অনুভূতি,পর্ব-৩১+৩২

অনুভূতি
পর্ব ৩১
মিশু মনি
.
৪৮.
মেঘালয় হোটেলে ফিরে ওর বন্ধুদেরকে রুমে ডেকে নিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে বললো অরণ্য ও দুপুরের ব্যাপারটা। সবাই শুনে রীতিমত রাগে ফুঁসতে লাগলো। অরণ্য’র সাধু চেহারার আড়ালে ওরকম বাজে একটা মানসিকতা লুকিয়ে ছিলো চিন্তাই করা যায়না। ওরা আর কখনো অরণ্য’র মুখ ও দেখতে চায়না, পুরুষ নামের কলঙ্ক একটা।
মেঘালয় অরণ্য’কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “দোস্ত তুই কোথায়? তোকে রুমেও পেলাম না আর লবিতেও পেলাম না।”
– “দুপুর তোদের সাথে কমফোর্ট ফিল করছিলো না রে,সেজন্য ওকে নিয়ে আমি একাই বেড়িয়ে পড়েছি। তোরা তাহলে তোদের মত বেড়িয়ে পড়। কিছু মনে করিস না কেমন?”
– “আচ্ছা,ভাবির দিকে খেয়াল রাখিস।”
কথাটা বলেই মেঘালয় কল কেটে দিয়ে তাকালো বন্ধুদের দিকে। ওরা জানতে চাইলো ভাবির খেয়াল রাখা বলতে মেঘালয় কি বুঝিয়েছে? মেঘালয় বললো, “অরণ্য বলেছে দুপুর নাকি আমাদের সাথে ঘুরতে কমফোর্ট ফিল করেনা। সেজন্য ও দুপুরকে নিয়ে একাই বেড়িয়ে পড়েছে। হোয়াট দা…”
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো। ওর বন্ধুরাও শব্দ করে হাসতে লাগলো। দুপুর অরণ্য’র সাথে থাকলে তো বেড়াতে যাওয়ার প্রশ্ন আসে। সে তো ইতিমধ্যে ঢাকার পথে পাড়ি দিয়েছে। আর মেঘালয়ের সাথে সে কেমন ফিল করে সেটা বুঝতে কারো বাকি নেই। কতটা বিশ্বাস করলে একজন অচেনা ব্যক্তিকে এভাবে নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার শেয়ার করা যায়? এটা কারো বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সেজন্য ওরা অরণ্য’র কথা ভেবে হাসতে লাগলো।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে ওরা রেস্টুরেন্টে চলে আসলো। মিশু রৌদ্রময়ীকে দেখেই ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে বললো, “এইযে বিয়ের কনে,সেদিন তো খুব ভাব নিচ্ছিলে। আমি এত এত করে গল্প করতে চাইছিলাম আর তুমি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিলে না। এখন কি করবে শুনি? এখন কি এই মিশুর সাথে কথা না বলে থাকতে পারবা হুম?”
মেঘালয়ের বন্ধুরা মিশুর এমন ছেলেমানুষি দেখে হাসলো। রৌদ্রময়ী বুঝে গেছে মেয়েটা অনেক মিশুক। নামেও মিশু আর কাজেও মিশুক। রোদ মিশুকে জাপটে ধরে বললো, “সরি বোন। সেদিন খুব মন খারাপ ছিলো।”
– “জানি জানি। তুমি খেয়েছো?”
মিশুর এমন সরলতা দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সবাই। সায়ান মেঘালয়কে বললো, “দ্যাখ মনেহচ্ছে মিশু নিজের বোনকে পেয়েছে। কি খাতির দেখেছিস?”
মিশু বললো, “বিডির সব মেয়েই আমার বোন।”
এরপর সবাই মিলে একসাথে নাস্তা করার পর বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো। একটা লেগুনা ঠিক করে নেয়া হলো ওদেরকে পৌছে দেয়ার জন্য। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে ওরা লেগুনায় উঠে পড়লো। লেগুনার রীতিমত ঝাঁকুনি শুরু হয়ে গেছে। ঝাঁকুনির ঠেলায় মিশু হো হো করে হাসছে। সায়ান বললো, “আমরা তাহলে চিল শুরু করে দেই কি বলো ফ্রান্স?”
মিশু বললো, “আমি ফ্রান্স নই আমি ফরাসী।”
আরাফ বললো, “তোর চিল শব্দটা শুনে আমার একটা জোকস মনে পড়ে গেলো। একটা ছেলে চিল আর একটা মেয়ে চিলের বিয়ে হয়েছে। তো বাসর রাতে ছেলে চিল মেয়ে চিলকে বললো, “ডার্লিং এখন আমরা চিল করবো। চিইইইল…”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। রোদ ও হেসে ফেললো। সত্যিই দুপুর ঠিকই বলেছে। মেঘালয়ের বন্ধুরা খুবই ভালো আর মজার। অনেক ফানি সবাই।
পূর্ব বললো, “আজকে আমরা একটা খুব ভালো কাজ করেছি। আজকে আমরা দুজন পবিত্র মনের মানুষকে এক করে দিয়েছি। একটা সুন্দর জুটি বেঁধে দিয়েছি, একটা স্বার্থপরের হাত থেকে ভালো একটা মেয়েকে উদ্ধার করেছি। আমাদের রৌদ্রময়ী আপুকে এখন এখন বিনোদনের ব্যবস্থা করে মন ভালো করে দেয়াটা আমাদের দ্বিতীয় দায়িত্ব। আজকে আমাদের আর কোনো দুঃখ নেই, সো জাস্ট এনজয়।”
মিশু হঠাৎ বলে উঠলো, “ডিয়ার লিসেনার্স, গুড মর্নিং টু অল। আপনারা টিউন করে আছেন ‘অনুভূতি’ এফ.এম ভালোবাসা পয়েন্ট টু। আপনাদের সাথে আছি আমি Rj মিশু। গল্প হবে, আড্ডা হবে, আর হবে অস্থির কিছু গান। তার আগেই আমরা নিয়ে নিচ্ছি একটা ছোট্ট টুইং ব্রেক। টুইংগ্যা ট্যাটাং টুইংগ্যা ট্যাটাং টুইং।”
সবাই হেসে ফেললো মিশুর কথা শুনে। কিন্তু মেঘালয় অবাক হয়ে গেলো। মেয়েটা সত্যিই Rj দের মত করে বলেছে। আর মিশুর ভয়েসের সাথে একদম খাপে খাপে মিলে গেছে জকির কাজটা। ওর ভয়েস টা খুবই মিষ্টি আর আবেগ মিশ্রিত, কন্ঠের ওঠানামা টাও একদম ভেতরে কাঁপন তুলে দেয়ার মত।
মিশু একটা ধাক্কা দিলো মেঘালয়কে। মেঘালয় চমকে উঠে বললো, “হুম মুশু বলো।”
– “তোমরা এমন কেন বলতো? আমাকে মিশমিশ, ম্যাশ,মুশ,মশা,মুশু আর কত কি বলো। আমার নামটা কত্ত সুইট না? এইগুলা বলো কেন?”
সায়ান বললো, “তোমার কিউটনেস দেখলে আপনা আপনি বেড়িয়ে আসে নামগুলা।”
– “আমার আবার কি দেখলে? আমিতো তোমাকে কিছু দেখাই নি।”
লজ্জায় সায়ান মাথা চুলকাতে লাগলো। সবাই মিটিমিটি হাসছে। মিশু বললো, “ফিরে এলাম ছোট্ট টুইং ব্রেক থেকে। এবার চলে যাচ্ছি গানে। এখন আমাদের মাঝে গান পরিবেশন করবে মেঘালয় আহমেদ। মিউজিকে থাকছে অনুভূতি ব্যান্ড দল। লেটস স্টার্ট।”
মেঘালয় গান আরম্ভ করে দিলো,
“আরে টিকাটুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে, হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
সবাই হেসে উঠলো। হেসে ওর বন্ধুরাও যোগ দিলো মেঘালয়ের গানে। মেঘালয় আবারো শুরু করলো,
“আ আ ওরে ভাই, একদিন গেলাম সিনেমা দেখতে,
আর রিক্সা থেকে নেমে দেখি হলে একটি সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে,
হঠাৎ দেখি সেই মেয়েটির চোখে আমার চোখ পড়েছে…
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে….”
আ আ ওরে ভাই, হাউজফুল কোনো টিকিট নাই,
ব্লাকে দশ টাকার টিকিট বিশ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে কোনো রকম ভিতরে গিয়ে বসলাম,
হঠাৎ দেখি পাশের চেয়ারে সেই মেয়েটি আমার পাশেই বসেছে,
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…
আরে টিকাটুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে, হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
সবাই হাসছে হাত তালি দিচ্ছে আর মেঘালয়ের গানের শেষ লাইনের সাথে তাল মিলাচ্ছে। দারুণ জমে গিয়েছে গানটা। মেঘালয় খুব সুন্দর করে গাইছে আর ওরা মিউজিক দিচ্ছে। যখন সবাই একসাথে গাইতে আরম্ভ করে, তখন আরো বেশি মজা হচ্ছে।
মেঘালয় আবারো শুরু করলো,
“আ আ ওরে ভাই, সিনেমা আরাম্ব হয়ে গেলো,রাজ্জাক শাবানা যখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো,
তখন আমার বুকের ভেতর ধুপধাপ শুরু হয়া গেলো,
আহা! আমি যদি প্রেম করতে পারতাম!
তখন দেখি পাশের সিটে বসা সেই মেয়েটি আমাকে চিমটি মেরেছে…”
এই পর্যন্ত গাওয়ার পর মিশু দুই নখ দিয়ে ইয়া জোরে মেঘালয়ের হাতে একটা চিমটি কেটে দিলো। মেঘালয় লাফিয়ে উঠে বললো, “উফফ!”
সবাই গানের সাথে তাল মিলাচ্ছে,
“টিকাটুলির মোরে একটা হল রয়েছে,
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে।”
মেঘালয় শুরু করলো,
“আ আ ওরে ভাই, আমি মেয়েটিকে বললাম,
তোমার নাম কি? বলল মালতী বিবি,
আহা গো, মালতী বিবি বলেই,
সেই মেয়েটি একটা ফক্লা হাসি দিয়েছে…
হলে নাকি এয়ারকন্ডিশন রয়েছে…”
“আরে টিকাটুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে,
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
“আ আ ওরে ভাই, সিনেমা শেষ হওয়ার পথে,
রজ্জাক ভীলেইন যখন ধুপ ধাপ মাইরপিট,
আবার শাবানা এসে রাজ্জাকে বলল,
আমি তোমার চিরদিনের সাথী,
তখন দেখি পাশের সিটে বসা মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরেছে…”
গানের এই জায়গায় এসে মিশু মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো। সবাই হাসতে শুরু করে দিলো। কিন্তু গান চলতেই লাগলো।
“আ আ ওরে ভাই, সিনেমা শেষ হয়া গেলো,
বাইরে আসলাম রিক্সা নিলাম,
হঠাৎ দেখি সেই মেয়েটি দৌড়ে এসে,
আমার রিক্সার ভেতরে চেপে বসেছে,
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
“আ আ ওরে ভাই, মেয়েটি বলল আমাকে
ডার্লিং খুভ খুধা পেয়েছে,
গেলাম মস্তফা হোটেলে,
খুব পোলাও কোর্মা খাইলাম,
হঠাৎ দেখি বয় একটা ৫০০ টাকার বিল এনেছে,
বিলটা দেখে তখন আমার মাথা ঘুরেছে…
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
এ পর্যন্ত গাওয়ার পর সবাই রিমিক্স শুরু করে দিলো। মিশুর যা আনন্দ হচ্ছে। ওর বন্ধুরা গানের সাথে সুর মিলিয়ে গাইছে। আর হাত তালি দিচ্ছে। রোদ হেসেই কুটিকুটি।
মেঘালয় আবারো গাইতে লাগলো,
“আ আ ওরে ভাই, মেয়েটি বলল ডার্লিং
আজকের মত চলে যাই,
বলে চলে গেলো..
আমি বাড়ি এসে রিক্সা থেকে নেমে,
রিক্সা ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি,
মেয়েটি আমার পকেট মেরে চলে গিয়েছে….”
গানের শেষ লাইনেই চরম বিনোদন। মেঘালয়ের সুরের সাথে ওর বন্ধুদের সুর মিলে এমন একটা হারমনি হচ্ছে যে, মন খারাপ থাকার কোনো সুযোগ ই নেই। শেষ লাইনের পর লেগুনার ড্রাইভার আর হেলপার ও শব্দ করে হাসতে লাগলো। লম্বা গান গাওয়ার পর সবাই থামলো। লেগুনার ড্রাইভার বললো, “মামারা তো পুরাই ফাটাই দিসেন।”
পূর্ব সবার মধ্যে একটু বেশিই দুষ্টু। ও জিজ্ঞেস করলো, “কি ফাটালাম মামা?”
ড্রাইভার হাসতে হাসতে বললো, “মামা গলা ফাটিয়ে গান গাইসেন।”
– “ও আচ্ছা। আমি আবার ভাবলাম কি না কি অজান্তেই ফাটিয়ে ফেলছি।”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। রৌদ্রময়ী শব্দ করে হাসতে হাসতে পূর্ব’র কাঁধের উপর লুটিয়ে পড়লো। রৌদ্রময়ীর শরীরে একটা মাদকতাময় গন্ধ। নাকে এসে লাগতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো পূর্ব’র। মেয়েদের গায়ে বুঝি এত সুন্দর ঘ্রাণ থাকে! আগে অজানা ছিলো ব্যাপার টা।
ও একা একাই মুখ টিপে হাসতে লাগলো। সায়ান জিজ্ঞেস করলো, “কিরে পূর্ব তুই একা একা হাসছিস কেন? আমাদেরকেও বল একটু, আমরাও হাসি।”
পূর্ব খুবই পাজি। ও মজা করে বললো, “পূর্বে রোদ উঠেছে।”
বলেই চোখ মারলো মেঘালয়কে। মেঘালয় পূর্ব’র সোজাসুজি সামনে বসেছে। ও খেয়াল করেছিলো ব্যাপারটা। শব্দ করে হেসে উঠলো ও। বাকিরা কেউ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “মেঘ হাসছিস যে? বল না তোরা হাসছিস কেন?”
মেঘালয় বলল, “পূর্বে রোদ উঠেছে। সেজন্য হাসছি।”
মিশু মাথা বাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো, “আজকে একটু বেশিই রোদ উঠেছে বাইরে। কিন্তু রোদ তো সবসময় পূর্ব দিকেই ওঠে। এতে হাসার কি হলো? আজকে তো আর পশ্চিম দিকে উঠেনাই।”
পূর্ব আর মেঘালয় হাসছে মুখ টিপে। রৌদ্রময়ী বুঝতে পেরেছে ওরা কি বুঝাতে চাইছে। লজ্জায় ওর ইচ্ছে করছিলো শাড়ির আচঁলে মুখটা লুকিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকতে। পূর্ব রোদের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কি রাগ করছো বা কিছু মনে করছো? কিছু মনে করোনা,আমরা খুব ফ্রেন্ডলি। ভাব্বে এখানে আমরা সবাই একে অপরের বেস্ট ফ্রেন্ড। মিশু যেমন আমাদের সবার বন্ধু,তুমিও সেরকম ভাব্বে। তাহলে এনজয় করতে পারবে।”
রোদ হাসার চেষ্টা করলো। আসলেই তাই। সবাইকে আপন ভাবতে পারলে তবেই আনন্দ করা সম্ভব। মনের মেঘটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। মন ভালো হয়ে গেছে ওর। এই কয়েক দিনের কষ্টের কথা একদম ভূলে গিয়েছে কয়েক মুহুর্তের জন্য।
রোদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হুম।”
আরাফ রোদকে বললো, “সহজ হোন আপু। সহজ হোন, কঠিন হয়ে বসে থাকলে আমিও কঠিন হবো কিন্তু। আমি গোমরামুখো মানুষ একদম ই দেখতে পারিনা। মুখ কালো করেছেন দেখলে ধাক্কা দিয়ে লেগুনা থেকে ফেলে দিবো।”
মিশু বললো, “আরাফ ভাইয়া কি আর কিছু পারো না? গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া ছাড়া?”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু একটা মোক্ষম জবাব দিয়েছে। এই ছেলেটা সবসময় বন্ধুদেরকে গাড়ি থেকে লাত্থি দিয়ে ফেলে দিতে চায়। এবার ঠিক হয়েছে।
মিশু বললো, “রোদকে গাড়ি থেকে ফেলে দিবেন কিভাবে? আজকে পূর্বদিকে রোদ উঠেছে। ”
পূর্ব হাসতে হাসতে বললো, “তোমার নাম মিশু না রেখে মশা রাখা উচিৎ ছিলো। মশার মত সারাক্ষণ ভনভন করো খালি।”
মিশু বললো, “মশার মত কামড়াই ও।”
কথাটা বলেই থতমত খেয়ে গেলো। মেঘালয় জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফেললো। মেয়েটার মুখে কিচ্ছু আটকায় না। ওর বন্ধুরা হাসছে। রৌদ্রময়ীর এখন মনটা একদম ভালো হয়ে গেছে। এদের সাথে থাকলে মন ভালো না হয়ে উপায় আছে? দুপুর ওকে রেখে গিয়ে বেশ করেছে। এখন ইচ্ছে করছে আজীবন এদের সাথে থেকে যাই।
মেঘালয় সবার অগোচরে মিশুর পিঠের পিছন দিক দিয়ে ওর কোমরে হাত রেখে হাতটা আস্তে আস্তে উপরে তুলতে লাগলো। মিশু শিউড়ে উঠে চোখ রাঙাল ওর দিকে। মেঘালয় খুব পাজি, মিশুকে থামিয়ে দিতে ওস্তাদ। খুব খারাপ একটা। মিশু চেঁচিয়ে বললো, “ধাক্কা দিয়ে লেগুনা থেকে ফেলে দিবো। ”
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালো মিশুর দিকে। লেগুনায় সবাই একসাথে মুখোমুখি হয়ে বসার কারণে বেশ ভালো হয়েছে। একে অপরের দিকে তাকাতে পারছে, গল্প করতে পারছে সবাই মিলে। গান গাওয়ার ও সুবিধে হয়েছে। সায়ান জিজ্ঞেস করলো, “কাকে ফেলে দিবা ম্যাশ ভাবি?”
– “কাউকে না। আরাফ ভাইয়ার অসুখটা আমাকেও ধরেছে।”
– “ও আচ্ছা। কাউকে ফেলে দেয়ার দরকার হলে আরাফকে বলো। ও লেগুনার দরজায় দাড় করিয়ে পিছনে একটা লাত্থি দিয়ে বাইরে ফেলে দিবে।”
– “কাউকে ফেলে দেয়ার দরকার নাই। অবশ্য কখনো পূর্বদিকে না উঠে, পশ্চিম দিকে রোদ উঠলে রোদকে ফেলে দেয়া যেতে পারে।”
রৌদ্রময়ী চোখ বড়বড় করে তাকালো মিশুর দিকে। কি বলেরে এই মেয়েটা! সাংঘাতিক মেয়ে বটে। মুখে কিচ্ছু আটকায় না একদম। পূর্ব না হয় বলতেই পারে অনায়াসে, তাই বলে সেও বলবে? অবশ্য এজন্যই মিশুকে সবার চেয়ে একটু আলাদা মনেহয়। সবাই অনায়াসে সবকিছু বলতে পারেনা, যে গুনটা মিশুর আছে।
লেগুনার ঝাঁকুনিতে একেকজনের অবস্থা করুণ। সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো। গায়ে ব্যথা অবস্থা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সিলেটের রাস্তাগুলোর একদম করুণ দশা, বিশেষ করে বিছানাকান্দি ও জাফলং এ যাওয়ার রুটটা। একদম হাড় হাড্ডি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। মিশুর বেশ মজা লাগছে। কারণ মেঘালয় ওকে বাহুর বন্ধনে ধরে রেখেছে যাতে পড়ে না যায়। মেঘালয় এভাবে ধরে রাখলে ভাঙা চূড়া কোনো ব্যাপার ই না। রৌদ্রময়ী বারবার গাড়ির ঝাঁকুনিতে পূর্ব’র কাঁধের উপর ওর মাথাটা গিয়ে পড়ছে। চুল পূর্ব’র মুখের উপর এসে উড়ছে। পূর্ব বেশ উত্তেজিত, দারুণ উপভোগ করছে ও ব্যাপার টা।
৪৯.
ঘাটে পৌছে লেগুনা থেকে নেমে নৌকায় এসে উঠলো ওরা। গন্তব্যস্থল বিছানাকান্দি। মিশু আনন্দে লাফাচ্ছে, ওর খুবই মজা লাগছে। মিশু ও মেঘালয় পাশাপাশি বসলো। আর বাকিরা ওদের পিছনে। মিশু সবার সামনে মেঘালয়কে নিয়ে বসেছে। নৌকা ছেড়ে দিলে মেঘালয় ওর হাত ধরে এনে এক কোনায় বসিয়ে দিলো। পানিতে পা নামিয়ে দিয়ে মেঘালয়ের হাত ধরে বসে রইলো মিশু। পানি পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে,খুব আনন্দ হচ্ছে।
মেঘালয় একহাতে ওকে ধরে রেখেছে। বাকিরা গান শুরু করে দিয়েছে,
“তুমি আর তো কারো নও, শুধু আমার
যত দূরে সরে যাও রবে আমার..
স্তব্ধ সময় টাকে ধরে রেখে,
স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার…”
গানের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে নদী। নৌকার ভটভটির শব্দ ছাড়িয়ে গানের আওয়াজ অনেক দূর চলে যাচ্ছে। নদীতে থাকা অন্য নৌকার যাত্রীরা মুগ্ধ হয়ে তাকাচ্ছে ওদের নৌকার দিকে। রৌদ্রময়ীর ও খুব আনন্দ হচ্ছে এখন। বাতাসে চুল উড়ছে, আঁচল উড়ছে। ভালো লাগছে খুব। এদিকে পূর্ব রীতিমত জ্বলছে, কারণ রোদের চুল উড়ে এসে ওকে মাতাল করে দিচ্ছে। মেয়েটার চুলের গন্ধও অপূর্ব। শুধুমাত্র এই মাদকতাময় ঘ্রাণ দিয়েই বোধহয় প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে মেয়েটা।
হঠাৎ একটা পাহাড়ের মত কিছু দেখতে পেয়ে মিশু আনন্দে লাফিয়ে উঠে মেঘালয়কে জিজ্ঞেস করলো, “ওটা কি?”
– “মেঘালয়।”
– “ওই যে দেখতে পাচ্ছো, একটা ইয়া বড় আকাশের সমান পাহাড়। ওটা কি?”
– “মেঘালয়।”
– “আরে ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে, গাঢ় সবুজ আর কি সুন্দর! ওটার কথা বলছি। কি ওটা?”
– “মেঘালয়।”
মিশু ভয়ংকর রেগে বললো, “একদম ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিবো। ইয়ার্কি করা হচ্ছে আমার সাথে। বারবার জানতে চাচ্ছি ওটা কি আর উনি বলছে মেঘালয়। রাগ ওঠেনা বলো?
আরাফ বলল, “কি জানতে চাচ্ছো মিশু?”
– “ওই যে ওই পাহাড়ের মত জিনিসটা দেখা যাচ্ছে যে, ওটা কি?”
– “ওই পাহাড়ের মত জিনিস টার নামই তো মেঘালয়।”
– “কিহ! ওটার নাম মেঘালয়!”
– “হ্যা, আমরা এখন মেঘালয়ের কাছেই যাচ্ছি।”
মিশু লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। মেঘালয় তো সঠিক জবাব ই দিয়েছে, ওটা মেঘালয়ই। কিন্তু মিশু ভেবেছিলো মেঘালয় বুঝি মজা করছে ওর সাথে। এখন লজ্জায় ওর মেঘালয়ের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “ওটা মেঘালয় বিশ্বাস হচ্ছিলো না তাইনা?”
মিশু বললো, “আমি কি আর জানি এখান থেকে মেঘালয় দেখা যাবে, তাছাড়া মেঘালয় নামে কিছু আছে সেটা আমার মনেই ছিলোনা। সত্যিই আমার মেঘালয় আর ওই মেঘালয় দুটোই খুব সুন্দর! দুটোই অনেক বিশাল আর ভয়ংকর সুন্দর!”
মেঘালয় বললো, “এক্ষুনি তো আমাকে নদীতে ফেলে দিতে চাইছিলে।”
মিশু লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। নদী থেকে মেঘালয়ের অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো ওর। হা করে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। বাতাসে এলোমেলো ভাবে চুল উড়ছে, মেঘালয় শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে। মিশু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে ওই বিশাল মেঘালয়ের দিকে, আর মিশুর মেঘালয় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে মিশুর দিকে।
চলবে..

অনুভূতি
পর্ব ৩২
মিশু মনি
.
৫০.
বিছানাকান্দিতে পৌছে মিশুর আনন্দ যেন আর ধরেই না। মেঘালয়ের হাত ধরে ও ছপ করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। পানিতে ছপ ছপ শব্দ তুলে বালিতে এসে এসে উঠলো। জুতোজোড়া নৌকাতেই খুলে রেখে এসেছে। মেঘালয়কে রেখেই মিশু ভো দৌড় শুরু করে দিলো। সব বন্ধুরা ওর কর্মকাণ্ড হা হয়ে দেখছে।
মিশু এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে আর মুগ্ধ হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। পিছনে বিশাল প্রশস্ত নদী, সামনে ডানেও মেঘালয় আর বামেও মেঘালয়। সামনে যত দূর চোখ যায়,মেঘালয়ের বিস্তৃত পাহাড় গুলোই চোখে পড়ে। গাঢ় সবুজে চোখ ধাধিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। দূরে একটা ঝরণাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মিশু ছুটতে ছুটতে অনেক দূর চলে গিয়ে স্রোতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। স্রোতে পা ডুবিয়ে দিয়ে কয়েকবার লাফালো। মেঘালয় ও ছুটতে শুরু করেছে,এভাবে লাফালে তো পাথরে পা কেটে যাবে।
মিশু লাফাতে লাফাতে ক্লান্ত হয়ে ধপ করে একটা পাথরের উপর বসে পড়লো। তারপর হাফাতে হাফাতে পানি ছিটাতে আরম্ভ করলো। শীতল পানির স্রোতে পা ডুবিয়ে কি যে শান্তি লাগছে! মেঘালয় ছুটে এসে ওর পাশেই পাথরে বসে পড়লো।
মিশু আনন্দের ঠেলায় কথাই বলতে পারছে না। সমানে পানিতে লাফাচ্ছে। পানির নিচে মৃদু লাল,নীল কত রঙের নুড়ি পাথর! পাথর গুলো তুলে তুলে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বিছানাকান্দির পানি একদম স্বচ্ছ। দূরের ঝরনার দিকে তাকিয়ে মিশু মেঘলয়কে বললো, “ওইখানে যাওয়া যাবেনা?”
– “না রে পাগলী। ওটা অনেক বেশি দূরে। এখান থেকে ঝরনা কত্ত ছোট দেখাচ্ছে দেখছো না?”
– “মেঘমনি, আমার আনন্দে কান্না করতে ইচ্ছে করছে গো। আমি একটু কান্না করি?”
মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “কাঁদবে? দুজনে একসাথে জলে নামার পর কান্না করিও।”
– “এখন কাঁদবো না?”
– “এখন কাঁদলে লোকজন হা করে তাকিয়ে থাকবে। দুজনে একসাথে পানিতে নেমে ডুবে বসে থাকবো, তখন আমার বুকে মাথা রেখে কান্না করো।”
– “ইস! আইডিয়াটা ভালো। তখন আমি অনেক গুলা কান্না করবো আচ্ছা?”
– “আচ্ছা অনেক গুলা কান্না করো। এখন কেঁদো না। এখন গা ভিজিও না, আসো আগে লাঞ্চ করে নেই।”
– “লাঞ্চ কই করবা? এখানে কে ভাত রেঁধে বসে আছে তোমার জন্য?”
মেঘালয় হেসে মিশুর একটা হাত তুলে নিয়ে পিছন দিকে দূরে কয়েকটা দোকান দেখিয়ে দিয়ে বললো, “ওই যে চালা গুলো দেখতে পাচ্ছো? ওইখানে আমার জন্য ভাত রেঁধে বসে আছে। চলো।”
– “এখনি তো খিদে পায়নি গো। আর এত তাড়াতাড়ি খাওয়ার কি আছে?”
– “পানিতে নেমে কান্না করবে না?”
– “আমি কি চার পাঁচ ছয় ঘন্টা ধরে কাঁদবো নাকি? অল্প একটু কাঁদবো।”
– “তুমি না বললা অনেক গুলা কান্না করবা?”
– “অনেক গুলা কান্না অল্প কয় মিনিটেই সেরে ফেলবো। বেশিক্ষণ কান্না করা যায়? এত সুন্দর জায়গায় বেশিক্ষণ কান্না করা যায়না।”
– “ও আচ্ছা, তবুও এখন আমাদের খেয়ে নেয়া উচিৎ। আমরা একটু পর পানিতে নামবো, ভেজা শরীরে তো আর খেতে ভালো লাগবে না।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “তা ভালো বলেছো। আসো তাড়াতাড়ি খেয়ে আসি।”
মিশু পানি থেকে পা তুলে পাথরের উপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে দ্রুত দোকানের দিকে যেতে লাগলো। ওর সাথে যে মেঘালয় আছে সেটা ভূলেই গিয়েছে বোধহয়। মেয়েটা বেশি সুখের মুহুর্ত গুলোতে একদম বাচ্চা স্বভাবের হয়ে যায়। এখনো তার ব্যতিক্রম হয়নি। এমনিতেই সবসময় শিশুসুলভ আচরণ ফুটে উঠে ওর আচরণে, আজকে আরো বেশি ফুটে উঠেছে। মেঘালয়ের বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করছে। চারিদিকে এত ভালো লাগা কেন!
মিশু দ্রুত হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ একটা পা উপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠলো। মেঘালয় কাছে গিয়ে বলল, “ব্যথা পেলে? এজন্যই তোমার আমার হাত ধরে সাথে সাথে চলা উচিৎ। এত ছুটোছুটি করলে তো হবেনা, পা ভেঙে বসে থাকবা তখন আর কোনো মজাই হবেনা।”
মিশু মুখটা কাচুমাচু করে বললো, “আচ্ছা আমার হাত ধরে ধরে আসো তাহলে।”
– “আমি তোমার হাত ধরে যাবো নাকি তুমি আমার হাত ধরে যাবা?”
মিশু হেসে ফেললো। ওর বন্ধুরা এসে উপরেই দাঁড়িয়ে আছে, কেউ আর জলের ধারে আসেনি। ওদের কাছে গিয়ে মেঘালয় বললো, “আগে খেয়ে নেই।”
সায়ান বললো, “এই বাচ্চাটাকে সামলাস কিভাবে তুই?”
মেঘালয় হাসলো। মিশুর কোনো মনোযোগই নেই ওদের প্রতি। ও অবাক হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। পায়ের নিচে গুড়িগুড়ি বালি আর পাথর। খালি পায়ে হাঁটলে পায়ের তলায় কেমন সুড়সুড়ি অনুভূত হয়। মাথার উপর স্বচ্ছ নীলাকাশ, তিনদিকেই মেঘালয় আর একদিকে প্রশস্ত নদী। সবকিছু এত সুন্দর কেন!
মেঘালয় মিশুর হাত ধরে ধরে ওকে নিয়ে চালা দেয়া রেস্টুরেন্টের কাছে চলে এলো। ওকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে খাবার অর্ডার দিয়ে আসলো। মিশু আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে। ও বসে বসে টেবিলে ঢোল বাজাতে লাগলো। কোনোদিকে ওর হুশ নেই। সবাই হা করে চেয়ে আছে ওর ঢোল বাজানোর দিকে। দুই হাতে সমান তালে টেবিলে ঢোল বাজিয়ে চলেছে।
মেঘালয় এসে দেখলো এই কাণ্ড! সবাই হতবাক আর মিশু তবলা বাজায়! পাগল হয়ে গেছে নাকি মেয়েটা? ও এসে মিশু পাশের চেয়ারে বসে বললো, “কি করছো? ঢোল বাজাচ্ছো কেন?”
– “ঢোল কই পেলাম? আমিতো টেবিল বাজাচ্ছি।”
হতবাক হয়ে চেয়ে থাকা মুখ গুলো হেসে উঠলো। মেঘালয়ের ও হাসি পেলো। ও হাসি থামিয়ে বললো, “টেবিল বাজাচ্ছো কেন?”
– “হাত আছে, ইচ্ছে হয়েছে তাই বাজাই। তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও বাজাও।”
– “যা ইচ্ছে হবে তাই করতে হবে?”
– “হ্যা, কয়দিন ই বা বাঁচবো। যা ইচ্ছে হবে তাই করতে হবে।”
মেঘালয় মিশুর কানের কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো, “আমার ইচ্ছে করছে তোমার নিচের ঠোঁটে একটা ছোট্ট কামড় দিতে।”
মিশুর শরীর শিউরে উঠলো। মুখের হাসি মুহুর্তেই মিলিয়ে গেলো ওর। চোখ রাঙিয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি এত খারাপ কেন? দেখছো আমি একটু অন্য জগতে চলে গেছি এখন আমাকে থামানোর জন্য এসব বলবা?”
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। মেঘালয় লজ্জা পেয়ে আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেতে শুরু করলো। মিশুও খাবার খাওয়া আরম্ভ করেছে। মেঘালয় মিশুর কানেকানে বললো, “তুমি রেগে গেলে আরো বেশি মিষ্টি দেখায়। তখন তোমার নাভীতে….”
কথা শেষ করতে পারলো না। মিশু দুটো ঘুষি দিতেই মেঘালয় চেয়ার সুদ্ধ পিছনে উলটে পড়ে গেলো। পাশের টেবিলের লোকজন তাকাচ্ছে ওদের দিকে। আর মেঘালয়ের বন্ধুরা একদম থ!
মেঘালয় ও মিশুর এমন আচরণে একদম অবাক। ও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। মিশু বললো,”আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আরাফ ভাইয়ার। সে সারাক্ষণ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চায়। তার ইফেক্ট আমার উপর পড়েছে।”
সবাই হাসলো। মেঘালয় উঠে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। আর কোনো কথাই বললো না। একদম চুপচাপ মাথা নিচু করে খেতে আরম্ভ করেছে। সবাই দেখছে ব্যাপারটা সংকোচ জনক। অন্যরাও খেতে লাগলো। এদিকে মেঘালয়ের মাথাটা খুব ঝিমঝিম করছে। পিছনে উলটে পড়ে একটা পাথরের উপর মাথাটা পড়ায় খুব আঘাত পেয়েছে মাথার পিছন দিকে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলো না। যথাসাধ্য চেষ্টা করলো স্বাভাবিক থাকার জন্য। তবুও ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। মেঘালয়ের চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। ও দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার চেষ্টা করছে।
সায়ান মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, “মেঘ তুই ঠিক আছিস?”
মেঘালয় এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলো। সায়ানের প্রশ্ন শুনে চোখ মেলে তাকালো। মিশুও প্রশ্ন শুনে চমকে তাকালো মেঘালয়ের দিকে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরটা কেঁপে উঠলো মিশুর। এমন দেখাচ্ছে কেন মেঘালয়কে? সে কি মিশুর আচরণে কষ্ট পেলো?
মিশু খাওয়া বন্ধ করে মাথা নিচু করে ভাবছে। এরকম রিয়েক্ট করাটা উচিৎ হয়নি। নিজের কাছে নিজেকেই অপরাধী মনেহচ্ছে। এখন সবার সামনে কিছু বলাও যাবেনা। খাওয়া শেষ হলে কথা বলতে হবে। কিন্তু এখন তো আর খেতেই পারবে না ও।
আরাফ জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি ব্যথা পেয়েছিস মেঘ?”
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “আরে না। তোরা অযথা ভাবছিস। আমি একদম ঠিক আছি।”
মিশু পিছন ফিরে তাকালো মাটির দিকে। ছোট্ট পাথরটা দেখেই ও বুঝে গেছে মেঘালয় সেটাতেই পড়ে আঘাত পেয়েছে। মনটা চরম খারাপ হয়ে গেলো। মেঘালয়ের চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি করে বলোতো মেঘ তুমি ব্যথা পাওনি?”
