অন্তঃকরণে তোরই পদচারণ পর্ব -৩১+৩২

#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৩১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★দেখতে দেখতে খুশি আর প্রহরের খুনসুটির মাঝে কেটে গেছে আরও দুই সপ্তাহ। খুশি এখন পুরোপুরি সুস্থ। মাথার চুল একটু লম্বা হয়ে কান পর্যন্ত এসেছে। খুশি সেগুলো গোল করে বব কাটিং করিয়েছে। এরই মাঝে ফাহিম আর তিশার বিয়েটাও হয়ে গেছে। খুশি আর প্রহরও গিয়েছিল ওদের বিয়েতে। খুব ধুমধামের সাথেই তাদের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে।

ফাল্গুন মাস প্রায় শেষ হতে চলেছে। পরিবেশে গরমের প্রভাব ফেলেছে। কম্বলের নিচ থেকে গরমে হাসফাস করে মাথা বের করে নিলো খুশি। মুখটা বিরক্তিতে ভরে উঠলো। এই প্রহরটাও না মাঝে মধ্যে অতিরিক্ত করে ফেলে। ছোট বাচ্চাদের মতো কম্বলে মুড়িয়ে থুয়ে গেছে আমাকে। আরে এখন কি আর এতো শীত আছে নাকি? অস্বস্তিতে ঘুমটা আর হলোনা খুশির। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো সে। চোখ কচলিয়ে সামনে তাকিয়ে প্রহরকে দেখতে পেল ও। সামনের সোফায় বসে ল্যাপটপে চোখ গেড়ে আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে। হাতের আঙুল গুলো যেন পিয়ানো বাজানোর মতো তালে তালে চলছে। খুশি হাঁটু ভাজ করে হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে কতক্ষণ প্রহরকে অবলোকন করলো। হায়য়,,,, ওর হাসব্যান্ড টা এত্তো কিউট কেন? সকাল সকালও এতো কিউটনেস কোথাথেকে আনে? আমার নিজেরই না নজর লেগে যায়।

খুশি মুচকি হেঁসে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মৃদু পায়ে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে প্রহরের কোলে বসে পড়লো। দুই হাতে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে বললো।
–গুড মর্নিং হাসব্যান্ড। সকাল সকাল বউকে রেখে কি এতো রাজকার্য হচ্ছে শুনি।

প্রহর মুচকি হেসে খুশির কপালে চুমু দিয়ে বললো।
–গুড মর্নিং বিবি সাহেবা। আর সকাল সকাল কাজ আর করতে দিলেন কই? এইযে আপনার ঘুম জড়ানো কিউট মুখখানা নিয়ে হাজির হলেন। এখনতো সব রাজকার্য গোল্লায় যাবে। জানো তোমার এই ছোট চুলগুলোতে তোমাকে আরও বেশি কিউট লাগে।

–আমার মন রাখার জন্য এসব বলার দরকার নেই। কিউট না ছাই। ছেলেদের মতো দেখতে লাগে। শুধু একটা মোছের কমতি আছে। একটা মোছ লাগিয়ে নিলেই দ্যা গ্রেট মফিজ হয়ে যাবো।

–যার যেমন ভাবনা। এখন তোমার ভাবনাকেতো আর আমি বদলাতে পারি না। তবে আমার কাছে তো তোমাকে এভাবে অনেক কিউট লাগে। আর আমার এই বউটার জন্য একটা কিউট কিউট সারপ্রাইজ আছে।

খুশি উৎসাহী কন্ঠে বললো।
–সারপ্রাইজ?? কি সারপ্রাইজ বলনা?

–হুম তো সারপ্রাইজ হলো আমি আমার দুষ্টুপরি টাকে নিয়ে মরিশাস দ্বীপে যাচ্ছি বেড়াতে।

খুশি এক্সাইটেড হয়ে বললো।
–ওয়াও সত্যিই??

–হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি মেরি জান । তোমার সমুদ্র অনেক পছন্দ না? তাই এবার সমুদ্রের একদম মাঝখানে যাবো। যেখানে চারপাশে শুধুই সমুদ্র। আর আমি এখন অনলাইনে প্লেনের টিকেটই বুক করেছিলাম।

–ওয়াও আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমরা মরিশাস যাবো? থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ সোওওওও মাচ।
অতি উৎসাহিত হয়ে খুশি প্রহরের ঠোঁটে একটা চুমু একে দিলো। প্রহর হেঁসে দিল খুশির কান্ডে। খুশি বলে উঠলো।
–আচ্ছা ফাহিম আর তিশাকেও বলোনা। ওরাও যাক আমাদের সাথে। তাহলে আরও মজা হবে।

–হ্যা ওরাও যাচ্ছে আমাদের সাথে। আমি ওদের আগেই বলে দিয়েছি। এখন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ব্রেকফাস্ট করেই বের হতে হবে আমাদের।
–আচ্ছা। আমি এখুনি ফটাফট রেডি হয়ে আসছি।

খুশি অতি প্রফুল্ল হয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেল ফ্রেশ হতে। আর খুশির এই উৎসাহ বরাবরের মতোই প্রহরের মনে অনাবিল প্রশান্তি বয়ে আনলো। খুশির এই হাসিমুখ টার জন্য প্রহর সবকিছু করতে রাজি।
__

যথা সময়ে সবাই রেডি হয়ে এয়ারপোর্টে এসে হাজির হলো। প্রথমে ওদের ঢাকা থেকে দিল্লি যেতে হবে। তারপর ওখান থেকে ওদের মরিশাসের প্লেনে উঠতে হবে। এই প্রথম খুশি প্লেনে উঠছে। এক্সাইটমেন্টে যেন মাটিতে পা পড়ছেনা ওর। এয়ারপোর্টে এসেই লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।লাগেজ নেওয়ার ট্রলিতে চড়ে বসে আছে সে। আর প্রহর ট্রলি সহ খুশিকেও ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে যাকে পাচ্ছে তার সাথেই সেলফি নিচ্ছে। ফাহিম আর তিশা ওর কান্ড দেখে হেঁসে শেষ।

লাগেজ জমা দিয়ে ওয়েটিং এ বসে আছে সবাই। কিন্তু চুলবুলি খুশির বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না। বসে থাকা তার জন্য বড়োই দুর্বোধ্য কাজ। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে কে কি করছে। তখনই পাশে বসে থাকা এক বয়স্ক দম্পতিকে দেখতে পেল ও। খুশি একটু এগিয়ে গিয়ে বসলো ওদের কাছে। মহিলাটির উদ্দেশ্যে বললো।
–হেলো আন্টি আপনারাও হানিমুনে যাচ্ছেন বুঝি?

বেচারা বয়স্ক দম্পতি দুজন খুশির এমন আজগুবি কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। তবে মহিলাটি কোনরকমে এই অদ্ভুতন্বিত কথা হজম করে নিয়ে বললো।
–আরে না না আমরা তো বিয়ের জন্য যাচ্ছি।

ব্যাস খুশি ওর মগজের ঘোড়া ফুল স্পিডে দৌড়িয়ে নিজের মতো করে ব্যাপার টা সাজিয়ে নিলো। আর সেই মোতাবেক অবাক হয়ে বললো।
–ও মাই গড আপনারা এখনো বিয়েই করেন নি? তাহলে কি আপনারা এতদিন লিভ ইন রিলেশনে ছিলেন? ওয়াও জেনারেশন এতো আপডেট হয়ে গেছে জানতামই না। আপনারা তো আমাদেরও পিছে ফেলে দিয়েছেন। ইশশ আমারও কতো শখ ছিল লিভ ইন করার। কিন্তু আমার হাসব্যান্ড টা না একেবারে রসকষহীন কাঠখোট্টা। ওকে যেই এ কথা বললাম। বাপরে বাপ কি একটা ধমকই না দিয়েছিল। মনে হলো আমি ঘোর অন্যায় কোন কথা বলে দিয়েছি। আমার এই কথা কোনভাবে লিক হলে দুনিয়াতে ওয়ার্ল্ড ওয়ার শুরু হয়ে যাবে। আজ মাছুম ইনোসেন্ট বলে আমার এতো মহামূল্যবান কথার চুল পরিমান দামও দিলোনা। লোকে ঠিকই বলে ভালো মাইনষের ভাত নাই দুনিয়ায়। আচ্ছা থাক বাদ দিন আমার দুঃখ বেদনার কথা। তো এখন কি আপনারা পালিয়ে বিয়ে করছেন?

দম্পতি দুজন একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আসলে খুশির এই মহান বাণীর কোনকিছুই তাদের বোধগম্য হয়নি। তবে শেষের কথা শুনে ওরা ফ্রীতে এইমাত্র তাজ্জব বনে ঘুরে এলো।ঘোরা শেষে মহিলাটি বলে উঠলো।
–আরে না আমরা তো আমাদের ছেলের বি….

পুরো কথা শেষ করার আগেই খুশি আবারও তার ব্যাতিক্রমী ভাবনার তীর নিক্ষেপ করে বললো।
–ও মাই গড! লিভ ইনে আপনাদের ছেলেও হয়ে গেছে? ওয়াহ্ আপনারা সত্যিই এপিক। আই সেলুট ইউ। ইউ আর গ্রেট। শুধু গ্রেট না। সুপার গ্রেট। আপনাদের তো নোবেল পুরষ্কার দেওয়া উচিত। আমি আজই সরকারের কাছে আবেদন জানাবো আপনাদের নোবেল পুরষ্কারের জন্য।

এবারতো বেচারাদের সজ্ঞানে থাকার মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না। জ্ঞান হারিয়ে কোমায় চলে গেলে ব্যাপার টা মন্দ হবে না। এই পাগলের হাত থেকে তো নিস্তার পাওয়া যাবে। আজকে যে কার মুখ দেখে উঠেছিল এরা যে,এই বালার সাথে সাক্ষাৎ হতে হলো।

প্রহর পাশেই বসে ছিল। বেচারি দম্পতি দুজন জ্ঞান হারানোর আগেই প্রহর খুশিকে টেনে সরিয়ে এনে ফিসফিস করে বললো।
–কি করছ খুশি? একটু চুপ করে বসোনা। নাহলে কিন্তু পাবলিক ধোলাই খেতে হবে।

–আরে ধোলাই কেন খেতে যাবো? আমিতো ওনাদের সাথে অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলাম। জানো ওনারা না এতদিন লিভ ইনে ছিল। আর তোমাকে একবার বলেছিলাম বলে তুমি আমাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলে। এখন ওনাদের দেখ। কত্তো মডার্ন।

ওদের কথার মাঝে ফাহিম এবার বিশেষ টিপ্পনী কেটে বললো।
–সত্যিই ভাবিজী?? বাহ্ আঙ্কেল তো খুব এনার্জেটিক দেখছি। জানেন আমারও না লিভ ইনে থাকার খুব শখ ছিল। কিন্তু তিশাকে বলার সাহসই পায়নি।

তিশা পাশ থেকে ফাহিমের কথা শুনে তেতে উঠে বললো।
–এই এই কি বললে তুমি? কি শখ ছিল?

ফাহিম আমতাআমতা করে বললো।
–ক কই কি বললাম? আমিতো বলছিলাম আজকে কি বার?

–তোমাকে একবার একা পাই তারপরে বুঝিয়ে দেবো আজকে কি বার?

বেচারা ফাহিমের অবস্থা দেখে খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–দেবরজী আপ তো গায়ে কামছে। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।

খুশির কথায় সবাই হেসে দিলো।
__

প্লেনে এসে উঠলো ওরা। খুশিতো প্লেনে উঠেই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে যাচ্ছে।উঠেই প্রথমে বিমান বালাদের সাথে ঘটাঘট কয়েক টা সেলফি নিয়ে নিলো। প্রহর কোনরকমে খুশির হাত ধরে ওকে নিয়ে সিটে এসে বসলো। এক্সাইটমেন্টে ভরপুর খুশি কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরেই প্লেন টেক অফ করলো। মেঘের ওপর চলছে প্লেন। জানালার কাছে সাদা মেঘের ভেলা এসে ভেসে বেড়াচ্ছে। খুশির খুব ইচ্ছে হচ্ছে সেগুলো ধরার। কিন্তু প্লেনের জানালা তো আর খোলা যায় না। তাই জানালার কাচেই হাত রেখে মেঘগুলোকে অনুভব করছে। খুশিকে এভাবে আনন্দিত দেখে প্রহরেরও মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। সত্যি করেই ওর আগের সেই দুষ্টুপরিকে ফিরে পেয়েছে ও। খুশিকে নিজের মতো এনজয় করতে দেখে প্রহর আর ওকে ডিস্টার্ব করলোনা। ও সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিল। যেকোনো জার্নিতেই ওর ঘুমের ভাব হয়। সেই অভ্যাস অনুযায়ী প্রহর একটু ঘুমাতে চাইলো।

মিনিট বিশেক পর খুশি এবার একটু প্রহরের দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রহর ঘুমিয়ে আছে। খুশি মুচকি হাসলো। তবে খুশির মুখের হাসি হঠাৎ উড়ে গেল সামনে তাকাতেই। ওদের পাশের সিটে একটি সুন্দরী মডার্ন টাইপের মেয়ে বসে আছে। যার বাজখাঁই নজর গেড়ে আছে প্রহরের ওপর। যেন চোখ দিয়েই গিলে খেয়ে ফেলবে প্রহরকে। এটা দেখে রাগে শরীর জ্বলে উঠলো খুশির। তাই সে মেয়েটিকে দেখিয়ে নিজেও প্রহরের কাঁধে মাথা রাখলো। প্রহরের এক হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটি এখনো তাকিয়ে আছে। খুশি এবার ওকে দেখানোর জন্য প্রহরের গালে একটা চুমু দিয়ে দিলো। নাহ্ তবুও মেয়েটির চাহনিতে কোন পরিবর্তন আসছে না। এবার আর সহ্য হলোনা খুশির। রণচণ্ডী রুপ ধারণ করে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার সামনে এগিয়ে এলো।

মেয়েটার কাছে এসে সোজা দুই হাতে মেয়েটির চুল খামচে ধরে টানাহেঁচড়া করে বললো।
–এই এই ডাইনি বেটি,পেত্নী বেটি তোর সাহস কি করে হলো আমার প্রহরের দিকে কুনজর দেওয়ার? তুই দেখছিস না আমি ওর বউ? তারপরও তাকিয়ে আছিস? নির্লজ্জ বেহায়া বেটি। আজকে তোর চোখের মনি খুলে নিয়ে গুটি খেলবো আমি।

খুশির আচমকা হামলাই বেচারি মেয়েটার নাজেহাল অবস্থা। মেয়েটির পাশের লোকটা খুশিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। সবাই ওদের কান্ড দেখে ফ্রী এন্টারটেইনমেন্ট পাচ্ছে। হৈচৈ শুনে প্রহরের ঘুম ভেঙে গেল। হড়বড়িয়ে উঠে সামনে তাকিয়ে খুশির তুলকালাম কান্ড দেখে প্রহর হতভম্ব হয়ে গেল। দ্রুত উঠে গিয়ে খুশিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো।
–কি করছ খুশি? পাগল হয়ে গেলে নাকি? ছাড় ওকে।

খুশি কিছুতেই ছাড়ছে না। প্রহর এবার খুশির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে ওকে উঠিয়ে সরিয়ে নিয়ে আসলো ওখান থেকে। খুশি তবুও হাত বাড়িয়ে আগ্রাসী হয়ে মেয়েটাকে ধরার চেষ্টা করছে। মেয়েটা ছাড়া পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল। প্রহর খুশিকে সরিয়ে এনে ধমকের সুরে বললো।
–এসব কি হচ্ছে খুশি? পাগল হয়ে গেছ তুমি? কি ধরনের ব্যবহার এসব? মানসম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিবে তুমি?

খুশি রাগী কন্ঠে বললো।
— আমি কি করছি তাইনা? আর ও কি করছিল? সেই কখন থেকে শকুনের মতো নজর গেড়ে ছিল তোমার ওপর। কেন তাকিয়ে থাকবে ও? ওর সাহস কি করে হলো?

সেই মেয়েটি বলে উঠলো।
–আমি কখন তাকিয়ে ছিলাম? আরে আমিতো আারামে ঘুমাচ্ছিলাম। আপনিই হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আক্রমণ করে বসলেন।

–এই এই একদম মিথ্যে বলবেনা। আমি নিজে দেখেছি তোমাকে তাকিয়ে থাকাতে।

মেয়েটির পাশের লোকটা বলে উঠলো।
–আসলে আপনি ভুল বুঝছেন। ওর তাকিয়ে থেকেই ঘুমানোর অভ্যাস। ও এভাবে চোখ খুলেই ঘুমায়।

খুশি এবার একটু থতমত খেয়ে গেল। নিজের কাজের ওপর লজ্জাবোধ হলো ওর। অপরাধী সুরে বললো।
–ওহ্ অ্যাম রিয়েলি সরি আমি আসলে বুঝতে পারিনি।

–ইটস ওকে।

খুশি মাথা নিচু করে চুপচাপ গিয়ে নিজের সিটে বসে পড়লো। প্রহরও নিজের সিটে বসলো। খুশি জানালার দিকে মুখ করে আছে। প্রহরের দিকে একবারের জন্যও তাকাচ্ছে না। প্রহর বুঝতে পারলো খুশি ওর ওপর অভিমান করেছে। তখন একটু বেশিই বলে ফেলেছে হয়তো। প্রহর খুশির কাঁধে হাত রেখে খুশিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু খুশি প্রহরের হাত নামিয়ে দিলো। প্রহর এক হাতে কান ধরে অপরাধী সুরে বললো।
–সরি খুশিরাণী। রাগ করে থেকনা প্লিজ। দেখ তোমাকে তখন না ঠেকালে প্লেনে এমন গ্যাঞ্জাম করার অপরাধে তোমাকে পুলিশেও ধরিয়ে দিতে পারতো ওরা। তখন আমি কি করতাম বলো?

খুশি উল্টো দিকে ঘুরে থেকেই অভিমানী সুরে বললো।
–আমার জন্য তোমার মানসম্মান চলে যায়।

কথা বলার সময় খুশির গলা কাঁপছে। প্রহর বুঝতে পারলো খুশি কাঁদছে। এবার প্রহরের বুকের মাঝে হু হু করে উঠলো। প্রহর দ্রুত খুশিকে নিজের দিকে ঘোরালো। খুশির চোখের পানি মুছে দিয়ে আবেগী কন্ঠে বললো।
–হেই সোনাপাখী। কাঁদছিস কেন? সরি না? তখন তোমাকে ঠেকানোর জন্য ওসব বলেছিলাম। বাট আই ডিডি’ন্ট মিন ইট। প্লিজ কাঁন্না বন্ধ কর।

খুশি প্রহরের বুকে মাথা রেখে বললো।
–যেভাবেই বলো, তুমি এসব বললে আমার সহ্য হয়না। তোমার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও আমার সহ্য হয়না।

প্রহর মুচকি হেঁসে বললো।
–আচ্ছা?? তো কতজনকে এভাবে মারবে শুনি?

–যে কয়জন এই ভুল করবে সবাইকে। তুমি শুধু আমার। তোমার দিকে কেউ তাকালে আমি তার চোখ তুলে ফেলবো।

প্রহর প্রাপ্তির হাসি দিয়ে খুশিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো।
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৩২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★মরিশাসের এয়ারপোর্টে এসে নামলো ওরা। একহাতে ট্রলি ঠেলে আরেক হাতে খুশির হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে এলো প্রহর। সাথে ফাহিম আর তিশাও এলো। প্রহর আগে থেকেই কার বুক করে রেখেছিল। যেটা বাইরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা গিয়ে উঠে বসলো গাড়িতে। ড্রাইভার লাগেজ গুলো ডিকিতে তুলে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। খুশি বরাবরের মতোই এক্সাইটেড হয়ে বাইরে সবকিছু দেখছে। গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে দুই হাত নেড়ে উচ্চস্বরে বলছে।
–হেলোওওওওও মরিশাস.. লুক হিয়ার আই কাম। দ্যা খুশি প্রহর মেহরাব।

প্রহর খুশিকে ভেতরে টেনে এনে বললো।
–খুশি কি করছ? এভাবে কেউ মাথা বের করে? অন্য গাড়ির সাথে টক্কর লেগে যাবেতো। প্লিজ একটু শান্ত হয়ে বসো। একবার রিসোর্টে গিয়ে পৌছাই তারপর যত হৈ হুল্লোড় করার করো ওকে।

–আরে বেড়াতে এসে কেউ শান্ত হয়ে বসে থাকে নাকি? তাহলে আর বেড়াতে আসার কি মজা হলো? তাইনা তিশা তুমিই বলো?

তিশা খুশির সাথে সহমত পোষণ করে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই ভাবি। আরে বেড়াতে এসে একটু হৈ হুল্লোড় করবোনাতো কি শোক দিবস পালন করবো?

খুশি তিশার হাতের সাথে হাত মিলিয়ে হাইফাই দিয়ে বললো।
–ইয়ে হুয়ি না বাত। তাহলে একটু গানা বাজানা হয়ে যাক?

–হ্যাঁ হ্যাঁ ভাবি আপনি শুরু করুন না।

খুশি গদগদ হয়ে বললো।
–আরে তুমি যখন এতোকরে বলছ তাহলে আর মানা করি কিভাবে? ঠিক আমি গান শুরু করছি হ্যাঁ।

ওদের কথায় প্রহর আর ফাহিমের চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। এই সেরেছে। এখন কি খুশি ওর মধুর কন্ঠ শোনাবে সবাইকে? ফাহিম তিশাকে টান দিয়ে নিজের কাছে এনে দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললো।
–তোমার কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? এখন কি তুমি আমাদের এক্সিডেন্ট করাতে চাও?

তিশা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–আজব, আরে আমি কেন এক্সিডেন্ট করাতে চাইবো?

–তোমার চাওয়া লাগবেনা। মহান ভাবিজী তার সুমধুর কন্ঠ ছেড়ে একবার গাওয়া শুরু করলে ড্রাইভার বেচারা হান্ড্রেড পার্সেন্ট এক্সিডেন্ট করবে? আরে কে বলেছে তোমাকে তাকে গান গাওয়ার জন্য বলতে? এখন আল্লায় জানে কি হবে?

কিন্তু অঘটন যা ঘটার তাতো ঘটে গেছে। এখন আর খুশিকে থামানো সম্ভব না। প্রহর বেচারা মনে মনে দোয়াদরুদ পড়ছে। ড্রাইভার বেচারা যেন এতবড় শক নিতে সক্ষম হয়।
অতঃপর খুশি গলা ঝেড়ে তার ট্রাক্টরের মতো মধুর আওয়াজে গলা ছেড়ে গাওয়া শুরু করলো।
♬ লাভলী না আমি বাবলি না নইরে বিল্লোরাণী
♬ খেলি ছিনিমিনি ছিনিমিনি ছিনিমিনি মন নিয়ে
♬ ম্যাজিক মামোনি
♬ হীরণী জেইছি আখে আমার চেহরা নূরানী
♬ খেলি ছিনিমিনি ছিনিমিনি ছিনিমিনি মন নিয়ে
♬ ম্যাজিক মামোনি

তিশা বেচারির মনে হচ্ছে কেউ ওকে হাজার বোল্টের শক দিয়েছে। খুশির মধুর কন্ঠ যে এতোটা মধুর তা জানা ছিলনা ওর। বেচারি করুন চোখে তাকালো ফাহিমের দিকে। ফাহিম চোখের ইশারায় বললো, বোঝ এখন কেমন লাগে। অন্যদিকে খুশির এই মধুর গান শুনে বেচারা ড্রাইভারের ব্যালেন্স হারিয়ে গেল। সে হাঠাৎ করে ব্রেক কষে, বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো।
–কি করছেন ম্যাডাম? আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?জানেন আমি হার্টের পেশেন্ট। এখনি যদি আমার হার্ট অ্যাটাক হতো তাহলে আমার ছোট ছোট বাচ্চার কি হতো? প্লিজ ম্যাডাম আপনের পায়ে ধরি আর গান গাইয়েন না। নাইলে আমি এক্সিডেন্ট করে বসবো।

