“আকাশী”
পর্ব ১৩.
অপূর্ব বিস্ময়ে পেছনে ফিরল। আকাশী তার সেই চাহনিকে পরোয়া না করে নিজের মতো করে বসে রয়েছে। সে খুবই উত্তেজিত। এই প্রথমবারের মতো এই অভিজ্ঞতা। অপূর্ব বাইক চালাতে শুরু করে। সে বলল, ‘তোমার ঠান্ডা লাগবে না?’
‘আমার ঠান্ডা লাগে না।’
‘এই কথা কে বলল?’
‘আপনিই আমাকে বরফ বলতেন।’
অপূর্বের সেসব কিছুই মনে নেই। বালির স্তরে প্রবল বেগে হাওয়া বয়ে গেলে একদিকের বালি যেভাবে আরেকদিকের বালিতে ছেয়ে গিয়ে আগের বালিকে নিচে ফেলে দেয়, ঠিক সেভাবে নতুন জীবনের স্মৃতিগুলো অপূর্বের পুরনো গ্রাম্য স্মৃতিকে ঢেকে নিচে ফেলে দিয়েছে।
আকাশীর সংকোচ লাগছে। ইশ, অপূর্ব ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হতো! তবে নিঃসঙ্কোচে একটা মেয়ের পেছনে বসা যেত। সে আগে ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলেছে, অনিকের সাইকেলের পেছনে বসেছে। এবার কিসের সংকোচ? সে নিজেকেই বুঝায়, তার ভেতরের আত্মাটা ঠিক থাকলেই হলো। মানুষের পরোয়া সে করে না। একটা ছেলের বাইকে কেউই তাকে দেখলে যে যাই ইচ্ছা ভাবুক। তবে কথা তা নয়। কথা হলো, সে একটা মেয়ের পেছনে নয়, ছেলের পেছনে বসেছে। আজ থেকে কিছু বছর আগে যখন তার যৌবনের শুরু, তখনের আগে সে বুঝতই না ছেলের আর মেয়ের মাঝের তফাৎ। সামনে বসা অপূর্বকে দেখে ওই রাতের কথা তার মনে পড়ে যায়। হতবুদ্ধির মতো সে অপূর্বের উত্তপ্ত গায়ে বরফ লাগানোর প্রক্রিয়ায় নিজের হাত বুলিয়ে দেয়। আচমকা সে ওই দেশে পৌঁছায়, যে দেশে যাওয়ার পরের অনুভূতির কথা এখন ভাবলে আকাশীর বোধ হয়, ওই অনুভূতিটাই ছিল তার যৌবন আরম্ভের লক্ষণ। অনিকের সাথে কত খেলাধুলা, প্রতিবেশী ছেলেদের সাথে কত মজা করেছে, অথচ ওইদিনের কাণ্ডটা তাকে সম্পূর্ণই অনড় করে ফেলেছে। লজ্জা তাকে এধার-ওধার থেকে ঘিরে ফেলেছিল। সেদিন প্রথম সে ছেলে জাতিকে ভিন্ন মনে করেছে। সে ভাবে, ভাইয়ার বুকে লোম থাকলে তার কেন নেই? ভাইয়া জ্বরের ঘোরে নড়তে পারছিলেন না। বহু কষ্টে তার হাত ধরে বললেন, ‘আর নিচে যেও না।’
সেদিনই সে প্রথম লজ্জা পায়। সে কিছুদিন তার কাছে পড়তে যায়নি। হয়তো এদিক থেকেই ভাইয়া তার লজ্জাটা ধরে ফেলতে পেরেছে, আর এজন্যই বলেছিলেন, মেয়েদের সাথে যেরূপ আচরণ করো, সেরূপ সবই ছেলেদের সাথে করতে পারো না। আকাশী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখন সে বুঝে ছেলে আর মেয়ের মাঝের পার্থক্য। এইযে, অপূর্বের পেছনে সংকোচের সাথে বসাটাই তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আজ পার্থক্য আছে বলেই জগতে এতো বৈচিত্র্য। পার্থক্য আছে বলেই একটা পুরুষের সাথে একটা মেয়ের বিয়ে হয়। তবে এখনও সে বুঝতে পারছে না, একটা মেয়ে বিয়ের পরই কেন গর্ভবতী হয়। খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন। কিন্তু কাউকে করতে প্রচণ্ড দ্বিধা বোধ হয়। দ্বিধাটা এই জায়গায় কেন আসে তা সে বুঝে না। একবার সে ফারাবির কাছে জিজ্ঞেস করেছিল। সে কিছুই বলেনি। আকাশীকে দীর্ঘক্ষণ যাবৎ চুপচাপ দেখে অপূর্ব বাইক থামায়। আকাশীও সম্বিত ফিরে পায়।
‘কী হয়েছে? আমি ভেবেছি, বাইকে চড়ার মজা নেওয়ার জন্যই উঠেছিলে। ভাবান্তর নেই দেখছি। কী হলো?’
