মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_১ #মৌরিন_আহমেদ

দুদিকে ঘন কাশবন আর তার মাঝখান দিয়ে একটা পথ। পিচ ঢালা সে পথের ধারে ফুটে থাকা থোকা থোকা সাদা কাশফুল আর নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো শুভ্র মেঘই জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে শরৎ এসেছে।

এ পথে একা একা হেঁটে যাচ্ছে একটা ছেলে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক সুদর্শন যুবক। পরনে নীল রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা প্যান্ট। কাঁধ থেকে ঝুলছে একটা পাটের ব্যাগ। ব্যাগটা তে কী আছে কেউ জানে না। অবশ্য অমন একটা পুরনো ধাঁচের ব্যাগের ভেতরে কি থাকতে পারে আন্দাজ করাই যায়। তাই সে ব্যাপারে কারো বিশেষ আগ্রহ নেই। সে হেঁটে চলেছে। একা একা…..

________________________

ভাদ্র মাসের গরম। বেলা সাড়ে এগারোটায় এমন রোদ উঠেছে বলার মত না। আজ ভার্সিটিতে ক্লাস নেই সেটা আগে জানতো না অনন্যা। শুধু শুধু এসে ঘুরে যেতে হচ্ছে! ভেবেই মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। আর সেই কখন থেকে দাড়িয়ে আছে অথচ একটা রিকশাও নেই? রিকশা কেন রিকশাওয়ালার টিকি’ টারও পাত্তা নেই!

বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ ওর চোখে পড়লো একটা ছেলেকে। রাস্তার ওপর পাশের ফুটপাত ধরে একা একা হেঁটে চলেছে। ওকে দেখেই হঠাৎ নিজের ভেতরে কেমন যেন একটা আগ্রহ বোধ করলো অনন্যা। ছেলেটাকে সে চেনে। তাদের এলাকাতেই থাকে। ওদের বাড়ীর ঠিক দুইটা বাড়ির সামনে একটা বিল্ডিংয়ে। ছয় তলা সে দালানের ঠিক কোন ফ্ল্যাটে থাকে সেটা অবশ্য ওর জানা নেই। কারণ ছেলেটার মুখ পরিচিত হলেও তার নাম- ধাম সম্পর্কে সে তেমন কিছুই জানে না। কখনো তো কথা বলার সুযোগই হয় নি।

ভাবতে ভাবতেই দেখে ছেলেটা ওকে ক্রস করে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ কী যেন একটা মনে হলো ওর। দ্রুত রাস্তা পার হয়ে ছেলেটার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো। উদ্দেশ্য ছেলেটার সাথে কথা বলা। তবে সেটা নিরিবিলিতে। আশেপাশের এমন কোলাহলে কথা বলা যাবে না কোনোভাবেই। তাই আপাদত ওকে ফলো করছে। ফাঁকা কোনো জায়গাতে এলেই ডাক দেবে ওকে।

এই ভার্সিটি এরিয়াতেই প্রথম ওই ছেলেটাকে দেখেছিল অন্যান্য। সেদিনও সে পাঞ্জাবি পড়েই ছিল। রঙটা ছিল হলুদ। তার ফর্সা বর্ণের শরীরে রঙটা ফুটে উঠেছিল দারুণভাবে। দূর থেকে ওকে দেখেই হিমুভক্ত অনন্যা মুহূর্তেই তার নামকরণ করে ফেলেছিল ‘হিমালয় হিমু’ । অবিকল সেই রকম কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, হলুদ পাঞ্জাবী- সত্যিই ওকে হিমুর মতোই লাগছিল। তবে হিমুর সাথে ওর পার্থক্যটাও ওর চোখে পড়ে। আর সেটা হলো স্যান্ডেল পরিহিত দুটি পা। হিমু তো কখনো স্যান্ডেল পরতো না,খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতো ঢাকার অলিগলি!

এরপর আরও কয়েকবার দেখেছে বিভিন্ন জায়গায়। শপিংমল, লাইব্রেরী, সিনেমা হলের সামনে অলি- গলি, রাস্তায় বেশ ক’ বার ওর দেখা হয়েছিল হিমুর সাথে। তবে সে সবসময় হলুদ পাঞ্জাবিতে নিজেকে আবৃত করতো না, একেক সময়ে একেক রঙের পাঞ্জাবি পরতো। অনন্যার ধারণা ছেলেটা কোনো কাজ- বাজ করে না। নয় তো এভাবে হেঁটে বেড়াবে কেন? সব সময় সে হেঁটে বেড়ায় একা একা….

– এই যে শুনছেন?… এই নীল পাঞ্জাবি!…

ফাঁকা জায়গা দেখে ডাক দিল অনন্যা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে তাকালো ছেলেটা। তার ফর্সা মুখ, আয়ত চোখ, খুব ছোট ছোট করে ছাঁটা চাপ দাড়ি আর বেশ বড় বড় চুলের সাজানো বিন্যাস দেখে অন্যরকম এক অনুভূতি জাগলো অনন্যার প্রাণ জুড়ে m ছেলেটা সত্যি সত্যিই সুদর্শন!

সে কোনো ভনিতা কিংবা অস্বস্তির আস্তরণে পড়লো না। সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল,

– কোনো সমস্যা? আমাকে কেন ডাকছেন?

অনন্যা কিছুটা অবাক হলো। সে ভেবেছিল ছেলেটা ডাক শুনে প্রথমে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করবে তাকেই ডাকা হয়েছে কি না। তারপর হ্যাবলা কান্তের মতো করে বলবে,

– জ্বী, আমাকে ডাকছিলেন? কিন্তু ছেলেটা তেমন কিছু না করে সরাসরিই জিজ্ঞেস করল তাকে কেন ডাকা হয়েছে! অনন্যা দ্রুত হেঁটে কথা বলার জন্য তার খুব কাছে চলে এলো। কিন্তু কথা বলতে গিয়েই রাজ্যের জড়তা এসে ভীড় করলো মুখ বিবরে। আমতা আমতা করে বললো,

– না সমস্যা না… আমি… আসলে.. ইয়ে… মানে… আপনার নামটা বলা যাবে?

– ধ্রুব। ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো ছেলেটার। অনন্যা ঠিক কি বলবে ভেবে পায় না। বলে,

– শুধুই ধ্রুব আর কিছু না?

– নাহ্, কেন বলুন তো?

প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল ও। আবারও কথা আটকে যেতে লাগলো মুখের কাছে।

– না… মানে… তেমন কিছু না… আমি শুধু আপনার সাথে পরিচিত হতে চাইছিলাম….

– ঠিক আছে, চলুন কথা বলি…

বলেই হাঁটতে শুরু করলো ধ্রুব নামের ছেলেটি। ওর এমন ভনিতা হীন সহজ ব্যবহারে বেশ অবাক হলো অনন্যা। ও ছেলেটার সাথে পরিচিত হতে চায় ভেবে কেন যেন একটুও অবাক হলো না সে। কোনো ভনিতা ছাড়াই বললো ‘ চলুন কথা বলি’। আচ্ছা, কথা বলতে এসে কোনো ট্র্যাপে পরে গেল না তো ও? ছেলেটা ছিনতাইকারী কিংবা মলমপার্টির লোক নয় তো? কথা বলতে চেয়েছে বলে কোনো সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে না তো? তবুও ছেলেটার সাথে কথা বলার সুযোগটা কেন যেন মিস করতে চাইছে না সে। কেমন যেন চুম্বকীয় আকর্ষণ কাজ করছে ছেলেটার প্রতি। দৌড়ে গিয়ে ধ্রুবের পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলো। ছেলেটা ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দিল।

– আচ্ছা, আপনি কি করেন?… মানে পড়ালেখা করছেন না চাকরি- বাকরি….

– কিছুই করি না। ভবঘুরে…

‘ভবঘুরে’ কথাটা বেশ মনে ধরলো ওর। একইসঙ্গে ছেলেটার সম্পর্কে জানার প্রতি আগ্রহটা যেন আরো একগুণ বেড়ে গেল। জানতে চাইলো,

– ভবঘুরে কেন? পড়ালেখা না হয় না করেন কিন্তু তাই বলে চাকরি- বাকরি কিছু করবেন না কেন? চাকরি ছাড়া এই দুর্মূল্যের বাজারে চলেন কি করে?….নাকি এখনও বেকার?

– চাকরির প্রয়োজন নেই।.. ওসবে আমার আগ্রহও নেই।

হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দিলো ধ্রুব। অনন্যা বেশ আগ্রহী হয়ে বললো,

– আপনার বুঝি অনেক টাকা? তাই বুঝি চাকরি করার প্রয়োজন হয় না?

কথাটা শুনে একটু হাসলো ছেলেটা। ও সে হাসি খেয়াল করে বুঝলো ছেলেটার উপরের পাটির ডান সাইডে প্রিমোলার দাঁতটা বাঁকা। তাতে যেন ওর হাসিটা অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে! ছেলেটা হাসি থামিয়ে বললো,

– তেমন কিছু না।… পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে টাকার প্রয়োজন। সেটা সবারই দরকার। তবে ধরাবাঁধা চাকরি বা ব্যবসা করার চাপ নেয়া আমার পছন্দ না। তাই ভবঘুরে জীবন যাপন করি আমি….

