আমি কাউকে বলিনি সে নাম পর্ব ৪

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৪
____________________________

ছেলের নাম আজাদ , একটা সরকারী অফিসের কেরানী ৷ পোস্টিং রাজধানী ঢাকায় ৷ ছেলের সাথে বিশেষ কেউ আসেনি , নিপার বাবা প্রচুর আয়োজন করেছিলেন ৷ কিন্তু দেখা গেলো ছেলে আর কয়েকজন বন্ধু আর একজন মুরুব্বি গোছের মানুষ নিয়ে চলে এসেছে ৷

পাত্রপক্ষ আসার আগেই নিপার মা সুফিয়া বেগমকে বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ৷ আলেয়া বেগমের শোবার ঘরের খাটের পায়ের সাথে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে , যাতে তার চিৎকার আর ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনে পাত্রপক্ষ চলে না যায় ৷ আলেয়া বেগম দরজায় শিকল দিয়ে রূপাকে দরজার সামনে বসিয়ে রেখে গেছেন ও বাড়ি ৷ কন্যা সন্তানকে ভালো না বাসলেও দায়িত্ব অবহেলা করতে পারেন না আলেয়া বেগম ! ও বাড়িতে এখন তার অনেক কাজ , মেহমান তদারকী তাকেই করতে হবে ৷

ঘরের ভেতর থেকে যান্তব আওয়াজ আসছে , আর ভয়ে গুটিশুটি হয়ে যাচ্ছে রূপা ৷ চাচী যে কেন তাকে এখানে বসিয়ে রেখে গেছে কে জানে ! সে যে তার বড় চাচীকে জমের মতো ভয় পায় এটা কী আলেয়া বেগম জানেন না ! মনে মনে চাচীর সাথে ঝগড়া করতে থাকে রূপা ৷ ঐ বাড়িতে কী হচ্ছে এটাও তার জানতে ইচ্ছে করছে খুব , নিপা আপাকে দেখতে আসা ছেলেটা কেমন সেটাও দেখতে ইচ্ছে করছে … এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে রূপার , চাচী ইচ্ছে করেই তাকে এমন আটকে রেখে গেছে ৷ এ আলেয়া বেগমের ভারী অন্যায় !

পাত্রপক্ষকে নাস্তা দেবার পর পাশের ঘরে নিপার বাবা , চাচা আর ভাইয়েরা এক জায়গায় হয়েছে ৷ ছেলের সাথে তেমন কোন মুরুব্বিগোছের কেউ আসেনি , কোন মহিলা মানুষও আসেনি এই বিষয়টা তাদের ভালো লাগছে না ৷ ঘটক আগে থেকে কিছু বলেওনি , এত এত রান্না করা হলো অযথাই ! দরজার কাছে মাথায় ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে ছিল আলেয়া বেগম ৷ একটুখানি গলা খাঁকাড়ি দিয়ে সে মনোযোগ আকর্ষন করার চেষ্টা করলো ভাসুরের ৷ তারপর বললো , “ভাইজান , আগেই এত চিন্তাভাবনা না কইরা পোলার লগে কতাবার্তা কন ৷ আর বেশি ময়মুরুব্বি থাকলেই যে মাইয়্যা সুখে থাকবো এমুন কুনো কতা নাই ৷ আর আমরার মাইয়্যারও বয়স বাড়তাছে , এত বাছ বিচারের না করণই ভালা ৷ আর নিপা আর পোলাডারে একটু আলদা কইরা কতা কইতে দিলে মুনে হয় ভালা হইবো , দোষ নিয়েন না ভাইজান ৷ পোলা মাইয়্যা সংসার করবো , এরার কতা কওনডা দরকার আছে ৷ ”

মানিক মিয়া বউয়ের সব সুরেই সুর মেলান বরাবরই ৷ অভ্যেসবসতই বউয়ের কথায় তাল দিয়ে বলে ফেললেন “হ ভাইজান , নয়নের মা ঠিক কইছে ”

নিপার বাবা আর কথা বাড়ালেন না ৷ আলেয়া বেগমের বাকী কথা তার মাথায় না ঢুকলেও একটা কথা খুব ভালোভাবে ঢুকেছে ৷ তার মেয়ের বয়স বাড়ছে , তাকে পাত্রস্থ করাটাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার ৷

*******

ঘর থেকে বেড়িয়ে কলতলায় যাচ্ছিলো নয়ন ৷ হঠাৎ তার চোখ পড়লো রূপার উপর ৷ তার মায়ের ঘরের দরজায় বসে মেয়েটা ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে ৷ ওদিকে যাবে না যাবে না ভেবেও নয়ন রূপার সামনে গিয়া দাঁড়ালো ৷

—কী রে কান্দিস ক্যান ? মায় মারছে ?

—আমার ডড় করে ভাইজান

—এহন তো সইন্ধ্যাও নামে নাই , কিয়ের ডড় ? ভূতের ? হা হা হা

—হাইসেন না ভাইজান ৷ এই ঘরে বড়চাচীরে বাইন্ধা রাইখা চাচী আমারে দুয়ারে বসায়া গেছে ৷ বড়চাচীরে আমি জম্মের ভয় পাই ৷ কেমুন বাঘের মতন আওয়াজ করে , মনডা কয় আমারে সামনে পাইলেই টান দিয়া ছিঁড়া খাইয়া ফালাইবো !

—হা হা হা , তুইও বড়চাচীর লাহান পাগল হইয়া গেছোস !

—হাইসেন না ভাইজান , আমার ডড় করে ৷

—আইচ্ছা হাসুম না ৷ তোর এইখানে একটু বসি ৷ শোন , জীবনে দেখছোস বড় চাচী কাউরে মারছে ? কাউরে ছিঁড়ে খাইছে ?

—না

—তাইলে এতো ডড়াইস ক্যান ! মানুষটা পাগল , চিল্লাপাল্লা করে , তয় তার অন্তরডা সুস্থ মানুষের চাইতে বহুত খাঁটি ৷ আয় তোরে একখান জিনিস দেহাই ….

নয়ন ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢোকে ৷ পেছনে ভয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে থাকে রূপা ৷ নয়ন হাঁটু গেড়ে সুফিয়া বেগমের কাছে বসে ৷ তারপর সুফিয়া বেগমের রুক্ষ ময়লা চুলে হাত বুলিয়ে দেয় পরম মমতায় ৷ তার গালে , পিঠে হাত বোলায় ৷ সুফিয়া বেগম চেঁচামেচি থামিয়ে একদম চুপ হয়ে যায় …. নয়ন তার বড়চাচীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করে “চাচী , আমারে চিনছেন ? আমি কে কন তো ?” সুফিয়া বেগম হাসে ৷ হেসে মুখ লুকিয়ে বলে “আব্বা”

নয়ন তাকে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ৷ তারপর ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে ৷ রূপা তখনও ঘরেই দাঁড়িয়ে আছে অবাক বিষ্ময়ে ! নয়ন ওর হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে ৷

হঠাৎ অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় রূপার , কেমন যেন পুরো শরীরে বিদ্যুৎ চমকে উঠে …. ভীষণ লজ্জা লাগে তার ৷ লজ্জায় গালগুলো লাল হয়ে যায় , নয়নের দিকে তাঁকাতেও ভীষণ লজ্জা লাগছে তার ৷

নয়নের অবশ্য সেদিকে কোন খেয়াল নেই ৷ সে নিজের মনে বলতে থাকে “দেখলি তো , বড়চাচীরে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নাই … মানুষটা ভালোবাসার কাঙাল ….”

“ভালোবাসার কাঙাল” কথাটা বারবার করে কানে বাজতে থাকে রূপার ৷ এমন কেন হচ্ছে ওর বুঝে উঠতে পারে না সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া অবুঝ মেয়েটি !

চলবে ……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here