অবেলায় তুমি পর্ব -১৩+১৪

#অবেলায়_তুমি (পর্ব-১৩)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ

তনু ডেস্কের উপরে থাকা কলমদানির মধ্যে থেকে ফল কাঁটার ছুরিটা নিয়ে আকাশের গলায় চেপে ধরে আকাশকে চোখ খুলতে বলে। আকাশ তনুর কথায় চোখ খুলে দেখে তনু তার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে ধরে আছে। আকাশ চোখ বড় বড় করে আশ্চর্য হয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে। আর তনু আকাশের আশ্চর্য হয়ে তাকানো দেখে জোরে জোরে পৈচাশিক ভাবে হাসতে আরম্ভ করে। তনুর হাসি দেখে মনে হচ্ছে তনু এই দিনটার জন্য বহু সময় ধরে অপেক্ষা করে বসে ছিল। আকাশ পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে তনুর আচরণে। বুকের ভিতরে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন উথাল-পাতাল করতে শুরু করেছে আকাশের। চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তেই তনু ছুরিটা চালিয়ে দিয়ে আকাশের নিশ্বাস বন্ধ করে দিতে পারে। আকাশের কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। আকাশ এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার তাড়নায় নড়াচড়া করতে থাকে। আকাশকে নড়াচড়া করতে দেখে পাশ থেকে তনু আকাশকে বলে,

–‘নড়াচড়া করিস না। তাহলে আরো কিছুটা সময় বেশি বাঁচতে পারবি। না হয় নড়াচড়া করলে রাগের মাথায় তোর উপরে এখুনি চালিয়ে দিব।’

আকাশ নড়াচড়া বন্ধ করে দেয় তনুর কথায়। এরপর করুণ সুরে তনু জিজ্ঞাস করে,

–‘তনু আমার সাথে কেন তুমি এমনটা করছো? আমি তো অনেক বড় কোনো অন্যায় করিনি তোমার সাথে। আর যেটা করেছি সেটার জন্য তো তুমি আমাকে শাস্তি দিয়েছো। তাহলে কেন আবারো এমন করছো তুমি আমার সাথে?’

–‘কারণ তোকে না মা’রা অব্দি আমার শান্তি হবে না। আর তুই আমার সাথে যেই অন্যায়টা করেছিস সেটা তোর কাছে সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে নয়। তাই তোকে এবার সাজা পেতে হবে। আমি তোকে দুনিয়ায় কোলাহল থেকে মুক্ত করে দিব। তোর মতন মানুষ দুনিয়ায় বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই।’

–‘তনু প্লিজ এমনটা করো না। আমার বাসায় মা আর ছোট বোন আছে। আমার কিছু হলে ওরা না খেয়ে ম’রবে।’

–‘ক্ষমাআমায় কর তুই। তোর অনুরোধ টা আমি রাখতে পারবো না। আর তোর মা-বোন না খেয়ে ম’রলে তাতে আমার কি? আমি তো প্রতিশোধ নিব’ই।’

আকাশের বুকের ভিতরটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। চোখের কোণে পানি এসে জমা হয়েছে। অবশ্য আকাশের ভয়টা নিজেকে নিয়ে নয়। ভয়টা হচ্ছে ছোট বোন আফিয়া এবং তার মা’কে নিয়ে। তার কিছু হলে তার মা-বোনের দেখাশোনা করার মতন কেউ নেই। আকাশ চোখের কোণে পানি নিয়ে আবারো তনু অনুরোধ করে বলে,

–‘তনু আমায় না মা’রলে কি হয় না? আমি এতো জলদি ম’রতে চাই না। আমি অন্তত দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করার আগে মা আর বিশেষ করে আফিয়ার জন্য কিছু করে যেতে চাই। প্লিজ আমায় এবারের মতন ক্ষমা করে দাও।’

আকাশ তনুর কাছে অনুরোধ করার সময় এবার আকাশের চোখের কোণে জমে থাকা পানি গুলো নিজের অবস্থান ত্যাগ করে আকাশের গাল বেয়ে পড়তে থাকে। সাথে দাঁড়িয়ে থাকা তনু আকাশের চোখ বেয়ে পানি পড়তে দেখে হাতে থাকা ছুরিটা ফিক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দেয়। এরপর বানরের মতন টুকুস করে লাফিয়ে আকাশের কোলের মধ্যে বসে আকাশের গালে দু’হাত রেখে বলে,

–‘এই পাগল তুমি কান্না করছো কেন? আমি তো তোমার সাথে এতো সময় ধরে মজা করছিলাম। আর দেখো তুমি কাঁদছে শুরু করেছো। আরে পাগল আমি তোমায় মা’রতে যাবো কেন বলো তো? তুমি কি আমার পাকা ধানে মই দিয়েছো নাকি? তাহলে কেন আমি তোমায় মা’রতে যাবো। আমি তো তোমার সাথে এতোটা সময় মজা করছিলাম। আর কাউকে মে’রে ফেলা কি এতো সহজ? অফিস ভর্তি মানুষ। আমার ভিতরে যদি ঐরকম কোনো কিছু থেকেই থাকতো, তাহলে আমি তোমায় অন্য কোথাও নিয়ে যেতাম। এই অফিসের মাঝে এসব করতাম না। আকাশ আমি সত্যিই মজা করেছি। আর তোমার উপরে গত পাঁচ বছর আগেরকার বিষয় নিয়ে এখন আমার আর কোনো অভিযান নেই। হ্যাঁ একটা সময় ছিল। তবে সেটা এখন শেষ হয়ে গিয়েছে। কারণ মানুষ বলতেই ভুল। তাছাড়া মাও বলেছে অতীতের বিষয় নিয়ে বর্তমানে রেষ মেটানোটা বোকামো। যা হয়েছে সেসব গত পাঁচ বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি তোমার উপরে আর রেগে নেই। আর একটু আগের সব কিছু ফাজলামো ছিল। এবার দেখি শান্ত হও।’

তনু আকাশের সাথে এতোটা সময় ফাজলামি করেছে কথাটা শুনে আকাশের স্বস্তি ফিরে আসে। আকাশের দুশ্চিন্তা কমে যায়। তবে সে চুপ করে থাকে। কোনো প্রকার কথাবার্তা বলেনা তনুর সাথে। ভিতরে প্রচন্ড অভিমান জন্মায় তনুর উপরে আকাশের। তনু আকাশকে চুপ করে থাকতে দেখে বুঝে ফেলে আকাশের ভিতরে অভিমান জন্মেছে। আকাশের অভিমান কমাতে তনু নিজেই দু’হাত দিয়ে আকাশের চোখের পানি মুছে দেয়। কিন্তু আকাশের তাও কোনো রেসপন্স নেই। আগের ন্যায় চুপ করে আছে সে। মনে হচ্ছে যেনো আকাশের শরীরে মরিচা ধরেছে।
একদম শান্তশিষ্ট হয়ে আছে আকাশ। পুতুল যেমন চুপ করে থাকে। আকাশ ও ঠিক একই পাবে পুতুলের বৈশিষ্ট্যকে বহন করে চুপ করে আছে। আকাশের এমন চুপসে থাকার কারণ ফাজলামোর একটা লিমিটেশন থাকা উচিৎ। ফাজলামো বা দুষ্টামি মানুষ মুখের মার্জিত ভাষায় করে। না হয় অন্য ভাবে করলে সেটার লাজ লেহাজ থাকতে হয়। কিন্তু তনু যেটা করেছে সেটা ফাজলামো বা দুষ্টামির কাতারে পড়ে না। এই রকম দুষ্টামির কারণে মানুষ ভয় পেয়ে এমনিতেই স্ট্রোক করে মা’রা যেতে পারে। আর এজন্যই তনুর উপরে প্রচন্ড অভিমান টা জন্মেছে আকাশের। অপরদিকে তনু নিজের হাত দিয়ে আকাশের চোখের পানি মুছে দেওয়ার পরেও যখন দেখে আকাশের অভিমান কমেনি, তাই সে আর কোনো কিছু না ভেবে আকাশের শার্ট খামচে ধরে উন্মাদের মতন শুরুতে আকাশের গলায় কয়েকটা চুমু বসায়। এরপর কিছুক্ষণ যেতেই আকাশের গলা ছেড়ে আকাশের ঠোঁট টাকে রপ্ত করে নেয়। তনুর মাত্রা ছাড়া পাগলামি দেখে আকাশ জোরপূর্বক তনুকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

–‘তনু এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।’

–‘কি ঠিক হচ্ছে না?’

–‘এই যে তুমি আমার শরীরে স্পর্শ করছো।’

–‘তাহলে কাকে শরীরে স্পর্শ করবো? অন্য কোনো পরপুরুষ কে?’

–‘না মানে আসলে তা নয়…

–‘আরে আজব তা নয়তো কি? আমি আমার স্বামীর সাথে রোমান্স করছি এতে বেঠিকের কি আছে? আমি তো অন্য কোনো পরপুরুষের সাথে রংতামাশা করছি না। যা করছি নিজের স্বামী বা হাজবেন্ডের সাথেই করছি। তাহলে কি ঠিক হচ্ছে না শুনি?’

আকাশ চুপ হয়ে যায়। কারণ তনুর কথা যুক্তিসঙ্গত। তনুর অধিকার আছে আকাশের সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার। অবশ্য আকাশের ও রয়েছে। তবে বেচারার পরিস্থিতি খারাপ দেখে হয়তো সে তনুর কাছাকাছি যাওয়ার সাহস করেনি কখনো। এখানে অনেকেই মনে করবে পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে। আর আকাশ হয়তো ভীতু প্রকৃতির ছেলে। আসলে বিষয়টা কিন্তু এমন না। পরিস্থিতি বুঝে সব করতে হয়। আকাশ নিজেকে সংযত করে রেখেছে ভদ্রতার খাতিরে। না হয়তো সে চাইলেও জোর খাটাতে পারে তনুর উপরে। তবে ভদ্রতার পাশাপাশি আকাশের চাকরি হারানোর ও একটা ভয় আছে। তাই আকাশ নিজেকে সামলে রাখে সর্বদা। আকাশ তনুর যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে চুপ হয়ে যায়। অন্যদিকে তনু আকাশকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে,

–‘দেখো আমি যা করছি সেসব আমার অধিকার থেকে করছি। অযথা আমাকে বাঁধা দিতে আসবা না একদম।’

তনু আবারো আকাশের ঠোঁটে নিজের অধিকার খাটায়। এবার আকাশের ভিতরেও একটা অ্যাট্রাকশন বা আকর্ষণ তৈরী হয় ঠিক কারেন্টের মতন।
যেমন- বৈদ্যুতিক তারের মাইনাস এবং প্লাস দু’টো যখন একসঙ্গে মেলানো হয়, তখন তাঁদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়। এখানেও ঠিক তাই হয়েছে। তনুর কারণে আকাশের ভিতরেও এক রকমের একটা প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়েছে। আকাশ নিজেও এবার তনুকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। দু’জনের ভিতরে ভালোবাসার এক নতুন সিক্ততা জন্ম নিয়েছে। দুজনের মতামতে এই প্রথম স্পর্শ। সারা শরীরে যেনো প্রজাপতির সাত রঙ ছড়িয়েছে। তনু মৌমাছির ন্যায় বারংবার আকাশের ঠোঁটে হুল ফুটাচ্ছে। তনুর স্পর্শে আকাশের নিজেকে কেমন বেসামাল লাগছে। অবশ্য আকাশ নিজের নিয়ন্ত্রনে আছেই বা কোথায়! একজন পুরুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তার প্রেয়সী। আর সে প্রেয়সীকে যদি এতো কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখা যায় তবে কি নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব! আকাশ ও তনুর আচরণে সাড়া দেয়। সামান্য কিছু সময়ে দু’জন এতো গভীর ভাবে মিশে গেছে, যে তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে যেনো এই দু’টো মানুষ বহু জন্মের পরিচিত। তাঁদের সংসার জীবনের একযুগ পূর্ণ হয়েছে। বেশ কিছু সময় আকাশ আর তনু ব্যক্তিগত সময় কাটায়। কিছুক্ষণ পর তনু নিজেই আকাশকে ছেড়ে দেয়। আর বলে,

–‘হয়েছে এবার গিয়ে কাজ মন দাও। সারাদিন দু’জন মিলে এভাবে রোমান্স করে সময় কাটালে অফিসের বারোটা বাজবে। যাও গিয়ে কাজ করো। আর না হয় যা ইচ্ছে হয় করো। তবে আমাকে এখন কাজ করতে হবে।’

–‘এই আজব! আমি তোমাকে বলেছি নাকি রোমান্স করতে? শুরু এবং শেষ সবটাই তো তোমার ইচ্ছেতে হলো। তাহলে এখন আমায় কেন দোষ দিচ্ছো?’

–‘এই যে মহাশয় আপানকে কোনো দোষ দেইনি। আমি শুধু বলেছি কাজের বারোটা বাজবে সারাদিন দু’জনে এসবে মেতে থাকলে।’

–‘ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি।’

–‘হুম যাও।’

–‘যেতে তো দাও।’

–‘আজব আমি আবার তোমায় কোথায় আটকালাম?’

–‘কোল থেকে না নামলে যাবো কি করে শুনি?’

–‘ওহ আচ্ছা ভুলে গিয়েছিলাম।’

তনু আকাশের কোল থেকে নেমে যায়।
আর আকাশ ও তনুর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। এমন সময় তনু আকাশকে বলে,

–‘যাও এবার। আর শুনো দুপুর হলে কেবিনে চলে এসো। দু’জনে একসাথে দুপুরের লাঞ্চ করবো।’

–‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

আকাশ কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য হাঁটা দিয়ে কয়েক কদম সামনে যেতেই তনু আবারো পিছন থেকে আকাশকে ডাক দেয়।

–‘এই আকাশ শুনো।’

–‘আবার কি হলো?’

–‘দেখো আজ থেকে তোমাকে আর অফিসের কেউ কিছু বলার সাহস পাবে না। আর তোমার যা ইচ্ছে হয় তুমি করতে পারবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা। অফিসে অসংখ্য মেয়ে কর্মচারী আছে। তাঁদের দিকে তুমি ভুলেও তাকাবা না। এমনকি তারা তাকালেও তুমি তাকাবা না। এখন কিন্তু তোমার সাথে অনেকেই ভাব জমানোর চেষ্টা করবে। কারণ ইতিমধ্যেই সবাই জেনে গেছে তুমি আমার খুব কাছের লোক। তাই সবার থেকে সাবধানে থাকবা। বিশেষ করে মেয়েদের থেকে। না হয় কিন্তু তোমার অবস্থা বারোটা বাজিয়ে দিব বলে দিলাম।’

–‘আচ্ছা ঠিক আছে সাবধানে থাকবো। এবার গেলাম।’

আকাশ কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে চলে যায়। তনুও নিজের কেবিনে বসে কাজ করতে আরম্ভ করে। দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হয়ে গেছে। এভাবে সাপ্তাহ খানিক কাটে। কেটে যাওয়া এই এক সাপ্তাহে দু’জনের সম্পর্ক আগের চেয়েও আরো অনেক গুণ মজবুত হয়েছে। দু’জনে দুপুর টাইমে একসাথে লাঞ্চ করে। তনু আকাশকে অফিস ছুটি হলে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দেয়। এমনকি তারা দু’জনে এক সঙ্গে একদিন ঘুরতেও বেরিয়েছিল। সাপ্তাহ খানিক পর সোহান একদিন হুট করে তনুর অফিসে আসে। আকাশ নিজের ডেস্কে বসে ছিল। কিন্তু সে সোহানকে দেখতে পেয়ে নিজের ডেস্ক ছেড়ে উঠে সোহানের কাছে যায়। এরপর হেঁসে হেঁসে
সোহানকে বলে,

–‘সোহান ভাই আপনি কিন্তু কাজটা ঠিক করেন নি।’

–‘কি ঠিক করি নি?’

–‘এই যে তনু আর আপনি মিলে প্রেমের নাটক সাজিয়ে আমাকে বোকা বানাতে চেয়েছেন। আমি কিন্তু জেনে গেছি, যে আপনি আর তনু মিলে আমাকে প্ল্যান করে বোকা বানাতে চিয়েছিলেন।’

–‘আকাশ সাহেব আপনার মাথায় কোনো সমস্যা টমস্যা আছে কি?’

–‘না কোনো সমস্যা নাই। আর সমস্যা কেন থাকবে?’

–‘তাহলে কি সব উল্টো-পাল্টা বলছেন? আমি আর তনু মিলে আপনাকে বোকা বানাবো এমন কোনো প্ল্যান এই তো আমরা করিনি। তাহলে আপনি এইসব আজগুবি প্ল্যান সম্পর্কে জানলেন কোথা থেকে শুনি?’

সোহানের কথা শুনে আকাশের মাথার টনক নড়ে উঠে। কারণ তনু বলেছে সব কিছু নাটক ছিল। কিন্তু এখন সোহান বলছে এমন কোনো প্ল্যান এই তারা করেনি। তনুর সাথে সোহানের কথার কোনো মিল এই নেই। তার মানে তনু তাকে যা বলেছে সব কিছুই মিথ্যা। তনুর সাথে হয়তো সত্যিই সোহানের কোনো সম্পর্ক ছিল বা এখনো আছে। এবং সেই সঙ্গে তনু তাকে প্রতিনিয়ত ঠকাচ্ছে…..
#অবেলায়_তুমি (পর্ব-১৪)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ

সোহান আর তনুর সম্পর্কের বিষয় নিয়ে তনু বলেছে সব কিছুই তাঁদের সাজানো নাটক ছিল। কিন্তু এখন সোহান বলছে এমন কোনো প্ল্যান এই তারা করেনি। তনুর সাথে সোহানের কথার কোনো মিল এই নেই। তার মানে তনু তাকে যা বলেছে সব কিছুই মিথ্যা। তনুর সাথে হয়তো সত্যিই সোহানের কোনো সম্পর্ক ছিল বা এখনো আছে। এবং সেই সঙ্গে তনু তাকে প্রতিনিয়ত ঠকাচ্ছে। তনুকে নিয়ে খটকা লাগতে শুরু করে আকাশের। মনের ভিতরে কৌতূহল জাগে বিষয়টা নিয়ে। তনু কি সত্যিই তাঁকে ঠকাচ্ছে। কৌতূহল মেটাতে সোহানকে প্রশ্ন করে,

–‘আচ্ছা তার মানে আপনারা আমাকে বোকা বানাবেন এমন কোনো প্ল্যান করেন নি?’

–‘না এমন কোনো প্ল্যান আমরা করিনি। আর এমন প্ল্যান করবোই বা কেন? তনু আর আমি সত্যিকারত্বে বয়ফ্রেন্ড- গার্লফ্রেন্ড। তাহলে আমরা আপনাকে বোকা বানানোর জন্য প্ল্যান করতে যাবোই বা কেন? কি লাভ এতে আমাদের?’

সোহানের কথা শুনে আকাশের সন্দেহ সত্যি হয়। তনু তাকে যা বলছে তাহলে সব কিছুই মিথ্যা ছিল।
দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে৷ কিন্তু আকাশের এবার আরেকটা ব্যাপার নিয়ে খটকা লাগে। সোহান বলছে সে আর তনু সত্যিকারত্বে প্রেমিক-প্রেমিকা। তাহলে সেদিন যখন তনু তাকে ফোন করেছিল তখন সোহান তনুকে দোস্ত বলে কেন সম্মোধন করছিল। নাহ এখানে হয়তো কোনো গন্ডগোল আছে। আর এই গন্ডগোলের সমাধান পাওয়া যাবে তনু আর সোহান মুখোমুখি হলে। কারণ দুই পক্ষ যেহেতু দু’রকমের কথাবার্তা বলছে তাহলে অবশ্যই যে কোনো একজন কথার গড়মিল করছে। হয় সেটা সোহান না হয় তনু। ব্যক্তিগত ভাবে আর প্রশ্ন না করে আকাশ চালাকি করে সোহানের সামনে থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ায়। আকাশ সরে যাওয়ায় সোহান কেবিনের দরজা খুলে অনুমতি নিয়ে তনুর কেবিনে প্রবেশ করে। সোহান তনুর কেবিনে প্রবেশ করার কয়েক সেকেন্ড পর বিনা অনুমতিতে আকাশ সোজা তনুর কেবিনের ভিতরে ঢুকে পড়ে। সোহান আর তনু দু’জনেই চমকে উঠে আকাশকে হুট করে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে। আকাশের চোখে-মুখে রাগ। আকাশের ইচ্ছে করছে পুরো কেবিন টাকে মাথায় তুলে নিতে। কিন্তু কোনো ভাবে নিজেকে কন্ট্রোল করে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের হাবভাব বুঝতে না পেরে তনু আকাশকে প্রশ্ন করে,

–‘এই তুমি হুট করে কোনো কথাবার্তা ছাড়া এভাবে কেবিনে ঢুকে পড়লে যে?’

–‘ইচ্ছে হয়েছে তাই ঢুকেছি। কেন অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করে ভুল করে ফেলেছি নাকি?’

–‘না ভুল করো নি৷ তোমার অধিকার আছে কেবিনে ঢুকার। কিন্তু হুট করে আসলে তো তাই জিজ্ঞাস করলাম।’

–‘ভুল না করলেই হলো। এবার আমার কথার উত্তর দাও। তুমি সেদিন আমায় বলেছো তুমি আর সোহান ভাই মিলে যা করেছো সব কিছুই তোমাদের সাজানো নাটক ছিল। কিন্তু একটু আগে আমি সোহান ভাইকে ঐ বিষয়ে জিজ্ঞাস করায় সোহান ভাই সোজা অস্বীকার করলো। তোমাদের মধ্যে নাকি এমন কোনো কথাবার্তাই হয়নি। আর সোহান ভাই নাকি তোমার সত্যিকারত্বে বয়ফ্রেন্ড। কাহিনী কি তনু আমায় সত্যি করে বলো। আমার কিন্তু মাথায় রক্ত চোটে যাচ্ছে। কখন কেবিনের পরিবেশ পাল্টে যায় তার কিন্তু কোনো ঠিক নাই বলে দিলাম।’

–‘আরে আকাশ তুমি অযথা রাগ করছো। তুমি আগে চেয়ারে বসো। তারপর আমি তোমায় বলছি।’

–‘আমি এখানে বসতে আসিনি। যা বলার এখুনি বলো। আমার উত্তর চাই।’

–‘আচ্ছা ঠিক আছে বলছি। আকাশ যা বলেছি সব কিছুই সত্যি। আমি তোমায় কোনো মিথ্যা বলিনি। সব কিছুই আমাদের প্ল্যান ছিল।’

–‘তাহলে সোহান ভাই কেন আমায় বললো তোমরা এমন কোনো প্ল্যান করোনি? আর উনি তোমার সত্যিকারত্বে বয়ফ্রেন্ড। কাহিনী কি? যদি তোমার কথা আসলেই সত্যি হয়, তাহলে কেন আমায় সোহান ভাই ঐরকমটা বলছে?’

–‘আকাশ কাহিনী কিছুই না। আর সোহান সত্যিই আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড না। এই সোহান তুই প্লিজ ওকে সত্যিটা বলে দে। না হয় আমার উপরে ঘূর্ণিঝড় আসবে। আমি আকাশকে সত্যিটা বহু আগেই বলে দিয়েছি।’

–‘ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার। তুই তাহলে নিজেই আকাশ সাহেবকে সব সত্যি বলে দিয়েছিস। আমিও তো বলি উনি এই ব্যাপারে জানলো কোথা থেকে! আকাশ সাহেব শুনুন তনু যা বলেছে সব কিছুই সত্যি। আমরা প্ল্যান করেই আপনার সাথে ঐরকমটা করেছি। আর একটু আগে আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছি। কারণ আমি জানতাম না তনু আগেই আপনাকে সব সত্যি বলে দিয়েছে। যার কারণে একটু আগে আমি সত্যিটা স্বীকার করিনি।’

সোহানের কথা শুনে আকাশের স্বস্তি ফিরে আসে। তবে রাগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। কারণ আকাশ এই সম্পর্কের মধ্যে কোনো প্রকার ঝামেলা চায়না। সে চায় সম্পর্কে লয়্যাল থাকার পাশাপাশি পরিপাটি ভাবে সম্পর্কটা নিজেও নিভাবে। এবং তনুর থেকেও সে একই জিনিস আশা করে। কিন্তু সম্পর্কের মধ্যে নতুন করে কান্ড ঘটায় আকাশের রাগের মাত্রা বেড়ে গেছে। চোখ বড় বড় করে তনুর দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশ। অপরদিকে তনু আকাশকে তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,

–‘এই তুমি এখনো কেন রেগে আছো? সোহান তো তোমাকে সমস্ত সত্যি বলেই দিয়েছে। তাও অযথা কেন রাগ করে আছো বলো তো?’

–‘রাগ করে আছি কেন সেটা তোর জানতে হবে না। তুই উনাকে এখন এখান থেকে চলে যেতে বল। আমার সত্যিই বেশ রাগ উঠছে। আর কিছু সময় গেলে নিজেকে কন্ট্রোল করা আমার জন্য কিন্তু দুষ্কর হয়ে যাবে।’

আকাশের হাবভাব দেখে এবং আকাশের কথা শুনে তনু নিজেও বুঝতে পারে আকাশের সত্যিই প্রচন্ডভাবে রাগ উঠে আছে। সোহানের এখন এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। না হয় কখন কি হয় তার কোনো ঠিক নেই। পরিস্থিতি যে কোনো সময় ভয়ানক রূপ ধারণ করতে পারে। পরিস্থিতিকে অনুকূলে রাখার জন্য তনু সোহানকে বলে,

–‘সোহান তুই এখন চলে যা। আমি কোনো সমস্যা হোক সেটা চাচ্ছি না। এমনিতেই আকাশ রেগে আছে। তার উপরে ওর কথা না শুনলে আমার উপরে যে কোনো সময় বিপদ আসতে পারে। তুই প্লিজ এখন চলে যা।’

–‘ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি।’

সোহান চলে যায়। আকাশের ভিতরে এখনো রাগ কাজ করছে। সোহান চলে গেছে কিন্তু আকাশ নিজের রাগ এখনো কমাতে পারেনি। সেই আগের ন্যায় রাগ রয়ে গেছে আকাশের মধ্যে। সোহান চলে যাওয়ার পরেও তনু আকাশকে রেগে থাকতে দেখে চেয়ার থেকে উঠে এসে আকাশের গালে হাত রেখে বলে,

–‘সোহান চলে গেছে। এবার তো রাগটা কমাও। আর কতো রাগ করে থাকবে?’

আকাশ কোনো উত্তর দেয় না। তনু আকাশকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করাতে উল্টো আরো বিস্ফোরণ ঘটে আকাশের ভিতরে। আকাশের ইচ্ছে করছে তনুকে কঠিন একটা শিক্ষা দিতে। কিন্তু সেটা করা উচিত হবে কিনা আকাশ ভাবছে। তখনি আকাশের মনে হয় নিজের মনকে কিছু সময় প্রাধান্য দেওয়া উচিত। না হয় সব সময় মনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলে মনের সাথেই নিজের একটা দ্বন্দ্ব শুরু হবে। আকাশ নিজের মনকে প্রশ্রয় দিয়ে সোজা তনুর গলা চে’পে ধরে তনুকে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে বলে,

–‘মোবাইল ফোন ছুঁড়ে মে’রে কপাল ফাটিয়েছিস, কিন্তু আমি কিছু বলিনি। গরম চা ছুঁড়ে মে’রে পেটে ফোস্কা ফেলেছিস, কিন্তু আমি কিছু বলিনি। অফিসের সকল কর্মচারীর সামনে সামান্য একটা ভুলের কারণে আমায় যেভাবে ইচ্ছে হয়েছে লজ্জিত করেছিস, কিন্তু আমি তাও কিছু বলিনি। তবে আগামীতে যদি তোকে আমি সোহানের সাথে বিনা প্রয়োজনে মিশতে দেখি, তাহলে তখন কিন্তু আর চুপ করে থাকবো না। আজকের পর সোহানের সাথে তোর সমস্ত বন্ধু পিরীতি বন্ধ। অযথা কোনো কারণে না ফোনে কথাবার্তা বলবি না সামনা-সামনি। এক কথায় ওর সাথে কোনো কারণ ছাড়া কথাবার্তা বলবি না। মনে থাকবে আমার কথা?’

তনু কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। আকাশ সব কিছু ফেলে সোহানের পিছনে কেন পড়েছে সেটা তনু বুঝে উঠতে পারছে না। চুপ করে আকশের দিকে তাকিয়ে আছে তনু। কথার উত্তর না পেয়ে আকাশ তনুকে প্রশ্ন করে,

–‘কি হয়েছে কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন? আমার কথা কি তোর কানে যায়নি?’

–‘হ্যাঁ গিয়েছে।’

–‘তাহলে উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছিস কেন? উত্তর দে।’

–‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি আর সোহানের সাথে কোনো দরকার ছাড়া কথাবার্তা বলবো না।’

–‘মনে থাকে যেনো।’

–‘হুম থাকবে।’

আকাশ তনুর জবানবন্দি পেয়ে তনুর গলা ছেড়ে দিয়ে বলে,

–‘নে এবার ছেড়ে দিলাম। আগামীতে বিনা প্রয়োজন সোহানের সাথে কোনো কথাবার্তা বলতে দেখলে তোর শ্বাসনালী সজোড়ে চে’পে ধরবো। এবারের মতন বেঁচে গেছিস। পরেরবার গলা চে’পে ধরলে কিন্তু সোজা উপরে চলে যাবি বলে দিলাম।’

–‘না আমি আর কোনো কারণ ছাড়া সোহানের সাথে কথাবার্তা বলবো না। কারণ আমি চাই না ওর কারণে আমাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হোক।’

–‘হুম আমিও এই কারণে বিনা প্রয়োজনে কথা বলতে না করেছি।’

–‘হুম।’

–‘সরি তনু।’

–‘ওমাহ সরি কেন?’

–‘তুইতোকারি করার জন্য এবং রেগে গিয়ে গলা চে’পে ধরার জন্য।’

–‘আরেহ সমস্যা নেই। আমি বুঝতেই পেরেছিলাম তোমার অনেক রাগ উঠেছে।’

–‘ধন্যবাদ বুঝার জন্য। আচ্ছা এবার আমি গেলাম।’

–‘না এখন আর যেতে হবে না। আর অল্প সময় বাকি আছে লাঞ্চ টাইম হওয়ার৷ একেবারে লাঞ্চ করে তারপর যেও।’

–‘আচ্ছা ঠিক আছে লাঞ্চ করে যাবো। তবে এখন গিয়ে খাবার নিয়ে আসি।’

–‘আজব! তুমি খাবার আনবে মানে?’

–‘ওমাহ কেন কি হয়েছে? আমি তোমার এ্যাসিস্ট্যান্ট। আমি খাবার আনলে সমস্যা কোথায়?’

–‘অনেক সমস্যা আছে। তুমি এ্যাসিস্ট্যান্ট সেটা ঠিক আছে। তবে তুমি আমার হাজবেন্ড ও। আগে না হয় বুঝিনি দেখে তাই তোমাই ফরমাইশ করেছি এটা ওটা করতে। তবে বর্তমানে বুঝার পর একই ভুল আবার করবো সেটা হতে পারে না। আমি নিজে বসে থেকে তোমাকে খাবার আনতে পাঠাবো সেটা তুমি ভাবলে কি করে? তুমি বসো। আমি কেন্টিনে ফোন দিলেই তারা খাবার পাঠিয়ে দিব। তোমার অযথা কষ্ট করে যেতে হবে না।’

–‘আচ্ছা।’

তনু কেন্টিনে ফোন দিয়ে দু’টো খাবার পার্সেল করতে বলে। তনুর কথা মতন কিছু সময় পর কেন্টিন থেকে একটা ছেলে দুইটা খাবারের পার্সেল তনুর কেবিনে দিয়ে যায়। হাত ধুয়ে আকাশ আর তনু খেতে আরম্ভ করে। খাওয়ার এক পর্যায়ে তনু মোহাব্বত করে এক লোকমা খাবার নিজের হাতে আকাশকে খাইয়ে দেয়। আকাশ ও তনুর দেখাদেখি একই কাজ করে। এক লোকমা খাবার নিয়ে সেও তনুকে খাইয়ে দেয়। দু’জন দু’জনকে মোহাব্বত দেখানোতে ব্যস্ত। কিন্তু তাদের কোনো আইডিয়াই নেই তাঁদের সামনে যে একটা বাঁধা আসতে চলেছে। আকাশের কথায় তনু সোহানকে চলে যেতে বলায় সোহান তাঁদের সামনে কোনো রিয়াকশন না করলেও ভিতরে ভিতরে বেশ অপমানবোধ করে বিষয়টা নিয়ে। সোহানের অনেকটা গায়ে লেগেছে দু’জনের আচরণ। বেশি গায়ে লেগেছে আকাশের টা। কারণ তনু নিজ থেকে এমনটা করেনি। আকাশের কথাতেই সে এমনটা করেছে। সোহান প্রতিশোধ নিবে বলে একটা ফন্দি করতে করতে বাসায় ফিরে আসে। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিজের পরিবারের সদস্যদের সাথে খেতে বসে। খাওয়ার মাঝামাঝি অবস্থায় সোহানের মা রোকেয়া বেগম সোহানকে বিয়ের বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাস করে সে বিয়ের বিষয় নিয়ে কিছু ভেবেছে কিনা। সোহান নিজের মা’কে জানায় সে বিয়ে করতে রাজি। এবং সেই সঙ্গে ফোন থেকে তনুর ছবি বের করে নিজের মা’কে দেখিয়ে বলে তনুকে সে বিয়ে করতে চায়….

চলবে….

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।)
চলবে….

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here