আকাশী পর্ব ৩৪(শেষ)

“আকাশী”
পর্ব ৩৪.

অবশেষে আকাশী অনেক বড় একটি আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এতো সুন্দর আর এতো বড় একটি আকাশের সামনে সে আগে কখনও দাঁড়ায়নি। তার সামনে অগাধ পানি। দূরদূরান্ত পর্যন্ত সীমানা দেখা যাচ্ছে না। আর এই মাতাল করা বাতাস, বলে যাচ্ছে অনেকগুলো ভাষায় কথা। ইশ! কক্সবাজারে সে আগে কেন আসেনি। কেন এতদিন এই মনোরম জায়গা থেকে দূরে থেকেছে? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে সম্ভবত একটা ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। সম্বিত ফিরে পেলে আকাশী পেছনে ফিরে দেখল, অপূর্ব এখনও সানট্যান চেয়ারে কালো একটা চশমা পরে বসে আছে। দূর থেকেই বুঝা যাচ্ছে, অপূর্ব কিছুটা বিরক্তও বটে। তার মুখ শুরুতে উজ্জ্বল দেখিয়েছে, যখন তারা এখানে এসে পৌঁছে। এখন সেই উজ্জ্বলতা উধাও। হওয়ারই কথা। তিনি হয়তো এই জায়গায় আকাশীর ন্যায় প্রথম বারের মতো আসেননি। হোটেলে ফিরে গিয়ে এখন কোনো কাজও নেই। আকাশীরা এর আগে শুরুতে কাপ্তাই লেকে গিয়ে দেখেছিল, অনেক সুন্দর অবিশ্বাস্য প্রকৃতির একটা রূপ। এরপর আবারও একদিনের মাঝে চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখেছিল, অদেখা কিছু জীবজন্তু। গিয়েছিল বান্দরবনে, নিজেকে সম্পূর্ণই মাতাল করে এসেছে। কোথায় অপূর্ব আর কোথায় সে। এক মুহূর্তের জন্যও সে অপূর্বের কাছাকাছি ছিল না। আকাশীকে ধরে রাখাই যাচ্ছিল না। আজ ধরতে গেলে পঞ্চম দিন। কক্সবাজারে প্রথমে আসার কথা থাকলেও অপূর্ব মত পালটানোয় সবার শেষে আসা হয়েছে। আর কোথাও আপাতত যাওয়া হবে না। কক্সবাজার আরও সুন্দর। সুন্দর, কারণ সে পায়ের তলায় এতোগুলো শামুক একসাথে দেখেনি। আকাশ উপভোগ করার পর ভেবেছিল কিছু শামুক কালেক্ট করবে। কিন্তু কবে যে ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। এবার সে শামুক-ঝিনুক কুড়াতে শুরু করল। একসময় দুটো হাত পুরিয়ে এসে সে চেয়ারে ওগুলো ঢেলে দেয়।
‘হোয়াট ননসেন্স? এসব কী করছ? ঝিনুক শামুক?’ অপূর্ব আশ্চর্যের সাথে উঠে বসে।
‘হ্যাঁ, কুড়িয়ে এনেছি।’
অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে অপূর্ব চশমা খুলে বলল, ‘কী করবে তুমি এগুলো দিয়ে?’
‘কক্সবাজারে আসার স্মৃতি হিসেবে রেখে দেবো।’
‘তুমি টোটালি পাগল।’ একই কথা সে এই কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার বলেছে।
‘ইয়েজ আই অ্যাম। আপনার সমস্যা হবে না। আমি প্যাকেট আনার চেষ্টা করছি।’
‘তোমাকে কে দেবে?’
‘ওহ্, তাই তো। আচ্ছা, কিছু টাকা দিন। আবারও কিছু কিনলে অবশ্যই পাব।’
‘যেগুলো কিনবে সেগুলো কোথায় রাখবে?’
‘এ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।’
অপূর্ব বিরক্ত হতে চেয়েও পারল না। আর মাত্র দুইদিনের ব্যাপার। পকেট থেকে সে টাকা বের করে আকাশীকে দেয়। অপূর্ব হেলান দিয়ে পুনরায় বসতে যায়।
আকাশী বলল, ‘বি কেয়ারফুল। ওসব যেন না ভাঙে।’
অপূর্ব থ হয়ে মনে মনে নিজেকে শোধালো, সিরিয়াসলি? গায়ের চাপে ঝিনুক ভাঙলে সে কি ব্যথা পাবে না? কেবল ঝিনুকেরই চিন্তা? সে যদি সত্যিকারই তার মনের মানুষ হতো, তবে আজ সে আকাশীর পরম যত্নে তুলে আনা ঝিনুকগুলো হাতে নিয়ে আগলে রাখত। কিন্তু তা তো আর বাস্তব নয়।
কিছুক্ষণ পর মৃদু আওয়াজে অপূর্ব উঠে দেখল, আকাশীর গলায় ঝিনুকের লম্বা একটা মালা। সম্ভবত কিনেছে। সে এবার গম্ভীর আর থাকতে পারল না। শব্দ করে অপূর্ব হাসল। আকাশী ঝিনুক প্যাকেটে ঢোকানোর সময় চমকে তার দিকে তাকায়। নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আজ কতমাস পর সে অপূর্বের গলা খুলে হাসা দেখছে! অপূর্ব বলল, ‘তোমাকে একদম একটা সাধুবাবা লাগছে।’ বলে আবারও মুখ টিপে হাসল।
আকাশী নিজের মনকে বলল, লাগলে লাগুক। কিছুই আসে যায় না। আপনার মুখে হাসি ফুটেছে এই অনেক। মুখে বলল, ‘আমি এগুলো এখানে রাখছি। আমাকে এবার বসতে দিন।’
অপূর্ব উঠে জায়গা করে দেয়, ‘অন্যটায় গিয়ে বসো না।’
‘এটাতে বসলে কোনো সমস্যা?’ অপূর্ব তর্ক না করে জায়গা করে দিচ্ছিল। কিন্তু আকাশী ততক্ষণে অন্য চেয়ারে গিয়ে বসে।
‘অদ্ভুত!’
