অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৫. ( উপসংহার )
হেনা পার্টি শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। ল্যায়লা নিজের রুমে ফিরে এসেছে ড্রেস চেঞ্জ করার উদ্দেশ্যে। এতক্ষণ এক চাপে বসে থাকতে থাকতে তার কোমর ধরে এসেছে। রুমে ফিরে দরজা লক করতেই নিজের ফোনের রিংটোনের শব্দ তার কানে ভেসে আসে। ল্যায়লা সাথে সাথে বিছানার পাশে কেবিনেটের উপর থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠে ইয়াসিরের হাস্যজ্জ্বল চেহারা।
“ মাশাল্লাহ। সুন্দর দেখাচ্ছে। “
“ ধন্যবাদ। আপনি আসলে ভালো লাগতো। “
ইয়াসির ক্লান্ত গলায় সুধায়,
“ বেশ কাজের প্রেশার এখানে আমার উপর। কিন্তু আমার দোয়া এবং শুভ কামনা রইলো তোমাদের জন্য। “
ইয়াসিরের কথা শুনে ল্যায়লা মুচকি হাসে। ইয়াসির তারপর টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দেয়। সত্যি বলতে সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই ল্যায়লার বিয়েতে যায় নি। ল্যায়লা তাকে যতই ক্ষমা করুক, তাদের মাঝে পরিপূর্ণ স্বাভাবিক সম্পর্ক হওয়ার সম্ভাবনা কখনোই নেই। সবসময়ই জড়তা কাজ করে তাদের কথার মাঝে। তাই যেই সম্পর্ক দূরে থাকলেই তার সৌন্দর্য বহাল থাকবে, সেই সম্পর্ক সেভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত।
__________
মরক্কোর সকল পরিবাররা একই বিবাহের ঐতিহ্য মেনে চলে। তারা তাদের সকল সময় একটি বিয়ের প্রস্তুতিতেই ব্যয় করে। মরক্কোতে একটি প্রবাদ আছে, এক বছরের মধ্যে একটি রাতের বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়।
বিবাহের অনুষ্ঠান শুরু হয় ল্যায়লার আমারিয়াতে বসে ওয়েডিং হলে প্রবেশের মাধ্যমে। আমারিয়া হলো রূপালি রঙের একটি মার্জিত ছাদযুক্ত প্ল্যাটফর্ম। এটি মূলত নববধূকে বহন করার জন্য একপ্রকার বাহক। ল্যায়লার মামা, মামাতো ভাই, ইসাম এবং আলি আমারিয়া বহনের দায়িত্বে রয়েছে। আমারিয়া কাঁধে তুলে নেওয়ার মানে হলো, নববধূ সবার মাথার উপরে, সম্মানিত এবং অনুষ্ঠানের রাণী। ল্যায়লাকে স্বাগত জানাতে বিশেষ গানের তালে সঙ্গীত বাজছে।
স্টেজ হতে এই সম্পূর্ণ দৃশ্যটা মুগ্ধ নয়নে দেখছে ফাতিহ। স্টেজের সামনে এনে আমারিয়া নামানো হয়। ফাতিহ এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিতেই ল্যায়লা তার হাতে হাত রেখে আমারিয়া থেকে বেরিয়ে আসে।
মরক্কান বিয়ের আরেকটা মূল দিক হলো নববধূর সাথে সবসময় নেগাফারা উপস্থিত থাকেন। নেগাফাকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয় ব্রাইডস মেইড৷ মূলত নববধূর বোন কিংবা বান্ধুবীরা এই দায়িত্বে থাকেন। তাদের ছাড়া বিবাহ অসম্পূর্ণ কারণ তারা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেন নববধূর কোনো অসুবিধা না হয়। ল্যায়লা এবং ফাতিহর বিয়ের অনুষ্ঠানে এই দায়িত্ব পেয়েছে ল্যায়লার মামাতো বোন এবং নাহাল।
__________
বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে সন্ধ্যার দিকে। বিয়ের হল থেকে বেরিয়েই ল্যায়লা এবং ফাতিহ রওনা হয় মরক্কোর নীল শহরের উদ্দেশ্যে। যেই শহরের নাম শেফচাউয়েন। উত্তর পশ্চিম মরক্কোর পাহাড়ের নীচে স্তুপ করা নীল রাস্তা এবং আঁটসাঁট বাড়িঘর সহ শেফচাউয়েন শহরটি পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহর থেকে একেবারেই আলাদা। শেফচাউয়েনের অর্থ হলো ‘ শৃঙ্গের দিকে তাকান। ’ কারণ এই শহরটির দু’দিকে দুটি পর্বত শৃঙ্গ প্রতিফলিত। নীল এবং সাদা রঙে আঁকা ঐতিহ্যবাহী ঘরগুলোর জন্য এই শহরটি দ্য ব্লু পার্ল নামেও পরিচিত।
ফাতিহ এবং ল্যায়লার তাদের বুক করা রিসোর্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে যায়। গাড়ি পার্কিং এরিয়াতে থামতেই ফাতিহ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ল্যায়লা সিটের একপাশে মাথা হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ল্যায়লাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ফাতিহর আর ডাকতে ইচ্ছে হয় না। আজকে সারাদিন এতো মানুষের ভীড়ে এবং বিয়ের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাঝ দিয়ে দু’জন মন খুলে এক দন্ড কথা বলারও সুযোগ পায় নি।
ফাতিহর কাছে অবশ্য এই মুহুর্তে সবকিছুই স্বপ্ন মনে হচ্ছে। যেই অ্যাটলাস শৃঙ্গের কারণে একদা সে নিজের ভালোবাসা হারিয়েছিলো, বহুবছর পর সেই অ্যাটলাস শৃঙ্গেই সে ল্যায়লার রূপে আবার ভালোবাসা খুঁজে পায়। এজন্যই হয়তো বলে, উপরওয়ালা কখনো কাউকে ঠকায় না। একটা মানুষ জীবন থেকে যতটুকু হারায় তার দ্বিগুণ আর্শীবাদ সরূপ আবার তার কাছে ফিরে আসে।
ফাতিহর ভাবনার মাঝেই ল্যায়লা আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকায়। সাথে সাথেই সে ফাতিহকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। ল্যায়লা সামান্য হেসে ঘুম জোড়ানো গলায় বলে উঠে,
“ একটা কথা বলি? “
ফাতিহ চোখের ইশারায় সম্মতি দেয়।
“ ইউ হিলড সামথিং দ্যাট ইউ নেভার ব্রোক। “
ফাতিহ ল্যায়লার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার দু চোখের পাতায় আলতো করে চুমু খায়। তারপর মৃদু স্বরে বলে উঠে,
“ ইউ অলসো হিলড সামথিং দ্যাট ইউ নেভার ব্রোক। ”
__________
লাল সবুজ রঙের জার্সি পড়ে স্টেডিয়ামের ভিআইপি এরিয়াতে বসে আছে ল্যায়লা। চোখে মুখে তার চিন্তার ছাপ। খেলার হাফ টাইম ব্রেক কেবল শেষ হলো। বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ আজ। মরক্কো বনাম স্পেনের ম্যাচ চলছে। দুই দলের গোল সংখ্যাই আপাতত ১-১। ইঞ্জুরির রেশ কাটিয়ে ফাতিহ খেলায় ফিরেছে আজ প্রায় দু বছর। এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে তাদের টিমের অনেক হাই হোপ। একপা দুপা করে এগোতে এগোতে মরক্কো টিম যে ফাইনালে পৌঁছাতে পেরেছে প্রথমবারের মতো এটাই যেন সকলের কাছে অনেক বড় বিস্ময়ের ব্যাপার। এতদূর আসার পর ল্যায়লাসহ সকলেই চায় এই অ্যাটলাস লায়ন খ্যাত মরক্কানদের হাতে এবারের কাপটা উঠুক।
আচমকা চুলে টান অনুভব করতেই ল্যায়লা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায়। তার পাশের সিটে নাহাল বসা। নাহালের কোলে ছোট নাদুসনুদুস এগারো মাসের বাচ্চাটাই তার চুল টেনে ধরেছে। নাহাল লক্ষ্য করতেই সাথে সাথে ছেলের হাত থেকে ল্যায়লার চুল ছাড়িয়ে নেয়। ল্যায়লা হেসে হাশিমের গাল টেনে দিয়ে বলে,
“ কি বাবা? আন্টির কোলে আসবে? “
হাশিম সাথে সাথে আবার নাহালের কোলে মুখ লুকায়। ল্যায়লা আবার ফিল্ডের দিকে মন দেয়। মাঠে উপস্থিত ফাতিহর দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। বিয়ের দুই বছরেও মানুষটার মাঝে এক বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন আসে নি। হাফ টাইম শেষে সকল প্লেয়ার কেবল মাঠে নামলো। রেফারি হুইসেল বাজানোর আগ মুহুর্তে ফাতিহ ল্যায়লার দিকে একপলক তাকায়। ল্যায়লাও হেসে ফাতিহকে চোখ মারে। ফাতিহ মৃদু হেসে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ল্যায়লা মনে মনে বলে উঠে,
“ নাও ইট’স টাইম টু সেভ ইউর টিম স্যাভিওর। “
