অনুভূতি
পর্ব ৩৩
মিশু মনি
.
৫১.
রাত্রিবেলা সবাই মিলে আড্ডায় বসেছে। বাংলোর সামনে কাঠখড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চারিদিকে বসে সবাই মিলে আগুন পোহাচ্ছে আর গল্প করছে। মৃদু কুয়াশা পড়েছে চারিদিকে, আজ আবার পূর্ণিমা। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়েছে। চাঁদের আলোয় চা বাগানের পাতাগুলো চকচক করছে। পুরো বাগান একদম নিস্তব্ধ। সুবিশাল চা বাগানের পাশে আবার ঘন ঝোপ জংগল। রাতের নির্জনতা আরো বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে। ঝিঝির ডাক কানে আসছে। এরকম পরিবেশে কাঠখড়িতে আগুন লাগিয়ে আগুন পোহানো আর আড্ডা দেয়ার মাঝে অন্যরকম একটা আনন্দময় উত্তেজনা কাজ করছে সবার মধ্যে।
মিশু ও মেঘালয় পাশাপাশি বসেছে। মিশুর পাশে রৌদ্রময়ী ও সায়ান। পূর্ব ঠিক রোদের সামনে মুখোমুখি হয়ে বসেছে। এভাবে বসার কারণে সরাসরি চোখ চলে যাচ্ছে রোদের দিকে। পূর্ব অজান্তেই বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। নিজেও জানেনা এতবার তাকাচ্ছে ও। কিন্তু রৌদ্রময়ী বুঝতে পারছে পূর্ব বারবার ওকে খেয়াল করছে। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।
সায়ান গিটারে টুংটাং সুর তোলার চেষ্টা করছে। মিশু ও রোদ দুজনে গল্প করছিলো এতক্ষণ। গিটারে মিউজিক ওঠার পর ও থামলো। মেঘালয় ই প্রথমে গান শুরু করলো,
“সর্বত মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রাই
বৃন্দাবনের বংশীধারী ঠাকুর কানাই
একলা রাধে জল ভরিতে যমুনাতে যায়,
পিছন থেকে কৃঞ্চ তখন আড়ে আড়ে চায়..
জল ভর, জল ভর রাধে ও গয়ালের ঝি
কলস আমার পূর্ণ করো রাধে বিনতি..
কালো মানিক হাত পেতেছে চাঁদ ধরিতে যায়,
বামন কি আর হাত বাড়ালেই চাঁদের দেখা পায়?
কালো কালো করিস না লো ও গয়ালের ঝি,
আমায় বিধাতা করেছে কালো আমি করবো কি?”
এই লাইনটা গাওয়ার সময় মেঘালয়ের গলায় অন্যরকম কম্পন হলো। কণ্ঠের ওঠানামার সাথে গানের লিরিকটা মিশে একদম অন্যরকম লাগছিলো। গানের কথাগুলো যেন রোদকে উদ্দেশ্য করেই গাওয়া হচ্ছে। রোদ মাথা নিচু করে আগুনের দিকে চেয়ে আছে। ওর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। পূর্ব খেয়াল করলো রোদের চোখের পানি। ইশারায় মেঘালয়কে থামতে বলল ও। মেঘালয় থামলো না। গাইতে গাইতে হুট করেই এক গান থেকে অন্য গানে চলে গেলো। পূর্ব হাসলো মেঘালয়ের গান বদলানো দেখে। আর কেউ কিছু বুঝুক না বুঝুক মেঘালয় সবকিছু বুঝে ফেলে। ও অন্য একটা গান শুরু করে দিলো,
“আমি ভাবতে পারিনি তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ…”
“আমি থামতে পারিনি তোমার গালে নরম দুঃখ আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ..”
পূর্ব মুচকি হাসলো। রোদ চোখ তুলতেই ওর সাথে চোখাচোখি হলো। এবার গানটা একদম ঠিক আছে। মেঘালয় গেয়েই যেতে লাগলো। মিশু নিষ্পলক ভাবে চেয়ে আছে মেঘালয়ের পানে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। আস্তে আস্তে কি ও মেঘালয়ের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে? প্রেমে পড়ার অনুভূতি কি এমন হয়? বুকের বামপাশে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয়। কেমন কেমন যেন লাগতে থাকে সবসময়। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে,ছুতে ইচ্ছে করে। এত কাছে থেকেও এক ধরণের বিষণ্ণতা ছেয়ে যায় সবসময়।
মেঘালয় গান শেষ করতেই সায়ান মিশুকে বললো, “ম্যাশ ভাবি এবার আপনি গান গেয়ে শোনাবেন।”
মিশু লাফিয়ে উঠলো, “আমি! না না না।”
– “বারে, সেদিন ডান্স দিলে আর আজকে গান শোনাতে পারবা না? গান গাইতেই হবে। শুরু করো তো।”
সব বন্ধুরাই মিশুর গান শোনার জন্য জোড় করতে লাগলো। এমনকি রোদ ও মিশুকে অনুরোধ করছে একটা গান শোনানোর জন্য। মিশু করুণ চোখে মেঘালয়ের দিকে চাইলো। মেঘালয় তো ডান্স দেয়াতে রেগে গিয়েছিলো, আজকেও কি রেগে যাবে নাকি? থাক, গাওয়া যাবেনা।
মেঘালয় নিজেই ওকে বললো, “সবাই এত করে বলছে একটা গান শুনাচ্ছো না কেন মিশু? শোনাও”
মেঘালয় ও দুবার বললো। মিশুর আর ভয় হচ্ছেনা। রাত বেড়ে যাচ্ছে, মাথার উপর কুয়াশা পড়ে ভিজে যাচ্ছে চুল। সামনে আগুন, গোল হয়ে বসে আছে বন্ধুরা। সবাই নিশ্চুপ,রাতের নির্জনতা বিরাজ করছে সবার মনে। কেউ কোনো কথা বলছে না। ঝিঝি ডাকছে,চা বাগানের অন্যরকম একটা শব্দ আছে। কেমন যেন ভৌতিকতা বিরাজ করছে। রাতের পোকারা ডাকছে, নির্জনতা কানে এসে বাজছে। সবমিলিয়ে অদ্ভুত মুগ্ধতা ছড়িয়েছে সবখানে। মিশু চোখ বন্ধ করে গান গাইতে আরম্ভ করলো,
“কার্নিশে ভূল,অবেলা বকুল
থাকো ছুঁয়ে একুল ওকুল..
থাকো ছুঁয়ে শহুরে বাতাস,
ছুঁয়ে থাকো নিয়ন আকাশ..
আবছায়া চলে যায় হিজলের দিন,
অভিমান জমে জমে আমি ব্যথাহীন..
আহারে জীবন, আহা জীবন..
জলে ভাসা পদ্ম যেমন…”
মিশুর কণ্ঠে অদ্ভুত মায়া। খুব অনুভূতি নিয়ে গাইছে গানটা। ওর গলার স্বরের সাথে রাতের নির্জনতা মিশে গিয়ে বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে সবার। গানের প্রত্যেকটা শব্দ ও এমনভাবে উচ্চারণ করছে যে সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। যার যত সুপ্ত ব্যথা আছে,সব ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। রোদের চোখ ছলছল করছে। বাকিরা একদম স্তব্ধ।
মিশু গেয়েই চলেছে,
“আহা পারতাম,যদি পারতাম..
আঙুল গুলো ছুঁয়ে থাকতাম..
বিষাদেরই জাল টালমাটাল,
এ কোন দেয়াল, এ কোন আড়াল
ছাই হয় গোধূলি কারে যে বলি..
এ কোন শ্রাবণ আজ বয়ে চলি…
আহারে জীবন, আহা জীবন..
জলে ভাসা পদ্ম যেমন…”
মিশুর চোখ বন্ধ। কিন্তু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কাঠখড়ির আগুনের আলোয় চিকচিক করছে ওর গাল। ওর মায়াবী মুখের দিকে চেয়ে থেকে মেঘালয়ের বুকের চিনচিন ব্যথাটা আরো বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই সবাই নস্টালজিক হয়ে পড়েছে। মিশু গানটা গেয়েই যাচ্ছে। ওর গাল বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। বাকিরাও সবাই হঠাৎ ই কেমন যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। এই গানটা তো ওরা অনেক বার শুনেছে,কিন্তু আজকে মিশুর গলায় শুনেছে কেমন যেন বুকটা ব্যথা করছে। পুরনো লুকানো কষ্টগুলো জেগে উঠছে সব।
সবার আগে আরাফ উঠে দাঁড়ালো। ওর ও খারাপ লাগছে এভাবে বসে থাকতে। আরাফ উঠে হেঁটে চলে গেলো। মিশু চোখ বন্ধ করে গেয়েই যাচ্ছে। রোদ ও আর বসে থাকতে পারলো না। ওর এখন কাঁদতে হবে, যেকোনো কোথাও গিয়ে সবার আড়ালে বসে কাঁদতে হবে ওকে। কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারছে না ও। রোদ উঠে যাওয়ার পর পূর্ব ও চিন্তিত মুখে রোদকে অনুসরণ করলো। মেঘালয় অবাক হয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলো। সায়ান একাই বসে থাকবে কিভাবে তাই সেও উঠে এলো। ওর গায়ে থাকা চাদর টা মেঘালয়কে দিয়ে ইশারায় মিশুকে পড়িয়ে দেয়ার কথা বলে সায়ান ও চলে গেলো। এখন খোলা আকাশের নিচে আগুনের পাশে শুধু মিশু আর মেঘালয় ই বসে রইলো।
“মেঘে মেঘে জমে আজ বেদনার বাঁধ,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে থেকে থেকে জলের নিনাদ…”
মেঘালয় মিশুর কাঁধে হাত রাখলো। মিশু চোখ মেলে তাকালো। মেঘালয় ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “মিশু, ভালোবাসি তোমাকে।”
মিশু আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। মেঘালয় ওকে বাঁধা দিলো না। কোনো অচেনা ব্যথা নাড়া দিয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরেছে ও। তাই আর কোনো শব্দও করলো না। মিশু অনেক্ষণ ধরে কান্না করার পর চোখ মেলে তাকালো। অবাক হয়ে বললো, “সবাই গেলো কোথায়?”
– “তুমি সবাইকে ইমোশনাল করে দিয়েছো। কেউ কারো চোখের জল কাউকে দেখাতে চায়না।”
– “কি বলো? আমার না হয় কষ্ট হচ্ছে,সবার কেন হবে? সবার ই কি কষ্ট আছে?”
– “সবার ই নিজস্ব কিছু বেদনা আছে মিশু। কারো কম,কারো বেশি। কিন্তু কষ্ট সবার ই ভেতরে চাপা আছে।”
মেঘালয় মিশুকে বুকে আলতো করে চেপে ধরে চাদর টা দুজনের গায়েই দিলো। একটা চাদরের ভেতরে দুজনে গুটিসুটি মেরে বসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রইলো। মাথার উপর টুপটুপ করে কুয়াশা পড়ছে। রাত বেড়ে অনেক হয়েছে। কিন্তু এই নির্জনে এভাবে জড়াজড়ি করে বসে থাকতেও সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। সাথে একটা নীল বেদনাও ছেয়ে আছে।
মিশু মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মেঘমনি।”
– “হুম বলো। আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দিবো মিশু।”
মিশু একটু সময় নিলো। চোখ মুছে ওর বুকে আরো একটু মুখ গুঁজে দিলো। হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়ে ওর বুকে মাথা রেখে বলে যেতে লাগলো।
“আমার সাথে সবসময় এমন কেন হয়? আমি সেই কৈশোর থেকেই বারবার এই জিনিস টার সম্মুখীন হই। আমাকে তো ছোটবেলা থেকেই রোজগার করে করে খেতে হয়। জানো,যখন আমি কারো কাছে কাজের জন্য যাই। কতজন আমাকে কত রকম বাজে প্রস্তাব দেয়? একদিন এক কর্মকর্তার কাছে দেড় ঘন্টার মত বসে ছিলাম যেন ওই প্রজেক্টের কাজে আমাকে কর্মী হিসেবে নেয়। কিন্তু দেড় ঘন্টা পর সবাই চলে গেলে আমাকে একা পেয়ে উনি বললেন, ‘এত সুন্দর শরীর থাকতে এভাবে কাজের জন্য বসে থাকা লাগে? সন্তুষ্টির বিনিময়ে সন্তুষ্টি। খুব বাজে উক্তি করেছিলো। এরকম প্রায় ই হয় আমার সাথে। শুধু আমার সাথেই সবাই কেন এমন করে মেঘালয়?”
মেঘালয় নিশ্চুপ। মুখে কথা আসছে না। মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আমি আছি তো। আর কেউ কখনো এভাবে বলার সাহস পাবেনা মিশু।”
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “আর হয়ত পাবেনা। কিন্তু আমার ভেতরে যেগুলো চাপা পড়ে আছে এসব তো কখনো মুছবে না আমার মাথা থেকে। লোকাল বাসে উঠলে দু একটা ছেলে পিছনে হাত বুলিয়ে চলে যায়, বুকে পেটে হাত দিয়ে চলে যায়। ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবা, সেখানেও এরকম লাঞ্চনার শিকার হতে হয়। একবার বাড়িতে কেউ ছিলোনা, এক কাজিন এসে সুযোগ নিলো। আমার সাথেই কেন এমন হয়? আর কারো সাথে তো এমন হয়না। আমার সাথে কেন সবসময় এমন হয়?”
মিশু অঝোর ধারায় কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে মেঘালয়ের শার্ট খামচে ধরে বললো, “আমি আর কিছু বুঝি বা না বুঝি ধর্ষিতা কিভাবে হয় সেটা ঠিকই বুঝি। আর শরীরের দিকে সবাই কিভাবে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।আমার যে আর কোনো উপায় ও নেই। আমার বাবা নেই, মা অসুস্থ। আমি যদি নিজে রোজগার না করি, আমার মা বোন না খেয়ে মরবে। আর যদি রোজগারের জন্য বাইরে বের হই, অফিসেও জামার নিচ দিয়ে কেউ শরীরে হাত দেবে। এসবের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভাবি, আমি বাইরে বের হবোনা, সারাদিন ঘরে বসে থাকবো। তাহলে না খেয়ে মরতে হবে আমাদের।”
মেঘালয়ের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মিশুর ভেতরে এত চাপা কষ্ট জমে ছিলো ওর জানা ছিলোনা। এতটুকু বয়সেই এরকম যন্ত্রণা গুলো নিয়ে মেয়েটা বেঁচে আছে কিভাবে? আর কোনোদিনো এক বিন্দু কষ্টকেও মিশুর ধারেকাছে পৌছাতে দেবেনা মেঘালয়। এতে নিজের জীবন চলে যায় যাক।
মেঘালয় মিশুকে শক্ত করে ধরে বললো, “আমি এখন তোমার সব। আমাকে নিয়ে বাঁচবা, আর কক্ষনো এরকম কিছু তোমার সাথে ঘটবে না।”
মিশু মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি না হয় একটা মিশুর দায়িত্ব নিলে। সারাদেশে এমন হাজার হাজার মিশু আছে যাদেরকে পেটের দায়ে রোজগার করতে নামতে হয়েছে। কিন্তু মানুষ তাকে সুযোগ পেয়ে সিচুয়েশনে ফেলে ইচ্ছেমত ব্যবহার করছে। এরকম মিশুদের কান্না দেখার মত কেউ নেই।”
মেঘালয় বললো, “আমি জানি। আমার ইচ্ছে করতো সব দুঃখী মেয়ের জন্য কিছু করি। কিন্তু সেটা তো হয়ে ওঠেনা। সবার জন্য কিছু করতে না পারি, একটা মানুষের মুখে তো হাসি ফোটাতে পারি। পারিনা?”
– “তুমি খুব ভালো মেঘালয়, খুব ভালো।”
– “আমি খারাপ। আমিও ট্রেনের ভেতর কন্ট্রোল হারিয়ে তোমাকে চুমু খেয়ে ফেলেছিলাম।”
মিশু বললো, “সে জন্যই তো তুমি ভালো। এই ছোট্ট একটা ভূলের জন্য তুমি আর কোনোকিছু না ভেবেই সেদিন ই আমাকে বিয়ে করে ফেললে। শুধুমাত্র এই ছোট্ট পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে, আমার কান্নার মূল্য দিতে। আর কোন ছেলে ই বা এটা করবে?”
