আগন্তুক🍁
চতুর্থ পর্ব
মিহি
বাড়ির সামনে আসতেই একটা ছোটখাটো জটলা লক্ষ করল আদৃত। ব্যস! সে যা ভেবেছিল তা-ই বুঝি সত্যি হলো। ভেতর থেকে অশ্লীল ভাষায় তন্বীর চিৎকারের শব্দ আসছে। আদৃত ভয়ে কুঁচকে যাচ্ছে। আদিরার অবস্থা ভাবতেই গা যেন আরো শিউরে উঠলো তার। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ভেতরে ঢুকতেই আদৃত দেখল আদিরা মেঝেতে হাঁটু ভাঁজ করে বসা। আদিরাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের মহিলারা নানান রকম প্রশ্ন করে যাচ্ছে। মেয়েটা উত্তর দিতে পারছে না। কি উত্তর দিবে সে? তার তো এমনিতেও এখানে আসার ইচ্ছে ছিল না। আদৃত নিয়ে এসেছে তাকে। সবাইকে সামনে থেকে সরিয়ে আদিরার হাত ধরতেই কেঁদে ফেলে আদিরা। এত অপরিচিতের মাঝে আপন সুগন্ধ তাকে যেন দুর্বল করে দিল,অনবরত চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। আদৃত কি করবে বুঝছে না। আদিরাকে সামলাবে নাকি আশেপাশের লোকজনদের সব বলবে? দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে তন্বী। তাচ্ছিল্যের এ হাসিটার সাথে পরিচিত ছিল না আদৃত। তন্বীর মুখে আজ প্রথম দেখছে সে এই হাসিটা। খালাম্মা এসে আদিরাকে একপাশে বসিয়ে পানি দিলেন। আদিরা খেল না,চুপ করে জড়সড় হয়ে বসে রইল। ” আদৃত বাবা,এসব কি? তন্বী পালিয়েছে,ভুল করেছৈ মানছি তাই বলে তুমি দুসপ্তাহ না যেতেই আরেকজনকে বিয়ে করে এনেছো? করতেই পারো কিন্তু আমাদের জানাতে পারতে। আমরা তো মানা কিংবা নিষেধ করতাম না। আমরাও চাই দুজন যার সাথে ভালো থাকবে তার সাথেই থাকুক। ” একনাগাড়ে কথাগুলো শেষ করলেন ভদ্রমহিলা। আদৃত মাথা নিচু করে বলল,”আমি বিয়ে করিনি খালাম্মা,মেয়েটা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। ওকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা আমি নিয়েছি তাই রাস্তায় ফেলে আসতে পারিনি।” আদৃতের কথা শেষ না হতেই এক প্রতিবেশী বলে উঠেন,”ছিঃ ছিঃ! তাই বলে বিয়ে না করে এক ছাদের নিচে রাত কাটাবে! সমাজটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। ” বরাবরের মতো শান্তশিষ্ট আদৃতের মুখে হঠাৎ আজ একটা প্রতিবাদী বাক্য শোনা যায়,” এক ছাদের নিচে থাকা মানেই কি সম্পর্ক স্থাপন? আপনি যদি বিপদে পড়তেন আর একটা ছেলে আপনাকে বাড়ি নিয়ে আসত তো তার মানেই কি তার সাথে সম্পর্ক আছে আপনার? ঐ ছেলেটাই যদি আপনাকে ফেলে আসত পরবর্তীতে আপনিই বলতেন ছেলেটা ভালো না। ” মহিলাটি চুপ হয়ে গেলেন। আদৃতের মুখের উপর আর একটা বাক্য উচ্চারণ করার সাহস অবধি কেউ পেল না। চুপচাপ বেরিয়ে গেল। তন্বী দেখছে আদৃতকে,অদ্ভুত চোখে। আজ নতুন এক আদৃতকে উপলব্ধি করেছে সে। যে আদৃত কোনদিন উচ্চস্বরে কথা বলেনা,সে আজ গুরুজনদের সাথে এমন রাগী গলায় কথা বলল? এই আদিরা মেয়েটার জন্য? কেন? আদিরার সাথে কি সম্পর্ক আদৃতের? প্রশ্নগুলো যন্ত্রণা দিচ্ছে তন্বীকে। প্রথমবারের মতো আদৃতকে নিয়ে মনে মনে হিংসা হতে থাকে তন্বীর। অধিকারবোধ জিনিসটা আজ প্রথম উপলব্ধি হয় তার। আদৃত আগের মতো শান্ত ভঙ্গিতে তন্বীর সামনে এসে দাঁড়ায়। “কি দরকার আপনার?” আদৃতের মুখে আপনি ডাকটা আরো পীড়া দেয় তন্বীকে। কথা যেন গলায় এসে বিঁধে যায় তার। “আ…আমার ডিভোর্স পেপারে সাইন লাগবে। কল করেছিলাম তোমায়,কল ধরোনি।” আদৃত হাসে,তাচ্ছিল্যের হাসি। “এত তাড়া ছিল মিসেস.তন্বী? কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরতে পারলেন না? ” ড্রয়ার থেকে ডিভোর্স পেপারটা বের করে আদৃত। অন্য সময় হলে হয়তো আদৃত কখনোই সাইন করত না পেপারে। পারলে তন্বীকে বোঝাত কিন্তু আজ সবকিছু যেন তার স্বভাবের বিপরীত গতিতে চলছে। তড়িৎ গতিতে পেপারে সাইন করে দিয়ে তা তন্বীর মুখের উপর ছুঁড়ে মারল আদৃত। আদৃতের থেকে এতটা অপমান বুঝি কখনো হয় নি তন্বী। পেপারগুলো নিয়ে আদিরার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় তন্বী। অতঃপর আদৃতের দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেল তন্বী।
“শুভ্র! এই শুভ্র! কই মরলি রে!” আজমিরা বেগম চেঁচিয়ে চলেছেন। আগে শুভ্রকে চাঁদবাবা ছাড়া ডাকতেন না,এখন শুভ্রকে অকারণে গালি দেন। কারণ? ঐ যে এখন অবধি আদিরা মেয়েটাকে রাস্তা থেকে সরাতে পারেনি। শুভ্রও কেমন যেন হয়ে গেছে। সিগারেট ছাড়া থাকতে পারে না,মদের নেশায় যেন উন্মত্ত হয়ে ওঠে রাত-বিরাতে। শুভ্রর অন্ধকার ঘেরা মস্তিষ্ক শুধু আদিরাকে খোঁজে,আদিরার হাসি,আদিরার শাসন,আদিরার কান্না সবকিছু। শুভ্র কি তবে আদিরার প্রেমে পড়ল? না!এটাকে প্রেম বলা চলে না।
প্রেম আর ভালোবাসা দুটি আলাদা বিষয়। প্রেমকে কখনোই ভালোবাসা বলা চলে না আর না ভালোবাসাকে প্রেম বলা চলে। শুভ্র কি তবে ভালোবেসে ফেলল আদিরাকে? আমরা এমনই। কাছে থাকতে ভালোবাসার মূল্য বুঝিনা,বারবার চেষ্টা করি তাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার। অথচ যখন সে দূরে চলে যায়,তাকে ফেরানোর জন্য ছটফট করতে থাকে মন। ভালোবাসার এ কেমন মায়া? সময় থাকতে কেউ বোঝে না।
শুভ্র,ফর্সা চেহারাটা মুর্ছে গেছে। মায়াবী চোখটা কেমন হিংস্র হয়ে উঠেছে। রক্তিম চোখজোড়া দেখলে আজকাল শুভ্রর নিজেরই ভয় লাগে। রাতের অন্ধকার ক্রমশ দিনের আলোকে গ্রাস করছে আর শুভ্রর মনটা গ্রাস করছে আদিরার অনুপস্থিতি। ” নাহ! যে করেই হোক,মায়ের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আমি আদিরাকে পড়তে দিব না। ” ফোন হাতে নিয়ে কয়েকটা কাপড় ব্যাগে ঢুকিয়ে সবার অলক্ষে বাড়ি থেকে বের হয় শুভ্র। আদিরার নম্বরে কল করে যাচ্ছে শুভ্র। রাতের এই আঁধারকে সাক্ষী রেখেই আদিরাকে নিয়ে এক নতুন দিনের সূচনা করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শুভ্র।
” আদিরা,ফোন বাজছে। ” আদিরা নিশ্চুপ,সে সকাল হতেই নিশ্চুপ। পানির গ্লাসটা এখনো টেবিলে পড়ে আছে অথচ তা হাতে ধরেও দেখছে না আদিরা। আদিরাকে কি বলবে সেটা ভাবতেও বেশ ভাবনায় পড়তে হচ্ছে আদৃতের। আদিরা বেশ কিছুক্ষণ পর ফোন তুলল।
–আদিরা! আমি শুভ্র! কোথায় তুমি? তুমি ঠিক আছো তো?
–আমি যেমনই থাকি,তোমার পাঠানো লোক আমায় মারতে পারেনি।
–আদিরা,ভুল বুঝ না আমায়। তোমায় খুব ভালোবাসি আমি। ফোনে সব বলতে পারব না। কোথায় তুমি?
–কেন? আবার লোক পাঠাবেনারার জন্য?
–আদিরা! বিশ্বাস করো আমি তোমায় ভালোবাসি। পায়ে পরি তোমার প্লিজ! আমাকে একটা সুযোগ দাও সব এক্সপ্লেইন করার।
–পারছি না। মাফ করেন।
কল কেটে ফোন সুইচড অফ করে দিল আদিরা। আদৃত এসে পানির গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল। আচমকা আদৃতের হাত চেপে ধরল আদিরা। আদৃত চমকে উঠল কিন্তু সরিয়ে নেওয়ার সাহস পেল না। আদিরার মানসিক অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে আদৃতের সামান্য একটা অবহেলা আদিরার মন ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে।
শুভ্র ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছে কি করবে। ফোন ট্র্যাকিংয়ের বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই বন্ধুকে কল করে ব্যবস্থা করে রাখে। অতঃপর কাজী অফিসের দিকে এগোতে থাকে। কাজী অফিসে প্রত্যহ থাকে এমন লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে যা তথ্য পায় তাতে আদিরাকে শেষবারের মতো কাজী অফিসের সামনেই দেখা গেছে। অতঃপর কয়েকটা ছেলে আদিরাকে তাড়া করে। কিছু করে ওঠার আগেই তারা চোখের আড়াল হয়। আদিরার নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে আসতে থাকে শুভ্রর। আদিরা কোন খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো না তো? অনিচ্ছাসেত্ত্বও শুভ্রর মন বারবার খারাপ বিষয়গুলোর প্রতিই ইঙ্গিত করছে। সৌভাগ্যক্রমে সেদিনের গুন্ডাদের মধ্যে একজনকে পায় শুভ্র। অনেক ধমকানোর পর ছেলেটা বলল একটা পার্ক অবধি আদিরাকে ফলো করার পর আর ওরা তাকে খুঁজে পায়নি। শুভ্রর রাগ হচ্ছে এখন,মারাত্মক রাগ। রাগের মাথায় ছেলেটার নাক বরাবর ঘুষি মারে শুভ্র। ছেলেটা কটমট করে তাকায় শুভ্রর দিকে কিন্তু কিছু করার সাহস পায় না। বাঁকা চোখে তাকিয়ে সে চলে যায় সেখান থেকে। শুভ্র সেখানেই বসে চিৎকার করতে থাকে। আশেপাশের সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে।
চলবে…