#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_১৮
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
দরজা বন্ধ দেখে চিন্তিত হলেন সাজিয়া বেগম। সায়েম আর রোজাকে সবটা বলতেই ওরা দুজনেই দরজা ধাক্কালো। সায়েম বলল
আপা দরজা খোল। এই আপা! আম্মা ডাকছে তো।
আমি ঘুমাচ্ছি। ডাকিস না।
খাবি না?
নাহ।
সায়েমকে দরজার কাছ থেকে সরতে বললেন সাজিয়া বেগম। সায়েম সরে গেল। উনি দরজায় টোকা দিয়ে বললেন
আমি বলে দিয়েছি উনাদের এখন কোনো বিয়েশাদি হবে না। মেয়েদের অনেক ধৈর্যশালী হতে হয়। এত অধৈর্য্য হলে তাদের কপালে দুঃখ থাকে সুজানা।
ভেতর থেকে কান্নামিশ্রিত গলার আওয়াজ ভেসে এল।
তুমি তো অনেক ধৈর্যশালী আম্মা। তাহলে তোমার কপালে কেন এত দুঃখ?
সুজানা আমি মা হই। মায়ের সাথে এভাবে কথা বলেনা কেউ।
তুমি আমার সাথে সব কথা শেয়ার করো এটা করলেনা কেন?
আমি তোকে না জানিয়ে কি এমন করেছি?
কথা বলেছ এটাও পাপ করেছ। আমি তোমার অবাধ্য কখনো হয়নি আম্মা। আমাকে আমার মতো করে থাকতে দাও। আব্বা থাকলে আমার সব অনুরোধ শুনতো।
তোর আব্বা নেই তাই তোকে আমার কথা অনুযায়ী চলতে হবে। তুই কি জানিস ওদের সম্পর্কে? না জেনে এতটা অস্থির হওয়া ঠিক নয়। তোর সবসময় খেয়াল রাখা উচিত আমি ছাড়া আর কেউ তোর অভিভাবক নয়। না তোর বাবা আছে না একজন বড় ভাই আছে। মাথার উপর ছাদ বলতে আমি আছি সুজানা। আমি বেঁচে থাকতে একটা ভালো ছেলের হাতে তোকে তুলে দিতে চাই। এটা আমার দোষ?
আমি কি বিয়ে করব না বলেছি আম্মা?
করবি সেটা কখন বলেছিস শুনি?
বলেছি তো আমাকে পড়াশোনা শেষ করতে দাও।
পড়াশোনা শেষ হলেই বিয়ে নামবে।
আমি চাইনা তারা অপেক্ষায় থাকুক।
সেটা তাদের ইচ্ছা। আমি শুধু আমার মতামত জানাবো।
তুমি এখনো আমার সাথে আপোস করছ না আম্মা।
আপোস আমি করবও না। কোনো মা মেয়ের জন্য এমন ভালো সম্বন্ধ পেলে কখনোই উপেক্ষা করবে না। আমিও পারব না। আমার মেয়ে বিশ্বসুন্দরীও না, বাবার আদরের রাজকন্যাও না। আমার তাকে নিয়ে অত ভাব নেয়ার দরকারও নেই।
ঠিক আছে। হ্যা বলে দাও। কসম পড়াশোনা করতে আমাকে বলবেনা।
সাজিয়া বেগম এবার বেশ রেগে গিয়ে বললেন,,
সুজানা এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব। অনেক্ক্ষণ ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়েছি। দরজা খোল। প্রশয় দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছি তোকে। আমার কথার কোনো দাম নেই না? বাপ মরার পর দুটোকে ফেলে অন্য কোথাও চলে যাওয়া উচিত ছিল।
সুজানা বালিশ থেকে মুখ তুললো। নাক টেনে বলল
আমাকে আর কথা শুনিওনা আম্মা। তুমি যা বলবে তাই করব। এখন অন্তত আমার মতো করে থাকতে দাও।
আমার কথা বুঝার চেষ্টা করেছিস এখন পর্যন্ত তুই? আমি বলেছি তোকে এখনি বিয়ে দেব?
তাহলে যখন দেবে তখন কথা বলবে। এখন সব যোগাযোগ বন্ধ করো।
মেয়ের এমন কথায় ধাতে লাগলো উনার। চেঁচিয়ে বললেন
নিমক*হারাম। বাপের গুষ্ঠির মতো হয়েছিস না? ওই মানুষগুলো যেচেপড়ে সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে সেটা উনাদের ভুল হয়েছে? এজন্যই বলে কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয়না। তোরও সেই দশা হয়েছে।
তোর জন্য মদ-গাজাখোরের সম্বন্ধ আসার দরকার ছিল। তুই কি একবারও ছেলেটার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছিস?
যখন বিয়ে করব তখন জেনে নেব। কারো সাথে কেন আমাকে চুক্তিতে জড়াতে হবে যে ফাইনালের পরেই বিয়েতে বসবো? আমার অনেক স্বপ্ন। তুমি এভাবে বিয়ে বিয়ে করে সব নষ্ট করে দিওনা। নিজের মতো করে থাকার কোনো ইচ্ছা আমার থাকতে পারেনা?
দরজা খোল। আমার কথা আছে তোর সাথে। রোজা তোকে আপা ডাকছে বোধহয়।
রোজা মাথা দুলালো।
হ্যা আন্টি যাচ্ছি। আপাকে বকোনা। আপা রাগ করোনা। ভাত খেয়ে নাও।
রোজা চলে যেতেই সায়েমও চলে গেল মায়ের ইশারায়। ওরা যেতেই সাজিয়া বেগম প্রশ্ন করলেন
নাকি কোথাও কারো সাথে কিছু আছে কিন্তু আমি জানিনা।
সুজানা এবার চাদর আঁকড়ে ধরলো। বিছানা থেকে উঠে বসলো। চোখ মুছে বলল
আমার উপর তোমার এই বিশ্বাস? তুমি আমাকে এইটুকু চিনলে আম্মা?
আমাকে বলতে বাধ্য করছিস। আমি কখনো এসব প্রশ্ন তোকে করতাম না। কেন অবাধ্য হচ্ছিস বলতো? আমার কথাটা বুঝার চেষ্টা কর মা আমার।
আমাকে পর করে দেয়ার এত তাড়া কেন তোমার আম্মা? তুমি আমার কথাটা বুঝার চেষ্টা না করলে আমি দরজা খুলব না।
কতক্ষণ? কতক্ষণ দরজা না খুলে থাকবি? পাঁচঘন্টা, দশঘন্টা, বিশঘন্টা, একদিন, দুদিন। কতদিন থাকবি? আমাকে এখনো চিনিসনি। কোনো আগপাশতলা না ভেবে দু বাচ্চাকে নিয়ে এই শহরে উঠেছি আমি। তোদের দুবেলা আহার জুটিয়েছি। ভালো স্কুল কলেজে পড়াশোনা করিয়েছি। কারো কোনো সাহায্য নিইনি আমি। নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করে গেছি, করছি। আমিও তোকে দরজা খুলতে বলব না। তুই ত্যাড়া হলে আমি তোর চাইতেও বেশি ত্যাড়া।
সুজানা মাকে বুঝাতে না পেরে হতাশ হয়ে আবারও ঢলে পড়লো বিছানায়। সাজিয়া বেগম চলে গেলেন। বহুদিন পর নিজেকে একটু হতাশ দেখালো। মেয়েটা কেন যে নিজের ভালোটা বুঝেনা।
ফোনে মেসেজের অসংখ্য রিংটোনের আওয়াজে যখন ধ্যান ভাঙলো তখন ফোন হাতে নিল সে।
বন্ধুমহলের আড্ডাগ্রুপে অসংখ্য মেসেজ আসছে আর যাচ্ছে। দুর্দান্ত চ্যাটিং চলছে। মাত্রই গ্রুপের নাম পাল্টেছে আহির।
ফানি এক্সপ্রেস থেকে টেলেন্টেড বেয়াদবের মজলিশ।
এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ চলছে। আর না পেরে নিখিল চেঞ্জ করে লিখলো
পিংপাংপুং চিংচাংচুং
সুজানার হাসি পেল। তাকে মেসেজ সিন করতে দেখে মেহুল বলল
সুজু আজ চুপচাপ কেন?
আহির বলল
পড়তাছে মনোযোগ দিয়া।
জায়িন বলল
গাইস আমি কিছু বলি?
আহির বলল
আগে মুতে আয়। তারপর বল।
লজ্জা পাওয়া ইমুজি দিল জায়িন। বাকিসবাই হা হা রিয়েক্ট দিয়ে বসলো। শান্তা বলল
টেলেন্টেড বেয়াদবদের জায়গা পিংপাংপুং চিংচাংচুংয়ে হবেনা। সুজানা কিছু বল বইন।
আহির বলল
তোর মতো আদব এই গ্রুপে কি করে? যাহ জামাই লইয়্যা ভাগ।
তুই বউ লইয়্যা ভাগ। ও তোর বউ তো পোয়াতি।
আহির নাক সিটকানো ইমুজি দিয়ে বলল
ষিঃ
শান্তা লিখলো
ষুহহহঃ
সুজানা লিখলো
ঝগড়া থামা। কলে আসবি তোরা?
সবাই ইয়েস লিখলো। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই সবাই ভিডিও কলে যোগ দিল। সুজানা চোখমুখ স্বাভাবিক করে বলল
আজ একটা ঘটনা ঘটেছে। আজ শান্ত কি করলো জানিস? অভিক স্যারের পেজে আমার আইডি দিয়ে কমেন্ট করে দিল। আমি কি লজ্জাটাই না পড়লাম। মানে এরকম কেউ করে? আমি তো প্রচুর বকেছি তোকে শান্ত।
মেহুল প্রশ্ন করলো।
কি বলিস? কিভাবে পড়লি?
বাকিরা সমস্বরে বলল
হ্যা হ্যা বল বল।
শান্তা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে রইলো।
সুজানা ধীরেসুস্থে বলল
ওদের পড়াচ্ছিলাম হঠাৎ করে দেখি কমেন্টের উত্তর এল। স্যারও তখনি এল। মানে ইজ্জতসম্মান সব শেষ।
সবাই এবার ভুরু কুঁচকে তাকালো।
কি বলিস এসব? স্যার ওখানে কি করে?
নিখিল নড়েচড়ে বসে বলল
আচ্ছা। তুই স্যারের বাড়িতে পড়াতে যাস। ও মাই আল্লাহ!
সবাই হৈচৈ বাঁধিয়ে ফেলল। সুজানা মাথায় হাত দিল। কি বলে ফেলল সে। থাক গে আজ বলে দেবে।
তুই আমাদের কাছ থেকে এতদিন লুকোলি? ২ নম্বর গেইটে নাকি স্যারের বাড়ি। ওরে বাবারে সুজানা তুই এতদিন বলবি না?
জায়িন বলল
নো নো সুজানা এটা ঠিক হয়নি।
সুজানা মুখ ঢেকে নিল। তারপর হাত সরিয়ে বলল সরি দোস্ত।
তারা খেয়াল করলো বোধহয়। সবাই সমস্বরে বলে উঠলো
কিরে তুই কেঁদেছিলি নাকি?
সবার প্রশ্ন শুনে নিজেই চুপ মেরে গেল সুজানা। বলল
আরেহ না না। শুয়ে ছিলাম তাই চোখ ফুলেছে। যেটা বলছিলাম আসলে আমি..
নিশ্চয়ই কেঁদেছিলি তুই।
আহির হেসে বলল
জামাইর লগে কাঁদতাছোস? একদম চাপলেস থাক বইন । তোর জামাই ধইরা আনার দায়িত্ব আমার। হালারে একসেকেন্ড সময়ও দিতাম না। ধইরা লইয়্যা আসুম।
সুজানা হেসে ফেলল। বলল
ধুরর।
মেহুল বলল
স্যারের বাড়িতে যাস আর লুকোলি?
আরেহ তোদের বলব বলব করে বলা হয়নি। ওসব ক্লাসে বলাবলি করিস না দোস্ত। স্যারের ভাইপো ভাইঝি দুটোকে পড়াই বুঝলি। আগামী মাস থেকে আর পড়াবো না।
কেন পড়াবি না কেন?
বললাম না একটা চাকরি পাইছি।
সবার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠলো এবার। জায়িন বলল
চাকরি করবি? আর পড়াবি কখন? আমাদের তো প্রাইভেটও নিতে হবে। কখন হবে এসব?
তোরা হেল্প করবি। তোরাই তো আমার ভরসা।
শান্তা বলল
হ্যা সে তো করবই কিন্তু চাকরি কোন টাইমে।
দিনের পাঁচঘন্টা। অনেকগুলো ডিজাইন করতে হবে। সাথে নাকি প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা আছে। টিউশনি থেকে ভালো হবে না?
হুমমম।
আহির বলল
দিনে তো পারবি না। তারমানে রাতে? আন্টির আপত্তি নেই?
আপত্তি করে কি হবে? আমার চাকরিটা লাগবেই।
নিখিল বলল
ওকে অল দ্য বেস্ট। আর কোনো সমস্যা হলে আমরা তো আছি। সব নোট আমাদের কাছ থেকে পাবি। এখন বল কেঁদেছিস কেন? কোনো সমস্যা? কাল বিয়েতে আসবি না? আন্টিকে রাজী করিয়েছিস?
বলা হয়নি। বলব।
মেহু আর শান্ত?
মেহুল বলল
হুমম বাবা যেতে দেবে সুজু আর শান্ত গেলে।
শান্তা বলল
আমারও। দাদীর জন্য সমস্যা নেই। বাবাকে রাজী করাতে পারলে হয়ে যাবে।
জায়িনের ফোনের সামনে হঠাৎ নিহাতকে দেখা গেল তারপরেই ঠুস করে কেটে গেল। সবাই বোকা চোখে একে অপরের দিকে চাইলো । মেহুল বলল
নিহাত ফোনটা কেটে দিল নাকি?
নিখিল বলল
হিংসুটে মহিলা। আমাদের গ্রুপে উনি নেই তাই হিংসে হয়।
জায়িন কিছুপর আবারও জয়ন করলো। বলল
ভাই নিহার জন্য একটা ছেলের খোঁজ লাগা। শ্বশুরবাড়ি পাঠাই দেই। ওর জ্বালায় আমি অতিষ্ঠ। পড়া আর পড়া। ফোনটা কেটে দিল এক্ষুণি দেখলি।
নিখিল বলল
বনবাসে পাঠিয়ে দে। সন্ন্যাসীর বউ হয়ে ফিরে আসুক।
সবাই হেসে উঠলো একসাথে। সুজানার মন খারাপটা কমে এল। মন খারাপের সময় বন্ধুগুলো ভালো উপশম। এখন মায়ের মান ভাঙাবে কি করে? মা টা তার বড্ড জেদী।
________________________
সেই রাতে মা মেয়ের ভাত খাওয়া হলো না। মান অভিমানের পাল্লায় পড়ে দুজনেই কেউ কারো সাথে যেচে কথা বললো না। মায়ের মন পুড়লো মেয়ের জন্য মেয়ের মায়ের জন্য। তাদের লড়াই তো একে অপরকে ভালো রাখার। সকাল সকাল নামাজ কালাম পড়ে চা বসিয়ে দিয়েছে সুজানা। মায়ের মুড ভালো দেখলে নিখিলের ভাইয়ের বিয়ের কথারা পেড়ে দেখবে। গিফটের টাকার চিন্তা নেই। সব বন্ধুরা মিলে ডিনার সেট দেবে ভেবে নিয়েছে। মেহুল, জায়িন আর আহির দিয়ে দিয়েছে সব টাকা। শান্তা আর সে পরে দিলেই চলবে। আপাতত মাকে রাজী করানোটা বড় বিষয়। মেয়েকে চা বসাতে দেখে সাজিয়া বেগম কোরআনে তেলওয়াতে বসেছে। সায়েমের রোজ ঘুম ভাঙে মা বোনের তেলওয়াতের মধুর সুরে। আজ মায়ের তেলওয়াত শুনে উঠে পড়লো সে। মা কতবার করে বলেছে নামাজটা কন্টিনিউ করতে সে সকালের নামাজটা কভু পড়তে পারেনা।
ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল সে। মা মেয়ে তো কাল রাতে মান অভিমান করে না খেয়ে ঘুমালো। আজ কি খবর?
সুজানাকে চা বানাতে দেখে বলল
আম্মার সাথে কথা বলেছিস?
সুজানা ছোট্ট করে আওয়াজ করলো।
না।
আম্মা কাল রাতে খুব কেঁদেছে।
কি বলিস? খুব কেঁদেছে?
সায়েম মাথা দুলালো।
খুবববব।
আমি বিয়ে করে চলে গেলে তুইও খুশি হবি?
ওরা অনেক বড়লোক । তুই ওখানে থাকলে আম্মা নিশ্চিত হবে আর এটাই আমার খুশি।
বড়লোকদের খুব সুখ?
আমি অতশত বুঝিনা। আম্মা তোকে বলছে জাস্ট মত দিতে।
আচ্ছা? ওরা আমার মত মানবে? মানলে সমস্যা নেই।
সত্যি? আম্মাকে বলব?
কোনো লাভ নেই। কেউ এসব উদ্ভট শর্ত মানবে না। আমি এমন কে যার কথায় তারা উঠবস করবে। উনাদের মেয়ের অভাব হবেনা।
অতকিছু জানিনা। আমি আম্মাকে বলে আসি।
সায়েম চলে গেল। সুজানা চা বানানো শেষ করতেই মা এল রান্নাঘরে। গম্ভীরভাবটা কেটে গেছে। স্বাভাবিক ভাবে চায়ের কাপে চা ঢেলে নিতে নিতে বললেন
তাহলে সায়েম যেটা বললো সেটাই হবে।
সুজানা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাজিয়া বেগম বললেন
কথার নড়চড় পছন্দ করিনা আমি।
সুজানা চুপ করে রইলো। মায়ের সাথে এ কেমন দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে তার।
আমি কি নিখিলের ভাইয়ের বিয়েতে যেতে পারব? আজ মেহেদী সন্ধ্যা। ওরা বোধহয় আসবে সন্ধ্যায়। একসাথে যাচ্ছি।
কে কে যাচ্ছে?
মেহুল আর শান্তাও যাচ্ছে।
যাওয়া যায় তবে সাবধান। আর কোনো সম্বন্ধ আসলে তখন দোষ না জানি আমার হয়।
আম্মা তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো?
উনি কথাটা শোনার আগেই বেরিয়ে গেলেন।
________________
বিয়ের এইসেই প্ল্যানের জন্য কেউ ক্যাম্পাসে গেল না। বৃহস্পতিবার দিনটা। বেশ সুন্দর ভাবে কেটে গেল। সুজানা টিউশনির উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে। তাড়াতাড়ি ফিরবে সে আজ। তারপর বন্ধুরা আসলে রেডি হয়ে বিয়ে বাড়িতে চলে যাবে। যদিও আজ টিউশনিতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। ওই বাড়ির মানুষগুলোকে সে আপন করে নিয়েছিল অল্পদিনে তাই বলে সম্বন্ধ নিয়ে যেতে হবে?
ভেতরে ভেতরে একটা ক্ষোভ ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। না সে উগ্র নয় কভু। একদম চুপচাপ থাকবে।
বাড়িটার গেইটের সাথে লাগোয়া ফুল গাছটার প্রাচীর টপকে বেরিয়ে গেছে। এপাশ ওপাশ দুপাশে গোলাপি রঙা ফুলগুলো বিছিয়ে থাকে। দূর থেকে দেখতেও সুন্দর লাগে। অবশ্য লাগবেনা কেন তাদের প্রতি যা যত্নশীল বাড়িটির ছোটকর্তা।
সুজানা যখনি বাড়িটার আশপাশে থাকে মনে হয় কোনো স্বর্গ। কেমন এক অদ্ভুত সুখানুভব হয় বুকের ভেতর। ঢিপঢিপ করতে থাকে অনবরত। দূরদর্শী মন কতকিছু ইঙ্গিত ইশারা করে। লজ্জায় আড়ষ্টতায় ভেতরে ভেতরে ঘৃণা হয় নিজের উপর। লোভী মনে হয় নিজেকে। মনে মনে প্রার্থনা করে যা তার হওয়ার নয় সেসবের প্রতি তার যেন লোভ না জন্মে।
পা টিপে টিপে যেতে যেতে সে থমকালো তাকে দেখে যার কথা ভাবতে গেলেও দ্বিধায় পড়ে যায়। অবশ্য এই বাড়িতে আসা বন্ধ হলে সব দ্বিধা কেটে যাবে। আর মাত্র একটা দিন। তারপর থেকে সে আসবেনা।
ঘাড় ঘুরাতেই সুজানাকে দেখে কৌতূহলী চোখে চাইলো অভিক। হাতে কাঁদা লেগে আছে। কাঁদা মিশ্রিত হাতের উল্টো পিঠে কপাল মুছে এগিয়ে এল।
জারটা সুজানার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
পানি ঢেলে দিন।
সুজানা বিনা দ্বিধায় জারটা নিয়ে পানি ঢেলে দিল। অভিক হাত ধুঁতে ধুঁতে বলল
চোখের সমস্যা বাড়ছে মনে হচ্ছে।
কেন?
আপনাকে আজকাল ক্যাম্পাসে দেখছিনা।
আমি যাইনি।
যাননি কেন?
ওই এমনি।
আপনি সব এমনিই করেন। এবার কিছু অন্তত কারণ দেখানোর জন্য হলেও করুন।
আচ্ছা।
হাত ধোঁয়া শেষ হতেই হাতঝাড়া দিল অভিক। মুখে পানির ছিঁটে পড়তেই সুজানা চোখ খিঁচে বন্ধ করতেই অভিক হেসে উঠলো।
তার পুরো সাঁঝের বেলা এলোমেলো, এলেবেলে, অগোছালো করে দেয়া মেয়েটাকে জ্বালাতে তার বড্ড ভালো লাগে।
এই গোছালো, পরিপাটি, নিয়মশৃঙ্খলার শিকল ছেড়ে সময়টুকুতে একটু অগোছালো হতে ইচ্ছে করে। দোষ তার নয়। দোষ মেয়েটার। ভারী দোষ। সেই বৃষ্টি ভেঁজা দিনটার দোষ। সেগুনবাগিচার লাল দিঘীটার দোষ। নীল শাড়ি, নীল চুড়ির দোষ। চুলে গুঁজা বকুল ফুলের দোষ। ভয়, লজ্জামিশ্রিত বোকা বোকা মোটা কাজল কালো চোখদুটোর দোষ। মোটকথা সুজানা মেয়েটাই একটা দোষ।
আর দোষটা তার।
চলবে………#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_১৯
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
সুজানা ওড়নার কোণায় মুখ মুছতে মুছতে বাড়ির ভেতরে পা রাখলো। হাত ধুঁতে সাহায্য করলো বলে পানির ছিটে মারতে হবে? আজব!
অনা আর আবিদ ফ্লোরে বসে খেলা করছিল। সুজানাকে দেখে দুজনেই হাততালি দিল।
আসসালামু আলাইকুম সুজান। গুড ইভিন।
ওয়ালাইকুমুস সালান। গুড ইভিনিং।
ইভননি।
ইভিনিং। যাইহোক পড়ার ঘরে যান।
মমতাজ বেগম ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। সুজানা সালাম দিতেই সালামের জবাব দিয়ে বললেন
তুমি এসেছ বোন? তোমার কথায় বলছিলাম এতক্ষণ। তোমার মা ভাই ভালো আছে?
জ্বি দাদু। আপনি ভালো আছেন?
আল্লাহ ভালো রেখেছেন।
সুজানা অনা আর আবিদকে তাড়া দিল।
এই আপনারা চলেন চলেন।
ওরা দুজনেই দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল। সুজানা ও ওদের পেছন পেছন গেল।
ওদের পড়াতে পড়াতে একসময় আনিকা এল। বলল
সুজানা অভি বলেছে যাওয়ার সময় দেখা করে যেতে।
আমাকে?
হ্যা। কালও নাকি বলেছে কিন্তু আপনি দেখা করে যাননি।
একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা আজ মনে করে দেখা করে যাবেন। নইলে স্যার বলে কথা দেখবেন পানিশমেন্ট দিতে ভুলবেনা।
অনা গালে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে উঠে বলল
অভি সুজানকে মার দিবে?
সুজানা গাল টেনে দিয়ে বলল
পড়ার সময় কোনো কথা না। ঠিক আছে?
ওকে সুজান।
আনিকা ছোট্ট একটা বাক্স বের করলো ওড়নার নিচ থেকে। আকাশী রঙা মিনিবক্স। তারউপর চকচকে একটা গোলাপফুল। সুজানার সামনে রেখে বলল
আপনার পারিশ্রমিক সুজানা।
সুজানা লজ্জায় পড়ে হাসলো। বলল
আজকে তো ২৮ তারিখ।
তাতে কি হয়েছে? ওদের পাপা বলেছিল গতকালকেই দিতে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
আবিদ বক্সটা ঠেলে দিয়ে বলল,
সুজান সুজান পাইশশমিক নাও।
আনিকা আর সুজানা একসাথে হেসে উঠলো। আনিকা বলল
হয়েছে আপনাকে আর পাকনামি করতে হবেনা।
আর হ্যা, সুজানা ছোটমা আর আমার সব কাপড়গুলোতে কত বিল এসেছে ওটার স্লিপটা এনেছেন?
না, ওটা তো আনা হয়নি।
এটা কোনো কথা? আমি ভাবছিলাম আজকেই পে করে দেব। আচ্ছা বিকাশ,নগদ যেকোনো একটা থাকলে সুবিধা হতো। আপনার নাম্বারটাতে পাঠালে হবে।
হুম ওটাতে বিকাশ করা আছে।
তাহলে ঠিক আছে। আর একটা কথা আপনার আম্মা তো খুব ভালো কেক বানাতে পারে। অনা আর আবিদের জন্য একটা কেক নিয়ে আসবেন পরশু দিন। পারবেন না?
উম উম কেকক? মোজা মোজা হবে।
দুজনেই মাথা দুলালো। সুজানা বলল
লিখুন। আচ্ছা আনব ম্যাডাম।
আনিকা সুজানার চেয়ারটা ধরে একটু নিচু হয়ে ফিসফিসিয়ে বলল
ম্যাডাম ট্যাডাম বাদ দেন। আপু ডাকার অভ্যাস করেন। কেমন?
আমি কফি পাঠাচ্ছি।
আনিকা চলে গেল। সুজানা মাথায় হাত চেপে বসে রইলো। অনা আর আবিদ লিখতে লিখতে মাথা তুলে তাকালো। আবিদ বলল
সুজান অচুখ?
সুজানা হাসলো। থুঁতনি ধরে আদর করে বলল..
না অসুখ না। লেখা শেষ করেন। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
আচচা তাতারি নিখি।
হুমম নিখেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে মর্জিনা কফি আর কিছু নাশতা নিয়ে এল। বলল
হ্যা গো তোমাকে এই কফি খাওয়া শেখালো কে? বাবু না হয় ওসব বিদেশে খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়েছে তাই খাচ্ছে তুমি কেন খাও এসব তেঁতো জিনিস। কত সুন্দর করে বানায় কিন্তু খেয়ে দেখলাম নাউজুবিল্লাহ।
সুজানা হাসলো। বলল
আপনার বাবুই শিখিয়েছে।
অ্যাহ?
হ্যা।
মর্জিনা চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ফিসফিস করে বলল
শুনো আমি যা শুনছি তা কি ঠিক? এই বাড়ির কথা তো এই ঘর থেকে ওই ঘরও পৌঁছায় না ভালো করে। যা কথা চাপা রাখতে জানে ওরা। বলছিলাম কি তোমার সাথে নাকি বড় বউয়ের মামাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এগুলো কি ঠিক কথা?
অনা বলল
মজি দাদু তুমি সুজানকি কি বোলো?
মাগোমা এই ফাজিলগুলোর জ্বালায় কিছু বলাও যায় না। হ্যা গো বলো এসব সত্যি? তাহলে তো তুমি ছক্কা মেরে দিয়েছ।
সুজানা কিছু বলতে চাইলো না কিন্তু কিছু না বললে এই মহিলা এখান থেকে নড়বে বলে মনে হচ্ছেনা তাই বলল
এই বাড়িতেই তো থাকেন। সব জানবেন সময় হলে।
মাগোমা তোমারও এই বাড়ির রোগে ভালোভাবে ধরছে। সোজা কথা বলেনা কেউ। হুহ ঢং।
উনি চলে যেতেই সুজানা কফির মগটা শেষ করলো দ্রুত। কি বাজে রোগে ধরেছে আজকাল। তেঁতো জিনিসও ভালো লাগে।
আপনাদের লেখা শেষ? বাকিটুকু লিখে তারপর উঠবেন কেমন? সুজান আসছে আজ। কেমন?
ওকে ওকে সুজান। টা টা। চি ইউ টুমুরু।
সুজানা হেসে বলল
চি ইউ আফটার ঠোমারো বাবু সোনা। টা টা।
দুজনেই ওর পেছন পেছন বেরিয়ে গেল চুপিচুপি। আবিদ অনাকে বলল
বুন বুন আচতে আচতে যাবো কিমন? সুজান দিখি ফিলবে। খুব বোকা দিবে।
আচচা আচতে আচতে যাবো।
যেতে যেতে সুজানার মনে পড়লো স্যার তাকে দেখা করতে বলেছিল। স্যারের ঘর কোনটা?
মর্জিনাকে কফির মগ নিয়ে যেতে দেখা গেল। সুজানাকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে বলল
কি গো কি খুঁজছ তুমি?
স্যার কি বাড়িতে আছে নাকি বাইরে গেছেন। আমাকে না দেখা করে যেতে বললেন।
তুমি দেখছ না কফির মগটা আনতে গেছি। কাপড় ঢলতেছে দেখি। যাও। ওই শেষের বারান্দা আছে না? তার আগের ঘরটা। বাত্তি জ্বলতেছে।
সুজানা মাথা নাড়ালো। বলল
আচ্ছা।
ধীরপায়ে ওই ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। ঘরটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। উঁকি দেবে দেবে করে যখন গলা বাড়ালো দেখলো অভিককে। আবারও চেপে গিয়ে দম নিয়ে উঁকি দিতেই দেখলো কোমর সমান আইরন টেবিলে শার্ট কি পাঞ্জাবি আইরন করছে। ঘরের দেয়ালো কয়েকটা ব্লু রঙের পেইন্টিং। ঝুলানো আর্ট পিস, একটি সাদা বুকশেল্প, বুকশেল্পের খালি তাকে রঙের বাক্স, তুলি। আরও রঙবেরঙের জিনিস। দেয়ালের গায়ে ইনডোর প্ল্যান্টের লতা দেয়াল বেয়ে বেরিয়ে গেছে জানালার উপর দিয়ে। জানালা সাজানো ড্রিম ক্যাচার, ছোট ছোট ফুল, রঙিন রিবন দিয়ে। বেডের দুপাশে দুটো গোল বেডসাইড টেবিলে দুটো টেবিল্যাম্প। ড্রেসিং টেবিল। বসার জন্য চেয়ার। পড়ার জন্য টেবিল। টেবিলের উপর কালো ল্যাপটপ, মাইক্রোফোন, ক্যামেরা, হেডফোন, চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক আরও কতকিছু। সুজানা বিড়বিড়িয়ে বলল, ধুর যাব কি করে?
শার্ট ফোল্ড করে বিছানার উপরে রাখার সময় দরজার কাছে সুজানার ওড়নার কোণা দেখে ভুরু কুঁচকালো অভিক। আবারও কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল
ভেতরে আসুন সুজানা।
সুজানা ভড়কে গিয়ে বলল
ওমা আমাকে দেখেছে?
হ্যা দেখেছি। ভেতরে আসুন।
সুজানা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পা রাখলো ঘরের ভেতর। ঢোক গিলে বলল
আমাকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে তো তাই তাড়াতাড়ি বললে ভালো হয়।
অভিক তাকাতেই সুজানা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ওরেবাবারে তার কেমন কেমন লাগছে। অভিক ওয়ারড্রব খুলে কিছু কালো আকাশীরঙা একটি শপিংব্যাগ বের করলো। ব্যাগ থেকে কালো আর ছাইরঙা ট্র্যাকসুইট বের করলো। বলল
এটা নিয়ে যান।
অ্যাহ?
এইটা।
এইটা আমি কি করব?
লুজ হয়, ফিটিং করবেন।
সুজানা ওড়নার কোণা মোচড়ে বলল
আচ্ছা।
অভিক আবারও ব্যাগে ভরতে গিয়ে বলল
আপনি করবেন।
অ্যাহ?
আপনি করবেন কাজটা, আপনার মা নন।
আমি করিনা।
তাতে কি? করবেন।
আমার ভুল হবে।
হোক।
আচ্ছা। একটা সাইজ লাগবে।
দিয়েছি। নিন। পরশু নিয়ে আসবেন।
সুজানা ব্যাগটা নেয়ার জন্য এগিয়ে গেল। চট করে কেড়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ওড়নায় টান পড়তেই চট করে ঘাড় ফেরালো। অভিক কৌতুহলী চোখে চাইলো। জুতোর সেলফের লৌহনির্মিত ছোট কাঁটার সাথে পেঁচিয়ে গিয়েছে। সুজানা লজ্জায় একটান দিতেই ওড়নার লেইস ছিঁড়ে গিয়ে কাটায় লেগে রইলো।
দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে গেল সে। অভিক এগিয়ে গিয়ে লেইসের ছেঁড়া অংশ তুলে নিয়ে রঙতুলির বাক্সে রেখে দিল। আসবাবপত্রগুলোও তাকে আটকাতে চায়।
________________
দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ঘরে হৈচৈ শুনতে পেল সুজানা। রেলিঙ ধরে নীচে তাকাতেই দেখলো গাড়ি। ওহ শিট তারমানে ওরা চলে এসেছে?
ঘরের দরজা খোলা। সে ভেতরে পা রাখতেই সবাই হৈহল্লা করে ছুটে এল। মেহুল আর শান্তার গায়ে শাড়ি। দু’জনকেই ভারী মিষ্টি লাগছে। আহির আর জায়িন সায়েমের সাথে একসাথে বসে টিভিতে মজে আছে। রাশেদা বেগমকে দেখে সুজানা হেসে বলল
আহ ছেলেবউকে দেখতে চলে এসেছ?
মেহুল লাজুকমুখে তাকালো। রাশেদা বেগম হেসে বলল
তোরও এরকম শ্বাশুড়ি হবে। সুজানার হাসিমাখা মুখ মিইয়ে গেল। মেহুল ঠেলে বলল
আরেহ যাহ। ফ্রেশ হয়ে আয়। আমরা বেরোবো তো।
শান্তা বলল
হ্যা। আমরা সবাই মিলে শাড়িও চুজ করে রেখেছি তোর জন্য।
কার শাড়ি। আন্টিই তো দিল।
মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে চলে গেল সুজানা।
শান্তা আর মেহুল দুজনে মিলে ওকে রেডি করে দিল। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সুজানা বলল
নিহাত যাচ্ছে না কেন?
শান্তা বলল
তুই পাগল! ও নিখিলের বাড়িতে বিয়ে খেতে যাবে। সাপে নেউলে বন্ধু হয় কখনো?
সেটা ঠিক। তবে ওকে আমার ভালোই লাগে। ওকে উপরে যেমনটা মনে হয় ও সেরকম না।
হুমম।
সুজানা কালো শাড়িটা পড়ে নিল। পাড়ে সোনালী আর লাল পুরু কাজ করা। লাল ব্লাউজের পাড়ে কালো সোনালী কাজ করা। শাড়িটা ভীষণ সুন্দর এবং সুজানার ভীষণ পছন্দের। তার মায়ের শাড়ি। সাজিয়া বেগম দূর থেকে একপলক দেখে মৃদু হেসে চলে গেলেন। দেখতে দেখতে চোখের সামনে মেয়েটা কতবড় হয়ে গেল।
আহির আর জায়িন তাড়া দিল। আহির হাঁকিয়ে বলল
বইনরে তোদের ময়দামাখা শেষ হয়ছে? নাকি চলে যামু?
শান্তা বলল
ময়দা কাকে বললি?
চুপ থাক। সত্যি বললে জ্বলে।
সুজানা শান্তার হাত ধরে রাখলো।
ঝগড়া পরে করিস।
সাজিয়া বেগম সবার জন্য চা নাশতা নিয়ে এলেন। আহির আর জায়িন নাশতা খেতে খেতে বলল
আন্টি তোমার হাতে জাদু আছে সত্যি।
উনি হাসলেন। বললেন
সত্যি ভালো হয়েছে। আরও নাও।
শান্তা আর মেহুল ভাগ বসিয়ে বলল
সব ওরা খাবে নাকি।
সুজানা তাড়া দিল এবার।
অ্যাহ খাওয়ায় মজে গিয়েছিস? চল দেরী হয়ে যাচ্ছে।
সায়েম বলল
আপা আমিও রেডি।
সুজানা বলল
তুই?
আহির সায়েমের পিঠে ধুপধাপ চাপড় বসিয়ে বলল
নিখিলের আদেশ ওকে সাথে নিয়ে যেতে হবে।
আম্মা তুমি তাহলে বড় আন্টির সাথে থাকো।
বলেই মায়ের দিকে তাকালো সুজানা। সাজিয়া বেগম চোখ সরিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অন্য কাজে।
ওরা বেরিয়ে পড়লো সবাই মিলে।
আহির গাড়ি ঘুরিয়ে বলল
মা কি বলছে জানিস? রাতে খেয়েদেয়ে চলে আসবি আহির। আমি বললাম ক্লাব থেকে বিরিয়ানির ঢেকচি আসবে রাত একটায়। বিরিয়ানি না খেয়ে ফেরা যাবেনা।
সবাই হেসে উঠলো। শান্তা বলল
মাম্মাস বয়।
আহির চটে গিয়ে বলল
একচড়ে বেহুশ কথাটা শুনছোস কখনো? নাকি সবাইকে দেখামু?
শান্তা ভেংচি কেটে বলল
আহ মরণ।
বিয়ে বাড়ির গেইট পার হতে হতে দেখা গেল অনেক অনেক মানুষ, আত্মীয় স্বজন আর বাচ্চাকাচ্চার ছোটাছুটি। ওদের গাড়ি দেখে নিখিল ছুটে এল। বলল
কোনো অসুবিধে হয়নি তো? সব ঠিকঠাক?
আহির আর জায়িন বলল
ইয়েস ব্রো। আগে বল বল সুন্দরী মেয়ে কোনদিক দিয়া গেলে পাব।
শান্তা বলল
টেলেন্টেড লুইচ্চা।
নিখিল হাসলো। বলল
এরেহ সায়েম এসেছিস ভাই আমার।
হ্যা চলে এসেছি।
আহ আমি ভারী খুশি হয়েছি। এই বান্ধবী তোরা ঠিকঠাক?
ওরা মাথা দুলালো। ওরা গাড়ি থেকে নেমে যেতে যেতে নিখিলের মা ছুটে এল তাদের দেখে। বলল
ওমা তোমরা এসেছ? খুব খুব ভালো হয়েছে। সেই তখন থেকে বলে যাচ্ছে আমার বন্ধুরা আসবে, আমার বন্ধুরা আসবে। ওমা মেয়ে তো চারজন আসার কথা ছিল।
সবাই চুপসে গেল। জায়িন হেসে উঠে বলল
ও কোনো ব্যাপার নয় আন্টি। আগে বলুন আপনি কেমন আছেন।
আল্লাহ ভালো রেখেছে বাবা। তোমাদের মা বাবা ভালো আছে তো।
কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে গেল সবাই। নাশতা পানি খেয়ে জিরিয়ে পুরো বাড়িটা আর বাড়ির চারপাশটা ঘুরলো সবাই মিলে। নিখিল সবার সাথে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিল। চারদিকে নানান রঙের আলোয় ঝলমল করছে। সাথে নানান রকম মানুষের ছোটাছুটি। বিশাল উঠোনে স্টেজ ও বসার আয়োজন করা হয়েছে।
মেহেদী সন্ধ্যা শুরু হবে তার আগেই সুজানারা সবাই বসা ছিল তাদের জন্য বরাদ্দ ঘরটাতে। ওখানে নিখিলের মামাতো ফুপাতো খালাতো বোনদের সাথে গল্প জমেছে তাদের। তবে গানের আওয়াজে তিন বান্ধবী স্টেজের কাছাকাছি চলে এল বাকিদের সাথে । দেখলো দলবদ্ধ হয়ে নাচছে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। তন্মধ্যে আহির জায়িন আর নিখিলও আছে। সায়েমকেও দেখে গালে হাত দিল সুজানা।
আকাশটা কালো, মাঝেমাঝে কয়েকটা তারা উঁকি দিচ্ছে। বড় বড় ফুলটবগুলো সরিয়ে একপাশে করে রাখা। কয়েকটা বড় বড় বাতি লাগানো বিপরীত পাশেই স্টেজের সামনে।
আলোয় ঝলমলে রাতের এই আনন্দ মুহূর্তে
যে যেরকম পারছে নাচছে মনের খুশিতে।
গান চলছে
চোগাদা তারা
চাবালা তারা
রাঙীলা তারা
রাঙবেরু জুতেরি ভাতরে, হেই..
চোগাদা তারা
চাবালা তারা
রাঙীলা তারা
মেহুল, শান্তাকে টেনে নিয়ে গেল ওরা। সুজানাকে টেনে নিয়ে যেতে আসবে তক্ষুণি উল্টো দৌড় দিল সে। তবে বেশিক্ষণ দৌড়াতে পারলো না। খানিকটা এঁদো জায়গায় গিয়ে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। কেউ কেউ দেখলো তবে ছুটে এল না কেউ একজনকে এগোতে দেখে। সুজানার হাত ছিলে গেল বড় ফুল টবের সাথে লেগে। পড়ে যাওয়া টবটা তুলে নিল সৌম্যদর্শন একজন। আজকাল সবাইকে দেখতে অমন লাগে। হাত দেখে চোখ নামিয়ে নিয়ে হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতে যাবে তখনি ফুলটবটাকে যত্নসহকারে দাঁড় করানো হলো। ধীরে ধীরে ওটা সরে যেতেই সৌম্যদর্শন লোকটাকে দেখে চোখ কপালে উঠলো সুজানার। ঢোক গিলে তাকিয়ে থাকলো। যেখানে সেখানে কেন উনাকে হাজির হতে হবে?এটা কেমন কথা?
কালো হালকা জ্যাকেট পরিহিত লোকটা হাঁটুভেঙে বসা। রসিকতা মিশ্রিত গলায় বলল
না মানে আপনি যেদিকে যান আমি সেদিকে যাই? নাকি আমি যেদিকে যাই আপনি সেদিকে যান?
সুজানা হাতের তালু অন্য তালুতে ঢলতে ঢলতে বলল
২ নাম্বারটা।
অভিক হেসে উঠলো। বলল
উহু, ইটস কো-ইন্সিডেন্স সুজানা।
চলবে…….