মেঘালয় মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। চোখ মুছে দিলো। একই চাদরে দুজনে গুটিসুটি মেরে বসে রইলো অনেক্ষণ। রাত বেড়ে যাচ্ছে, মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়ে মিশুকে কোলে তুলে নিলো। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিলো ভালোমতো। মিশু ওর গলা ধরে রইল দুহাতে। মেঘালয় ওকে নিয়ে রুমের দিকে পা বাঁড়ালো। দূর থেকে ওদেরকে এভাবে দেখলো রোদ ও পূর্ব। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মিশু মেঘালয়ের দিকে চেয়ে ছিলো নিশ্চুপ হয়ে। মেঘালয় ওর চোখ মুছে দিয়ে বুকে চেপে ধরে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল,মিশু অঝোর ধারায় কাঁদছিল। এসব দেখে রোদের ও ইচ্ছে করছিলো এভাবে কারো বুকে মাথা রেখে কাঁদতে পারতো যদি!
এতক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পূর্বই প্রথম কথা বললো, “রোদ।”
রোদ চমকে উঠে বললো, “হুম, আপনি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?”
– “তোমাকে একা রেখে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তুমি একা থাকলেই তোমার আপসেট লাগবে।”
– “আমার মনটা আপনারা অনেক ভালো করে দিয়েছেন। সবসময় মন ভালো করে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকলে তো সারাক্ষণ আমাকে পাহারা দিতে হবে।”
– “তা হোক। সারাক্ষণ পাহারা দিলেও যদি একটা মানুষের মন ভালো রাখা যায় সেটাই বা কম কিসে বলো? মেঘালয় নিজের সবটুকু দিয়ে ওই মেয়েটার সমস্ত কষ্ট দূর করে দিতে পারলে আমি কেনই বা শুধু মনটা ভালো রাখতে পারবো না বলো?”
রোদ হাসার চেষ্টা করে বললো “আপনারা অনেক ভালো। আমার লাইফে আমি কক্ষনো এরকম মানুষ দেখিনি।”
পূর্ব বললো,”আমি ছোটবেলা থেকেই মেঘালয়ের সাথে বড় হয়েছি। আমরা চার বন্ধু একসাথে আছি প্রায় ছ বছর হলো। কেউ কাউকে ছাড়িনি মুহুর্তের জন্যও। আর অন্য কারো সাথে এত ভালো বন্ধুত্বও করিনি। কারণ কারো সাথে আমাদের এরকম মনের মিল হতোনা। সবাই শুধু নিজের স্বার্থ খোঁজে। একমাত্র মেঘালয়, সায়ান আর আরাফ কেই দেখেছি যারা কক্ষনো নিজের স্বার্থের কথা ভাবেনা।”
রোদ বললো, “সত্যিই আপনারা অনেক ভালো।”
পূর্ব আকাশের দিকে তাকালো। কুয়াশার মাঝেও চাঁদের সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে। দেখতে খুবই ভালো লাগছে। ও বললো, “রোদ তোমার জোৎস্না ভালো লাগে?”
– “হুম খুব ভালো লাগে। আমার অমাবস্যা এখন বেশি ভালো লাগে। সারাবছর যদি অমাবস্যা লেগে থাকতো তাহলে খুবই ভালো হতো।”
রোদের কথায় অভিমান মেশানো। পূর্ব বুঝতে পেরে বললো কথা ঘুরানোর জন্য বললো, “আচ্ছা আজকে বিছানাকান্দিতে গোসল করতে কেমন লেগেছে বলো?”
– “খুবই ভালো। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে যা আনন্দ হচ্ছিলো!”
এমন সময় আরাফের গলা শোনা গেলো। পূর্ব ও রোদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আরাফ বারান্দায় এসে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। আরাফের রাগ মিশ্রিত গলা শুনে রোদ ভয় পেয়ে বললো, “ওনার এত রাগ কেন?”
পূর্ব বললো, “ওই ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে। একটা মেয়েকে খুবই ভালোবাসতো ও। একদিন কোনো কথাবার্তা ছাড়াই মেয়েটি রাতে ফোন দিয়ে বললো, আজকে আমাকে দেখতে এসে একেবারে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি করে ফেলেছে। আমি অনেক কান্নাকাটি করেও, অনেক কিছু বলেও কিছুতেই বিয়েটা আটকাতে পারিনি। তারপর থেকে মেয়েটির সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ওর। মাঝেমাঝে মেয়েটি ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে বলতো আরাফ আমি তোমাকে খুব মিস করি। আরাফ অনেক কষ্ট পেয়েছিলো। মেয়েটি একদিন ফোন দিয়ে জানালো ওর বিয়েও হয়ে গেছে। এখন স্বামীর বাসায় থাকে। আরাফের সাথে টোটালি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ওর। কষ্ট সহ্য করতে করতে ছেলেটা যখন সামলে উঠেছে, তখন একদিন হঠাৎ প্রকাশ পেলো মেয়েটির আসলে বিয়ে বা রেজিস্ট্রি এসব কিছুই হয়নি। মেয়েটি একটা ছেলের সাথে নতুন রিলেশনে জড়িয়েছে আর আরাফের সাথে ব্রেকাপ করার জন্য বিয়ে নামক মিথ্যে কথাটা বলেছে।”
রোদ অবাক হয়ে বললো, “এরকম মেয়েও জগতে আছে! অদ্ভুত। আপনারা খোজ নিতে পারেন নি?”
– “মেয়েটির বাসা দূরে ছিলো। তাছাড়া আলাদা করে যাচাই করার তো দরকার নেই,কারণ গার্ল ফ্রেন্ডকে আরাফ খুবই বিশ্বাস করতো। কে জানতো এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এভাবে ধোঁকা দেবে।”
রোদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পূর্ব বললো, “এরপর থেকেই আরাফ কেমন যেন বদমেজাজি হয়ে গেছে। মেয়েদেরকে সহ্যই করতে পারতো না। অনেক দিন পর এখন মিশুকে দেখে একটু একটু করে ওর রাগটা কমে যাচ্ছে। মিশুকে দেখে ওর নাকি মেয়েদের প্রতি ধারণাটা একটু বদলেছে।”
– “জীবন টা এত বিচিত্র কেন?”
পূর্ব বললো, “বিচিত্র বলেই তো এটা জীবন। বিচিত্র না হলে তো এটাকে জীবন বলা যায়না। বিচিত্রতা আছে বলেই জীবনে সুখের স্বাদ টুকু উপলব্ধি করতে পারি।”
চলবে..
অনুভূতি
পর্ব ৩৪
মিশু মনি
.
৫২.
ঢাকায় পৌছে নিখিল ও দুপুর সরাসরি মেঘালয়ের বাসায় চলে এলো। আকাশ আহমেদ চাবি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দুপুর চোখ বড়বড় করে বললো, “ওমা! এত সুন্দর বাড়ি! রীতিমত প্যালেস!”
নিখিল ওকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেই মেইন দরজা লক করে দিলো। ওরা বাইরে থেকে খেয়েই এসেছে। ফ্রেশ হয়ে দুপুর রুমে আসার পর নিখিল বাথরুমে চলে গেলো।
নিখিল বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এসে দেখলো দুপুর বিছানায় শুয়ে আছে। ওর শাড়ি হাঁটু অব্দি উঠে থাকার কারণে ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। ও এসে বললো, “শাড়ি ঠিক করে নাও।”
দুপুর শাড়ি ঠিক করতে করতে বললো, “তো কি হয়েছে? তুমি আর আমি ই তো। আর কে বা আছে এই বাড়িতে?”
– “এখনো আমাদের বিয়ে হয়নি দুপুর। এমন কোনো কিছু করোনা যাতে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।”
দুপুর এসে নিখিলের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “উম, কবে বিয়ে করবো আমরা?”
নিখিল দুপুরের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পাশে বসলো। ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “আরো অনেক সময় লাগবে। এটা সিনেমা নয় যে আজকে বিয়ে করলা, কালকে ডিভোর্স দিয়ে আবার পরশু আরেকজন কে বিয়ে করলা।”
দুপুর বাচ্চাদের মতন মুখ করে বললো, “এভাবে বলছো কেন?”
নিখিল হেসে বললো, “সরি লক্ষিটি। আমি ভাবছি সবকিছু নিয়ে। আরো অনেক সময় লাগবে সবকিছু সামলে নিতে। প্রথম কাজ হচ্ছে তোমার বাবা আর অরণ্য’র বাবাকে ডেকে নিয়ে এসে সবকিছু বুঝিয়ে বলা। এজন্য ও কিছুদিন সময় দরকার। আমরা এখানে কিছুদিন থাকার পর ওনাদেরকে ডেকে এনে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। আমি কোনো ঝামেলা পছন্দ করিনা। সবকিছু সুন্দর ভাবে গুছিয়ে যাক সেটাই চাই। সেজন্য সময় আর ধৈর্য দরকার।”
দুপুর জিজ্ঞেস করলো, “তারপর কি হবে?”
নিখিল বললো, “ওনারা নিজে থেকে তোমার আর অরণ্য’র তালাকের ব্যবস্থা করবে। আমাদেরকে কিছুই করতে হবেনা। আমাদের একটাই কাজ সেটা হচ্ছে ওনাদেরকে ভালোমতো বুঝিয়ে বলা। আর আমার দ্বিতীয় দায়িত্ব, এর মধ্যে একটা চাকরী জুটিয়ে ফেলা। আমি চাকরী পেয়ে গেলে বাসায় জানাবো তোমার কথা। ততদিনে সবকিছু আশাকরি ঠিকঠাক হয়ে যাবে, আমি পালিয়ে বিয়ে করতে চাইনা দুপুর। বাবা মা তোমাকে সম্মানের সাথে আমাদের বাসায় নিয়ে যাক সেটা চাই।”
দুপুর নিখিলের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “তুমি এত ব্রিলিয়ান্ট কেন শুনি? এরই মধ্যে এতকিছু ভেবেও ফেলেছো? এজন্যই এত ভালোবাসি তোমায়।”
– “ভালোবাসো ভালো কথা। গলায় বাঁদরের মত ঝোলাঝুলি করছো কেন?”
– “ইস! এরকম করছো? যাও,আমি অরণ্য’র কাছেই চলে যাবো। তুমি খারাপ। আমাকে একটুও ভালোবাসো না।”
নিখিল দুপুরকে বুকে নিয়ে বললো, “এখানে কান পেতে শোন তো ভেতরে কি বলে? এই কটা দিন আমার কি অবস্থায় গেছে জানিস?”
– “হুম জানি। আমি না জানলে আর কে জানবে?”
– “এবার লক্ষী মেয়ের মত ঘুমাও তো তুমি।”
দুপুর ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, “ঘুমাবো? সারারাত জেগে জেগে গল্প করবো ভাবলাম।”
– “মাইর দিবো তাহলে। এমনিতেই এই কদিনে চেহারার অবস্থা বারোটা বাজিয়ে ফেলেছো। এখন তুমি শুয়ে একটা ঘুম দিবা। আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবা।”
– “আর কিচ্ছু করবো না?”
– “না, আর কিচ্ছু করবো না।”
– “সিরিয়াসলি? থাকতে পারবা তুমি?”
নিখিল হেসে বললো, “আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখি। একদিন তোমার আপুকে বিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে সারারাত তোমার বিছানায় ছিলাম মনে পড়ে? সারাটা রাত তুমিই ছটফট করেছো, আমি স্বাভাবিক ছিলাম। তোমাকে শুধু বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছি। আর কিচ্ছু করিনি।”
– “এত ভালো হলে চলে?”
– “বারে, খারাপ হলেও দোষ আবার ভালো হলেও দোষ?”
দুপুর হেসে ফেললো। বললো, “নাহ ঠিকাছে। এতকিছুর পরেও তোমাকে পাচ্ছি সেটাই অনেক। এখন আমি তোমার জন্য এক যুগ অপেক্ষা করতে পারবো। শুধু আমার সামনে বসে থাকো। আমি শুধু দেখবো আর থাকবো।”
নিখিলের বুকে মাথা রেখে মাথাটা উপরে তুলে ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো দুপুর। আর কোনোকিছুর প্রয়োজন ই তো নেই, এই মানুষ টা সারাক্ষণ চোখের সামনে বসে থাকলেই যথেষ্ট। আর কি ই বা চাই? একটা জীবন এভাবে দেখে দেখেই পার করে দেয়া যাবে।
৫৩.
সকালে মিশুর ঘুম ভাংলেও শুয়েই রইলো ও। মেঘালয় বলে দিয়েছে যেন ওকে ফেলে না ওঠা হয়। আগে ঘুম ভাংলেও শুয়ে থাকতে হবে। মিশু মাথাটা তুলে মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকালো। জানালার ফাঁক দিয়ে হালকা রোদের ঝিলিক এসে মেঘের মুখের উপর পড়েছে। কি দারুণ দেখতে লাগছে মেঘালয়কে! ফর্সা মুখে লাল রোদ পড়ে কেমন রাঙা হয়ে উঠেছে চেহারাটা। ঘন ঘন দুটো ভ্রুয়ের নিচে দুটো টানা চোখ, চোখের পাপড়ি গুলোও খুব ঘন আর সুন্দর। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো একটু বড় হয়ে গেছে। শুভ্রতা ছেয়ে আছে গালে, নাকে মুখে। কি সুন্দর গোলাপের পাপড়ির মতন ঠোঁট! নাকটা লম্বা, গলাটা একটু বেশিই ফর্সা। গলা থেকে বুকের দিকে নামলে পাঞ্জাবির উপরের বোতাম টা খোলা রাখলে যতটুকু জায়গা দেখা যায়, মেঘালয়ের ওই জায়গা টুকু পৃথিবীর সেরা সৌন্দর্য মনেহয়। ফর্সা বুকে দু একটা লোম উঁকি দেয়, কি যে মায়া লাগে!
মিশু অনেক্ষণ এভাবে চেয়ে চেয়ে এসব ভাবতে লাগলো। মেঘালয় চোখ মেলে তাকালো। মিশুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মিশুর কপালে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে বললো, “সুপ্রভাত মিষ্টি মিশু।”
মেঘালয়ের উষ্ণ স্পর্শে মিশু আবেশে চোখ বুজে ওর বুকে মাথা রেখে বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ শুনতে লাগলো। যেন ওর হার্টবিট প্রতি স্পন্দনে বলছে, “মিশু ভালোবাসি তোমাকে, ভালোবাসি মিশু।”
মিশু আলগা হাতের আলতো বাঁধনে আঁকড়ে ধরে রইলো ওর প্রিয় মানুষ টাকে।
বাংলোর পাহারাদার সকালে গরম গরম ফুলকো লুচির সাথে তরকারী রান্না করেছেন। সাথে গরম চা ও। মেঘালয় ও ওর বন্ধুরা একসাথে বসে নাস্তা করে নিলো। এরপর বেড়িয়ে পড়া হলো ঘুরতে যাওয়ার জন্য। আজকের গন্তব্যস্থান জাফলং। জাফলং এর রাস্তাও খুব খারাপ। লেগুনায় ওঠার সময় পূর্ব ও রোদ পাশাপাশি বসলো। তাই দেখে মিশু বললো, “আজকে পূর্বে দারুণ রোদ উঠবে।”
সবাই মুচকি হাসলো। মিশু ও মেঘালয় পাশাপাশি বসে মিশুকে সবার শেষে বসতে দেয়া হলো যাতে রাস্তা দেখতে দেখতে যেতে পারে। জাফলং এর রাস্তাটা খারাপ হলেও দেখতে সুন্দর। মেইন রোড ধরে যাওয়ার সময় অনেক সুন্দর চা বাগান, পাহাড় আর এক সাড়িতে তিনটা ঝরনাও দেখতে পাওয়া যায়। মিশুর আবার ঝরনার প্রতি খুবই দূর্বলতা। কিন্তু একটাই সমস্যা, রাস্তায় প্রচণ্ড ধূলা। আজকে মিশু একটা রাউন্ড ফ্রক জাতীয় ড্রেস পড়ায় ওকে একদম পুতুলের মত লাগছে। ওদের সবাইকে একসাথে দেখলে সবার আগে মিশুর দিকে নজর যাচ্ছে, নিতান্তই ছোট্ট বাচ্চা মনেহচ্ছে ওকে। মেঘালয় সিটে বসে একহাতে ওকে ধরে রইলো।
গতকালের লেগুনা টাই আজকেও নেয়া হয়েছে। ড্রাইভারের সাথে বেশ খাতির জমে গেছে। উনি বললেন,”মামারা আজকেও গান ধরেন।”
পূর্ব দুষ্টুমি করে বললো, “অবশ্যই মামা। আপনাকে খুশি করার জন্য আজকে আমি পেট ভর্তি করে খায়া এনার্জি বাড়াইয়া আনছি। আজকেও ফাটাইয়া দিবো মামা।”
ড্রাইভার দাঁত বের করে হাসলেন। পূর্ব সবার উদ্দেশ্যে বললো, “গান শুরু করা যাক তবে। মেঘ দোস্ত, সাব তেরা গানটা ধর। ওকে ফ্রেন্ডস, লেটস স্টার্ট।”
“Na jiya zindagi ek pal bhi
tujshe hoke judaa sun zara
bin tere mujshe naaraaz tha dil
tu mila hai toh hai keh raha…”
“Main toh tere rang mein
rang chuka hoon
bas tera ban chuka hoon
mera mujhme kuch nehi sab tera…”
গানের মাঝখানে মিশু সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “ধেৎ একদম মজা হচ্ছেনা। মজা হচ্ছেনা, মজাই হচ্ছেনা। ঝাকানাকা গান ধরো। কালকের মত মজার গান শুরু করোনা কেন?”
পূর্ব বললো, “লুঙি কো উঠানা পাড়েকা?”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু বললো, “না, সানি রকস। মেরে পিছে হিন্দুস্থান হ্যায়। নয়ত আজ ব্লু হ্যায় পানি পানি সানি সানি।”
সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো। মেঘালয় মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিলো। মিশু চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। ওর ও হাসি পাচ্ছে। ও সরল মনে বললেও সবাই হাসবে এটাই স্বাভাবিক। বলার আগে কি আর বুঝতে পেরেছে সবাই হাসবে, বুঝলে তো আর বলতো না। গান তো গানই,এখানে এভাবে হাসার কি আছে?
মেঘালয় কণ্ঠে যথাসম্ভব আবেগ ঢেলে দিয়ে গেয়ে উঠলো,
“এক্সকিউজ মি ওয়ান্না লাভ ইউ লাভ ইউ,
এক্সকিউজ মি ওয়ান্না টাচ ইউ টাচ ইউ”
পুরো লেগুনা জুড়ে সবাই হেসে উঠলো। মিশুর ইচ্ছে করছিলো লজ্জায় মেঘালয়ের বুকের ভেতর গিয়ে লুকায়। সবাই হাসছে কেন অযথা? সবাই খুব খারাপ। ও লজ্জায় মাথা ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। পিংক কালার পুতুলের মত ড্রেস পড়ে এমনিতেই চেহারায় একটা গোলাপি আভা চলে এসেছে। এবার লজ্জায় আরো গোলাপি হয়ে গেলো।
রোদ মাথা নিচু করে হাসছে। তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। পূর্ব গান গাওয়ার সাথে সাথে পা নাচাচ্ছে। ওর পা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো রোদ। ফর্সা আর পায়ের নখগুলো বেশ সুন্দর, পরিষ্কার। ওর পা নাচানোর মাঝেও একটা আর্ট ফুটে উঠছে, দারুণ লাগছে দেখতে। ওরা এখন সানি সানি গানটা গাইছে। সবাই মিলে একসাথে রিমিক্স দিয়ে গাইছে আর হাতে তালি বাজাচ্ছে। সবার মুখে হাসি লেগে থাকলেও গানটা দারুণ হচ্ছে।
গানের ফাঁকেফাঁকে মেঘালয় মিশুর দিকে তাকাচ্ছিলো। মিশু হাত তালি দিচ্ছে কিন্তু চেয়ে আছে বাইরের দিকে। ওর মুখে হাসি। মেঘালয় যতটা ভালো, ঠিক ততটাই দুষ্টু। এমন ভাবে গাইছে যে মুখে আপনা আপনি দুষ্টুমি হাসি চলেই আসে।
মেঘালয় গেয়ে উঠলো,
“আমি ফাইসা গেছি, আমি ফাইসা গেছি,
আমি ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়…
আমার দিলের চোট বোঝেনা কোনো হালায়..”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু এবার মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “এটা আবার কেমন গান? এ জন্মেও এমন গান শুনিনি।”
মেঘালয় আবারো গাইলো,
” সকাল বিকাল রাইত দুপুর বউয়ে দেয় ঠেলা
কয়, ‘বউ পুষার মুরদ নাই তয় বিয়া করছোস ক্যালা?”
আবারো হাসতে লাগলো সবাই। মেঘালয় সত্যিই খুব দুষ্টু। পাজির পা ঝাড়া, সারারাত মিশুকে জ্বালিয়ে মারে আবার এখনো শুরু করেছে। খুব পাজি একটা।
লেগুনার ড্রাইভার বললো, “মামা ঠিকই কইছেন। বউয়ের এই ঠেলা প্রত্যেকদিন। বউ পোষার মুরদ না থাকলে বিয়ে করছ ক্যান? জীবনটা বরবাদ হয়া গ্যালো।”
পূর্ব বললো, “গেবন শ্যাষ। আহারে গেবন, আহা গেবন,জলে ভাসা মরা মাছ যেমন।”
মিশু বলল, “ঠিকই বলছো। মরা মাছ জলের উপর ভাসতে ভাসতে গন্ধ ছড়ায়। সেই একই দশা হয়েছে জীবনের।”
আরাফ বলল,”কে বলছে জীবন কঠিন? জীবন অনেক সহজ। পানির অপর নাম জীবন, তাহলে জীবনের আরেক নাম পানি। জীবন পানির মত সহজ ”
সবাই হাসলো। মেঘালয় অবাক হয়ে খেয়াল করলো আরাফের রাগ আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। ছেলেটা মিশুর সংস্পর্শে আসার পর থেকে অনেক সহজ হতে শুরু করেছে। মিশুকে বলতে হবে সবসময় ওর সাথে থাকতে আর বেশি বেশি বকবক করতে। তাহলে ছেলেটা একদম আগের মত হয়ে যাবে। মেঘালয় মিশুর কানে কানে বুঝিয়ে বললো ব্যাপার টা। মিশু হেসে ফিসফিস করে বলল, “আচ্ছা হয়ে যাবে। তুমি টেনশন করোনা।”
রাস্তা দিয়ে আসার সময় দূর থেকে মেঘালয় মিশুকে একটা ঝরনা দেখিয়ে দিলো। গাঢ় সবুজের মাঝখানে একটু সাদা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে,সেটাই ঝরনা। এতদূর থেকে দেখার মাঝেও অন্যরকম ভালো লাগা আছে। মিশু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ঝরনার দিকে। এরপর আরো একটা ঝরনা দেখতে পাওয়া গেলে মেঘালয় সেটাও দেখালো ওকে। তিনটা ঝরনাই যখন একসাথে দেখতে পেয়ে মিশু আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠলো। এইতো বাচ্চাটার পাগলামি শুরু হয়ে গেলো। নানান প্রশ্নে মাতিয়ে তুললো মেঘালয়কে।
রাস্তায় একবার লেগুনা দাড় করিয়ে সবাই নেমে প্রাণভরে শ্বাস নিতে লাগলো। জায়গাটা অনেক সুন্দর। চারদিকে শুধু ঘন গাছ,জংগল,চা বাগান,পাহাড় এসবই চোখে পড়ছে। মিশু মুগ্ধতার ঠেলায় কথাই বলতে পারছে না। বারবার মেঘালয়ের হাত চেপে ধরছে ও। কিছুক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখা, ছবি তোলাতুলি, চা খাওয়ার পর আবারো লেগুনা ছেড়ে দেয়া হলো।
কিন্তু একদম জাফলং এর কাছাকাছি এসে শুরু হয়ে গেলো ঝাঁকুনি। রাস্তার অবস্থা মারাত্মক রকমের খারাপ। ধূলা, ভাঙা চূড়া রাস্তায় লেগুনা রীতিমত হেলেদুলে যাচ্ছে। সবাই টুকটাক গল্প করছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আড্ডা বেশ জমে গেছে। এভাবে ঝাঁকুনি খেতে খেতে ওরা পৌছে গেলো। লেগুনা থেকে নেমে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো জাফলং এর পথে। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকে ডাউকি আর মেঘালয়ের সৌন্দর্য দেখলো ওরা। ডাউকির সাদা সাদা ছোট ছোট ঘরগুলো দূর থেকে দেখতে দারুণ লাগছে। মিশুর ইচ্ছে করছে সেখানে ছুটে চলে যায়।
ডাউকির দিকে বারবার তাকাতে তাকাতে ও মেঘালয়ের হাত ধরে হাঁটছিলো। নূড়ি পাথর, কাচ, গুড়ি বালি, উঁচু নিচু টিলা, পাহাড় সব পেড়িয়ে ওরা এসে নদীর তীরে দাঁড়ালো। চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মিশু অন্য এক জগতে ডুবে গেছে। নৌকায় করে জাফলং এ এসে কিছুক্ষণ সময় কাটালো ওরা। নেমে হেঁটে হেঁটে মায়াবী ঝরনায় যাওয়ার জন্য আবারো হাঁটা ধরলো। জাফলং এ আর আগের মত পাথর নেই। শুধু পানি ই চোখে পড়ছে। মেঘালয়ের হাত ধরে মায়াবী ঝরনায় যাওয়ার সময় মিশু পাশের পাহাড় আর ঝাউ জংগল দের সাথে কথা বলছে। পাহাড়ের সাথে কথা বলতে দেখে সবাই হাসছিলো। কিন্তু মিশুর অন্যদিকে মনোযোগ নেই। ও পাহাড় দেখছিলো আর কথা বলছিলো। নিচু হয়ে গুড়ি গুড়ি বালির সাথে কথা বলছিলো। পাথরের সাথে, আকাশের সাথেও কথা বলছিলো। মেঘালয় শুধু অবাক হয়ে এই পাগলির পাগলামি দেখছিলো। মায়াবী ঝরনায় পৌছে ওরা ঝরনা স্নান করে নিলো। মিশু ঝরনার পানি গুলোর সাথেও কথা বলছিলো।
জাফলং ছেড়ে বের হলো রাত্রিবেলা। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ। মৃদু কুয়াশা পড়েছে। শীত শীত লাগছে সবার। জাফলং এ পূর্ণিমা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এসব নিয়ে গল্প করতে করতে লেগুনা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলো শহরের দিকে। রাত নেমেছে অনেক আগেই। মেঘালয় তিনটা চাদর এনেছিলো। একটা ও আর মিশু গায়ে দিলো, একটা আরাফ ও সায়ান আর অন্য চাদরটা রোদকে একাই দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু রোদ চাদর টা সায়ানের গায়ের উপরেও ফেলে দিলো। একে অপরের শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছিলো।
মেঘালয় চাদরের ভেতর দিয়েই মিশুকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখায় মিশুর একটু ও ঠাণ্ডা লাগছে না। এরকম একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ায় নিজেকে বড্ড ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিলো ওর। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে লেগুনা দাঁড়িয়ে পড়লো। ওরা জিজ্ঞেস করলো, “মামা কি হলো? গাড়ি থামালেন কেন?”
ড্রাইভার উত্তর দিলো, “সামনে দেখেন ওইটা কি?”
সবাই উঁকি ঝুঁকি মেরে বাইরে দেখার চেষ্টা করলো। রাস্তার দিকে তাকানো মাত্রই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো সবার। রৌদ্রময়ী শিউড়ে উঠলো। মিশু ভয়েই মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো।
চলবে..