মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_২ #মৌরিন_আহমেদ

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_২
#মৌরিন_আহমেদ

অনন্যাকে এতো দ্রুত বাসায় ফিরতে দেখে অবাক হলেন ওর মা মিসেস. জোহরা বেগম। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন,

– কী রে, আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে? ক্লাস ছিল না আজ?

অনন্যা কাঁধের ব্যাক প্যাকটা সোফার উপর ছুড়ে দিয়ে বললো,

– নাহ্… ক্লাস হয় নি।

বলেই ডায়নিং টেবিল থেকে জগ তুলে মুখের উপর রেখে পানি খেতে শুরু করলো। জোহরা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,

– ক্লাস হয় নি ভালো কথা। কিন্তু জগে মুখ লাগিয়ে পানি খাস কেন? গ্লাসগুলো চোখে পড়ে না?

সে কথার পাত্তা দিল বলে মনে হলো না। বাম হাত দিয়ে মুখে লেগে থাকা পানিটুকু মুছে ফেলে হেলতে দুলতে নিজের ঘরে চলে গেল।

ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ কানিজের কল। কানিজ অনন্যার ছোটবেলার বান্ধবী। বলা যায় কলিজার দোস্ত। ও কলটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিয়ে বিছানার উপর রাখলো। আর নিজে গেল কাবার্ডের কাছে গোসল করতে ঢোকার জন্য জামা- কাপড় নিতে। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো কানিজের গলা,

– অনু, তুই কি আজ ভার্সিটি এসেছিলি?… ক্লাস হয়েছে কোনোটা?

ও জামা কাপড় ঘাড়ে ঝুলিয়ে এগিয়ে এলো ফোনের কাছে। বললো,

– ক্লাস হয় নি। শুধু শুধু গিয়ে ঘুরে এসেছি।… আচ্ছা,তুই এলি না কেন? আমি একা একা ঘুরে এলাম।…

– ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে রে! সরি!..

বেশ কিউট করে বললো কানিজ। অনন্যা অভিমান করে বললো,

– রাখ তোর সরি! … তুই নেই দেখে আমার যে কী খারাপ লাগলো! একা একা ভারসিটিতে যেতে ভালো লাগে বল?

– বললাম তো সরি! রাগ করিস না, প্লীজ!…

অনন্যা অস্পষ্ট স্বরে ‘হুম’ বলতেই ও আবারও বললো,

– বিকেলে বেরোবি?… চল না ফুসকা খেয়ে আসি?… আমিই খাওয়াবো। যাবি?

– না রে, আজ আর বেরোব না। তারচেয়ে এক কাজ কর না, তুইই আমার বাড়ি চলে আয়? দুজনে মিলে জমিয়ে আড্ডা হবে!…. মাকে বলে রাখি, তোর ফেভারিট আলু পাঁকোড়া বানাতে?

– আন্টির হাতের পাঁকোড়া? ওহ্! দারুণ জমবে কিন্তু!.. এই শোন, আন্টিকে বলে দে আমি আসছি!…

– ওকে!

কানিজের উচ্ছাস দেখে মুচকি হাসে অনন্যা। ফোন রেখে দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে ওর আসার কথাটা জানিয়ে দেয়। তারপর হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে ঢোকে গোসল সাড়ার জন্য।

________________________

সোফার উপর শুয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল ধ্রুব। ম্যাগাজিনটা আমেরিকার একটা সামরিক সংস্থা থেকে প্রকাশিত। সেখানেই একটা জায়গায় অত্যাধুনিক বিভিন্ন অস্ত্র সম্পর্কে আর্টিকেল পড়ছিল। তখন হঠাৎ সামনে থাকা টি- টেবিলে চায়ের কাপ রাখার শব্দ হলো। ও চোখ না তুলেই বললো,

– দুপুরে খেয়েছ, করিম চাচা?

করিম পাশে দাড়িয়ে থেকে জানালো,

– জ্বী, আপনে তো আইলেন না, আমিই খায়া লইছি।…. রাতে কি খাইবেন? মুরগির মাংস আর ডাল রানধি?

– সে তুমি যা ভালো বোঝ!

বলেই করিমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ধ্রুব। করিম হাসি মুখে সায় জানিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেই আবার জিজ্ঞাসা করলো,

– ইয়ে… চাচা একটু দেখ তো কয়টা বাজে?

করিম পাশের ঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটার দিকে তাকালো। সময় দেখে নিয়ে ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– চাইরটা দশ।… আইজ আর বাইরে যাইবেন না?

ও কাপে চুমুক দিতে দিতে কি যেন ভাবলো। তারপর বললো,

– সাড়ে চারটার দিকে বেরবো। ফিরতে ফিরতে নয়টা- দশটা বাজবে।

সেটা শুনে করিম মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,

– আমি বুঝি না, এতক্ষণ বাইরে হাইটা হাইটা আপনে কি করেন!.. সারাদিন খালি হাঁটেন আর হাঁটেন। কেউ তো বাড়িতেও আয় না, আর আপনিও কারো বাড়িতও যান না।… একলা একলা রাস্তা দিয়া হাইটা কি মজা পান আপনে?

বলতে বলতেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন উনি। ধ্রুব চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক বসিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো। ম্যাগাজিন তুলে আবারও মনোযোগ দিল সেখানে।

________________________________

কফির কাপ হাতে নিয়ে বাড়ির ছাদে পায়চারি করছে অনন্যা। পাশেই একটা পিলারের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে কানিজ। কিছুক্ষণ আগেই ওদের বাড়িতে এসেছে ও। ওর কোলের ওপর অনন্যার মায়ের বানানো পাঁকোড়ার প্লেট। ও একটা পাঁকোড়া মুখে দিতে দিতে বিশেষজ্ঞ দের মতো করে বললো,

– তারমানে ছয় তলার ওই ছেলেটার সাথে কথা বলেছিলি তুই, তাই তো?