‘নিচ্ছি মজা। চারিদিকে খোলা আকাশ। একটু আকাশ দেখলে প্রশ্নেরা পাহাড় বানায়। সেই পাহাড়ের দেশেই হারিয়ে গিয়েছিলাম।’
‘ঠিক আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহাড় গুনো। আমি চলে যাই। আমার সময় নেই। তাছাড়া আমি যাকে-তাকে বাইকে বসাই না।’
আকাশী প্রতিবাদী হয়ে উঠল। এই প্রথম সে বাইকে চড়েছে। মজাটা এখনও লুপে নিতে পারেনি। আর ভাইয়া কিনা বলছে…
‘না, না হবে না। আমার খুব মজা লাগছে। আমাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইকে করে ঘোরাতে হবে।’
‘কি!’ অপূর্ব প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘দুপুরের খাবার খাব না? তুমি পাগল হয়ে গেলে নাকি? কোন দায়ে তোমার আদেশ পালন করব শুনি?’
‘আমি পাগল, কথাটা কি আজ জানছেন? প্লিজ প্লিজ, কাজ না থাকলে আমাকে ঘোরান না। প্লিজ।’
‘তুমি মেয়েটা দেখছি চুইংগামের মতো। ছাড়ছই না। নামো এখন বাইক থেকে।’
আকাশী হুট করেই অপূর্বের প্যাণ্টের ফোলানো পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে নেয়। বাইকে ওঠার সময় সে লক্ষ করেছিল, পকেটে প্যাকেটের সাইজের কিছু একটা আছে।
অপূর্ব হাত বাড়িয়ে বলল, ‘এই এই, সিগারেট কেন নিলে? দাও, দাও বলছি।’
আকাশী বাইক থেকে নেমে সিগারেটের প্যাকেট পেছনে নিয়ে বলল, ‘না, দেব না। আমাকে আরও কিছুক্ষণ ঘোরাতে হবে।’
‘ওটা আমার লাস্ট সম্বল। কারো সিগারেটের দোকানে গেলে কথাটা বাবার কানে যেতে দেরি লাগবে না। দোহাই লাগি তোমার, দিয়ে দাও।’
‘আপনি আমাকে নিয়ে আরেকটা রাইড দিলে দিয়ে ফেলব।’
‘না, আমি তোমাকে আরেক মুহূর্তও আমার পেছনে বসাব না।’
আকাশী ফোঁস করে উঠে রাস্তার আরও কিনারায় চলে যায়। সিগারেটের প্যাকেটটা তোলে ধরল। পাশের বিলটায় এখন পানি। পুকুর সেচা হয়েছিল। ওই পানির ওপরে ধরে থাকে প্যাকেটটা। এখন বাইকে না চড়িয়ে যাবে কোথায়? মেয়ে হয়ে এই এক সুবিধা, ছেলেরা ঘেঁষার চেষ্টা করে না। সে ছেলে হলে এতক্ষণে নির্ঘাত অপূর্ব সিগারেটটা তাকে ডিঙিয়ে ছিনিয়ে নিত। আকাশীকে অবাক করে দিয়ে অপূর্ব তার খুব কাছাকাছি এসে সিগারেট ছিনিয়ে নেয়। আকাশী তার সাথে লাগার আগেই পিছিয়ে যেতে গিয়ে নিচে পড়ে যায়। অপূর্ব বোকার মতো চেয়ে রইল। আকাশী পড়ে গিয়ে শাড়ি ভিজিয়ে ফেলল। ঝুপ করে পড়ায় কাদার ছিটা মুখেও পড়েছে।
‘সর্বনাশ!’ আকাশী ওঠে দাঁড়ায়।
হাতে অনেক ব্যথা পেয়েছে। কোমরে ব্যথা না পাওয়ার জন্যই হাতে ভার দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। হাতের গিঁড়েটা বোধ হয় উল্টেই গেছে। অপূর্বের দিকে তাকিয়ে সে দেখল, সে মিটিমিটি হাসছে।
‘বেশি করলে এমনই হয়। দেখলে তো কাদায় পড়ে গেলে।’
আকাশী কণ্ঠটা যথেষ্ট শীতল করে বলল, ‘আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনি এখন শহরে থাকেন। মেয়েদের কাছাকাছি থাকা আর ছোঁয়া তো রীতিমতো অভ্যাসই হওয়ার কথা।’
অপূর্ব থতমত খেল। সত্যিই সে অনেক বদলেছে। গ্রামে থাকতে মেয়েদের আশপাশ ঘেঁষত না। শহরে যাওয়ার পর ক্রমে দেখাদেখিই মেয়েদের সাথে অনেক ফ্রি হয়ে গেছে। মেয়েদের পাশে যেতে সংকোচ হয় না। ওখানকার মেয়েরা ছেলেদের মতোই স্বাধীন। আকাশী হয়তো এই ভেবে সিগারেটের প্যাকেট পেছনে রেখেছিল, মেয়ে বিধায় তার কাছাকাছি সে যাবে না। অপূর্ব তার ভুল বুঝতে পেরে আকাশীকে তোলার জন্য হাত বাড়ায়। আকাশী ওই হাত না দেখার ভঙ্গিতে বিনা সাহায্যে একটু কষ্ট করে উঠে গেল।
আকাশী যখন হাতের কাদা ছাড়ায় ব্যস্ত, অপূর্ব বলল, ‘গিয়ে গোসল করে নেবে। এখন বাইকে উঠে পড়।’
‘না থাক। আপনার বাইক ময়লা হয়ে যাবে। তাছাড়া আপনার তো সময় নেই।’
আকাশী যবুথবু হয়ে দাঁড়ায়। শাড়িটা গায়ে নিচের দিকে লেপ্টে আছে। সে নিজেকে সামলে বলল, ‘আপনি প্লিজ এখন চলে যান।’
অপূর্ব কী করবে ভেবে পায় না। যা-ই হোক, আকাশী নিজের কারণেই পড়েছে। যথেষ্ট করুণা সে দেখিয়েছে। এখান থেকে কেটে পড়াই ভালো হবে। অপূর্ব বাইক চালিয়ে কয়েক সেকেন্ডেই ক্ষেতের পাশের রাস্তায় ওঠে গেল। আকাশী নিশ্চিন্তে সামনের দিকে পা বাড়ায়। সামনে অনেক তালগাছ। তালগাছের পাশে পুকুর। পুকুরের ওধারে গাছে ঘেরা খামার। আকাশী পুকুরে গিয়ে শাড়ির কাদা লাগা অংশ পানি লাগিয়ে পরিষ্কার করে নেয়। পুকুরটা নিচু এবং রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে। এখানে পাড়ে বসে থাকলে কেউই টের পাবে না। আকাশী ভেজা শরীরেই বসে রইল। বাইকে রাইড করার নামে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে।
সে ফিক করে হেসে দিলো। সত্যিই সে পাগল। মানুষ তাকে পাগল সাধে বলে না। কিন্তু তারা জানে না, এই শ্রেণির পাগলেরা যা উপলব্ধি করতে পারে, তা সাধারণ কেউ পারে না। মানুষ ভালো দিকটাই অধিক পছন্দ করে। আকাশী খারাপটাও করে। এতে করে দুনিয়াকে চেনা যায়। ইচ্ছাকৃতভাবেই এমন সব কাজ করে, যাতে ভালো খারাপের নানা শ্রেণির সাথে সে পরিচিত হতে পারে। কিছুদূরের তালগাছের দিকে তার চোখ যায়। আরেকবার সে হাসে। এই দিকেই একবার রাতে জয় ভাইয়ার সাথে সে হাঁটছিল। আর তিনি তাকে ভয় দেখিয়েছিলেন। শহুরে ছেলেদের একরূপ সে সেদিন দেখেছে, আর আজ দেখেছে আরেকরূপ। আসলে তফাৎ শহুরে গ্রামীণে নয়, তফাৎ মানুষে মানুষে। কেউ ছোট-বড় সবার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়। আর কেউ নিজেকেই নিজের কাছে সর্বেসর্বা করে তোলে।
দরজা খোলার পর রোকসানা দেখলেন, আকাশী ভেজা অবস্থায় থরথর করে কাঁপছে। তিনি কিছুই বললেন না। তাঁর কেন যেন লাগে আকাশীর অস্তিত্বই নেই। আকাশীর ওপর তাঁর অধিকার নেই। আকাশীও অনেক স্বাধীন। কেউ তার জন্য চিন্তা করে না। স্পষ্টতই কেউ তার অবস্থা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করে না। আকাশী ঢুকে গায়ে গামছা জড়িয়ে বাথরুমে চলে গেল। তার ক্ষিধে লাগার কথা কেউ জিজ্ঞেস করেনি দেখেও সে চমকিত হয়নি। এসবে সে অভ্যস্ত। সে স্বাধীন। সত্যিই স্বাধীন। আশেপাশে অনেক প্রাণ থেকেও কোনো প্রাণী নেই। সমস্যা নেই, সে চালিয়ে নেবে। টান যত কম হয়, ধরাবাঁধাও ততটা কম হয়। সে যতটুকু ইচ্ছা বেপরোয়া হতে পারবে। তবে মাঝে মাঝে মনের কোমল জায়গাটায় হাহাকার করে। একটু যদি ভালোবাসা পেত! এটা এমন একটা জিনিস, যেটা খোঁজা যায় না। প্রকৃতি পাইয়ে দেয়।
আকাশী নামাজ পড়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। আজ নিজেকে অনেকটা বিষণ্ণ লাগছে। চোখে ভাসছে মায়ের দরজায় নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটা। এতই নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন যে, একটু হালচাল জিজ্ঞেস করাও প্রয়োজন বোধ করেননি? আকাশী চোখ বন্ধ করে। অনেক ব্যথা। অনেক। কোথায় করছে বুঝতে পারছে না। ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। তবু মনকে মানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল মাগরিবের আজান শোনে। অদ্ভুত এক আড়ষ্টতা এসেছে শরীরে। আজ যেন বহু বছর বাদে ঘুমোনোর সুযোগ পেয়েও তৃপ্তি সহকারে ঘুমাতে পারেনি। সে আড়মোড়া ভেঙে উঠল। পেটে একবিন্দু পানিও নেই। সে ওঠার পরই লক্ষ করল, তার হাতগুলো অবশ।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার