আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি
(বোনাস পার্ট)
৯.
ভালোবাসা কি? এ তো এক নাম না জানা অনুভূতি। যা উপলব্ধি করতে হয় মোনের গভীর থেকে। শরীর ছোঁয়ার আগে মোন ছুঁতে হয়। আপন করে নিতে হয় মোনের একান্তে থাকা কথাগুলোকে। ছুঁয়ে দিতে হয় খোলশে আবৃত থাকা হৃদয়কে। তবেই তো ভালোবাসা যায়।
খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তেমনি এক দম্পতি নিরবে আদান প্রদান করছে অনুভূতি। রেলিংয়ে রাখা ইচ্ছের হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল ছুঁয়ে আছে ইহানের হাত। এ সামান্য স্পর্শ যেন সর্গসুখ এনে দিচ্ছে হৃদয়ে। রেলিং এ রাখা ইচ্ছের আধখাওয়া কফির মগে তৃপ্তির সাথে ঠোঁট ছোয়ালো সে। ইচ্ছের মাজে আলাদা এক শিহরণ বয়ে গেল যেন। মুগ্ধ হয়ে দেখলো সে ইহানের পানে। কি অনায়াসে লোকটা তার আধখাওয়া কফির মগে চুমুক বসাচ্ছে। অথচ এই মানুষটা কারো এঁটো তো দূরের কথা নিজের মায়ের হাতের রান্না ছাড়া অন্য কারো রান্নাও মুখে তোলে না। রেস্টুরেন্টে গেলেও তার বাছাইয়ের শেষ থাকে না। ভালোলাগায় ছুঁয়ে গেল মোন। ইচ্ছে আর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাড়ালো। আলতো হাতে ইহানের বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগলো নতুন অনুভূতিকে।
______________
অগ্যত কোন কারণ বসতো ইহান আজ বাড়িতে। ইচ্ছের খুশির অন্ত রইলো না। মানুষটা আশপাশে থাকলে নিজেকে অনেক সুখি সুখি ফিল হয়। সকাল থেকে সে ইহানের আশপাশে ঘুরঘুর করেছে। দুবার নিজ হাতে চা করে দিয়েছে। নিজ দায়িত্বে ইহানের মাথা টিপে দিয়েছে। আজ ইচ্ছে শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজেছে। ইরা বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে তাকে। বারকয়েক আয়নায় নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখেছে। তা দেখে ইরা মুখ টিপে হেসেছে।
দুপুরের খাবারের জন্য ইহানকে ডাকতে গেলে ইহানকে রুমের কোথাও খুঁজে পেল না। রুম থেকে বের হতে নিতেই ইরার সম্মুখীন হলো। তাকে দেখা মাত্র ইরা দুষ্টু হেসে বললো,
“ভাইকে খুজছো বুঝি?”
ইচ্ছে আমতা আমতা করলো। তা দেখে ফিক করে হেসে ফেলল ইরা। হাসতে হাসতেই বলল,
“ভাই বাগানের দিকে গেছে। খুঁজে আনো গিয়ে।”
ইচ্ছেও তাই বাগানের দিকে গেল। দূর থেকে দেখলো বাগানে পাতানো চেয়ারে বসে ফোনে কথা বলছে ইহান। কপালের ভাঁজ স্পষ্ট। মুখে গম্ভীরতা এটে কাউকে ধমকে চলছে। কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে ইহানকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিল। আনমনে বলল,
“লোকটা কি তার পুরোনো রূপে ফিরে যাচ্ছে নাকি?”
ইচ্ছে ভাবলো এমনটা যদি হয় তাহলে দেখা যাবে দিনে তিন বেলা ভাতের বদলে তাকে ধমকি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে। কি ভয়ংকর ব্যাপার সাপার! ভাবনার মাঝে ইহান কখন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তার খেয়াল নেই ইচ্ছের। সে আপাতত অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তায় চিন্তিত। তখনি তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কেউ বলে উঠলো,
“আমায় বশীভূত করার নতুন মন্ত্র রপ্ত করেছ দেখছি।”
ইচ্ছে চমকে উঠে দূরে যেখানে ইহান বসেছিল সেদিকে তাকালো। কিন্তু সেখানে কেবল ফাঁকা চেয়ারটি পড়ে রয়েছে। ততক্ষণে একজোড়া হাত তাকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরেছে। শিউরে উঠলো ইচ্ছে। এই স্পর্শ সহ্য ক্ষমতার বাহিরে। চোখ খিচে বন্ধ করে নিল ইচ্ছে। তোলপাড় শুরু হলো বুকের ভেতরে। বক্ষপিঞ্জর ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটা। ইহান কিছুটা ঝুকলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় ইচ্ছের কানের পিঠে ছোট্ট করে চুমু একে দিল। হৃৎপিণ্ডটা থমকে গেল কিছু সময়ের জন্য। তীরতীর করে কাঁপতে থাকা বদ্ধ চোখের পাতা ধপ করে খুলে গেল। বিস্ময় শ্বাস নিতে ভুলে গেছে যেন ইচ্ছে। ইহান নিচু কন্ঠে শুধালো,
“আমার ইচ্ছেকে আর একটু ছুঁয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা ডানা ঝাপটাচ্ছে। আই কান্ট কন্ট্রোল। মে আই?”
ইচ্ছের মনে হলো এই লোকটা আজ তাকে মেরে ফেলার বন্দোবস্ত করেছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে ইচ্ছের। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি লোপ পাচ্ছে। ইহানের দুহাতের বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে চাইছে মোন। ইহানকে বাঁধা দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও মুখ ফুটে একটা শব্দও বের হলো না। শব্দরাও যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার থেকে। ততক্ষণে একজোড়া তপ্ত ওষ্ঠের উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব হলো কাঁধে। অযাচিত এই স্পর্শে তীব্র কম্পন সৃষ্টি হলো দেহে। সময় নিয়ে সরে দাঁড়ালো ইহান। ইচ্ছে তখনো চোখ বন্ধ রেখে দাঁড়িয়ে। ইহানকেও অস্থির দেখালো। বড় বড় পা ফেলে বাড়ির ভেতরে পা রাখলো। যাওয়ার পূর্বে ইচ্ছেকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভেতরে আসো।”
ইচ্ছে এলো মিনিট দশেক বাদে। ডায়নিং টেবিলে সবাই তখন খেতে বসে পড়েছে। ইহানের পাশের চেয়ার টেনে বসলো সে। ইহান একমোনে নিচ দিকে তাকিয়ে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। কোনোদিকে তার নজর নেই। যেন এই মুহুর্তে এটাই তার একমাত্র কাজ। ইচ্ছেও চুপচাপ খেতে শুরু করলো। অন্যদিনের মতো আজও টেবিলে কথার অসর বসলো। ইহান হু হা করেই কাটালো। কোন রকম খাবার শেষ করে এক প্রকার পালালো যেন।
ইচ্ছে অবিশ্বাস্য নয়নে চেয়ে রইল। এই লোক তো দেখছি নিজেই লজ্জায় মরে যাচ্ছে।
___________
কেটেছে সময়। গড়িয়েছে দিন খন। উন্নতি হয়েছে সম্পর্কের। তিন মাস গড়িয়েছে বিয়ের। ইহানের প্রতি ইচ্ছের অনুভূতি প্রগাঢ় হয়েছে। অবাধ্য হয়েছে মোন। যখন তখন টুপটাপ চুমু খেয়ে লজ্জায় নেতিয়ে পড়ে সে। এইতো বেশ কিছুদিন আগের কথা। মেঘাচ্ছন্ন বিকেল তখন। আকাশে কালো মেঘের ভেলা ভাসছে। যখন তখন ঝুপ করে নেমে আসতে পারে। থেকে গর্জে উঠছে আকাশ। ইহান ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেটে ফুক দিয়ে ধোয়া গুলো আকাশে ওড়াতে ব্যাস্ত। আজকাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরানো হয়না ইচ্ছের কথা ভেবে। বাড়িতে থাকলে ছাদে এসেই এই বিষাক্ত ধোঁয়া নিজের ভেতর টেনে নেয়। এটা অন্য রকম একটা প্রশান্তি। নয়তো নিজের ক্ষতি জেনেও কেন লোকে এতে আসক্ত হবে?
ইচ্ছে কখন নিঃশব্দে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি ইহান। দু ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট গুজে দক্ষ ভাবে টান দিচ্ছে তাতে। হঠাৎ কেউ ছিনিয়ে নিল সেটা। ছুড়ে দিল কিছুটা দূরে। আকষ্মিক আক্রমনে হতবাক হয়ে তাকালো ইহান। চোখা জোড়া ছোট ছোট করে চাইতেই ইচ্ছে কড়া কন্ঠে শুধালো,
“যে বাতাসে আপনার প্রিয়জনেরা শ্বাস নেয়, সেই বাতাসকে বিষক্ত করার অধিকার আপনার নেই।”
পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ইহান। সাদা রঙের কামিজ পড়িহিত মেয়েটা এখনো কঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইহান নিঃশব্দে হাসলো। তার হাসি দেখে রমনী বিরক্ত হলো যেন। ইহান কন্ঠ খাদে নামিয়ে আস্তে করে বলল,
“যেটা আমার কোমল ইচ্ছেকে কঠিন হতে বাধ্য করেছে সেটা আমি নাইবা ছুলাম!”
প্রেয়সীর হৃদয়কে ঘায়েল করতে আর কি দরকার? এ অসামান্য কথাতেই তার বুক শীতলতায় ছেয়ে গেছে। লোকটার কথায় সে বরাবরই মুগ্ধ হয়। এত মুগ্ধতা কেন তাতে? এই কথা দ্বারাই তার সর্বস্ব কেড়ে নিল লোকটা। মোনটাযে ডুবেছে তীরে ওঠার কোনো রাস্তা নেই সামনে।
ঝপঝপ কড়ে বৃষ্টি কণা আছড়ে পড়তে শুরু করলো। দূরে কোথাও বিকট শব্দে বাজ পড়লো বোধহয়। ইচ্ছে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাড়ালো ইহানের সাথে। অসংখ্য বৃষ্টি কণা ছুঁয়ে দিতে লাগলো তাদের। ভিজিয়ে দিল মানব-মানবীকে। ইচ্ছের ভালো লাগলো। প্রেমময় একটি পরিবেশে প্রেমিক পুরুষটির সাথে বৃষ্টিবিলাস! এর থেকে রোমাঞ্চকর আর কি হতে পারে? ইহানের ঠোঁট জুড়ে তখনো মুগ্ধকর সে হাসির প্রলেপ ছড়িয়ে আছে। সপ্রতিভ সরল সে হাসি। চোখ দুটো ইচ্ছেতে নিবদ্ধ। ভেজা চুল গড়িয়ে পানি নাক ঠোট ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে চেয়ে রইল সেদিকে। বুকের ভেতর অনুভূতিরা হরতালে নেমেছে। অনুভূতির সমুদ্রে গা ভাসিয়ে দিন দুনিয়া ভুলে সে ইহানে হারিয়ে গেল। অজান্তেই কতটা কাছাকাছি এসেছিল তারা জানা নেই। তবে এক দীর্ঘ চুম্বনের সাক্ষী হয়েছিল সেই বৃষ্টি স্নাতক বিকেল। দীর্ঘ চুম্বন শেষে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে ইচ্ছে বলেছিল,
“আপনার এ নোংরা ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দেওয়ার লোভ আমার এ জীবনে মিটবেনা।”
চলবে.………..