অপেক্ষারা পর্ব -৪৪

#অপেক্ষারা
৪৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে এক খন্ড আলোর বার্তা নিয়ে এসেছে চাঁদটা। আকাশে চাঁদ, আর মাটিতে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দুই নর-নারী। সায়েম আর নাজের অদ্ভুত সুন্দর এই ছবিটা তুলেছিল কনা। গতবার যখন তারা বাড়িতে গিয়েছিল, বেশ কিছু চমৎকার ছবি তুলে দিয়েছিল। সব ছবিগুলোই বিশাল ফ্রেমে বাঁধাই করিয়ে ঘরের নানান দেয়ালজুড়ে টানিয়ে রেখেছে তারা।

নতুন এই বাড়িটা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপন হয়ে উঠেছে নাজের কাছে। চার বেডরুমের এই বিশাল ফ্ল্যাটে মাঝেমধ্যে নিজেকেই হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়। সবথেকে সুন্দর ঘরটা পশ্চিম দিকে। দিনভর সূর্যালোকের আনাগোনা সেখানে। সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়ার আগেই সূর্যাস্তের লাল আভা ছেয়ে যায় ঘর জুড়ে। এই ঘরটাই নাজ আর সায়েমের। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দাটাও বিশাল।

ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বাড়ির বারান্দা থেকে দেখতে পাওয়া দৃশ্যগুলো সাধারণত খুব একটা সুখকর হয় না। একটা বিল্ডিংয়ের গায়ের সঙ্গেই আরেকটা বিল্ডিং থাকায় বারান্দা থেকে পাশের বাড়ির মেলে রাখা কাপড় ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। তবে এই বাড়িটা ব্যতিক্রম। এর গায়ের সঙ্গেই আরেকটা বিল্ডিং নেই। আছে একটা সবুজঘেরা পার্ক। বিকেল হলেই বাচ্চাকাচ্চাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে জায়গাটা। প্রায় প্রতিটি বিকেলেই নাজের কাটে বাচ্চাগুলোর আনন্দে আত্মহারা চেহারাগুলো দেখে।

তবে আজ সেসব কিছুই করছে না। অলস ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দিয়েছে বিছানার ওপরে। মনটা কেমন যেন অবশ হয়ে আছে। আশেপাশের সবকিছুই অসহ্য লাগছে। এই মন খারাপের মুহূর্তের জন্যে দায়ী সায়েম। না, দুজনের মধ্যে ঝগড়া-টগড়া বাঁধেনি। সায়েমের সঙ্গে ঝগড়া করার মতো ক্ষমতা প্রকৃতি নাজকে দেয়নি।

সায়েম আগামীকাল সকালে খুলনায় যাচ্ছে, বিজনেস ট্রিপের উদ্দেশ্যে। কোম্পানির নতুন ব্রাঞ্চ খোলা হচ্ছে খুলনায়। উপযুক্ত পরিচর্যা আর যত্ন পেলে ছোট্ট একটি নড়বড়ে চারাগাছও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে। একবার তার গোড়া মজবুত হয়ে গেলে কোনপ্রকার সাহায্য ছাড়া একাই সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তেমনি প্রথমদিকে সঠিক নির্দেশনা পেলে নতুন ব্রাঞ্চটা বেশ ভালোই উন্নতি করবে, যা কোম্পানির জন্যেই হবে লাভজনক। তাই কয়েকটা দিন সায়েমকে সেখানেই থাকতে হবে। কারণ ‘সঠিক নির্দেশনা’ দেওয়াটা কেবলমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব।

নাজ সবসময় চেষ্টা করে সায়েমের কাজে কোনো ব্যাঘাত না ঘটাতে। প্রতিটা সফল পুরুষের পেছনে না-কি একজন নারীর অবদান থাকে। অবদান না রেখে উল্টো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চায় না সে। তবুও, এতগুলো দিন তাকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবতেই একরাশ মলিনতা ছেয়ে যাচ্ছে মনে। আগামী কয়েক দিন ইচ্ছে হলেই সায়েমকে বিরক্ত করতে পারবে না। ইচ্ছে হলেই তার পরিপাটি আচড়ানো চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিতে পারবে না। ইচ্ছে হলেই তার কাঁধে মাথা রাখতে পারবে না। ক্ষণিকের দূরত্বগুলোও মাঝে মাঝে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়।

হঠাৎই নাজের ফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল তার। এই অসময়ে আবার কে ফোন করেছে? ফোনে কথা বলতেও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। এই মুহূর্তে কোনো কিছুর ওপরেই নাজ ধৈর্য ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে ফোন হাতে নিতেই স্ক্রিনের ওপর ভেসে ওঠা নামটা পড়ে মনে মনে বেশ ভালোই চমকে উঠলো নাজ। ফোন করেছে শিউলি। তাও আবার এতদিন পর? নাজ বহুবার চেষ্টা করেছে মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু কোনোবারই সে ফোন তোলেনি। তবে আজ হঠাৎ কী মনে করে? প্রচন্ড অভিমানে না একবার ভাবলো ফোনটা রিসিভ করবে না। আবার পরমুহূর্তেই মনে হলো, আহারে! কতদিন মেয়েটার সঙ্গে কথা হয় না।

নাজ ফোন রিসিভ করেই কঠিন গলায় কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল শিউলির আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর।

“নাজ! আমাকে বাঁচা!”

নাজ কিছুটা ভড়কে গিয়ে বলল, “শিউলি? কী হয়েছে তোর? তুই ঠিক আছিস?”

শিউলি অসহায় গলায় বলল, “না, আমি ঠিক নেই। তোর আমাকে বাঁচাতেই হবে। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকলে আমি মরেই যাবো?”

নাজ উঠে বসতে বসতে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “এখানে মানে? কোথায় তুই? কী হয়েছে তোর?”

“আমার শাশুড়ি এক সপ্তাহ হলো মারা গেছেন। সেই থেকে শিহাব আমাকে জীবনটাকে অতিষ্ট করে রেখেছে। বলছে, আমি অপারেশনের টাকা যোগাড় করে দিতে পারিনি বলেই না-কি ওর মা মারা গেছে।”

শিউলি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। নাজ কী বলবে বুঝতে পারছে না। কী হচ্ছে এসব?

শিউলি কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “আমি তো একবার টাকা দিয়েছিলাম। মা সব গয়না বিক্রি করে টাকা পাঠিয়েছিল। একবার অপারেশন করানোও হয়েছিল। তারপর ডাক্তার বলে আবারও অপারেশন করাতে হবে, কী যেন সমস্যা রয়ে গেছে। আমি এত টাকা কোথা থেকে জোগাড় করি বল তো? মা তো তার যা ছিল, সবটুকুই দিয়েছে।”

নাজ আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “তুই শান্ত থাক শিউলি। তোর হাসব্যান্ড অতিরিক্ত শোকে পাথর হয়ে এমন কান্ড করছে। আসলে যে শাশুড়ির মৃত্যুতে তোর কোনো দোষ নেই সেটা সেও জানে।”

“না রে দোস্ত। তুই ওকে চিনিস না, আমি চিনি। এতকাল ধরে সহ্য করে আসছি।”

“কী সহ্য করে আসছিস?”

“বিয়ের পরদিন থেকে আমাকে উঠতে বসতে খোঁটা দিচ্ছে। কথায় কথায় বলে বাপের বাড়ি ফিরে যেতে। নিজের পছন্দে বিয়ে করে এসেছি, চাইলেই তো বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারি না। তোকে মিথ্যা বলেছিলাম, আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শিহাব দিতে দেয়নি। শাশুড়ির অসুস্থতার অজুহাতে আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি বাড়ির কাজের লোককে বিদায় করে দিয়েছে। তবুও মুখ বুজে সহ্য করে ছিলাম, কিন্তু এখন…”

নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “এখন কী শিউলি?”

“দ্বিতীয়দফায় অপারেশন টাকা যোগাড় করতে না পারার পর থেকে ও ক্রমাগত আমার গায়ে হাত তোলে। আমার শরীরের একটা জায়গাও অবশিষ্ট নেই যেখানে ওর দেওয়া আঘাতের চিহ্ন নেই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না নাজ। কোনদিন দেখবি ওর হাতে মরে গেছি।”

কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই নাজের চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠলো। হাত-পা তার থরথর করে কাঁপছে। প্রকৃতি দুহাত উজাড় করে মায়া-মমতার মতো শক্তিশালী অনুভূতিগুলো দিয়ে শিউলিকে তৈরি করেছে। মেয়েটা তার আশপাশের সকলকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে জানে। এমন একটা মেয়ের তো কোনো রাজপ্রাসাদের রাণী হয়ে থাকার কথা। আর তার কিনা হয়েছে এমন করুণ পরিণতি? তাও আবার যে মানুষটাকে ভালোবাসে বিয়ে করলো তার হাতে?

নাজ নিচু গলায় বলল, “আমাকে আগে বলিসনি কেন?”

শিউলি কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলল, “ভেবেছিলাম তাতে শিহাবের অপমান হবে। কী করবো বল? ভালোবেসেছিলাম তো!”

ভালোবাসা জিনিসটা এমন কেন? ভালোবাসার মানুষটা যতই কষ্ট দিক না কেন, এই অনুভূতি তার প্রতি একবার জন্মালে এই জীবনে ছেড়ে যায় না।

নাজ কিছু একটা ভেবে দৃঢ় গলায় বলল, “তুই চিন্তা করিস না, আরেকটু সহ্য কর। ওই শিহাবের শেষ আমি দেখে ছাড়বো।”

শিউলিকে চিন্তা করতে না বলে নাজ নিজেই দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ঘরজুড়ে পায়চারি করছে মেয়েটা। কোনোকালেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো সাহস বা ইচ্ছা দেখা যায়নি শিউলির মাঝে। তাই অন্যায় কিছু ঘটলে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ তার প্রাণের বান্ধবীরাই করে এসেছে। সেই সময়ে সকলে ছিল একই এলাকাই। বাড়ির জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করলেই যেন কয়েক মিনিটের মাঝে জড়ো হয়ে যেত সকল বান্ধবীরা। কিন্তু এবার কী হবে? আজ তো আর সকলে একই এলাকায় নেই। একেকজনের বসবাস একেক শহরে। চাইলেই তো একজন আরেকজনের বিপদে ছুটে যেতে পারে না। নাজ কী করে উদ্ধার করবে শিউলিকে? মাথায় কিছুই কাজ করছে না। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আসছে।

মনের অজান্তেই নাজের হাতটা চলে গেল মোবাইলের ওপরে। কনাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাতে হবে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভাবনা-চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে নাজ। কনাকে ফোন করেই একটা বুদ্ধি চাইতে হবে।

একটা রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল কনার উৎফুল্ল কণ্ঠ, “আরে ভাবি সাহেবা! হঠাৎ আমাকে পড়লো যে?”

নাজ থেমে থেমে বলল, “কনা? তোর মনে আছে বিয়ের পর প্রথম যেবার আমি বাড়ি গিয়েছিলাম, সেবার শিউলির হাজবেন্ডকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে ওর বাড়ির সামনে ময়লা ফেলে রাখার প্ল্যান করেছিলাম।”

“করেছিলি তো! কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর গেলি না। তুই যাবি না দেখে আমরাও আর যাইনি। কত কষ্ট করে দুই বালতি দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা জোগাড় করেছিলাম, সব কষ্ট তোর জন্যে জলে গেল।”

নাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শিহাবকে শিক্ষা দেওয়াটা বাকি রয়ে গেছে বুঝলি? এবার দিতে হবে।”

“মানে?”

নাজ পুরো ঘটনার খুঁটি-নাটি খুলে বলল কনাকে। পরবর্তী কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল নিস্তব্ধ নিরবতায়। কনা কিছু একটা বলতে চাইছে, তবে বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে বারবার। শিউলির মতো চমৎকার একটা মেয়ের সঙ্গে এমন নির্মম ঘটনা ঘটতে পারে তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।

অবশেষে নিরবতা ভঙ্গ করে কনা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এটা কী করে সম্ভব? তুই তো কখনো ওদের প্রেমটা দেখিসনি, আমি আর মালা দেখেছি। শিহাবভাই তো এমন মানুষ ছিল না। প্রতিটা মুহূর্ত শিউলির জন্যে পাগল হয়ে থাকতো। ওর গায়ে সামান্য একটা আঁচড় পড়লেও দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়তো। সেই একই মানুষটা কী করে শিউলির গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে পারে?”

“হয়তো তার তরফ থেকে কেবল প্রেম ছিল বলেই পারে। ভালোবাসাটা কোনোদিন ছিল না।”

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না নাজ। আমরা এখন কী করবো?”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “আমি জানি না। আমার মাথা কাজ করছে না।”

“নাজ? আমরা বরং শিউলির বাবা-মাকে বিষয়টা জানিয়ে দিই। উনারা চিটাগংয়ে গিয়ে শিউলিকে নিয়ে আসুক।”

“আমার মনে হয় না তাতে কাজের কাজ কিছু হবে।”

“কেন?”

“ওর বাবা-মা জানতে পারলে বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করবেই না, বরং মেয়েকে বলবে মানিয়ে চলতে।”

কনা প্রায় অনেকটা সময় কী যেন ভেবে বলল, “তাহলে চল আমরা সেখানে যাই।”

“আমরা? তুই ময়মনসিংহে আমি ঢাকায়, আমরা কী করে যাবো? তাছাড়া তোর ভাইয়া কাল বিজনেস ট্রিপে যাচ্ছে। ফিরতে ফিরতে এক সপ্তাহ। আমি তো আর একা একা অত দূর যেতে পারবো না।”

“তাহলে বরং এক কাজ করি। আমি আর মালা ঢাকায় চলে যাই, সেখান থেকে সকলে আবার চিটাগংয়ে যাবো।”

“ব্যাপারটা যতটা সহজ ভাবছিস, ততটা সহজ কিন্তু না। মাকে কী বলবি? আর তোর ভাইয়াকে? তোর ভাইয়া জীবনেও আমাদের একা একা অন্য একটা শহরে যেতে দেবে না। আর যেখানে এমন পারিবারিক ঝামেলা আছে সেখানে তো একেবারেই। সে নিজে সবসময় ঝামেলা এড়িয়ে চলে, আমকেও ঝামেলার ধারের কাছে ঘেঁষতে দেয় না।”

“ভাইয়াকে বুঝিয়ে বল। আমরা না গেলে মেয়েটা তো মরে যাবে।”

“বললেও লাভ হবে না। উনিও বলবে শিউলির বাবা-মাকে জানাতে। যাদের মেয়ে তারা বুঝবে।”

“তাহলে আর কী করা? সত্যি কথায় কাজ না হলে মিথ্যার আশ্রয়ই নিতে হবে।”

“মানে?”

“ভাইয়া তো কাল বিজনেস ট্রিপে যাচ্ছে তাই না?”

“হুঁ।”

“আমি এখন ভাইয়াকে ফোন করে বলি, এতগুলো দিন একা একা থাকতে তোর কষ্ট হবে তাই আমরা গিয়ে তোর সঙ্গে থাকবো। এতে ভাইয়া বরং খুশিই হবে, মায়েরও কোনো আপত্তি থাকবে না। তারপর ঢাকা থেকে আমরা চিটাগংয়ে চলে যাবো, কেউ জানতেও পারবে না।”

নাজ শুকনো মুখে বলল, “উনাকে মিথ্যা বলবো?”

“উফ নাজ! জীবনে দুয়েকটা মিথ্যা বললে ক্ষতি হয় না।”

“কিন্তু আরও একটা সমস্যা আছে।”

“আবার কী সমস্যা?”

“এতটা পথ আমরা একা একা যাবো?”

“একা কোথায়? আমি, তুই আর মালা – আমরা তিনজন মানুষ!”

“তবুও… আমরা ভয় করছে। একে তো অচেনা একটা শহর, তার ওপরে আবার অমন আবুসিভ একটা ছেলে।”

“এক কাজ করি, পাহারাদার হিসেবে বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসি।”

“বাবাকে সঙ্গে নিয়ে চিটাগংয়ে যাবো? উনাকে কী বলবি?”

“বলবো যে একদিনের জন্যে আমরা চিটাগংয়ে যাচ্ছি শিউলির সঙ্গে দেখা করতে। বাবা যেন পাহারাদার হিসেবে আমাদের সেখানে নিয়ে যায়। ভাইয়া রাগ করবে, এজন্যে তাকে যেন কিছু না বলে। বাবা সহজ-সরল মানুষ। তাকে যদি একবার বারণ করি, সে কিছুতেই ভাইয়াকে বলবে না।”

কনার কথায় তেমন একটা ভরসা পেল না নাজ। তবুও এই মুহূর্তে ভরসা করা ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পেল না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে আগে শিউলিকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে হবে।

রাত দশটা সতেরো মিনিট। ব্যস্ত ভঙ্গিতে সায়েমের সুটকেস গোছাচ্ছে নাজ। সকাল সকাল তার ফ্লাইট, নাজ বারবার দেখছে কোনো কিছু বাদ পড়লো কি-না। ছেলেটা সাতদিন সেখানে থাকবে, কিছু একটা বাদ পড়লে তারই কষ্ট হবে। সায়েম বিছানার ওপরে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাজের ব্যস্ততামাখা মুখটার দিকে।

নাজ সুটকেস গোছাতে গোছাতে বলল, “শুনুন! একদম সিগারেট-টিগারেট খাবেন না। আর যেখানেই যাবেন সাথে করে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যাবেন। চার্জ ফুরিয়ে গেলে আমি আবার ফোন পাবো না। আর সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করবেন। আমাকে যেন বারবার ফোন করে মনে করিয়ে দিতে না নয়।”

সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “এসব না বলে একবার থেকে যেতে বললেই তো পারো।”

“বললেই বুঝি আপনি থেকে যাবেন?”

“থেকে যেতেও তো পারি।”

“মোটেও না। কাজে ফাঁকি দেওয়া আমার একদম পছন্দ নয়। ভালোবাসা ভালোবাসার জায়গায় আর কাজ কাজের জায়গায়। কোনো একটার জন্যে আরেকটা অবহেলা করা ঠিক নয়।”

সায়েম অবাক গলায় বলল, “ইউ সাউন্ড লাইক মি।”

নাজ তার স্নিগ্ধ হাসিটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “কী আর করা? তোমার সঙ্গে থেকে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“আমার তো তোমার সঙ্গে থাকাটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। এই কয়টা দিন কী করে থাকবো বলো তো? এক কাজ করো, নিজেকেও এই সুটকেসে ভরে দাও।”

“অভ্যাস তো আমারও হয়ে গেছে। বিয়ের পর তোমাকে ছেড়ে এতগুলো দিন থেকেছি কখনো? আগে যখন আমরা আলাদা আলাদা ঘরে থাকতাম, তখন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে দুজনে একই ছাদের নিচে তো আছি। ইচ্ছে হলেই তোমার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতাম, মানুষটা কী করছে। জেগে আছে না ঘুমিয়ে পড়েছে।”

সায়েম লক্ষ করলো নাজ একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখদুটো জলে টলমল করছে, যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। নাজ প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের জল ধরে রাখতে, কিন্তু সেই চেষ্টা বেশিক্ষণ সফল হবে বলে মনে হচ্ছে না।

সায়েম তড়িৎ গতিতে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তার প্রেয়সীকে। ছেলেটার বুকে মাথা রাখতেই কানে ভেসে এলো তার অস্থির গতিতে স্পন্দিত হতে থাকা হৃদয়ের ধ্বনি। নিজেকে ধরে রাখা আর সম্ভব হলো না নাজের পক্ষে। দুয়েক ফোঁটা অবাধ্য অশ্রু টুপটাপ করে গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে।

সায়েম কোমল স্বরে বলল, “কান্না চেপে রাখার দরকার নেই। আমি তো চাই আমার জন্যে কাঁদো, আমার অ্যাবসেন্সে অস্থির হয়ে থাকো, আমাকে মিস করো।”

সকাল সকাল ফ্লাইটের জন্যে তৈরি হচ্ছে সায়েম। অফিস থেকে একটু পর পরই ফোন আসছে। সকলে ইতোমধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে। বাদ রয়ে গেছে কেবল সায়েম। সায়েম যথেষ্ট সময় সচেতন একটা মানুষ। কোথাও নির্ধারিত সময়ের পর গিয়েছে, এমন দৃশ্য বিরল। আজও যে দেরি হয়েছে তা নয়। অফিসের অন্যান্যরা আগে আগেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে। নিজেরা আগে আগে পৌঁছে সায়েমকে তাড়া দেওয়ার অর্থ কী কে জানে?

সায়েম ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতঘড়িটা পড়ছে, তখনই আবার বেজে উঠলো মোবাইলটা। নিতান্ত অনিচ্ছায় মোবাইলটা তুলে কানের কাছে ধরলো সায়েম। এক হাতে হাতঘড়ি পড়ার চেষ্টা করার কোনো অর্থ নেই। তবুও সায়েম ফোনে কথা বলতে বলতে সে চেষ্টা করছে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা খেয়াল করে নাজ তার কাছে এগিয়ে গেল। সায়েমের হাতটা সরিয়ে দিয়ে সে নিজেই অতি যত্নে ঘড়িটা পড়িয়ে দিল তার হাতে।

সায়েমের কথা শেষ হতেই নাজ নিচু গলায় বলল, “আমি আপনাকে ছেড়ে দিতে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাই?”

“উহুঁ। পরে এয়ারপোর্ট থেকে এতটা পথ একা এক বাসায় ফিরবে কী করে?”

মুহূর্তেই একরাশ অপরাধবোধ জেঁকে ধরলো নাজকে। যে মানুষটা সামান্য এয়ারপোর্ট থেকেই নাজকে একা ছাড়তে ভরসা পায় না, তাকে না জানিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা একটা শহরে যাওয়াটা অন্যায়। জানালে যে সায়েম তাকে কিছুতেই সেখানে যেতে দেবে না খুব ভালো করেই জানে নাজ। সেজন্যেই তো এমন লুকোছাপা।

কিন্তু একবার সেখান থেকে ফিরে এসেই মানুষটাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবে নাজ। সায়েমের কাছ থেকে সে অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কিছুও লুকিয়ে রাখতে পারে না। আচ্ছা এসব ঘটনা শোনার পর সায়েম কি তাকে বকবে? রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দেবে? যা হবার দেখা যাবে। একবার ওই নরক থেকে শিউলিকে উদ্ধার করে আনুক, বাকিটা শক্ত হাতে সামাল দেওয়া যাবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here