খুশি একটা ভেংচি কেটে বললো।
–হুহ্,, আসল ট্যালেন্টের কোন কদরই নেই।

প্রহর মুচকি হেঁসে বললো।
–আরে মন খারাপ করে না। ওরা আসলে আমার খুশিরাণীর প্রতিভার মূল্য বোঝে না। তবে আমি আছি না? আমি শুনবো তোমার গান কেমন? এখন আর ওদের শোনানোর দরকার নেই।

–হুমম ঠিকই বলেছ এসব আনারিদের এই খুশির ট্যালেন্ট বোঝার ক্ষমতা নেই।

হাসি ঠাট্টার মাঝেই ওরা রিসোর্টে এসে পৌছালো। সমুদ্র সংলগ্ন সেভেন স্টার লাক্সারি রিসোর্ট বুক করেছে প্রহর। রিসোর্টে দুটো হানিমুন সুইট বুক করেছে। একটা নিজেদের জন্য আর একটা ফাহিমদের জন্য। রিসিপশনে এসে চাবি সংগ্রহ করলো প্রহর। ফাহিমের টা ফাহিমের হাতে দিয়ে বললো।
–এখন একটু রুমে গিয়ে সবাই রেস্ট করি। তারপর লাঞ্চের জন্য নিচে আসবো ওকে?

–ওকে বস।

ফাহিম চাবি হাতে নিয়ে তিশার সাথে ওদের রুমের দিকে চলে গেল। প্রহরও খুশির হাত ওদের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। প্রহর খুশির দিকে তাকিয়ে দেখলো খুশিকে কেমন টায়ার্ড লাগছে। মুখটা কেমন ঘেমে উঠেছে। প্রহর হঠাৎ খুশিকে পাঁজা কোলে তুলে নিল। খুশি প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে দুষ্টু হেসে বললো।
–আরে বাহ্ হানিমুনে আসতেই আমার সোয়ামী একদম রোমান্টিক হয়ে গেল দেখছি।

প্রহর যেতে যেতে বললো।
–মগজের ঘোড়া বেশি দৌঁড়ানোর দরকার নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোমার টায়ার্ডনেস হচ্ছে। লাফালাফি করতে করতে ব্যাটারি লো হয়ে গেছে তো? এজন্যই বলি এতো বেশি লাফালাফি করতে নেই। কিন্তু তুমি শুনলে তো আমার কথা। তুমি কেন বোঝনা তোমার এতো লাফালাফি করা ঠিক না। তোমার সমস্যা হতে পারে।

–উহুম হবে না। আমার প্রহর থাকতে আমার কিছু হতে পারে নাকি? আমি জানি তুমি আমার কিছুই হতে দিবে না। তাইতো আমার নিজেকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই।

–আচ্ছা তারমানে আমাকে টেনশনে রাখতে তোমার খুব মজা লাগে তাইনা?

–এই একটুখানি লাগে বেশি না।

–তাই না?? আগে রুমে চলো তারপর তোমাকে মজা দেখাচ্ছি।

খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–আঃ আঃ মাই হাসব্যান্ড বিকাম ভায়োলেন্ট। আই লাভ দিস এটিটিউড।

প্রহর হেঁসে দিয়ে বললো।
–তুমি সত্যিই পাগল।

–জানিতো

–পুরো পাগল

–তাও জানি

এভাবে দুজন হাসাহাসি করতে করতে নিজেদের রুমের দিকে এগুলো। অথচ ওরা জানলও না একজোড়া ক্রুর চোখের তপ্ত নজর ওদের ওপর পড়ে আছে। তার চোখে জ্বলছে ধ্বংসাত্মক অগ্নিশিখা। যে অগ্নিতে ঝলসে দিতে চাইছে ওদের কে। ওদের এই হাস্যজ্বল মুখটা তার চোখে তীরের মতো বিঁধছে। সহ্য হচ্ছে না প্রহর খুশির এতো সুখ। মনের মধ্যে দাউদাউ করে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠছে। যে আগুনে সে প্রহর খুশিকে জ্বালিয়ে দিবে। ওদের এই হাসি কেড়ে নিবে সে। সুখী থাকতে দিবেনা ওদেরকে।

সেই অজানা ব্যাক্তির মনকামনা থেকে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত প্রহর খুশিকে নিয়ে মনের আনন্দে নিজেদের রুমে ঢুকলো। রুমে ঢুকে খুশি রুমের চারপাশে তাকিয়ে আরও আত্মহারা হয়ে গেল। একলাফে প্রহরের কোল থেকে নেমে দৌড়ে সারারুম ঘুরে দেখতে লাগলো। এতসুন্দর রুম দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল খুশি। জানালার পর্দা সরাতেই সামনের নীল সমুদ্র চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে গেল। সাথে সাথে দমকা বাতাস এসে শীতল করে দিয়ে গেল দেহ মনটাকে। চোখ বুজে সেই বাতাসে নিজেকে মেলে ধরলো খুশি। এ যেন এক অব্যক্ত অনুভূতি। প্রহর খুশির পেছনে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে থুতনি রেখে বললো।
–পছন্দ হয়েছে রুম? এটা এই রিসোর্টের সবচেয়ে বেস্ট হানিমুন সুইট।

খুশি প্রহরের দিকে ঘুরে দুই হাতে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বললো।
–অনেক অনেক অনেক পছন্দ হয়েছে। আই জাস্ট লাভ ইট। আচ্ছা এটাকে হানিমুন কেন বলে? এখানে না হানি আছে, না মুন। তাহলে হানিমুন কিভাবে হলো?

প্রহর মৃদু হেসে বললো।
–আছে তো। এইযে আমার সামনে হচ্ছে আমার মুন। আর এই মুনের মাঝেই ভরপুর মধুর ভান্ডার আছে। তাহলে হয়ে গেল তো হানিমুন।

–ওয়াও হোয়াট আ ক্রিয়েটিভ থিংক।

–শুকরিয়া জনাবা। বাইদাওয়ে তোমার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।

–সত্যিই? কি সারপ্রাইজ?

–আসো দেখাচ্ছি।

প্রহর খুশির হাত ধরে ব্যালকনির দরজা খুলে ব্যালকনিতে নিয়ে এলো। ব্যালকনিটা বিশাল খোলা জায়গা নিয়ে গঠিত।একটা ছোটমোটো ছাঁদের সমান। আর ব্যালকনির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হলো বড়ো একটা প্রাইভেট সুইমিং পুল। যার সীমানা একদম ব্যালকনির শেষ মাথায় গিয়ে ঠেকেছে। উপর থেকে দেখে মনে হবে সমুদ্রের সামনে আরেকটা ছোট সমুদ্র। সুইমিং পুলের পানির ওপর সুন্দর করে গোলাপের পাপড়ি ছিটানো। খুশির যেন আনন্দ ধরছেনা। এতসুন্দর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সে এর আগে কখনো দেখেনি। খুশি উল্লাসিত হয়ে বললো।
–ওয়াও আমার তো আর তর সইছে না। প্রহর আমি এখুনি পুলে নামবো প্লিজ প্লিজ প্লিজ..

–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আগে চেঞ্জ তো করে নাও। এভাবেই নামবে নাকি।

–ওকে আমি এখুনি চেঞ্জ করে আসছি।

খুশি এক ছুটে চলে গেল চেঞ্জ করতে। প্রহরও চেঞ্জ করার জন্য ভেতরে এলো। খুশি একটা থ্রি কোয়ার্টার টাইস আর টিশার্ট পড়লো। আর প্রহর খালি গায়ে শুধু একটা বক্সার হাফ প্যান্ট পড়লো। চেঞ্জ করা শেষে প্রহর আবারও খুশিকে কোলে তুলে নিল। কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে আসলো। তারপর খুশিকে নিয়েই ধীরে ধীরে পুলের পানিতে নামলো। তখন নাচতে নাচতে পানিতে নামতে তো চেয়েছে। কিন্তু ঠান্ডা পানির শীতলতা শরীরে লাগতেই শিরশিরানি জেগে উঠলো খুশির। খুশি প্রহরের গলা জাপটে ধরলো। প্রহর মুচকি হেসে বললো।
–কি সব এনার্জি ফুস হয়ে গেল? এইটুকু ঠান্ডাতেই কুপোকাত?

খুশি নিজের এটিটিউট ধরে রাখার প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়ে বললো।
–মোটেই না।এটা কোন ব্যাপার হলো? এইটুকু ঠান্ডা তো আমার কাছে কিছুই না।

–ইয়া শিওর। আই ক্যান সি দ্যাট।

প্রহর পুলে নেমে খুশিকে ছেড়ে দিতে নিলেই খুশি প্রহরের গলা আরও শক্ত করে ধরে তড়িঘড়ি করে বললো।
–আরে আরে কি করছ? আমি সাঁতার জানি না ডুবে যাবো তো।

প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট? তুমি সাঁতার জানো না? আর সাঁতার জানো না তাহলে পুলে নামার জন্য এতো লাফাচ্ছিলে কেন?

–ওমা সাঁতার না জানলে পুলে নামা যাবে না এমন কোন নিয়ম আছে নাকি? আর তাছাড়া তুমিতো আছোই। তুমি থাকতে আমার সাঁতার জানার কি দরকার?

–অবশ্যই দরকার আছে। প্রত্যেকটা ব্যাক্তিরই সাঁতার জানা অতি অবশ্যক। যাতে কখনো কোন বিপদে পড়লে নিজেকে রক্ষা করতে পারো।

–আচ্ছা তাহলে তুমি শিখিয়ে দাও।

প্রহর খুশির দুই পা নিজের কোমড়ের সাথে পেঁচিয়ে খুশিকে মুখোমুখি করে কোলে বসালো। তারপর বলে উঠলো।
–আগে ডুবে যাওয়া তো শেখো। তারপর নাহয় সাঁতার শিখো।

প্রহর খুশির সাথে লিপলক করে খুশিকে নিয়ে পানির মাঝে ডুব দিলো। সচ্ছ পানির গভীরতায় সিক্ত করলো নিজেদের। খুশি এই প্রথম এভাবে কোন পানিতে নেমেছে। প্রথমবার হওয়ায় খুশি একটু ভয় পেয়ে প্রহরকে শক্ত করে জাপটে ধরলো। তবে কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত হতেই খুশির ভয় কমে এলো। প্রিয়তমের সাথে এই রোমাঞ্চকর মুহূর্ত টাকে সানন্দে অনুভব করছে। মনে হচ্ছে কোন অজানা সুখের রাজ্যে ভাসছে তারা। কিছুক্ষণ পরেই আবার খুশিকে নিয়ে পানির ভেতর থেকে মাথা তুললো প্রহর। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। ঠোঁটে ভাসছে তৃপ্তির হাসি। এই অনাবিল সুখের মুহূর্ত দেওয়ার জন্য খুশিও প্রহরকে রিটার্ন গিফট দিতে পিছু পা হলো না। প্রহরের অধরে নিজের অধরের মধু ঢেলে দিলো। প্রহরও সেটা সাদরে গ্রহণ করে নিলো। চুম্বন ক্রিয়া শেষে খুশি প্রহরের কপাল থেকে গাল পর্যন্ত তর্জনী আঙুল টা স্লাইড করে আবেদনময়ী হাসি দিয়ে বললো।
♬ সুইমিং পুল মে নাহাকে, অরভি নামকিন হো গায়ে হো

হেঁসে দিল প্রহর। খুশিকে নিয়ে আরও কিছুসময় পুলের মাঝে নানারকম লীলায় মেতে উঠলো। খুশিকে পিঠে চড়িয়ে সাঁতার কাটছে প্রহর।ওদের দুজনের এই প্রেমলীলা যে আরও এক ব্যাক্তি দেখছে সেটার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ওদের। দুরবিনের সাহায্যে নজর রাখছে ওদের ওপর। ওদের দুজনের এই প্রেমলীলা তার ভেতরের আগুনে যেন ঘী ঢেলে দিচ্ছে। প্রহর খুশির এতো সুখ তার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধছে। সে মনে মনে পণ করছে ওদের এই সুখ বেশিক্ষণ টিকতে দিবেনা সে। কিছুতেই না।
___

ওরা কিছুক্ষণ রেস্ট করে সবাই আবার নিচে নেমে এলো খাওয়া দাওয়া করতে। লাঞ্চ করার জন্য ফুড কর্ণারে এলো ওরা। চারজন এসে একটা টেবিলে বসলো। মেনু কার্ড দেখে কিছু সামুদ্রিক মাছের আইটেম অর্ডার করলো। খাবার আসতে আসতে ওরা নিজেদের মাঝে আড্ডা জুড়ে দিলো।ওদের খাবার টেবিলের কিছুটা দূরেই রয়েছে রিসোর্টের বিশাল সুইমিং পুল। যেখানে অনেক লোক সুইম করছে। কথার মাঝেই ফাহিমের নজর গেল সেদিকে। ফরেনার মেয়েরা সব বিকিনি পরে সুইমিং পুলে নেমেছে। প্রহর সেটা দেখে বাঁকা হেসে বললো।
–আই মাস্ট সে প্রহর সেই একটা ফাস্টক্লাস জায়গা সিলেক্ট করেছিস তুই। চারিদিকে খালি ভিউ আর ভিউ।

ফাহিমের কথায় তিশা ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকালো। ফাহিমের এতো মুগ্ধতার কারণ বুঝতে পারলো সে। দাঁত কিড়মিড় করে ফাহিমের পায়ে পাড়া দিয়ে বললো।
–তোমার নজর আজকাল বেশিই চলছে। বলোতো একেবারে অন্ধ করে দেই কি বলো?তখন শুধু চোখের সামনে তারা ঝিলমিল করবে। ভালো হবে না বলো?

ফাহিম জোরপূর্বক হেসে বললো।
–না না থাক তোমার এতো কষ্ট করার কি দরকার? এইযে আমি কালো চশমা পরে নিলাম।
ফাহিমের অবস্থা দেখে খুশি তিশার উদ্দেশ্যে বললো।
–বাহ্ তিশা এই না হলো বাঙালি নারী,যার ষোলকলা ভারী।

আড্ডার মাঝেই খাবার চলে এলো। হাসিখুশির মাধ্যমে ওরা খাবার খেয়ে নিলো। সেই অজানা ব্যাক্তি ওদের সব গতিবিধির ওপরই নজর গেড়ে আছে। কখন কি করছে না করছে সবই পর্যবেক্ষণ করছে। ব্যাস সঠিক সুযোগের অপেক্ষা করছে সে।

খাওয়া শেষে প্রহর বললো।
–আচ্ছা শোন আজকে যেহেতু জার্নি করে এসেছি। আর বেলাও তেমন হাতে নেই। তাই আজকে আর দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। সামনের পিরেবেরের বিচটাই একটু ঘুরে আসি। কাল নাহয় অন্য কোথাও যাবো।

ফাহিম বলে উঠলো।
–জো হুকুম বস।

কিছুক্ষণ পরেই ওরা বিচের উদ্দেশ্যে বের হলো। আর ওদের পিছে গেল সেই অজানা ব্যাক্তি।
__

পিরেবেরের বিচে হাঁটছে ওরা।মাথার ওপরে বিশাল সীমাহীন নীল গগনতলে খুশির হাত ধরে বালুর চাদরে হাঁটছে প্রহর। পাশেই অসীম নীল সমুদ্রের জলরাশির অশান্ত কলতান। আর তার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে শীতল পবন। সবমিলিয়ে যেন এক অতুলনীয় দৃষ্টিনন্দিত পরিবেশ। জায়গায় জায়গায় উঁচু উঁচু নারিকেল গাছের সারি।আবার কোথাও কোথাও বালির তৈরী সুন্দর সুন্দর মূর্তি। জায়গায়টা প্রায়ই বাংলাদেশের কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের মতোই। সবকিছুই অতি মনোমুগ্ধকর। তবে এসবের মাঝে একটা জিনিসই দৃষ্টিকটু লাগছে খুশি আর তিশা দুজনের কাছেই। সেটা হলো বিচের মেয়েগুলো। সবগুলো বিকিনি পরে কেমন বেশরমের মতো এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। খুশির কেমন রাগ লাগছে। এসব দেখলে যেকোনো ছেলেদেরই নজর খারাপ হবে। তবে প্রহরের দিকে তাকাতেই খুশির সব রাগ হাওয়ায় উড়ে গেল। আনি শুধু শুধু রাগছি। আমার প্রহরের নজর তো শুধু ওর খুশিতেই আবদ্ধ। এইযে কি সুন্দর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এইসব পেত্নীদের দেখার সময় আছে নাকি ওর। খুশি ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসির রেখা টেনে দু’হাতে প্রহরের বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁধে আলতো করে মাথা এলিয়ে দিলো।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা সিবোটে উঠে কিছুক্ষণ সমুদ্রের সওয়ারী করলো। সন্ধ্যার সূর্য ঢলে পড়তেই ওরা আবারও রিসোর্টে ব্যাক করলো। রিসোর্টে ফিরে কিছুক্ষণ রিসোর্টের পুল সাইডে বসে আড্ডা দিলো ওরা। হঠাৎ প্রহরের অফিসের একটা ফোন আসায় প্রহর ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।তখনই তিশারও ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার পড়লো। তাই সে ফাহিমকে সাথে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল। প্রহর এখনো কথা বলে যাচ্ছে। খুশি বোর হয়ে উঠে একটু পুলের কাছাকাছি এগিয়ে গেল। হাতে একটা ককটেলের গ্লাস। গ্লাসের মাঝে রাখা ছাতার মতো পাইপটা ঘুরাতে ঘুরাতে হাঁটছে খুশি। হঠাৎ একটা অপরিচিত এক লোক এসে বললো ম্যাম আপনার হাসব্যান্ড আপনাকে ডেকেছে। খুশি ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো ওখানে প্রহর নেই। প্রহরকে না দেখে খুশি লোকটার কথায় বিশ্বাস করে নিলো। খুশি বললো।
–কোথায় ডেকেছে।

লোকটা হাতের ইশারায় রিসোর্টের কর্ণারের দিকে দেখিয়ে বললো ওইযে ওইখানে আছে। খুশি লোকটার ইশারা অনুযায়ী সেদিকে এগিয়ে গেল। কর্ণারের দিকে আসতেই হঠাৎ ওখানকার সব লাইট বন্ধ হয়ে। খুশি একটু ঘাবড়ে গেল।ভীতু কন্ঠে বললো।
–প্রহর? তুমি কি আছ এখানে? প্রহর?

হঠাৎ ওর সামনে কালো কোটওয়ালা মাথায় হুডি পড়া কেউ এসে দাঁড়াল ওর সামনে। লোকটার মুখের ওপর লাল আলো পড়লো। আর আলো পড়তেই লোকটার ভয়ংকর মাস্ক পড়া মুখটা দৃশ্যমান হলো খুশির সামনে। হঠাৎ করে এমন ভয়ংকর দৃশ্য দেখে খুশির ভয়ে কলিজা কেঁপে উঠল। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করারও শক্তি পাচ্ছে না ও। তখনই ঘটলো আরও ভয়ংকর ঘটনা। ওই ভয়ংকর লোকটা এবার ধারালো এক ছুরি বের করে খুশির দিকে তাক করলো। খুশির এবার ভয়ে আত্মা বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। অনেক চেষ্টা করে শেষমেশ চিৎকার দিতে সক্ষম হলো সে। দুই চোখ খিঁচে নিয়ে গলা ছেড়ে একটা চিৎকার দিলো খুশি।
–আআআআআআ!!

প্রহর ফিরে এসে কাউকে না দেখে ভ্রু কুঁচকে আসলো ওর। ফোনের নেটওয়ার্ক ঠিকমতো না পাওয়ায় একটু দূরে গিয়েছিল কথা বলার জন্য।যাওয়ার আগে তো খুশিকে পুল সাইডেই দেখেছিল। তাহলে আবার কোথায় গেল। প্রহর ফোন করলো খুশির নাম্বারে। দেখলো টেবিলের ওপরই খুশির ফোন বাজছে। প্রহর এবার একটু ঘাবড়ে গেল। খুশি ফোন রেখে কোথায় চলে গেল? একটু পরে ওখানে ফাহিম আর তিশাও চলে এলো। ওদের সাথেও খুশিকে না দেখে প্রহরের চিন্তা হতে লাগলো। ওরা সবাই এদিক ওদিক খুশিকে খুঁজতে লাগলো। তখনই হঠাৎ কর্ণারের সাইড থেকে খুশির চিৎকার শুনতে পেল প্রহর। হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল ওর।ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো মন। খু খুশি,, এটাতো খুশির আওয়াজ। খুশিইইইই…. উচ্চস্বরে ডাকতে ডাকতে সেদিকে ছুটে এলো প্রহর। এসে দেখলো খুশি চোখ বুজে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করছে। প্রহর আৎকে উঠে ছুটে এলো খুশির কাছে। দুই হাতে খুশির মুখটা ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–হেইই খুশি,, কি হয়েছে তোমার? তাকাও সোনা।
প্রহরের কন্ঠ শুনে চোখ মেলে তাকালো খুশি। প্রহরকে দেখে জাপটে ধরলো ওকে।সারা শরীর থরথর করে কাপছে ওর। আতঙ্কিত কন্ঠে বললো।
–প প প্রহর ও ও ওই…

অতিরিক্ত ভয়ের কারণে খুশি কথাও বলতে পারছেনা।খুশিকে এভাবে ভয় পেতে দেখে প্রহর ঘাবড়ে গেল। আবারও খুশির মুখটা ধরে বললো।
–হুশহুশ শান্ত হও প্লিজ। কি হয়েছে আমার সোনাটা? এমন করছ কেন তুমি? আর এখানে কেন এসেছ তুমি?

খুশি কোনরকমে নিজেকে একটু শান্ত করে বললো।
–এ একটা লোক এসে বললো তু তুমি নাকি আমাকে ডাকছো। আমি এখানে আসতেই ও ওই ভয়ংকর লোকটা আ আমাকে ছুরি দিয়ে মা মারতে চাচ্ছিল। এ এখানেই ছিলো ওই ভয়ংকর লোকটা।

প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ভয়ংকর লোক? কোথায়? এখানে তো কাওকেই দেখলাম না। আমার মনে হয় তোমার কোন ভ্রম হয়েছে। তুমি হয়তো অন্যকিছু দেখে ভয় পেয়েছ।

–না না আমি সত্যিই দেখেছি। অনেক ভয়ংকর ছিলো লোকটা। আমার ভয় করছে প্রহর। ও আমাকে মেরে ফেলবে।

প্রহর খুশিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে বললো।
–শুশ আমার জানপাখির গায়ে কেউ হাত দিতে পারবেনা। আমি আছি না? আমি থাকতে কেউ তোমাকে ছুতেও পারবেনা। ভয় নেই কোন। প্লিজ এখন শান্ত হও একটু। এতো স্ট্রেস তোমার শরীরের জন্য ঠিক না।

প্রহর খুশিকে কোলে তুলে নিল। খুশি ভয়ে একেবারে প্রহরের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে ফেললো। প্রহরের খুব চিন্তা হচ্ছে। কি এমন দেখলো খুশি? ও যা দেখেছে তাকি সত্যি? নাকি কোন ভ্রম হয়েছে ওর?

প্রহর আর খুশিকে এভাবে দেখে সেই অজানা ব্যক্তি সয়তানি হাসি হাসছে। ওদের এই করুন চেহারা দেখে তার কলিজা যেন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কেবলতো মাত্র শুরু। আগে আগে দেখো হোতা হে কেয়া? লাইফ হেল করে দেবো তোমাদের।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here