#অপেক্ষারা
৬+৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
বেলা এগারোটা। সূর্যের উত্তাপ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু এই সময়টাতেই। রোদে চারিদিক ঝাঁ ঝাঁ করছে, চোখ মেলে তাকানোর উপায় পর্যন্ত নেই। এতক্ষণ চোখে সানগ্লাস থাকলেও এবার সেটা খুলে ফেলল সায়েম। সানগ্লাসের কালচে আভায় খুঁজে পেতে অসুবিধা হচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে।
এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো পুরো ক্যাম্পাসটায় চোখ বুলিয়ে নিলো। নাহ্! কোথাও দেখা যাচ্ছে না নাজকে। গেল কোথায় মেয়েটা? একে তো বাচ্চা একটা মেয়ে, তার ওপরে আবার ঢাকা শহরে নতুন। একা একা বাসায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি তো?
ইতোমধ্যেই সায়েমের বুকে ধুকধুক শুরু হয়ে গেছে। মা মাঝে মধ্যেই ফোন করে বলেন, “তোকে বিয়ে দিতে পেরেছি, এবার আমি নিশ্চিত!” অথচ তিনি কী জানেন, বিয়ে দিয়ে সায়েমকে কতোটা দুশ্চিন্তায় ফেলেছেন? এই মেয়েটার জন্যে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় তাকে।
সায়েমের চঞ্চল চোখদুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে নাজকে, তখনই পেছন থেকে শুনতে পেল পরিচিত এক কণ্ঠস্বর।
“চলে এসেছেন?”
সায়েম পেছনে ফিরে দেখে নাজ হাসৌজ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা সবুজ রঙের ললি আইস্ক্রিম।
সায়েম কঠিন গলায় বলল, “কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
নাজের তৎক্ষণাৎ উত্তর, “আইস্ক্রিম কিনতে।”
“ওয়াট? তোমাকে না গেটের বাইরে যেতে বারণ করেছি?”
“আমি একা যাইনি তো, আমার বান্ধবীও সঙ্গে ছিল।”
“এরমধ্যে বান্ধবীও পাতিয়ে ফেলেছো?”
“হুঁ! জানেন, আমার বান্ধবী অনেক ভালো ছাত্রী। সব পরীক্ষায় হাইয়েস্ট নম্বর পায়!”
“এত ভালো ছাত্রীর তো তোমার মতো জঘন্য ছাত্রীর সঙ্গে মেশার কথা নয়। আমার তো মনে হচ্ছে হাইয়েস্ট নম্বর পায় উল্টোদিক থেকে।”
নাজ চুপ করে রইলো। নাহ্! এই মানুষটার ঘটভর্তি বুদ্ধি। উনার কাছে মিথ্যা বলা যাবে না, বললেও সাবধানে বলতে হবে।
“ভুল বললাম?”
নাজ অসহায় গলায় বলল, “আমাকে পচিয়ে শান্তি পান না? এবার আমার বান্ধবীকে নিয়ে পড়লেন?”
“আচ্ছা পড়লাম না। ব্যাগটা দাও।”
“না, আমি পারবো।”
সায়েম কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো নাজের দিকে। যে দৃষ্টি স্পষ্টই জানান দিচ্ছে, “ব্যাগটা আমাকে না দিলে খবর আছে তোমার!” নাজ বাধ্য হয়েই ব্যাগটা তুলে দিল তার কাঁধে।
সায়েম নাজকে নিয়ে রিকশায় উঠে বলল, “কেমন লাগলো ক্লাস?”
“ক্লাস তো আমি করিনি।”
“মানে? কী করেছ তাহলে?”
“ঘুরে বেড়িয়েছি।”
সায়েম ধমকের সুরে বলল, “কী? ঘুরে বেড়াতে কলেজে এসেছ তুমি?”
“শুনুন, আমাকে অযথা বকবেন না। ডাইনোসর ম্যাডাম নিজে আমাকে ঘুরতে বলেছেন?”
“ডাইনোসর?”
“সকলে প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে আড়ালে ডাইনোসর ডাকে। আপনি বুঝবেন না।”
সায়েম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি বুঝলেই হলো। শোনো, তোমার মা ফোন করেছিলেন।”
“কেন?”
“বলছিলেন তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসতে। কয়েকদিন মায়ের সঙ্গে থেকে আসবে। যাবে?”
