আবর্তন পর্ব ৯+শেষ

#আবর্তন
#তাজরীন_খন্দকার
#পর্বঃ০৯_অন্তিম

আমার করা তিনটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তাহলে একদম পাক্কা মাফ করে দিবো প্রমিজ!

চন্দ্রার কথা শুনে অরুণ স্বাভাবিক চেহেরায় বললো,
___ আচ্ছা মাফ না করলে নাই। তাছাড়া বিয়ের পরে বউকে ছোঁয়া জায়েজ আছে ! ঘুমালাম আমি ।

বলেই অরুণ বালিশে মাথা রাখলো।

কিন্তু চন্দ্রা জোর গলায় আবার বললো,
___ তাহলে বিয়ের পরেরদিন বউকে ডিভোর্স দেওয়ার হুমকির জায়েজনামা কোথায় পেয়েছিলেন?

অরুণ চন্দ্রার কথা শুনে আবার উঠে বসলো জোরে দুবার নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
___ ওকে, তাহলে একটা সুযোগ দিচ্ছি। তুমি তিনটা প্রশ্নের যে কোনো একটা প্রশ্ন করবে।কারণ আমি শুধু একটা প্রশ্নেরই জবাব দিবো।

___ সত্যি তো?

___ হ্যাঁ একদম সত্যি। কিন্তু যে কোনো একটা প্রশ্ন!

চন্দ্রা একটু ভেবে বললো,

___ আমাকে পাওয়ার জন্য আপনি এই পর্যন্ত কি কি করেছেন?

এই প্রশ্ন শুনে অরুণের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। সে এদিকে ওদিক তাকিয়ে বললো,
___ এটা তো একের ভেতর সব! এমন প্রশ্ন মানিনা।
মানবোনা!

___ অবশ্যই মানতে হবে! আপনি বলেছেন যেকোনো একটা প্রশ্নের জবাব দিবেন। আর মনে করেন এটা একটা রচনামূলক প্রশ্ন। তাই কোনো চালাকি না করে পটাপট প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে দেন।

অরুণ কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে নিচে তাকিয়ে রইলো। তারপর মাথা তুলে বলতে লাগলো..

___ মনে আছে সেদিন তোমার ভাড়া করা মেয়েটা যখন আমার সম্পর্কে এতো এতো বাজেকথা বলছিল, তার মধ্যে সবার সামনে তুমি কেঁদে কেঁদে বলেছিলে আমার মুখ দেখতে চাওনা। তখন শুধু তুমি নও, আমার পরিবারের লোকজনও বলেছিল আমার মুখ দেখতে চায়না। কিন্তু আমি তখনই পণ করেছি বিয়ে ভাঙার পেছনে যে কোনো কারণই থাকুক আমি তোমাকেই আবার সসম্মানে বিয়ে করবো। কারণ আমি যতই প্রমাণ করি আমি নির্দোষ, কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করতে গেলে নিন্দুকেরা কথা তুলবেই আমার বউ বাচ্চা ছিল এবং এর জন্য আগে একটা বিয়ে ভেঙেছে। তাই সেদিন থেকেই আমার একটা কাজ ছিল নিজেকে সবার কাছ থেকে নির্দোষ প্রমাণ করা। কয়েকদিনে তুমিও হয়তো দেখেছো আমার পরিবার আমাকে কতো ভালোবাসে, হ্যাঁ সত্যিই ভালোবাসে কিন্তু সেইদিনের ঘটনার পরে আমার সাথে কতো রূঢ় ব্যবহার করতো সেটা নিজ চোখে দেখলে তোমারও বুকে আগুন জ্বলতো!

বলেই অরুণ একটু থামলো।
চন্দ্রার চোখে পানি ছলছল করছে। সে আস্তে আস্তে বললো,
___ ওই মেয়েটার মাকে কীভাবে খুঁজে পেয়েছেন আমি সেটা দরজার আড়াল থেকে শুনেছিলাম। কিন্তু সবকিছুর পেছনে যে আমি সেটা কীভাবে জেনেছেন? জেনে কেন বিয়ে করলেন?

অরুণ হাসলো আর বললো,
___ওই মহিলাকে আমিই শিখিয়ে এনেছিলাম, যেন তোমার বাবার সামনে সত্যটা না বলে। কিন্তু ওই মহিলা এটা অবশ্যই জানতো এই বিয়ে ভাঙার পেছনে সম্পূর্ণ হাত এই বিয়ের পাত্রীরই ছিল। সেটা শোনার পরে আমার অবস্থা কেমন হয়েছিল জানো? আমি দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার সামনে সবকিছু চক্রাকারে ঘুর্নায়মান অবস্থায় দেখছিলাম। ভেতর থেকে বারবার উত্তর আসছে,চন্দ্রা এটা করতে পারেনা। তারপর নিজেকে বুঝালাম, আমাকে এর সম্পূর্ণ সত্যিটা জানতে হবে। কেন সে এমন করলো!
তারপর তোমার এক বান্ধবীর খোঁজ নিলাম, তার সাথে কথা বলে জানলাম রনি নাম এক ছেলের সাথে তোমার সম্পর্ক আছে। এই কথা শুনে আমি ভাবলাম তাহলে রনির সাথেই যা কথা বলার বলবো, কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম রনি তোমাকে এই বিয়ে ভাঙার পরিকল্পনা দিয়েছে। তারপর আর তোমাকে বিয়ে করতে হবে এই চিন্তা মাথায় ছিলো না। কারণ তুমি অন্য একজনকে ভালোবাসো। সেদিন রনিকে শায়েস্তা করার জন্যই মূলত তার কাছে আমার যাওয়া। প্রচন্ডরকম রাগ আর জেদ নিয়ে আমি ছুটাছুটি করছিলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল রনি আর ওই মহিলাকে একসাথে এনে তোমার আর আমার পরিবারকে এক করে সবকিছুর প্রমাণ দিবো। কিন্তু রনির কাছে গিয়ে তোমার কথা বলতেই সে হেসে ফেটে পড়লো, তার কথা অনুযায়ী সে এসবের কিছুই জানেনা এবং পরবর্তী সে তোমাকে বিয়ে করবে এমন কোনো কথাও দেয়নি। তুমি তার উপর দূর্বল তাই সে ইচ্ছে করে তোমার সাথে সাথে সম্পর্কের অভিনয় করছে। রুশা নামে একটা মেয়েকে সে সিরিয়াস ভালোবাসে।
তখন আমি চিন্তা করলাম আমাকে তুমি ঠকালে আরেকটা ঠকবাজের জন্য। এরপর তুমিও তো খুব বাজেভাবে ঠকবে। তাহলে তোমাকে অযথা আর কি শাস্তি দিবো! এর মধ্যে ওই মহিলাকে নিয়ে গেলাম আমাদের বাড়িতে, তুমি এসব করেছো এটা গোপন রেখে আমার প্রতি বাড়ির সবার ভুল ভাঙালাম। কিন্তু তাদের ভুল ভাঙানোর সাথে সাথে তাদের আবারও আবদার তোমার পরিবারে এসব জানিয়ে যেন তোমাকেই আবার বিয়ে করি। কারণ অন্য কোথাও বিয়ে করলে নাকি পাড়াপড়শি কানাকানি করবে নিশ্চয়ই আমার কোনো দোষ ছিল তাই বিয়েটা করতে পারিনি কারণ সবাই তো আর সত্যিটা জানবেনা। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করলে বলবে,, ছেলেটা অবশ্যই নির্দোষ তাইতো সেটা প্রমাণ করে সেই মেয়েকেই বিয়ে করে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে।
সেই মূহুর্তে বাবা মাকে পুরোটা বলার সুযোগ পাইনি। আর সত্যি বলতে তোমাকে প্রথমবার দেখেই আমার মনে হয়েছিল তুমি আমার। ওই যে সেদিন কেঁদে কেঁদে বলেছিলে, আমি তোমাকে ফোনে বলেছিলাম অরুণের ভালোবাসার আলোতে চন্দ্রা আঁধারেও আজীবন আলোকিত থাকবে! সত্যি কথাটা মন থেকে বলা ছিল। কিন্তু এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরে আমি কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেছিলাম। অন্যদিকে তোমার বয়ফ্রেন্ডের আসল রূপটা আমি সামনে থেকে দেখেছিলাম। তাই সেদিন একটা ঠকবাজের থেকে আমার প্রথমবার অনূভুত হওয়া ভালোবাসাকে আমার করতে চলে আসছিলাম। এবং তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।

বলেই অরুণ একটু মৃদু হাসলো। কিন্তু চন্দ্রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। অরুণ চন্দ্রার গালে ডান হাতটা আলতো করে রেখে বললো,
___ বয়ফ্রেন্ডের জন্য কাঁদছো?

চন্দ্রার কান্নাভেজা মুখটা এবার রাগে রূপান্তর হলো, অরুণ চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, কান্নার মধ্যে রাগলে মানুষকে খুব সুন্দর দেখায় তো!
এটা আগে দেখা হয়নি তার! এর মধ্যে চন্দ্রা কান্না কান্না স্বরে বললো,
___ তাহলে বিয়ের পরেদিন আমাকে ডিভোর্স দিয়ে ডিভোর্সী উপাধী দিবেন, কেন বলেছিলেন?

চন্দ্রার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। অরুণ চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
___ এই মেয়ে, ডিভোর্স দিলে কি তুমি একা এই উপাধি পাবে? আমিও তো পাবো, আর ডিভোর্স হলে বাচ্চাকাচ্চাওয়ালা জামাই পাবে বলেছিলাম, তাহলে ঘটক তো আমার জন্যও বাচ্চাওয়ালা বউ-ই আনতো তাইনা! কারণ আমিও তো আগে বিয়ে করেছি।
আর তোমার থেকে আমার ব্যাপারটা মারাত্মক, লোকে বলবে প্রথমবার বিয়ে ভাঙলো তারপর বিয়ে করলো, এরপর মনে হয় তার বউ তার সমন্ধে গোপন কিছু জেনে গেছিল আর তাই সে বউকে দ্রুত ডিভোর্স দিয়েছে। মনে হয় এরপর বউ-ই পেতাম না! হেহেহেহ, তবে সত্যিটা হলো, ওইদিন এই কথা তোমাকে ডিপ্রেশনে ফেলার জন্য বলেছিলাম, কেননা তখনও তোমার উপর ভীষণ রাগ ছিলো, জেদ ছিল। ভেবেছিলাম আমি যেমন কষ্ট পেয়েছি তেমন অনেকদিন পর্যন্ত তোমাকেও কষ্ট দিবো।
আর তাইতো এমন খারাপ ব্যবহার করতাম, বিশ্বাস করো আমি এমন নই। আর ওই যে ভাবীকে এসব বলি, এগুলোও তোমাকে রাগানোর জন্য, কারণ ভাবী আগে থেকেই সব জানে, রনির আসল উদ্দেশ্য আমি ভাবীকে জানিয়েছিলাম বলেই উনি তোমাকে এই বিয়ের জন্য তোড়জোর করেছিল।
আমি ভেবেছিলাম বিয়ের পরে তোমার সাথে অনেকদিন খারাপ ব্যবহার করবো, যেটা হলো আমাকে কষ্ট দেওয়ার অল্প শাস্তি!
কিন্তু কথা হলো, এতো তারাতাড়ি তোমার মধ্যে প্রবলভাবে আসক্ত হবো সত্যিই ভাবিনি। আমার সব রাগ অভিমান, প্রতিশোধের তাড়না পরিবর্তিত হয়ে মাত্র অল্প সময়েই সেসবগুলো ভালোবাসায় আবর্তন হয়েছে।
এই আবর্তন স্পষ্ট প্রমাণ করে আমরা দুজন শুধু দুজনের জন্য জন্মেছিলাম চন্দ্রা! নাহলে এতোশত ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে আমরা দুজন কি করে এক হলাম বলোতো?

চন্দ্রা অরুণের বুকে মুখ লুকিয়ে এখনো কেঁদেই যাচ্ছে! অরুণ চন্দ্রার মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করলো,
___এবার কান্না কেন? তোমার ‘একের ভেতর সব’ করা প্রশ্নটার সম্পূর্ণ জবাব পাওনি বুঝি?

চন্দ্রা কান্নার বেগ না থামিয়েই অরুণের গলায় হাত রেখে,তার গালে গাল ছুঁয়ে কানের কাছে বললো,
___ ভালোবাসার এই আবর্তন যেন কখনো বিবর্তন না হয়!

অরুণ মুচকি হেসে চন্দ্রাকে আবারও জড়িয়ে ধরলো, এবং বললো,
___কখনোই হবেনা, আমি যে তোমাকে খুব ভালোবাসি চন্দ্রা!

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here