#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ২৪
ঠোঁটে লম্বা হাসি টেনে রেখে দ্রুত পদে নিজের ছেলের ক্যাবিনে প্রবেশ করেন আরহান সাহেব।তার তাড়াহুড়ো এমন যেনো নিজের পুত্রের দেখা পেতে এক লহমার বিলম্বও মানতেও নারাজ তিনি।কত বছর পর নিজের ছেলের দেখা পাবেন তিনি,ভেবেই আবেগে পূর্ণ হয়ে আছে তার হৃদয়।একরাশ উত্তেজনা,আনন্দ,উৎফুল্লতা নিয়ে নিজের ছেলের ক্যাবিনে প্রবেশ করলেও মুহূর্তেই ঠোঁটের হাসিটি অস্তিত্ব হারায় আরহার সাহেবের।আশায় ছিলেন ছেলের দেখা পাবেন।কিন্তু দেখা পেলেন রিয়াদ ও অফিসের দু’জন স্টাফের।স্টাফ দু’জন আফিমের ক্যাবিন পরিস্কার করায় ব্যস্ত।আর রিয়াদ এক কোণে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করছে।এই ছেলেটা এমনই।আফিমের অনুপস্থিতিতে আফিমের সবকিছুর দায়িত্ব সে স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে নিবে।তাতে থাকবে তার শ্রম,নিষ্ঠা ও ভালোবাসা।ছেলেটা যেনো আফিমের ছায়া।আবার আফিমের ঢাল ও।নিজে জান দিয়ে দিবে কিন্তু তার নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আফিমকে কিভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়।
রিয়াদের এসব গুণাবলী সমন্ধে খুব ভালোভাবে অবগত আরহান সাহেব।তিনি জানেন আফিমের ছায়ার নাম ‘রিয়াদ’।তিনি ঠোঁটে হাসি টেনে এগিয়ে যান রিয়াদের দিকে।বলে ওঠেন,
-হেই ইয়াং ম্যান,কি খবর?
আরহান সাহেবের কন্ঠস্বর কানে আসতেই তার দিকে তাকায় রিয়াদ।তাকাতেই ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তোলে সে।আরহান সাবেহের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে সেও বলে ওঠে,
-আসসালামু আলাইকুম স্যার,সো গ্লাড টু সি ইউ!
রিয়াদের কথা খানা শেষ হতেই আরহান সাহেব বুকে জড়িয়ে নেন রিয়াদকে।বলে ওঠেন,
-বদলাওনি রিয়াদ!সেই তোমার যখন ১৩ বছর বয়স তখন তোমায় আমার ছেলের সঙ্গী হওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলাম।আর এই ১৫ বছরে আমার ছেলের সঙ্গী হওয়ার পাশাপাশি তার ছায়াতেও পরিণত হয়েছো।
আরহান সাহেবের কথায় মৃদু হাসে রিয়াদ।বলে ওঠে,
-এমন কিছু না স্যার।আফিম স্যার আমার দায়িত্ব ও ভালোবাসা দুটোই।তাই তিনি সম্পর্কিত সব কিছুই সামলে রাখা আমার কর্তব্য।
-দেখতেই পারছি।চাইলেই পারতে স্টাফদের কাজের আদেশ দিয়ে নিজে গিয়ে নিজের ক্যাবিনে বসে আরাম করতে।কিন্তু না, তা না করে দাঁড়িয়ে এদের কাজ পর্যবেক্ষণ করছো যাতে ভুলেও কোনো ভুল না হয় বা আফিমের ক্যাবিনে থাকা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফাইল,কাগজ-পত্র যেনো কোনো ভুল মানুষের হাতে না লাগে।একেই বলে দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করা।
আরহান সাহেবের কথায় ঠোঁটে হাসি টেনে নেয় রিয়াদ।বলে ওঠে,
-ধন্যবাদ স্যার।
-তা তোমার বস আমার একমাত্র অ্যাংগ্রি ইয়াং ম্যান কোথায়?
-স্যার একটু কাজে বাইরে গিয়েছেন।আজ রাতে হয়তো ফিরবেন না।
মুহূর্তেই ঠোঁটের হাসি গায়েব হয়ে যায় আরহান সাহেবের।ব্রুদ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে তিনি বলে ওঠেন,
-মানে?আধ ঘন্টা আগে তোমাকে কল দিয়ে জানিয়েছিলাম না আমি?তখন তো বললে ও অফিসে।তাহলে আমি আসবো শুনেও ও আমার সাথে দেখা না করে চলে গেলো কেনো?
-আসলে স্যার,আপনার সাথে কথা হবার পর আমি স্যারের ক্যাবিনে এসে দেখি স্যার নেই।তাকে আমি খবরটা দেওয়ার আগেই স্যার কাজের জন্যে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন।
-কোথায় আর কোন কাজে গিয়েছে?
-তা তো স্যার আমায় সঠিক জানিয়ে যায়নি তবে হয়তো কোনো ইমপোর্টেন্ট ক্লাইন্টসের সাথে মিটিং এ গিয়েছেন।
-মিথ্যে বলছো রিয়াদ।কারণ আফিমের খবর আফিমের থেকেও তুমি বেশি রাখো।এতো বছর দেশে ছিলাম না কিন্তু নিজের ছেলের খবর ঠিকই রাখতাম।আর সেজন্যই আমি জানি আফিমের কোনে কিছু সমন্ধেই তুমি অজানা নও।
আরহার সাহেবের কথার বিপরীতে নিজের পক্ষে বলার জন্যে যথাযথ কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না রিয়াদ।কারণ আরহান সাহেব যা বলেছেন তার একটি শব্দও মিথ্যে নয়।রিয়াদ ভালো করেই জানে আফিম তার ফার্মহাউসে গিয়েছে।যদিও আফিম তাকে বলে যায়নি তবুও আফিম কখন কি করে না করে তা সমন্ধে এক স্বচ্ছ ধারণা আছে তার।কোনো মতে এ মুহুর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবার জন্যে রিয়াদ বলে ওঠে,
-আমি মিথ্যে বলছি না স্যার।আফিম স্যার আসলেই আমাকে কিছু বলে যাননি।তবে আপনি প্লিজ বাসায় গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিন ততক্ষণে আমি আফিম স্যারকে আপনার দেশে ফিরবার খবর জানানোর ব্যবস্থা করছি।
রিয়াদের কথার ভঙ্গিতে আরহান সাহেবের কেমন যেনো একটু সন্দেহ হচ্ছে।সন্দেহ হচ্ছে এই নিয়ে যে ছেলেটা হয়তো তার থেকে কিছু লুকচ্ছে।নিজের সন্দেহ টিকে নিজের মাঝে চেপে রেখে আরহান সাহেব রিয়াদের কাঁধে হাত রেখে বলে ওঠেন,
-দ্রুত নিজের স্যারকে আমার সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থা করো রিয়াদ।১৫ বছরের অপেক্ষা এবার শেষ করতে চাই।
কথাখানা বলেই উদাস মনে স্থান ত্যাগ করতে অগ্রসর হন আরহান সাহেব।
এদিকে চুপচাপ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ।কি করে আফিমকে বুঝাবে সে!কি করে আটকাবে পিতাপুত্রের শুরু হতে চলা যুদ্ধকে।
!!
অচেনা এক প্রকৃতিতে ঘেরা জায়গা।যেখানে অভাব নেই সবুজ-শ্যামল গাছপালার।মাঝে একটি এক তলা বড় বাড়ি দেখতে পায় নাফিয়া।সাদা রঙের বাড়িটা যেকেউকে মুগ্ধ করতে সক্ষম।স্বাভাবিক সময় হলে হয়তো মুগ্ধ হতো সে নিজেও।কিন্তু এখন সে যে পরিস্থিতিতে আছে সেখানে মুগ্ধতার বালাই নেই।বরং ভয়ে চুপসে আছে মেয়েটা।
হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে বাড়িটির সামনে এসে থামে আফিম।গাড়ি থামিয়ে তা হতে বেরিয়ে আসে সে।নাফিয়ার কাছে গিয়ে গাড়ির গেইট খুলে আবারও মেয়েটার হাতের কব্জি চেপে ধরে।শক্ত করে মেয়েটার হাত আঁকড়ে ধরে বাড়ির ভেতরের দিকে অগ্রসর হয় ছেলেটা।
হাতে ব্যথা অনুভব করছে নাফিয়া।তবুও মুখে কিছু বলার সাহস যোগাতে পারছে না সে।মনে হাজারো প্রশ্নেরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে তার।
আফিম বাড়িতে প্রবেশ করতেই ২-৩ জন গৃহপরিচারিকারা এগিয়ে আসে তাকে সালাম দিতে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার পূর্বেই ভয়ে চুপসে যায় তারা।আফিমের চোখ-মুখে তার রাগ স্পষ্ট ফুটে আছে।সেই সাথে তার পায়ের গতি যেনো ঝরের ন্যায়।ছেলেটা বাড়িতে ঢুকে সোজা নাফিয়াকে নিয়ে প্রবেশ করে নিজ কক্ষে।কক্ষের ভেতর প্রবেশ করেই ছেড়ে দেয় নাফিয়ার হাত।গতি জড়তার প্রভাবে তাল সামলাতে একটু সমস্যা হয় নাফিয়ার।তবে সে সামলে নেয় নিজেকে।তাকিয়ে রয় আফিমের মুখ পানে।
নিজের মাঝে ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করছে আফিম।অসহ্য লাগছে তার।মুহূর্তের মাঝেই যেনো তার সবকিছু উল্টে-পাল্টে গিয়েছে।অতীতের পুরোনো ক্ষত গুলো হৃৎপিণ্ডে যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে।আফিম বুঝে উঠতে পারছে না এই যন্ত্রণার অন্ত কোথায়!দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে বিছানায় বসে পড়ে সে।এতোক্ষণ রাগে চোখ লাল হয়ে ছিলো ছেলেটার আর এখন হৃৎপিণ্ডে হওয়া অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ জ্বলতে আরম্ভ করেছে।যন্ত্রণাগুলো যেনো এবার তীব্র আবেদন জানাচ্ছে অশ্রুর মাধ্যমে বেরিয়ে আসার।
এমন সময়ই হটাৎ নিজের হাতে কারো নরম হাতের স্পর্শ অনুভব করে আফিম।কেউ একজন তার সামনে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে কপাল থেকে তার দু’হাত সরিয়ে নিজের দু’হাত দ্বারা তার গাল আঁকড়ে ধরেছে।আফিম চোখ তুলে সেই মানুষটির দিকে তাকায়।দেখা পায় এক মায়াভরা মুখশ্রীর।যে মুখে স্পষ্ট দুঃখ ফুটে আছে।তার যন্ত্রণা তার সামনের এই মানবীটিকেও যে যন্ত্রণা দেয় তা বুঝতে কষ্ট হলো না আফিমের।
নাফিয়া এগিয়ে গিয়ে আফিমের কপালে আলতো করে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দেয়।ক’সেকেন্ড ঠোঁট খানা আফিমের কপালে ঠেকিয়ে রাখবার পর একটু সরে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আফিমকে।বলে ওঠে,
-আপনার কষ্ট হচ্ছে আফিম?আমারও হচ্ছে।আদর করলে না কষ্ট কমে যায়?আমি আদর করলে আপনার কষ্ট কমবে?
!!
আফিমের ক্যাবিন পূর্বের ন্যায় পরিপাটি করে তার ক্যাবিন হতে বেরিয়ে আসে রিয়াদ।মাথায় তার এখনো এটিই চলছে যে কিভাবে আফিমকে স্বাভাবিক থাকার জন্যে বুঝাতে সক্ষম হবে সে।এসব ভাবতে ভাবতে নিজের ক্যাবিনের কাছে যাওয়ার পথে হুট করে কারো সাথে ধাক্কা লাগে রিয়াদের।সাথে সাথে কানে আসে কারো ধপাস করে মেঝেতে পরে যাওয়ার শব্দ।মেঝের দিকে তাকাতেই রিয়াদ দেখতে পায় কুসুমের ব্যথীত মুখশ্রী।মেয়েটা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ব্যথা সংবরণ করার চেষ্টা করছে।এরই মাঝে হটাৎ করে কয়েকজনের হাসির শব্দ কানে আসে রিয়াদের।কুসুমের পড়ে যাওয়া দেখে অফিসের কয়েকজন স্টাফ কোনোক্রমেই নিজের হাসি থামাতে পারছেন না।সাথে সাথে মেজাজ বিগড়ে যায় রিয়াদের।রাগে চেচিয়ে বলে ওঠে,
“স্টপ স্টুপিডস”
রিয়াদের কথাগুলো কানে আসতেই সবার হাসি বন্ধ হয়ে যায়।উক্ত কথাখানা বলে আর দাঁড়ায় না রিয়াদ।কোলে তুলে নেয় কুসুমকে।এগিয়ে যায় নিজের ক্যাবিনের দিকে।
চলবে।