“আকাশী”
পর্ব ১০…
সম্পূর্ণ ক্ষেতে আকাশী ব্যতীত কেউই নেই। শূন্য দৃষ্টিতে সে একদিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার জীবনে অনেক দুঃখ এসেছে। বোঝ-ব্যবস্থা হওয়ার পর থেকে সে কখনও কোনোকিছু নিয়ে কাঁদেনি। মা তাকে যতই অবহেলা করুক, তার চোখ কখনও ভেজেনি। আজ কেমন এক উদাসীনতায় তার চোখ ভিজে গেছে। সত্যিই তার দোষ ছিল না। কিন্তু এমন পরিণতি সে চায়নি। এই রোদে ক্ষেতে আর কেউই নেই। পাশের রাস্তাটাও খালি। সকালের চাও সে খেতে পারেনি। একটু আগে যে সামান্য ক্ষিধেটুকু পেয়েছিল, তা পেটের কোনো এক কোণে গিয়ে যেন মিইয়ে গেছে। এখন রান্না করারও সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু উঠার শক্তিটুকুও সে জোগাতে পারছে না। শরীর কেমন অবশ হয়ে গেছে।
উপরের আকাশটাও সাদা। হালকা এক আকাশী রং দেখা যাচ্ছে। কারো হেঁটে আসার আওয়াজ পেয়ে আকাশী ফিরে তাকিয়ে দেখল, তাসফিয়া এদিকে তার কাছেই আসছে। তাকে কেন যেন মরীচিকার মতো লেগেছিল। বাস্তব বলে বোধই হয়নি। আকাশীর পাশে এসে যখন তাসফিয়া তার কাঁধে হাত রাখল, তখনই সে টের পায় তাসফিয়া সত্যিই এসেছে। তার পাশে তাসফিয়া নিশ্চুপভাবে বসে পড়ল। একটু পর বলল, ‘তোর মা তোকে খুঁজছে।’
আকাশীর চোখের পলক পড়ছে না। এই কথা সে জানে। দূরে কোথাও দৃষ্টি রেখে সে বলল, ‘তোর জীবনটা আমার কারণেই এমন হয়েছে তাই না?’
‘তুই পাগল হলি নাকি? ও তো আমার নিয়তি। আজ জীবনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পড়েছি। কথা বলতে পারছি না। অথচ আমি জানি আমি নির্দোষ। জীবনটা এমনই। আমাদের কপালে কলঙ্ক লেখা থাকলে লেগে যায়। মানুষ কেবল লাগানোর মাধ্যম।’
‘তবু তুই আমাকে বলেছিলি উপায় বাতলে দিতে। আর আমি করলাম কী..’ আকাশী দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সে পাশে তাকিয়ে দেখে তাসফিয়া মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। মেয়েটি বিধবা না হলেও তার চেহারার মধ্যে বিধবাদের মতো একটা ছাপ পড়েছে। এই একটা মাসে মেয়েটি কেমন শুকিয়েই না গিয়েছে। এই এক মাস আগে ওর সর্বনাশ হয়েছিল। ওর স্বামী ওকে তালাক দেয়। সবের জন্যই আকাশী নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করছে। সে যদি মতি ভাইকে গ্রাম থেকে বের করিয়ে না দিত, তবে তার স্বামীর মতো নেশাখোর লোকেরা হিংস্র হয়ে উঠত না। আর যেই না তার স্বামী জেনেছে, আকাশী তার স্ত্রীরই বান্ধবী, লোকটা তাসফিয়াকে ছেড়ে দিয়েছে। পুরুষেরা দ্বিতীয় বিয়ে যতটা সহজভাবে করতে পারবে, এখনও মেয়েদের ক্ষেত্রে তা ততটা সহজ হয়ে উঠেনি। তাসফিয়া আজ একটা মাস দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। একটি মেয়েকে তার স্বামীর ছেড়ে দেওয়া মানেই ওই মেয়ের মাথায় কলঙ্ক লাগা। তাসফিয়া যে রাতদিন মা-বাবার অবহেলার পাত্র হচ্ছে তা তার মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যায়।
তাসফিয়া বলল, ‘দোষ আমার না, এই সমাজটার আর এর অদ্ভুত প্রচলিত নিয়মনীতির। মায়ের যথেষ্ট সামর্থ্য ছিল আমাকে পড়ানোর। দু-চারটা লোকের কানাঘুষোর কারণেই আমাকে বিয়েটা দিয়ে দিলেন। নইলে তুই বল, মেয়েদের তো বয়ঃসন্ধিকালের পর থেকে প্রেম করার মানসিকতা তৈরি হয়। আমার কি কখনও হয়েছে? আমি আর তুই তো একই ধাঁচের মেয়ে। আমরা তো কারো ক্ষতি করিনি। কোনো ছেলের দিকে চোখ তোলে তাকাইনি। তাহলে আমাদেরই জীবনে এতো দুঃখ কেন? আকাশী, বিয়ের পর আমি গ্লানিগুলোকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার স্বামী খারাপ হলেও মনেপ্রাণে তাঁকে ঠাঁই দিয়েছি। এখন আমার সেই জীবন এমনভাবে আয়নার মতো করে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে যে, আমি নতুন আরেকটা জীবন গড়তেই পারব না। পদে পদে সেই ভাঙা টুকরোগুলোই আমার পায়ে ঢুকে আমাকে কাঁদাবে।’
আকাশী সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘এভাবে বলিস না। তোর জীবন এখনও আছে।’
‘কী আছে বল? এই এক জীবনে আমাকে কয়টা বিয়ে করতে হবে বল?’
‘তুই পড়াশোনা করবি। বিয়ে লাগবে না।’
‘কেমনে? টাকা কি তুই দিবি?’
আকাশীর বাকরোধ হয়ে গেল। তবে তাসফিয়া কথাগুলো বলার সময় কাঁদেনি দেখে তার ভালোই লেগেছে। তাসফিয়ার মুখ এখন অসম্ভব কঠিন। আকাশীর বোধ হলো, জীবনের এক কঠিন পর্যায়ে আমরা দিশেহারা হলেই আমাদের সবারই মুখকে এভাবেই কঠিন দেখায়। আকাশী আর কিছু না বলে তাসফিয়ার সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।
সে বাসায় গিয়ে মনোযোগটা রান্নায় দেওয়ার চেষ্টা করে। বিগত মাসটার মাঝে মাঝেই তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছে। তাসফিয়ার এই পরিণতির জন্য কোনো না কোনোভাবে নিজেকে দায়ী ভাবত। আজ সামান্য হালকা লাগছে। তাসফিয়াকে এই একটা মাস বাইরে দেখা যায়নি। হয়তো তারও অনুভব হয়েছিল, আকাশী বিষণ্ণতায় ভুগছে। তাই তার পরিণতিতে কার দোষ সেটা বুঝাতে এসে আকাশীর মনকে হালকা করেছে। সে ভেবে অবাক হয়, টর্চের চার্জ দিতে হলে একটা ক্যাবল টর্চে লাগিয়ে দিলেই সংযোগ স্থাপন হওয়ার মাধ্যমে টর্চের চার্জ হয়, কিন্তু বাস্তবিক জীবনে এমন কোনো ক্যাবল নেই। তবু দুটো মনের মাঝে সংযোগ স্থাপন হয়। সংযোগের আওতায় আসা মন’ধারী সহজেই বুঝতে পারে আরেকজনের মনে কী চলছে। এই হিসেবে এতমাস আকাশীর কাছ থেকে দূরে থাকা মেয়েটা খুব সহজেই তার মনের দুঃখ বুঝে ফেলতে পেরেছে। অবাক হওয়ার কথা নয় কি?
তাসফিয়ার মন কি একটু হালকা হচ্ছে? সে তো এই যাবৎ বাইরেই আসেনি। আজকে তার বাইরে বেরিয়ে আকাশীর সাথে দেখা করার ব্যাপারটা কি তার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়? তার অনেক আপসোস হলো, এতো তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলাতে পারা চমৎকার মেয়েটার তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়ায়। মা-বাবার কি উচিত নয় মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা?
আচ্ছা, একদিন আকাশীর ক্ষেত্রে ব্যাপারগুলো ঘটলে কেমন হবে? তার ভাবনা এটুকু পর্যন্ত গড়াতেই সে কেঁপে উঠল। না না, এমন বিপর্যয়ের শিকার যেন সে না হয়। কী জানি, কোন সময় কী হয়ে যায়। আজ একমাস যাবৎ মনের ভেতর একটা ভীতি নিয়ে সে ঘুরছে। শত হোক, সে এখনও বড় হয়নি। বড়দের বিরুদ্ধে লড়তে সে পারবে না। চারপাঁচটা ছেলে যদি তাকে ধাওয়া করে মেরে ফেলতে চায়, তবে সে তাদের সাথে হাত-পা দিয়ে বেশিক্ষণ লড়তে পারবে না। এই ভীতিটা একমাস আগের ওই দিনটার পর জাগ্রত হয়েছে, যেদিন মতি ভাইকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তার দোকানে চেয়ারম্যান তালা লাগিয়েছেন। সেদিনের পর থেকে প্রতিটা মদ্যপায়ীর নোংরা রক্ত সেদ্ধ হচ্ছে। চেয়ারম্যান কারও কাছে আকাশীর নাম প্রকাশ করেননি বলে সে নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতে পারছে।
নেশাখোরদের কাছ থেকে নেশা কেড়ে নিতে চাওয়া হলে তারা মানুষ থেকে পশুতে পরিণত হয়। হয়েছেও। ভাগ্যিস মতি ভাইকে ফারুক চাচা গ্রামের কারো সাথেই দেখা করতে দেননি। নইলে লোকটা হয়তো যেতে যেতে আকাশীরও সর্বনাশ করে যেত। তবু তার মনে সুপ্ত একটা ভয় জাগ্রত হয়েছে, এই না কেউ ওকে ধরে ফেলতে পারে, এই না কেউ তার ওপর আক্রমণ করে বসে।
খাওয়া-দাওয়ার পর সে আজকে শুতে গেল। তার মন অকারণেই খারাপ। ভেতরটা কেবল উঠা-নামাই করছে। ঘুমোলে আমরা অন্য জগতে চলে যাই। ঘুমোনোর আগে মনের আনচান করাটা ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলে আমরা ভুলে যাই। আকাশী কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল। বিকালে হৈ-হুল্লোড়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে সে চোখ রগড়ে ওঠে। বাইরে হয়তো কিছু একটা ঘটেছে। সে দৌড়ে ঘর থেকে বেরুয়। বাইরে গিয়ে দেখে প্রায় বাড়ির লোকেরা জড় হয়েছে। অধিক জড় হওয়া লোকের মাঝে গিয়ে আকাশী জানতে পেল, তাসফিয়া নামের মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে।
আকাশীর মাথার ওপর যেন বাজ পড়েছে। কেউ এসে যদি বলে দেয়, এটা মিথ্যা, তবে সে তা গ্রহণ করে নেবে। কিন্তু সকালে জীবন্ত দেখা মেয়েটি বিকাল হতেই মৃত কী করে হতে পারে?
আকাশী কিছুক্ষণ বেহুঁশ অবস্থায় ছিল। হুঁশ ফেরার পর সে বুঝতে পারে কেন তাসফিয়া এতদিন পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাকে দায়মুক্ত করতে এসেছিল। মানুষ স্বার্থপর কেন? দুপুর অবধি তো দিব্যি ভালো ছিল মেয়েটি। তাহলে ভালো থাকার নাটক করছিল সে? সে কি আগে থেকেই নিজের জীবনের অবসান করা কথা ভেবে ফেলেছিল? মৃত্যুর আগের মুহূর্তে মানুষ কতই না অদ্ভুত কাজ করে। তখন তার কথাবার্তা শুনে মনেই হয়নি সে বিকেলের দিকে এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছিল।
মেয়েটি ফাঁসির ফান্দা গলায় দেওয়ার আগে একটিবারও ভাবেনি, আমরা পৃথিবীতে আসি অন্যের জন্য?
আকাশীর বেশ কয়েকটা দিন অস্বাভাবিকতায় কাটে। এই দিনগুলোতে সে একবারও কল্পনা করতে পারেনি, একসময় তার বন্ধু হয়ে থাকা মেয়েটি এখন আর মানুষের মাঝে নেই। তাকে এই কয়টা দিন স্কুলে যাওয়া ব্যতীত বাহিরেও দেখা যায়নি। গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল সে। সে এসব সমস্যা কেন করছে? এই মেয়েটি কি করতে চায়? কার জন্য করতে চায়? সে অন্য স্বার্থপর মানুষের মতো কেন হতে পারে না, যারা শুধু নিজের কথা ভাবে? সে প্রতিবেশীকে কেন প্রতিবেশীর মতো করে থাকতে দিচ্ছে না? কেন প্রতিবেশীদেরও আপন করছে? কেন সে এখানের মেয়েদের আর ছেলেদের মাঝে বৈষম্য দূর করেছে? কেন সে ছেলেদের অনুভব করিয়েছে তারা মেয়ে ছাড়া কতটা অচল আর মেয়েদের ভূমিকা কেবল তাদের ভোগবিলাসের বস্তু হয়ে থাকাতে নয়? কেন সে স্কুলের মেয়েদের মোবাইল আনা নিষিদ্ধ করিয়েছে? কেন সে সেদিনের সেলিনার মতো ওই স্কুলের শতেক ছাত্রীদের বাঁচিয়েছে? কেন সে মদের নাম এই জায়গা থেকে মিটিয়েছে? কেন সে তাসফিয়ার স্বামীর বিরুদ্ধে অ্যাকশন না নিয়ে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিটা মদ্যপায়ীর কাছ থেকে নেশাকে ছিনিয়ে নিয়েছে? কেন সে এসব করছে? কেন?
অনেক প্রশ্ন ওই কাঁচা মনে, যা প্রতিনিয়ত নতুন একটা সংগ্রামের জন্য মুখিয়ে থাকে। সে সংগ্রাম পছন্দ করে। হেরে হোক কিংবা জেতে, সে শিক্ষা নিয়ে দুটোর মাধ্যমেই আত্মতৃপ্তি চায়। এই তার মনোকামনা। সে চায় কেউ বঞ্চিত না হোক। তবে তাসফিয়া কেন এই জীবন যাপন করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে? আদৌ কি আকাশীর দোষ? না, তার দোষ কেন হবে? কেউই কারো মৃত্যু কামনা করে না। সে এক তাসফিয়াকে বাঁচাতে না পারলেও আরও অনেক তাসফিয়াকে বাঁচাতে পারে। আকাশী গোটা সপ্তাহ দেড়েক পর অনিকের বাড়িতে গেল। ফারুক চাচা সোফায় বসে আছেন। আকাশীকে দেখে বললেন, ‘কিরে, কী খবর? কেমন আছিস? তোকে দেখি না কেন?’
আকাশী নির্লিপ্তভাবে তাঁর পাশে গিয়ে বসল। ফারুক চৌধুরী তার মাথায় হাত বুলালেন, ‘কী হয়েছে ফুলি মা?’
‘চাচা, আমার একটা কথা রাখবেন?’, করুণাময় দেখাল আকাশীর চেহারা।
‘কী লাগবে বল। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’
‘আপনার তো অনেক ক্ষমতা। মানে আপনি চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার কথাই সকলে শিরোধার্য করে। আপনি তো জানেন, তাসফিয়ার মৃত্যুর কারণটা কী। মানে ওর যদি বাল্যবিবাহ না হতো, তবে হয়তো সে আজ মৃত্যুর পরপারে হতো না। আমি চাই না, আগামীতে অন্য কোনো মেয়ে তাসফিয়ার মতো ডিপ্রেশনে ভুগুক। একটি বালিকার বিয়ের একবছরও পার না হতেই স্বামীর কাছ থেকে তালাক পেয়ে বাপের বাড়িতে বিধবার ন্যায় বসে থাকা কত বড় একটা অভিশাপসরূপ তা অন্য কোনো মেয়ের অনুধাবন করার পরিস্থিতি আসুক আমি তা চাই না। আপনি ডিক্লেয়ার করে দিন, এই গ্রামে অন্তত এসএসসি পাস করা ব্যতীত কোনো মেয়ের যেন বিয়ে না হয়।’
সে কথাগুলো বলা শেষ করে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলল। ফারুক মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনছিলেন। তাঁর চোখ ছলছল করে উঠল। কে না চায় আকাশীর মতো একটি মেয়ে ঘরে ঘরে থাকুক?
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার