গল্পঃ #অসময়ে_রোদন (৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
অরুণ আমার বাচ্চাকে বিক্রি করে দিয়েছে শুনে আমার সারাশরীরে কম্পন ধরে গেলো!
অরুণের মা এই কথাটা বলে হুহু করে কাঁদছে, কিন্তু আমি কেমন যেন পাথরের মতো স্থির হয়ে আছি। কোনো একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছিনা, তবে বিকট আওয়াজের সাথে শুনতে পাচ্ছি আমার ভেতরটা চিৎকার করছে, বুক ফেটে উচ্চারণ হচ্ছে ছিহ! ছিহ! একজন বাবা নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দিতে পারে? কিন্তু একটা কথাও মুখ ফুটে বাইরে প্রকট হচ্ছেনা।
হঠাৎ দেখলাম চারপাশ কেমন ঘূর্ণায়মান লাগছে, চারপাশ ঘুরছে নাকি আমি ঘুরছি বুঝতে পারছি না। তৎক্ষনাৎ ফয়সাল ভাই আমাকে ধরে বললো,
___তুই তো পড়ে যাচ্ছিস! আবিদা, শক্ত হ! স্নেহা যেখানেই থাকুক আমরা ফিরিয়ে আনবো। আবিদা আবিদা?
নাহ শক্ত হতে পারলাম না। পড়ে গিয়েও পড়লাম না, ফয়সাল ভাই ততক্ষণে আমাকে শক্ত করে ধরে নিয়েছে। অরুণের মাও আমাকে ধরে সেই বাসার ভেতর নিয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পরে আমি অনেকটাই ঠিক হলাম। খেয়াল করলাম অরুণের মামার বউ, উনার বাচ্চারা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আমি ফয়সাল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___ভাই চলো, আমি এখন ঠিক আছি, সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
অরুণের মা আমার পাশে বসে বললো,
___ তুমি আমাকে মাফ করে দিতে পারবে তো?
আমি চুপ করে রইলাম। উনি বিনয়ের সাথে আবার বললেন,
___মা হওয়ার যোগ্যতা তো আমি নিজেই বিনষ্ট করেছি। অপরাধ করেছি! তবুও তুমি আমাকে একজন অপরাধী মা হিসেবে পারবেনা ক্ষমা করতে?
আমি কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই বিছানার ডান পাশের বালিশটা সাথে স্নেহার একটা ছবি দেখলাম, আমি ছবিটা টান দিয়ে আনতেই আরেকটা ছবি বের হলো। সেটা ছিল আমার আর অরুণের বিয়েরদিনের ছবি। পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম, তবে সেদিন বেনারসি ঠিকি পরেছিলাম। অনেক ছবিও তুলেছি! আমি ছবি দুটো হাতে নিয়ে বললাম,
___এই ছবি?
অরুণের মা ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,
___তোমাদের এই ছবিটা ময়লার ঝুড়িতে পেয়েছিলাম, অরুণ নয়তো ওর বউ হয়তো কোথাও পেয়ে ফেলে দিয়েছিলো। আর স্নেহার ছবিটা সিনথিয়ার কাছ থেকে চেয়ে এনেছি!
আমি অরুণের মা’র দিকে তাকিয়ে বললাম,
___স্নেহাকে আপনি কখনো আমার ছবি দেখিয়েছেন?
আমার প্রশ্নটা শুনে তিনি চুপসে গেলেন। পাশ থেকে উনার ভাইয়ের স্ত্রী বললেন,
___ হ্যাঁ আপা গত চারদিন আগে দেখিয়েছিলো। বলেছিলো এটা ওর আম্মু। এই কথা অরুণ শুনে ফেলেছিলো, তারপর যা-তা বলেছে। সিনথিয়া রিকুয়েষ্ট করলে স্নেহাকে দেখাতে আনে প্রায়ই, কারণ আপা স্নেহাকে দেখতে সবসময় পাগল হয়ে থাকে। আর স্নেহাও ওর দিদিমণির জন্য পাগল।
কিন্তু সেদিন বলে গেছে আর কোনোদিন দেখাতে আনবেনা, কারণ উনি নাকি স্নেহাকে আলাদা করে দিতে তার আসল মায়ের পরিচয় দিচ্ছে!
আমি আনমনে চাপা কান্নায় মুখ চেপে ধরলাম। ফয়সাল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___ ভাই দেখলে তুমি? আমার মেয়ে আমাকে সেদিন অল্প দেখেই চিনে ফেলেছে। সে আমাকে আম্মু বলে ডেকেছিলো!
আমার কথা শুনে অরুণের মা অস্থির হয়ে জানতে চাইলো, স্নেহাকে কোথায় দেখেছি, কেমন আছে!তখন আমি উনাকে বিস্তারিত বললাম।
তারপর আমি মর্মাহত চেহেরায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
___ জানেন, স্নেহা ওই মেয়ের সাথে থাকতে চায়না, তার চোখমুখ কেঁদে লাল হয়ে ছিল। তারপর সেখানে অরুণ আসলো, এসে রিকশায় করে কোথাও গেলো। জানিনা এরপর কি হলো!
অরুণের মা বললো,
___তুমি ঠিক বলেছো, স্নেহা সিনথিয়ার সাথে থাকতে চায়না। দু একদিন পর পর অরুণ কিংবা আমাকে না দেখলে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাই সিনথিয়া ওকে নিয়ে আসে দেখা করাতে। অরুণ স্নেহার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও সে বলে, আমি তোমার সাথে থাকতে চাই আঙ্কেল।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
___ আঙ্কেল?
বিমর্ষ মুখে তিনি বললেন,
___হ্যাঁ সেটাই শিখিয়েছে। সেদিন যখন তোমার ছবি দেখিয়ে বললাম, এটা তোমার আসল আম্মু। তখন সে বলে, পাশের আঙ্কেলও কি তাহলে আমার আসল আব্বু? আমি সেটা বলতে পারিনি, তার আগেই এসন শুনে অরুণ রেগে গিয়েছিলো। এই যে ছবিটা এটা কাঁচের ফ্রেমে বাঁধিয়েছিলাম, কিন্তু সেদিন এটা অরুণ ছুঁড়ে ফেলে একদম ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে। সে চলে যাওয়ার পরে আমি একটা একটা কাঁচ তুলে আবার যত্ন করে আবার আমার শোবার পাশে রেখেছি।
উনার কথাগুলো বলতে যেমন চোখ গড়িয়ে জল পড়ছিলো, তেমন আমার ভেতরটাও দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। আমি উনার মাথায় রেখে বললাম,
___আপনার উপরে আমার আর কোন রাগ,কষ্ট নেই। তবে যা করেছেন তা আর ফেরাতে পারবেন না। আর তার জন্য হয়তো বাকিটা জীবনই আপনাকে রোদন করে যেতে হবে। অসময়ে রোদন!
বলেই বিদায় নিয়ে আমি সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম। ফয়সাল ভাইও আমার সাথে সাথে এসে দরজা খোলে দিলো। আর অরুণের মা চুপ সেখানেই বসে আছে।
আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফয়সাল ভাই বললো,
___ সময় বের কর, আমরা অরুণ এবং তার বউয়ের সাথে খুব শীগ্রই দেখা করবো।
আমি বললাম,
___ আমার ভয় লাগছে! বাচ্চা এখন অরুণের কাছেও নেই, আছে সিনথিয়া নামক কোনো এক মেয়ের কাছে, তাও সে কিনে নিয়েছে! এখন কি করে আনবো?
আচ্ছা ফয়সাল ভাই আমি আমার মেয়েকে আনতে পারবো তো?
মুচকি হেসে ফয়সাল ভাই বললো,
___আমি আছি তো! অবশ্যই স্নেহাকে ফিরিয়ে আনবো, এবং খুব তারাতাড়ি!
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উনাকে বিদায় দিলাম। বাবাও এতক্ষণ আমাদের কথা শুনছিলো। ফয়সাল ভাই চলে যাওয়ার পরে আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে বললো,
___ দেখলি তো ছেলেটা এখনো তোকে কতটা ভালোবাসে!
বাবার কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত গলায় বললাম,
___ কি বলছো বলোতো? আমি একজন ডিভোর্সি, তার উপর এক বাচ্চার মা। আর ফয়সাল ভাই এখনো অবিবাহিত। ভাই আমার জন্য যা করছে তা আত্মীয়তার সূত্রে শুধুই করুণা। বিপদে আছি বলে তা আমিও গ্রহণ করছি। এর চেয়ে বেশি আশা করা অনুচিত।
বলেই আমি ছুটে আমার রুমে চলে গেলাম। সেদিনও বাবা ফয়সাল ভাইকে নিয়ে কথা বলেছিলো! কেন জানি এই ক’দিন ধরে আমারও মনে হচ্ছে, সত্যিই যদি অরুণকে বিশ্বাস করার মতো ভুলটা না করতাম! বাবার খুশির দিকে তাকিয়েও যদি সব মেনে নিতাম! আজ এই পরিণতি দেখতে হতোনা।
তবে যা হবার তো হয়েই গেছে, পেরিয়ে সে গেছে সময়। এখন যা আছে সবই আফসোস, রোদন, আর হাহাকার !
‘
‘
শুক্রবার।
ফয়সাল ভাই এবং আমার দুজনেরই ছুটির দিন। শুনেছি অরুণ বাসা বদলেছে, খুঁজে বের করতে দেরি হতে পারে। এরপর আবার ওদের সাথে কথা বলে সিনথিয়া নামক মেয়েটার পরিবারের সঙ্গেও দেখা করা লাগতে পারে। তাই সকাল সকাল রওয়ানা দিয়ে দিলাম। অরুণের মায়ের থেকে ঠিকানা নিয়ে তারাতাড়িই বাসা বের করে ফেললাম।
তাদের বাসাটা বাইরে থেকেই বড্ড রুচিশীল আর দুর্দান্ত। ভাড়ায় থাকে নাকি ফ্ল্যাট কিনেছে জানিনা, তবে অরুণের এতো টাকা হওয়ার কথা না। আবার ভাড়ায় থাকলেও প্রতিমাসে অনেক টাকা দিতে হয় হয়তো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ জাঁকজমক।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কলিংবেল চাপলাম। সাথেই দরজা খোলে ঘর্মাক্ত মুখে একটা কিশোরী দাঁড়ালো, দেখে মনে হলো কাজ করে।
আমি বললাম,
___বাসার মালিক আছে? ডেকে দাও তো।
মেয়েটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
___আচ্ছা দিচ্ছি!
বলেই সে ভেতরে গিয়ে ডাকলো। ভেতর থেকে উঁকি দিতে দিতে একটা সর্ট আর টি শার্ট পরোয়া মেয়ে বের হলো। তার মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া প্রবল বললেও কম হবে। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, টি শার্ট যে পরেছে সেটাও কোনো রকম উপর পর্যন্ত ঢেকে আছে, পেট পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। তার লাল চুলগুলো ঘাঁড় পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। হাতে ছেলেদের মতো কতগুলো অদ্ভুত ফিতা। মেয়ে হয়েও এমন বেশ দেখে আমারই কেমন লজ্জা লাগছিলো। ফয়সাল ভাই অন্যদিক ফিরে আছে।
মেয়েটা এসেই এক হাত গলায় বুলিয়ে বামদিক তাকিয়ে উদাস স্বরে বললো,
___অরুউউউন দেখো কে আসছে!
ডাকার সাথে হন্তদন্ত হয়ে অরুণ এসে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে তখনি দেখলো আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
অরুণ কিছু বলার আগেই আমি বললাম,
___ আপনি কি কি করেছেন সেসবের হিসাব চাইলে আপনি আজীবনেও পার পাবেন না। থাক সেসব, এখন বলেন আমার মেয়ে কোথায়? আমি তাকে যে কোনো মূল্যে ফিরিয়ে নিতে চাই।
আমার কথা শুনে অরুণের বউ ঠোঁট বেঁকে বললো,
___আচ্ছা যে কোনো মূল্যে নিতে পারবে? কতো মূল্য আছে তোমার কাছে?
এটা শুনে আমি চুপ করে গেলাম, আমি কি মূল্য বললাম আর কি মূল্য বলছে? আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু তখনি ফয়সাল ভাই বললো,
___কতো মূল্য লাগবে বলুন?
মেয়েটা এবার ফয়সাল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকালো, তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
___আচ্ছা আপনি দিবেন? কে হন উনার? অবৈধ প্রেমিক টেমিক?
অরুণ ওর বউয়ের কথার সাথে আরো তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বললো,
___আরে এমনই হবে কিছু, তবে ফুফাতো ভাই লাগে। একটা সময় বিয়ে ঠিক হয়েছিলো ওর সাথে , সেটা ভেঙে গেছে বেচারির। এবার মনে হয় ভাবছে বিয়ে ছাড়াই রঙঢঙ চলুক ।
অরুণের কথায় আমার সারা শরীর জ্বলছিল, রাগে কটমট করছিলাম। অনেক সহ্য করেছি আর পারছিনা! আমার রাগের তীব্র পর্যায়ে ফয়সাল ভাই আমার হাত ধরে বললো,
___আজই বিয়ে করবি আমায়?
আমি রাগের মাত্রা কমিয়ে অবশ চোখে উনার দিকে তাকালাম। আঙুলে আঙুল রেখে কোনো এক সময়ের প্রিয় মানুষটার সামনে আরেকটা মানুষের চোখে চোখ। কি করুণ এই দৃশ্য!
চলবে……