আমার_পূর্ণতা #রেদশী_ইসলাম পর্বঃ ২৪

0
507

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ২৪

প্রকৃতিতে সকাল নেমেছে। বাইরে রোদ উঁকি দিচ্ছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে সবাইকে উঠার আহবান জানাচ্ছে। তাফসির উঠে দরজা খুলে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়াতেই ঠান্ডা হাওয়ার শরীর ছুঁয়ে দিলো। এখন ডিসেম্বর মাস। এ সময় কানাডায় বেশির ভাগ দিনই বরফে আচ্ছাদিত থাকে। গাছের পাতা সহ শুরু করে রাস্তাঘাট সব জায়গাতেই বরফের মোটা আস্তরণ। ওয়েদার ফোরকাস্টে মাইনাস ডিগ্রি দেখাচ্ছে। অফিসও ছুটি আছে আজ।
তাফসির ফ্রেশ হয়ে শাহিনকে ডেকে ওঠালো ঘুম থেকে। শাহিন ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে লিভিং রুমের সোফায় ধপ করে শুয়ে পরলো। শাহিনের দিকে এক পলক তাকিয়ে তাফসির ব্রেকফাস্ট রেডি করতে থাকলো। তাফসির টোস্টারে ব্রেড দিতে দিতে শাহিনের গলা পেলো।

” ভাই তোর ফোন বাজছে। নিয়ে আসবো? ”

” হ্যাঁ নিয়ে আয়। ”

অনুমতি পেয়ে এক লাফে সোফা থেকে উঠে ফোন আনতে গেলো শাহিন। রুম থেকে বের হতে হতে বললে—

” উইলসন ফোন দিচ্ছে। এখন আবার ওর কি দরকার?”

” ফোন রিসিভ করলেই না বুঝবো? ”

তাফসির শাহিন থেকে ফোন নিয়ে কানে ঠেকাতেই উইলসন বললো—

” কি খবর তাফসির কি করছো? ”

” ব্রেকফাস্ট রেডি করছি। কি হয়েছে এতো সকাল সকাল ফোন দিলে যে? আজ তো অফিস ছুটি। ”

” আজ যে আমার বার্থডে এটা কি তোমরা ভুলে গেলে তাফসির? একবার তো উইশ ও করলে না। ”

কিছুক্ষণ ভাবার পর মনে পরলো যে হ্যাঁ আজ তো উইলসনের জন্মদিন। কিন্তু তার তো মনে নেই। অবশ্য মনে না থাকায় স্বাভাবিক। ইদানীং তার উপর যে প্রেশার যাচ্ছে। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো—

” দুঃখিত উইলসন। জানোই তো কি পরিমাণ প্রেসারে আছি। একদমই ভুলে বসেছি। আমি সত্যিই দুঃখিত। যাই হোক শুভ জন্মদিন। ”

” ধন্যবাদ। আচ্ছা সেসব বাদ দাও। রাতে একটা পার্টি রেখেছি। অবশ্যই আসছো তো তুমি আর শাইন? ”

” সঠিকভাবে বলতে পারছি না। আসার চেষ্টা করবো। ”

” আমি কোনো কথা শুনতে চাই না তাফসির। তোমরা আসছো তো আসছোই। তোমরা না আসলে আমি অনেক কষ্ট পাবো। ”

” আচ্ছা বেশ। আসবো। ”
.
.
.
.
সপ্তাহ খানিক হলো প্রাচুর্যের কলেজে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তবুও ছুটি পাওয়া দুষ্কর। যেহেতু কিছুদিন পরেই এইচএসসি তাই পড়ার চাপ ও অনেক বেশি। যেমন এখনো সে পরার টেবিলে বসে আছে। এর মধ্যে ঘরের ভেতর উঁকি দিলো রিয়া। মাথা অর্ধেক ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করলো—

” এই প্রাচুর্য পড়ছিস? থাক তাইলে পরে আসবো। ”

” সমস্যা নেই আপু। আসো তুমি। ”

রিয়া ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসতে বসতে বললে—

” তাফসির ভাই কবে আসবে রে? ”

” বললো তো খুব তাড়াতাড়ি আসবে। কেনো? ”

রিয়া করুন স্বরে বললো—

” বাবা আজকেও একটা পাত্র পক্ষ আনছে। আমি আর কতো রিজেক্ট করবো বল! রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছি তো। ভাইয়া তো বললো ম্যানেজ করবে কিন্তু বাবা যদি না শোনে তখন? ”

” আরে শুনবে শুনবে। অতো চিন্তা করো না তো। ”

” চিন্তা করবো না বলছিস? আমার তো মনে হচ্ছে যেভাবেই হোক আজকের ছেলেটার সাথে আমার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। কারন এতোদিন তো যতগুলো বাহানা শিখেছি সব দেওয়া শেষ। আর কি বাহানা দেবো বল। ”

” আরফান ভাইয়াকে বলো পরিবার নিয়ে দেখতে আসতে। তুমি আর কতোদিন অপেক্ষা করবে বলো। ”

” আর আরফান। ওই ব্যাটা আস্ত এক বজ্জাত। প্রতিদিন তিন বেলা করে বলছি যে বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসো। ব্যাটা আসবো আসবো করে আসেই না। আজকে আর একবার বলবো। আসলে আসলো নাইলে একদম ব্রেকআপ। হুহ আমিও কম যায় না। ”

” তাফসির ভাইকে বলো যেনো আরফান ভাইয়াকে বলে প্রস্তাব নিয়ে আসতে। উনি বললে আরফান ভাইয়া শুনবে আমি শিওর। ”

” বলেছি ভাইয়াকে। ভাইয়া বলেছে জানাবে। ভাগ্যিস ভাইয়া একটু ম্যানেজ করছে বাবাকে। আমাকে বিয়ে আটকানোর পথ বলে দিচ্ছে নাহলে তো সেদিনই বাবার সেই বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যেতো। ”

” এক্ষেত্রে ক্রেডিট কিন্তু আমারই৷ আমি যদি না বলতাম তাহলে তাফসির ভাই জানতো কোথা থেকে বলো। তুমিও তো বলো নি প্রথমে। ”

” আরে আমি তো ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ভাইয়া রাজি হবে না। পরে দেখি ওমা সে-তো রাজি। তখন যে কি খুশি লাগছিলো জানিস না। আর আমি জানি ভাইয়া রাজি মানেই কোনো না কোনোভাবে বাবা ও রাজি হয়ে যাবে। আচ্ছা তুই কিভাবে জানলি আমার আর আরফানের রিলেশনের কথা। ”

” সারাদিন যেভাবে ফুসফুস করে কথা বলতে। আগে তো তোমার হাতে তেমন একটা ফোন ই দেখা যেতো না আর এখন তো খেতে গেলেও ফোনটা সাথে নিয়ে যাও। তাই সন্দেহ হয়েছিলো আমার। আর তারপর কিভাবে শিওর হলাম জানো? টিএসসিতে তোমাকে আর আরফান ভাইয়াকে একসাথে দেখেছিলো প্রিয়তি। ওই আমাকে বলেছিলো। ”

” ভালোই কুটনী আছে তো। ওরে তো ভালো ভাবতাম। ”

” যাহ কিসব বলছো। ভুলে যেয়ো না ও কুটনামতি করেছে বলেই কিন্তু আমি জানতে পেরেছি। আর আমার থেকে তাফসির ভাই। ”

” লিস্টে তুই ও আছিস দেখছি। ”

” ইহ ছিলাম বলেই বিয়ে এখনো আটকাতে পেরেছো। কোথায় বাহবা দিবা তা না। ”

এর মধ্যেই ঘরে ঢুকলো মিসেস মুমতাহিনা। তিনি রিয়াকে দেখেই চিল্লিয়ে বললেন—

” তুই এখনো এখানে বসে আছিস? ওইদিকে পাত্র পক্ষ চলে আসলো বলে। যা তাড়াতাড়ি রেডি হ। প্রাচুর্য ওকে রেডি হতে হেল্প কর তো। আর শোন রিয়া সুন্দর শাড়ি পরবি সাথে সুন্দর করে সাজবি। যেনো পাত্র পক্ষের দেখলেই পছন্দ হয়ে যায়। যদি অন্যদিনের মতো করিস তাহলে আজকে তোর বাবা হাড্ডি গুড্ডি আলাদা করে দেবে মনে রাখিস। ”

বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো মুমতাহিনা বেগম। সাথে সাথে রিয়া মুখ ভেঙচি কেটে বললো—

” সুন্দর করে রেডি হবো না তো আরও কতো কি করবো!!এমন ভাবে রেডি হবো যাতে পছন্দ তো দুরেরই কথা সাথে সাথে রিজেক্ট করে দেয়। ”

” থাক আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। চলো তোমাকে রেডি করে দি। ”

এই তিন মাসে রিয়া নানা রকম বাহানা দিয়ে বিয়ে ভেঙেছে। আর সেসব বাহানা তাফসিরই শিখিয়েছে রিয়াকে। তাদের ভাই-বোনের এসব কাহিনি দেখে মাঝে মাঝে প্রাচুর্যের হাসতে হাসতে পেট ফেটে যায়। সেদিন প্রাচুর্য নিজের সন্দেহের কথা বলেছিলো তাফসিরকে। কিন্তু তখন তাফসির কিছুই বলে নি। পরে যখন ইকরাম চৌধুরীর বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হবে হবে ভাব সেই মুহুর্তে রিয়ার মাথায় সর্ব প্রথম তাফসিরের কথায় মাথায় আসলো। সেই মুহুর্তে তাফসির ছাড়া আর কেউই সাহায্য করতে পারতো না তাকে। আর সে জানতে যদি তাফসিরকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে তাহলে নিশ্চয়ই বুঝবে সে। কারন সে নিজেও তো প্রাচুর্যকে ভালোবাসে। তাই ভালোবাসার মর্ম টা অন্তত বুঝবে। অনেক দেনা মনা করে ভয়ে ভয়ে সে তাফসিরের সামনে স্বীকার করলো সব। তাফসির পরে আরফান সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়েই রাজি হয়েছে। আর ততোদিনে রিয়াও তাফসিরের সাথে আরফানের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এখন দু’জনের সম্পর্ক ও বেশ ভালো।

” আপু দেখো তো সব ঠিকঠাক আছে নাকি? ”

প্রাচুর্যের কথায় ঘোর কাটলো রিয়ার। সে এতোক্ষন মনে মনে নানা জল্পনা কল্পনা করছিলো কিভাবে বিয়ে ভাঙা যায়। এবার নিজের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে নাক শিটকালো সে। গজগজ করে বললো—

” তোকে বললাম এতো ভালো ভাবে সাজাতে হবে না। তুই সেই ঠিকভাবে সাজিয়ে দিলি। আয়না টা ও দেখতে দিলি না। ধুর তুই কোনো কাজেরই না। ”

” শোনো কপালে যা আছে তাই হবে। তুমি ভালো করে সাজলেও কি আর না সাজলেও কি। ”

” পাত্র পক্ষ চলে এসেছে। নিচে চল। “__ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন মিসেস ফারাহ।

পাত্র পক্ষ চলে এসেছে শুনেই হাত পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেলো রিয়ার। মানে আবার সেই সেজেগুজে বসে থাকতে হবে অন্য পুরুষের সামনে। মনে মনে একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের জন্য সেজে বসে থাকা যে কি পরিমাণ কষ্টের সেটা যার সাথে হয় একমাত্র সেই বোঝে। এর মধ্যেই মিসেস ফরাহ উঠে দার করালেন রিয়াকে। মাথায় ভালো করে ঘোমটা টেনে রিয়াকে সাথে করে নিয়ে গেলেন। আর প্রচুর্য সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। তাফসিরের কঠর নিষেধাজ্ঞা আছে যেনো বাড়িতে রিয়াকে দেখতে আসলে সে কখনো নিচে না যায়। না জানি কখন দেখা গেলো আবার পাত্র পক্ষ তাকে পছন্দ করে বসলো। আর সে তার বউকে নিয়ে এক বিন্দু রিস্ক নিতেও রাজি নয়।
রিয়া শক্ত করে মিসেস ফারাহর হাত ধরে আস্তে নিচে আসলো। আর ফারাহ বিভিন্ন কথা বলে ভরসা দিচ্ছে রিয়াকে। এতো টুকু পথ সে একটুও মাথা তুলে তাকায়নি। সে অবস্থাতেই সে সালাম দিলো সবাইকে। সালামের উত্তর দিয়ে একটি মহিলা শান্ত কন্ঠে বললেন—

” এসো মা তুমি আমার পাশে এসে বসো। ”

মিসেস ফারাহ হাতে হাতে মহিলাটির পাশে এনে বসিয়ে দিলো রিয়াকে। বাড়িতে ইশতিয়াক চৌধুরী বা ইনসাফ চৌধুরী কেউই নেই। ব্যবসার কাজে বাইরে গেছেন তারা তাই ইকরাম চৌধুরীই সব সামলাচ্ছেন। হঠাৎ ইকরাম চৌধুরী ভরাট কন্ঠে সামনে বসে থাকা যুবকের উদ্দেশ্যে বললেন—

” তো তুমি তাফসিরের বন্ধু? ”

” জ্বি ”

” নাম কি তোমার?”

” আরফান খন্দকার ”

রিয়া নামটা কি ঠিক শুনলো? বুক কেঁপে উঠলো তার। এই ঠান্ডার মধ্যে ও কেমন গরম লাগছে তার। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে যেনো। ধীরে ধীরে মুখ তুলে পাশে তাকাতেই বিমূর্ত হয়ে গেলো সে। না ভুল দেখেনি সে। এটাই তো তার প্রেমিক পুরুষ। যাকে সবটা উজাড় করে ভালোবাসে সে। অবশেষে এতোদিন পর আসলো তবে। কিন্তু সে তো কিছু জানে না। কোথার থেকে কি হলো।

” তাফসির যখন তোমার কথা বলেছে সেহেতু বোঝায় যাচ্ছে তুমি ভালো ছেলে। আমার আর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। যায় হোক কি করো তুমি? ”

” এস আর কোম্পানির নাম শুনেছেন আশা করি। আমি সেখানকার ম্যানেজার পদে আছি।”

রিয়া মনে মনে ভাবলো—এস আর কোম্পানির ম্যানেজার মানে কও? কবে পেলো জব? সে তো কিছুই জানে না।

” হ্যাঁ শুনবো না কেনো। ভালো বড় কোম্পানি। তা আমার মেয়ের ভরনপোষণ পোষাতে পারবে তো? ”

আরফান হালকা হেঁসে বললো—

” কি বলছেন আঙ্কেল? আপনার মেয়ে তো রাক্ষস নয় যে ভরনপোষণ পোষাতে পারবো না। আশা রাখছি পারবো। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। ”

” বেশ। তো কেমন লাগলো আমার মেয়েকে? পছন্দ হয়েছে? ”
.
.
.
গভীর রাত। গালে পিঠে কারও আলতো হাতের স্পর্শে ঘুম হালকা হলো তাফসিরের। বোঝার চেষ্টা করলো কি হচ্ছে তার সাথে। এখনো ঘুম পুরোপুরি ভাঙে নি তার। ঘুমিয়েছে ঘন্টা খানিক হলো। তাই ঘুম এখন গাঢ় হবে এটাই স্বাভাবিক। এখনো বাইরে থেকে মৃদু মিউজিকের আওয়াজ আসছে। ছেলে থেকে শুরু করে মেয়ে সবাই-ই মদ খেয়ে পরে আছে সোফা থেকে শুরু করে একেক জায়গায়। কারোরই কোনো দিকে হুঁশ নেই। তবে তার সাথে এমন করছে কে? শাহিন? কিন্তু সে নিজেই তো ঘুমিয়েছে তাফসিরের আগে। তবে?

#চলবে

[আজকের পর্বটা অনেকের কাছেই বিরক্ত,বোরিং বা অযৌক্তিক লাগতে পারে। তবে কিছু করার নেই। আমি আস্তে আস্তে কনফিউশান খোলার চেষ্টা করছি। আশা করি ধৈর্য ধরে পরবেন]

[তাফসিরকে খুব তাড়াতাড়িই ফিরিয়ে আনবো]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here