রেফারির হুইসেল বাজতেই আবার খেলা শুরু হয়। দু দলই সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুকৌশলে খেলে যাচ্ছে। স্টেডিয়াম জুড়ে দু দলের ফ্যানদের চেহারাতেই চিন্তার ছাপ। কিন্তু অবশেষে ৮১ মিনিটের মাথায় স্কোরের সামঞ্জস্যতা ভেঙে ফাতিহ তার দলের হয়ে দ্বিতীয় গোলটা গোলপোস্টে ছুড়ে দেয়। মুহুর্তেই সম্পূর্ণ স্টেডিয়াম জুড়ে একপাক্ষিক দলের আনন্দের রোল পড়ে যায়। ল্যায়লার একপাশে বসা ফাতিহর পরিবার এবং সকলেই দাঁড়িয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে। কিন্তু ল্যায়লা ঠাই বসে রয়। এখনো ৯ মিনিট বাকি।
এই ৯ মিনিটে প্রতিপক্ষ দলের গোল প্রতিরোধ করে জয় নিজেদের নামে করে নিতেই ল্যায়লাও আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে। ফাতিহ সহ সকল প্লেয়ারদের চোখে মুখে স্বপ্ন পূরণের খুশি চিকচিক করছে। সকল প্লেয়ারদের পরিবারের সদস্যরাই ইতিমধ্যে স্টেডিয়াম ছেড়ে মাঠে চলে গিয়েছে। কিন্তু ল্যায়লা ভীড় সামান্য কমার পরই ধীরে সুস্থে নিচের দিকে এগিয়ে যায়। ফাতিহ এতক্ষণে নিজের পরিবারের সকলের সাথেই নিজের খুশি ভাগাভাগি করে ব্যস্ত দৃষ্টিতে ল্যায়লাকে খুঁজছে। যখন সে দেখে ল্যায়লা কেবল স্টেডিয়াম হয়ে নামছে তখন সে আর ল্যায়লার অপেক্ষা না করে নিজেই বাউন্ডারি টপকে ল্যায়লার দিকে দৌঁড়ে এগিয়ে যায়।
ল্যায়লার কাছে গিয়েই সে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে স্টেডিয়ামের মাঝেই তাকে জড়িয়ে ধরে। এতক্ষণের দমিয়ে রাখা খুশি এবং উত্তেজনা নোনাজল হয়ে তার মুখশ্রী গড়িয়ে ল্যায়লার কাধে গিয়ে পড়ে। ল্যায়লা অবাক হয় না। সেও ফাতিহর পিঠে হাত রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। অত:পর তার খুশির মাত্রা দ্বিগুণ করে দিতে কোমল স্বরে বলে উঠে,
“ কংগ্রেচুলেশন উড বি পাপা। “
ফাতিহ চমকায়। শত ভীড়ের কোলাহল চিড়ে তার কানে বাজতে থাকে কেবল ল্যায়লার বলা কথাটা। তার হাতের বাধন আলগা হয়ে আসে। সে ল্যায়লাকে ছেড়ে বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকায়। ল্যায়লা অশ্রুসিক্ত চোখ মেলে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেয় যে সে সত্যি বলছে। ফাতিহর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। এই মুহুর্তে তার নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবান মানুষ মনে হচ্ছে। সাথে সাথে সে ল্যায়লাকে আবার জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
“ আই লাভ ইউ। “
“ আই লাভ ইউ মোর। “
তখনই ইসাম পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
“ ল্যায়লা? নিজের স্বামীকেই শুধু শুভেচ্ছা জানাবে? আমাদের জানাবে না? “
ফাতিহ ল্যায়লাকে ছেড়ে পিছনে ফিরে ইসামের দিকে তাকায়। পরমুহূর্তেই উল্লাসে ফেটে বলে উঠে,
“ আগে আমাকে শুভেচ্ছা জানা। বাবা হচ্ছি। “
ইসামসহ মাঠে উপস্থিত অনেকেই ফাতিহর কথা স্পষ্ট শুনতে পায়। তারাও পিছন থেকে একসাথে কংগ্রেচুলেশনস বলে উঠে। ফাতিহ আবার ল্যায়লার দিকে ফিরেই তার কপালে চুমু খায়। ল্যায়লা ফাতিহর বুকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বলে,
“ মাঠে যাও তাড়াতাড়ি। তোমার কাঙ্ক্ষিত ট্রফি তোমার অপেক্ষায়। “
ফাতিহ ল্যায়লার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ ব্যক্তিগত ট্রফি আর কাঙ্ক্ষিত ট্রফি দুটোই জিতে নিয়েছি। আর কোনো অপেক্ষা নেই। পরিপূর্ণ এখন আমি। “
সমাপ্ত…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]