মিশুর চোখের দিকে তাকালে মেঘালয় কিচ্ছু লুকাতে পারেনা। ও বলল, “এমন কিছু না। সামান্য একটু ব্যথা পেয়েছি।”
মিশুর কান্না এসে যাচ্ছে। কেন এরকম আচরণ করলো ও? এই ছেলেটা ওকে কত ভালোবাসে,কত্ত খেয়াল রাখে। আর ও শুধুশুধু কষ্ট দিয়ে ফেললো। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।
মেঘালয় বললো, “আমার অভ্যেস আছে এসবে। যখন হিমালয়ে যেতাম, কত বড় বড় বিপদে পড়েছি। তুষারঝড়ের মত অনেক বড় বড় বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছি। এ আর কি এমন। বাদ দে, খা তোরা সবাই।”
সবাই খেতে শুরু করেছে। মিশু খাচ্ছেনা দেখে মেঘালয় বললো, “তুমি খাচ্ছো না কেন? আরে পাগলী আমি রাগ করিনি। আমি কতবার বেস ক্যাম্পে গিয়েছি তুমি জানো? আমার এসব সামান্য আঘাতে কিছু হয়না।”
– “মাথায় না হয় সামান্য আঘাত পেয়েছ, আমার আচরণে ভেতরে যে আঘাতটা পেয়েছো সেটার কি অভ্যেস আছে?”
মিশুর প্রশ্নে টেবিলের সবাই মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। মিশুর চোখ ছলছল করছে। কেউ কিছু বললো না। মেঘালয় হেসে বললো, “তুমি আমার বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কলিজাটা টেনে বের করে নাও, তবুও আমার একটুও কষ্ট হবেনা। আমার লাইফটাই তো তোমার। খেয়ে নাও নয়ত আমিও খাবোনা।”
মেঘালয় মিশুর মুখে খাবার তুলে দিলো। মিশু এবার কেঁদেই ফেললো একেবারে। মেঘ বললো, “এখনি কান্না করছো কেন? তুমি না বললা পানিতে নেমে অনেক গুলা কান্না করবা? এখন সব কান্না শেষ হলে তখন কাঁদবা কি?”
বলেই হেসে ফেললো। মিশুও হাসলো। রৌদ্রময়ী মুগ্ধ হয়ে ওদের দুজনকে দেখছে। কিভাবে মেঘালয় এই বাচ্চা মেয়েটাকে এতটা ভালোবাসতে পারে? কাউকে পরোয়া করছে না, লোকজনের সামনেই ওকে তুলে খাওয়াচ্ছে। অন্য কোনো ছেলে হলে তো রেগে আর মিশুর সাথে কথাই বলতো না। মেঘালয় মিশুর সমস্ত কিছু সহ্য করে যায়। অদ্ভুত একটা মানুষ!
খাওয়া শেষ করে ওরা পাশের দোকানগুলোতে এলো। হরেক রকমের কসমেটিক্স বিক্রি হচ্ছে। মিশু অবাক হলেও আগের মত স্বাভাবিক হতে পারছে না। মন খারাপ লাগছে খুব। ওরা টুকটাক কেনাকাটা করতে লাগলো। মেঘালয় বারবার মিশুকে বলল, “যা মন চায় নাও।” তবুও মিশুর কোনো ভাবান্তর নেই। ও কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মনেহচ্ছে মেঘালয় ই বোধহয় ওকে ঘুষি মেরে ফেলে দিয়েছিলো। মেঘ দিব্যি হেসে হেসে জিনিসপত্র দেখছে আর ও বিষণ্ণ হয়ে আছে।
মিশু একা একা হাঁটতে হাঁটতে স্রোতের দিকে যেতে লাগলো। মেঘালয় এসে ওর পাশে হাঁটতে লাগলো। দুজনে এসে একসাথে পানিতে নামলো। মেঘালয় হাঁটুজলে পা ডুবিয়ে মিশুকে এসে ওর পাশে বসতে বলল। কিন্তু মিশু ওর কথা শুনলো না। ও একাই এগিয়ে যেতে লাগলো গভীর স্রোতের দিকে। মেঘালয় বলল, “ওদিকে যেওনা, ওখানে স্রোত বেশি।”
মিশুর কোনোই ভাবান্তর নেই। ও কেমন যেন স্থবির হয়ে গেছে। মেঘালয় ওর পিছুপিছু যেতে লাগলো। মিশু একটা পাথরে আঘাত পেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়,তবুও থামলো না। একটা একটা করে পাথর ডিঙিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ওদিকে স্রোতের গভীরতা বেশি। মেঘালয় এত করে ডাকছে তবুও শুনছে না। গিয়ে সামনে একটা গর্তে লাফিয়ে পড়লো। বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো মেঘালয়ের। আবার ব্যথা পেলো না তো? কি যে করে মেয়েটা। শুধুশুধু দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়।
দুপাশে বড় বড় পাথর আর মাঝখানে একটু গভীর, মিশু সেখানে ডুবে শুধু নাক আর চোখ বের করে চেয়ে আছে। চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে মেঘালয়ের দিকে। পুরো শরীর টা পানির নিচে। স্রোত ওকে ঠেলে নিয়ে যেত চাইছে কিন্তু পাথরে পা ঠেলে বসে আছে ও। দুপাশেই বড় বড় পাথর থাকায় পাথরের সাথে আটকে আছে। ও যে খুব মজা পাচ্ছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চোখে হাসির ঝিলিক। স্বচ্ছ পানিতে বসে আছে পা দুটো একসাথে জড়ো করে সেটাও বোঝা যাচ্ছে। মেঘালয় নেমে পাথরে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। মেঘালয়ও ডুবে গেলো প্রায়, শুধু মাথাটা বের হয়ে থাকলো। মিশু শুধু নাক আর চোখ কান বের করে রেখেছে। পুরো শরীরটাই পানির নিচে। এদিকে কেউ নেই, শুধু ওরাই দুজন।
মেঘালয়কে পাথরে হেলান দিয়ে বসতে দেখে মিশু এসে ওর কোলের উপর বসে পড়লো। মেঘালয়ের বুকে হেলান দিয়ে ডুবে রইলো দুজনে। এদিকে বরফ শীতল জলের স্পর্শে শরীর শিউড়ে উঠছে দুজনের। মেঘালয় পানির নিচেই শক্ত করে মিশুকে জাপটে ধরে রইল। মিশু পাথরের আড়ালে মেঘালয়ের মাথাটা আচমকা ঠেস দিয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। মিশুর এরকম কাজে একদম অবাক হয়ে গেলো মেঘালয়। সেজন্যই মেয়েটা এত দূরে এসে ডুবে বসে আছে, এতক্ষণে স্পষ্ট হলো ওর কাছে। মেঘালয় চোখ খুলে রেখেছে, মিশুর চোখ বন্ধ। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মেঘালয় ওর ঠোঁটে একটা ছোট্ট কামড় দেয়ার পর মিশু ওকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল।
মেঘালয়ের চোখে চোখ রেখে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “সরি মেঘালয়। আর কক্ষনো এভাবে তোমাকে আঘাত করবো না। সরি, আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।”
বলেই দুহাতে নিজের কান ধরে বসে রইলো। মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “এত বড় একটা সারপ্রাইজের পরও কি আর রাগ করে থাকা যায়?”
মিশু এসে ওর বুকে মাথা রেখে ডুব দিয়ে রইলো অনেক্ষণ। তারপর মাথা তুলে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললো, “দম আটকে আসছিলো উফফ। পানি গুলো জলের মত ঠাণ্ডা।”
– “হা হা হা, পানি আবার জলের মত ঠাণ্ডা হয় কি করে?”
-“মেঘালয় যেভাবে মিশুর মত মিষ্টি, সেভাবে।”
মেঘালয় আবারো হেসে উঠলো। মিশু ওর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বুকে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। মেঘালয় পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে, আর মিশু ওর বুকে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। দুজনেই একসাথে আকাশ দেখছে। আকাশ ঘন নীল, সাদা তুলোর মতন মেঘ উড়ছে। মিশু এক মেঘালয়ের বুকে হেলান দিয়ে আরেক মেঘালয় দেখছে। পিছনে মেঘালয়, ডানে মেঘালয়, বামেও মেঘালয়। যার বুকে হেলান দিয়ে কোলে বসে আছে, সেও মেঘালয়। আর মাথার উপর উড়ছে মেঘ আর মেঘ। আহ! কি অদ্ভুত সুখ!
অনেক্ষণ পানিতে এভাবে ভেসে ভেসে আকাশ দেখলো। আস্তে আস্তে এদিকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। এতক্ষণ এখানে কেউ ছিলোনা। লোকজনের সামনে এভাবে শুয়ে থাকা যায় না। মেঘালয় মিশুকে নিয়ে সেখান থেকে উঠে আসলো। দুজনে একটা পাথরের উপরে বসে একে অপরের পিঠে হেলান দিয়ে বসে বসে বিছানাকান্দির মুগ্ধ করা সৌন্দর্য দেখতে লাগলো। যত বিকেল হচ্ছে, স্রোত তত বেড়ে যাচ্ছে।
রৌদ্রময়ীর একজন ভালো সঙ্গী জুটে গেছে, পূর্ব। বাকিরা যখন জলের ভেতর শুয়ে আকাশ দেখছিলো পূর্ব তখন রোদের সাথে বসে গল্প করছিলো। রোদ পাথরে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে অনেক্ষণ গল্প করলো ওর সাথে। পূর্ব’র কিছু ছবি তুলে দিলো, পূর্ব ওর অনেক ছবি তুললো, বাকিদের ছবিও তুললো। মিশু আর মেঘালয় দূরে হারিয়ে গিয়ে পানিতে ডুবে প্রকৃতি আর প্রেমের নেশায় মেতেছে। আর ওরা সবাই মিলে হাসি ঠাট্টা, দুষ্টুমি, পানি ছুঁড়োছুড়ি করতে লাগলো। রোদের মন এখন একদম ভালো। রোদ নিজেও অনেক্ষণ পানিতে শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। আকাশ দেখতে খুবই ভালো লাগে ওর। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এলো।
মেঘালয় মিশুকে বলল, “চলো এবার ওদের কাছে যাই। অনেক্ষণ এখানে বসে আছি।”
-“আমার ইচ্ছে করছে আজীবন এখানে থেকে যাই।”
মেঘালয় হাসলো। হাত ধরে মিশুকে টেনে তুলে আস্তে আস্তে হেঁটে ওর বন্ধুদের দিকে আসতে লাগলো। অনেক্ষণ পাথরের উপর বসে গল্প করেছে ওরা, একে অপরকে পানি আর পাথর দিয়ে মারামারি করেছে। মিশুর মজার মজার কথা শুনে বিভোর হয়ে রইলো মেঘালয়।
সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ওরা নৌকায় করে আবারো ঘাটের দিকে ফিরছিলো। আজকের দিনটা অন্যরকম একটা দিন ছিলো। সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে বিছানাকান্দির সৌন্দর্য একদম মোহনীয় হয়ে উঠে। মিশু বারবার বলতে লাগলো, “পাথর কেন খাওয়া যায় না? বালি কেন খাওয়া যায়না? মেঘালয় কেন খাওয়া যায়না?”
পূর্ব বলল, “মেঘালয় খাওয়া যায়।”
সবাই হেসে উঠলো ওর কথা শুনে। নৌকায় ফেরার সময় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নদীর শীতল হাওয়ায় শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। তার উপর ভেজা কাপড়ে সবাই বসে আছে। শিরশির করে ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে গায়ে। শরীর ফুড়ে যেন বাতাস ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। মেঘালয় মিশুকে ধরে রইলো। ওর উষ্ণ স্পর্শে মিশুর একটুও শীত করছে না। কিন্তু বাকিদের অবস্থা করুণ। রোদ রীতিমত ঠাণ্ডায় কাঁপছে। মেঘালয় সবকিছুতে অভ্যস্ত। সে পর্বতারোহণে গেলে কত ঠাণ্ডা সইতে হয়। হিমালয়ের বরফে জমে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায় একেবারে।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here