ নিজেও তাকে কতটা ভালোবাসে, যত্ন করে। মাহমুদের ভালোবাসা টুকু গভীর কিন্তু প্রকাশ খুবই কম।

তরী ভয়ে ভয়ে বাবাকে ডাকলো,
-“বাবা!”

-“হু।”
ধ্যান ভাঙা স্বরে সাড়া দিলেন বাবা। চোখ ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। অতঃপর মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু বলবি?”

তরী ঢোক গিলে ফের জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কিছু নিয়ে চিন্তা করছো?”

বাবা তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
-“তেমন কিছু না।”
মাথা থেকে খা*রা*প চিন্তা টুকু দূর করতে আজ নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন। তরী আশ্চর্য হলো! মায়ের মৃত্যুর পর বাবা একদিনের জন্যেও নিজেদের ঘরে পা রাখেন নি। এতগুলো মাস পর আজ পা রাখলেন। ভেতর থেকেও দরজা বন্ধ করে দিলেন। তরী আর ভেতরের দৃশ্যটুকু সম্পর্কে অবগত হতে পারলোনা।

★★★

স্ত্রীর হাতে গড়া প্রতিটি জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন তরীর বাবা। চোখের কোনে মেঘ জমেছে। হুটহাট বৃষ্টি নামতে পারে। গলা ভার হয়ে এলো। তিনি আজ ভীষণভাবে উপলব্ধি করলেন, স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন তার কদর বোঝেননি। এখন বোধদয় হলো। রুবিনা নামক নারীটি উনার জীবনে অনেক বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিল। কখনো নিজের একরোখা মনোভাবের কারণে স্ত্রীর মতামতের গুরুত্ব পর্যন্ত দিতেন না। এখন বুঝতে পারছেন কতটা ভুল তিনি করেছেন। বাংলায় প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে,” আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না।”

তরীর বাবা আজ সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়ের দিকটা ভেবে দেখবেন। সত্যিই তো সংসারটা মেয়ে করবে। এখানে তার মতামতের গুরুত্বটাই আসল। পিতামাতার দায়িত্ব হলো কন্যাকে সুপাত্রে দান করা। মাহমুদ খা*রা*প ছেলে নয়। তবুও তিনি আত্মগর্বে মেয়ের মতামতের বিরোধীতা করলেন। কিছুক্ষণ স্ত্রীর কথা ভেবে অশ্রু ঝরালেন। অতঃপর চোখেমুখে পানি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তরীকে ডাকলেন।
-“তটিনী।“

তরী অরুকে নিয়ে ছুটে বাবার কাছে এলো। ডাকে সাড়া দিয়ে বলল,
-“জি বাবা।”

বাবা স্বাভাবিক গলায় তরীকে সামনের সোফা দেখিয়ে বললেন,
-“এখানে বস। কথা আছে তোর সাথে।”

তরীর ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবা হঠাৎ কী কথা বলতে চাইছেন! তটস্থ চোখের দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে এলো। ভয়ে ভয়ে বাবার সামনে বসতেই তিনি মেয়েকে বেশ খানিকক্ষণ অবলোকন করলেন। একটু সময় নিয়ে গম্ভীর স্বরে শুধালেন,
-“তুই কী চাস?”

তরীর নত মস্তক হুট করেই সোজা হয়ে গেল। বাবার পানে তাকিয়ে রইলো চোখজোড়া। বুঝতে পারলোন সে। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“কিসের কথা বলছো বাবা?”

বাবা সরাসরি বললেন,
-“মাহমুদের সাথেই থাকতে চাস, না-কি আমাদের সাথে?”

তরীর চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। পানি চিকচিক করছে। কিন্তু জবাব দিলোনা। বাবা তাড়া দিলেন।
-“আমি তোকে কিছু প্রশ্ন করেছি!”

আপনাআপনি নিরব অশ্রু কপোল স্পর্শ করলো। হাতের উল্টো পিঠে দ্রুত চোখের পানি মুছে নিলো তরী। রুদ্ধ হয়ে আসা গলায় বলল,
-“বাবা আমি সবাইকে নিয়ে থাকতে চাই। প্লিজ আমাকে এভাবে দোটানায় ফেলো না! আমি তোমাদের ও ছাড়তে পারবোনা আর না মাহমুদকে।”

বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন,
-“আমি তোকে দেখে দিনদিন অবাক হচ্ছি, তটিনী। আমার ভীরু মেয়েটা দিনদিন সাহসের উচ্চ পযার্য়ে চলে যাচ্ছে। আগের তটিনী হলে কখনোই আমার সামনে কথাটুকু বলতে পারতোনা!”

তরী মাথানিচু করে নিলো। বাবার সামনে এভাবে বলায় লজ্জাও হচ্ছে। কিছু পেতে হলে কিছু বিসর্জন দিতে হয়। সে না-হয় ভীরুতাকে বিসর্জন দিলো!

বাবা আর কোন প্রশ্ন করলেন না। উঠে চলে গেলেন। অরু পিটপিট করে তরীকে দেখছে। দুপাশে ঝুলে থাকা লম্বা বিনুনি দুটো পেটের কাছটা স্পর্শ করছে। গোলাপি রঙের ফ্রকে মেয়েটাকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে। যখন ঝগড়া করার মুডে থাকে, তখন বেশি আদুরে দেখায়। অরু তরীর চোখের পানি মুছে দিল। নরম স্বরে বলল,
-“কাঁদছো কেন আপু? মাহমুদ ভাইয়া তোমাকে নিয়ে যাবে, এজন্য?”

তরী অরুর ধারণা বদলাতে দিলোনা। উপরনিচ মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। ছোট্ট অরু নাক ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো। বড়োদের মতো গম্ভীর হতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। বলল,
-“তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে আলমারির ভেতর লুকিয়ে রাখবো। মাহমুদ ভাইয়া তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবো ‘আপু আলমারির ভেতর নেই’। তখন আর খুঁজে পাবেনা তোমায়।”

তরীর দুঃখের মাঝেও হাসি পেল অরুর কথা শুনে। চেপে রাখলোনা। কান্না চোখেই ফিক করে হেসে ফেললো। অরু উৎফুল্ল হয়ে বলল
-“দেখলে তো, আমার খুউউউব বুদ্ধি।”

অরুর নাক টিপে দিয়ে হেসে তরী বলল,
-“হ্যাঁ, আপনার খুব বুদ্ধি।”

★★★

ভাইয়ের সাথে দেখা হলেও কথা বললেন না তরীর বাবা। তিয়াসের বাবা বিদ্রুপ করেই বললেন,
-“আজকাল সাপের পাঁচ পা দেখেছিস না-কি?
না-কি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিস?”

তরীর বাবা হাসলেন। না দাঁড়িয়ে হেঁটে যেতে যেতেই বললেন,
-“নাহ্, তবে আমার পেছনে লোক লাগানো মানুষ দেখেছি।”

কথাটা তিয়াসের বাবাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন বুঝতে পেরেই তিনি তেতে উঠলেন। পেছন থেকেই উচ্চস্বরে বললেন,
-“বাপ যেমন বে*য়া*দ*ব, ঠিক ছেলে-মেয়েদের ও তেমনই শিক্ষা দিয়েছে।”

তরীর বাবা জবাব দিলেন না। ঠুনকো মানুষ বিবেচনা করে এড়িয়ে গেলেন তিয়াসের বাবাকে। বিপদের সময় পাশে থাকেনা। মেয়েকে বিয়ে দেবেনা জানতেই তিনি দু*শ*ম*ন হয়ে গেলেন। আজ বুঝতে পারলেন তরীকে বিয়ে করিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য কী। ভেবেছিলেন হয়তো এমন সহজ সরল মেয়েকে যেভাবে ইচ্ছে চালাতে পারবেন, খাটাতে পারবেন। জীবনে বহু ভুল করেছেন তরীর বাবা। তবে এবার আর ভুল করবেন না।
পরদিন দুপুরেই আয়োশা সুলতানাকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ জানালেন।

#চলবে…….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here