– হুম্…. ছেলেটার নাম ধ্রুব। বেশ অদ্ভুদ টাইপের…..

– অদ্ভুদ কেন?

– নাহ্, ঠিক অদ্ভুদ না। একটু অন্যরকম। তার মধ্যে হিমু হিমু একটা ভাব আছে, জানিস? কোন কারণ ছাড়া একা একা হেঁটে বেড়ায়। কথাবার্তার ভঙ্গিও ওই একইরকম….

ওর কথা শুনে বিরক্ত হয় কানিজ। এই মেয়েটা যে কি না! সবসময় গল্পের কাল্পনিক চরিত্রগুলোকে বাস্তবে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আরে বাবা, যেটা কাল্পনিক সেটা তো কল্পনাতেই থাকে। বাস্তবে খুঁজে কী লাভ? মুখ বেঁকিয়ে বলে,

– অনু, তুই কিন্তু এইবার বাড়াবাড়ি করছিস! ছেলেটার সম্মন্ধে কিছুই জানিস না তুই, শুধু নামটা… তাতেই ওকে হিমু বানিয়ে দিলি?… এজন্যই বলি এতো বই পড়িস না। আজ পর্যন্ত যত বই পড়েছিস সব চরিত্রকেই বাস্তবে খোঁজার চেষ্টা করেছিস। ফেলুদা, রবিনহুড, টেনিদা, ক্যাবলা, দিলু, রাশেদ, দীপু, তপু থেকে শুরু করে শুভ্র, মিসির আলী, হিমু পর্যন্ত! কোন ক্যারেক্টার টাকে তুই বাদ রেখেছিস, বলবি? প্লিজ, অফ যা দোস্ত! আর মাতামাতি করিস না!

অনন্যা কেমন যেন চোখ করে তাকায় ওর দিকে। ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে বলে,

– তুই আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছিস না, কানিজ! আগে যেগুলো করেছি সেটা বাড়াবাড়ি ছিল মানছি। কিন্তু এবারে সত্যি বলছি ছেলেটা একদম হিমুর মতো! হ্যাঁ, কিছু পার্থক্য আছে… সেটা তো ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। তুই ছেলেটাকে একবার ভালো করে দেখ, কথা বল! তারপর বলিস ও কি রকম…

ও কথা শেষ করার আগেই কানিজ দু’হাত তুলে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে,

– হয়েছে বাপ! তুই বলেছিস তাতেই হয়েছে!.. আমার আর সাধ জাগে নি ওই হিমু মার্কা ছেলের সাথে কথা বলার!

কানিজের কথায় মনে মনে রাগ করে অনন্যা। কাপ হাতে পুরো ছাদময় পায়চারি করতে থাকে। হঠাৎ বাড়ির সামনে রাস্তার দিকে তাকাতেই চোখ আটকে যায় ওর। ছয়তলা বিল্ডিং থেকে ধ্রুব বেরোচ্ছে! এখন ওর পরনে একটা অফ হোয়াইট রঙের পাঞ্জাবি। ও বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে হাঁটা লাগালো সামনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে হাইওয়েতে উঠে বাম হাতের দিকে চলে গেল।

ছাদ থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত ওকে দেখা গেল ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত অনন্যা সেদিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুগ্ধময় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো ছেলেটার প্রত্যেক পা ফেলার ভঙ্গি, হেঁটে যাওয়ার সুশৃঙ্খল কলা-কৌশল। আর বুকের ভেতর ছড়িয়ে গেল একরাশ মুগ্ধতার ছোঁয়া!

ওকে ওভাবে স্ট্যাচুর মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো কানিজ। কোলের প্লেটটা পিলারের ওপর রেখে ঝাঁপ দিয়ে নিচে নামলো। নিজের জামা-কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,

– কিরে অমন হাবার মত দাড়িয়ে আছিস কেন?

সে কথার জবাব দিলো না অনন্যা। তা দেখে কানিজ ওর কাছে এসে হাত। ধরে ঝাঁকালো,

– আব্বে ওই!

ঝাঁকি খেয়ে হুশ হলো ওর। থতমত খেয়ে বললো,

– আব্ হ্যাঁ বল…

– তুই অমন ‘হা’ করে কি দেখছিলি?

– কই কিছু না তো, বাসায় চল…

বলেই একপ্রকার জোর করেই ওকে টেনে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসে অনন্যা। কানিজ বোকার মতো তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ওর মনের ভেতর কি চলছে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারে না। কী যে হলো এই পাগলির!
____________________________

প্রায় আধঘন্টা ধরে সিনেমা হলের সামনে ঘোরাফেরা করছে ধ্রুব। তবুও কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির পাত্তা নেই। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার হলের ভেতরে গিয়েও চেক করে এসেছে। কিন্তু সেখানেও কাউকে পায় নি। তাই আবারও হলের বাইরের দিকে এসেই ঘোরাফেরা করছে।

বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর হলের সামনের চায়ের দোকানটায় এসে বসলো ও। এক কাপ মালাই চা অর্ডার করে চেয়ে রইলো হলের মেইন গেটের দিকে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলো চা ওয়ালার সাথে। কিন্তু কথা বলে তেমন কিছু হলো না। লোকটা কিছুই জানে না!

সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত ওখানেই অপেক্ষা করলো ধ্রুব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েই হাঁটা লাগালো অন্য দিকে।

#চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here