আগন্তুকের আসক্তি পর্ব -১০+১১

#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১০]
_________
নির্ঘুম আরেকটি রজনী পার হচ্ছে ইতিকার।গত তিনদিন ইনানের পাগলামো দেখে যাচ্ছে চুপচাপ কিন্তু নাসরিনের ভয়ে দু’বাক্য করার সাহস তার হয় নি।ইতিকাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য নাসরিনের সঙ্গে বেশ আবদার সুরে কথা বলেছিল ইনান।তবে তাতেও মন গলেনি নাসরিনের।তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।যদি ইতিকার সাথে সংসার করতেই হয় তবে এই বাড়িতে থেকে করতে হবে।ওই ফ্লাটে যাওয়া নিষিদ্ধ।কিন্তু একগুঁয়ে ইনান কিছুতেই এই বাড়িতে আসবে না বলে জানিয়ে দেয়।

মা ছেলের রাগারাগির মাঝে ফাল হয়ে আছে ইতিকা।ঝগড়ার মূল হেতু সে কী না!

বিনুনি করা চুল গুলোর বাঁধন খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মেয়েটি।তার ঢেউ খেলানো চুলগুলো মৃদ্যু বাতাসে উড়ছে।দোতলার রুমটি থেকে বাড়ির অর্ধেক পরিবেশ বেশ ভালোভাবেই পরখ করা সম্ভব।পিচ ঢালা রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট গুলো দাঁড়িয়ে আছে তার আলো নিয়ে।

ইতিকা রেলংএর সাথে হেলান দিয়ে রাস্তায় তাকাতেই একটি মানব অবয় দেখতে পায়।ভালোভাবে পরক্ষ করে বুঝতে পারে বুকের উপর হাত গুজে স্টেট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে।হঠাৎ বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত ভাবে কম্পিত হতে থাকে।ছেলেটি ইতিকার দিকে তাকিয়ে আছে প্রবল দুচোখের তৃষ্ণা নিয়ে।

বেশ কিছুক্ষণ পরখ করে ইতিকা বুঝতে পারে এতো ইফতিহার ইনান! ঘড়িতে রাত দুইটা বেজে বত্রিশ মিনিট।এত রাতে এই ছেলে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

ইতিকা সব ভাবনা ছুড়ে ফেলে নিচে চলে যায়।বাড়ির ল্যান লাইনে ইনানের নাম্বারে দ্রুত ফোন করতে থাকে।ইতিকা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেই ইনানের নাম্বারটা মুখস্ত করে নেয়।তাই আজ তার সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়।
কাঁপাকাঁপা গলায় ইতিকাই সর্ব প্রথম কথা বলে,

– হ্যালো আমি ইতিকা বলছি।

ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।সে চুপচাপ তার ইতিবউয়ের কন্ঠ শুনতে ব্যস্ত।

– আপনি কি শুনতে পারছেন না?আমি ইতিকা বলছি।

ইনান আবারো জবাব দিলো না।তবে তার ভারী হওয়া গাঢ় শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দটা ইতিকা ঠিকি শুনতে পারছে।

– আমি বুঝতে পারছি আপনি ইচ্ছে করেই জবাব দিচ্ছেন না।আমি অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে নিচে এসে আপনার সঙ্গে কথা বলছি।আম্মা জেনে গেলে রক্ষে থাকবে না।

– তোমার আম্মা যদি যেনে যায় আমার সঙ্গে কথা বলছো তবে তোমার রক্ষে থাকবে না।এদিকে আমার সামনে যদি তুমি একবার পড়ো তোমার কি আর রক্ষে থাকবে ইতিবউ?

ইনানের দাঁতে দাঁত চেপে কথায় কলিজা কেঁপে উঠলো ইতিকার।সে ভেবেছিল ইনান হয়তো তার সঙ্গে মিষ্টি সুরে কথা বলবে কিন্তু তার ভাবনাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ করে দিলো ছেলেটি।

– আপনি এতটা রেগে যাচ্ছেন কেন?

– না আমি তো শান্ত স্থির থাকবো।তুমি আমার ক্ষমতা সম্পর্কে জানো না ইতিবউ।চাইলে তোমায় তুলে আনতে পারি কিন্তু ওই বাড়ির চৌকাঠে আমি পা দেবো না, কখনো না।ব্লাকমেল করেও তোমায় আপনা আপনি আমার সামনে আনতে পারি কিন্তু আমি কিছুই করবো না।তুমি সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে ফিরে আসবে আমার কাছে এবং খুব শীঘ্রই।

– কখনো না।আমি এখানেই থাকবো আপনার যদি একান্ত আমাকে প্রয়োজন হয় তবে এই বাড়িতে আসবেন পার্মানেন্ট ভাবে।

– যদি না আসি?

– সেটা আপনার ইচ্ছে,আমি চাই আপনি এই বাড়িতে ফিরে আসুন।

– দুইদিন পর তোমার জন্মদিন ইতিবউ।

– তো?আমার জন্মদিন হয়েছে হোক সেটা প্রতিবছরেই হয়।এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কি আছে?

– তোমার আঠারো বছর পূর্ণ হলে সবার সম্মুখে তুমি আসতে পারবে।তুমি যে মিসেস ইফতিহার ইনান সবাইকে বলতে আর আমার জড়তা কাজ করবে না।

– আমি কিছু জানতে চাই না।আপনি প্লিজ বাড়ি ফিরে আসুন।দুনিয়ার সকলের সঙ্গে ইগো দেখালেও বাবা মায়ের সঙ্গে ইগো দেখানো সবচেয়ে বড় নিন্দনীয় কাজ।তাই বারবার বলছি যা হয়েছে ভুলে যান।প্লিজ আসুন।

– আসবো না।

– ঠিক আছে আমিও আর ফিরবো না।

– ইতিবউ!

ইতিকা ফোনটা রেখে আবারো উপরে নিজের রুমে চলে যায়।তার দু’চোখ ভিজে উঠছে বারবার।জীবন সঙ্গী হিসেবে একটা নরম,যত্ন, মনের মানুষ চেয়েছিল।কিন্তু এমন জেদি,দেমাগী একগুঁয়ের মানুষ সে কখনো চায় নি।
এলোমেলো গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শাড়িটা ঠিক ঠাক করে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে।বেশ রাত হয়েছে ইনান হয়তো চলে গেছে ভেবে চনমনিয়ে থাকা মনটাকে মিথ্যা শান্তনা দিতে থাকে।

.

রাস্তার ধারে এখনো বসে আছে ইনান।চোখ তার অতীতের রুমের বারান্দার দিকে।বর্তমানে সেখানে স্থান হয়েছে ইতিকার।
হঠাৎ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে বাতাস।চারিদিকে বাতাসের গতিক বৃদ্ধ পেয়ে গাছের পাতা উড়ছে বেগতিক।আকাশের গুমগুম শব্দ বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে।বিদ্যুৎ চমকানিতে আলোকিত হচ্ছে চারিদিক।ইনান ঘাবড়ে যায় তবুও অনড় থাকে,তাকিয়ে আছে বারান্দার দিকে।

হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে চমকে উঠে ইতিকা।মূহুর্তে ঝমঝম শব্দ করে জমিনে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটারা।ইতিকা দ্রুত পা চালিয়ে বারান্দায় যায়।বৃষ্টির দরুনে বাইরে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আছে।তবুও ল্যাম্পপোস্টের আলোতে মানব অবয়টি ঠিকি তার চোখ পড়ে।
ইতিকা দ্রুত পা চালিয়ে নিচে যায়।সাবধানে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে।সরু চিকন রাস্তা মাড়িয়ে এক ছুটে বেরিয়ে যায় গেটের বাইরে।ইনান তাকে দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।ইতিকা রাস্তা পার করে ইনানের থেকে দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়।

– আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?ফিরে যান আপনার ফ্লাটে।

– যাবো না ইতিবউ।যদি যাই তবে তোমায় নিয়ে যাবো।

– আমিও যাবো না।আমি এই বাড়িতেই থাকবো।আপনার যদি ইচ্ছে হয় তবে আপনি চলে আসুন।

– তুমি নিচে এসেছো কেন ইতিবউ?এখন যদি তোমায় তুলে নিয়ে যাই তোমার শাশুড়ী আম্মা তো জানতেও পারবে না।বি কেয়ারফুল!

– এত সহজ নয়।
– তাই নাকি?

কথাটি বলেই ইনান ইতিকার সামনে দু’কদম এগিয়ে আসে।সে ভেবেছিল হয়তো ইতিকা সরে যাবে কিন্তু না ইতিকা একই স্থানে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।ইনান বাঁকা হেসে কাদয়া করে ইতিকার সামনে দাঁড়ায়।দুজনে ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে।ইনানের গাঢ় শ্বাস আছড়ে পড়ছে ইতিকার চোখে মুখে।ইতিকার কোমড়ে কায়দা করে হাত রাখে ইনান।ইনানের স্পর্শে সে শিউরে উঠলেও চুপচাপ তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

– একটা চুমু খাবো ইতিবউ?

ইনানের বেহায়াপনা দেখে অবাক হলো ইতিকা।বাম হাত দিয়ে মুখের পানি লেপ্টে সরিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে,

– ভালো হবে না বলে দিলাম।

ইনান ইতিকার রাগ দেখে কিঞ্চিৎ হাসে।আরেকটু কাছে এসে মেয়েটির মাথা টেনে কপালে অধর ছুঁয়ে দেয়।ইতিকার মাঝে অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ইনান তাকে শক্ত করে ছুঁয়ে থাকে।

– এই তো এই ছোঁয়ার জন্য, কাছে পাওয়ার জন্য সাতদিনের কাজ তিন/চারদিনে শেষ করে এসেছি।কিন্তু তোমার হিটলার শাশুড়ী কায়দা করে তোমায় সরিয়ে নিলো।গত কয়েকদিনের রাগ,ক্ষোভ এই মূহুর্তে মিটে গেছে আমার।

– আ..আমি চলে যাচ্ছি আপনিও যান।

– ইতিবউ তোমার জন্মদিনের উপহার কি চাও?

ইতিকা কিছু একটা ভাবলো।ইনানের হাতটা ছাড়িয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,

– আমি চাই আপনি এই বাড়িতে ফিরে আসুন।আসবেন তো?

ইতিকার কথায় হাতের বাধঁন আলগা হয়ে যায় ইনানের।ঠোঁটের কোনের হাসিটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।চোখে মুখে যেন এখন শুধু আগুনের ফুলকি ঝরছে।

– বাড়ি যাও ইতিবউ।ঠান্ডা লেগে যাবে।

ইনানের ক্রুদ্ধ কন্ঠে আর এক মূহুর্তেও দারালো না সে।ছুটে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।

__

সকালের আলো এখনো পরিপূর্ণ ভাবে ফুটেনি।ইনান ভোর ভোর পৌঁছে গেছে বাহরুল ইসলামের বাড়িতে।সারারাত বৃষ্টিতে ভেজার ফলে শরীর জুড়ে জ্বর জ্বর ভাব।

– এত সকালে তুমি?কোন সমস্যা ইনান?

– সমস্যা তো বটেই।মামু তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম।তবে কেন আম্মুকে ইতিকাকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করেছিলে?

– দেখো নাসরিন আমার বোন হয়।তার চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারিনা।সে আমার সাথে দেখা করেছিল লুকিয়ে।জানোই তো তোমার বাবা দেখলে আর রক্ষে থাকবে না।সে কাদঁতে কাদঁতে আমার কাছে শেষ আবদার করলো ইতিকাকে যেন তার বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দি।আমিও দিলাম এতে দোষের কি আছে?

– আমার বউ হয় সে।তার সকল দায়িত্ব আমি নিয়েছি তবে আমায় কেন জানানো হলো না?

– তুমি কি যেতে দিতে তাকে?অবশ্যই না তাই আমি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি তাদের।

– কিন্তু মামু….

– কোন কিন্তু নয় ইনান। তোমার রাজনীতিতে মনোনিবেশ করার কথা।তুমি তা না করে ওই মেয়েকে নিয়ে পড়ে আছো।মেয়েটা যেখানে আছে নিরাপদে আছে তুমি তোমার কাজ করো।

ইনান বাহরুলের কথার উল্টো পিঠে আর কথা খুঁজে পেলো না।উঠে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই আবারো পেছন থেকে ডেকে উঠে বাহরুল।

– ইনান এখন যেওনা।নাস্তা করে যাও।আর আজ মিটিং আছে, আশা করি অবশ্যই মিটিং এ সময় মতো থাকবে।

– আমি ফ্লাটে যাচ্ছি পরে কথা হবে।

ইনান আর এক মূহুর্তেও দারালো না।বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
_

কালশিটা রঙের আভা লেগে আছে ইনানের গলায়।গতকাল হঠাৎ করেই তার গাড়িতে আক্রমণ হয় দূর্বিত্তদের।একা থাকায় নিজেকে সামলাতে বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।তবুও জান বাঁচিয়ে ফিরে এসেছে সে।

– ইনান কিছু কি ভাবলি?

অলীদের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে ইনানের।

– কি ভাববো আমি?

– তুই বরং ভাবীর কথা মেনে নে। ওই বাড়িতে ফিরে যা।

– কখনো না।যাবো না মানে না।

ইনানের ত্যাড়া কথায় বিরক্ত হয় সুফিয়া।সোফার বালিশটা মেঝেতে ছুড়ে রাগ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।ইনানের কাছে এসে শান্ত সুরে বলে,

– জীবনের প্রিয় এবং কাছের মানুষগুলো হারিয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় হেতু এই ইগো।তুই তোর ইগো কমা।রাগ,জেদ,ক্ষোভ কমিয়ে দে।হয়তো জীবনে তোর এমন পর্যায় আসবে মায়ের কোলে কাঁদার জন্য কোল খুঁজবি কিন্তু তোর মা’কে আর পাবিনা।একটু ভরসার জন্য বাবার হাত খুঁজবি আর সেটাও পাবি না।আর রইলো বাকি তোর সঙ্গীসাথি।তোর ইতিবউ হয়তো কোনদিন অভিমান করে হারিয়ে যাবে।তুই ফেরাবি বলে সে অভিমানী হয়ে বসে থাকবে কিন্তু তুই তোর ইগোর দরুনে তাকে ফিরিয়ে আনবি না।হারিয়ে যাবে তোর সব কিছু।

– উফফ চুপ করবি তুই?তোর কাছে এত গীত শুনতে চাইনি।আমার ভালো লাগছে না।রুমে গেলাম।

ইনান রাগ দেখিয়ে রুমে চলে যায়।অলীদ এবং সুফিয়া তার দিকে তাকিয়ে রইলো বিতৃষ্ণার ভঙ্গিতে।

অলীদ এবং সুফিয়া দুজনের মাঝে কথা বলায় ব্যস্ত হঠাৎ সুফিয়ার ফোনে আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে।

– কে ফোন করেছে সুফু?

– আননোন নাম্বার।বাইরের দেশের মনে হচ্ছে।

– তাহলে ধর দ্রুত।

সুফিয়া দ্রুত রিসিভ করে ফোন কানে ধরে,

– হ্যালো কে বলছেন?

– কেমন আছিস সুফু?

– ওয়াসিম!

– আহ চিনে ফেলেছিস দেখছি।অবশ্য চিনবি না কেন?আমরা তো সবাই বন্ধুই ছিলাম।

– তুই আমায় ফোন করেছিস কেন?

– বিশেষ কারণে।আচ্ছা যাই হোক ওই শু*য়রটা কোথায়?

– কার কথা বলছিস তুই?

– ইফতিহার ইনান।

– মুখ সামলে কথা বল ওয়াসিম।আমি রাখছি তোর সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে লাগছে।

– আমার সাথে কথা বলতে তোদের রুচিতে বাধে? অথচ আমার বউকে তোর বন্ধু জোর করে বিয়ে করে এনেছে তখন রুচিতে লাগেনি?নাকি বিবেকে বাধেনি?

ওয়াসিমের শান্ত ক্রুদ্ধ স্বরে কথায় ভয় পেয়ে যায় সুফিয়া।অলীদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতে থাকে।

– কিরে কথা বলছিস না কেন?তোরা কোন সাহসে এই কাজ করেছিস?আমাকে দমন করতে না পেরে আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিস।

– ওয়াসিম ইতিকা তোর বউ কবে হলো?কবে বিয়ে হয়েছে তোদের?ফাউল কথা বাদ দে।

– বউ হয়নি তো কি হয়েছে?মন থেকে তাকে বউ মানি।

– হ্যা হয়েছে হয়েছে এবার তুই চুপ কর।বিয়ের দু’মাস হয়ে যাচ্ছে ইনান এবং ইতিকার সম্পর্কটা দুই-চারটা স্বামী, স্ত্রীর মতোই।অতীত ভুলে যা।

– আমি খুব শীঘ্রই আসছি।ইতিকাকে তো আমি দেখে নেবো।তবে তার আগে ইনানকে।ভালো থাকিস।

কথাটা শেষ করেই দ্রুত ফোন কেটে দেয় ওয়াসিম।অপরদিকে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে সুফিয়া।
দ্রুত ইনানের কাছে গিয়ে সবটা খুলে বলে।
অলীদ ইনানের ঘাড়ে হাত রেখে আশ্বাস সুরে বলে,

– হাতে সময় কম ভাবী যা চায় তা কর তুই ওই বাড়িতে ফিরে যা।আরেকটা কথা একটু নরম হওয়ার চেষ্টা কর।সারাদিন মন মেজাজ গরম রাখলে কোন মেয়ে’তো দূরের কথা একটা থার্ড জেন্ডা-রের মানুষও তোর সামনে আসবে না।

অলীদের কথায় ঠোঁট খিচে হেসে দেয় সুফিয়া।ইনান গায়ের শাটটা খুলে মাটিয়ে ছুড়ে ধমকের সুরে বলে।

– চুপ কর।#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১১]
_________
আম্মা রাত নয়টা বেজে গেল তিনি কি তবে আসবেন না?আমার চাওয়া পাওয়ার দাম যে তার কাছে নেই আগেই জানতাম আমি।

ইতিকার কথায় নাসরিন স্মিথ হাসলেন।হুঠ করে তার চোখ দুটো অশ্রু কণায় ভরে গেছে।ইতিকার দিকে তাকিয়ে আশ্বাস সুরে বলে,

– আরেকটু দৈর্য্য ধর মা।আসলেও তো আসতে পারে।

নাসরিনের কথায় বিদ্রুপের হাসি হাসলেন ইনানের বাবা ইব্রাহিম।

– জন্মদিনে মেয়েটা আবদার করেছিল আজকে অন্তত এই বাড়িতে আসতে কিন্তু সে আসেনি।কোন কুলাঙ্গার জন্ম দিলাম আমরা!ইতিকা মা তুই কেক কাঁ/ট সে আসবে না আর।রাত দশটা পার হয়ে যাচ্ছে।

তাদের তিনজনের আফসোস দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয় অলীদ এবং সুফিয়া।ইতিকার আবদারেই তারা আজ এখানে এসেছিল কিন্তু ইনান আসেনি।

– আব্বা আমি কেক কাটবো না। আপনারা কেটে খেয়ে নিন আমি ঘুমাতে গেলাম।

ইতিকা উঠে দাঁড়ায় দরজার দিকে আরেক পলক তাকিয়ে অভিমান করে নিজের রুমে চলে যায়।

ইনান আসে বেশ কিছুক্ষণ পরেই।তাকে দেখে বাড়ির সকলেই স্থির মূর্তির ন্যায় তাকিয়ে থাকে।এক পা দু পা এগিয়ে এসে ইব্রাহিমের পা ছুঁয়ে সালাম করে ইনান।কতদিন পর বাবার মুখোমুখি হয়েছে একদম সব রাগ, অভিমান ঝেরে।

– কেমন আছো বাবা?

ইফতিহার ইব্রাহিম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না।ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু জল বিসর্জন দিতে থাকেন।বেশ কিছুক্ষণ বাবা, ছেলের কান্না শেষে ইনান সুফিয়াকে ইশারায় বলে ইতিকার কথা।

– ইতিবউ কোথায় সুফু?

– তোর বউ অভিমান করে উপরে চলে গেছে।

– যা নিয়ে আয়।

বেশ কিছুক্ষণ পর সুফিয়া ইতিকাকে নিয়ে নিচে নামে।ইনানকে দেখে স্থির চিত্তে তাকিয়ে রইলো সে।ইনানো তার সাথে ভাব দেখিয়ে আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলেনি।পুরো অনুষ্ঠানটাই শেষ হয় দুজনের বাক্যহীন ভাবে।
.
রাতের গভীরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।ইনান বারান্দায় বসে সিগারেটের ধৌঁয়া উড়াতে ব্যস্ত।কত মাস পর সে ফিরে এসেছে তার কোন ইয়াত্তা নেই।ইতিকা গুটিগুটি পায়ে এসে ইনানের পেছনে দাঁড়ায়।তার অবস্থা বুঝতে পেরে স্থির কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ইনান।

– কিছু বলবেন ইতিবউ?

– ন…না।

– যান ঘুমান।অনেক রাত হয়ে গেছে।

– আপনি ঘুমাবেন না?

– আপনার কোলে যদি আমার মাথা রাখার ঠাই হয় তবেই ঘুমাবো।হবে কি?

ইনানের নিঃসংকোচ আবেদনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইতিকা।’হা’ নাকি ‘না’ কি বলবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।মন তো চাইছিল একবার বলি আসুন আমার কোলে মাথা রেখে চিন্তাহীন,তন্দ্রায় আচ্ছন্ন থাকুন।কিন্তু কোথায় যেন বাঁধা দিল মন।

নিজের সাথে নিজেই যুক্তিতর্কতে পেরে না উঠে ইতিকা রুমে চলে যায়।অপরদিকে তার এমন সংকোচ অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে ইনান।

বেশ কিছুক্ষণ পর ইনান রুমে ডুকে।ইতিকা তখনো বসে বসে টেলিভিশন দেখছে মন দিয়ে।ইনান একবার টেলিভিশনের দিকে তাকায় আরেকবার ইতিকার দিকে।টম এন্ড জেরি কার্টুন এত মনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে বুঝলো না সে।
ইনান ঝটপট ইতিকার কোলে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে শুয়ে যায়।

– আপনি…
– এত রাতে জেগে আছেন কেন?আর এই কার্টুন মমনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে?

– আপনার ঘুম পেয়েছে?বিছানায় ঘুমান।

– কেন আপনার কোলে ঘুমালে কি জাত চলে যাবে?

ইতিকা উত্তর দিলো না।আবারো মন বসালো কার্টুনের দিকে।ইনান বিরক্ত হয়ে রিমোট’টা নিয়ে টিভি অফ করে দিলো।

– ইতিবউ যখন আমি আপনার পাশে থাকবো ধ্যান- ধারণা,মনোনিবেশ সব আমাকে ঘিরে হবে।শুধু আমাকে।বুঝতে পারছেন?

– কেন এটা কি আপনার সাথে সংসার করার রুলস?

– যদি বলি তাই।আর এই রুলস সারাজীবনের জন্য মানতে হবে আপনাকে।

ইতিকা জবাব দিল না।চুপচাপ ইনানের চুলে হাত বুলাতে থাকে।

– একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?

-কী প্রশ্ন ইতিবউ?

– আমাকে সবসময় ‘আপনি’ ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন কেন?শুধুমাত্র গতকাল রাগের মাথায় ‘তুমি’ বলেছিলেন।

ইতিকার প্রশ্নে লীন হাসে ইনান।

– তুমি আমায় যেভাবে শাসন করো,ধমক দাও,আদেশ ছুড়ে দাও তাতে মনে হয় তুমি আমার বড়।মনে আছে বিয়ের দিন জলন্ত উত্তপ্ত আগুনের মতো রাগ নিয়ে জানতে চেয়েছিলে মাত্র ১৬ বছর বয়সী একজকে বিয়ে করছেন সাক্ষী হিসেবে আমার মা-বাবা কোথায়। সেদিনি আমি বুঝে নিয়েছি তুমি তো আমাকে এক ইশারায় সোজা করার ক্ষমতা রাখো।প্রথম প্রথম রাগ দেখিয়ে আপনি বলেছি কিন্তু এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

– তাই নাকি?আমার কোন কথা আপনি কী শুনেন?

– যদি তোমার কথা না শুনতাম তবে আজ এই বাড়ির চৌকাঠে কখনোই পা মাড়াতাম না।

– আম্মা ঠিকি বলে বেপরোয়া ছেলেদের বিয়ে করিয়ে দেওয়া উচিত।বউয়ের মায়ায় পড়ে ঠিকি ঘর সংসারে মনোনিবেশ করবে।

– তাই নাকি তোমার আম্মা আর কি কি বলেছে?

– বলেছে বলেছে অনেক কথা বলেছে এবার বালিশে মাথা রাখুন আমি ঘুমাবো।

– পরে ঘুমাবে আগে আমার কপালে তোমার ওই নরম ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দাও।

ইনানের বেখাপ্পা কথায় লজ্জায় নুইয়ে যায় ইতিকা।ইনানের নিঃসংকোচ আবেদন সে মান্য করতে নারাজ।

_

বাহরুল ইসলাম আজ বেজায় চটে আছেন।এতটাই রেগে আছেন যে ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় পানি ঢালতে ব্যস্ত সে।তার স্ত্রী রোশনী হন্তদন্ত হয়ে রুমে ডুকেন।

– আরে পাগল হয়ে গেছো তুমি?মাথায় এমন মগ ভর্তি পানি ঢালছো কেন?

– আমার সব জল্পনা-কল্পনা ধীরে ধীরে মাটি হয়ে যাচ্ছে রোশনী স্থির থাকবো আমি কি করে?

– কি হচ্ছে, না হচ্ছে তা পরের কথা।নিচে চলো সাহাব ভাইজান এসেছে।

– হোয়াট?শক্রু আমার ঘরে চলে এসেছে।সাহাব কেন এসেছে কিছু বলেছে তোমায়?

– না।তোমায় শীঘ্রই নিচে যেতে বলেছে।

.
বাহরুল ইসলাম মাথা মুছে নিচে চলে যায়।সাহাব উদ্দিন তাকে দেখে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

– কেমন আছো বন্ধু?

– হঠাৎ শক্রু আজ ঘরে?

– একটা সময় তো বন্ধু ছিলাম।যাই হোক বলেছিলাম গ্রামের মেয়েটাকে মেরে দিতে।না হয় পাচার চক্রের কাছে বেঁচে দিতে।তুই তো জানিস পুলিশ আমার উপর আলাদা নজরদারি রেখেছে চাইলেও কিছু করতে পারবো না।তোর সাহায্য চেয়েছিলাম আর তুই মেয়েটাকে ইনানের বউ করে আনলি।অদ্ভুত!

– আমার ইচ্ছা ছিল না মেয়েটাকে ইনানের বউ করার।কিন্তু ইনানের জোরাজুরিতে আমিও রাজি হতে বাধ্য হই।মেয়েটা যেমন তোর বিপদ ছিল এখন আমারো বিপদ হয়ে দাড়িয়েছে।এক কথায় আমি খাল কেটে কুমির ঘরে ডুকালাম।

– বাহরুল ‘ওয়াসিম’ জেনে গেছে ইতিকার বিয়ে হয়ে গেছে।তাও আবার ইনানের সঙ্গে।সে বলেছে খুব শীঘ্রই ঢাকায় ব্যাক করবে।তুই তো জানিস এই ছেলে কতটা জেদি।মেয়েটাকে মেরে দিলে আজ না আমার বিপদ হতো না তোর বিপদ হতো।

বাহরুল ইসলাম প্রত্যুত্তর করলো না।তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন।কিছুক্ষণ পর সাহাবের দিকে তাকিয়ে সিগারেট মুখে পুরে বলেন,

– তুই কি কিছু ভেবেছিস?

– না।

– আর ভাবতে হবে না তোকে।আমরা খুব শীঘ্রই এই সম্পর্কে গোপন মিটিং এ বসবো।সেখানে ইনান থাকবে না।

– অবশ্যই।আজ তবে আমি আসি।ভালো থাকিস।
_

ক্যানভাসে রংতুলিতে রাঙিয়ে তুলছে সাদা কাগজটি একটি মেয়ে।যার শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই।ক্লিপ দিয়ে চুলগুলোকে আটকে রংতুলিটা মুখে পুরে কিছু একটা ভাবতে থাকে ক্যানভাসে দিকে তাকিয়ে।

– কি রে মা আসবো?

বাহরুল ইসলামের কন্ঠে ঘুরে তাকায় রুমু।

বাহরুল ইসলামের একমাত্র মেয়ে রুমু।যার বৈশিষ্ট্য সবসময় চুপচাপ থাকা।নিজেকে ব্যস্ত রাখে রংতুলির মাঝে।ঝগড়া বিবাদে কখনো জড়িয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।

– তোমার এই রংতুলির যুদ্ধ কি কখনো থামবেনা রুমু মা?

– না বাবা, তুমি জানো আমি কতটা ভালোবাসি এই রংতুলি।কিছু বলবে তুমি?

– তোমায় আগেই বলেছি ইনানকে বাড়ির জামাই করতে চাই।কিন্তু তুমি তো কোন পাত্তাই দিচ্ছো না।

– আগেই বলেছি বাবা ইনানকে আমার সাথে যায় না।আমার প্রয়োজন শান্তশিষ্ট, আমাকে বুঝতে পারবে এমন ছেলে।আর প্রতিষ্ঠিত একটি ছেলে।কিন্তু ইনান ভাই সব কিছুর বিপরীত।

– কিন্তু আমাদের তো তাকে পছন্দ মা।

– বাবা এই সম্পর্কে পরে কথা হবে।এখন আমায় ডিস্টার্ব করো না।

– ঠিক আছে পরে কথা হবে তবে।

বাহরুল মুখভার করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।মেয়েটা তার সহজ সরল।তবে নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার বিরুদ্ধে এক পা ও ফেলবে না।নিজের ইচ্ছাতেই অনড় সে।

_

স্কুলের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ইতিকা এবং ইনান।গাড়ি থেকে নেমে ইনানকে বিদায় দিতেই ইতিকার চোখে পড়ে হাস্যজ্বল চেহারার রাতুলকে।ছেলেটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে।ইতিকা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দু’কদম পিছিয়ে যায়।তখনি কারো বুকের সাথে ধাক্কা লাগে তার।পেছনে ঘুরে ইনানকে দেখে ইতিকার ভেতরটায় আরো ভয়ের সঞ্চার হয়।কিন্তু ইতিকার ভাবনাকে মিথ্যা প্রমান করে ইনান রাতুলের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

– হেই রাতুল কি অবস্থা?

– ভালো ভাইয়া।আপনি কেমন আছেন?

– হুম ভালো। আমি যাচ্ছি ইতিকাকে ক্লাসে পৌছে দাও।

– চিন্তা করবেন না ভাইয়া।আমি আছি তো।

ইতিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ইনান এবং রাতুলের দিকে।দুইদিন আগেও যারা সাপ নেউলের মতো ঝগড়ায় মত্ত থাকতো তারা আজ কি করে এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ।

– আসছি ইতিবউ।

ইনান ইতিকাকে বিদায় দিয়ে হাটতে শুরু করে।ইতিকা তার প্রশ্নের উত্তরের আশায় এক ছুটে দাঁড়ায় ইনানের সামনে।

– কি হলো ফিরে আসলে যে?

– রাতুলের সাথে হঠাৎ এত মেলামেশা বুঝলাম না।

– তোমার বুঝতে হবে না ইতিবউ।আমার বৈশিষ্ট্য বেইমান বন্ধুদের সাথে শত্রুতা করা আর শক্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here