আগন্তুকের আসক্তি পর্ব -১২+১৩

#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১২]
_________
হাতে বেশ কয়েকটি শপিং ব্যাগ নিয়ে হেলেদুলে হাটছে সুফিয়া।তার বাম পাশে ইতিকা।অলীদ সামনে সামনে হাটলেও তাদের স্থির হাটায় বিরক্ত সে।

– এইসব কি? এমনে কেউ হাটে?এমন হেলেদুলে হাটার মানে কি সুফু?

– আর পারছিনা দোস্ত।তুই দুইটা ব্যাগ নে হাতে।আমার হাত তো ছিড়ে যাবে।

– আমি কোন শপিং করছি?করলি তোরা দুজনে।তাহলে ব্যাগ নিবিও তোরা দুজনে।আমাকে কি তোদের চামচা লাগে নাকি?

– আহ চামচা হওয়ার কি আছে?তুই না আমার বন্ধু?

– আজকের জন্য সব বন্ধুত্ব বাতিল।ওই ইনান শালা কোথায় গেলো আবার?আমাদের একা করে তিনি কোন মহাভারত শুদ্ধ কর‍তে গেল?

– আমি জানি না।যাই হোক দ্রুত হাট।

৩ জনে আবার হাটতে শুরু করে।শপিং মল থেকে বের হয়ে পার্কিং জোনের দিকে এগিয়ে যায় তারা।পার্কিং জোনের দিকে লোক সমাগম তেমন নেই।ইতিকা চাতক পাখির মতো এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে পরিবেশটা।

– ইতিকা?

দূর থেকে একটি ছেলর চিৎকারে ঘুরে তাকায় ইতিকা।কিন্তু পেছেনে ঘুরে ওয়াসিমকে দেখতে পাবে সপ্নেও ভাবে নি সে।ওয়াসিম ইতিকার নাগাল পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।এক ছুটে ইতিকার সামনে চলে আসে।আশেপাশে না তাকিয়ে নির্দ্বিধায় ইতিকাকে জড়িয়ে ধরে বক্ষপিঞ্জরে।অপরদিকে ইতিকা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মাথার সবটা যেন খালি খালি লাগছে।কি করবে সে?ওয়াসিমের বক্ষপিঞ্জরে তার ছিল সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।আজ আবার দীর্ঘদিন পর সেই চেনা স্থানে সে ফিরে এসেছে।জড়িয়ে কি ধরবে তাকে একবার?নাকি দূরে সরিয়ে দেবে?
ইতিকা ভাবনার মাঝেই হাতে থাকা শপিং ব্যাগগুলো আলগা করে ছেড়ে দিলো।ইতিকা আলতো হাতে ওয়াসিমকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।সবটা তার সপ্ন লাগছে।দৃঢ় মনে কখনো ভাবেনি ওয়াসিমকে এইভাবে আরো একবার ছুঁয়ে দিতে পারবে।

– ক…কোথায় ছিলে তুমি?

ইতিকার কান্না জড়িত কন্ঠে উত্তর দিলো না ওয়াসিম বরং সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে ইতিকাকে।

.
দুপুরের পর ইতিকা অলীদ এবং সুফিয়াকে শপিং এর উদ্দেশ্য বের হয় ইনান।কেনাকাটা শেষে অলীদকে সুফিয়া আর ইতিকার দায়িত্ব দিয়ে সে ফুল দোকানের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে ফেরে সে।কিন্তু পার্কিং জোনে দাঁড়িয়ে এমন একটা পরিস্থিতি দেখবে সপ্নেও ভাবেনি।হাতে থাকা গুচ্ছগোলাপ গুলো সহসা হাত থেকে মাটিতে পতিত হয়।

– ইতিবউ!

ইনানের ডাক ইতিকার কর্ণকুহুরে পৌছালো না।সে এখনো ওয়াসিমের বাহুডোরে বন্ধী।

অলীদ আর সুফিয়া তাকিয়ে আছে স্থির নয়নে।এই পরিস্থিতে কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না তারা।

– ইতিকা ভুলে যেওনা তুমি বিবাহিত।ইনান দাঁড়িয়ে আছে পেছনে।

সুফিয়ার কথায় ছিটকে দূরে সরে যায় ইতিকা।ইনানের দিকে তাকিয়ে সে যেন বর্তমানে ফিরে এসেছে।ওয়াসিমের সামনে থেকে সরে ইনানের পাশে আসতেই ক্রুদ্ধ হয় ইনান।

– দূরে যান ইতিবউ।আরেকটু কাছে আসলে আমার দুহাত আর স্থির থাকবে না বলে দিলাম।

– সরি!

– চুপ,মুখ বন্ধ।

ইনান ইতিকাকে বেশ শান্ত সুরেই কথাগুলো বলছে।এ যেন ঝড় আসার পূর্বাভাস।ইনানের কাছে এগিয়ে আসে ওয়াসিম।বেশ কয়েকবার সামনে থাকা ইনান, ইতিকাকে পরখ করে বলে,

– আমি এসে গেছি তোর নাটক বন্ধ করে ইতিকাকে আমার কাছে ফেরত দে।

– নাটক কে করছে?আমি নাকি তুই?আমি কি চিনি কে তোর গার্লফ্রেন্ডে।আর না চিনি কে তোর হবু বউ।আমি তো এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছি তার পরিবারকে জেনে। কে তার বয়ফ্রেন্ড আর কে তার এক্স সেই সব জেনে নয়।

-দেখ ইনান কথা একদম প্যাচাবি না।সবটা যে তুই ইচ্ছে করে করেছিস তা আমি ভালো করেই জানি।ইতিকাকে ফেরত দে।

– অদ্ভুত কথা তোর।আর বউকে আমি কেন পরপুরুষের কাছে দেব।ভালোয় ভালোয় বলছি সরে যা।

– তুই নিজে সরে যা আমাদের জীবন থেকে।মাঝখানে এসে কেন সবটা তছনছ করে দিচ্ছিস?

ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।সে ইতিকাকে ইশারা করে গাড়িতে গিয়ে বসতে।ইতিকাও বিনাবাক্য গাড়ির দিকে পা বাড়ায়।তৎক্ষনাৎ ওয়াসিম তার হাত চেপে ধরে আর বিষটি সহ্য হয়নি ইনানের।সহসা রুষ্ট বাঘের ন্যায় মুছড়ে ধরে ওয়াসিমের শার্টের কলার।

– অধিকার আগের মতো এক চুল পরিমানেও নেই তোর।আগের ইতিকা ইয়াসমিন তোর যা ইচ্ছা তা ছিল।কিন্তু বর্তমান ইতিকা ইয়াসমিন হলো মিসেস ইফতিহার।যা বলবি সাবধানে। আর যা করবি সাবধানেই করবি।আবার এমন সাহস দেখালে হাত কেঁটে রাস্তার মাঝে ছুড়ে মারবো মাইন্ড ইট।’ইতিকা’ গাড়িতে বসুন।

ইনানের মুখে ‘ইতিকা’ নামটি শুনেই চমকে তাকায় ইতিকা।যার মুখে ‘ইতিবউ’ শব্দটা মুখোরিত থাকতো সে আজ ইতিকা বলে ডাকছে।
ইতিকা আর কথা বাড়ালো না।চুপচাপ এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে।
_

নিজের রুমে এসে সহসা ওয়াশরুমে প্রবেশ করে ইনান।গায়ের শার্টটা ছুড়ে ফেলে ঝরনার পানিতে ভিজতে থাকে অবিরত।শরীরের শিরায় উপশিরায় রাগের সঞ্চার হয়েছে।চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে ওয়াসিমকে জড়িয়ে ধরার সেই মূহুর্তটা।

ভয়ে গুটিয়ে থাকা ইতিকা স্থির পায়ে রুমে প্রবেশ করে ইনাকে না দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে।কিন্তু পেছন থেকে বজ্রকন্ঠ ইনানের কথা শুনেই লাফিয়ে উঠে সে।

– ইতিকা ওয়াশরুমে যান।দ্রুত গোসল করবেন আপনি।

– কিন্তু কেন?

– পরপুরুষকে ছুঁয়েছেন আশা করি আর কোন কারন জানার প্রয়োজন নেই আপনার।

.
দীর্ঘ দিন পর ওয়াসিম দেশে আসায় বাড়িতে বেশ হইহুল্লোর শুরু করে দিয়েছে ওয়াসিমের পরিবারের লোকজন।কিন্তু তার আগুনের চুল্লির মতো মুখখানা দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়।ওয়াসিমের বাবা সাহাব উদ্দিন বেশ রেগেই প্রশ্ন ছুড়েদিলেন তার দিকে,

-সমস্যা কি তোমার?আমাদের আনন্দের কোন মূল্য নেই তোমার কাছে?একটা মেয়ের জন্য সবাইকে অবজ্ঞা করছো।

– বাবা আমি স্থির থাকতে পারছিনা।পারছিনা নিজের মনকে শান্তনা কি করে দেবো?তুমি যদি আমায় জোরাজোরি করে বিদেশ না পাঠাতে তবে এমনটা ভুলেও হতো না।

– তোমার জন্য কি মেয়ের অভাব হবে?একটা গাইয়া মেয়ের জন্য পড়ে আছো কেন?নিজের ব্যাক্তিত্ব ঠিক রেখে চলো।

– তোমার এসব জ্ঞান আমার ভালোলাগছে না বাবা।আমি উপরে গেলাম।আরেকটা কথা ইতিকা এই বাড়ির বউ হয়ে আসবে এটাই ফাইনাল।

ওয়াসিম রাগ দেখিয়ে উপরে চলে যায়।সাহাব উদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে।
_
গত দুইদিন কোন কথা নেই ইনানের মুখে।ভুলেও ইতিকার সাথে কথা বলেনি।প্রতিবার তাকে উপেক্ষা করে গেছে।ইতিকা বেশ ভালো করেই বুঝেছে ইনান ক্ষেপে আছে।ইতিকার উপর রাগ দেখিয়ে বাড়ির কোন দানাপানি মুখে তুলে নি সে।আর বিষটি বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে নাসরিন এবং ইব্রাহিম।

বেশ রাত করে বাড়ি ফিরেছে ইনান।গত কয়েনদিন তার বাড়ি ফেরা নিত্যকার অভ্যাস হয়ে গেছে।প্রতিদিন ইতিকা ঘুমিয়ে পড়লেও আজ তন্দ্রাহীন অপেক্ষায় আছে ইনানের আশায়।ইনানকে রুমে আসতে দেখেই প্রশ্ন ছুড়লো ইতিকা।

– সমস্যা কি আপনার?আমাকে ইগ্নোর করছেন কেন?

– কে করলো আপনাকে ইগ্নোর?

– যাকে প্রশ্নটা করেছি সে করছে।

ইনান এবারো উত্তর দিলো না।রাগ দেখিয়ে শুয়ে পড়লো।ইতিকা তার পাশে বসে বাহুতে মাথা রেখে শুয়ে যায়।

– দূরে সরুন ইতিবউ আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগছেনা।

– এমন কেন করছেন আপনি?

– কোন মুখে এই কথা জিজ্ঞেস করছেন?ওয়াসিমকে জড়িয়ে ধরলেন কেন?

-ভুল হয়ে গেছে।

– ভুল হয়েছে গেলে বললেই কি হবে নাকি?আশেপাশে সুফিয়া, অলীদ তার মাঝে আপনি ছিহ!

ইতিকা নিজের ভুল বুঝতে পেরে দ্রুত মাথা নামিয়ে নেয়।অপরাধ যে তার মাঝে হয়নি তা কিন্তু না।অপরাধ তার মাঝেও সৃষ্টি হয়েছে আর তা নিয়ে অনুতপ্ত সে।

– একটা কথা বলুন ইতিকা যদি আপনার সামনে কেউ আমায় জড়িয়ে ধরে,মাথায় চুমু খায় আপনি কি মেনে নেবেন?সহ্য করতে পারবেন সেই মূহুর্তটা?

ইতিকা শিউরে উঠলো।বিষটি ভাবতেই তার গা কেঁপে উঠছে।বিয়েটা যেমন তেমন হোক ইনানকে যেহেতু সে নিজের স্বামীর স্থানে একবার বসিয়েছে সে তো আর কিছুতেই অন্য মেয়ের সঙ্গে তাকে মেনে নিতে পারবেনা।

– কথা বলছেন না কেন ইতিবউ?

– ভুল হয়ে গেছে মাফ করেদিন।

– একটা জবান দিন তো আমি মানছি আমার সাথে হয়তো আপনি জড়তা নিয়ে থাকেন কিন্তু আমার বাবা, মা তারা তো আপনাকে নিজের মেয়ে চোখেই দেখছে।আদর যত্নে আগলে রাখছে আমাকে ছেড়ে গেলেও তাদেরকে ছাড়তে পারবেন?

-আমার বাবা- মা নেই।এই বাড়িতে আসার পর বাবা-মা নেই এটা নিয়ে আমার সব অভিযোগ যেন ভুলে গেছি।বর্তমানে তারাই আমার সবকিছু।

– আর আমি?আমাকেও কি আপন ভাবছেন?

ইতিকা চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ইনানের দিকে।এই ছেলে যে আজ বেজায় চটে আছে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে।

ইনান ইতিকার এমন নিরব চাহনী কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা।রাগের মাথায় এতক্ষণ শান্ত থাকলেও হুট করেই রাগ দিগুন বেড়েছে।হেঁচকা টেনে ইতিকে কোলে বসায় ইনান।হঠাৎ টানে ইতিকাকেও নিজেকে সামলাতে পারলো না।দড়াম করে বসে যায় ইনানের কোলে।

– কি করছেন কি?এইভাবে কেউ….

-চুপ কথা বাড়াবেন না।পরিস্থিতি ভালো নেই ইতিবউ।আর আপনি যদি আমার বিরদ্ধে যান তবে এরপর কি হবে আমি জানিনা।শুধু এটাই জানি আমি ভালো থাকবো না।

জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে শুচালো কথা গুলোর কোন মানে বুঝে উঠতে পারছেনা ইতিকা।

– আপনার কি হয়েছে বলবেন আমায়?আমি আপনার এইসব অস্বাভাবিক অচরণ আর নিতে পারছিনা।

– ওয়াসিম চলে এসেছে। সে আপনাকে নেওয়ার জন্য নানান ছল বাহানা করবে।যদি আপনি তার সাথে চলে যান তখন আমার কি হবে?

ইতিকা স্তব্দ হয়ে যায়।কি বলবে সে বুঝে উঠতে পারছে না।

– ওয়াসিমের বউ আছে আমি কেন তার সাথে যাবো?

– আবেগে পড়ে যেতে পারেন।যেমনটা সেদিন জড়িয়ে ধরেছেন।

ইনান কথা শেষ করতেই বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ পেলো।অস্বাভাবিক ভাবে গাড়ির হর্নটা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।ইনানের অবচেতন মন জানান দিচ্ছে নিশ্চই ওয়াসিম এসেছে।

ইতিকাকে সরিয়ে ইনান বারান্দার দরজা ফাঁক করে দৃষ্টি বাইরের দিকে তাক করলো।তার ভাবনাটা তবে সত্যি হয়েছে।ওয়াসিম বাইক নিয়ে এসে বাইরে হর্ন বাজাচ্ছে।

ইনান ধীরে পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে আসে।ওয়াসিম তার দিকে তাকিয়ে আছে বাইকের উপরে বসে।ইতিকা জড়োসড়ো হয়ে ইনানের পাশে দাঁড়ায়।নিচ থেকে ওয়াসিমকে দেখে তার চক্ষুচড়ক গাছ।

-ইতিবউ প্লিজ হাগ মি।

– হাহ!

– হা হু করার সময় নেই।আমাকে হাগ করো।

ইনানের কথায় নড়ে-চড়ে উঠে ইতিকা।ইনানকে সে নিজে থেকে হাগ করবে!কখনোই না মরে গেলেও না।

ইনান দাঁত কিড়মিড় করে ইতিকার দিকে দৃষ্টি রাখে।

– কি বলেছি তোমায়?যদি হাগ না করো তবে আমি দোতলা থেকে লাফ দেবো।

– না মানে….

– এখন মানে মানে করছো?ওয়াসিমকে কি করে জড়িয়ে ধরেছিলে?

ইতিকা বিভ্রমে পড়ে গেছে কি করবে সে?মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।তবুও একটু একটু করে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে ইনানের দিকে।ইনান তার হাত টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।এটাই ইনানের জীবনের প্রথম আলিঙ্গন তার ইতিবউকে আদর মিশ্রিত ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরার।ইতিকা জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছে ইনানের বক্ষপিঞ্জরে।অপর দিকে ওয়াসিম ক্রুদ্ধ হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।ইনান হাত ইশারায় ওয়াসিমকে হেরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে।ওয়াসিম আর সেখানে দাড়ালো না।বাইক নিয়ে ছুটে চলে আপন গন্তব্য।

– ইতিবউ কাঁপছো কেন?তোমার কাঁপুনিতে আমার শরীরে যেন ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে।

– ছেড়ে দিন প্লিজ আপনার ছোঁয়া কেমন যেন।

– কেমন আমার ছোঁয়া?

– আপনাকে আমি প্রথম বার জড়িয়ে ধরেছি তাই।তাও আবার অপ্রতিভ অবস্থায়।

– প্রথমবার জড়িয়ে ধরেছো মেনে নিলাম।আর এই আলিঙ্গন যেন আমাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

ইতিকা প্রত্যুত্তর করলো না।ইনান তার মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।মেয়েটা কেমন যেন দিন দিন অগোছালো নুইয়ে যাচ্ছে ইনানের মাঝে।

_

গভীর রাতে ভিডিও কলে সুফিয়ার কান্না দেখতে ব্যস্ত অলীদ।সুফিয়ার ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নায় তেঁতে উঠে অলীদ।

– সমস্যা কি সুফু?অতীত কেন টানছিস?

– আমি ওয়াসিমকে ভুলতে পারছি না রে।

-তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি ওয়াসিম কু*ত্তাটার জন্য তোর চোখে আবার পানিও আসে।

– ইতিকা যখন ওয়াসিমকে জড়িয়ে ধরেছিল তখন আমার কেমন যে লেগেছিল সেটা শুধু আমি জানি।বিশ্বাস কর আমি মানতে পারছি না।যত যাই হোক ওয়াসিমকে আমি ভালোবাসি।

– তুই একা বাসিস ওয়াসিমতো আর বাসে না।এইসব বাদ দে সুফু ইনান জানলে আর রক্ষে থাকবে না।

– আমি কি করবো আমায় বুদ্ধি দে।

– তুই মর বেয়াদব মেয়ে।রাতবিরেত আমার ঘুম ভেঙ্গে পরপুরুষের জন্য কান্না দেখাতে এসেছিস। ফাউল মাইয়া।

অলীদ কথা শেষ করেই মুখের উপর ফোনটা কেটে দেয়।
#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৩]

________
স্কুলে ড্রেস পরে আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে ইতিকা।তার আজ মূল লক্ষ্য ইনানকে জব্দ করা।গত কয়েকদিন এই বাড়ির কোন দানাপানি মুখে তুলেনি সে।আর সবটা যে ইতিকার উপর রাগ দেখিয়ে করছে সেই বিষয়ে বেশ ভালোভাবে অবগত ইতিকা।ইতিকাকে বসে থাকতে দেখে বেশ রেগে গেলেন নাসরিন

– তোর সমস্যা কি? এইভাবে বসে পা দুলাচ্ছিস কেন?স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে।দ্রুত খাওয়ারটা শেষ কর।গরম গরম আলুপরোটা ঠান্ডা হলে ভালো লাগবে না।

– তোমার ছেলে কই আম্মা?

– আমার ছেলের দায়িত্ব কী এখন আমার হাতে নাকি?আমার ছেলেটাকে তো তোর ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছি।এবার সব ভালো মন্দ যা করার তুই করবি।

– কিন্তু তিনি আমার কোন কথাই রাখতে চায় না আম্মা।যদি আমি তার কথা না রাখি রাগ দেখিয়ে, জোর করে হলেও তা করিয়ে ছাড়বেন।

ইতিকা বিরক্ত মুখ নিয়ে কথা শেষ করলেও নাসরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়ে যায় সে।

-তুমি মুখ টিপে হাসছো কেন আম্মা?

– হাসবো না কেন?আমার ছেলেটা তার বাপের মতই হয়েছে।তার বাবাও এই কিসিমের ছিল।

– মানে?তোমারদের বিয়েটা….

ইতিকা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভেবেই থেমে গেলো।নাসরিন আবারো হেসে নির্দ্বিধায় বলতে থাকে।

– তোর শশুড়কে ভয় পাবো না কেন?এলাকার বড় ভাই ছিলেন।শহরে পড়াশোনা করতেন, মাঝে মাঝে গ্রামে যেতেন আর যখন যেতেন সব এলাকার মেয়ে ছেলেদের শাসন করে বেড়াতেন।সবার ভুল ধরতেন।সবাই তাকে যমের মতো ভয় পেতো আমিও পেতাম।একবার হুট করেই শুনি আমাদের বিয়ে দিন তারিখ ঠিক।আমার কোন মত না নিয়েই বিয়ে হয়ে গেলো।তারপর এই মানুষটার সাথে মানিয়ে নিতে আমার বড্ড কষ্ট হয়েছিল।গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।অবশ্য তিনি ছিলেন মিশুক প্রকৃতির আমার সবসময় যত্ন নিতেন।আমি ছিলাম ভীতু প্রকৃতির।আর এখন দেখ আমার কথার প্যাচে ফেলে তাকে কিভাবে ফাসাই।ধীরে ধীরে আমার ছেলেটাকেও কবজা করে দে দেখিনি।

নাসরিনের শেষ কথায় খিলখিল করে হেসে উঠে ইতিকা।

– তোমার ছেলেকে শাসন করবো তাও আবার আমি?আমাকে তুলে আছাড় দিবে।

কথাটা বলেই আবার হাসতে থাকে ইতিকা।

কাধের দুইপাশে দুটি বেনি পড়ে আছে।কপালের দিকটায় দুগাছি চুল লেপ্টে আছে।সাদার সাথে ছাই রঙা ইউনিফর্মটা যে তার সাথে মানানসই ভাবে এঁটে সেঁটে আছে সেটা কি বুঝতে পারছে ইতিকা?আর মুগ্ধ নয়নে ইনান উপর থেকে আড়ালে তাকিয়ে আছে শাশুড়ী বউমার দিকে।এদের ভাব দেখ মাঝে মাঝে ইনানের হিংসে হয়।কই ইতিকা তো কখনো তার সাথে এতটা মিশে হেসে খেলে কথা বলেনি।প্রতিবারি একটা ভীতু মুখ নিয়ে ইনানের সামনে এসেছে।

শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে নিচে নেমে এলো ইনান।একবার ঘড়ির দিকে আরেকবার ইতিকার দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলো সে।

– কয়টা বাজে?আপনি এখনো খাওয়ার শেষ করেন নি কেন?

– একসাথে খাবো বলে অপেক্ষা করছি আপনিও আসুন।

ইতিকা আর ইনানের কথার মাঝে উঠে চলে যান নাসরিন।তিনি জানেন এখন একটা হালকা পাতলা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।

– আমি খাবো না ইতিবউ।আপনি খেয়ে নিন আমাদের হাতে সময় কম।

– আম্মা আমি খাবো না, গেলাম।

ইতিকা নাসরিনের উদ্দেশ্য কথাটি বলে ঝটপট উঠে পড়ে।ইনান তার কান্ডে কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ করে।

– সমস্যা কি?কোথায় যাচ্ছেন?খাওয়ারটা শেষ করে তবেই উঠবেন।

– আপনি যেহেতু খাবেন না আমিও খাবো না

– আজ আবার নাটক শুরু করেছেন আপনি?

– নাটকের কী দেখলেন?

– ইতিবউ কথা বাড়াবে না খেয়ে নিন।

– আপনি খান আগে।

ইনান বিরক্ত হয়ে ইতিকার পাশে বসে যায়।আলুপরোটা হাতে নিয়েই বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখ বাঁকায়।

– সকাল সকাল এই তৈলাক্ত খাবার কেন খাচ্ছো তুমি?মা ইতিকার জন্য সালাদ করতে বলো।

ইনানের কথায় তেতে উঠলো ইতিকা।

– আমি আম্মাকে বলেছি খাবো তাই তিনি নিজের হাতে করেছেন।আপনিও খাবেন আমিও খাবো।

ইনান তর্ক করলো না একটুকরো পরোটা মুখে তুলে ইতিকার দিকে তাকালো।

– একা একা খাচ্ছো কেন ইতিবউ?আমাকেও খাইয়ে দিতে পারো।

তৎক্ষণাৎ ইতিকার বিষম উঠে।কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা।ইনান তাড়াহুড়ো করে হাটু মুড়িয়ে বসে ইতিকার পাশে।পানির গ্লাস নিয়ে মুখে পানি তুলে দেয়।মিসেস নাসরিন এগিয়ে আসতে গিয়েও থেমে যান।ছেলে আর ছেলের বউকে দেখে তিনি মুচকি হেসে সরে যান।

– ইতিবউ এত তাড়াহুড়ো করে কেন খাচ্ছেন?

– আপনি কি বললেন?আপনার কথায় আমার বিষম উঠেছে।

– এই কথায় আপনার বিষম উঠেছে?হাউ ফানি।

ইতিকা জবাব দিলো না।ইনানের ফোন আসায় সে কিছুটা আড়ালে সরে আসে।

– হ্যা রাতুল বল।

– ‘ওয়াসিম হাসনাত’ আপনি যার ছবি দেখিয়েছিলেন আমায়।ওনি আজ সকাল থেকে ইতিকার ক্যাম্পাসের আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন।

– তুমি শিওর লোকটা ওয়াসিম?

– পাক্কা শিওর।আপনার হোয়াটসঅ্যাপে আমি একটা ছবি পাঠিয়েছি লোকটার, চেক করুন।আমার মনে হচ্ছে সে ইতিকাকে খুঁজতে এসেছে।

– হ্যা তার মূল উদ্দেশ্য এটাই।ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোমায় রাতুল।

– শুকরিয়া ভাইয়া।

ইনান ফোন কেটে মোবাইলে কিছু একটা চেক করতে থাকে।ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে এগিয়ে আসে ইতিকার দিকে।

– আমার একমাত্র ছোট বউ!ইতিবউ আমার কিছু কথা ছিল।

ইনানের কথার সুর পালটে গেছে।অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে ইনান।ইতিকা পরোটা হাত থেকে রেখে ইনানের দিকে চোখ তুলে তাকায়।

– হ্যা বলুন।

– রুমে আসুন।

– স্কুলে যাবো না?দেরি হয়ে যাচ্ছে।প্রথম পিরিয়ডে আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।

– বিবাহীত মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস স্বামীর ক্লাস।সব ক্লাস বাদ আজ আপনি আমার ক্লাস করবেন।

কথা শেষ করেই ঝটকায় ইতিকার হাত টেনে দাঁড় করায় ইনান।মেয়েটিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে টানতে টানতে উপরে নিয়ে যায়।

.

অকস্মাৎ একটা মানুষের ভাব পালটে যায় কি করে ভেবে পায় না ইতিকা।ইনান তাকে রুমে ডেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।তার বেনুনির চুল গুলো ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে চুলের ঘ্রাণে মত্ত সে।ইতিকা গুটিয়ে চুপচাপ বসে আছে ভূতগ্রস্ত হয়ে।

– আ..আপনি এমন করছেন কেন?

– কেমন করছি ইতিবউ?

– কেমন যেন মাতাল মাতাল।

– যেখানে আপনি আমার জীবনে মাদকময় নেশা ছড়িয়ে রেখেছেন, সেখানে আমি একটু নেশা করে মাতাল হলে দোষের কি?

– এসব কি কথা বলছেন আবল তাবল?আমাকে স্কুল যেতে দেন নি কেন?

– দুঃখিত বউ এক্সামের আগে আপনার স্কুল যাওয়া বন্ধ।

ইনানের কথায় নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় ইতিকা।রাগ দেখিয়ে বাঘিনীর ন্যায় বুলি ফোঁটায় মুখে।

– মানে?

– কেন বুঝেন নি?সোজাসাপটা বলেছি।

– আমার ভালো লাগছেনা আপনার এইসব নাটক।

ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।পেছেন ঘুরে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফোন চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।ইতিকা রাগ দেখিয়ে ইনানের পিঠে ঘুষি মারতেই তীব্র ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে সে।
ইনানের আর্তনাদের থতমত খেয়ে যায় ইতিকা।

– কি হয়েছে আপনার?

– কিছু না।

– মিথ্যা বলছেন কেন?আমাকে দেখান আপনার কি হয়েছে?

– কিছু না ইতিবউ সরে যান।

ইনান পালিয়ে বাঁচার জন্য উঠে দাঁড়ায়।দ্রুত রুম থেকে বের হতে নিলেই ইতিকা তাকে বাধা দেয়।একে একে শার্টের সবকটা বোতাম খুলে পিঠের দিকে তাকাতেই আতঁকে উঠে।
কালশিটে দাগ ইনানের পিঠে ছড়িয়ে আছে।

– এসব কি করে হলো?

– সেদিন বাইকের ব্রেকে সমস্যা হচ্ছিল কিছুতেই কাজ করেনি।অতঃপর ছোট খাটো এক্সিডেন্ট।

– আমায় বলেননি কেন?

– আপনাকে কি বলবো ইতিবউ?আপনার চিন্তায় আমার রাতদিন সবটা এক হয়ে যাচ্ছে।অথচ আপনি আমায় পাত্তাই দেন না।

ইতিকা জবাব দিলো না চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ইনানের পিঠের কালশিটে দাগের দিকে।

– একটা কথা বলবো ইতিবউ?

– বলুন

– চলো না আমরা স্বাভাবিক ভাবে সংসার শুরু করি। প্রমিস করছি তোমায় কখনো কষ্ট দেবো না।
– বাবার ব্যবসায় হাত লাগান আর রাজনীতি ছেড়ে আসুন। পারবেন?

ইতিকা এমন একটা শর্ত দেবে স্বপ্নেও ভাবেনি ইনান।ইনান রাগ দেখিয়ে ইতিকার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।হঠাৎ কি মনে করে ইতিকার কোমড় টেনে এনে তার সাথে মিশিয়ে নেয়।বন্দী করে তার বাহুডোরে।

– ইতিবউ তুমিও আমার হবে।আর রাজনীতিও আমার জীবনে থাকবে একদম সমান সমান ভাবে।
___

ভার্সিটি ক্যাম্পাসে সুফিয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াসিম।সুফিয়া নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলেও জোর খাটালো না।ওয়াসিম তো তার ভালোবাসার মানুষ হোক সেটা একপাক্ষিক।

– প্লিজ সুফু তোর কথা ইনান শুনবে ইতিকাকে ছেড়ে দিতে বল।

– তুই পাগল হয়ে গেছিস?যে ছেলে ইতিকার জন্য বহু বছরের পুরোনো ফ্রেন্ডকে অপমান কর‍তে ছাড়েনা সে কী না ইতিকাকে ছাড়বে?

– আমি এত কথা জানতে চাই না ইতিকাকে আমার চাই।প্লিজ সুফিয়া তুই অন্তত আমার সঙ্গ দে।

সুফিয়া ঠোঁট বাকিয়ে বিশ্রি ভঙ্গিতে হাসে।

– একটা এডভাইস দিচ্ছি তোকে।ইতিকার কথা ভুলে অন্য কাউকে বিয়ে করে নে।আমাকেও করতে পারিস তোকে আগেও প্রপোজ করেছিলাম রাজি হলি না।

সুফিয়ার সিরিয়াস মুডের কথায় তেতে উঠলো ওয়াসিম।ইনানের উপর সব রাগ যেন হুট করেই সুফিয়ার উপর চড়ে উঠেছে।কোন দ্বিধাবোধ ছাড়াই ইতিকার গালে বেশ জোরেই থাপ্পড় মারলো ওয়াসিম।
লাহমায় স্থির নয়ন যুগলে সিক্ত নোনা জলে ভরে গেছে।ওয়াসিম বিনাবাক্য স্থান ত্যাগ করে।

কয়েক মিনিট পর অলীদ সুফিয়ার সামনে দাঁড়ায় আগুনের চুল্লির মতো মুখ করে।

– কাজটা ভালো হলো না সুফিয়া।

অলীদের স্থির কন্ঠ।

– কি করেছি আমি?

– তোর বেহায়াপনার জন্য ওয়াসিমের হাতে চড় খেয়েছিস।আমি আংকেলকে সবটা জানিয়ে দিয়েছি।তিনি আসছেন।

অলীদের কথায় মুষড়ে উঠে সুফিয়া।

– তুই পাগল হয়ে গেছিস?বাবাকে কেন বললি সবটা?বাবা আমায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে।তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন আমায় কোন উচিলায় দেশের বাইরে পাঠানোর।এবার কি হবে?আমায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে অলীদ তুই এটা কি করলি?

– আমি সবটা জেনে বুঝে করেছি।দেশের বাইরে চলে যা পড়াশোনা কর মাথা থেকে কুবুদ্ধি ঝেরে ফেল।

– আমি যাবো না।
– যেতে তোকে হবেই।

#চলবে…

]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here