নাজ খুব ভালো করেই জানে কেন আজই তার মা তাকে বাড়ি যেতে বলেছেন। তবে সে যাবে না। হুট করে বিয়ে দেওয়াতে এখনও মনের মধ্যে মায়ের প্রতি চাপা অভিমান পুশে রেখেছে নাজ।
নাজ অভিমানী সুরে বলল, “এতদিন কোনো খবর নেই, আজ এসেছে বাড়ি ফেরাতে। কোথাও যাবো না আমি। তাছাড়া সবে কলেজ শুরু হলো, এখন আমি কোথাও যেতে পারবো না।”
সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “তোমার হঠাৎ হলো কী বলো তো? সকালে তো কলেজে আসতেই চাইছিলে না। একদিনেই কলেজের ভক্ত হয়ে গেলে কী করে? ডিড ইউ ফল ইন লাভ?”
নাজ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কী?”
“কারও প্রেমে-টেমে পড়েছ না-কি তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
নাজ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। ছেলেটা ভাবতে পারলো কী করে যে নাজ কারও প্রেমে পড়বে? ক্লাসে কতগুলো ছেলে ছিলো, কারও দিকে সে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায়নি।
নাজ থমথমে গলায় বলল, “প্রেমে পড়া এত সহজ না-কি? আর তাছাড়া প্রেমে তারাই পড়ে যাদের প্রয়োজন আছে।”
“তোমার প্রয়োজন নেই?”
নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “না নেই।”
প্রেমের প্রসঙ্গে আরও দুয়েকটা কথা বলে নাজকে রাগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল সায়েমের। কিন্তু তার আগেই রিকশা এসে থামলো বাড়ির সামনে।
সায়েম বলল, “তুমি ওপরে চলে যাও। আমি এই রিকশা নিয়েই অফিসে যাবো।”
“আমার ব্যাগটাও সাথে করে নিয়ে যাবেন?”
ব্যাগ নিয়ে বাসায় পা রাখতেই রান্নাঘর থেকে ভেসে এলো খুন্তি নাড়ার শব্দ। জরিনাকে বাসার চাবি দেওয়া আছে। বাসায় কেউ না থাকলে সে নিজেই সময়মতো এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে কাজ শুরু করে দেয়।
দরজার শব্দ পেয়ে জরিনা রান্নাঘর থেকেই উঁচু গলায় বলল, “আফা আইছেন?”
“হুঁ। কী রান্না করছো জরিনা?”
“করলা ভাজি।”
“ছি! করলা ভাজি একটা খাবার হলো? আমি কিন্তু এসব খাবো না।”
“খাইতেই হইবো আফা। কাইল ভাইজান কইয়া রাখছে, আফনের করলা ভাজি দিয়া ভাত খাওয়া হইলে তারপর যেন আমি যাই।”
নাজ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, “উফ এই লোকটাকে নিয়ে আমি আর পারিনা! আমাকে বিরক্ত করার কোনো সুযোগ ছাড়ে না।”
জরিনা রান্নাঘর থেকে এসে নাজের দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তয় আফা, ভাইজান মানুষটা কিন্তু ভালা আছে।”
“মানুষ ভালো না মন্দ, বুঝলে কী করে?”
“এই যে আফনেরে বিয়ার পরেও কলেজে পড়াইতেছে, ভালা মানুষ না?”
নাজ চুপ করে রইলো। পড়াশোনা নামক জেলখানা যে কী যন্ত্রণাদায়ক, জরিনা মেয়েটা জানলে কখনোই সায়েমকে ভালো মানুষ আখ্যা দিতো না।
জরিনা আবারও বলল, “আমার জামাইও এই দিক থেইকা ভালা মানুষ। আমারে রোজ কয়, তোমার বাসা বাড়িতে কাম করার দরকার কী? আমি যা কামাই তাতেই তো আমগো দুইজনের হাইসা-খেইলা চলবো।”
“কী করেন তিনি?”
“প্রেরাইভেট কার চালায়। বেতন মাশাল্লাহ ভালাই পায়। বাসায় একলা একলা সময় কাটে না দেইখাই আমি কাম করি।”
“ভালো তো। সময়ও কাটলো, নিজে আয় করে স্বাবলম্বীও হতে পারলে।”
“হ! তয় আফা একটা কথা, যতই বাইরে কাম করেন – স্বামীরে বাইন্দা রাখতে হয় আঁচলের নিচে। পুরুষ মাইনষের চোখ খালি ছটফট করে, একটু সুযোগ পাইলেই বাইরের দিকে নজর দেয়।”
নাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “হয়েছে আর জ্ঞান দিতে হবে না। ওদিকে যে করলা পুড়ে যাচ্ছে সে খেয়াল আছে?”
জরিনা চিৎকার করে “আল্লা গো!” – বলে দৌড় দিলো রান্নাঘরের দিকে। নাজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, আজ আর অখাদ্য করলা খেতে হচ্ছে না।
তবে জরিনার বলা কথাগুলো খানিকটা ভাবাচ্ছে নাজকে। “পুরুষমানুষ সুযোগ পেলেই বাইরের দিকে নজর দেয়।” – এ আবার কেমন কথা? একটা সম্পর্কের পুরোটা জুড়েই রয়েছে বিশ্বাস। একটা মানুষকে বিশ্বাস না করলে তাকে ভালোবাসা যায় না-কি? একজন মানুষ যদি সত্যিকার অর্থেই তার স্বামী বা স্ত্রীকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে কি তাকে নিয়ে এধরনের সন্দেহ করতে পারে?
নাজ ফেসবুকে ঢুকল। আজকাল বেশির ভাগ সময় এখানেই কাটে তার। জরিনা বাড়িতে থাকলে তার সঙ্গে দুয়েকটা কথা বলে সময় পার করা যায়। কিন্তু সে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাজ একদম একা। একা থাকতে প্রচন্ড অস্বস্তি লাগে তার। অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসে। সেই অস্বস্তি থেকে খানিকটা হলেও মুক্তি দেয় এই ফেসবুক।
কিন্তু আজ একেবারে উল্টো চিত্র। নিউজ ফিডে ঢুকতেই অস্বস্তি কাটার বদলে বরং কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ময়মনসিংহে নাজের সবথেকে কাছের তিন বান্ধবী কনা, মালা এবং শিউলি। কলেজ থেকে বাড়ির ফিরেই আবার এদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া ছিল নাজের রোজকার রুটিন। কখনো ফুচকা খেতে, কখনো সিনেমা দেখতে, কখনো বা নদীর পাড়ে।
নাজ বিয়ের পর ঢাকায় এসে একা হয়ে পড়েছে, অথচ এরা ঠিকই নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা তিনজন ঝালমুড়ি6 খাচ্ছে এমন একটা ছবি পোস্ট করে কনা লিখেছে, ‘ফ্রেন্ডস ফরেভার’। রাগে গা কাঁপতে শুরু করলো নাজের। দলের একজন সদস্য নেই, অথচ সে দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই এদের! পোস্টটাতে অ্যানগ্রি রিয়েক্ট দিয়ে ফোন বন্ধ করে রাখলো নাজ।
সূর্য ডোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই কলিংবেল বেজে উঠলো। নাজ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক, এবার এই মানুষটাকে একটু বিরক্ত করে সময় কাটানো যাবে।
সায়েম ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকলো। তার হাতভর্তি কতগুলো প্যাকেট। বাড়িতে পা রাখতেই সোজা চলে নিজের ঘরের দিকে। যেন প্যাকেটগুলো নাজের থেকে আড়াল করার তীব্র চেষ্টা। আড়াল করার কী আছে? তার ব্যক্তিগত জিনিস নাজ ধরতে যাবে কেন?
সায়েম ফ্রেশ হয়ে বসার ঘরে এসে দেখে নাজ ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে।
সায়েম অন্য একটা সোফায় বসতে বসতে বলল, “সারাদিন কী করলে?”
নাজ হাই তুলতে তুলতে বলল, “তেমন কিছু না।”
“পড়তে বসোনি নিশ্চয়ই!”
“আমি শুধু পরীক্ষার আগের দিনই বই খুলে দেখি।”
“সেজন্যেই তো রেজাল্টের এ অবস্থা।”
“আপনাকে না বলেছি, আমার রেজাল্ট নিয়ে বাজে কথা বলবেন না।”
“আর তোমাকেও না বলেছি, আমার এখানে কোনো ফাঁকিবাজি চলবে না। কানে ফাঁকি দেওয়াটা আমি একদমই পছন্দ করি না ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল। আমার সাথে থেকে কিছুতেই খারাপ রেজাল্ট করতে পারবে না তুমি। যাও, এক্ষনি পড়তে বসো।”
“বসবো না। কী করবেন আপনি? আমাকে আপনার সঙ্গে রাখবেন না? না রাখলে আমারও দরকার নেই থাকার। দিয়ে আসুন আমাকে বাড়িতে।”
সায়েম ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট হাসির আভা ফুটিয়ে তুলে বলল, “বাড়ি দিয়ে আসবো কেন? তোমাকে শাস্তি দিবো তোমার মতো করে?”
“মানে?”
“ভাবছি ফেসবুকে একটা পোস্ট করবো। খারাপ ছাত্রী হইতে সাবধান। ভুলেও এই ছাত্রীর দশ গজের মধ্যে যাবেন না, আপনাকেও খারাপ ছাত্র বা ছাত্রী বানিয়ে ছাড়বে। আর নিচে থাকবে তোমার ছবি। ভালো হবে না?”
নাজ হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে।
সায়েম আবারও বলল, “আর আমার গুণধর বোন তো আছেই। তাকে বলবো তোমার আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে সযত্নে ট্যাগ করে দিবে।”
নাজ নিচু গলায় বলল, “আপনি এসব কিছুই করবেন না।”
“তোমার কী মনে হয় আমি ঠাট্টা করছি?”
“আমার তো তা-ই মনে হয়!”
“ঠিক আছে।”
কিছুক্ষণের মধ্যে সায়েম তার ফোনটা নাজের সামনে তুলে ধরে বলল, “কী সাংঘাতিক ব্যাপার! পোস্ট করেছি এক মিনিটও হয়নি, এর মধ্যেই সাতটা হাহা রিয়েক্ট। আজ তোমার কারণে ফেমাস হয়ে যাবো মনে হচ্ছে।”
নাজ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি সত্যি সত্যি পোস্ট করলেন?”
“মিথ্যা-মিথ্যি আবার পোষ্ট করা যায় না-কি?”
নাজ আতঙ্কিত হয়ে বলল, “ডিলিট করুন! এক্ষুনি ডিলিট করুন!”
সায়েম স্বাভাবিক ভাবেই বলল, “যতক্ষণ না তুমি পড়তে বসছো, ততক্ষণ এই পোষ্ট ডিলিট হবে না।”
নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “এত খারাপ কেন আপনি?”
“কথা বলে সময় নষ্ট না করে যাও পড়তে বসো। হাহার সংখ্যা কিন্তু বেড়েই যাচ্ছে।”
বাধ্য হয়েই পড়তে বসলো নাজ। এই লোকটা তার জীবনটাকে টিস্যু পেপার বানিয়ে রেখেছে। যে মেয়েটা তাকে বিয়ে না করে পালিয়ে গেছে, বেঁচে গেছে! নাজেরও উচিত ছিল ওই মেয়েটার মতো পালিয়ে যাওয়া।
টানা দেড় ঘণ্টা পড়াশোনা করে মাথা ভনভন করে উঠলো নাজের। একসঙ্গে এত পড়াশোনা নাজ গত দুই বছরে করেনি। আর পড়া সম্ভব না, টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নাজ। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। সেদিকেই পা বাড়ালো সে। সায়েম কী যেন রান্না করছে।
নাজ তার কাছে গিয়ে বলল, “কী রান্না করছেন?”
সায়েম গম্ভীর গলায় বলল, “পায়েস।”
নাজ উৎফুল্ল গলায় বলল, “আমি আপনাকে হেল্প করি।”
“থ্যাংকস ফর ইউর কিন্ডনেস, আমার কোনো হেল্পের প্রয়োজন নেই। তুমি পড়তে যাও।”
“পড়েই তো এলাম, আমি আর পড়তে পারবো না।”
“তোমার মতো বয়সে আমি প্রতিদিন আটঘন্টা করে পড়তাম। আর সেখানে তুমি?”
“আটঘন্টা পড়ে লাভটা কী হলো? আপনি কি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন?”
সায়েম কঠিন গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তখনই তার ফোনটা বেজে উঠলো।
সায়েম বলল, “এখানে ছয় চামচ চিনি দাও তো, আমি আসছি।”
সায়েম ফোনটা নিয়ে চলে যেতেই নাজ আগ্রহের সঙ্গে পায়েসে চিনি মেশালো। এই প্রথম তাকে কোনো একটা দায়িত্ব দিয়েছে মানুষটা।
সায়েম ফিরে এসে বলল, “চিনি দিয়েছ?”
“হুঁ।”
“কই দেখি?”
একটা চামচ দিয়ে পায়েস চেখে দেখলো নাজ। সঙ্গে সঙ্গে কুঞ্চিত হয়ে উঠল তার ভ্রু যুগল।
“সত্যিই চিনি দিয়েছ?”
“তা ছাড়া আর কী দিবো?”
“নিজেই খেয়ে দেখো!”
নাজ একটু পায়েস খেয়েই মুখ বিকৃত করে বলল, “ছিহ! আপনি একেবারেই রান্না করতে পারেন না।”
সায়েম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি রান্না ঠিকই করতে পারি, তবে আমার পায়েসে কেউ যদি লবণ মিশিয়ে দেয় – তখন আর কী করা?”
নাজ খেয়াল করলো, সত্যি সত্যিই সে লবণ মিশিয়ে দিয়েছে।
সায়েম কঠিন গলায় বলল, “একটা কাজও যদি ঠিকমত করতে পারো!”
“বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছা করে করিনি।”
“বিশ্বাস করেছি। কারণ ইচ্ছা করে করতেও বুদ্ধি লাগে। তোমার তো সে বুদ্ধিও নেই। ইডিয়ট কোথাকার!”
“শুনুন…”
তাকে থামিয়ে দিয়ে সায়েম বলল, “এই তুমি রান্নাঘর থেকে যাও তো। এখানে থাকলে একটা না একটা ঝামেলা করতেই থাকবে।”
মন খারাপ করে বারান্দায় এসে বসলো নাজ। এই লোকটা একটা অজুহাত পেলেই বকে তাকে। এত বকাঝকা করে কী মজা পায় কে জানে? নাজ ঠিক করল এখন থেকে আর কথাই বলবে না তার সঙ্গে। এতে করে যদি তার বকার পরিমাণ কমে!
এ বাড়ির বারান্দাটা বেশ সুন্দর। গ্রিলবিহীন এই বারান্দাটার রেলিংয়ের ওপরে ঝুলন্ত টবে বেশ অনেকগুলো গাছ লাগিয়েছে সায়েম। আর ফ্লোর জুড়ে ঘাসের কার্পেট। নাজ আসার পর এখানে একটা দোলনাও আনা হয়েছে। নাজ গিয়ে বসে পড়লো দোলনাটার ওপরে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় চাঁদটাকে।
নাজ প্রায়ই এখানে এসে বসে থাকে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে। প্রকৃতির কী অপরূপ সৃষ্টি। এই চাঁদের ওপরে প্রথম কদম যে রেখেছিল, সে না জানি কত ভাগ্যবান।
এভাবেই ঘন্টাখানেক বসে রইল নাজ। হুট করে সায়েম এসে বসলো তার পাশে।
তার মুখের কাছে একটা চামচ ধরে বলল, “খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে!”
নাজ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। এই মানুষটা তাকে খাইয়ে দিতে চাইছে? ভাবা যায়?
“কী হলো খাও?”
পায়েস মুখে দিতেই দ্বিতীয় দফা অবাক হয়ে উঠল নাজ। লবণের সেই কটু স্বাদ একেবারেই নেই।
“কেমন হয়েছে?”
“অনেক ভালো হয়েছে। আপনাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হলো তাই না?”
“করতেই হতো। আজ একটা বিশেষ দিন তো, তাই!”
নাজ কিছু বলল না, বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে।
“হ্যাপি বার্থডে নাজ।”
এবার যেন নাজের চোখে পানি চলে এলো। একে তো এই প্রথম মানুষটা তাকে ‘নাজ’ বলে ডেকেছে, তার ওপরে আবার তার জন্মদিনও মনে করে রেখেছে। অশ্রু লুকাতে অন্য দিকে মুখ ঘোরালো নাজ। তবে লুকিয়ে রাখতে পারলো না, সায়েম ঠিকই বুঝে ফেলল মেয়েটা কাঁদছে।
সায়েম বলল, “হয়েছে, আর কাঁদতে হবে না। তাকাও এদিকে।”
নাজ সাবধানে চোখের জল মুছে তাকালো তার দিকে।
সায়েম নাজের হাতে র্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা প্যাকেট তুলে দিয়ে বলল, “তোমার বার্থডে গিফট। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা।”
নাজ লজ্জিত গলায় বলল,“আপনি জানলেন কীভাবে?”
“জানতে হয়।”
নাজ র্যাপিং পেপার খুলছে আর ওদিকে সায়েম মিটিমিটি হাসছে। সেই হাসির অর্থ প্রথমে নাজ বুঝতে না পারলেও গিফটটা দেখার পর ঠিকই বুঝতে পারলো। গিফট নামক বস্তুটা দেখেই প্রবল রাগ তার শিরদাঁড়া প্রকম্পিত করে বয়ে গেল। এমন বিশ্রী গিফট কেউ কাউকে দিতে পারে? তাও আবার জন্মদিনে?
(চলবে)
[আজকে বড় পর্ব দিলাম কিন্তু!]