“আকাশী”
পর্ব ৩০.
চারিদিকে যেন হলদে একটা আভা ছড়িয়ে আছে। নাকি আকাশীর চোখেরই দোষ তা তার জানা নেই। কত পরিচিত মানুষ আসছে। পাশে বসছে। তাকে এক চামচ কেক খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সেও খাইয়ে দিচ্ছে। আজ তার গায়ে হলুদ। সম্পূর্ণ হলদে একটা শাড়ি পরায় তাকে একটা হলদে পরীর মতোই দেখাচ্ছে। পায়ে সোনালি নূপুর। হাতে ফুলের ব্রেসলেট। গলায়, কপালে, কানে ফুলেরই অলঙ্কার পরে আছে। হলুদ শাড়ির পাড়ে সোনালি ডিজাইন থাকায় তা মাঝে মাঝে ক্যামরার লাইটে চকচক করে উঠছে। আপন বলতে কেবল তার মা, আপারা আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই আছে। অবশ্য বাড়ির অর্ধেক ভাগ মানুষ আকাশীর স্বামীর পক্ষেই। মাঝখানে যদি বাধাটা না থাকত, তবে সরাসরিই এখান থেকে অপূর্বকে দেখা যেত। তার কী হয়েছে জানা নেই। একবার তাকে দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে। অপূর্বেরও কি তাই ইচ্ছে হচ্ছে? ইতঃপূর্বে আকাশী ওইপক্ষ থেকে বদলি হওয়া ফটোগ্রাফারকে অপূর্বের লুক দেখাতে বলেছে। ফটোগ্রাফারও যেন আকাশীর বান্ধবীদের সাথে মিশেছে। কোনোভাবে তার ছবিই দেখতে দিচ্ছে না। অথচ লোকটি এক সপ্তাহ আগে পাশাপাশি বসে কবুল বলার সাথে সাথেই স্বামী হয়ে গিয়েছিল, এই অনুষ্ঠানের পর তার সাথে শহরে চলে গেলে তাকে স্বামীর রূপে পাবে, তবু কেন যেন তাকে একবার দেখার তৃষ্ণা মনের কোনোভাবেই মিটছে না।
সে কত ঘোরাঘুরিই না করে! অথচ আজ কয়েকটিমাত্র পদক্ষেপ ফেলে সে অপূর্বকে দেখতে যেতে পারছে না। ফারাবি একটা শর্তে ছবি তুলে এনে দেবে বলেছে। শর্তটা হলো, এই যাবৎ তার আর অপূর্বের মাঝে কী কী হয়েছে তা তাকে বলতে হবে। কিন্তু আকাশী সত্য হিসেবে বলেছে কিছুই হয়নি, এমনকি এই সপ্তাহে অপূর্বকে ফোনকল করলেও বিশেষ কোনো কথা হয়নি। ফারাবি মোটেই বিশ্বাস করছে না। বলল, মিথ্যা। তোরা একে অপরকে এতো বছর যাবৎ চিনিস, এতবার দেখা করেছিস, তবু কিনা কিছু হয়নি! বিশ্বাস হয় না।
অগত্যা সে তৃষাতুর মন নিয়ে বসে রইল। কে জানে অপূর্ব কেমন পাঞ্জাবি পরেছেন। সে শুনেছে সাদা রঙের। কাঁধ থেকে বুকের ওপর পর্যন্ত সাদা চকচকে কাজ করা। বাকিটা প্লেইন। সাথে স্ট্রেট হোয়াইট প্যান্ট। কিন্তু এটুকু শুনে তো মন ভরে না। স্বচক্ষে পাঞ্জাবির সাথে পাঞ্জাবিওয়ালার মুখটাকেও দেখতে হবে। ওদের স্টেজটাও সে দেখেনি। তার নিজেদেরটা এতো স্পেশাল হলে অপূর্বেরটা কেমন হতে পারে! সে বিয়ের আয়োজন দেখতে বেরুতে পারেনি। কারণ মানুষের ভিড় বাড়ছিল। তথাকথিত সে স্বয়ং এই বিয়ের কনে। তবু বিভার কাছে আয়োজনের বর্ণনা শুনে হা করে থেকেছিল। গ্রামে এমন আয়োজন সবার চোখকেই হয়তো তার মতো বিস্ফারিত করেছে। সত্যিই এমন আয়োজন গ্রামবাসী আগে কখনও দেখেনি। আকাশী খুব কমই দেখেছে। এখান থেকে শুরু করে হাইস্কুল পেরিয়ে মেইন রোড শুরু হওয়া পর্যন্ত প্যান্ডেল টাঙিয়ে কালারড এবং ডেকোরেটিং লাইট দিয়ে সাজানো। সেই রোড থেকে বাড়ির ভেতর অবধি সবদিকটাই ঝকমক করছে। সামনের পুকুর, দুইপাশের ক্ষেত, আসার সময় আশেপাশে যতগুলো গাছপালা দেখা যায় সবই নানাপ্রকার কালারড লাইট দিয়ে সাজানো। বিভার বর্ণনা শুনে ইচ্ছে হলো, দৌড়ে সবগুলো দেখতে যায়। বিভা হেসে ওঠে। আকাশী লজ্জা পেয়ে যায়। বড় আপা বলল, তোর সম্ভবত মনে নেই, তোর বিয়ে টাকাওয়ালা চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলের সাথে হয়েছে। আকাশী লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে গেল। তবে না দেখেও এসব সজ্জার কিঞ্চিত আভাস সে স্টেজে আসার সময় পেয়েছে। যখন তাকে পার্লার থেকে এনে গাড়ি থেকে বের করানো হয়, তখন উঠোনে এসে বুঝাই দায় হয়ে পড়ল, আশেপাশে কোনো বাড়িও আছে কিনা। গাড়িতে সে সমবয়সীদের হাসিমজা, ঠেশাঠেশির কারণে আশপাশ তেমন একটা দেখতে পারেনি। এখানে পুরো উঠোন জুড়ে লাল কার্পেট বিছানো। সে স্টেজের সামনে এসে দেখে, স্টেজ লাল-সাদার খেলা খেলছে। সোফাগুলো ফুল হোয়াইট। নিচের কার্পেটসহ পেছনে চমৎকার পর্দাগুলো লাল রঙের। সেই পর্দা কিছু সীমার পর থেকে উঠে অনেক ওপরে স্টেজের শীর্ষে গিয়ে একটা বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। সেই বিন্দু থেকে বড় একটা ঝাড়বাতির ন্যায় গোলাপ ফুলের তোড়া এসে স্টেজের মাঝ বরাবর ঝুলে আছে। স্টেজের মাঝে মাঝে কালারড লাইটিং। আশেপাশে অন্ধকার। চমৎকার হয়েছে স্টেজটা। কনেপক্ষের স্টেজ হয়েছে আকাশীর ঘর থেকে বেরুলে উঠোনের ডানপাশে। শুনেছিল, কালকের আয়োজন ক্লাবে হবে। তবে এখনের আয়োজন তো কনভেনশন হলের চেয়ে কম নয়। বরং উঠোন হিসেবে শনাক্ত করাই যাচ্ছে না।
আকাশীকে স্টেজের সোফাগুলোর মধ্যে মাঝের বড় সোফাটায় বসানো হয়। তার সামনে নিচু কিন্তু বড় একটা টেবিল রাখা আছে। তার মাঝ বরাবর একটা ঝুড়ি রাখা হয়েছে, যা সম্পূর্ণই গোলাপে ভর্তি। ইস! এতো গোলাপ সে একসাথে কখনও দেখেনি। ঠিক তখনই বিকট কিছু শব্দ হওয়ায় সবাই উপরের তাকিয়ে দেখে একসাথে কয়েকটা ক্র্যাকার জ্বলে চারিদিকে রঙিন বৃত্তাকার বলয়রেখা দিয়ে আকাশকে সম্পূর্ণই আলোকিত করে ফেলেছে। ছোটরা আমোদে চিৎকার করে উঠল। আকাশী আনন্দিত হলেও মনে মনে আপসোস করল, এতো খরচের প্রয়োজন কী ছিল! সামান্য একটা বিয়েই তো।
কোনোভাবে অপূর্বকে দেখার কথা ভাবতে ভাবতে তার বিবেকে একটা বুদ্ধি খেলে যায়। ফারাবিকে বলল, তার কাছে ওয়াশরুমে যেতে হবে। স্টেজ থেকে উঠে কিছুদূর গেলে নিজেদের ঘর। আর ঘরের শেষান্তে লম্বা একটা পর্দা মাঝামাঝি করে টাঙানো। যাওয়ার সময় পর্দা সরিয়ে দেখা যেতে পারে। সে গতকাল স্টেজ তৈরি করার সময় দেখেছে, বরের স্টেজ তাদের স্টেজের মুখোমুখি করে বাঁধানো হচ্ছিল। তাই এতে কোনো সন্দেহ নেই, স্টেজে বসে থাকা অপূর্বকে সে দেখবে। কিন্তু বিপত্তি বাধল, কেউ তাকে একা ছাড়ছে না।
কোনোভাবে তাদের মানিয়ে সে উঠোন অর্ধেক পেরুনোর পর একাকীত্ব পায়। অবশেষে! আকাশী তড়িঘড়ি করে পর্দা খানিকটা সরিয়ে দেখে কনেপক্ষের ন্যায় ওখানেও জমজমাট আয়োজন। বাড়ির একই লোক দরজার ন্যায় খোলা একটা জায়গা দিয়ে এইপক্ষেও আসতে পারবে। মানুষ দেখা বাদ দিয়ে সে পর্দা আরেকটু সরিয়ে বহুদূরের স্টেজে অবশেষে অপূর্বকে দেখতে পায়। তাকে দেখে তার দৌড়ে ওখানে চলে যেতে ইচ্ছে হয়। কেন যে স্টেজ একসাথে করল না! কেন যে তাদের একসাথে বসায়নি! বসালে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত! অন্তত একটা স্টেজ তো না করলেই চলত।
অপূর্ব সমবয়সীদের ভিড়ে আছেন। সম্ভবত এগুলো তার বন্ধু। জয়ভাইও তাদের মাঝে আছেন। অপূর্বকে অসাধারণ এবং অনন্য দেখাচ্ছে। কিন্তু মাথায় তার পাগড়ি নেই। অন্য একটা বন্ধু মাথায় পরে আছে। অপূর্ব মাঝে মাঝে তাদের মজায় হেসে উঠছেন। তাদের মতো অট্টহাসি নয়। কিছুটা চাপা হাসি। আকাশীর মনে তা বিঁধে যায়। এই ধরনের কিছুই এই বরের মুখে সে দেখতে চেয়েছে। আকাশীর খেয়ালই নেই, সে অনেকক্ষণ যাবৎ এভাবেই চেয়ে আছে। তার ভ্রম ভাঙল তার সাথে স্টেজের একটা ছেলের চোখাচোখি হওয়ায়। ছেলেটা কী যেন বলল, অপূর্বসহ তার সকল বন্ধুই তৎক্ষণাৎ আকাশীর দিকে তাকায়। সে সাথে সাথে পর্দা থেকে হাত ছেড়ে দেয়। কোলাহলেও সে স্পষ্ট বুঝতে পারে, এ নিয়ে অপূর্বের সাথে তার বন্ধুরা ইয়ার্কি করছে। সে লজ্জা পেয়ে ভেতরে চলে যায়।
রাত বাড়ছে। একপর্যায়ে মেহেদি পরানো শেষ হয়। পরদিন হয় আরেকটা দীর্ঘ কিন্তু ব্যস্ত দিনের শুরু। সাধারণত এই ধরনের আয়োজনে সে নিজে কাজে লেগে পড়ে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আসা-যাওয়ারত অতিথিদের সাথে তার কথাবার্তা বলতে হচ্ছে। ছেলেপক্ষের কেউ কেউ কম দূরত্ব পেয়ে তাকে দেখতে চলে আসছে। এরকম জাঁকজমকপূর্ণ কিছুর জন্য সে কখনও প্রস্তুত ছিল না। অন্তত এতো তাড়াতাড়ি নয়। বিয়েতে তার অনেক বন্ধুবান্ধব এসেছে। কাল রাজিব, নিশান, ঝুমুর, আতিকা সকলই ছিল। এখনও তারা আছে। কিন্তু কারো সাথে সে ভালোভাবে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না। আজ কনভেনশন হলে অনার্সের দুটো বছরে গড়া আরও কিছু বন্ধু আসবে। আজকের এই দিনে অনিক থাকলে মন্দ হতো না। একফাঁকে তাসফিয়ার কথাও মনে পড়ে যায়। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
দুপুর শুরু হলে তাকে ভারী সাজগোজ করিয়ে ক্লাবে নেওয়া হয়। মানুষেরা ভিড় জমিয়েছে। আজ এখানে এমপি’ও আসবেন। গতকালের ন্যায় সাজানো বড় একটা স্টেজে আকাশীকে বসানো হলো। আত্মীয়রা এসে বসে ছবি তুলে যান। কখনও বা কোনো নতুন আত্মীয়ের সাথে কথাবার্তা বলতে হয়েছে। এরই মাঝে সহপাঠীদের সাথে তার মিনিট কয়েক আলাপন চলেছে। তারপর তাকে নিয়ে কনেপক্ষের শেষ ব্যাচের খাবার পরিবেশন করা হয়।
আকাশী অভিজ্ঞতার কলস পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতা ব্যতীত এতটুকু আপ্যায়িত হওয়া যায়, তা সে এই প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করছে। খাওয়ার পর্ব শেষে তাকে ছেলেপক্ষের স্টেজে নিয়ে যাওয়া হয়। অপূর্বাকাশীর মালা বদলের পর এমপি এসে তাদের আশীর্বাদ করে একদণ্ড সময় কাটিয়ে যান। ক্লাব থেকে সুগন্ধার দূরত্ব বেশি না হলেও আকাশীর বিদায় হতে রাত গড়ায়।
অবশেষে সে শ্বশুরের পারম্যানেন্ট ফ্ল্যাটে ওঠে। আকাশীকে একটা রুমে এনে বসালে, তবেই সে স্বস্তিবোধ করল। বড় একটা ফ্ল্যাট। সামনের হলে অপূর্ব একঝাঁক ছেলের সাথে বসে আছে। কেউ বন্ধু, কেউ বন্ধুরই বন্ধু। আবার কেউ কেউ জয়ের বন্ধু। তাছাড়া মাহমুদের কিছু নিকটবর্তী আত্মীয়ও আছে। সবাই আজ এখানেই থাকবে। যথেষ্ট রুম আছে। অপূর্বের রুমটা ফ্ল্যাটের মাঝ বরাবর। রাত হলে তার কিছু কাজিন আকাশীকে সেই রুমে দিয়ে যায়। তার ওপর সারাদিন যে ধকলটা গিয়েছিল, ইচ্ছে করেছিল ঘুমিয়েই পড়ে। কিন্তু বেডের সজ্জাটা দেখে তার তা নষ্ট করতে মন চাইল না। তার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি উদয় হয়, রুমে অপূর্ব ঢুকলে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? সে চারিদিকে ফুল দিয়ে সাজানো বিছানার মুক্তপ্রান্তের একপাশে বসে অপেক্ষা করতে থাকে অপূর্বকে একবার দেখার। মিনিট দশেক পর সে আরেকটু ওঠে পিঠের পেছনে একটা বালিশ চেপে আধশোয়া হয়ে রইল। চোখের উপর নিচ থেকে কে যেন তাকে জোর দিচ্ছে চোখ বাঁধার জন্য। সে কেবল কোনোভাবে চোখ পাকিয়ে রইল।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার