“আকাশী”
পর্ব ১৪.
পুকুরের সামনের তালগাছের ওপরের অংশে ঘন আঁধার। আকাশী একনাগাড়ে ওই গাছগুলোর দিকে চেয়ে থেকেছে। একরাতে সে এই গাছগুলোকে দেখে চরম ভয় পেয়েছিল। জয়ের কাছে শোনা ভূতের কথা তার কাছে মুহূর্তের জন্য সত্য বলে মনে হয়েছিল। সেরাতও চারিদিকটা নিস্তব্ধ ছিল। তবে হ্যাঁ, এখনের মতো ঘন আঁধার তখন ছিল না। আকাশীর চোখের পলক পড়ছে না। ইশ, আজও যদি রক্ত হিম করার মতো কোনো আওয়াজ ভেসে আসত, যেটা তাকে অলৌকিক এক জগতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে! গাছগুলোর সাথে সে একাধারে বসে নীরব ভাষায় কথা বলে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি মনে ছড়িয়ে আছে। আশেপাশে কেউই নেই। রাস্তাটা দূরদূরান্ত পর্যন্ত নিস্তব্ধ। রাস্তায় এই নিশুতি রাতে বসে থাকার আনন্দটাই ভিন্ন। আকাশীর হাতদুটোতে খুব ব্যথা করছে। আশ্চর্য রকমের শীত চারিদিকে বিরাজ করলেও তার মনটা উত্তপ্ত। তাকে একদা কেউ বরফের সাথে তুলনা করেছে। জাতে জাতে যেমন মিতালি থাকে, তেমনই এই বরফের সাথে শীতের মিতালি ভাব আছে। সে তালগাছ দেখতে দেখতে আচমকা শা করে এক ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসে। মুহূর্তের জন্য লাগে জয় ভাইয়া ভয় দেখাতে এই বুঝি চলে এসেছে। আকাশী আলো অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখে একটা বাইক দাঁড় করানো। ওখান থেকে অপূর্ব নেমে এসে আকাশীর সামনে দাঁড়ায়।
‘এই মেয়ে, এতো রাতে এখানে কী?’
‘আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
হাঁটু ভাঁজ করে অপূর্ব বসল, ‘বন্ধু?’
‘এই যে, এই মাতাল করা আকাশ। কালো মূর্তির রূপ ধারণ করা একেকটা গাছ। আর এই তালগাছ, যারা আমাকে অলৌকিক এক জগতে নিয়ে যায়। আর এই সময়। সবাই আমার বন্ধু।’
‘আমার শুরু থেকেই মনে হয়েছিল, তুমি বড় হয়ে মস্ত বড় একটা পাগল হবে।’
‘জানেন, প্রকৃত সুখী কারা?’
অপূর্বের জবাব শোনার আগেই সে বলল, ‘পাগলেরা। কারণ তারা মানুষের ভাষা বুঝে না। বুঝে না, মানুষ তাদের পাত্তা দেয় না। আর মেইন ফ্যাক্ট হলো, তারা বুঝেই না মানুষ কী কী কারণে তাদের পাগল ভাবে। এই জন্য তারা পাগলামি করে যায়। এতে অদ্ভুত এক তৃপ্তি পায়। কারণ তাদের কাছে মানুষের ভয় থাকে না। তাদের জগতে এমন অনেক অনুভূতি থাকে, যা একটা সাধারণ মানুষের থাকে না।’
‘তুমি সত্যি অনেক বদলে গেছ। অনেকটা। সেই বারো বছরের আকাশীর সাথে আজকের আকাশীর কোনো মিলই নেই।’
‘আপনিও তো বদলে গেছেন।’
‘আমি?’ যেন নিজেকেই করে প্রশ্নটা। আর নিঃশব্দের এই পরিবেশে আকাশীর কানে পৌঁছায়।
‘হুঁ, জয় ভাইয়ার বিশেষত্ব কি জানেন? উনি যে পরিবেশেই যান না কেন, নিজ নিয়ম কখনও পাল্টাবেন না। আর আপনি মাত্র দুই-তিন বছর শহরে থেকে পুরোই পালটে গেছেন। আপনার মাঝের ওই গ্রাম্য চরিত্রটাই নেই। আর জয় ভাইয়া এতবছর গ্রামে না থেকেও গ্রামীণ একটা চরিত্র নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন।’
অপূর্ব হাসল, ‘জয়? আর গ্রামীণ? তুমি কোন জয়ের কথা বলছ? আজ অবধি কয়টা মেয়ের জন্য সে কয়টা ক্যারেক্টারে প্লে করেছে তার আন্দাজ হয়তো ওরই নেই। আমার কী লাগছে জানো?’
‘কী?’
অপূর্ব এবার মুখে শব্দ করে আকাশীর পাশে তার মতো রাস্তায় বসে পড়ে, ‘ও এবার তোমাকে পছন্দ করে বসেছে।’ বলে সে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরায়।
আকাশী আপন মনেই হাসে। এতো এতো চরিত্রের এতো এতো রং দেখে লাগছে, যে ব্যক্তি রঙের আবিষ্কার করেছে তার জানা উচিত ছিল পৃথিবীতে আর্টিফিশিয়াল রঙের কোনো দরকার নেই। সিগারেটের গন্ধ আকাশীর আশেপাশে টগবগ করছে।
মনে পড়ার মতো করে অপূর্ব বলল, ‘তুমি বললে না, সিগারেট কখনও খেয়েছ?’
‘হুঁ, অনিক থাকতে। ও আপনার মতোই লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেত। একদিন আমি ধরে ফেলেছিলাম। ও আমাকে ভোলানো শুরু করল। আর বলল, তুই একটু টেস্ট করে দেখ না। সত্যিই মজা তো। আমি একটান দেওয়ার পর কেশে ফেললাম। ও আমাকে শেখাল, নাকেমুখে একসাথে ধোঁয়া ছাড়বি না। পরপর করে ছাড়বি। বিশ্বাস করুন, সিগারেটে কোন মজা ছেলেরা পায় তা আমার জানা নেই, কিন্তু ওই পদ্ধতিতে ধোঁয়া ছাড়ার পর উঠন্তি ধোঁয়াগুলো দেখে খুব মজা লাগত।’
আকাশী তাকিয়ে দেখে অপূর্ব সেটা চেষ্টা করে দেখছে। সে হো হো করে হেসে ফেলে।
‘এই অন্ধকারে কি ভালো করে ধোঁয়া দেখা যাবে?
আকাশী হাত নাড়তে গিয়ে ব্যথায় অস্ফুট একটা শব্দ করল।
‘সরি। আমি জানতাম না তখন পড়ে যাবে।’ অপূর্ব ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘বাই দ্যা ওয়ে, আমার এখন যেতে হবে। বাবা নয়টার আগে বাসায় না দেখলে বকবে। একচুয়ালি, হি লাভস্ মি অ্যা লট। তোমার মতো রাত-বেরাত থাকার প্রয়োজন আমার হতে দেন না।’
অপূর্ব বাইকে ওঠে বসে।
আকাশী শেষ মুহূর্তে নিজেকে বলার মতো করেই বলল, ‘আমার বাবাও আমাকে ভালোবাসে। তাই আমার চাওয়ার গুরুত্ব তাঁর কাছে অনেক, যা আমাকে সত্যিকার অর্থে বাঁচিয়ে রেখেছে।’
বাইক স্টার্ট দিতে গিয়ে অপূর্ব থেমে গেল। কিছুক্ষণ সে আকাশীর দিকে চেয়ে থাকে। দুই বাবার ভালোবাসার তফাৎ বুঝতে না পেরে সে বাড়ির রাস্তা ধরল।
আকাশীর মন হঠাৎ করেই বিষণ্ণতার বনে যায়। বাবা আজ কল করে বলেছেন, দুইদিন পর তিনি চলে আসবেন। এমনটা কখনও হয়নি। আসার প্রায় একমাস আগে থেকে আসার কথা বলে রাখতেন। এবার যেন হুট করেই দেশের প্রতি টান বেড়ে গেছে। আকাশী তার সাথে কথা বলেছে। গলার স্বরটা তাঁর খুব করুণ শুনিয়েছে। কাজে লিপ্ত থাকা একটা মানুষের কি অবশেষে ক্লান্তি বোধ হয়? আশেপাশে এতো এতো আপনজন থাকার সত্ত্বেও তাদের জন্য কি কামাই করা থেকে মন উঠে যায়? আকাশী ভেবে পায় না। বাবার মধ্যে মাঝে মাঝে সে নিজের ছবি দেখেছে। লোকটাও তার মতো ভিন্ন। হুট করেই বলেছেন, যে করেই হোক, ভালো একটা বাড়ি বাঁধতে হবে। জীবনটা কারো জন্য থেমে থাকে না। সুযোগ না পেলেও বানিয়ে নিতে হবে। একটা মই বানাতে হবে উঠার। আর কতদিন তোরা মাটির ঘরে থাকবি? আকাশীর কানে বাজে আজমের কথা। চোখ থেকে তার পানি ঝরছে। এই একটা মানুষই তার দু’চোখের আশার প্রদীপ। তাঁর দুঃখ যেন আকাশীরই দুঃখ। আকাশীর দুঃখ যেন কারোরই না।
দুইদিন পর সত্যিই আজম বিদেশ থেকে চলে আসেন। এসেই বাড়ি বাঁধার কাজে লেগে পড়েন। আজম গতবছর কোনোভাবে মূল বাড়িটার পিলার দাঁড় করিয়েছিলেন। বেশ কিছু অতিরিক্ত টাকা জমিয়ে এই বাড়িটা শেষ করবেন ভেবে কোন টানে যেন চলে এলেন। তাঁর এবং আকাশীর স্বভাবের বিশেষ একটা দিক হলো, কেউই অপেক্ষা করতে পারে না। আকাশীরা শেষবারের মতো টিনের বাড়িতে থাকতে শুরু করে। সামনে পিলার তোলা বাড়ির সিমেন্টের ছাদ তৈরি করা হচ্ছে। আস্তে আস্তে ভেতরের ঘরের কাজগুলোও শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি পড়ে সিমেন্টের আস্তরণকে ধুয়ে যায়। একদা আকাশী ছাদে শাড়ির আঁচল এক হাতে ছড়িয়ে দু’হাত তোলে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। এমন সময় আজমও চলে আসেন। বললেন; ‘কিরে, তোর না গায়ের জ্বর এসেছে? বৃষ্টিতে ভিজছিস কেন?’
আকাশী কী ভেবে যেন উত্তর না করে বাবাকে টেনে বৃষ্টিতে নিয়ে যায়।
‘বাবা, এই সময়গুলো বারবার আসে না। বৃষ্টিটা এমন এক জায়গা থেকে আসে, যে জায়গাকে আমরা ছুঁতে পারি না। যে জায়গায় যাওয়ার জন্য মানুষের মনে উথালপাতাল শুরু হয়। আজ প্রথম, এই উচ্চতায় বৃষ্টিকে দেখছি। মজাটা লুপে না নিলে পরে তো পস্তাতে হবে।’
আজমের মুখে হাসি ফুটে। লোকটা অন্য কারো সামনে গম্ভীর হলেও এই মেয়ের সামনে তিনি ছোট একটা বাচ্চা হয়ে যান। তখন মনে হয়, আকাশী আর তাঁর বয়সে কোনো তফাত নেই।
আকাশী বৃষ্টিতে ভিজছিল। আজম বললেন, ‘তুই কি এখন ড্রয়িং করিস না?’
‘সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখলে মন-হাত সবকিছুই পাকা হয়। আমি পাকাপোক্ত হয়ে ধরব, সব ধরব।’
মেয়ের এই ভাষা তিনি বুঝেন না। তার হাসিখুশি চেহারা দেখে মনে একটা সন্তুষ্টি বিরাজ করছে। মেয়েটিকে তার নিজের মতো করে চলতে দিয়েছেন বলে তার পিটে দুটো দাগ উঠেছে। শীঘ্রই এই দাগ ছিঁড়ে দুটো ডানা গজাবে। শীঘ্রই। আকাশীও অবাক হয়ে তার বাবার প্রসন্ন মুখ চেয়ে থাকে। তিনি ওই নীল দিগন্তে কী যেন চেয়ে আছেন।
‘জানিস, তোর নাম কেন আকাশী রেখেছি?’
এবার আকাশীর বিবেকে নাড়া খায়। সে তো আগে কখনও তার নামের রহস্যের কথা ভাবেনি!
‘কেন রেখেছেন?’
‘ওই যে, ওই আকাশটা দেখছিস? কত পিওর তাই না? একটা দাগ কোনোদিকে আছে? এই আকাশটার কোনো সীমা নেই। ঠিক এই অসীম ধারাটা তোর জন্মের পর তোর চোখে আমি দেখেছি। কত ভোলানোই না চোখগুলো! আমি মুহূর্তের জন্য তোর চোখে হারিয়ে গিয়েছিলাম। ওখানে আমি আকাশ দেখেছিলাম, যার কোনো সীমা নেই। ওখানে উড়তে চাওয়া আমাকে দেখেছিলাম। ব্যস! ভেবে ফেলেছিলাম, আমার বাকি মেয়েদের কাছ থেকে তুই ভিন্ন হবি। তাই তোর নামটাও ভিন্ন রেখে ফেলি। আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম আমার ভুল হয়নি। আমি ছেলে চেয়েছিলাম। তোকে দেখে আমার ভ্রম ভেঙেছে। মনকে বলেছি, এটা আমার মেয়েও না, ছেলেও না। মানুষ। সব জাতির ওপরই তো মনুষ্য জাতি। একের মধ্যে দশ পেয়েছি তোর মাঝে।’
কথাগুলো শোনে অদ্ভুত এক মুগ্ধতা আকাশীর মনে ছেয়ে যায়। শরীরে কাঁটা দেওয়া প্রবল শীতে উষ্ণতা পেলে মনটা যে ধরনের আমেজে চলে আসে, ঠিক সে ধরনের আমেজে আজ তার মন চলে এসেছে। নিচ থেকে অবিরত হাতুড়ির বাড়ির আওয়াজ আসতে থাকে। নতুন বাড়ি হচ্ছে। জীবনেও হয়তো এসে গেছে নতুনত্ব। এই নতুনত্ব পুরনো ক্লেশ মুছে নিয়ে আসে পরিশোধন।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার