অন্তঃকরণে তোরই পদচারণ পর্ব -৩৯+৪০ ও শেষ

#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৩৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★হাসিখুশি মুহূর্ত টা হঠাৎই কালবৈশাখী ঝড়ের মতো এলোমেলো হয়ে গেল। আনন্দিত পরিবেশ টা কেমন থমথমে গুমোট পরিস্থিতিতে পরিবর্তীত হয়ে গেল। সবার মাঝেই ছেয়ে গেল নীরব অশান্ত অবস্থা। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় আজ আর ওদের বিয়েটা হলোনা। জিদান সাহেব রাকিব হাসানের কাছে মাফ চেয়ে কিছুদিন সময় চাইলো। তারপরই ওরা বেড়িয়ে গেল। যাওয়ার আগে একবার অসহায় চোখে তাকালো বেলির দিকে।না চাইতেও মেয়েটিকে সে আবারও আঘাত দিলো। এরজন্য তার প্রচুর অপরাধ বোধ হচ্ছে। আজ নিজের অসাবধানতার কারণেই এসব হলো। জানা নেই এসব সে ঠিক করতে পারবে কিনা।

খুশির হাত শক্ত করে ধরে নিজেদের রুমে এলো প্রহর। সেই তখন থেকেই প্রহর একবারের জন্যও খুশির হাত ছাড়েনি। যেন হাত ছেড়ে দিলেই কেউ কেঁড়ে নিয়ে যাবে ওর খুশিকে। প্রহরের এই অশান্ত অবস্থা খুশির সহ্য হচ্ছে না। অন্তর কাঁদছে ওর। খুশির আপাতত অন্য সবকিছু বাদে শুধুই প্রহরের চিন্তা হচ্ছে। প্রহরের ভেতর যে কষ্টের আগুন জ্বলছে তা বুঝতে পেরেছি বুক ফেটে যাচ্ছে খুশির। কি করে প্রহরের কষ্ট কমাবে সেই উপায়ই শুধু খুঁজে চলেছে সে।

প্রহর খুশিকে নিয়ে বিছানার মাঝখানে বসালো। বসিয়ে দিয়ে কেমন অস্থির অস্বাভাবিক সুরে বলতে লাগলো।
–তু তুমি এখানেই বসে থাকবে হ্যাঁ? এখান একদম নড়বে না কিন্তু। ওই মহিলা আবার এসেছে। ও আমার সব সুখ কেঁড়ে নেয়। এখন আবার তোমাকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিতে এসেছে। আমি তা হতে দিবোনা। কিছুতেই না।
কথাগুলো বলে প্রহর উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির ভাবে এগিয়ে রুমের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে পর্দা টানিয়ে দিলো। প্রহরের এই অস্বাভাবিক করুন অবস্থা দেখে খুশির চোখের পানি বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে আসছে। খুশি মুখে হাত চেপে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। এইমুহূর্তে প্রহরের সামনে কাঁদলে ও আরও পাগল হয়ে যাবে। তাই দ্রুত চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো খুশি।

সবকিছু আটকানো শেষে প্রহর আবারও দৌড়ে এলো খুশির কাছে। খুশির পাশে বসে খুশিকে বুকের মাঝে আবারও শক্ত করে নিলো। নাহ্ তাতেও যেন ভয় কমছে না প্রহরের। সে এবার বালিশগুলো নিয়ে খুশির চারিদিকে ঘেরাও করে দিলো। তারপর আবারও খুশিকে বুকের মাঝে নিয়ে অশান্ত কন্ঠে বললো।
–এখন ঠিক আছে। এখন আর কেউ আসতে পারবেনা তোমার কাছে। আমার খুশিকে কেউ কেঁড়ে নিতে পারবেনা আমার কাছ থেকে। কেউ না। আমি হতেই দিবো না।

খুশি প্রহরের বুক থেকে মাথা তুলে দুই হাতে প্রহরের মুখটা আগলে ধরে আবেগী কন্ঠে বললো।
–প্লিজ শান্ত হও প্রহর। দেখ আমি তোমার কাছেই আছি। আমাকে কেউ কেড়ে নিবে না তোমার কাছ থেকে। প্লিজ একটু সামলাও নিজেকে।

–না না খুশি তুমি জানোনা। উনি আমাকে সুখে দেখতে পারে না। আবারও আমার সব সুখ কেঁড়ে নিতে এসেছে। সে নিশ্চয় জানে তুমি আমার সব। তাইতো সে এখন তোমাকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিবে। খুশি তুমি সবসময় আমার বুকের মাঝেই থাকবে। আমাকে ছেড়ে এক পাও নড়বে না। তাহলে কেউ আর তোমাকে কেঁড়ে নিতে পারবেনা। কেউ না।

খুশি বুঝতে পারছে এভাবে প্রহর শান্ত হবে না।তাই সে কিছু একটা ভেবে বললো।
–আচ্ছা ঠিক আছে। আমার টায়ার্ড লাগছে। আমি বরং একটু শুয়ে থাকি কেমন?
কথাটা বলে খুশি বালিশে মাথা রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো। প্রহরের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো।
–তুমিও আসোনা আমার কাছে।
খুশির আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রহর আস্তে করে খুশির বুকে মাথা রেখে খুশিকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। খুশি দুই হাতে প্রহরের মাথাটা নিজের বুকের মাঝে পরম আবেশে আগলে নিলো। প্রহরের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললো।
–প্রহর আমি পারছিনা তোমাকে এভাবে দেখতে। আমি জানি তোমার মাঝে অনেক ঝড় চলছে। তোমার ভেতরে কষ্টগুলো জমাট বেঁধে আছে। যা তোমাকে ভেতরে ভেতরে খেয়ে যাচ্ছে। আজ সেগুলো বের করে দাও প্লিজ। তুমি একটু মন খুলে কাঁদো। দেখবে তোমার ভেতরটা অনেক হালকা হয়ে যাবে। আমিতো তোমারই তাইনা? তাহলে আমাকে কি একটু তোমার কষ্টের সঙ্গী হতে দিবেনা? প্লিজ প্রহর নিজেকে আর আটকে রেখো না।ভেতরের সব বের করে দাও আজ।

খুশির আবেগী কথায় প্রহরও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা। এত বছরের জমানো কষ্ট গুলো আজ বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে এলো।খুশিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে মুখ চেপে শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো প্রহর। বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভাসিয়ে দিলো খুশিকে। প্রহরের সাথে কাঁদছে খুশিও। কাঁদতে কাঁদতে প্রহর বলতে লাগলো।
–উনি কেন আবার এসেছে খুশি? কেন আমাদের সুখ কেঁড়ে নিতে এসেছে আবারও? কোন মা কি এমন হয় বলোনা? উনার ক্রিয়াকর্মের কথা আমার বলতেও ঘৃণা লাগে। আমাকে অন্য রুমে আটকে রেখে তিনি তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে…..। তারপর আমাকে ধমকি দিতেন আমি যদি বাবাকে এসব বলি তাহলে তিনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন। জানো আমি তার পায়ে ধরে কতো কান্নাকাটি করেছিলাম আমাকে ছেড়ে যেন না যায় সেজন্য। কিন্তু উনার মনে পেটের সন্তানের জন্য একটুও মায়া হয়নি। উনি আমার সাথে যা করেছে সেটা তবুও নাহয় আমি ভুলে গেলাম। কিন্তু উনি আমার বাবাকে যে কষ্ট দিয়েছে সেটা কখনও ভুলতে পারবোনা। আর তারজন্য আমি তাকে কোনদিন ক্ষমা করবোনা। আমি ছোট ছিলাম কেঁদে কেটে নিজের কষ্ট জাহির করতাম। কিন্তু বাবা তো সেটাও পারতোনা। একা একা ভেতরে ভেতরে গুমোট হয়ে থাকতো। একা রুমে বাবাকে আমি অনেক দিন লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি। দিনের পর একাকিত্বের সাথে লড়তে হয়েছে তাকে। আর আজ যখন বাবা নিজের জীবনে একটু সুখী হতে চলেছে উনি আবারও চলে এসেছেন বাবার সুখ কেঁড়ে নিতে। কেন করে এমন উনি? কি চায় তিনি? আর কত কষ্ট দিলে উনি শান্তি পাবেন?

প্রহরের কথা শুনে রাগে আর ঘৃণায় শরীর রি রি করছে খুশির।ইচ্ছে হচ্ছে এখুনি গিয়ে গলা টিপে খুন করে ফেলতে। কোন মা এমন কিভাবে হতে পারে? কিন্তু আর না। ওই মহিলাকে আমি এবার জিততে দিবোনা।এবার উনি আমার প্রহরকে কোন কষ্ট দিতে পারবে না। কিছুতেই না। খুশি প্রহরের মাথায় চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কান্না করে প্রহরের সত্যিই একটু হালকা লাগছে। সে ধীরে ধীরে খুশির বুকেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
__

–ছাড় আমাকে ছেড়ে দাও। প্রহররররর… বাঁচাও আমাকে। দেখ ও নিয়ে যাচ্ছে আমাকে।

পাপিয়া বেগম খুশির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। খুশি ছাড়া পাওয়ার জন্য আকুতি মিনতি করছে। তবুও পাপিয়া বেগম ছাড়ছে না। টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। প্রহর অনেক চেষ্টা করেও এগিয়ে যেতে পারছেনা ওদের কাছে। মনে হচ্ছে ওর হাত পা কেউ শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। চিল্লাতে গেলে গলা দিয়ে কোন আওয়াজও বের হচ্ছে না। প্রহরের জানটা যেন বেরিয়ে যাচ্ছে।
–খুশিইইইইই

চোখ মেলে ঠাস করে উঠে বসলো প্রহর। জোরে জোরে হাঁপাতে লাগলো। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে গেছে। প্রহর তড়িৎ গতিতে পাশে ফিরে তাকালো। বিছানায় খুশিকে না দেখে হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল প্রহরের। খু খুশি?? খুশি কোথায়??খুশিইইই??খুশিইইই……….. প্রহর অস্থির হয়ে খুশির নাম ধরে ডাকতে লাগলো। ডাকতে ডাকতে দৌড়ে নিচে নেমে এলো প্রহর। পাগলের মতো খুশিকে খুঁজতে লাগলো।

জিদান সাহেব সোফায় বসেছিলেন। প্রহরকে এভাবে অস্থির হতে দেখে তিনি চিন্তিত সুরে বললেন।
–কি হয়েছে প্রহর? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?

প্রহর অস্থির কন্ঠে বললো।
–বাবা খুশি কোথায়? বলনা আমার খুশি কোথায়?

–খুশি মা তো একটু আগে বাইরে গেল। বললো কি যেন একটা দরকারি কাজে যাচ্ছে। একটু পরেই চলে আসবে।

খুশি বাসায় নেই এই কথাটাই প্রহরকে প্রাণহীন করার জন্য যথেষ্ট ছিল। প্রহর কম্পিত গলায় বললো।
–বা বাইরে গেছে মানে? কোথায় গেছে? আর তুমি ওকে যেতে দিলে কেন?
প্রহর দ্রুত ফোন বের খুশির নাম্বারে কল দিলো। কিন্তু ফোন রিসিভ হলো না। কয়েকবার কল দেওয়ার পরও ধরলো না। প্রহর যেন এবার পুরো পাগল হয়ে গেল। দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে উন্মাদের মতো পায়চারী করে বললো।
–এখন আমি কি করবো? কোথায় খুঁজবো খুশিকে? ও ওই মহিলা আমার খুশিকে কেঁড়ে নিবে। সব আমার দোষ। আমি কেন ঘুমুতে গেলাম? কেন? কেন? কেন?
প্রহর রাগে সামনের টি টেবিলে সজোরে একটা লাথি মেরে দিল। প্রহরের এমন পাগলামো দেখে জিদান সাহেব ঘাবড়ে গিয়ে বললো।
–এত চিন্তার কিছু নেই প্রহর। খুশির কিছু হবে না। আচ্ছা খুশিতো বাসার গাড়ি নিয়েই গেছে। এক কাজ কর ড্রাইভারকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর ওরা কোথায়।

জিদান সাহেবের কথামতো প্রহর ওদের ড্রাইভারকে ফোন করলো। আর ড্রাইভারকে বলা ঠিকানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো প্রহর।
__

পাপিয়া বেগমের সামনে বসে আছে খুশি। কিছুক্ষণ পূর্বেই এখানে এসে পৌঁছেছে ও। পাপিয়া বেগম বলে উঠলেন।
–তো বলো এখানে কেন এসেছ তুমি? কি বলতে চাও?

খুশি দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো।
–দেখুন ভনিতা করে লাভ নেই। আমি ভালো করেই জানি এসবি মানে আমার শশুরের সাথে নতুন করে সংসার শুরু করার আপনার কোন ইচ্ছেই নেই। আর না প্রহরের প্রতি কোন মায়ার কারণে এসব করছেন। তো আসল পয়েন্টে আসুন। কি চান আপনি? টাকা না সম্পত্তির ভাগ? দেখুন আমি সংসারের সুখের জন্য সব করতে রাজি।

খুশি টি টেবিলের ওপর একটা ফাইল রেখে বললো।
–এখানে প্রহরের সম্পত্তির পঁচিশ পার্সেন্ট শেয়ার আছে। যা প্রহর আমার নামে করেছিল। আমাকে বিয়ের গিফট হিসেবে দিয়েছিল। এটা আমার কাছে শুধু সামান্য কাগজের টুকরো ছাড়া কিছুই না। তাই এগুলো আমি আপনার নামে করে দিতে রাজি। বিনিময়ে আপনি এই ডিভোর্স পেপারে সাইন করবেন।আর প্রমিজ করবেন আর কখনো আমাদের জীবনে দখলদারি করতে আসবেন না।

পাপিয়া বেগম কতক্ষণ খুশির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর শান্ত সুরে বললো।
–ঠিক আছে।

পাপিয়া বেগম ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিলো। আর খুশি সম্পত্তির পেপারে। সাইন শেষেই খুশি পেপার নিয়ে উঠে আসতে নিলেই পাপিয়া বেগম নরম সুরে বলে উঠলেন।
–প্রহর সত্যিই অনেক লাকি। কারণ তোমার মতো জীবনসাথী পেয়েছে। দেখে ভালো লাগলো।

পাপিয়া বেগমের সুর কেমন বদলানো মনে হচ্ছে আজ। খুশি বলে উঠলো।
–এতই যখন ওকে ভালো দেখতে চান তাহলে ওর ক্ষতকে কেন তাজা করতে আবার চলে এসেছেন?

পাপিয়া বেগম অপরাধী সুরে বললো।
–আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি। আমার কাছে আর কোন উপায় ছিলোনা। আমার আরেক ছেলে পলাশের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চিকিৎসার জন্য লাখ লাখ টাকার দরকার। আর আমার বর্তমান হাসব্যান্ড রাসেল এর ব্যাবসা লসে গেছে। ব্যাংকরাপ্ট হয়ে গেছি আমরা। রাসেল সেই শোকে দিনরাত মদ খেয়ে পড়ে থাকে। এসব হয়তো আমারই কর্মের ফল পাচ্ছি। তবে যাইহোক ছেলেকে তো আর চোখের সামনে মরতে দেখতে পারি না। তাই একমাত্র এটাই উপায় ছিলো। ডিভোর্সের বদলে কিছু পাওয়ার আশাই এসব করেছি। জানি এখানেও স্বার্থপরের মতোই কাজ করেছি। কিন্তু কি করবো? আর কোন উপায় ছিলোনা।

দরজায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবকিছু শুনছিল প্রহর। খুশিকে খুঁজতে এখানে এসেছিল ও।কিন্তু দরজার কাছে আসতেই পাপিয়া বেগমের কথাগুলো শুনতে পায় সে। প্রহর এবার ভেতরে এসে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–আপসোস আপনি আপনার সন্তান কে কখনো চিনতেই পারেননি। আরে একবার বলেতো দেখতেন। যতটাকা চাই দিয়ে দিতাম। এই প্রহর মেহরাব চ্যারিটি করতে কখনো পিছু পা হয়না। সে যেই হোক না কেন। তারজন্য আমাদের জীবনে এসে তান্ডব না করলেও হতো।

পাপিয়া ছলছল চোখে তাকালো প্রহরের দিকে। নিজের ছেলেকে সে আসলেই কখনো চিনতে পারেনি। আসলে ওর মতো ছেলের মা হওয়ার যোগ্যই না আমি।

প্রহর এবার দ্রুত পায়ে খুশির কাছে এসে দুই হাতে খুশির মুখটা ধরে অস্থির কন্ঠে বললো।
–তুমি আমাকে না বলে এখানে কেন এসেছ? জানো কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি? আমাকে জ্বালাতে খুব মজা লাগে না তোমার?

খুশি অপরাধী সুরে মিনমিনিয়ে বললো।
–সরি, তোমাকে বললে তুমি আমাকে কখনোই আসতে দিতে না। তাই না বলে এসেছি। প্লিজ মাফ করে দাও।

–হ্যাঁ এখন ইচ্ছে করে এমন কিউট ফেস করবে যাতে আমি গলে যাই তাইতো? তুমি আগে বাসায় চলো তারপর দেখাচ্ছি মজা।

প্রহর খুশির কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যোত হলো। ঘুরে দুকদম আসতেই আবার একটু দাঁড়িয়ে উল্টো ঘুরে থাকা অবস্থায়ই পাপিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে বললো।
–আমি আজ থেকে আপনাকে মাফ করে দিলাম। কারণ আমি আপনার জন্য আমার মনে কোন রকম অনুভূতি রাখতে চাইনা। এমনকি ঘৃণাও না। আজ থেকে আপনি আমার জন্য বাকি সাধারণ মানুষের মতো শুধুই একটা অচেনা ব্যাক্তি। যার প্রতি কোন অনুভূতিই থাকে না।

কথাটা বলেই প্রহর খুশিকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। পাপিয়া বেগমের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা জল। এটাই হয়তো ও ডিজার্ভ করে।
__

দুদিন পর ঘরোয়া ভাবে জিদান সাহেব আর বেলির বিয়ে পড়ানো হয়। বিয়ের কার্যক্রম শেষে বউ নিয়ে বাসায় ফেরে সবাই। খুশির আনন্দ আর দেখে কে। নাচতে নাচতে বেহুশ হয়ে যাচ্ছে সে। প্রহর বেচারা কিছুতেই তাকে শান্ত রাখতে পারছেনা। কোনরকমে ধরে বেঁধে বাসায় নিয়ে আসলো তাকে।

বাসায় এসেও সেই হৈ হুল্লোড়। বেলিকে নিয়ে গেল জিদান সাহেবের রুমে। রুমে এসে বাসর ঘর সাজানো দেখে চরম অস্বস্তিতে পড়ে গেল বেলি। সে খুশির উদ্দেশ্যে চোখ গরম করে বললো।
–এই পাগলী এসব কি করেছিস? এই বয়সে কেউ বাসর করে?

–ওমা বাসর করার ওপর কি কোন এজ লিমিট দেওয়া আছে নাকি যে এত বছর পর বাসর করা যাবে না? আরে বাসর তো ফিলিংস থেকে হয়। এসবির নাহয় দ্বিতীয় বিয়ে। তোমারতো প্রথম বিয়ে তাইনা? বাসর নিয়ে নিশ্চয় কতো প্লানিং আছে। বলোনা মনের মধ্যে লাড্ডু ফুটছে তাইনা বলো? ♬ আজ মধুরাত আমার ফুলসজ্জার…

বেলি খুশির কান টেনে ধরে বললো।
–অনেক পাঁজি হয়ে গেছিস তাইনা? প্রহর আর জিদান তোকে লায় দিয়ে একেবারে মাথায় তুলেছে। এখন আমি এসে গেছি। তোর সব বান্দরামী আমি ছুটিয়ে দিবো।

–বাহ্ শাশুড়ী হতেই নিজের রঙ দেখানো শুরু করে দিলে? একেবারে প্রথম দিনই দজ্জাল শাশুড়ীর রোল চালু করে দিয়েছ। তুমি তো রিনা খানকেও ছাড়িয়ে যাবে। একেই বলে ইচ্ছে করে বিপদ ডেকে আনা।

–হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। আমি আসলেই একটা দজ্জাল শাশুড়ী। এখন দেখ এই দজ্জাল শাশুড়ী তোর কি হাল করে।

খুশি যথারীতি তার ওভারডোজ মেলোড্রামা শুরু করে দিলো। নেকি কান্নার সুরে বললো।
♬ মারবেন না মারবেন না আ.. আম্মাজান গো..
♬ ও আম্মাজান মারবেন না আমারে গো…
♬ আম্মা.. আম্মাজান গো…

বেলি এবার খুশির দিকে তেড়ে যেতে লাগলে খুশি হাসতে হাসতে দৌড়ে বাইরে চলে গেল।
নিজের রুমে এসে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই প্রহর ওর সামনে এসে আবির্ভাব হলো। প্রহরকে দেখে খুশির চোখের মনি বেড়িয়ে আসার উপক্রম। প্রহর সাদা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পড়েছে। শার্টের বোতাম সবগুলো খোলা। যার দরুন প্রহরের বলিষ্ঠ দেহ দৃশ্যমান। এই আকর্ষণীয় যুবককে দেখে গলা শুঁকিয়ে যাচ্ছে খুশির। প্রহর এক হাত খুশির মাথার পাশে দরোজায় ঠেকালো। আরেক হাত খুশির কোমড়ে রেখে খুশির দিকে নেশালো চোখে তাকিয়ে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে বললো।
–হায় সেক্সি, এত দেরি করলে কেন আসতে? জানো কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছিলাম?

খুশির এবার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। এটা কি সত্যিই প্রহর? নাকি আবারও ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে? খুশি কোনরকমে ঢোক গিলে বললো।
–প্রহর তুমি কি উল্টো পাল্টা কিছু খেয়েছ নাকি?

প্রহর খুশির কানের কাছে ঝুঁকে লো ভয়েসে বললো।
–উহুম খাইনি। তবে এখন খাবো, তোমাকে।

নাহ্ আর নিতে পারলোনা খুশি। খুশির হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠে বললো।
–আআআ ভুততত ভুততত….. বাঁচাও বাঁচাও ভুত এসেছে আমার ঘরে। প্রহর কোথায় তুমি?

বেচার প্রহর ভ্যাবাচেকা খেয়ে মন। তড়িঘড়ি করে খুশির মুখ চেপে ধরে বললো।
–আরে আরে কি করছ? চিৎকার কেন করছ? পুরো মহল্লা জানাবে নাকি? আর আমাকে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে তোমার ভুত মনে হচ্ছে? পুরো রোমান্টিক মুডের বারোটা বাজিয়ে দিলে।

কথাট বলে প্রহর খুশিকে ছেড়ে সরে দাঁড়াল। খুশি তখন বললো।
–তাহলে এসব কি? হঠাৎ করে এমন আউট অফ ক্যারেক্টর চলে গেলে ভুত ভাববো নাতো কি করবো? বিবিসি চ্যানেলে হঠাৎ এমটিভি চলে আসলে তো একটু চমকেই যাবো।

–কিহ্ আমি বিবিসি চ্যানেল? ওকে ফাইন। আমি তাহলে গিয়ে বরং শুয়ে পড়ি।

প্রহর অভিমান করে চলে যেতে নিলেই। খুশি দ্রুত প্রহরের সামনে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো।
–আচ্ছা আচ্ছা সরি সরি ভুল হয়ে গেছে। এতদিন পর আমার হাসব্যান্ড এর এতো রোমান্টিক আন্দাজ দেখতে পাচ্ছি। এটা বন্ধ করোনা প্লিজ। চলোনা আবার শুরু করি। হ্যাঁ তো বলো তুমি কি যেন বলছিলে?

প্রহর ফট করে খুশিকে কোলে তুলে নিয়ে বললো।
–বলাবলির সময় শেষ। ইটস টাইম ফর এ্যাকশন।

খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–হায়, আজতো খেলা জমবে বেস।
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৪০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
(অন্তিম পর্ব)

★দেখতে দেখতেই প্রহর খুশির বিবাহিত জীবনের প্রায় বছর হতে চলেছে। সবই চলছে আপন গতিতে। প্রহর খুশি ভাসছে তাদের সুখময় ভেলায়। খুশির সবকিছু ঠিকই চলছে শুধু একটা বিষয় ছাড়া। আর তা হলো পড়াশোনার প্যারা। যা ওর কাছে উটকো একটা ঝামেলা ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু এই কথা কাকে বলবে সে? এই দুঃখিয়ারির দুঃখ দেখার কেউ নেই নিষ্ঠুর দুনিয়ায়। তাইতো দুঃখের সাগরে ভাসতে ভাসতে পড়তে বসতে হয় ওকে।যেমন এখনো বসে আছে। সামনে পরিক্ষা তাই অফিস থেকে এসেই প্রহর খুশিকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে দিয়েছে। তার কোন আকুতি মিনতি একটুও কর্নপাত করেনি ওই অত্যাচারী লোকটা। ধরে বেঁধে বইয়ের গাদায় বসিয়ে দিয়েছে। এতো ঘোর অন্যায়ের প্রতিবাদও জানাতে পারেনি খুশি। অগত্যা বইয়ের সাথে কম্প্রোমাইজ করার চেষ্টা করছে।

বাংলার পাঁচের মতো মুখ বানিয়ে কলম দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে আর বিরক্তিকর নজরে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।প্রহর ওকে পড়তে দিয়ে ওয়াশরুমে গেছে ফ্রেশ হতে।কিন্তু খুশি পড়ার টেবিলে বোর হয়ে যাচ্ছে। খুশি ভেবে পায়না এই কালো কালো অক্ষর গুলো এতো বিরক্তিকর কেন? মনে হচ্ছে সব কয়টা রাক্ষসের মতো দাঁত বের করে ওকে খেয়ে ফেলার জন্য আক্রমণ করছে। কি একটা ভয়ংকর অবস্থা? এখন এদের হাত থেকে কে বাঁচাবে?

একটু পরে প্রহর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো। শাওয়ার নিয়েছে প্রহর। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু পরিপাটি করছে। শরীরে পারফিউম উড়াচ্ছে। খুশির এমনিতেই পড়ায় মন নেই। তারওপর প্রহরের আকর্ষণীয় মুভমেন্ট দেখে খুশির হায়হুতাশ শুরু হয়ে গেছে। টেবিলের ওপর গালে হাত ঠেকিয়ে লোলুভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রহরের দিকে। হায়য়,, ইয়ার কেউ এতো হট কেমনে হতে পারে? এতো হটনেস রুমে থাকলে শীতেও এসি চালানো লাগবে। এমন হট মাল সামনে থাকলে পড়ায় কিভাবে মন বসবে?

প্রহর এবার খুশির দিকে তাকালো। খুশিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলো।
–তোমাকে আমি পড়তে বলেছি। আমাকে চোখ দিয়ে গিলতে বলিনি। পরিক্ষায় ফেল করে আমার মান সম্মান ডুবাতে দিবোনা। তাই পড়ায় মন দাও।

খুশি অসহায় কন্ঠে বললো
–দিস ইস নট ফেয়ার হাহ্। একদিকে পড়তে বলছো। আবার চোখের সামনে এভাবে হট সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছ। এটা কেমন অবিচার? কে বলেছে এতো হট হতে? একটু ঠান্ডা হলে কি হতো? আমার তো ঘাম ছুটে যাচ্ছে।
খুশি বই দিয়ে নিজের গায়ে বাতাস করতে লাগলো।
প্রহর চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বললো।
–দেখ এসব ফালতু ড্রামা করে কোন লাভ হবে না। তাই চুপচাপ পড়ায় মন দাও। সামনে তোমার এক্সাম। তোমার এখন বেশি বেশি বইয়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া দরকার।

খুশি দায়সারাভাবে বললো।
–কেন? বই কি বাচ্চা দিবে নাকি যে এতো যত্নশীল হতে হবে? আজব! আরে বাচ্চা তো আমার হওয়া দরকার। কিন্তু তুমি সেটা হতে দিচ্ছ কই? একটা পণ নিয়ে বসে আছ। আগে আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হবে তারপর নাকি বাচ্চা। এটা কোন কথা? গ্রাজুয়েট না হলে কি বাচ্চা নেওয়া ইলিগ্যাল নাকি? যতসব আজব কৃত্তি তোমার কাছে আছে।

প্রহর একটু বিরক্তির সুরে বললো।
–খুশি আমার রাগ উঠিও না। তাড়াতাড়ি পড়া কমপ্লিট করো।

খুশি হঠাৎ তেতে উঠে বললো।
–কিহহ্ আমার কথায় তোমার রাগ হচ্ছে? এখন এতটা অসহ্যকর হয়ে গেছি আমি। লোকে ঠিকই বলে বিয়ের কিছুদিন পর বউকে আর ভালো লাগে না। তোমারও এখন আমাকে আর ভালো লাগে না তাইনা? বলো কোন পেত্নির সাথে অ্যাফেয়ার করছ? বলো? বলো?

খুশির এমন আজগুবি কথায় প্রহর এবার সত্যিই বিরক্ত হয়ে গেল। সে হালকা রাগী কন্ঠে বললো।
–এখন কিন্তু সত্যিই আমার রাগ উঠছে খুশি।

–হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো রাগ উঠবেই। তারপর কি মারবে আমাকে? মারো মারো। এটাও বাদ রাখবে কেন?

প্রহর এবার ধমকের সুরে বললো।
–খুশিইইই কি আবোল তাবোল বলছ এসব? ঝগড়াটে মহিলাদের মতো পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করছ কেন?

–কিহহ্? কি বললে তুমি আমি ঝগড়াটে মহিলা?
খুশিই হঠাৎ নেকি কান্না শুরু করে দিলো। কান্না করতে করতে বিলাপ করতে লাগলো।
–এ্যাঁ…….আমাকে আর ভালোবাসো না তুমি। পঁচা একটা।

প্রহর বেচারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এখানে কান্না করার মতো কি এমন অন্যায় অপরাধ করলো ও সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না ও। প্রহর খুশির কাছে এগিয়ে যেতে যেতে নরম সুরে বললো।
–আচ্ছা আচ্ছা ওকে সরি। কান্না বন্ধ করো।

কিন্তু নাহ্ প্রহরের কথায় খুশির কান্না বাড়লো বই কমলো না। সে চিৎকার করে মরা কান্না শুরু করে দিলো। প্রহর কাছে আসতে নিলে ছিটকে সরে গেল খুশি। উঠে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে সে। প্রহর যেন আরও থতমত খেয়ে গেল। খুশির হঠাৎ হলোটা কি কিছুই বুঝতে পারছে না সে। প্রহরও খুশির পিছে পিছে ছুটলো। খুশি কাদতে কাঁদতে এলো জিদান সাহেবের রুমে। খুশিকে কাঁদতে দেখে জিদান সাহেব ঘাবড়ে গিয়ে খুশির কাছে এসে বললো।
–কি হয়েছে খুশি মা? কাঁদছ কেন?

খুশি নাক টেনে টেনে ঠোঁট উল্টে বলতে লাগলো।
–এসবি আপনার ছেলে আমাকে বকেছে। অনেক বকেছে। আমাকে ঝগড়াটে মহিলাও বলেছে। ও অনেক পঁচা হয়ে গেছে।

জিদান সাহেব খুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–কিহহ্? ওর এতবড় সাহস? ওকে আজই আমি বাড়ি থেকে বের করে দিবো।

ততক্ষণে প্রহরও চলে আসলো ওখানে। খুশির কাছে যেতে নিলেই জিদান সাহেব সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে রাগী মুডে বললো।
–ওখানেই দাঁড়া। খবরদার আমার মেয়ের কাছে আসার চেষ্টা করবিনা। তোর সাহস কি করে হলো খুশি মাকে বকাঝকা করার? মনে হচ্ছে এই বয়সে তোর বাপের হাতে মার খাওয়ার শখ জেগেছে।

প্রহর বেচার তব্দা খেয়ে গেল। কোথাকার কথা কোথায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছে? মাথা ঘোলা হয়ে যাচ্ছে ওর। এবারে বেলি এগিয়ে এসে প্রহরের সাপোর্টে জিদান সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো।
–আরে কোন কিছু না জেনেই ছেলেটার উপর চড়াও হচ্ছ কেন? আর এই বাঁদর কে আমি ভালো করেই চিনি। নিশ্চয় ওই কিছু করেছে।

খুশি করুন সুরে বললো।
–দেখেছ এসবি? এই লোকটা আপনার বউ আর আমার ফুপিকেও ম্যানুপুলেট করে হাত করে নিয়েছে। এখন এরা এক সংগঠন গড়ে তুলে আমাদেরকে দমিয়ে রাখবে।

জিদান সাহেব সিনা টান করে দৃঢ় কন্ঠে বললো।
–মোটেও না। আমাদের দমানোর সাহস কারোর মাঝে নেই। শোন বেলি আমার খুশি মায়ের কোন দোষ নেই। আমি জানি সব দোষ এই হাঁদারাম টারই।

এবারে প্রহর বলে উঠলো।
–বাবা প্লিজ, এবার তুমি শুরু করোনা। আর আমাদের মাঝে তেমন কিছুই হয়নি। ও শুধু পড়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য এসব নাটক করছে আর কিছুই না।

বেলি বলে উঠলো।
–দেখেছ আমি বলেছিলাম না? এই বদমাইশটাই কিছু করেছে। ওর এই নাটক আমার চেনা আছে। পড়াশোনা দেখলেই ওর এসব ড্রামা শুরু হয়ে যায়।

খুশি এবার আরও মরা কান্না করতে করতে বললো।
–এ্যাঁ…কেউ নেই আমার। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। সবাই খালি বকে আমায়।

জিদান সাহেব বলে উঠলেন।
–কে বলেছে ভালোবাসে না। আমি বাসিতো। এই খবরদার! আমার খুশি মাকে কেউ কিছু বলবে না। নাহলে সবকয়টাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবো।

প্রহর এবার একটু নরম সুরে বললো।
–আচ্ছা ওকে অ্যাম সরি। আর বকবো না। এখন চলো প্লিজ।

খুশি অভিমানী সুরে বললো।
–না যাবোনা আমি তোমার সাথে। এসবি আজ আমি এখানেই থাকবো আপনাদের সাথে। ওর কাছে যাবোনা আমি।

জিদান সাহেব বললেন।
–আচ্ছা ঠিক আছে। খুশি মা যা বলবে তাই হবে। এই প্রহর তুই যা। ও আজ আমাদের সাথেই থাকবে।

প্রহর এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেল। খুশিকে ছাড়া ও থাকবে কিভাবে? ওকে বুকে না নিলে তো ওর ঘুমই হবে না। প্রহর করুন চোখে খুশির দিকে তাকিয়ে বললো।
–সরি বলছি তো, প্লিজ চলোনা। আই প্রমিজ আর বকবোনা।

নাহ্ তবুও খুশির মাঝে কোন হেলদোল হলোনা। সে অভিমানে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখলো। প্রহর খুশির কাছে এগিয়ে যেতে চাইলে জিদান সাহেব বাঁধা দিয়ে বললেন।
–খুশি বলেছে না ও যাবে না তোর সাথে? তুই ওকে ফোর্স করছিস কেন? যা এখান থেকে। রুমে গিয়ে একা একা থাক। এটাই তোর শাস্তি। যা এখন।
বেচারা প্রহরকে একপ্রকার ঠেলেই রুম থেকে বের করে দিলো জিদান সাহেব। প্রহর চেয়েও কিছু করতে পারলোনা।
__

খুশি শুয়ে আছে বেলির পাশে। আর জিদান সাহেব সামনের ডিভানে শুয়ে আছে। তখন অভিমান দেখিয়ে এখানে শুয়েতো পড়লো কিন্তু এখন আর ঘুম আসছে না ওর।প্রহরের বুকের উঞ্চতা ছাড়া ভালো লাগছে না। নাজানি ওর কি হয়ে গিয়েছিল তখন? আজকাল ওর কেন যেন হঠাৎ মুড সুইং হয়ে যায়। এই রাগ তো এই হাসি। কিন্তু এখন কি করবো? ভাব দেখিয়ে এখানে থেকে তো গেলাম। এখন নিজের থেকেই গেলে কেমন দেখাবে? ধুৎ ভাল্লাগে না।ঘুম আসছিল না দেখে বেলির ফোনটা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করছিল খুশি। হঠাৎ টুন করে ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। ম্যাসেজ ওপেন করে দেখলো প্রহরের ম্যাসেজ।
“” লক্ষি সোনা আমার প্লিজ চলে এসো। তোমাকে ছাড়া একটুও ভালো লাগছে না। প্লিজ আমার কিউটিপাই,সুইট, দুষ্টুপরি টা এসো না? প্লিজ প্লিজ প্লিজ “”
সাথে অনেক গুলো স্যাড ইমোজি দিয়েছে।

প্রহরের ম্যাসেজ দেখে খুশির আরও খারাপ লাগছে। আহারে আমার প্রহরটা নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছে। আমি না সত্যিই পঁচা। শুয়ে শুধু ওকে কষ্ট দেই। খুশির ভাবনার মাঝেই আরেকটা ম্যাসেজ এলো। এবার প্রহর নিজের একটা ছবি পাঠিয়েছে। যেখানে প্রহর এক হাতে কান ধরে আছে। আর নিচে সরি লিখা। এবারতো খুশির কান্নাই চলে এলো।চোখে পানি টলমল করছে। আর এক সেকেন্ডও থাকতে পারলোনা ও। আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে পা টিপে টিপে দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো খুশি। বাইরে এসে দেখলো প্রহর করিডরেই দাঁড়িয়ে আছে। খুশি আবেগপ্রবণ হয়ে দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়লো প্রহরের বুকে। প্রহরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো প্রিয়তমা স্ত্রীকে। খুশির কান্নার শব্দে প্রহর দুই হাতে খুশির মুখটা সামনে ধরে বললো।
–হেই সোনা এখনো কাঁদছ কেন? সরি তো রে বাবা।

খুশি নাক টেনে টেনে বললো।
–আমি খুব পঁচা বউ। তোমাকে শুধু জ্বালায় আমি।আমি একটুও ভালো না।

প্রহর মুচকি হেসে বললো।
–হ্যাঁ তো আমাকে আমার বউ জ্বালাবে না তো কি প্রতিবেশীর বউ জ্বালাবে? এখন কান্না বন্ধ করো প্লিজ? তুমি জানোনা আমাকে সবচেয়ে বেশি তোমার এই চোখের মূল্যবান মতিগুলো কষ্ট দেয়।

–জানি না কি হয়েছে আমার। হঠাৎ এমনি এমনি রাগ উঠে যায়। আবার এমনিতেই কান্না চলে আসে।

খুশির কথায় প্রহরেরও একটু চিন্তা হচ্ছে। তবে আপাতত সেটা খুশির সামনে জাহির করলোনা। কপালে চুমু দিয়ে খুশিকে কোলে নিয়ে রুমের ভেতরে এলো। বেডে এসে খুশিকে বুকে জড়িয়ে শুতে নিলেই হঠাৎ খুশির নাকে তীব্র একটা গন্ধ আসলো। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে সব উল্টে আসছে। খুশি প্রহরের থেকে ছিটকে সরে গিয়ে নাক চেপে ধরে বললো।
–সরো সরো আমার কাছ থেকে। কি বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে। কি মেখেছ তুমি?

প্রহর ভ্রু কুঁচকে নিজের টিশার্ট টা শুঁকে নিয়ে বললো।
–আরে গন্ধ কিসের আসবে? আমিতো কোন গন্ধ পাচ্ছি না। তোমার সামনেই তো শাওয়ার নিলাম। আর কি মাখবো? শোবার আগে রোজ যে বডি স্প্রে নেই সেটাই নিয়েছি জাস্ট।

খুশি উঠে বসে উকি আসার মতো করে বললো।
–না না আমি নিতে পারছিনা। বমি আসছে আমার। তুমি এখুনি আবার শাওয়ার নিয়ে এই স্প্রে ধুয়ে এসো। নাহলে আমি ঘুমাতে পারবোনা তোমার সাথে।

–কি বলছ?এতরাতে আবার শাওয়ার নিবো?

–ঠিক আছে নেওয়ার দরকার নেই। তুমি বরং গিয়ে ওই সোফায় শুয়ে থাকো যাও।

–এই না না। তারচেয়ে বরং আমি শাওয়ার নিয়েই আসছি।

অসহায় প্রহর খুশির অত্যাচারে এই রাতের বেলায় আবারও শাওয়ার নিলো। অতঃপর সে খুশির কাছে আসার সুযোগ পেল। খুশিও এবার অনায়াসে প্রহরের বুকে লুকালো। খুশিকে বুকে জড়িয়ে প্রহর চিন্তা করতে লাগলো। ওর খুশিটার কি হয়েছে? কেমন যেন আজব বিহেব করছে? আবার কোন সমস্যা হলো নাতো?
__

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে সবাই নাস্তা করছে। প্রহর খেয়াল করলো খুশি সব বাদ দিয়ে কখন থেকে শুধু নিউটেলা খেয়ে যাচ্ছে। বয়োমের ভেতর থেকে আঙুল দিয়ে নিউটেলা বের করে খাচ্ছে। প্রহর বলে উঠলো।
–খুশি তুমি শুধু নিউটেলা কেন খাচ্ছ? আরও অন্যকিছু খাও। শুধু নিউটেলা খেলে কি পেট ভরবে?

খুশির আবারও হঠাৎ রাগ উঠে গেল। সে হাতের নিউটেলার বয়োম টা ঠাস করে টেবিলের ওপর রেখে বললো।
–কেন? এখন কি আমি নিউটেলাও খেতে পারবোনা? ঠিক আছে যাও খাবোই না কিছু। তোমরাই খাও।

খুশি রাগ করে উঠলো যেতে লাগলো। প্রহর বেচারা থতমত খেয়ে গেল। ও রাগ করার মতো কি এমন বললো? এই খুশির হয়েছে টা কি? জিদান সাহেব প্রহর কে ধমক দিয়ে বললেন।
–এই তুই মেয়েটাকে খেতে দিচ্ছিস না কেন রে? ওর যা ভালো লাগে খাবে তাতে কি হয়েছে? খুশি মা তুমি বসো। তোমার যা মন চায় তাই খাও। একটা বয়োম শেষ হলে দরকার হলে আরেকটা নিয়ে খাও। কেউ কিছু বলবে না তোমাকে।

জিদান সাহেবের কথায় খুশি আবারও বসে নিউটেলা খেতে লাগলো মনের সুখে। একটা শেষ হওয়ার পর আরেকটা নিয়ে খেতে লাগলো। প্রহর আর কিছু বললোনা। কিজানি আবার কোন কথায় ম্যাডামের রাগ হয়ে যায়। তারচেয়ে বরং চুপচাপ থাকাই শ্রেয়।

আজ শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় প্রহর বাসায়ই আছে। ব্রেকফাস্ট শেষে খুশিকে অনেক অনুরোধ করে একটু পড়তে বসিয়েছে। যদিও তার কাছে না পড়ার জন্য তালবাহানার কমতি নেই। কখনো হাত ব্যাথা তো কখনো পা ব্যাথা। বাহনার শেষ নেই। খুশিকে পড়তে দিয়ে ল্যাপটপে বসে কিনা কাজ করছে প্রহর। তখনই খুশি বলে উঠলো।
–প্রহর আমার মাথা কেমন যেন ঘুরছে।

প্রহর ভাবলো খুশি বরাবরের মতো নাটক করছে। তাই সে খুশির কথায় পাত্তা না দিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো।
–খুশি এসব তালবাহানা করে কোন লাভ হবেনা। পড়া শেষ করতে হবে।

–প্রহর আমি ড্রামা কর…

খুশি কথা শেষ করতে পারলো না। হঠাৎ ধুপ করে কিছু পড়ার শব্দে চমকে তাকালো প্রহর। খুশিকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে আৎকে উঠলো সে। দ্রুত বেগে ছুটে এলো খুশির কাছে। দুই হাতে খুশির মাথাটা কোলে নিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–খু খুশি.. খুশি সোনা কি হয়েছে তোমার? চোখ খোল প্লিজ। অ্যাম সো সরি, আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় নাটক করছ। প্লিজ ওঠনা সোনা। বাবা…বাবা….
প্রহর জোরে জোরে ওর বাবাকে ডাকতে লাগলো। একটু পরেই জিদান সাহেব আর বেলি দৌড়ে এলো ওখানে। খুশিকে অজ্ঞান দেখে তারাও প্রচুর ঘাবড়ে গেল। জিদান সাহেব সময় নষ্ট না করে দ্রুত ডক্টর কে ফোন দিলো।

বর্তমানে ডক্টর খুশিকে চেকআপ করছে। প্রহর খুশির এক হাত মুঠোয় ধরে নিয়ে বসে আছে। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে প্রহরের। ওর খুশির আবার কোন কিছু হলো নাতো? সবকিছু তো ঠিকই চলছিল। আবার কোন বিপদ এলো? সবসময় আমার খুশির সাথেই কেন এমন হয়? ওর সব কষ্ট আমার কেন হয়না?

ডক্টর চেকআপ শেষে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো।
–হুমম যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হয়েছে।

প্রহর হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। সে কম্পিতো গলায় বললো।
–মা মানে? কি হয়েছে আমার খুশির? আঙ্কেল প্লিজ বলুনা না? আমার খুশির বড় কোন সমস্যা হয়নিতো?

জিদান সাহেব বললেন।
–হ্যাঁরে মনির বলনা কি হলো মেয়েটার?

ডক্টর বলে উঠলো।
–হয়েছে তো অনেক বড়ো কিছুই।

–মানে কি হয়েছে ঠিক করে বল।

–আরে সালা মিষ্টি খাওয়া তুই দাদা হতে চলেছিস। সি ইজ প্রেগন্যান্ট।

ডক্টরের কথায় জিদান সাহেব আর বেলি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। আর প্রহর তো কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আপাতত কোন ইন্দ্রিয় সারা দিচ্ছে না ওকে। এতক্ষণে খুশিরও জ্ঞান ফিরে এলো। জিদান সাহেব আর বেলি খুশির মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া আশীর্বাদ করে দিয়ে ডক্টরের সাথে বাইরে চলে গেল। খুশি প্রহরের দিকে তাকালো। প্রহর এখনো কেমন মূর্তির মতো বসে আছে। খুশি প্রহরের গালে হাত দিয়ে প্রহরকে ডাকলো। এতক্ষণে বেচারার স্তম্ভুতি ফিরে এলো। খুশি ভীতু স্বরে বললো।
–তুমি খুশি হওনি?

প্রহর টলমল চোখে তাকিয়ে বললো।
–খুশি? শুধু কি খুশি বললে আমার অনুভূতি টা জাস্টিফাই হবে? মানুষ যেমন অতি দুঃখে পাথর হয়ে যায়। তেমনি আমি আজ অতি খুশিতে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। আমি জানি না কিভাবে নিজের অভিব্যক্তি বয়ান করবো। খুশি আজ তুমি আমাকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো আনন্দ দিয়েছ। এই অনাবিল আনন্দ যে ভাষায় প্রকাশ করার নয়।

খুশির ঠোঁটে হাসির রেখা ভেসে উঠলো। প্রহর খুশির কপালে চুমু দিয়ে মায়া ভরা কন্ঠে বললো।
–ভালোবাসি খুশি। অন্তহীন চাই তোমায়। তুমি আজ আমাকে পরিপূর্ণ করেছ। তোমার পদচারণায় রাঙিয়ে দিয়েছ আমার অন্তঃকরণ।

খুশি আবেশে লুকালো প্রহরের বুকে। ওদের প্রেমকাব্যে নতুন অধ্যায় যোগ হলো। পরিপূর্ণতা পেল ওদের ভালোবাসা।

ভালো থাকুক সব ভালোবাসা
_____________💖সমাপ্ত💖____________

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here