“আকাশী”
পর্ব ২৬.
দরজায় টোকার আওয়াজ শোনে অপূর্ব বই থেকে মুখ তোলে পেছনে ঘুরে তাকায়। সালমাকে ভেতরে আসতে বলে সে পুনরায় বই পড়ায় মনোনিবেশ করলো। সালমা এসে বলল, ‘আমি শুনেছি, এই জায়গায় আঙ্কেলের কাছে বইয়ের ভালো কালেকশন আছে?’
‘তুমি তো সুগন্ধার বাসায় গিয়েছিলে। ওখানের বাবার লাইব্রেরির কালেকশন এখান থেকেই তো ট্রান্সফার করা।’
‘ওহ্ আচ্ছা।’
‘বসো।’
সালমা একটি চেয়ার টেনে বসল, ‘আমার সময় কাটছিল না। ভাবলাম, এখানে এসে আঙ্কেলের কাছ থেকে কোনো বই নেব। তুমি যখন আছ…’
তার কথা শেষ না হতেই অপূর্ব ওঠে একটি বই নিয়ে তাকে দেয়, ‘বাবা তো নেই। এটি পড়তে পারো।’
‘এটি তো অনেক বড়। দু-চারদিনে পড়ে ফেলতে পারব এমন একটা দাও না।’
অপূর্ব তাকে কৃষ্ণপক্ষ দেয়, ‘হুমায়ূন আহমেদের। ভালো লাগবে।’
‘এটির সারসংক্ষেপটা বলো তো।’
‘আগে থেকে বলে দিলে বইটি পড়ে তুমি আসল মজাটা পাবে না। তবে হ্যাঁ, এটুকু বলতে পারি, অরু মেয়েটির জন্য আমার অনেক দয়া হয়েছে। মেয়েটি বিয়ে করেও প্রেমিককে বেশিক্ষণের জন্য পায়নি। আপসোসের বিষয়। অন্তত আমি এর লেখক হলে ওকে ওর ভালোবাসার কাছ থেকে দূর করার মাধ্যমে এতবড় শাস্তি দিতাম না।’
‘তারপর?
অপূর্ব নিস্তব্ধ হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে অন্যদিকে চেয়ে আছে।
‘তুমি তো সবসময় বই নিয়ে বিশদ বলো। এটটি নিয়ে আরও কিছু বলো।’
‘ইচ্ছে নেই।’
‘তোমার হয়েছে কী বলো তো!’
‘কিছু হয়নি।’
‘কাম অন। আমাদের ফ্রেন্ডশিপের বয়স কিন্তু ছয়মাসেরও বেশি। আমাকে বলতে পারবে না?’
অপূর্ব কিন্তু কিন্তু করে বলল, ‘কিছু কথা কাউকেই বলা হয়ে উঠে না।’
‘আমাকে বলতে পারো।’
‘আসলে আমি আমার জীবনটা সবসময় দাগহীন রাখতে চাওয়ায় আজ দাগ পড়েই গেছে। কখনও কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাবিনি। ভেবেছি, পেলে সত্যিকার একজনকে পাব। অন্যান্য ছেলেদের মতো অগণিত গার্লফ্রেন্ড রাখার মতোও ইন্টারেস্ট আমার ছিল না। কিন্তু আকাশীকে দেখার পর থেকে…’
‘তারপর কী?’
‘অনেক সময় আমাদের কল্পনার সীমার বাইরে কিছু হয়ে যায়। আমি ভাবতাম, আমি সহজেই কারো প্রেমে পড়ব না। কিন্তু আকাশী যখন আমার জীবনে এল, সবকিছু যেন পালটে গেছে। একটি উপলক্ষে ও আমার কাছ থেকে দূরে গেছে। কিন্তু আর বেশিক্ষণ দূরে থাকতে পারছি না।’
‘কী বলছ? তুমি আর আকাশী? কখনই না। তুমি কিন্তু ওর চেয়েও বেটার মেয়ে ডিজার্ভ করো।’
‘বেটার বলতে আবার কেমন?’
‘না মানে তুমিই তো বলছ, কখনও কোনো মেয়ের কথা ভাবোনি। তোমার মতো ছেলের ভাগ্যে একটি নিষ্পাপ মেয়ে জোটা উচিত, যে কিনা কাউকে আদৌ ভালোবাসেনি।’
‘শোন, মনের ওপর মানুষের জোর থাকে না। ভালোবাসায়ও থাকে না। তাই এমন কাউকে প্রত্যাশা করা উচিত নয়। এটা কি বেশি পরখ করা হয়ে গেল না?’
‘বেশি পরখ করা কেন হবে? আচ্ছা যাও, তুমি তোমার মতো অলওয়েজ সিঙ্গেল থাকা মেয়ে না খুঁজলেও চলবে। কিন্তু আকাশীর মতো খুঁজতে যেও না। ওকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি। খানিকটা প্লে গার্লদের মতোই। একজনের সাথে ভাব জমাবে। আরেকজনের কাছ থেকে খাবে।’
‘হোয়াট ডু ইউ মিন? খাবে কেমন কথা?’ অপূর্ব হেলান দেওয়া ইজিচেয়ার থেকে ওঠে সোজা হয়ে বসল।
‘এখানের লোকের ভাষায় বলেছি। আমার কথা বিশ্বাস না করলে সত্য পালটে তো যাবে না। তোমার ভালোর জন্যই বলছি। নইলে পরবর্তীতে কষ্ট পাবে।’
‘কী বলতে চাচ্ছ?’
‘আকাশী স্বার্থপর। কিছু মেয়ে টাকাকেই বেশি ভালোবাসে। সেও ওই ধাঁচের। দেখ না, বাড়িতে এতগুলো সমবয়সী ছেলে থাকতে ও কিনা বন্ধুত্ব করেছে আমার ভাইয়ের সাথে। মায়ের কাছে শুনি, বাবা চেয়ারম্যান থাকতে প্রায়ই তাঁর সাথে ভাব জমাতে আসত। বাবার পাওয়ারকে ব্যবহার করে সে কতই না সুনাম অর্জন করেছে। এমনকি বাবার টাকায় তারা কিস্তিও অনেক চুকিয়েছে। নইলে ওর পরিবারের এতো সাধ্য ছিল না নিজেদের চালানোর। আকাশী ইচ্ছাকৃত ভাবেই প্রভাবশালীদের সাথে সম্পর্ক গড়তে যায়। লাভবান হয়। অথচ পরিবর্তে কিছুই কাউকে দেয় না। অনিক ভাই তো রীতিমতো ওকে পছন্দই করতে শুরু করেছিল। ওর কাছে শুনেছি ওর ইন্টারের ফরম ফিল আপের টাকা সে-ই দিয়েছে। বাবার টাকায় তাদের কিস্তির চালানোর কথাও ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা। অথচ আমরা কেউ জানতামই না সেকথা। আকাশী সবকিছু এমনভাবে হাইড করেছে, চাইলেও কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। সে এতটুকু কোনো না কোনোভাবে এসেছে ভাইয়ের কারণেই। অথচ ভাইকে ও নির্দ্বিধায় রিজেক্ট করে দিয়েছে। এখন যখন, অনিক আর বাবা কোনোটাই হাতে রইল না, তোমাকে অথবা জয়ভাইকে টার্গেট করার চেষ্টা করছে।’
‘কী যা-তা বলছ? ও এমন মেয়ে নয়। ওকে আমি চিনি।’
‘কখন থেকে? তুমি তো বছরের পর বছর শহরেই থাকো।’
‘ওর দশ-এগারো বছর বয়সে আমি ওর প্রাইভেট টিউটর ছিলাম।’
‘কখনের কথা তুমি এখন টানছ? ওই বয়সের পরই তো মেয়েরা চেঞ্জ হয়।’
‘তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। ওকে আমার অমন মেয়ে মনে হয় না। জানো আমাদের বিচ্ছেদ কীভাবে হয়েছিল? আমি যখন ওকে ভালোবাসি, তখন ও হয়তো আমাকে নিয়ে কিছু ফিলও করত না। এমন অবস্থায় আমি ওর নিকটতম হওয়ার চেষ্টা করেছি। ও আমার হাত পুড়িয়ে দেয়। ও যদি ওই টাইপের মেয়ে হতো, তবে ফিলিংসের দরকার হতো না। ও স্বার্থের খাতিরে আমাকে আপন করে নিত।’
‘তুমি গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করো। ও তোমাকে পরখ করে দেখতে চেয়েছে, তোমাকে শাস্তি দেওয়ার পরও ওকে ভালোবাসো কিনা। তুমি ওর হাতের কাঠপুতুল হওয়ার যোগ্য কিনা একবার যাচাই করে দেখেছে। বলো, একটি ছেলে ভালোবাসতেই পারে। তার জন্য কেউ তো হাত পুড়ে দেয় না। আচ্ছা, পুড়ে দেওয়ার পরও কি একবারও তোমার প্রতি দয়া দেখিয়েছে?’
