অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩৩.

0
451

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৩.

বিয়ের প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার একদিন পরেই শুরু হয় তিনদিনের বাকি আচার অনুষ্ঠান। প্রথম দিনেই যেই অনুষ্ঠান হয় তার নাম হাম্মাম দিবস। এটি উদযাপনের জন্য মূলত নববধূ এবং তার মহিলা আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধুরা একসাথে হাম্মামে যায়। হাম্মাম দ্বারা বুঝানো হয় পাবলিক স্টিম বাথ। এইদিন নববধূ সাদা রঙের পোশাক পরিধান করে যা পবিত্রতা এবং বিশুদ্ধতার প্রতিনিধিত্ব করে।

রাবাতে অবস্থিত একটি পাবলিক হাম্মাম সকল মহিলাদের জন্য ভাড়া করা হয়েছে। তাওয়ালের মতো কেবল সাদা কাপড় পেঁচিয়ে সকল মহিলাদের মাঝে বসে থাকতে বেশ লজ্জা লাগছে ল্যায়লার। যতই সে মরক্কোর মেয়ে হোক না কেন, এধরনের অনুষ্ঠান আগে কখনো সে দেখে নি। তাই এতো লজ্জা লাগছে তার। কিন্তু তার আশেপাশে সকলকে দেখে মনে হচ্ছে তারা খুব উপভোগ করছে। ফারাহ, নাহাল সহ আরো বেশ কয়েকজন আত্মীয় স্বজনরা হাম্মামের মাঝে গান ছেড়ে নাচতে ব্যস্ত।

এতসব কিছুর মাঝে ল্যায়লা করার মতো কিছুই পাচ্ছে না। কারণ এই অনুষ্ঠানের আরেকটা রীতি হলো নববধূ কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকে এবং বাকি মহিলারা তাকে রাণীর মতো সেবা করে। ল্যায়লা মনে মনে ভাবছে ফাতিহর কথা। গতকাল রাবাতে ফেরার পর থেকে এখনো ঠিকঠাক কথা বলার সুযোগ পায় নি সে। আগামীকাল পর্যন্ত ওর এই মহিলাদের সাথেই দিন কাটাতে হবে।

ল্যায়লার ভাবনার মাঝেই তার শাশুড়ী এগিয়ে এসে তার পাশে বসে। উনার হাতে একটা ট্রে তে বেশ কিছু জিনিস পত্র। ফাতিহর মা ফাতিমা বেগম হেসে বলে উঠে,

“ তুমি অনেক বোর হচ্ছো আম্মু? “

ল্যায়লার ভেতরটা ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ফাতিহর পরিবারের সাথে তার পরিচয় হয়েছে মাস খানেক হবে। প্রথমে সে খুব ভয়ে ছিলো আদৌ ফাতিহর পরিবার তাকে মেনে নিবে কিনা! কিন্তু একবার সকলের সাথে পরিচয় হওয়ার পর তার সকল চিন্তা দূর হয়ে যায়। ল্যায়লা এখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, জীবন থেকে একটা মানুষ যা কিছু হারায় আল্লাহ সেই সকল কিছু দ্বিগুণ রূপে তাকে ফিরিয়ে দেয়।

এটা সত্যি যে ল্যায়লা ছোটবেলা থেকে কখনো মা, বাবা কিংবা পরিবারের ভালোবাসা পায় নি। অথচ এতো বছর পর এসে এখন সে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। ফাতিহর বাবা-মার উছিলায় সে মেয়ের ভালোবাসা পাচ্ছে। তার নানু বাড়ির সকলের মাধ্যমে তার পরিবারের অভাব ঘুচে গিয়েছে। আর কি চাই তার? এসব কিছুর জন্য সে আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া জানায় প্রতিদিন।

ভাবনায় বিভোর ল্যায়লার চোখ জোড়া নিজের অজান্তেই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। তা দেখে ফাতিমা বেগম ব্যস্ত হয়ে বলে উঠে,

“ আরে! কাঁদছো কেন? ল্যায়লা? কিছু হয়েছে? “

উনার কণ্ঠস্বর শুনে আশেপাশের সকলেই জোড়ো হয়ে যায় সেখানে। ল্যায়লা হেসে এরাবিকে বলে উঠে,

“ শুকরান লাকিয়া মামা। “

যার অর্থ,

“ ধন্যবাদ মা। “

ফাতিমা অবাক স্বরে প্রশ্ন করে,

“ ধন্যবাদ কিসের জন্য? “

“ আমাকে ভালোবাসার জন্য। “

ফাতিমা অবাক হয়। পরমুহূর্তেই হেসে ল্যায়লাকে পরম স্নেহ নিয়ে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। একদম স্বচ্ছ মনের। হাম্মামের এক কোণে বসে থাকা ল্যায়লার নানু এই দৃশ্য দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মহিলা বেশ বৃদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু পুরোনো জখম এখনো তাজা তার। আমাল তাদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট ভুলে একটা সময় ঠিকই সে মেয়েকে মনে মনে মাফ করে দিয়েছিলো। চেয়েছিলো তার মেয়ে ভালো থাকুক। কিন্তু তার মেয়ে যে এতটা অমানুষ হবে মা হিসেবে তা উনি কখনো ঘূনাক্ষরেও বুঝতে পারে নি। উনিতো কখনো আমালকে কম ভালোবাসে নি। তাহলে আমাল কিভাবে পারলো নিজের মেয়ের সাথে এতো অন্যায় করতে? আপাতত উনি এতেই খুশি যে ল্যায়লা একটা ভালো পরিবার পেয়েছে।

__________

ল্যায়লার দুইপাশে তার মামী এবং নানু বসে ঘাসুল দ্বারা তার হাত ম্যাসাজ করছে। ঘাসুল হলো ভেষজ মিশ্রিত একধরনের বিশেষ কাদামাটি। ম্যাসাজ করা শেষ হতেই নাহাল এসে উনাদের উদ্দেশ্য করে বলে,

“ এটা ঠিক হচ্ছে না আন্টি। আমরা একাই নাচানাচি করছি। আপনারাও এসে ইঞ্জয় করুন না। “

ল্যায়লার মামী হেসে বলে উঠে,

“ ওর চুল ধোয়া বাকি এখনো। “

“ আমি আছি তো ল্যায়লার সাথে। আপনারা যান। “

ল্যায়লার নানু আর মামী চলে যেতেই ল্যায়লা নাহালকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজে শ্যাম্পু করে নিচ্ছি। “

নাহাল অবাক সুরে বলে,

“ কিসের কষ্ট? এটাতো আমাদের রীতি। চুপচাপ বসে থাকো। “

কথাটুকু বলেই নাহাল শ্যাম্পু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ল্যায়লা হাম্মামের মাঝে সকল মহিলাদের গান এবং নাচ উপভোগ করছে। নাহাল প্রশ্ন করে,

“ ফাতিহর সাথে এখনো কথা হয়েছে? “

“ উহু। কালকে রাবাতে ফিরে বেশ ক্লান্ত ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছি। আর আজ সারাদিন তো তোমাদের সাথেই। “

নাহাল ল্যায়লার পাশে বসে বলে উঠে,

“ বেশ হয়েছে। কথা বলো না আপাতত। লুকোচুরি করে বেড়াও কাল পর্যন্ত। একবার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে তোমাকে ফাতিহর অপেক্ষায় দিন পার করতে হবে। আমাকে দেখো না? ইসাম হুটহাট এই ম্যাচ সেই ম্যাচের জন্য উধাও হয়ে যায়। আমি তখন বসে বসে অপেক্ষা করে কাটাই। তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করো না। “

ল্যায়লা খুব মনযোগ দিয়ে নাহালের কথা শুনছিলো। একটু পর দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলে,

“ খারাপ বুদ্ধি দাও নি। আমি আরো ভাবছিলাম এখান থেকে বের হয়ে ফাতিহকে কল করবো। “

কথাটুকু বলেই ল্যায়লা সাথে সাথে বলে উঠে,

“ তুমিও চাইলে ইসামের থেকে পালিয়ে বেড়াতে পারো আজ সারাদিন। আগামীকাল মেহেন্দির অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে ওর সামনে যেও না। “

নাহাল যেন ল্যায়লার কথায় বেশ খুশি হয়। সে চোখ টিপে বলে,

“ তাহলে ওরা আগামীকাল পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষায় থাকুক। আমরা দুজন আজকে রাতে পার্টি করবো মিলে। বিবাহিত ব্যাচেলর পার্টি। “

নাহাল, ল্যায়লা দুজনেই হেসে দেয়।

__________

বিছানার একপাশে অবহেলায় পড়ে থাকা দুটি ফোনে লাগাতার কল আসছে। কিন্তু রিংটোনের কোনো শব্দ হচ্ছে না। কারণ দুটি ফোনই সাইলেন্ট মুডে দেওয়া। মৃদু অন্ধকার রুমে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে নাহাল এবং ল্যায়লা। দুজনেই কোল্ড ড্রিংকস আর পপকর্ন খেতে ব্যস্ত। টিভিতে চলছে বিখ্যাত হলিউড সিনেমা টাইটানিক। তারা এই মুহুর্তে ল্যায়লার নানুবাসায় আছে। বিয়ের সব অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে ল্যায়লা ফাতিহর বাসায় যেতে পারবে না।

টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই নাহাল বলে উঠে,

“ আমি আর ইসাম একবার এই সিনেমা দেখতে বসেছিলাম। ও আমার মেজাজ গরম করে দিয়েছিলো একদম। জ্যাকের মারা যাওয়ার দৃশ্য দেখে কেদে কেটে একাকার। “

ল্যায়লা চোখ বাকিয়ে বলে,

“ এই মুভি আমি বহুবার দেখেছি। কিন্তু একবারও কান্না পায় নি। “

নাহাল বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,

“ আই এম শিউর ইসাম হরর মুভি দেখলেও ভয়ে কেদে দিবে। পুরুষ মানুষ উপরে উপরেই সাহস দেখায় শুধু। “

নাহালের কথা শুনে ল্যায়লা হেসে দিয়ে বলে,

“ লেটস ওয়াচ এ হরর মুভি। এসব পানসে মুভি দিয়ে আমাদের পার্টি জমছে না। একটু থ্রিল দরকার। “

নাহাল সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে বলে,

“ ইয়েস। ভালো কথা বলেছো। “

__________

সবেমাত্র চোখ লেগে এসেছে ইসামের। তখনই কেউ একজন তার কাধের কলার ধরে তাকে টেনে দাঁড় করায়। আচমকা এরকম কাজে ইসাম ভয় পেয়ে যায়। চিৎকার করতেই নিবে তখনই ফাতিহ তার কানের কাছে বলে উঠে,

“ আমি ফাতিহ। “

সাথে সাথে ইসাম দমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে ফাতিহর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ তুই কি মাঝরাতে আমাকে মারতে এসেছিস? “

“ না। আমার বউয়ের সাথে দেখা করতে যাবো আমি। “

ইসাম ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ তোর বউ তার নানু বাসায়। তুই আমার বাসায় কেন এসেছিস? “

ফাতিহ ইসামের ড্রয়ার থেকে একটা টর্চ লাইট বের করে নিতে নিতে বলে উঠে,

“ কারণ তুইও আমার সাথে যাবি। “

“ তুই তোর বউয়ের সাথে দেখা করবি। আমার সেখানে কি কাজ? “

ফাতিহ ইসামের দিকে এগিয়ে এসে একহাত তার কাধে রেখে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ কাজ আছে। তোর বউও আমার বউয়ের সাথে আছে। আই এম শিওর দুইজন প্ল্যান করে আমাদের সাথে কথা বলছে না। আমি এখন ল্যায়লার সাথে দেখা করতে গেলেও তোর বউ মাঝখানে বাঁধা দিবে। তাই তুই তোর বউ সামলাবি গিয়ে। “

ইসাম সিরিয়াস ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলে,

“ আইডিয়া খারাপ না। কিন্তু আমাদের বাসা থেকে সাবধানে বের হতে হবে। হামিদ দাদার কাছে ধরা খেলে তুই আর আমি দুজনেই লেকচার পাবো। “

ফাতিহ নিজের কাধের কলার নাচিয়ে বলে,

“ ডোন্ট ওয়ারি। বারান্দার সাথে মৈ দাঁড় করানো আছে। কেউ টের পাবে না। “

ইসাম হতভম্ব গলায় বলে,

“ তোর আর নাহালের বুদ্ধি একদম সেম টু সেম। “

ফাতিহ ইসামকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ প্রশংসা পরে করিস। আগে চল। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here