ধ্রুবের ফিলোসফি মার্কা কথা শুনে অনন্যা বেশ বুঝলো ও আসলে কি করে তা ওকে জানতে দিতে চাচ্ছে না। যদি না চায় তবে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। তাই বললো,

– আপনি কি কথা বলতে বিরক্ত হচ্ছেন?.. কেন যেন আমাকে একটা প্রশ্নও করলেন না! আমি হঠাৎ কেন পরচিত হতে চাইছি সেটাও তো জানতে চাইলেন না…

ছেলেটা আবারও হাসলো। অনন্যা আড়চোখে তাকিয়ে তার মুগ্ধময় হাসিটা দেখলো। ধ্রুব হাসতে হাসতেই বললো,

– আমি আপনার সম্পর্কে জানি।.. তাই নতুন করে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করি নি। ….

কথাটা কানে আসতেই যেন পিলে চমকে উঠলো ওর। ছেলেটা ওর সম্পর্কে জানে? কীভাবে? আঁতকে উঠে বললো,

– কীভাবে চেনেন?… আপনি কী আমার পিছে লোক….

– আপনি ভয় পাচ্ছেন নাকি? দেখুন, ভয় পাবেন না। … আমি আপনাদের এলাকায় ভাড়া থাকি.. সেখানেই দেখেছি আপনাকে। আপনার নাম অনন্যা। ভার্সিটিতে পড়েন…

ছেলেটা বুঝলো কি করে ও ওকে ভয় পেতে শুরু করেছে? ESP পাওয়ার- টাওয়ার আছে না কি? নাকি কোনো গোয়েন্দা- গুপ্তচর? ওকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে না তো? ভাবতেই গা হাত-পা ঠান্ডা হতে শুরু করলো ওর। নিজে নিজেই বিপদের মুখে ঝাপ দিলো না তো ও?

ওকে দাড়িয়ে থেকে ভয় পেতে শুরু দেখে বেশ মজা পেলো ধ্রুব। হাসি হাসি মুখে বললো,

– আমাকে কিডন্যাপার ভাবার কোন কারণ নেই। যদি তাই হতাম তবে এতক্ষণে ক্লোরোফর্ম দিয়ে কাজ সেরে ফেলতাম। অযথা পরিচয়ের ঝক্কিতে যেতাম না….

ধ্রুবের এবারকার কোথায় আরো চমকে উঠলো অনন্যা। ছেলেটা তো ওকে প্রতি পদে পদে চমকে দিচ্ছে! ও ওর মনের কথা ধরে ফেলছে কি করে? কারো মন পড়ে ফেলার ক্ষমতা আছে নাকি? মগজধোলাই করতে পারে? লোকটা কি ম্যাজিশিয়ান? ও আঁতকে উঠে বললো,

– আপনি আমার মনের কথা বুঝলেন কী করে?.. মন পড়তে পারেন না কি?… আপনার Esp পাওয়ার আছে?…

ছেলেটা আবারও হাসলো। ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– এই সামান্য কথাটা বুঝতে Esp পাওয়ারের দরকার হয় না। সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায়… আপনি অপরিচিত একটা লোকের সঙ্গে কথা বলতে এলেন, তার সম্পর্কে জানতে চাইলেন.. লোকটা নির্দ্বিধায় আপনাকে সব কিছু বলে দিচ্ছে এটা কি আপনার কাছে সন্দেহ জনক নয়?…

নিজের বোকামিটা বেশ বুঝতে পারলো অনন্যা। এভাবে ছেলেটার সাথে কথা বলতে আসা ওর একদমই উচিৎ হয় নি। ছেলেটা নির্ঘাত ওর সম্পর্কে উল্টো- পাল্টা কিছু ভাবছে! ধ্যাত! ভেবেই মন খারাপ করে বললো,

– সরি!.. আপনার সময় নষ্ট করলাম। আমি আসছি!..

বলেই হাত দিয়ে পাশ দিয়ে চলতে থাকা একটা রিকশাকে থামালো। চটপট রিকশায় উঠে চলে গেল জায়গা ছেড়ে। অনন্যার এভাবে চলে যাওয়াটা প্রত্যাশা করে নি ধ্রুব। মেয়েটা বড় অদ্ভুদ! এলো, কথা বললো আর চলে গেল? যাক গে! অতো ভেবে ওর কি লাভ? ভেবেই আবারও হাঁটায় মনোযোগ দিল ধ্রুব।

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_১
#মৌরিন_আহমেদ

#চলবে—–
___________________

সামান্য ভিন্নধারার গল্প। প্রথম পর্ব পড়েই গল্পের মান কে জাজ করতে যাবেন না। ধৈর্য ধরুন। ধীরে ধীরে মূল থিমটা তুলে ধরার চেষ্টা করবো…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here