অপূর্ব নীরব রইল। সে সময় নির্লিপ্ত ভাবে আকাশী কেবল সরি বলেছিল।
‘সালমা, আমি ওকে ওর চেহারা দেখে ভালোবাসিনি। আমি সিওর করে বলছি, ও যদি কালোও হতো, তবু আমি ওর প্রেমে পড়তাম। ওইদিন যাস্ট একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। আর কিছুই না। ও আমাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে পুড়ে দিতে চায়নি। আসলে ও এমন অবস্থায় ছিল, আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিতে পারেনি। আবার আমাকে কাছে যেতে দিতেও পারছিল না। এমন সময় মেয়েরা অনেক সেন্সিটিভ থাকে। কী করবে ভেবে পায় না। ওর হাতও কাঁপছিল। কাঁপানো অবস্থায় আমার হাত হ্যারিকেনে লেগে গিয়েছে। যদিও এটা পুরোপুরি সত্য না। ও সিচুয়েশনটা থেকে বেরুনোর জন্যই ওই কাজটা করেছিল। ওর দোষ তেমন নেই।’
‘মানুষের ওপরেরটা দেখে ভেতরেরটা বুঝা যায় না। কিছু মানুষের আলাদা মুখোশ থাকে। তুমি বুঝবে না।’
‘তুমি ওকে ভুল বুঝছ।’
‘ভুল কেন বুঝব? জয়ভাইয়ের সাথে যেভাবে মেলামেশা করে সব ঠিকভাবেই বুঝা যায়। ও তোমাকে ট্রাই করেছিল। তুমি সুবিধার না থাকায় জয়ভাইকে ট্রাই করছে। আই থিংক সাক্সেসফুলও হচ্ছে। ভাইয়া তো সবসময় ওর আগেপিছেই ঘুরঘুর করে।’
‘ওর ভালো লাগা প্রতিটি মেয়ের সাথেই করে। আর তাছাড়া আমাকে যা বলছ, ওকে কি তা বলোনি? ও তো আরেকজনের কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে।’
‘মজা করো না। উনার সাথে আমার কথাবার্তা নেই। তাছাড়া উনি আমাকে এভয়েড করেন। তাই গায়ে পড়ে কথা বলতে যাই না।’ সালমা ওঠে কৃষ্ণপক্ষ রেখেই লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল।
অপূর্ব বই বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সালমার কথা যদিও অনেকদিক দিয়ে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু মন মানতে চাইছে না। কিছুক্ষণ নীরব বসে থেকে বুকের ওপর হাত রেখে বিড়বিড় করল, আকাশী ভালো। খুব ভালো।
সালমা বেরিয়ে এলে জয় তাচ্ছিল্যের সুরে গলা উঁচিয়ে রুম থেকে বলল, ‘এতো আগুন কোত্থেকে আসে?’
সালমা রাগে প্রায় ফেটে পড়ল, ‘যেখান থেকেই আসুক, তাতে আপনার কী?’
‘কিছু না। আচ্ছা, আকাশীকে কি দেখেছ?’
‘না।’ সালমা আরও ফুঁসে উঠল। যার-তার মুখে একই নাম! কী আছে এই নামে?
‘ও কোথায় থাকতে পারে জানো?’
‘ওর তো মনে হয় আজ চলে যাওয়ার কথা। তিনদিনের বেশি থাকতে আসেনি। হয়তো ওর বন্ধুদের আই মিন ওই খামারের দিকে গিয়েছে।’
জয় তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত হয়ে বিছানা থেকে ওঠে পড়ল। সালমা মুখ বাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল। জয় এখন কোথায় যাবে সে ভালোই জানে। জয় তার পর পর বেরিয়ে ক্ষেতের মাঝের রাস্তার দিকে চলে গেল। সালমা বাসায় গিয়ে রাগ সংবরণ করতে ছাদে ওঠে যায়।
অপূর্ব আবার পড়ায় মনোনিবেশ করল। তখন সানজিদা পাশে এসে বসলেন, ‘তোর জন্য কফি এনেছি।’
‘থ্যাংকস মা।’ অপূর্ব কাপ তোলে নেয়।
সানজিদা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘চাকরি তো তোর ভালোই চলছে। এখন একটি বিয়ে করে ফেল না। এই বিরক্তিকর সময়টা কেটে যাবে।’
অপূর্ব বিরক্ত হলো, ‘মা, আমার এখনও ছাব্বিশের গণ্ডিও পেরুয়নি।’
‘তাতে কী? আমাদের যুগে ছেলেদের বাইশ-তেইশেও বিয়ে হতো। তোর বাবার চব্বিশে হয়েছে।’
‘এখনের কথা ভিন্ন।’
‘তুই নিজেই ভিন্ন। জয়কে দেখ। কত চতুর! তার জন্য মেয়ে দেখার প্রয়োজনই নেই।’
অপূর্ব হাসল, ‘আপনি ভিন্ন মা। এমন মা খুব কমই পাওয়া যায়, যার কিনা ছেলের গার্লফ্রেন্ড রাখাতে আপত্তি নেই। আমি উপযুক্ত কাউকে পেলে করব। নইলে আপনিই খুঁজুন। আমার কী.. আমি মেয়েদের বুঝিই না।’
‘আচ্ছা, বলছিলাম কী.. আকাশীকে কেমন লাগে তোর কাছে?’
‘ও অনেক ভালো। এতই ভালো যে, ওর মতো রত্ন পাওয়ার সৌভাগ্য যার-তার নেই।’
‘কী যার-তার নেই! তোর মতো সৎপাত্র পাওয়া যায় নাকি কোথাও?’
‘মা, ওর সাথে আমার জমে না। ও আমার কপালে নেই।’
‘তোদের জুটি কিন্তু বেশ জমত। আচ্ছা, ওই মেয়েটা.. কী নাম তার? সালমা। দেখতে কিন্তু মন্দ নয়। ফর্সাও আছে।’
‘ও হয়তো আমাকে বন্ধুর চেয়ে বেশিকিছু ভাবে না।’
‘ভাববে। ছেলেমেয়েদের মাঝে বেশিক্ষণ বন্ধুত্ব স্থায়ী থাকে না। তাছাড়া যতই পরিচারিকা রাখি না কেন পুত্রবধূর সেবা পাওয়ার জন্য মন ব্যকুল হয়ে আছে। আমার একটিই তো ছেলে।’
‘বিয়ে করব তো। ভালো কাউকে পেলে করিয়ে দেবেন।’ অপূর্ব নিজেকেই বলল, ‘কারো দায়িত্ব কাঁধে এলে মনের দুঃখগুলো চাপা পড়বে।’
‘কিছু কি বলেছিস?’
‘কই? না।’
আকাশী সকাল থেকে বাইরে বেরুয়নি। বেরুনোর প্রয়োজনও হয়নি। কয়েকদিন আছে হেতু রাতের বেলায় বেরুনো যাবে। তাছাড়া নানুর শরীর ঠিক নেই। সে যে-কয়দিন আছে, মাকে রেস্ট করতে দেওয়ার কথা ভেবে নিজেই নানুর সেবায় লেগে পড়েছে। সকালে নানুর জন্য গরম পানি দিতে হয়েছে, আলাদা করে চিনি-লবণ ব্যতীত নাস্তা তৈরি করতে হয়েছে, নানুকে খাইয়ে দিয়ে পাশে বসে তাঁর কপাল অনেকক্ষণ টিপে দিতে হয়েছে। এরই ফাঁকে রান্নাবান্না সেরে ফেলায় এখন এগারোটা না বাজতেই সে ফ্রি হয়ে গিয়েছে। হাতের কাছে এখন কোনো কাজ নেই। মন আজ একধরনের ছটফট করছে। কী কারণে সে ধরতে পারছে না। পায়ের নূপুরের দিকে নজর পড়লে বুঝতে পারল, কাল সে কী ভেবে যেন এগুলো পরে ফেলেছে। একই সাথে বুঝতে পারছে মনের অহেতুক ছটফটানোর কারণ। মন বলছে, একবার অপূর্ব ভাইয়ের কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তুভাব করে সে ওঠে তার বাড়িতে গেল। ছোটচাচির রান্না এখনও শেষ হয়নি। বড়চাচিকে দেখা যাচ্ছে না। আকাশী অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে সাহায্য না করে পারল না। বারোটা নাগাদ সে ঘর ঘুছানোর নাম করে লাইব্রেরিতে এলে এখানেই অপূর্বের দেখা পেয়ে যায়।
দরজা খোলা। অপূর্ব নূপুরের আওয়াজে পেছনে ফিরল। তার মনটা বিচলিত হয়ে বলল, পারফেক্ট! নূপুরগুলো ওই শাড়ি পরিহিতার পায়ের জন্যই তৈরি। সে মনের কথা বাইরে বুঝতে না দিয়ে বইয়ের দিকে মুখ ফেরাল। আকাশী দরজার কাছেই ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুনিয়ার যতসব জড়তা আজ তাকে ভর করেছে। পা’গুলো ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না। আগে কখনও এমন হয়নি। সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সে চেয়ারের কাছে গেলে অপূর্ব ব্যস্ত হয়ে উঠে একটি শেলফের কাছে চলে যায়। মনে হয়, এখনও একটা রাগ তার মাঝে বিরাজ করছে। ক্ষমা আকাশীর নিজেরই চাওয়া উচিত। সে নিজেই যে পুড়ে দিয়েছিল। অপূর্বের হাতটির পোড়া অংশের সাদা চামড়া এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। ইশ, কি বেরহম হয়েই না পুড়ে দিয়েছিল!
আকাশী বলল, ‘আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।’
অপূর্ব না শোনার ভান করে রইল। আকাশী পুনরায় তার কাছে এগিয়ে গেলে অপূর্ব অন্য আরেকটি শেলফে গিয়ে বই ঘাটাঘাটি করে বলল, ‘আকাশী বিরক্ত করো না। আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম।’
শুনে আকাশীর ভালো লাগল। কিন্তু তাতে তৃপ্তি মিটছে না। সে অপূর্বের কাছে আর কী চাইছে নিজেই বুঝতে পারে না। তবে ক্ষমাটা যথেষ্ট নয়, যথার্থও নয়। সে তৎক্ষণাৎ অপূর্বের কাছে এসে তাকে যেতে না দিয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে মন থেকে ক্ষমা করেননি।’
‘ক্ষমা কি কেউ এভাবে দুইহাত দিয়ে আটকে রেখে চায়?’
আকাশী হাত নামিয়ে ফেলল। অপূর্ব তাকে ডিঙিয়ে চলে যেতেই আকাশী তার হাত ধরে হাতের পোড়াস্থানটা তার গালের সাথে লাগিয়ে বলল, ‘আমি সত্যিই দুঃখিত। ওই সময় আমি কী করব বুঝতে পারিনি।’ আকাশীর চোখে পানি চলে এলো। কিন্তু তা দেখাচ্ছে না। অপূর্ব কিছু বলছে না দেখে সে ওই পোড়াস্থানে ঠোঁট লাগায়। অপূর্ব ইতস্তত করে হাত সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আকাশী দারুণভাবে অবাক হয়। অপূর্বের হাত গালে লাগানোর সময় মনের নানা কোণ থেকে কত দুঃখই না বেরিয়ে এসেছিল যে, তার চোখে পানিরা ভিড় জমিয়েছে। সে এতদিন এতো দুঃখ মনে নিয়ে ছিল, জানতই না। আজ তার কাছে মনে পড়ে যায় অনিককে বলা তার কথাগুলো। কীভাবে সে বলেছিল, আমি কাউকে ভালোবাসলে আমার সবকিছু উজাড় করে ভালোবাসব। এখন থেকে বুঝি তার পড়ালেখার গতিও কমে যাবে। প্রকৃতির পরিবেশকে কিংবা আকাশকেও ভুলে যাবে।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
[