আগন্তুকের আসক্তি পর্ব -২৪+২৫ ও শেষ

#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৪]

________
অলস দুপুর।রোদে দাপটে ঘেমে একাকার ইনান।তার সামনে বসে আছে ওয়াসিম।ছেলেটার ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত হাসি।পানির গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শুধালো ছেলেটি,

– নে পানি।এত ঘমছিস কেন ইনান?

– তুই এখানে?

ইনানের প্রশ্নের উত্তর দিলো না ছেলেটি বরং হেলদোল ছাড়া গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে।নীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে।মৃদ্যু বাতাসে উড়ছে তার কপাল ছুঁয়ে থাকা চুলগুলো।অন্তরালে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,

– পাহাড়ে এসেছিস ঘুরতে ভালো কথা।ইতিকাকে আনলি কেন?তোর তো শত্রুর অভাব নেই ধর তোরা দুজনেই ঘুরছিস হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ইতিকাকে ধাক্কা দিলো তখন কী হবে?

ইনান ঘাবড়ে গেলো।চটজলদি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে থাকে।তার দুই হাত থরথর করে কাঁপছে, সেদিকে তাকিয়ে বেশ শব্দ করেই হেসে দিলো ওয়াসিম।

– কিরে ভয় পেয়ে গেলি?আরে আমি তো উদাহরণ দিলাম।এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

– একদম হাসবি না তোর হাসি আমার কাছে বিদঘুটে লাগে।তুই এখানে কি করে এলি ওয়াসিম?তুই তো…..

– মরে গেছি তাই তো?মরেছি তো কি হয়েছে আমি তো আর তোদের জল্পনাকল্পনা থেকে মুক্তি পাইনি।তোরাই আমায় ডেকে আনছিস বারংবার।যাই হোক চলে যাবো শেষ আবদার যদি রাখিস।

– কী?

– ইতিকাকে নিয়ে যাই?

ইনান চমকে যায়।অদ্ভুত অনুভূতি খেলে যাচ্ছে তার ভেতরটায়।শ্বাস প্রশ্বাস চালচলন যেন থেমে গেছে।ওয়াসিমের বিদঘুটে হাসিটাও তার ভেতরটা নাড়িয়ে তুলছে।ওয়াসিমকে হাসতে দেখে রেগে যায় ছেলেটি যার দরুনে দুজনের মাঝে শুরু হয় ধস্তাধস্তির।একটি পর্যায়ে ইনানের ধাক্কা লেগে পাহাড় থেকে ছিটকে পড়ে ওয়াসিম।

মূহুর্তে ওয়াসিমের নাম ডেকে লাফিয়ে উঠে ইনান।চোখের ঘুম ভাঙ্গতেই চারিদিকে পরখ করে নেয় সে।সারা শরীর ঘেমে করুন অবস্থা।শরীরটা যেন ধীরে ধীরে বিবশ হয়ে আসছে।হাত নাড়ানোর শক্তি টুকু তার মাঝে নেই আজ।চোখ বুলিয়ে দেয়াল ঘড়িয়ে সকাল সাড়ে সাতটা বাজতে দেখে হাতের বাম পাশটায় তীর্যক ভাবে তাকায়।ইতিকাকে পাশে না পেয়ে বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠে।ধীরে ধীরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বিছানা থেকে নেমে যায়।দ্রুত পা খুড়িয়ে হাটতে হাটতে ডাক পাঠায় ইতিকার উদ্দেশ্য।

– ইতিবউ কোথায় আপনি?ইতিবউ!

অলীদ এবং সুফিয়ার বিবাহ বার্ষিকী শেষে গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছিল ইতিকা এবং ইনান।গ্রামের বাড়ির পরিস্থিতি সব কিছু স্বাভাবিক থাকলেও স্বাভাবিক নেই মিহি।মেয়টি দিন দিন কেমন যেন নিগূঢ় হয়ে যাচ্ছে তোর চোখে মুখে ছেঁয়ে আছে মলিনতা।চঞ্চল মেয়েটি হুট করেই চুপচাপ হয়ে যাওয়ার কারন খুঁজে পেলো না ইতিকা।ইনান বার বার চাইছিল মেয়েটা ঢাকায় ফিরে আসুক।ব্যস্ত হয়ে পড়ুক এই জনবহুল শহরে।অতীত ভুলে ভবিষ্যৎ জীবনটাকে প্রাধান্য দিক কিন্তু অতীত ভুলতে নারাজ মেয়েটি।

সে বার গ্রামে ফিরে এসে আর গ্রামে যাওয়া হলো না ইতিকার।কেটে গেলো প্রায় দেড় বছরের মতো।ব্যস্ত সময় পার করছে ইতিকা এবং ইনান।ব্যবসার সাথে পড়াশোনার সফলতার আশায় ছুটছে ছেলেটি।তার সাথে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টাই কড়া পাহাড়ায় রাখছে তার ইতিবউয়ের।শত্রু পক্ষের ভয় এখনো কাটেনি।সুযোগ বুঝেই হামলে পড়ছে।

অপরদিকে সাহাব উদ্দীনের জেল থেকে এখনো মুক্তি মেলেনি।সব ভয়ে জড়ো হয়ে রাজনৈতিক পথ থেকে চিরতরে মুক্তি নিয়েছেন বাহরুল ইসলাম।সেই গোপন আস্তানা ভেঙ্গে চুরে সব প্রমান লুটপাট করেছেন।বর্তমানে স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে দেশের বাইরে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।অবশ্য যাওয়া আগে নাসরিনের কাছ থেকে নেওয়া সেই জমি আর বাড়ির দলিল ফিরেয়ে দিয়ে যান তিনি।
.
দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে বারংবার।শরীরটা থরথর করে কাঁপছে ছেলেটির।তার কোলেই চেতনাহীন পড়ে আছে তার প্রিয়তমা স্ত্রী।পাশে কাদঁছেন নাসরিন।রূপসী পানির ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক কিন্তু ইতিকার চোখ খোলার নাম নেই।

– মা খবরটা কখন পেলে?আর আমাকে ঘুম থেকে তুলোনি কেন?

– আমি তো তোর বাবার সাথে কথা বলছিলাম।মেয়েটা রান্না ঘরেই ছিল হঠাৎ চিৎকার শুনে ছুটে গেলাম।তারপর থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দেয়।গ্রাম থেকে নাকি তার ফুফি আম্মা ফোন করেছে মিহি নাকি ‘আত্মহত্যা’করেছে এই কথা টুকু বলেই সহসা ঘুরে পড়ে যায়।

ইনান চমকে তাকায়।বুকের ভেতর হৃদযন্ত্রটার ধুকপুক শব্দ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।হাত পা ধীরে ধীরে হিম হয়ে যাচ্ছে।গলা শুকিয়ে চৌচির।

– মা তুমি ঠিক শুনেছো মিহি নেই?

– তুই নিজেই একবার ফোন করে দেখ গ্রামের বাড়ির পরিস্থিতি কি।

– আমি ফোন করছি, তোমরা দ্রুত ইতিকার জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করো।

_

মিহির আত্মহত্যা গ্রামে চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি তৈরি করেছে নির্বাক হয়ে গেছে তার মা – বাবা।কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ নিয়ে যায়।ইনানের হাতে একটি কাগজ।হাতের লেখাগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কাঁপা-কাঁপা হাতেই চিঠিটা সম্পূর্ণ করেছে।কিছুক্ষণ আগেই চিঠিটা তার রুমের টেবিল ক্লথের নিচে পাওয়া যায়।একজন পুলিশ এগিয়ে আসে ইনানের দিকে এবং চিঠিটি দেওয়ার জন্য ইশারা করে।ইনানো নির্দ্বিধায় চিঠিটি ফেরত দেয়।সবার আড়ালে হয়ে ছেলেটি দিঘির পাড়ে দাড়ায় পকেট থেকে ফোন নিয়ে দ্রুত গ্যালারিতে প্রবেশ করে।
কিছুক্ষণ আগে চিঠিটি পাওয়ার সাথে সাথে ইনান ছবি তুলে নেয়।

ক্লান্ত চোখে নিয়ে দিঘির থই থই জলে তাকিয়ে আছে ইনান।চিঠিটা পড়তে তার বড্ড ভয় হচ্ছে।মেয়েটা যে ডিপ্রেশন থেকেই এমন একটা সিধান্ত নিয়েছে তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে সে।আড়াই বছর আগে ঘটে যাওয়ার কাহিনিটা তো আর মিথ্যা নয়।সবটা ভুলে গেলেও গায়ে যে কলঙ্ক লেগেছে সেটা কিছুতেই মুছতে পারবেনা মেয়েটি।

ইনান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাটাতনে বসে পড়ে।মোবাইলের ব্রাইটনেস বাড়িয়ে সহসা চিঠিটি পড়া শুরু করে,

শুরুতে ক্ষমা চেয়ে নিলাম আমার বাবা মায়ের কাছে।জানি আমার এমন সিদ্ধান্ততে আপনাদের বড় একটা ধাক্কা সামলাতে হবে।কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।নিজের মনের বিরুদ্ধে হাজার বার যুদ্ধ করেছি তবুও আমি সফল হয়নি।আসলে নিজের কাছে যখন নিজেই বিরক্তির কারন হয়ে যাই তখন আর কারো কোন সহানুভূতি কাজে আসেনা।শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে।ওয়াসিম নামের নিষ্পাপ ভাবা যুবকটিকে যারা হন্যে হয়ে খুঁজছে সবাই, বলা চলে আমার জীবন ধ্বংস করার জন্য ছেলেটি একমাত্র দায়ী।ওয়াসিমকে আমি ভাইয়ের নজরেই দেখতাম।আমার নজর আর তার সেই শেয়ালের নজর যে কখনোই এক ছিলনা তা আমি মোটেও বুঝতে পারিনি। আমাকে তুলে নিয়ে ধ’র্ষ’ণ করেন তিনি,বিষয়টি আমি লুকিয়ে গেলাম সবার আড়ালে।নিজের উপর তৈরি হতে থাকে ঘৃণা তবুও বেঁচে রইলাম।অবশেষে গ্রাম ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্য রওনা হলাম সুফিয়া আপুর বিয়ে উপলক্ষ্য।তাতেও বাঁধা হয়ে দাড়ালো ওয়াসিম।আমাকে গোপন একটি আস্তানায় তুলে নিয়ে পুনরায় ধ’র্ষ’ণ করার চেষ্টা করে।মনে আছে সেদিন ওয়াসিম নিরুদ্দেশ হওয়ার পর রিসোর্টের একটাও সিসি টিভি ক্যামেরা কাজ করছিলনা।সব গুলো এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়।ক্যামেরা গুলো সেদিন অফ করে দেয় ওয়াসিম নিজেই।কেননা আমাকে রুম থেকে তুলে আনার বিষয়টি সবার কাছে প্রকাশ্য চলে আসবে বলে আর নিজেই জালে নিজেই ফেসে গেলো বেচারা।সেদিন রাতের সব জেদ,রাগ,ক্ষোভ,ভয় দূর করতে হাতে তুলে নিলাম লোহার রড।বেশ কয়েকবার মাথায় আঘাত করার পর নিস্তব্ধ হয়ে যায় ছেলেটি।ঠিক তখনো আমার মাঝে ভয় কাজ করেনি।বরং আনন্দ কাজ করেছে।লা’শটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম এক ঘোরে।আর জীবনের হিসাব কষতে ব্যস্ত আমি।বাস্তবতায় ফিরে এসে ভয়েরা ঘিরে ধরে আমায়।জলজ্যান্ত মানুষটা আমার সামনে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে যাকে কি না মেরেছি আমি নিজেই!কি করবো,কোন সিদ্ধান্ততে উপনীত হবো,কাকে বোঝাবো কোন উত্তর আমি খুঁজে পাইনি।হঠাৎ আশার আলো হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো একজন।যার সাহায্যে আমি ওয়াসিমের লা’শটা গুম করতে সক্ষম হই।আপনারা নিশ্চই ভাবছেন কার সাহায্য আমি লাশ গুম করেছি?ভেবে কাজ নেই যিনি আমাকে সাহায্য করেছেন তিনি সেদিন রাতেই গত হয়েছেন।বেঁচে ছিলাম একমাত্র আমি।ওয়াসিমের ফোন থেকে যে মেসেজ গুলো পাঠানো হয় সবার কাছে সেই মেসেজ গুলো আমি নিজেই পাঠিয়ে ছিলাম।আমার কাজে আমি ঠিক তখনো আফসোস করিনি কেননা সুফিয়া আপু সেদিন বেঁচে যায়।এমন নোংরা চরিত্রের মানুষের সাথে ঘর বাঁধা মোটেও সমীচীন নয়।কিন্তু আমি বাঁচতে পারলাম না।প্রতিটি দিন আমি অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েছে।ক্রমশ একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছি।কলঙ্কের কালি আমি মুছতে পারিনি আমার মাঝ থেকে, তাই সর্বশেষ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।আমাকে নিয়ে আর কারো আফসোস না করলেও চলবে।হয়তো এটি আমার ‘মায়ের’ পাপের শাস্তি আমি ভোগ করছি।কেননা একটা সময় ইতিকাকেও আমার মা বাজার পণ্যর ন্যায় বিক্রির জন্য লাগামছাড়া ছুটে চলেছিল আর আজ সেই শাস্তি আমি পেয়েছি।যাই হোক শেষ একমাস দেখলাম আমার মা আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন কোন এক বড় লোক বাপের পুত্রের সঙ্গে।কিন্তু আমি বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত নই।আর কোন দিন প্রস্তুত হতাম কি না আমার জানা নেই।অন্তত যাই হোক এমন কলঙ্ক নিয়ে এই সমাজ আমায় কিছুতেই মানবেনা।লাল শাড়ি,গহনা মুড়িয়ে আমাকে সাজানোর বেশ শখ ছিল আমার মায়ের,কিন্তু তা আর হলো কই!
লাল শাড়ি অঙ্গে ধারণ করার আগে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে নেওয়া মন্দ নয়।সমাপ্তিটাই তো সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্ত।হোক না সেটা চিরতরে বিদায়ের মুহূর্ত!

চোখের নোনা জল বেশ কিছুক্ষণ বাধ মানলেও আর যেন বাধ মানছেনা ইনানের চোখে।এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সে আগেও পড়েছে কই তাই বলে তো এতটাও কষ্ট হয়নি।মাথার ভেতরটায় সবটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।মিহি যাবার আগে সবটা পরিষ্কার করে গেছে ওয়াসিমকে হত্যার দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে কিন্তু কোথাও ইনানকে ইঙ্গিত করে কিছু লেখা নেই।বর্তমানে সম্পূর্ণ নির্দোষ ইনান।এত চঞ্চল একটি মেয়ে ধীরে ধীরে নিপাতনে হারিয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি ছেলেটি।এইতো এখনো মনে পড়ে সেদিনের কথা বড় বড় চোখ নিয়ে ইনানকে ‘দুলাভাই’ বলে সম্বোধন করেছিল।এখন হয়তো আর কেউ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলবেনা, ‘আপনাকে আমি ভয় পাই দুলাভাই।বিয়ের দিন যে রামদা নিয়ে এসেছেন ভাবতেও আমার ভয়ে গলা শুকায়’।
মায়া আবেগটা অদ্ভুত কাছে থাকলে অনুভব করি না।বুঝেও বুঝিনা,গুরুত্ব না দিয়ে আপন কাজে ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়ি।কিন্তু ছেড়ে গেলেই এত নোনা জল আসে কেন?এত কষ্ট লাগে কেন?ফিরে তো পাবো না।এত কাদঁছি কেন!

ইনান ডান হাত উঠিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় তৎক্ষণাৎ কানে আসে সুফিয়ার কন্ঠ।

– ই..ইনান।

সুফিয়ার ডাকে ঘুরে তাকায় ইনান।

– হ্যা বল।

– শুনলাম ওয়াসিম মারা গেছে সেদিন রাতেই!

– কেন তোর কি আফসোস হচ্ছে?
নাকি অন্য….

– মোটেও না।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।অন্তত আমার দিক দিয়ে যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে আমি যাকে পেয়েছি সে আমায় যতটুকু বুঝে আর যতটুকু যত্ন নেয়,এতটা ভালো হয়তো কেউ আমায় কখনো রাখতো না।তবুও আফসোস হচ্ছে আঙ্কেল আন্টির জন্য।আর মিহি!অল্পবয়সী একটি মেয়ে।কোথা থেকে কি হয়ে গেলো?আমার মাথা কাজ করছে না।

– ইতিবউ কোথায়?

– নাসরিন আন্টির সাথেই আছেন।মেয়েটা ভেঙ্গে পড়েছে রে।

ইনানের মুখ থেকে আর কোন বাক্য ব্যয় হলো না কপালে হাত ঘষে কান্না আড়াল করতে ব্যস্ত সে।
#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৫ <শেষ>]

_________
গুটি গুটি পা ফেলে চপল পায়ে দৌড়াতে ব্যস্ত দুটি বাচ্চা।হেলেদুলে হেটে দুজনেই ছুটে চলে তাদের বাবাইয়ের রুমে।ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বেশ মনোযোগ সহকারে কাজ করছে ইনান।রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়েই চমকে তাকায় সে।

– ইশাত,ইফাত ওখানে কী করছো?কাছে এসো বাবাইয়ের।

বাচ্চা দুটি অনুমতি পেয়ে ছুটে চলে লাগামছাড়া।দুজনেই এক ছুটে লাফিয়ে উঠে তাদের বাবার কোলে।ইনানো দুজনকে দু’পাশে বসিয়ে হাতে চকলেট ধরিয়ে দেয়।গালে এঁকে দেয় ভালোবাসার পরশ।

– বাবাই থুমি খুব্ভালো।মাম্মাল পতা।

ইফাতের কথা শুনে ভ্রু কুচকায় ইনান।তার গালটা আলতো ভাবে টেনে শাসন সুরে বলে,

– কে বলেছে মাম্মাম পঁচা?চকলেট না দিলে সবাই পঁচা আর দিলেই ভালো।বাহ বাহ এই বাচ্চাগুলো দেখছি দুনিয়ার নিয়মনীতি শিখে নিয়েছে।

ইনানের বচনভঙ্গিতে আবারো খিলখিল করে হেঁসে উঠে বাঁচ্চা মেয়ে দুটি।তৎক্ষণাৎ রুমে প্রবেশ করে ইতিকা।

– কিরে ইশাত ইফাত তোরা এখানে?তোদের দাদুমনি খুঁজছেন ছুটে যা দ্রুত।

ইতিকার তাড়া দেখানো হাত ভঙ্গিতে চোখ পিটপিট করে তাকায় ইফাত।

– খেন মাম্মাম?

– এত প্রশ্ন কেন ইফাত যাও দ্রুত।

ইফাত এবং ইশাত গেলো না বরং দৃঢ় হয়ে বসে রইলো তাদের বাবার কোলে।ইতিকা এবার বেজায় চটে গেছে।রাগের মাথায় এগিয়ে এসে ইনানের কোল থেকে তাদের নিচে নামিয়ে রাখে।

– আরে কি করছেন কী ইতিবউ?ওদের নামিয়ে দিচ্ছেন কেন?

– এই বাবাইয়ের ইতিবও আমালের নামাচো খেন?

ইশাতের রগচটা প্রশ্নে চমকে তাকায় ইতিকা।ইনান ঠোঁট খিচে হাসছে।তিন মা মেয়ের ঝগড়া নতুন কিছু নয়।প্রতিদিনি তাদের খুনশুটি লেগেই থাকে।

ইতিকা বেশ রাগ নিয়ে কাদো কাদো সুরে শুধালো,

– তোরা যে তোদের বাবাইকে সারাদিন নিজেদের জিম্মায় বন্দি করে রাখিস সে তো আমার খোঁজ নেয় না।সব আদর ভালোবাসা তোদের জন্য আর আমার ভালোবাসার নদীটাতো শুকিয়ে মরে গেছে।যা দাদুমনি ডাকছে তোদের।চকলেট দেবে হয়তো।

ইফাত ইশাত আবারো চপল পায়ে ছুটে চলে।দুজনেই বেজায় দুষ্টু।তবে ইশাত একটু বেশি রাগি।ইনান এবং ইতিকার ঘর আলো করে এসেছে জমজ দুই মেয়ে ইশাত এবং ইফাত।দুজনের বয়স প্রায় তিন বছর।ঝগড়া খুনশুটিতে সময়টা বেশ ভালোই যাচ্ছে তাদের।

ইতিকা ক্লান্ত মাথাটা এলিয়ে দিলো ইনানের গায়ের উপর।মুখ দিয়ে একটা বাক্য না করে চুপচাপ ইনানের হৃদযন্ত্রের শব্দ শুনতে ব্যস্ত।

– ইতিবউ ক্লান্ত লাগছে শরীর?এত কাজ করতে কে বলে আপনাকে?এত কাজের লোক এই বাড়িতে কেন আছে তবে!

– আমার সংসার আমি কাজ করবো না তো কে করবে?আপনি তো এখন আর আমায় ভালোবাসেন না।কেমন জানি দূরে দূরে থাকেন।

– তাই নাকি?তাহলে আমি যে সারাদিন খেটেখুটে মরছি, তবুও রাতদিন যার চিন্তায় বিভোর থাকছি সে কে?

– আমি তো জানি না নতুন কাউকে পেয়েছেন হয়তো!

– আমার জীবনে আগন্তুক একজন ছিল একজন আছে আর একজনি থাকবে।সে হলো আমার ইতিবউ!

– মানিনা মিথ্যা বলছেন।

– একটুও না।আসলে বুড়া হইয়া যাচ্ছি তো তাই আর আগের মতো আমারে পছন্দ না আপনার তাই এমন বাহানা বানান।

ইনানের কথায় শব্দ করে হেসে উঠে ইতিকা।দুজনে মাঝ কেটে যায় বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা।নিরবতা ঘুচে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ইতিকা,

– আমাকে চাকরি করতে দেবেন?

ইতিকার কথা শুনেই ইনানে কপালে ভাঁজ পড়লো।রেগে গেলো মূহুর্তেই।

– চাকরি?চাকরির কথা আসছে কেন এখানে?

– আমারো তো কিছু করার ইচ্ছা আছে তাছাড়া ইফাত-ইশাত এখন বড় হয়েছে আব্বা আম্মার কাছেও তারা থাকবে আমি একটা জব কি খুঁজবো?

– এসব কুবুদ্ধি কে দিচ্ছে আপনাকে? সুফিয়া চাকরি করছে?সে তো আপনার থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিজের বাচ্চা সংসার নিয়ে পড়ে আছে।এই সময় চাকরি করা মানে বাচ্চাদের সময় দিতে পারবেন না।

– প্লিজ রেগে যাবেন না আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন।

– কোন বোঝা বুঝি নাই।আমি চাকরি করতে দেবো না এটাই ফাইনাল।

ইতিকা ছিটকে সরে যায় ইনানের কাছ থেকে।ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করছে বারংবার।ইনানের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সহসা।তখনি রুমে প্রতিধ্বনি হলো কিছু ভাঙ্গার শব্দ।ইতিকা ভীতকর চাহনীতে তাকাতেই খেয়াল করে ইনানের ল্যাপটপটা পড়ে আছে মেঝেতে।ভয়ে ইতিকার দু’ঠোঁট কাঁপছে বেসামাল গতিতে।ইনানের হাবভাব মোটেও সুবিধার নয়।গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।ইতিকা ভয় পেয়ে যায় যার দরুনে ছুটে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা চালায়।কিন্তু দু’কদম যেতেই পেছন থেকে হাতটা খপ করে ধরে নেয় ইনান।

– কোথায় যাচ্ছেন?

– ছাড়ুন আমায়।এখানে থাকার ইচ্ছে নেই আমার।

-কিন্তু এখান থেকে তো যেতে দেবো না আমি।আপনার শশুড় শাশুড়ী কানে ফোড়ন কাটবেন?যেখানে আমি এই ইফতিহার ইনান সম্মতি দেয় নি সেখানে কারো সুপারিশ কাজে আসবে না।

ইতিকা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য বেশ ছোটাছুটি শুরু করে দেয়।দু’চোখ দিয়ে তার অনবরত পানি ঝরছে ইনানের অস্বাভাবিক রাগের কারনটা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না সে।

– ছেড়ে দিন চলে যাবো।থাকবো না আর আপনার সাথে।

– কোথায় যাবেন ইতিবউ?

– যেখানেই যাই আপনার কাছে আর ফিরবো না।

ইতিকার কথা শুনে ইনান ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো।আরেকটু কাছে টেনে নিলো ইতিকাকে।মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে বলে,

– আপনি জানেন না ইতিবউ এখনো আমার কত ভয় কাজ করে মনে।অতীতের শত্রুপক্ষ এখনো পিছু ছাড়েনি আমার।সবাই আপনাকেই বেছে নেয় আমাকে ব্লাক মেইল করার জন্য সেখানে আমি কি করে আপনাকে বাইরে চাকরির উদ্দেশ্য পাঠাবো।যেখানেই থাকেন আমার অন্তরালে নিরাপত্তা সবসময় আপনার ছায়া হয়ে থাকে।কিন্তু তবুও যে ভয় আমার কাটে না।হয়তো বা কাটবেও না কখনো।
.

গভীর রাত চারিদিকে বর্ষণমন্দ্রিত।বাতাসের শো শো শব্দ কানে আসলেও আবার তা বৃষ্টির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে।বিছানার একদম কিনারায় রেগে ঘুমিয়ে আছে ইতিকা।ঝগড়ার পর আর দুজনের মাঝে কথা হয় নি।ইশাত-ইফাত দুজনেই আজ দাদুমনির সাথে ঘুম দিয়েছে।ইনান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে।অলীদকে ফোন করবে কি করবে না ভেবেই ফোন করে বসলো দ্রুত।

– হ্যালো অলীদ ঘুমিয়ে পড়েছিস?

– আরে ব্যাডা ঘুম থেকে তুইলা জিগাস ঘুমাইয়া গেসি কি না।মদ খাইসত?ভাবী কিছু কয় নাই?

– একটা চড় দিবো, আগে কথা শুন।তোর বউ বাচ্চা কই?

– আমার বউ,আমার বাচ্চা মেয়েটা আমার পাশেই আছে কি বলবি বল।

– ইতিকার মাথায় চাকরির ভুতটা কী তোরা ডুকিয়েছিস?

– চাকরি!কিসব বলছিস ভুলেও না।আমি তো বরং সুফুকে উঠতে বসতে চড় লাগাই সে নিজেও চাকরি করতে চায় কিন্তু আমি ভাই দিবো না;করতে হলে আরো দুই তিন বছর পরে করো তবে এখন নয়।

– তার মানে সুফিয়া এই বুদ্ধি মাথায় ঠেসে দিয়েছে।রীতিমতো আমার ঘরে ঝগড়া চলছে ভাই কেউ কারো সাথে কথা বলছি না।

ইনান ফস করে শ্বাস ছাড়লো, বারান্দায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টির পানি হাতে তুলে নেয়।

– এত চাপ নিস না ইনান।চাকরি করতে দে তবে তোর অফিসে ডানে বামে ভুলেও নড়তে দিবিনা।

– গুড আইডিয়া।
.

ঘুমন্ত মুখটায় বৃষ্টির ঝাপটা পড়তেই সহসা চোখ খোলে ইতিকা।নিজেকে ভাসমান খোলা আকাশের নিচে দেখে বুকের ভেতরটায় মুষড়ে উঠে।

– ভায় পাচ্ছো কেন ইতিবউ এই যে আমি।

ইতিকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।ইনানের কোলে নিজের অবস্থান বুঝে ঠোঁট বাকিয়ে মনে মনে বিশ্রি একটি গালি ছুড়ে দেয়।

– ছাদে কেন এনেছেন?ছাড়ুন আমায়।

– লাফালাফি করলে কিন্তু আপনাকে ছাদে রেখে তালা ঝুলিয়ে আমি নিচে চলে যাবো।বাই দা ওয়ে আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।

– কি সেটা?

– চাকরি করার অনুমতি দিলাম তবে সেটা একমাত্র আমার অফিসে।চলবে?

– চলবে মানে দৌড়াবে।

ইতিকাকে কোল থেমে নামিয়ে দেয় ইনান।দুজনেই ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টি স্নানে।ইনান জারিয়ে আছে তার ইতিকার মাঝে দুজনের মাঝে ব্যবধাব ঘুচে গেছে বহু আগেই।তবুও নিত্যুনতুন ভাবে একে অপরকে ভালোবেসে যায় নতুন করে।নিরিবিলি রাতে শুধু বৃষ্টির শব্দটাই কানে আসছে তাদের।ইনান আগলে নেয় ইতিকাকে জড়িয়ে নেয় আলতো হাতে।

– শুরুটা মনে আছে ইতিবউ?তখন আপনি কতটা ছোট ছিলেন।তখনকার চাহনী ছিল প্রখর।সেই ছোট্ট ইতিকা এখন আমার বাচ্চার মা।

– আপনি কী বড় ছিলেন নাকি?ইঁচড়েপাকা ছেলে গুন্ডার দল নিয়ে ছুটে গেলেন বিয়ে করতে।

ইতিকার আড়চোখের চাহনীতে শব্দ করে হেঁসে দেয় ইনান।বৃষ্টিতে জুবুথুবু শরীরে ইতিকাকে জড়িয়ে নেয় আরো শক্ত বন্ধনীতে।
ইতিকা কিছু একটা ভেবে ইনানের পিঠে কিল বসায়।আচমকা আঘাতে ধড়ফড়িয়ে উঠে সে,

– আহ ইতিবউ মারছেন কেন?

– মানে আছে কি বলেছিলেন বিয়ের পর দিন?

– কি বলেছিলাম?

– বেশ রাগ নিয়ে আমার মাথায় পানি ঢালতে নিয়ে গেছেন আর বলেছিলেন ‘আমার সাথে সংসার করার পূর্ব শর্ত হলো তোমার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।’ সেদিন আমায় অন্ধকার রুমে বন্দি করে চলে যান।কম কষ্ট দেননি আমায়।

– আপনিও কম তর্ক বির্তে জড়িয়ে পড়েননি ইতিবউ।ছোট্ট মেয়ে আমার সাথে পান থেকে চুন খসলেই তর্কে জড়াতেন।

– তো এখন এই তর্ক বাজ ছোট্ট মেয়েকে সহ্য করছেন কী করে?

ইনান ইতিকার কপালে অঁধর ছোঁয়ায়।কোমড়ে হাত জড়াতেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠে মেয়েটি।ভেজা চোখ নিয়ে ইনানের চোখে চোখ রাখতেই আবারো মাথা সরিয়ে নেয়।

– যদি বলি এই তর্কবাজ মেয়েটাকেই আমার চাই সারাজীবনের জন্য?আর ছোট্ট সেয়ানা মেয়েটা যে কিনা ইফতিহার ইনানের মতো মানুষকে পালটে দিতে পারে।তুমি আমার জীবনের সেই আসক্তি যা ছাড়া আমি ছন্নছাড়া।এই আসক্তিতে কোন ক্ষতি নেই।সবটাই ভালো দিক।অন্তত এই আগন্তুক আমার জীবনে আরো বেশ কয়েক বছর আগে এলেও পারতো কিন্তু আসেনি!

– আর নোলক?নোলক তো ছিল অতীতে!

ইতিকার মুখে নোলকের কথা শুনে ঘাবড়ে যায় ইনান।অলীদ-সুফিয়ার বিয়ের দিন সেই রাতে নেশায় ডুবে থাকা ইতিকাকে নোলকের ঘটনা বলেছিল সে।তবে কী সবটা জেনে গেছে ইতিকা?আর ওয়াসিমকে মারার বিষয়টা?

মূহুর্তেই রোমাঞ্চকর পরিবেশটা ইনানের কাছে বিদঘুটে লাগতে শুরু করে।ভয়ে তার শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।তার অস্থিরতা দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে ইতিকা।

– ভয় পাচ্ছেন কেন?আমি সবটা জানি!

– জ..জানেন মানে?ক..কি কি জানেন আপনি?

– আমাকে আম্মা সব বলেছে নোলক কি করে মারা গেছে আমি সব জানি।আপনি শান্ত হোন যে চলে যাওয়ার সে চলে গেছে আর ওয়াসিম এতটা জঘন্য কাজ করেছিল আমি ভাবতেও পারছিনা।এখন তো আপনার কোন ভয় নেই না আছে ওয়াসিম আর না আছে ফিরে আসার মতো নোলক এখন শুধু আমরা আমরা।ভয় পাবেন না ইনান, আপনার ইতিবউ আপনার সাথেই থাকবে।

ইতিকার মুখে কথা গুলো শুনে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো ইনান।আবারো জড়িতে ধরলো ইতিকাকে তার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির সঙ্গে।মনের ভেতর এখনো তার ভয় কাজ করে ইতিকা যদি হারিয়ে যায় তবে কী হবে?আবারো কী ছন্ন ছাড়া হয়ে যাবে ইনান।

ইতিকা আগলে নেয় ইনানকে ঠোঁটের কোনে তার তৃপ্তির হাসি।বৃষ্টিতে চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে অতীতের কথা।অতীত বর্তমান হিসাব কষে সে যেন আজ জয়ী।

– ইফতিহার ইনান আপনার কাছে বিয়েটা ছিল একান্ত আমায় বাঁচানোর উদ্দেশ্য কিন্তু আমার কাছে বিয়েটা ছিল আপনাকে আমার উপযুক্ত বর এবং আমার শশুড় শাশুড়ীর যোগ্য সন্তান গড়ে তোলার তাড়না।ওয়াসিমের সাথে সর্ম্পকে যাওয়ার চার মাসের মাথায় বেশ বড়লোক কোন বাড়ির বউ করার জন্য সেই বাড়ির কর্তী প্রস্তাব পাঠান আর তিনি ছিলেন আপনার মা।আমার তো সাদা মনে কাঁদা নেই তাই আমি নির্দ্বিধায় গোপনে আমার আর ওয়াসিমের সম্পর্কের কথাটি জানাই।সেদিন তিনি আমায় নোলকের কথা বলেন এবং ওয়াসিমের কুর্তীর কথা জানান।আমার কাছে কোন উপায় ছিল না ঠিক তখনো ওয়াসিমকে ছেড়ে আসার।তাই আপনার মা আমায় সব কলাকৌশল শিখিয়ে দেন।তিনি নিজেই ওয়াসিমের বাবা মায়ের কাছে জানিয়ে দেন ওয়াসিম গ্রামের কোন মেয়ের সাথে প্রেম করছে আর সেটা নিয়ে পড়ে যায় হইচই।অপর দিকে আপনি আমায় মারা জন্য যখন অনুসন্ধানে ব্যস্ত তখন নিজেই অদ্ভুত ভাবে নিজেই বিয়ে করলেন।আর বিয়ের পর স্টেপ বাই স্টেপ আপনাকে আমি বাড়ি ফিরিয়েছি, বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিতে বলেছি,রাজনৈতিক ছাড়াতে বাধ্য করেছি।সব কিছু সবার জন্য ভালো হলেও একমাত্র আমার কলিজার টুকরা মিহির জন্য শেষটা ভালো হয়নি।আর সেই আফসোস আমার কোন দিন শেষ হবে না।আমি আপনার এই আগন্তুক মেয়েটি অন্যর পরিবারে বোঝা হলেও আপনাদের পরিবারে রাজরানী।

ইতিকার ভাবনায় ফোড়ন কাটে ইনানের কথায়।এতক্ষন অতীতে বিভোর ছিল মেয়েটি।

– ইতিবউ কোথায় হারিয়ে গেলেন?

– না না কিছু না।চলুন নিচে যাই।

.

ভোরের আলো ফুটতে দেরি নেই আর।ফজরের নামাজ শেষ করে বারান্দায় দাঁড়ালো ইতিকা।ইনান এখনো ঘুমে বিভোর।বারান্দার দোলনায় চোখ বুলাতেই ইতিকার চোখে পড়ে ইনানের নোট খাতা।এই খাতায় প্রায় সময় ইনান তার কাজের হিসাব নিকাশ করে কিন্তু এত দরকারি খাতাটা দোলনায় দেখে বিরক্ত হয় সে।খাতাটি তুলতেই তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি চিরকুট।বেশ কৌতূহল নিয়ে চিরকুটটি পড়তে থাকে সে,

‘হঠাৎ সাদা আকাশে কালো মেঘের আলাপন,
গুমোট পরিবেশ রয়ে যায় দীর্ঘক্ষণ!
বৃষ্টি নামবে বলেও নামে নি,
উষ্ণতাহীন পরিবেশ আসবে বলেও আসেনি!তারপর খেলে যায় এক আচমকা ঝড়, নেমে এলো প্রলয়!
অকস্মাৎ আগন্তুক বৃষ্টির দেখা মিললো।শীতল হলো পরিবেশ, নেমে এলো নির্মলতা।আর সেই নির্মলতাকে আকঁড়ে ধরতেই আসক্তি তৈরি হলো।
আগন্তুকের আসক্তি আমায় মুষড়ে দিলো সব দিক থেকে।আজ আমি যেন শেকলহীন এক অদৃশ্য জালে বন্দি।আগন্তুকের আসক্তিতে ভুগছি আমি।

ইতিকা মৃদ্যু হেসে চিরকুটটা রেখে দেয়।চোখের কোনে তার জল এমন অটুট থাকুক তার ভালোবাসার সংসার।

_

বেশ কয়েকদিন পর।অফিসের কাজে ব্যস্ত ইনান।বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়ে রাত দিন কাজ করে চলছে সে।তার জানা মতে ইতিকা বেশ কয়েকমাস পর অফিসের কাজে জয়েন হবে।তাই এই মূহুর্তে প্যারা নেই ভেবেই নিজের কাজ সামলাচ্ছে সে।কেবিনে ডেস্কটপ বসে ফাইল চেক করতে ব্যস্ত সে।সেই মূহুর্তে কেবিনে প্রবেশ করে তার মেনেজার।

– স্যার আজ আপনার নতুন পি.এ জয়েন করার কথা তিনি এসেছেন।

– হুম শুনলাম বাবা নাকি তাকে ঠিক করেছে!ডাকুন তাকে।

– ওকে স্যার।

ইনান ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।পানির গ্লাসটা হাতে তুলে এক ঢোক গিলতেই কেবিনে প্রবেশ করলো নতুন পি.এ এবং মেনেজার।

– স্যার আপনার নতুন পি.এ ইতিকা মেম।

নামটা শুনতেই ইনানের মুখের পানি নাকে উঠে যায়।চোখ উলটে তাকাতেই চোখে পড়ে ফর্মাল ড্রেসের একটি মেয়েকে।যাকে দেখতে মোটেও গৃহিণী মনে হচ্ছে না।এই অফিসিয়াল ড্রেসটা যেন তার জন্যই তৈরি।

– তুমি আমার পিএ?বাবা….

ইনান কথা শেষ করার আগেই মেনেজার রুম থেকে চলে যান।তার ঠোঁটের কোনে হাসি লেগে আছে।বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইনান।ইতিকা এক পা দু পা করে এগিয়ে আসে ইনানের কাছে।

– তো স্যার বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?

– বাহ ঘরে আপনি বাইরেও আপনি। আমার জীবনটাই এখন ইতিবউ ময়।

– অফিসে ইতিবউ ডাকবেন না প্লিজ!

– কেন?

– আমার আদর আদর লাগে!

ইতিকার লজ্জায় লাল হওয়া মুখ ইনান তাকিয়ে আছে আহাম্মক বনে।

~ সমাপ্ত 🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here