আমার আকাশে তারা নেই ২ পর্ব -১৪

#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৪.

ইচ্ছে‌ নিজেকে তেমন ভাবেই তৈরি করছে যেমনটা নাজমুল সাহেব চাইতেন। এই মানুষটা পাশে ছিল বলেই সে এতদূর আসতে পেরেছে। তার একার জন্য এটা মোটেই সহজ ছিল না। ক্ষমতা টাকার সাহায্যে অতি দ্রুত ভিষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন নাজমুল সাহেব। ইরা পাশে থেকে সাহায্য করেছে। মনোবল তৈরি করেছে। যাকে ভালোবেসে ইচ্ছে নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে চেয়েছিল সে বাদে বাকি সবার পাহাড় সমান ভালোবাসা সে পেয়েছে। কেবল যাকে চেয়েছে তাকেই পায়নি। তবুও ইচ্ছে ভাবে তার কথা। তার সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা। তার করা ছোট ছোট কেয়ার গুলোর কথা। সময়গুলো হয়তো খুব স্বল্প ছিল কিন্তু জীবনের সবথেকে মূল্যবান আর মিষ্টি মূহুর্ত ছিল সেগুলো। এত সহজেই কি তা ভুলে থাকা যায়?
ইচ্ছে একটা বেকারির দোকানে পার্টটাইম কাজ করে। দোকানের মালকিনের ব্যাবহার অসাধারণ। মাঝ বয়সি মহিলা দেখতে এখনো বেশ সুদর্শন। হুট করে দেখে তার বয়স ঠাহর করা যায় না। কাজের সময়টুকু বেশ ভালোভাবেই কাটে ইচ্ছের। মালকিনের নাম জেনি‌। মিশুক স্বভাবের হওয়ায় হাসি মজায় সময় পার হয়ে যায়। তবে মজার কথা হলো এখানের কেউ ইচ্ছের নাম উচ্চারণ করতে পারে না। তাদের মুখে ইচ্ছের নামটা খুব বেশিই জঘন্য শুনতে। জেনি আন্টিতো না পেরে এখন উইশ বলে ডাকে। ইচ্ছেও মেনে নিয়েছে। ওমন জঘন্য ডাকের তুলনায় এটা বেশ ভালো।
আজকাল ইচ্ছে লক্ষ করছে জেনি আন্টির ছেলে বেশ ঘন ঘন আসা যাওয়া করে। সুযোগ পেলেই ইচ্ছের সাথে কথা বলার বিভিন্ন কারণ খুঁজে। অতিমাত্রায় সুদর্শন এই ছেলেকে ইচ্ছের একদমই পছন্দ নয়। কেমন গায়ে পরা স্বভাব! তবুও সে কিছুই বলতে পারে না জব হারানোর ভয়ে। ছেলেটার নাম ডিউক। ইচ্ছে যথাসম্ভব এর থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলে। ছেলে মানুষের উপর কোনো বিশ্বাস নেই।

_______________

ইচ্ছে চলে গেছে আছ দুমাসের বেশি সময় হয়ে গেছে। ইহান এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। জব ছেড়ে দিয়েছে সে। এখন সর্বদা রুমের মাঝে নিজেকে আটকে রাখে। শারমিন বেগম ছেলের এ অবস্থা দেখে কেঁদে বুক ভাসান। স্বামীকে অনুরোধ করেন ইচ্ছের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কিন্তু নাজমুল সাহেব চেয়েও সেটা পারছেন‌ না। যোগাযোগের সব রাস্তাতো সে নিজ থেকেই বন্ধ করে দিয়েছিল। ইচ্ছেকে বারবার করে বলে দিয়েছিল এখানের কারো সাথে যোগাযোগ‌‌ না রাখতে। ইচ্ছে কোথায় আছে কেমন‌ আছে কিভাবে তার কিছুই জানে না তারা। এখন কেবল আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা ব্যাতীত কিছু করার নেই তাদের। সব কিছু আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।
রুশা এখনো চৌধুরী বাড়িতেই আছে। সকলে তাকে মেনে নিয়েছে। ইচ্ছেকে সেদিন চলে যেতে দেখে সে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। তার জন্য একটা সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল এটা সে মেনে নিতে পারেনি। তাই সেদিন সকলকে সবটা খুলে বলেছিল। ইহানের সাথে তার পরিচয় ভার্সিটিতে থাকাকালীন। ইহানের একবছরের জুনিয়ার ছিলো রুশা। ইহানের ভার্সিটিতে বেশ নাম ডাক ছিল। চার্মিং বয় কিনা! নুহাশ ইহানের সাথে একই ভার্সিটিতে একই ডিপার্মেন্ট এ ছিল। সে ইহানের অনেক কাছের ছিল। সর্বদা তাদেরকে একসাথে দেখা যেত। তাদের বন্ডিং ছিল নজর কাড়া। ইহান চুপচাপ গম্ভীর স্বভাবের হলেও নুহাশ ছিল সম্পূর্ণ তার বিপরীত। মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং এ তার জুড়ি নেই। জামা বদলানোর মতোই সে গার্লফ্রেন্ড বদলাতো। এক নম্বর প্লেবয় যাকে বলে আরকি। তার এ স্বভাবের কথা ভার্সিটির সকলের জানা ছিল তবুও কোনো মেয়েই কখনো তাকে ফেরাতো না। ইহান ও কখনো এ নিয়ে কিছুই বলতো না। যেখানে মেয়েরা জেনে বুঝে খাদে ঝাঁপ দিচ্ছে সেখানে সে বাঁধা দেওয়ার কে? তাছাড়া এসব মেয়েদের বিষয় থেকে বরাবর সে দূরে থাকে। এটা নিয়ে বন্ধুরাও বিভিন্ন ভাবে মজা উড়িয়েছে। কিন্তু তাতে সে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। রুশা প্রথম যেদিন ভার্সিটিতে এডমিশন নেয় সেদিনই তার পরিচয় হয় নুহাশের সাথে। রুশা শান্ত স্বভাবের হলেও বেশ কঠোর প্রকৃতির ছিল। কথা বলার ভঙ্গিমা দারুন। ব্যাপারটা মুগ্ধ করে নুহাশকে। এরপর থেকে সে রুশার সামনে পেছনে ছুটতে শুরু করে। রুশা কখনোই তার পাত্তা দিত না। পরিবর্তন দেখা গেল নুহাশের মাঝে। যে ছেলেটা আগে দিনে চার পাঁচটা মেয়ের সাথে ডেট করতো সেই ছেলেটা মেয়েদের এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। ঘন্টার পর ঘন্টা রুশার হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো। রুশা বাধ্য হয়ে ইহানের কাছে কমপ্লেন জানায়। ইহানের সম্পর্কে রুশা জানতো। তাই ইহান ছিল তার ভরসা। ইহান নুহাশকে সরে যেতে বললে নুহাশ মেন্টালি ভেঙে পড়ে। তার এ অদ্ভুত পরিবর্তন দেখে বন্ধু মহলের সকলে হতভম্ব। ইহান এ ব্যাপারে নুহাশকে কনভেন্স করলে সে জানায় রুশার প্রতি অনুভূতি গুলো তার মিথ্যে নয়। বরং রুশা ছিল তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। ইহান নুহাশকে টাইম নিতে বলে নিজের অনুভূতিকে বোঝার জন্য। সময় কাটে। সপ্তাহ খানেক না যেতেই নুহাশ পাগলামি শুরু করে। ওর পাগলামিতে বাধ্য হয়েই ইহান রুশার সাথে মিট করে। নুহাশের ব্যাপারে সবটা শুনে রুশার মনও নরম হয়। তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছিল। ইহান তাকে ভরসা দেয়। কথা দেয় নুহাশের দ্বারা কোনো ক্ষতি হবেনা তার। ইহান সর্বদা ঢাল হয়ে থাকবে তার পাশে। রুশা অনাথ ছিল। আপন বলতে কেউই ছিল না। বড় ভাইয়ের মতো ইহানকে পেয়ে সে যেন একটা ভরসার হাত খুঁজে পায়। নুহাশের প্রতি কিছুটা জড়তা থাকলেও ইহানের ভরসায় সে নুহাশকে মেনে নেয়। শুরু হয় এক মিষ্টি প্রেম কাহিনী। ভালোবাসার গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে দুজনের মাঝের গভীরতাও বাড়তে থাকে। কেটে যায় তিন বছর। ইহান নুহাশ পড়াশোনা শেষ করে কর্ম জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে যার মতো। তাদের আলাপ ও কমতে শুরু করে। একসময় নুহাশ আর রুশার খোঁজ খবর নেওয়াও আর হয়ে উঠতো না ইহানের। এরপর ইহানের বিয়ে হলো। নুহাশ সে সময়ে চাকরির সুবাদে দেশের বাইরে ছিল। ইহানের বিয়েতে সে জয়েন হতে পারেনি। এরপর নুহাশের বিয়ের ঠিক কিছুদিন আগেই ইহান জানতে পারে নুহাশ আর রুশার ব্রেকআপ এর কথা। অবাক হয় সে। তার জানা মতে রিলেশন নিয়ে রুশা নুহাশ দুজনই ভিষণ সিরিয়াস ছিল। তাহলে কি এমন হলো যে আলাদা হয়ে গেল দুজন। অবাক হওয়ার সাথে সাথে অপরাধ তাকে ঘিরে ধরে। কথা দিয়েছিল সে রুশাকে আগলে রাখার। সে কথা সে রাখতে সক্ষম হয়নি। সে তো রুশা কোথায় আছে কেমন আছে সেটাই জানে না। চিন্তিত হয়ে নুহাশকে কল করলে নুহাশ তার ফোন ধরেনি। এরপর জানতে পারলো নুহাশের বিয়ের কথা। সেখানে যেয়ে তার নুহাশের সাথে এ বিষয় নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি হয়। সেদিন রাতে লুকিয়ে রুশা দেখা করতে আসে নুহাশের সাথে। মেয়েটার আগের মতো সৌন্দর্যতা নেই। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। একটু মোটাও হয়েছে। পড়নের কাপড়টাও অগোছালো। আগের মতো পরিপাটি নেই। রুশা নুহাশকে মানানোর চেষ্টা করে। উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অনেক আকুতি মিনতি করেও যখন লাভ হয়না তখন সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তাদের এভাবে কথা বলতে ইহান দেখে ফেলে। নুহাশ বাড়ির ভেতর চলে গেলে ইহান যেয়ে রুশার সাথে দেখা করে। তখন সে জানতে পারে রুশা নুহাশের সন্তান গর্ভে বহন করছে। এটাও জানতে পারে নুহাশ কেবল তাকে ব্যাবহার করেছে। সে তো কখনোই রুশাকে ভালোবাসেনি। রুশার এভোয়েড করাটা সে মেনে নিতে পারেনি তাই এতসব নাটক ছিল। এসব কিছু জানতে পেরে ইহান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ সে কখনোই ভাবতে পারেনি নুহাশ এতটা নিচ অবদি নেমে যাবে। তার আফসোস হচ্ছিলো খুব। কারণ সেই তো রুশাকে তার উপর ভরসা করে নুহাশকে মেনে নিতে বলেছিল। সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটার এমন করুণ অবস্থা দেখে তার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিলো। বারবার মনে হচ্ছিল মেয়েটার জীবন তার হাতেই নষ্ট হয়েছে। সে কি আর এই মেয়েটার জীবন গুছিয়ে দিতে পারবে?

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here