আকাশী ফিরে তাকাল না। নিশ্চিন্তে বসে সুদূর দূরের অগাধ পানির দিকে চেয়ে রইল। গলার মালাগুলো সে নিতান্ত প্যাকেটের জন্য কিনেছিল। এখন গলায় কিছু কিছু ঝিনুকের ধারালো অংশ ফুটছে। আকাশী মালা খুলে ফেলল। সব কেনাকাটা সে আগেই করে হোটেলে রেখে এসেছে। তাই আপাতত ওগুলো রাখার কোনো জায়গা নেই। আকাশী আবার চেয়ারে রাখলে নিতেও ভুলে যেতে পারে। সে মালাটা দুইভাঁজ করে মাথায় পরে পুনরায় আকাশের দিকে মনোযোগ দেয়। সে খেয়ালও করেনি, অপূর্ব তার দিকে অপলক চেয়ে আছে। যখন খেয়াল করল, তখন সে থতমত খেয়ে অন্যদিকে ফিরে। আকাশী বলল, ‘আপনি ন্যাকামি বেশি করেন।’
‘তো?’
‘ইসমাইল নামের একজন বলেছে আপনাকে চিকন একটা বেত দিয়ে পেটানো উচিত। আরও একটা উপায় বাতলে দিয়েছেন, যাতে আপনাকে পানিতে চুবাই।’
‘কি অদ্ভুত! কে এই লোক? আমি কী অপরাধ করেছি?
‘এইযে, সবসময় নিজের মন যা চায় তাই করেন! আপনার স্বভাবের একটা লোকের জন্য তাঁকে একবার বলতে শুনেছি। ভাবলাম, আপনাকে জানিয়ে দেই।’
‘যে যার-যার স্বভাব নিয়েই গঠিত। আমাকে দোষারোপ করা ঠিক হয়নি।’
‘আপনাকে আমি পানিতে চুবাচ্ছি না। নইলে পারমিশনও নিতাম না। গলা ধরে বলা-কওয়া ছাড়া পানিতে ডুবিয়ে রাখতাম।’
‘ডেঞ্জারাস। ডুবাও না কেন?’
আকাশী এবার মজা থেকে বেরিয়ে আসে, ‘আমি এমনটা পারব না।’ তার তৎক্ষণাৎ মন খারাপ হয়ে যায়। সে বুঝবে না, আকাশী তাকে কেন আঘাত করতে পারবে না। অপূর্ব একসময় তার ছিল না। আজ সে পাশে থেকেও যেন নেই। ‘আমি হোটেলে চলে যাচ্ছি। আর ইচ্ছা নেই বসার। আপনি থাকুন।’
‘ওয়েট। আমিও চলে যাব।’
আকাশী কিছু বলল না। দুজনই গিয়ে লবণাক্ত পানিতে ডুবানো পা’গুলো ধুয়ে নেয়। আকাশী নিশ্চুপ থাকায় অপূর্বও কিছু বলছিল না। সেই নীরবতা নিয়ে তারা হোটেলে চলে আসে। এসে কাপড় পালটে নেয়। রাতের খাওয়া-দাওয়া সারার পর আকাশী বিছানায় এলিয়ে পড়ে। অপূর্ব কিছুটা হতবাক হয়। মেয়েটি আজ কক্সবাজারে এসে কত খুশিই না হয়েছিল। বিকেলে কী এমন হয়ে গেছে? অপূর্ব বিছানায় ঠেশ দিয়ে অন্য হাতে আকাশীর কপালের তাপ অনুভব করে দেখে। ঠান্ডাই আছে সবটা সময়ের মতো। আকাশী নড়ছে না দেখে কপাল থেকে সরাসরি হাত না নামিয়ে সে হাতটা তার গালে ছোঁয়ায়। এবার আকাশী চোখ খুলে ফিরে তাকাল। তার মন খারাপ ছিল। এখন অপূর্বের মুখ তার সোজাসুজি দেখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল।
অপূর্ব বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’ আকাশী অস্ফুটভাবে শব্দগুলো উচ্চারণ করল।
‘বিচে যাবে?’
‘এখন? এখন তো শাড়ি পরে আছি।’
‘কিছু হবে না। এখন অন্ধকার। তেমন কেউ লক্ষ করবে না।’
সে দেখল, অপূর্ব এখন ফুল প্যাণ্ট পরে আছেন। সম্ভবত পানিতে আর নামবেন না। তার শার্টের বোতামগুলো প্রতিবারের মতোই খোলা। কিন্তু আজ তিনি ভেতরে হাফ হাতের গেঞ্জি পরেননি। তার চোখ একবার তার বুকের দিকে যায়। একদা সে এই জায়গায় এসে চরম ভয় পেয়েছিল। কিন্তু আজ কেন যেন ওই লোমগুলো ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আকাশী এক পলক ওদিকে তাকাতেই নজর সরাল, ‘আমার উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’
আকাশী অপূর্বকে কোমল স্বরে কথা বলতে দেখায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়ই হয়ে পড়েছে। কী বলছে তার খেয়াল নেই। অপূর্ব তার দিকে চেয়ে রয়েছে। সে আর পারছে না আকাশীর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে। তার এই চাহনি, তার ঘ্রাণ, তার এই নিশ্বাস এগুলো তাকে বেশিক্ষণ দূরে থাকতে দিচ্ছে না। সে তাকে কোলে তোলে নেয়। আকাশী এবার পুরোপুরিই নির্বাক হয়ে পড়ল। সে তাকে নিচে নিয়ে যায়। কিছু মানুষের আসা-যাওয়া ছিল। অপূর্ব ভ্রূক্ষেপ করেনি। তবে আকাশী অগত্যা একহাত দিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে বলল, করছেনটা কী?
অপূর্ব কিছুই বলল না। বিচের বহুদূরে আসার পর সে আকাশীকে বালির ওপর বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসল, ‘দেখ জায়গাটা এখন কেমন সুন্দর দেখায়।’
আকাশী তাকিয়ে সকালের চেয়ে আরও অধিক মোহিত হয়ে পড়ল। কারণ সে রাতের পরিবেশকে অত্যধিক ভালোবাসে। কিন্তু এই উত্তেজনা পাশে বসে থাকা অপূর্বের কারণে চাপা পড়েছে। সে আকাশের দিকে কিংবা পানির দিকে মনোযোগ দিতে পারছে না। সে খেয়াল করছে, অপূর্ব এই যাবৎ তার দিকেই চেয়ে আছে। আকাশী তার দিকে তাকায়। এই পর্যন্ত সে এতটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে কখনও পড়েনি। অবশেষে কি অপূর্ব গাম্ভীর্যের জন্যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন? নাকি এটা আদৌ কোনো স্বপ্ন? অপূর্ব তার গালে হালকা করে হাতের আঙুলের পেছনের অংশ ছুঁয়ালে সে বাস্তবতাকে বুঝতে পারল। সে শিউরে উঠে ঠিক প্রথমবারের মতো, যেদিন সে তার পায়ে নূপুর পরিয়ে দিয়ে তার হাত ধরে। আকাশী তখনও পাথর হয়ে বসে রইল, যখন অপূর্বের ডানহাতটা তার কোমরে ছিল, যখন তার নাক আকাশীর নাককে ছুঁয়। এরপর সবদিকটা ধোঁয়াটে হয়ে যায়, যেন দুটো মানুষ ঘোরের মধ্যে আছে। আশেপাশের জায়গাগুলো ঝাপসা হয়ে যায়। উপরের অসামান্য আকাশ, সামনের সুদীর্ঘ সুপ্রশস্ত বাধাহীন ভূ-তল, তার পরে শুরু হওয়া সীমাহীন পানির পেয়ালা অসাধারণ সবকিছুই এখন তাকে আর প্রভাবিত করতে পারছে না। প্রকৃতির শক্তিশালী বিশালাকৃতির এসব উপাদান আকাশীকে আর মোহিত করতে পারছে না, যতটা অপূর্ব নামের লোকটা করে রেখেছে। তার ঠোঁটের ওপর থেকে ঠোঁট নামিয়ে আকাশী দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি হোটেলে ফিরে যাচ্ছি।’
‘আমিও আর বসতে চাই না। এখন থেকে আমাদের মাঝে আর কেউ যেন না থাকে। প্রকৃতির তোমার এই বন্ধুগুলোকে বলে দাও।’ আকাশী কিছুটা লজ্জা পেয়ে সায় না দিয়ে চলে যায়।
.
পরদিন সকাল আকাশী ভাবতে লাগল, সে প্রকৃতির সাথে বড় অন্যায় করেছে। অপূর্বকে পেয়ে সে তার অনন্য উপাদানগুলোকে ভুলে গেছে। কক্সবাজারের মতো অপরূপ একটি জায়গাকে এখন নিতান্তই সাধারণ বোধ হচ্ছে। অন্য কোনো সময় এমনটা হতো না। অপূর্ব নাস্তা করার পর আকাশীর বিছানায় রাখা নীল টি-শার্টটা পরে নেয়। আকাশী কেনাকাটার জিনিসগুলো লাগেজে গুছাচ্ছে। অপূর্ব নিঃশব্দে এসে পেছন থেকে তার ঘাড়ের চুল সরিয়ে ঘাড়ে মুখ রাখে, ‘বাইরে যাবে না?’
তখন অপূর্বের হাত তার পেটের কাছে এসে যায়। তার জবাব দিতে দেরি হয়, ‘ভেতর-বাহির আমার জন্য কেন যেন সমান হয়ে গেছে।’
‘তা কেন?’ অপূর্বের ঘুম থেকে উঠার পরের ভাঙা গলার আভাসটা এখনও রয়ে গেছে। আকাশী মুগ্ধ হয়ে শোনে রইল, ‘তুমি না আকাশকে অনেক ভালোবাসো, বিশেষ করে ওখানে, যেখানে সে নিজের বাহু মেলিয়ে হাসে? আমি ভেবেছি বড় আকাশটা দেখানোর জন্য কক্সবাজারের চেয়ে বেটার কিছু হতে পারে না। একচুয়ালি, আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই তোমাকে প্রথমে এখানে আনিনি। যদি এখানেই নিজের মনের খোরাকগুলো মিটিয়ে নিতে, তবে অন্যান্য জায়গায় মজা করতে না পারলে সেই জায়গাগুলো আমার আকাশীর ওপর রাগ করত।’
আকাশী মনে মনে বলল, তাইতো। কেবল আকাশই নয়, অপূর্বও এই কক্সবাজারে আসার অনুভূতিটাকে সম্পূর্ণ পালটিয়ে দিয়েছে। এই অপূর্ব আগে ছিল কোথায়? কাল হঠাৎ তিনি তাকে এতো কাছে কী করে টেনে নিলেন? প্রশ্নগুলো ঘুম হতে উঠার পর থেকেই মাথায় ভনভন করে চলেছে। কেন যেন হঠাৎ করে চাঁদ হাতের মুঠোয় পাওয়ার মতো করে অবিশ্বাস্য বনে চলে গিয়েছিল। মনটা কোনোভাবেই মানতে চাইছে না, ফাইনালি অপূর্বকে সে পেয়েছে। কিন্তু কীভাবে?
আকাশী তার হাত ছেড়ে দিয়ে তার দিকে ফিরল। অপূর্ব চোখাচোখি হওয়ার অবকাশ না দিয়েই তার কপালে আলতোভাবে চুমু খায়। ওখানেই সে নাক লাগিয়ে রাখল। আকাশীর চেহারা না দেখলেও সে কিছু একটা বুঝতে পেরে বলল, ‘কোনো প্রশ্ন করবে বুঝি?’
আকাশীর বারবার লাগছে, প্রশ্নটা করা উচিত হবে না। জিজ্ঞেস না করলে মনের খচখচানোও দূর হবে না।
‘আপনি…হঠাৎ এভাবে পালটে গেলেন কেন? সত্যি বলতে এখনও ঘোরের মধ্যে আছি।’
অপূর্ব প্রশ্নের গভীরতা না বুঝে স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল, ‘আমি জানি না, তুমি কেমন। তুমি লোভী স্বার্থপর যাই হও, আমি তোমাকে ভালোবেসে এসেছি। অবশ্য মনটাকে বাধা দিতে চেয়েছি। কিন্তু সে আবারও তোমার পিছু ছুটেছে। আমি কিচ্ছু জানি না, স্রেফ তোমাকেই ভালোবাসি।’ বলতে বলতে সে আকাশীকে নিজ বাহুতে ভরে নেয়।
আকাশী পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়েছিল। তার মুখের কাঠিন্য এমন হয়েছে যে, কিছু একটাকে সে জোরপূর্বক বাধা দিচ্ছে। হয়তো কান্না। অপূর্বের আদরে তার আবেগ প্রশ্রয় পেতে চেয়েও পাচ্ছে না। অপূর্ব যখন আকাশীর দিকে তাকাল, তখন সে হতভম্ব হয়ে যায়। সে কাঠের ন্যায় নড়নচড়নহীন দাঁড়িয়ে আছে। সে যে কবে অপূর্বের পিঠে থাকা হাতগুলো সরিয়ে ফেলেছে তাও লক্ষ করেনি। সে তার দুই হাত দিয়ে আকাশীর মুখ ধরে ডাকল, ‘আকাশী?’
আকাশী মুখ উপরে তুললে অপূর্বের সাথে তার চোখাচোখি হয়। সে আকাশীর লাল চোখ দেখে পুরোপুরিই থতমত খেয়ে যায়, ‘কী হয়েছে আকাশী?’
‘আমি মনে করতাম আপনি আমাকে, আমার মাঝের আসল আমিকে চেনেন।’
অপূর্ব তবু কিছু বুঝে উঠতে পারল না। উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আমি কি তোমাকে হার্ট করেছি? তুমি জানো না, বিয়ের পর থেকে আমি অনেকবার তোমার কাছে আসতে চেয়েছি। আমি চাইলে পুরুষত্ব দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্কটা আগেই করতে পারতাম। কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা এতো দৃঢ় ছিল যে, ভেবেছি আগে আমাদের মানসিক সম্পর্কটা গড়ুক। আমি কি মানসিকটা করতে দেরি করে ফেলেছি? সত্যি বলছি আকাশী, আমি যদি আগের অপূর্বটা থাকতাম তবে তোমাকে এই একটা মাস কষ্ট দিতাম না। তুমি যেমন আছ, তেমনই তোমাকে মেনে নিতাম। বিয়ের আগে আমি বিষণ্ণতার কারণে পুরোপুরি পালটে যাওয়ায়, বিয়ের পর নিজেকে ঠিক করতে দেরি লেগেছে।’
আকাশী দাঁত চেপে চেপে বলল, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি একটা ভুল মানুষকে এতদিন ভালোবেসে এসেছি।’ সে অপূর্বের হাতগুলো ছেড়ে দেয়।
সে ফিরে গুছানো লাগেজের বাইরে থাকা দুয়েকটা কাপড় ভাঁজ না করেই লাগেজে ঢুকিয়ে চেইন বেঁধে দেয়।
অপূর্ব হতবাক হয়ে বলল, ‘হয়েছেটা কী? ওই তোয়ালে কাপড় তো আরও লাগবে। আমরা দুইদিন আছি না?’
‘আমরা আজই চলে যাচ্ছি।’
‘বলছটা কী?’
‘যাই বলছি তাই।’
‘আমি যাব না।’
‘তাহলে আমি একাই চলে যাব।’
‘একা যাওয়ার কথা তো আসেনি। তোমার হঠাৎ কী হয়েছে ওটাই তো বুঝছি না।’
আকাশী ক্ষণকালের জন্য ব্যস্ততা থেকে নিজেকে তুলে আনে, ‘আমি সবসময় একা থেকে এসেছি, যাতে আমার বিশ্বাসের সাথে কেউ যেন খেলতে না পারে। কিন্তু আমি পারলাম না। তবে এতটা দেরিও হয়নি। আমি থাকতে চাই না, এমন একটা মানুষের সাথে যে আমাকে চেনে না।’
‘সবারই ভালো-খারাপ দিক থাকে। তাই বলে আমরা সবাইকে তো ঘৃণা করে ফিরতে পারি না। আমি তো মেনে নিয়েছি তোমাকে।’
‘যেন অনেক বড় একটা উপকার করেছেন।’
‘এমনটা নয়।’
‘আমি চলে যাচ্ছি। একমুহূর্তও থাকব না।’
‘বাসার চাবি কিন্তু আমার কাছে।’
‘আমি আপনার বাসায় যাচ্ছি না।’ মনে মনে বলল, আত্মসম্মানে লাগে, এমন জায়গায় আমি যাব না।
অপূর্ব মজা করছিল। কিন্তু এখন সে গম্ভীর না হয়ে পারল না। ‘কী মিন করছ?’
‘আমি মেসে থেকে পড়াশোনা করব।’
‘স্বামী থাকতে তুমি…’
আকাশী তাকে কথাটা শেষ করতে দিলো না, ‘আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি।’
অপূর্ব এতক্ষণ নম্র ছিল। ভেতরে লুকিয়ে পড়া উগ্রতাটা এখন বেরিয়ে আসতে চাইছে, ‘বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। তোমার জীবনটা কেবল আমার জন্য নয়। বিয়ের পর থেকে মা-বাবারও হয়েছে।’
‘আমি জানালাম, আলাদা হচ্ছি। তালাকের কথা বলিনি। মা-বাবা দুই বছরের আগে আসবেন না। এলে তখনেরটা তখন দেখা যাবে। আমি কিন্তু এখন আর এক সেকেন্ডও আপনার সামনে থাকতে চাই না।’
অপূর্ব মেজাজের উগ্রতার মাঝে একটু হলেও ভাবল, এটা তারই উদারতা যে, আকাশীকে সে আগলে রেখেছে। নইলে তার ন্যায় ছেলে আকাশীর মতো কোনো মেয়েকে পাত্তা দিত না।
আকাশী ক্রমে বোরকা পরে নেয়। সে চাইছিল, হঠাৎ করে পালটে যাওয়া পরিস্থিতিটা যেন ঠিক হয়ে যায়। অপূর্ব যেন তাকে থামিয়ে বলে দেন, তুমি লোভী কিংবা স্বার্থপর নও। আমি এমনিই দুষ্টুমি করছিলাম। কিন্তু অপূর্ব দূরে দাঁড়িয়ে আছেন।
সে বলল, ‘চলে যাও, আমার ভালোবাসাকে চিনতে না পারলে আর কখনও আসবে না আমার জীবনে।’
.
.
পরিশিষ্ট
.
অর্ডার করা খাবারের প্যাকেটগুলো এখনও সেভাবে পড়ে আছে, যেভাবে দুপুরে রেখেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, এখন সে ব্যতীত কেউ নেই, যে এগুলো ঠিক করবে। সে নিজেই উঠে দুইদিনের নিয়মের মতো টেবিল পরিষ্কার করে। খাবার আবারও রাতের জন্য অর্ডার করতে হবে। নিজের হাতের রান্না তার এখনও পাকা হয়নি। লবণ-মসলা পরিমাণমতো দিতে এখনও জানে না। বিস্বাদ খাবার খাওয়ার চেয়ে ঢের ভালো, টাকা দিয়ে অর্ডার করে খাওয়া। এমন সময় নাছিমা আপাও নেই। মা-বাবার আদেশে দুইজন একা থাকার জন্য তাঁকে বিদায় করে দিতে বলেছিল আকাশীকে। একসময় মা-বাবা দেশের বাইরে গেলে এই আপা অপূর্বকে একা কিছু করতে দিতেন না। পানির বোতলও নিজে পুরিয়ে দিতেন। কিন্তু আজকে এই দিনটা দেখতে হবে, সে আগে জানলে তাঁকে বিদায় দিতই না। এখন তৎক্ষণাৎ কাজের লোকই বা কোত্থেকে খুঁজবে! দুইদিন যথেষ্ট খোঁজ-খবর নিয়েছে। বিশ্বস্ত কারও সম্বন্ধে জানেনি। নাছিমা আপার ফোন নাম্বারটাও এখন নেই। আকাশী এই বাড়িতে নতুন উঠেছিল বিধায় সে একটা ফোনবুক রেখেছিল, যাতে নতুন গঠিত আত্মীয়-স্বজনের ফোন নাম্বার রাখত। হয়তো ওখানে নাছিমা আপার নাম্বারও থাকতে পারে। অপূর্ব রুমে ফিরে যায়। এই রুমটাতে থাকতে ইচ্ছে এখন হয় না। প্রতিটা কিছুতেই যেন আকাশীর ছোঁয়া আছে। কী আর করা! পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হয়তো বেশিদিন লাগবে না। নইলে সে রুম পাল্টাবে। অপূর্ব ড্রয়ার আলমারি সবই খুঁজে দেখছে। আকাশী কক্সবাজারের হোটেল থেকে আর বাসায় আসেনি। তার কাপড়গুলোও এখনও আগের মতো আছে। অপূর্ব হতাশ হয়ে আকাশীর বইয়ের দিকে তাকায়। তার একবার আসার সম্ভাবনা কিছুটা দেখা দিচ্ছে। তবে সে এলে তাকে অপূর্ব কিছুই বলবে না। এসে তার জিনিসগুলো নিয়ে গেলেই ভালো হবে। অপূর্ব বইয়ের ছোট রেকে খুঁজতে থাকে। একটা ডায়েরিও আছে বইয়ের ভেতর। সম্ভবত এখানে থাকতে পারে। অপূর্ব ডায়েরি খুলল না। ডায়েরির মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা। হয়তো ছোট ফোনবুকটা এখানেই আছে। অপূর্ব সেই ফাঁকা জায়গায় ডায়েরিটা খুললে একটা ভাঁজ করা কাগজ নিচে পড়ে গেল। অপূর্ব তুলে নেড়েচেড়ে বুঝার চেষ্টা করে কী হতে পারে। কাগজের অমসৃণতা দেখে লাগছে, কাগজটা মোচড়ানো হয়েছিল। একবার আরেকজনের চিঠি পড়ার ভুল করেছিল। আবারও করবে? শেষবারের মতো করা যায়। অপূর্ব খুলে দেখল, এটা সেই চিঠি, একদা যেটা আকাশী জয়কে লিখেছিল। কিন্তু এটা তো সে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আকাশী কি তা কুড়িয়ে নিয়েছে? যদি নেয়, তবে সে হয়তো স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিল, জয় তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাহলে এখনও তাদের মাঝের বন্ধুত্ব ভাঙেনি কেন? অপূর্ব কিছুই বুঝতে পারছে না। ইশ! তার যদি টেলিপ্যাথি ক্ষমতা থাকত!
অপূর্ব খাবার টেবিলে হাত রেখে চেয়ারে বসে পড়ল। আকাশীর ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়ার সাহস হচ্ছে না। সে হাতগুলো দিয়ে মুখ ঢাকল। যা হয়েছে মোটেই ঠিক হয়নি। আকাশী পাগলামি করছিল, করুক। সে কেন উগ্রতা দেখাতে গিয়েছে? সফটলি সবকিছু সে হ্যান্ডেল করতে পারত। একটা মানুষ যতই মন্দ হোক, তার মন্দতাকে মুখে কেন প্রকাশ করতে যাবে? আকাশী কি আদৌ ওরকম? তার মাঝে এমন কিছু তো অবশ্যই ছিল, যার জন্যে আকাশীর মন্দ চরিত্রকে চেনেও তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। নাকি তাকে অন্য কারো হতে না দেওয়ার জন্যই তাকে বিয়ে করে নিয়েছে? সে আসলেই জানে না, কোন মোহে পড়ে সে আকাশীকে নিজের জীবনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এটুকু বলা যায়, তার মধ্যে ভালোবাসাই লুকিয়ে ছিল।
একটা মাস সে তার সাথে থেকেছে। আকাশীর বিবেককে পড়তে না পারলেও খারাপ কিছু চোখে পড়েনি। এমনকি সে টাকা নিয়ে তেমন কোনো দাবি-দাওয়া করেনি। সবসময় তাকে কোমলমনা একটা মেয়েই লেগেছে। কিছু মায়াবতী অবশ্য নিজের চেহারায় একটা নকল স্বচ্ছতা ঝুলিয়ে রাখে, কিন্তু আকাশীকে তো ওই জায়গায় ফেলা যায় না। বরং সে তাকে যতটুকু চেনেছে, এতে মন্দ কিছু চোখে পড়েনি। দুইদিন আগের কাণ্ডটাই বা ওর চরিত্রের মন্দ কিছু প্রকাশ করে না। একটা লোভী মেয়ে কখনও তার বিত্তবান স্বামীকে ফেলে নিজ আয়ে পড়াশোনা করতে পারে না। সে এটুকু নিশ্চিত যে, আকাশী তার কাছ থেকে তেমন কোনো অর্থও পায়নি যে, এভাবে তাকে একেবারে ছেড়ে দিতে পারে। অথবা তাকে কোনো ছেলের কবলে পড়তেও দেখা যায়নি। এমনকি জয়ের জন্য মেয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, তার আকাশীর সাথে বন্ধুত্বের চেয়ে অধিক কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তাহলে কারণটা কী হতে পারে?
অপূর্ব হতাশাগ্রস্থ হয়ে শুরু থেকে ভাবতে লাগল। কী কারণে তার আর আকাশীর মাঝে দূরত্ব এতটুকু বেড়েছে। কী কারণে সে আকাশীর ভেতরটাকে দেখার চেষ্টা করেনি। অপূর্ব ভেবে দেখল, সে একদিন হুট করেই বুঝতে পারে, আকাশীর জন্য তার মনে অনেক বড় একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। প্রেম শুরু করার প্রথম ধাপ অনুযায়ী সে আকাশীকে তার মনের ভাবনাটা বুঝাতে যায়, এই ভেবে যে, সেও তাকে হয়তো পছন্দ করে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে আকাশী তাকে দূরে ঠেলে দেয়। তাতে সে বেশি আঘাত পায়নি। কারণ বুঝতে পেরেছিল, পরিস্থিতিটাই মন্দ ছিল। পরে অবশ্য তার মন গলে যায়, যখন আকাশী তার হাতটা তার কোমল গালে ছোঁয়ায়। সেদিন সে আবারও তাকে নিজের করার কথা ভেবেছিল। এমন সময় একটা চিঠি সবই পালটে দেয়। সালমা এনে তাকে একটা প্রেমপত্র ধরিয়ে দিয়ে বলল, জয়কে যেন দেয়। ওয়েট, ওয়েট, সে কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, জয় বাসায় ছিল কিনা। কিন্তু এও তো বলেনি, চিঠিটা কাকে দিতে হবে। কিন্তু সালমা বলতে পারত, চিঠিটা অপূর্বের জন্য। চিঠির প্রতিটা শব্দ তার মনে এখনও গেঁথে আছে। লেখাগুলো তার জন্যই পারফেক্ট ছিল। কিন্তু কোন কারণে সে চিঠির কথা এখন উপলব্ধি করতে পারলেও তখন করেনি? সে তখন কেন ভেবেছিল, চিঠির কথাগুলো জয়ের জন্যই স্যুট করে? তার মনে পড়ল সালমাই তাকে এর আগে আকাশীর চরিত্রের সম্বন্ধে বলেছিল। বিশ্বাস না করলেও চিঠিটা পড়েই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখনও সবকিছু জট পাকিয়ে আছে। তার কাছে ডায়েরিটা খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু এখানে যদি জয়কে নিয়ে কিংবা অন্য কোনো ছেলেকে নিয়ে কিছু লেখা থাকে? অপূর্বের তা পড়ার মোটেই ক্ষমতা নেই। আকাশীর জীবনে সে অন্য কাউকে একদম মেনে নিতে পারে না। সে তবু দ্বিধাবোধ করে ডায়েরিটা খুলল।
আকাশী সম্ভবত শহরেই আছে। কিন্তু কোথায় সে থাকবে অপূর্ব কী করে বুঝবে? এতো বড় জায়গায় সে তাকে কী করে খুঁজবে? আকাশী তাকে আপন করে না নিলেও ক্ষমা তো চাইতেই হবে। নইলে তার ভালোবাসাটা সার্থকতা পাবে না। সে ক্ষমা না চাইলে, অনেক ক্লেশ জমবে, সে তাকে চিনতে ভুল করেছে। অন্তত এই দুইদিনে সে ভালই বুঝেছে, আকাশীকে ছাড়া সে কতটা অচল। অপূর্ব তবু গাড়ি নিয়ে নানাদিকে তাকে খোঁজার চেষ্টা করছে। কোনোদিকে যদি খবর পেয়ে যায়, একটা নতুন মেয়ে দুইদিন আগে এই জায়গায় উঠেছে। কিন্তু তার ছবি কাউকে দেখিয়েও লাভ হচ্ছে না। আকাশীকে খুঁজতে গিয়ে সে সারাটা বিকেল নানা জায়গা চষে ফেলে। আগে শহরটাকে যতটা চিনত না, তার চেয়েও বেশি আজ চেনে ফেলেছে। সে সন্ধ্যায় গাড়ি এক অজানা বাজারের সামনে পার্ক করে বসে থেকেছিল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। তার চোখও ঝাপসা হয়ে আসছে। সে কি আর কখনও আকাশীর দেখা পাবে না? ওর হয়তো অনুতাপ নেই যে, সে ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছে। কারণ তার দ্বিতীয় ভালোবাসা স্ট্রাগল। ওটা নিয়ে সে জীবনকে অতিবাহিত করতে পারবে। কিন্তু অপূর্বের কী হবে?
ঝাপসা চোখগুলো কিছু একটা টের পেয়ে গ্লাসের বাইরে তাকায়। একটা চেনা চেনা লোক বলল, ‘অপূর্ব ভাই না?’
‘জ্বি, আপনি কে?’
‘আমি মতিউর রহমান।’ সে শোধরাল, ‘মতিভাই।’
অপূর্ব নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘এখানে কবে থেকে থাকতে শুরু করেছিস?’
‘এইতো ভাই, ভালো ধান্দা শুরু করলে অনেক মানুষ আকাশ ছুঁয়। আল্লাহ আমাগো ওপর মেহেরবান হওয়ায় এখানে বউ-বাচ্চাকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পেরেছি। তা এখানে কী করেন ভাই?’
‘কাজে এসেছি। ব্যবসা কি মদের?’
‘না ভাই।’ সে জিভ কেটে তওবা খেল, ‘ওই ভুলটা আর করি নাই। একটাই জীবন, গুনাহ্ এতো কেন কামাব? গুনাহ্টা গেরাম থেকে তাড়া না খেলে হয়তো বাড়তেই থাকত। আমি কাল গেরামে গেছিলাম। সবই দেখি পালটে গেছে। আমার বিশ্বাসও হয় না, মাত্র কয়েক বছরে এতটা পালটে যেতে পারে। আমি আকাশীকেও কত খারাপ ভাবছিলাম। অথচ সে পুরো গেরামের চেহারাই পালটে দিছে। ভাগ্যিস কাল দেখা হয়ছিল। নইলে শুকরিয়াটা আদায় করতে পাইরতাম না।’
অপূর্ব এতক্ষণ তার কথায় মনোযোগ দেয়নি। কিন্তু শেষের কথায় ভ্রূ নেচে উঠল, ‘কোথায় দেখেছিস মতি?’
‘গেরামে।’
অপূর্ব কপালে হাত দেয়। তার মাথায় এটা কেন আসেনি, আকাশী গ্রামের বাড়িতেও থাকতে পারে? এতক্ষণে সে পৌঁছেও যেতে পারত। অপূর্ব উত্তেজিত হয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে মতিউরকে জড়িয়ে ধরে, ‘ধন্যবাদ মতি। কী করে আমার খুশি প্রকাশ করব?’
অপূর্ব একহাজার টাকা বের করে তাকে দেয়, ‘বকশিশ হিসেবে রাখিস।’
অপূর্ব কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়ে।
.
অপূর্ব তালগাছের পাশে গাড়িটাকে থামায়। খামারের পাশের জায়গায় কোনো একটা কাপড় দেখা যাচ্ছে। তার মন বলছে এটা আকাশীই। সে গিয়ে দেখল, আকাশী বিলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবারের মতোই তার চুল খোলা। অপূর্ব তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল, যেন আকাশী ছাড়া তার কেউই নেই।
‘প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও।’
আকাশী নিজেকে ছাড়িয়ে অপূর্বের ঘাড়ে হাত রেখে তাকে সামনে আনে, ‘করেছি। অনেক আগেই।’ ভুল করে ধরেছিল মনে পড়ায় হাতটা সরিয়ে নেয়। এই যাবৎ অপূর্বের কথাই সে ভাবছিল। বাবার পর কাউকে হারিয়ে সে এতটা কষ্ট পায়নি।
‘সত্যিই। তুমি জানো না, এই দুইদিন আমার উপর কী গিয়েছে। আমি দুঃখিত আকাশী।’
‘যা হয়েছিল সবকিছুকেই ভুলে যান। নতুন একটা জীবন শুরু করুন।’
‘হুঁ, চল আমার সাথে। তোমাকে ছাড়া শুরু করতে চাই না।’
আকাশী হাসল, ‘একা শুরু করতে বলেছি।’
‘প্লিজ আকাশী। যা হয়েছিল, সবই মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং। সালমাই লোভী আর স্বার্থপর ছিল। ও নিজের চরিত্রই তোমার বলে আমার মনকে বিষাক্ত করেছে। প্লিজ, আমাকে আমার ভুল শুধরাতে দাও। তোমাকে কষ্টে আমি আর এক মুহূর্তও রাখতে চাই না।’
‘কষ্ট পেতে পেতে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাই সুখকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারি না। ভালই হবে আমরা বিয়ের আগের মতোই থাকি। আমি আবারও আমার জীবনের সংগ্রাম শুরু করতে চাই, যেখানে থেমেছিলাম, সেখান থেকেই।’
‘এই সংগ্রামের অংশ কি আমি হতে পারি না? প্রমিজ করছি, এবার থেকে কিছু হলে, সবার আগে আমি নিজের ওপরই সন্দেহ করব, তোমাকে সঠিকভাবে ভালোবাসতে পারছি কিনা..’ আকাশী তার মুখে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করে দেয়।
‘এমনটা বলবেন না। সত্যিকার ভালোবাসায় কখনও খাদ থাকে না।’
‘তবে আমি আরেকটা সুযোগ কেন পাচ্ছি না?’
আকাশীকে শিউরে তুলতে অপূর্ব তার নাকে নাক লাগায়। আকাশী অনুভব করে, তার মনে যে ভালোবাসাটা আছে, তা কখনও মিটবে না। অন্তত এভাবে অপূর্ব তাকে মোহিত করে রাখলে সম্ভবই না। আকাশী আরও বেশি মোহিত হয়, যখন অপূর্বের নাকটা সরে কপালে চলে যায়। অপূর্ব তার কপালে চুমু খায়, ‘শুনো, আকাশী। সবকিছুরই একটা এন্ডিং আছে। ঠিক সেভাবেই তোমার দুঃখেরও এন্ডিং হয়েছে।’
‘আমারও তাই লাগছে।’
‘চুপ, আর কথা বলো না। আকাশ আমাদের সাথে কথা বলতে চায়। ও আমাদের কাছ থেকে ভালোবাসা শিখতে চায়। তোমাকে তোমার সংগ্রামের দিকে আরও এগিয়ে দিতে চায়।’
আকাশী নীরবে হাসল, ‘জানেন, যারা এরূপ মহাজাগতিক ভাষায় কথা বলতে জানে তারা সকলে সীমাহীন আকাশেরই অংশ। তারা সকলেই আকাশী।’
‘তাই তো বলি, শ্বশুর মশাই তোমার এই পারফেক্ট নামটা কোত্থেকে খুঁজে পেলেন! সেই আকাশী লোকটাও হয়তো জানতেন, তার একটা মেয়ে একদিন আকাশের সাথে বন্ধুত্ব করবে। সাথে আরেকজনকেও করাবে।’
(সমাপ্ত…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
[*

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here