অন্তঃকরণে তোরই পদচারণ পর্ব -৩৩+৩৪

#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৩৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★সকাল বেলার শিরশিরানি বাতাসের শীতলতা ছুয়ে দিলো খুশির মুখমণ্ডল। আস্তে করে আঁখি যুগল মেলে তাকালো সে। প্রহরকে বিছানায় দেখতে পেল না। ভাবলো হয়তো উঠে গেছে। কালকের ওই ঘটনার পর খুশি প্রচুর ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সারারাত প্রহরের বুকের মাঝে লুকিয়ে ছিলো। একটুর জন্যেও প্রহরকে কোথাও যেতে দেয়নি ও। খুশি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। তখনই প্রহর হাতে ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকলো। প্রফুল্লতার সহিত বলতে লাগলো।
–আমার খুশিরাণীর ঘুম ভেঙেছে বুঝি? এই দেখ তোমার ডিয়ার হাসব্যান্ড তার বউয়ের খিদমতে হাজির হয়ে গেছে। পেশ হে তোমার জন্য ফ্রেশ ফ্রেশ ব্রেকফাস্ট।

ট্রেটা বেডের ওপর রেখে খুশির সামনে এসে বসলো প্রহর। কপালে চুমু একে দিয়ে বললো।
–চলো তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নাও। তারপর আমরা বের হবো কেমন?

খুশির খুব খারাপ নিজের কাছে। প্রহর ওকে এখানে এনেছে কিছু সুন্দর সময় কাটানোর জন্য। আর আমি কিনা সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এভাবে ওকে টেনশনে ফেলে দিয়েছি। না না এটা একদম ঠিক না। আমি প্রহরকে আর কোন টেনশন দিবোনা। কথাগুলো ভেবে খুশি হাসিমুখে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে বললো।
–গুড মর্নিং মাই হ্যান্ডসাম হাবি। ভাবছি আজ বাইরে না গেলে কেমন হয়? তুমি আমি আর এই হানিমুন সুইট। ব্যাপার টা কেমন হবে?

প্রহর খুশির কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো।
–আই থিংক ইটস আ গ্রেট আইডিয়া। উই শুড গো ফর ইট।

খুশি প্রহরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে হাসলো। সাথে হাসলো প্রহরও। তারপর বললো।
–বাচ একটাই সমস্যা। ফাহিমদের কি বলবো? এখন সবারতো আর তোমার মতো এতো ইনটেলিজেন্ট বউ নেই। ওদের মাথায় তো আর এই গ্রেট আইডিয়া টা নাও আসতে পারে।

–হুম তাও ঠিক। সবাই তো আর খুশি না। ঠিক আছে তাহলে ওদের মন রাখতে বাইরে যাবো। কি আর করার?

প্রহর হেঁসে দিয়ে খুশিকে কাতুকুতু দিতে দিতে বললো।
–তাই না??
খুশি খিলখিল করে হাসছে আর মোচড়ামুচড়ি করছে।
__

আজ ওর প্রথমে “গ্রান্ড বে” বিচে এলো। মরিশাস দ্বিপের চারপাশে শুধুই সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যে ভরপুর। যতদূর চোখ যায় শুধুই নীল রুপে রুপান্বিত। এই অসীম সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা হয়তো অসম্ভব। “গ্রান্ড বে” বিচও তেমনি আরেকটি অপরুপ প্রকৃতির নিদর্শন। মরিশাসের উওরে অবস্থিত মরিশাসের অন্যতম সৈকত হিসেবে পরিচিত। প্রহররা কিছুক্ষণ পূর্বেই এসে পৌঁছেছে এখানে। সৈকতের সৌন্দর্যে মোহিত হচ্ছে সবাই। নীল স্বচ্ছ পানির মাঝে পা ডুবালো খুশি। সুইমিং পুলের পানির চেয়েও স্বচ্ছ সুন্দর পানি। পানির নিচের সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। এ যেন এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। পাশেই প্রহর খুশির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আর খুশিকে সে এক মুহূর্তের জন্যেও একা ছাড়বে না। গতকালের ভুলের পুনরাবৃত্তি কোনমতেই করবে না সে।

পানিতে কিছুক্ষণ ঘোরার পর। ওরা এখানেও সি বোটে উঠলো। বোটে চড়ে গভীর নীল লেগুন প্রদক্ষিণ করছে। বোটে ঘুরতে ঘুরতে ওরা পোর্ট লুইস আর পর্বতমালারও প্রদক্ষিণ করলো। ঘোরা শেষে ওরা সমুদ্র কিনারে সারি করা ছোন পাতার গোল গোল ছাউনির নিচে এলো। ওখানে টেবিল চেয়ার রাখা আছে। ওর এসে চেয়াগুলোতে বসলো। ওখানেই হালকা কিছু খাওয়া দাওয়া করে নিলো। খাওয়া দাওয়া শেষে একটু রেস্ট নিয়ে আবার বেড়িয়ে পড়লো ”

ওদের সাথে সাথে চলছে সেই অজানা ব্যক্তি। ওদের সব গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর তার। সঠিক সুযোগের অপেক্ষা করছে সে।

প্রহররা এবার এলো “গ্রান্ড বের আরেকটি অপরুপ সৈকত “লা কুভেটে। এটিও অসীম সৌন্দর্য বহনকৃত এক রূপবতী সৈকত। সমুদ্রের তীরে এবং পানির মাঝে জমা আছে হাজারো পাথরের মেলা। খুশি প্রহরের আর তিশা ফাহিমের হাত ধরে পানির মাঝে সেই পাথরের উপর এসে দাঁড়াল। পাথর গুলো অনেক পিচ্ছিল হয়ে আছে। স্বচ্ছ জলরাশির মাঝে পাথর আর শৈবাল গুলো দেখতে অপূর্ব লাগছে। পানির উত্তাল ঢেউ এসে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে। এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি হচ্ছে ওদের।

সারাদিন আরও কিছু দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে বেড়ালো ওরা। তারপর সন্ধ্যার একটু আগে “পিরেবেরে” বিচের “পয়েন ডি আজুরে এলো সূর্যাস্ত দেখতে। সীমাহীন নীল সুস্পষ্ট জলরাশি আর পাথরে ঘেরা আরেকটি প্রকৃতির অপরুপ নিদর্শন হলো এই স্থানটি। অপরিসীম সৌন্দর্যে সমন্বিত এই জায়গার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিলো সূর্যাস্তের রক্তিম আভা। চারিদিকে কমলা আলোর ঝলকানি দিয়ে বিশাল থালার মতো সূর্য টা ঢলে পড়ছে সমুদ্রের গহ্বরে। প্রহর এসে পেছন থেকে খুশিকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। দুজন সাক্ষী হলো এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তের। ফাহিমও পিছিয়ে রইলোনা। প্রহরের দেখাদেখি সেও তিশাকে জড়িয়ে ধরলো। সূর্যাস্ত শেষে ওরা আবারও রিসোর্টে ফিরে এলো। সাথেই ফিরলো সেই অজানা ব্যক্তি। আজ সারাদিন কোন সুযোগ পায়নি নিজের কার্য প্রতিফলন করার। প্রহর এক সেকেন্ডের জন্যেও খুশিকে হাত ছাড়া করেনি। তবে সেও এতো সহজে ছাড়বে না। ওদের এই সুখ দুঃখে পরিনত করেই ছাড়বে।

ডিনার শেষ করে প্রহর আর ফাহিমরা নিজেদের রুমে এলো। ফাহিম রুমে আসতেই দরজা আটকে দিয়ে তিশার হাত টেনে ধরলো। তিশা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি হয়েছে? টেনে ধরলে কেন?

ফাহিম দুষ্টু হেসে বললো।
–কারণ আজ খেলা হবে।

তিশা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–খেলা? কি খেলা?

–ফুটবল, বলিবল,সব ধরনের খেলাই চলবে। এখানে আসার পর থেকে আমরা একবারও রোমান্টিক কোন কিছু করতেই পারিনি। রোজ তুমি ঘুরে ঘুরে এসে টায়ার্ড হয়ে শুয়ে পড়ো। আরে খুশি ভাবির কাছ থেকে কিছু শেখ। ওরা কতো রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার করে।ওদের রোমাঞ্চের চিহ্ন গুলো প্রহরের শরীরে বিদ্যমান দেখা যায়। আর এক তুমি। হানিমুনে এসেও ঘুমাও। এটা কোন কথা? তাই আজ নো ঘুমানো। ওনলি রোমাঞ্চ এন্ড রোমাঞ্চ। আমিও আমার শরীরে এমন চিহ্ন চাই। দেখ আমি তোমার জন্য কিছু এনেছি।

ফাহিম লাগেজের ভেতর থেকে একটা প্যাকেট বের করে এনে তিশার হাতে দিয়ে বললো।
–এটা তোমার জন্য। প্লিজ এটা পড়ে এসোনা?

তিশা প্যাকেট খুলে দেখলো একটা লাল রঙের শিফন জর্জেটের নাইটি। তিশা চোখ মুখ নাইটিটা বেডের সাথে ছিটকে ফেলে দিয়ে বললো।
–ছিহ্হ,, এটা কি? এসব আমি পড়বো? কিছুতেই না।

ফাহিম অনুনয়ের সুরে বললো।
–আরে ছিহ এর কি হলো? এটাতো সবাই পড়ে। প্লিজ একবার শুধু আমার জন্য পড়োনা? প্লিজ প্লিজ প্লিজ..

ফাহিমের জোরাজুরিতে তিশাও আর মানা করতে পারলোনা। ওর মন রাখতে তিশা নাইটি টা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফাহিম এদিকে এক্সাইটেড হয়ে লাফাতে লাগলো। আজতো খেলা জমবে খুব। তিশা আসতে আসতে ফাহিম এক্সাইটমেন্টে নিজের প্রায় অর্ধেক জামাকাপড় খুলে ফেললো। বিছানার উপর ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে দিলো। তারপর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো তিশার। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে ফাহিম অতি উৎসাহ নিয়ে সেদিকে তাকালো। তবে তিশাকে দেখে ওর সব উৎসাহ ফাটা বেলুনের মতো ফুসস হয়ে গেল। তিশা কামিজের ওপর দিয়েই নাইটি টা পরিধান করেছে। তিশার আউট অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড ড্রেসিং সেন্স দেখে ফাহিম বেচারা হতবিহ্বল হয়ে গেল।তিশা মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে বললো।
–সরি আসলে আমার খুব লজ্জা করছিল। তাই এভাবেই পড়েছি।

ফাহিম নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে বললো।
–আচ্ছা থাক বাদ দাও। তুমি আছ আমি আছি আর কি চাই। লেটস ডু সাম এ্যাকশন বেবি।
ফাহিম ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো তিশার কাছে। মাথা ঝুকিয়ে তিশার ঠোঁটের দিকে এগুলো সে। তিশার ঠোঁট প্রায় ছুঁইছুঁই তখনই ফাহিমের রোমাঞ্চে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে তিশার ফোনটা তীব্র আওয়াজে বেজে উঠলো। তিশা দ্রুত ওখান থেকে সরে গিয়ে ফোনটা ধরলো। ফাহিম বেচারা চুমু খেতেই যাচ্ছিলো সেই মুহূর্তে তিশা সরে যাওয়ায় ফাহিম পড়ে যেতে যেতে কোনরকমে নিজেকে বাঁচালো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো তিশা ফোনে কথা বলছে। তিশার মা ফোন করেছে। এই কনভোকেশন যে কতো ঘন্টা চলবে তার ঠিকানা নেই। ফাহিমের এখন হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কারোর শাশুড়ী যে মেয়ের জামায়ের রোমাঞ্চের দুশমন হতে পারে তা তিশার মাকে না দেখলে জানতোই না। যখনই একটু দুজন রোমাঞ্চ করতে নেয় ঠিক তখনই ওনার ফোন আসা লাগে। আর তিশাও তখন দুনিয়া দাড়ি ভুলে ঘন্টার ঘন্টা আলাপ শুরু করে দেয়। কিন্তু আজ আর তা হতে দিবেনা।

ফাহিম এগিয়ে গেল তিশার কাছে। চোখের ইশারায় ফোন রাখতে বললো। তিশাও আঙুল দেখিয়ে বুঝালো একটুখানি। কিন্তু এই একটুখানি সময় আর শেষ হচ্ছে না। ফাহিম এবার তিশাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তিশার ফোনালাপের মাঝেই ওর সাথে দুষ্টুমি শুরু করে দিলো। তিশা বারবার চোখ গরম করে দেখাচ্ছে। কিন্তু কিছুই মানছে না ফাহিম। অনেকক্ষণ পর শেষমেশ তিশা ফোনালাপ শেষ করলো। ফাহিম ভাবলো এবার নিশ্চয় রোমাঞ্চ জমবে। ফাহিম আবারও তিশার অধরপানে এগুলো। তখনই হঠাৎ তিশা বলে উঠলো।
–আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি প্লিজ।

ফাহিম বেচারা আবারও হতাশ হলো।তবে আশা ছাড়লোনা।তিশার ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার অপেক্ষা করছে সে। তিশা ফিরে আসলেই ফাহিম ওর রোমাঞ্চ আবারও রিজুম করবে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তিশা বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। ফাহিম টেবিলের ওপর থাকা ফুলদানি থেকে একটা লাল গোলাপ তুলে নিল। ফুলের ডাটিটা দাঁতের দুই পাটির মাঝে কামড় দিয়ে ধরে রোমান্টিক মুডে এগুলো তিশার দিকে। তিশার কাছে এসে এক হাতে তিশার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। দাতের মাঝে থাকা ফুলটা এবার বের করে তিশার কপাল থেকে গাল পর্যন্ত ফুল দিয়ে স্লাইড করলো।অতঃপর আবারও নিজের মিশনে অগ্রসর হলো। তবে এবারও ওর মিশন নাকামিয়াব করে দিয়ে তিশা বলে উঠলো।
–আমার পিরিয়ড শুরু হয়ে গেছে। সরি..

বেচারা ফাহিম এতবড় পরাজয় মেনে নিতে পারলোনা।ঠাস করে জ্ঞান হারিয়ে ঠুস করে পড়ে গেল।
___

রাতের আকাশে তাঁরারা ঝলমল করছে। জানালা ভেদ করে আসছে ভরা জোছনার রুপালী আলো। ঘড়ির কাঁটা গিয়ে ঠেকেছে রাত দশটায়। প্রহর বসে ফোনে কিছু ইমেইল চেক করছে। খুশি ওয়াশরুমে ঢুকেছে অনেকক্ষণ হলো।এখনো বের হওয়ার নাম নেই। কি করছে কে জানে? পাগলিটার মাথায় কখন কি চলে তা জানা মুশকিল। তবে ওর এই পাগলামু গুলোই প্রহরকে আনন্দঘন মুহূর্ত এনে দেয়। খুশির হাসিখুশি প্রাণচঞ্চলতাই প্রহরের সুখী জীবনের মূলমন্ত্র।

খট করে দরজা খোলার শব্দে ফোন থেকে মাথা তুলে সামনে তাকালো প্রহর। তাকাতেই চোখের নজর সহ সব ইন্দ্রিয় গুলো আবদ্ধ হয়ে গেল সামনের মহীয়সী রমনীতে।ওর সামনে পিংক নাইট ড্রেস পরিধানরত খুশি নামক এই আবেদনময়ী নারীর মায়াজালে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে ফেলছে প্রহর। নাইট ড্রেস টার ঝুল হাটুর উপর পর্যন্ত। প্রহর ভেবে পায়না একটা নারীই আর কতবার ঘায়েল করবে ওকে। ওতো কবেই এই নারীতে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে।

খুশি মায়াবী হাসির রেখা টেনে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো প্রহরের কাছে। প্রহরও মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলো খুশির দিকে। খুশির কাছে এসে ওর সাথে আলিঙ্গন করতে নিলেই খুশি আবেদনময়ী হাসি দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে প্রহরকে পেছনের সোফায় ফেলে দিলো। হেঁসে উঠলো প্রহর। খুশি প্রহরের মুখোমুখি হয়ে ওর কোলে বসলো। হাতের দুই আঙুল দিয়ে বন্দুকের মতো বানিয়ে প্রহরের থুতনির নিচে ঠেকিয়ে বলে উঠলো।
–দ্যা খুশি তোমাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।পালানোর পথ খোলা নেই। বাঁচতে চাইলে আত্মসমর্পণ করো। নিজেকে আমারে কাছে সঁপে দাও। নাহলে চুমু চালাতে বাদ্ধ হবো।

প্রহর হাসলো কিছুক্ষণ। তারপর খুশির কোমড়ে রাখা হাতের বাঁধন আরও মজবুত করে বললো।
–আমি আত্মসমর্পণ করবোনা। আপনি আপনার হুমকি কার্যকর করুন।

খুশি তার হুমকি কার্যকর করা আরম্ভ করলো। প্রহরের শার্টের বোতাম খুলে প্রহরের গলা আর বুকে শুরু করলো চুমুর তীর চালানো। প্রহর ভাসছে অনাবিল সুখের সাগরে। খুশির অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছে ও। আর পারছে না। এবার সেও পাল্টা আক্রমণ করবে। প্রহর আকড়ে ধরলো খুশির অধরযুগল। ওভাবে খুশিকে কোলে নিয়েই এগুলো বিছানার দিকে।
___

পরম শান্তি সুখের আবেশে প্রহরের বুকে মিশে ঘুমিয়ে আছে খুশি। দুজনের মুখমন্ডলে ভাসছে অসীম সুখের প্রচ্ছায়া। যেন এদের চেয়ে সুখী দুনিয়াতে আর কেই নেই। আর ওদের এই সুখ কারো চোখে বিষাক্ত কাটা হয়ে বিঁধছে। ওদের এই সুখ সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। কেড়ে নিবে ওদের সব সুখ। কিছুতেই ওদের কে সুখে থাকতে দিবেনা।

সকালের মিষ্টি রোদ রুমে ঢুকে ঘরময় আলো ছড়িয়ে দিলো। ঘুমের লেশ কেটে মুচকি হাসির রেখা ঠোঁটে এনে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো খুশি। তবে চোখ খুলে যে এমন কিছু দেখতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি খুশি। বিছানায় প্রহরের জায়গায় রক্তে রঞ্জিত প্রহরের শার্ট পড়ে থাকতে দেখে খুশির অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। ঠাস করে উঠে বসলো ও। শার্টের ওপর রক্ত মাখা ছুরি দেখে চোখের সামনে পৃথিবী ঘুরে উঠলো ওর। হঠাৎ কেমন বোধশক্তিহীন হয়ে পড়লো খুশি। হাত পা থরথর করে কাঁপছে। ও নিশ্চয় কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছে। এটা সত্যি হতে পারে না। কিছুতেই না। প পপ্রহর?? প্রহর কোথায়? আ আমার প্রহর কোথায়?? ভয়ে নিঃশ্বাস আটকে আসছে খুশির। খুশি অনেক কষ্টে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে প্রহরকে ডাকলো।
–প্রহররররররর…..

প্রহর ওয়াশরুমে শাওয়ার নিয়ে মাত্রই তোয়ালে পড়ছিল। তখনই হঠাৎ খুশির চিৎকার শুনে ঘাবড়ে গেল প্রহর। তড়িঘড়ি করে তোয়ালেটা পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো প্রহর। এসে দেখলো খুশি আবারও সেদিনের মতো ভয়ে চোখ বুজে চিৎকার করে যাচ্ছে। প্রহর দৌড়ে এলো খুশির কাছে। দুই হাতে খুশির মুখটা ধরে বললো।
–এই খুশি কি হয়েছে তোমার? এই দেখ আমি এখানে।

খুশি চোখ খুলে তাকালো। প্রহরকে দেখে ওর জানে পানি এলো। প্রহরকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো খুশি। প্রহর আরও ঘাবড়ে গেল। কি হলো ওর খুশিরাণীটার? সবতো ঠিকই ছিল। খুশি প্রহরের সারা মুখে পাগলের মতো চুমু খেয়ে অস্থির হয়ে বললো।
–তু তুমি ঠিক আছ? তোমার কিছু হয়নিতো?

–আমার কি হবে? আমি একদম ঠিক আছি? এই দেখ। কিন্তু তোমার কি হয়েছে? আর এভাবে কেন বলছ?

খুশি বিছানার দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলতে লাগলো।
–ও ও ওখানে…

বিছানার দিকে তাকাতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল খুশির। কারণ বিছানা একদম পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। একটু আগের কোনকিছুই নেই এখানে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি হয়েছে খুশি? ওখানে কি?

–প্রহর এখানে এইমাত্র তোমার রক্ত মাখা শার্ট আর চাকু দেখেছি আমি। ঘুম থেকে উঠেই ওসব দেখলাম আমি। আ আমি ভেবেছি তোমার হয়তো কিছু…

–কিন্তু এখানে তো কিছুই নেই। আমার মনে হয় তুমি কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেছ। ওটাকে সত্যি ভেবে ভয় পেয়ে গেছ।

খুশি কিছুই বুঝতে পারছে না। ওতো সত্যিই দেখেছিল। তাহলে সব গায়েব হয়ে গেল কিভাবে? নাকি প্রহর ঠিক বলছে? আমি কি কোন স্বপ্ন দেখেছিলাম? খুশি প্রহরকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–তুমি আমাকো ছেড়ে আর কোথাও যেওনা প্লিজ। আমার অনেক ভয় করছে।

প্রহর খুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–আমি এখানেই আছি আমার খুশিরাণীর কাছে। কোথাও যাবোনা। ভয়ের কিছু নেই।

খুশিকে শান্তনা দিলেও প্রহরের ভেতর ভেতর অনেক চিন্তা হচ্ছে। ওর খুশির হঠাৎ কি হয়ে গেল? এমন অদ্ভুত কথা বলছে কেন? ওর অপারেশনের কারণে মাথায় কোন সাইড ইফেক্ট হলো নাতো?

ওদের কে এভাবে অশান্তিতে দেখে অজানা ব্যক্তির মনে পরম শান্তি হচ্ছে। পরবর্তীতে সে এমন কিছু করবে যাতে এদের সুখ চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে।
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৩৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★মরিশাসে আজ ওদের তৃতীয় দিন। আজ ওরা যাবে মরিশাসের আরও অন্যতম সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সেটা হলো “সোলার সিয়া ওয়াক” (পানির নিচে হাঁটা)। এটা এখানকার সবচেয়ে উপভোগ্য বৈচিত্র্যময় দৃশ্য। পানির নিচের জগৎ কে স্ব শরীরে এবং স্ব চোক্ষে সামনাসামনি দেখা যায়। এটা এক অকল্পনীয় অনুভূতিকে। আজ ওরাও সেই অনুভূতি অর্জন করতে এসেছে। প্রথমে প্রহররা জাহাজের ঘাটে আসে। এখান থেকে স্পেশাল শিপ এসে ওদের নিয়ে যাবে। সেই শিপের কর্মকর্তা রাই এইসবের সব ব্যাবস্থা করে রাখে। এবং যথা সময়ে শিপ চলে আসে। প্রহররা সহ ওখানকার আরও কিছু পর্যটক যাচ্ছে এই “সোলার সিয়া ওয়াক” এর মজা লুফে নিতে। তবে এদের মাঝে যে সেই অজানা ব্যক্তিও আছে। সেটার নূন্যতম খবর নেই প্রহরদের। ওরা ওদের মতো শিপে চড়ে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যাস্ত।

শিপ কিছুদূর চলার পর সমুদ্রের পানির মাঝে এসে থেমে গেল। তবে পানির গভীরতা খুব একটা বেশি না। সবার মাথায় অক্সিজেন হেলমেট পরিয়ে দিলো।কাচের হেলমেট গুলো অনেক বড়ো আকারের। এর ভেতর আরামে মাথা ঘোরানো যাবে। হেলমেটের সাথে থাকা অক্সিজেনের পাইপ গুলো অনেক লম্বা। যার একমাথা শিপে থাকবে,আরেক মাথা হেলমেটের সাথে থাকবে। যাতে পানিতে কোন সমস্যা হলে তারা উপরের মানুষদের অবগত করতে পারে। সব অ্যারেঞ্জমেন্ট শেষে এবার পানিতে নামার পালা। খুশির প্রচুর এক্সাইটমেন্ট হচ্ছে। প্রহর খুশির হাত শক্ত করে ধরে আছে। তিশার একটু ভয় ভয় লাগছে। তাই সে ফাহিমের হাত শক্ত করে ধরে আছে। অতঃপর সেই মুহূর্ত চলে এলো। শিপের কর্মকর্তা রা সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে প্রহর-খুশি,ফাহি-তিশা সহ আরও তিন-চারজন কে পানিতে নামিয়ে দিলো।

প্রহর খুশির হাত ধরে ডাইভ করে পানির একেবারে তলদেশে গেল। পানির নিচে মাটির সংস্পর্শে আসলে ওরা পানির ভেতর দাঁড়িয়ে গেল। তারপর শুরু হলো পানির নিচের অপরুপ দৃশ্য প্রদর্শন। স্বচ্ছ সুস্পষ্ট পানির নিচে নানান রকম শৈবাল আর বাহারি মাছের খেলা চলছে। মাছের দলগুলো ওদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা হেঁটে হেঁটে হাত বাড়িয়ে সেগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। শিহরিত হয়ে যাচ্ছে খুশি। এ যেন এক অবিস্মরণীয় অভূতপূর্ব অনুভূতি। এ মনোভাব ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। জেব্রার গায়ের রঙের মতো সাদাকালো ডোরাকাটা রঙের মাছের বড়ো একটা দল এসে ওদের চারিদিকে ঘুরতে লাগলো। খুশি প্রহরের হাত ছেড়ে দিয়ে মহা আনন্দে সেই মাছগুলোর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো। প্রহরও ওর সাথে সাথেই যাচ্ছে। হঠাৎ প্রহরের পায়ের সাথে কিছু সামুদ্রিক গাছের ডগা বেজে ধরলো। প্রহর নিচে ঝুঁকে সেগুলো ছাড়াতে লাগলো। ওদিকে খুশি নিজের মতো মাছগুলোর সাথে সাথে চলছে। চলতে চলতে একটা বড়ো পাথরের কাছে চলে এলো।

হঠাৎ পাথরের পেছন থেকে কেউ খুশির পা টেনে ধরল। ভয়ে আৎকে উঠলো খুশি। হাত পা দাপিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পারছেনা। দু চোখ খুঁজছে প্রহরকে। কিন্তু প্রহরের কাছে যেতে পারলোনা ও। সেই অজানা ব্যক্তি খুশির পা টেনে ধরে পাথরের ওইপাশে নিয়ে গেল। সেই কালো হুডি আর ভয়ংকর মাস্ক পড়া আগুন্তক কে দেখে খুশির ভয়ে আবারও অন্তর কেঁপে উঠল। এই লোকটা এখানেও চলে এসেছে? এখন কি করবে খুশি? খুশির ভয়ের মাত্রা আরও শতগুণ বেড়ে গেল সেই ব্যাক্তির হাতে ধারালো ছুরি দেখে। যা সে খুশির ওপর এইমুহূর্তে তাক করে আছে। তবে কি এখানেই ওর জীবনের ইতি ঘটবে?

পায়ের বেড়াজাল ছাড়িয়ে নিয়ে আবারও উঠে দাঁড়াল প্রহর। কিন্তু সামনে খুশিকে না দেখে ভয় পেয়ে গেল সে? খুশি কোনদিকে গেল? এখুনি তো সামনেই ছিল। প্রহর অস্থির হয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো খুশিকে। তখনই খুশির অক্সিজেন পাইপটা দেখতে পেল। যেটা পাথরের পেছনে যেতে দেখা যাচ্ছে। প্রহর দ্রুত সেদিকে গেল। পাথরের পেছনে গিয়ে দেখলো খুশি গত দুবারের মতো আবারও একই ভাবে চোখ বুজে ভয়ে কাঁপছে। প্রহর দ্রুত গিয়ে দুই হাতে খুশির ধরে আলতো ঝাকালো। খুশি চোখ মেলে তাকিয়ে প্রহরকে দেখে আবারও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। খুশির এমন অবস্থা দেখে প্রহর দ্রুত ওকে নিয়ে পানির ওপরে উঠে এলো। শিপে উঠে আসলে দুজনের হেলমেট খুলে দিলো ওরা। হেলমেট খুলতেই খুশি প্রহরকে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠলো। প্রহর ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–কি হয়েছে সোনা? আমাকে বলো।

খুশি ফোপাঁতে ফোঁপাতে আতঙ্কিত কন্ঠে বললো।
–ও ও আবার এসেছে প্রহর।এখানে পানির মাঝে চলে এসেছিল ওই ভয়ংকর লোকটা। আমাকে মারতে চেয়েছিল।

–কে এসেছিল? আমিতো ওখানে কাউকেই দেখলাম না। তুমি হয়তো পানির নিচের কোন জীব দেখে ভয় পেয়ে গেছ।

–না না আমি ঠিক দেখেছি। ও ওই ভয়ংকর লোকটাই ছিল। আ আমি অন্য কিছু দেখিনি। সত্যি বলছি আমি।

প্রহর আপাতত খুশিকে করার জন্য বললো।
–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। এখন শান্ত হও প্লিজ। চলো আমরা রিসোর্টে ফিরে যাই।

প্রহরের কথায় খুশি কিছুটা শান্ত হলো।কিন্তু প্রহরের মনের অশান্তি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমার খুশিরাণীর সাথে কি হচ্ছে এসব? সত্যিই যদি এমন কেউ থেকে থাকে তাহলে আমি কেন তাকে দেখতে পাচ্ছি না? নাকি এইসব খুশির মস্তিষ্কের ভ্রম? ওর মস্তিষ্ক কি এসব ইমাজিন করছে? তবে কি আমার খুশির মস্তিষ্কে টিউমারের কোন সাইড ইফেক্ট হয়েছে? এসব নানান দুশ্চিন্তা প্রহরকে আতঙ্কে ফেলে দিচ্ছে। এতো সাধনার পর ও খুশিকে ফিরে পেয়েছে। এখন আবার কিছু হলে সইতে পারবে না ও।

আর ওদের কে এভাবে আতঙ্কে দেখে সেই অজানা ব্যক্তি পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। এভাবে ওদের সব সুখ ধ্বংস করে দিবে সে।
__

খুশিকে নিয়ে রিসোর্টে ফিরে এলো প্রহর। ওর ওই অবস্থায় আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে হলোনা। তাই সবাই আবার রিসোর্টে ফিরে এলো। খুশিকে নিয়ে রুমে এলো প্রহর। খুশি ভয়ে প্রহরের শার্ট খামচে ধরে বুকে লুকিয়ে আছে। প্রহর খুশিকে নিয়ে এসে বেডে বসিয়ে দিয়ে বললো।
–তুমি বসো আমি তোমার জন্য খাবার কিছু নিয়ে আসছি।

খুশি প্রহরের শার্ট আরও জোরে খামচে ধরে উত্তেজিত হয়ে বললো।
–না না তুমি কোথাও যাবে না। তুমি আমার কাছেই থাকো। আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ। ও আবারও চলে আসবে।

প্রহর খুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–আচ্ছা আচ্ছা আমি যাচ্ছি না কোথাও। এখানেই আছি আমার খুশিরাণীর কাছে।

খুশি করুন সুরে বললো।
–প্রহর ও কি চায় আমাদের কাছ থেকে? কেন করছে আমাদের সাথে এমন?

প্রহর খুশির উত্তর কি দিবে? সেতো জানেও না আদৌও খুশির কথা সত্যি নাকি ওর ইমাজিনেশন। প্রহর খুশির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নরম সুরে বললো।
–আচ্ছা খুশি তোমার মাথার ভেতর কি কখনো খারাপ লাগে? যেমন মাথাব্যথা বা মাথা ঘুরানো? কিম্বা অন্য কোন রকম কিছু মনে হয় তোমার? এমন কিছু হলে আমাদের দ্রুত ডক্টর কে জানানো উচিত। আমি কোন চাঞ্চ নিতে চাই না।

খুশি হঠাৎ প্রহরকে ছেড়ে দিলো। ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এক মিনিট!! তুমি মনে করছ আমার মাথায় কোন সমস্যা হয়েছে? আর তাই আমি এসব আবোল তাবোল বকছি? তুমি আমাকে পা পাগল ভাবছ?

–তুমি আমাকে ভুল বুঝছ খুশি। আমার কথাটাতো আগে শোন।
প্রহর খুশির দিকে হাত বাড়াতে নিলেই খুশি সরে গিয়ে অভিমানী সুরে বললো।
–আর কিছু বলতে হবেনা তোমার। সব বুঝে গেছি আমি। আমি পাগল তাইতো? আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি চোখের সামনে সব আবোল তাবোল দেখতে পাচ্ছি। এটাই তো বলতে চাইছো। ওকে ফাইন। তাহলে তুমিও দূরে থাক এই পাগলের থেকে। আমিতো বদ্ধ উন্মাদ পাগল। কি জানি আবার কখন তোমাকে হার্ম করে বসি। তারথেকে ভালো তুমি এই পাগলের কাছ থেকে দূরে থাক।

–খুশি সোনা কি বলছ এসব তুমি? দেখ এমন কিছুই না। আমার কথাটা তো শোন।

খুশি আর কোন কথাই শুনলো না। অভিমানে ভরপুর হয়ে ঝট করে উঠে ব্যালকনিতে চলে গেল। প্রহরও ওর পিছু পিছু যেতে নিলো। তবে তার আগেই খুশি ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগিয়ে সুইমিং পুলের কাছে এসে বসে পড়লো। অভিমানী চোখে নেমে এলো অশ্রুধারা। এমনিতেই ওর সাথে এতকিছু হচ্ছে তা নিয়ে ওর মন মস্তিষ্কের মাঝে নানান ঝড় চলছে। তারওপর প্রহরও ওকে অবিশ্বাস করছে। ভাবছে ওর মাথার সমস্যা হয়েছে। এরজন্য খুশির আরও খারাপ লাগছে। খুব অভিমান হচ্ছে প্রহরের ওপর।

প্রহর এদিকে দরজা থাপড়িয়েই যাচ্ছে আর খুশিকে ডাকছে। কিন্তু খুশি দরজা খুলছে না। দরজার মাঝে লাগানে গ্লাসের সাহায্যে প্রহর দেখতে পেল ওর দুষ্টুপরি টা কাঁদছে। প্রহরের এবার নিজের ওপর চরম রাগ লাগছে। কি দরকার ছিল ওসব বলার? এখন আমার ময়নাপাখি টা কিভাবে কেঁদে যাচ্ছে। কিভাবে মানাবো ওকে এখন? প্রহর দরজায় থাপড়িয়ে করুন অপরাধী সুরে বললো।
–অ্যাম সরি সোনা। রিয়েলি ভেরি সরি। আমি ওটা বলতে চাইনি। প্লিজ একবার দরজা খোল। কথা বলো আমার সাথে। কেদনা প্লিজ। তোমাকে যদি দেখাতে পারতাম তোমার একফোঁটা চোখের পানি আমার বুকে কতটা ক্ষত করে। তাহলে হয়তো তুমি কখনো কাদতে না। প্লিজ সোনাপাখি একটা বার আমার কথা শোন।

খুশি আগের মতোই বসে আছে। দরজা খুলবে না সে কোনভাবেই। কথাও বলবেনা প্রহরের সাথে। কিন্তু হঠাৎ প্রহরের প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়। দরজায় আর কোন সারাশব্দ শোনা যাচ্ছে না। খুশির অভিমান যেন আরও বেড়ে গেল। ব্যাস এতটুকুই? এই ছিল উনার প্রচেষ্টা? আমি এখানে বসে কাঁদছি, আর উনার কিছু যায় আসছেই না? পঁচা লোক একটা? এখন তো আর কথাই বলবোনা। একদমই না। খুশিকে এভাবে বসে কাঁদতে দেখে সেই অজানা ব্যক্তির মনে প্রচুর শান্তি হচ্ছে। দূরবিনের সাহায্যে খুশিকে কান্নারত অবস্থায় দেখছে সে। তার কৃতকর্মের সুফল দেখতে পাচ্ছে সে। বিশ্বজয়ের হাসি তার ঠোঁটে ঝুলছে।

ঘন্টা খানিক পার হয়ে গেছে।বেলা তখন দুপুর বারোটা।চারিদিকে তপ্ত রোদ্দুরের প্রখরতা। খুশি এখনও বসে আছে ওভাবেই। প্রহর আসছে না দেখে অভিমানের পালা আরও ভারী হয়ে যাচ্ছে। অভিমান যখন চুড়ান্ত পর্যায়ে তখন আবারও দরজায় প্রহরের করাঘাতের শব্দ পেল খুশি। প্রহর ডাকছে খুশিকে। খুশি ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বললো।
–হুহ এতক্ষণে মনে পড়েছে বউয়ের কথা। খুলবোনা দরজা।

প্রহর দরজা থাপড়াতে থাপড়াতে বলতে লাগলো।
–খুশি দেখ এখন কিন্তু অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। তুমি দরজা না খুললে কিন্তু আমি দরজা ভেঙে ফেলবো বলে দিলাম।

খুশি তবুও দরজা খুলছে না। প্রহর এবার সত্যি সত্যিই দরজা ভাঙার উদ্দেশ্যে থাক্কানো শুরু করলো। এবার আর খুশি বসে থাকতে পারলোনা। প্রহর আঘাত পেতে পারে এই ভয়ে দ্রুত উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এপাশ থেকে প্রহর দরজা থাক্কিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে খুশি ওপাশ থেকে দরজা খুলে দিল। আচমকা দরজা খুলে দেওয়ায় প্রহর ব্যালেন্স হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। সাথে খুশিকে নিয়েই পড়লো। খুশি নিচে আর প্রহর খুশির ওপরে পড়লো। প্রহর মাথা তুলে খুশির দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সুরে বললো।
–তুমি ঠিক আছ তো? লাগেনি তো কোথাও?

খুশি কোন কথা না বলে প্রহরকে ঠেলতে লাগলো। প্রহর খুশির হাত ফ্লোরের সাথে চেপে ধরে বললো।
–বাচ না? আর কতো রাগ করে থাকবে? সরি না? প্লিজ মাফ করে দাও। এই দেখ আমি কান ধরছি। আর কখনো এমন স্টুপিটের মতো কথা বলবোনা। প্লিজ কথা বলো আমার সাথে।দরকার হলে ঝগড়া করো আমার সাথে। বকাঝকা করো আমাকে। আমি সবকিছু নিতে পারি। কিন্তু তোমার সাইলেন্স নিতে পারি না। ইট কিলস মি। প্লিজ সোনা কথা বলোনা?

খুশি অভিমানী সুরে বললো।
–কেন? কেন বলবো কথা? আমিতো একটা পাগলী তাইনা?

–হুমম পাগলী তো অবশ্যই। তবে আমার পাগলী। প্রহরের মিষ্টি পাগলী। দেখ এভাবে কিউট করে রাগ করে থাকলে কিন্তু আমি টুপ করে খেয়ে ফেলবো তোমাকে। পরে কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবেনা।

খুশির মন গলছে। তবে উপরে সেটা দেখাচ্ছে না। মুখের ওপর এখনো রাগের চাদর টেনে রেখেছে। প্রহর এবার বললো।
–আমার খুশিরাণীর জন্য একটা ফ্যান্টাস্টিক সারপ্রাইজ আছে। তবে মনে হচ্ছে খুশির সেটাতে কোন ইন্টারেস্ট নেই। ঠিক আছে তাহলে আমি চলেই যাই।
কথাটা বলে প্রহর মুখ ছোট করে অসহায় করে ভাব ধরে উঠে আসতে নিলো। সারপ্রাইজের কথা শুনে খুশির মনে লাড্ডু ফুটছে। তবে উপরে উপরে ভাব দেখিয়ে খুশি বলে উঠলো।
–ঠিক আছে ঠিক আছে আমি তোমার মতো এতো নিষ্ঠুর না। তোমার মন রাখার জন্য তোমার সারপ্রাইজ দেখে নিবো।

প্রহর বাঁকা হেসে বললো।
–আপনি সত্যিই অনেক দয়ালু। তাহলে চলুন। আপনার সারপ্রাইজ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

প্রহর খুশিকে নিয়ে রিসোর্টের ছাদে এলো। সেখানে একটা প্রাইভেট হেলিকপ্টার ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। খুশি সেটা দেখে আশ্চর্য চকিত হয়ে গেল। প্রহর ওর জন্য এতবড় সারপ্রাইজ অ্যারেঞ্জ করেছে? তাহলে গত ঘন্টাখানিক ধরে প্রহর এই কাজে ব্যাস্ত ছিল? বিস্ময়ে খুশির চোখ দুটো চকচক করছে। অতি উত্তেজিত হয়ে খুশি প্রহরকে জড়িয়ে ধরে লাফাতে লাফাতে উচ্চস্বরে বললো।
–প্রহর,প্রহর,প্রহর… আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ সোওওওওওওওও মাচ।

প্রহর হাসিমুখে বললো।
–আই লাভ ইউ টু মাই কুইন।
প্রহর খুশির হাত ধরে বললো।
–তো চলুন রাণীসাহেবা,আপনার সওয়ারী আপনার অপেক্ষা করছে।

খুশি উদ্দিপনার সহিত প্রহরের হাত ধরে হেলিকপ্টারের দিকে এগুলো। আগে প্রহর উঠে তারপর খুশির হাত ধরে উঠালো হেলিকপ্টারে। ওরা উঠে বসলে পাইলট হেলিকপ্টার চালু করলো। হেলিকপ্টার উড়ছে আকাশ পথে। উপর থেকে মরিশাস দ্বিপের সবটা ঘুরে ঘুরে দেখছে ওরা। উপর থেকে নিচের বিশাল নীল সমুদ্র আর সবুজে ঘেরা অরন্য দেখতে পাচ্ছে। ওপর থেকে এসব দেখতে অপূর্ব লাগছে। খুশিতো মহা আনন্দে ভাসছে। আগের সবকিছু মুহূর্তেই ভুলে গেল ও। খুশিকে প্রফুল্ল দেখে প্রহরের মনেও প্রশান্তি হচ্ছে। ওর খুশিকে শুধু হাসিতেই মানায়। ওর দিকে কোন দুঃখ আসতে দিবে না ও। আর এই মিস্ট্রি ম্যানের হিস্ট্রি তো ও বের করেই ছাড়বে।
__

বিকালের পর ওরা এলো “মন্ট চয়েছি” বিচে ঘুরতে। মরিশাসের সমুদ্র সৈকতের মাঝে এটিও অন্যতম। সৈকতের তীরে সারিবদ্ধ আছে ঝাউবনের সবুজ অরণ্য। প্রাকৃতিক পরিবেশের নিদারুণ এক অপরুপ স্থান। আর আজ এখানে আফ্রিকান কিছু শিল্পিরা বিচে একটা ওপেন কনসার্টের আয়োজন করেছে। যার কারণে বিচটা আরও জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চারিদিকে কনসার্ট উপলক্ষে মেলার মতো একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কিছু আফ্রিকান মেয়েরা লম্বা স্কাটের মতো ড্রেস পরে তাদের নিজস্ব ফোক ডান্স করছে।

খুশির এগুলো দেখে ভীষণ মজা লাগছে। খুশিও ওদের কাছে গিয়ে ওই মেয়েগুলোর সাথে তাদের ডান্স করতে লাগলো।একটুপরে তিশাকেও টেনে নিলো ডান্স করতে। প্রহর শুধু মুচকি হেঁসে দেখছে ওর পাগলীটাকে। কনসার্ট আর মেলা উপভোগ করতে করতে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলো চারিদিকে। প্রহর বারবার খুশিকে ফিরে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু খুশি এই আনন্দ রেখে যেতেই চাইছে না। এখনো মেলায় রয়েছে ওরা। খুশি আর তিশা নানান রকম জিনিস কেনাকাটা করছে। হঠাৎ প্রহর দেখলো একটা বাচ্চা পড়ে গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করছে। হাত থেকে রক্তও বের হচ্ছে। হয়তো মাকে হারিয়ে ফেলেছে। প্রহর একবার খুশির দিকে তাকিয়ে দেখলো ও কেনাকাটায় ব্যাস্ত। প্রহর ভাবলো খুশি কোনাকাটা করতে করতে ও একটু বাচ্চাটার হেল্প করে আসুক। সেই ভাবনা মোতাবেক প্রহর ছুটে গেল বাচ্চাটির কাছে। বাচ্চাটিকে উঠে বসিয়ে হাতের কাটা জায়গায় রুমাল বেঁধে দিয়ে বললো।
–তোমার মা বাবা কোথায়?

ছেলেটি আফ্রিকান শিশু। তাই সে প্রহরের ভাষা বুঝতে পারলো না। এত ছোট বাচ্চা ইংলিশও তেমন বুঝে না। প্রহর পড়ে গেল এক মহামুশকিলে। কিছু একটা ভেবে প্রহর ছেলেটিকে কোলে নিয়ে ওখানে কোন এক আফ্রিকান লোকের কাছে নিয়ে গিয়ে ছেলেটিকে হস্তান্তর করে দিল।যাতে তারা ওর মা বাবাকে খুঁজে দিতে পারে। ছেলেটিকে প্রহর আবার দ্রুত ফিরে এলো খুশির কাছে। কিন্তু একি! খুশি এখানে নেই। কোথায় গেল খুশি? প্রহরের ভয়ে বুক কোপে উঠলো। আবারও সেই মিস্ট্রি ম্যান কিছু করলোনাতো ওর খুশিকে? প্রহর অস্থির হয়ে পাগলের মতো সবজায়গায় খুশিকে খুশিকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও পেলনা খুশিকে।খুশির ফোনও বন্ধ আসছে। ফাহিম আর তিশাও খুশির কোন খবর বলতে পারলোনা। ওরাও খুশিকে খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও কেউ পাচ্ছে না। প্রহর স্টেজে উঠে মাইকে এনাউন্সমেন্টও করলো। তবুও কোন খোঁজ পেলনা খুশির। প্রহর পাগল হয়ে গেল। কোথায় গেল খুশি? আবারও হারিয়ে ফেললো ও খুশিকে??

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here