আমি তারে দেখেছি পর্ব -০৭ ও শেষ

#আমি_তারে_দেখেছি (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#অন্তিম_পর্ব

শান্তের ঘুম ভাঙ্গলো মধ্য রাতে। পাশে হাত দিতেই বিছানায় শীতলতা ছুঁয়ে দিলো হাতের তালু। চোখ মেলে তাকালো। পাশের স্থানটি ফাঁকা। নবনীতা নেই, অথচ মেয়েটি তার পাশেই ঘুমিয়েছিলো। চোখের ঘুম জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো যেনো। তড়িৎ গতিতে উঠে বসে প্রথমেই তাকালো ঘড়ির দিকে। তিনটে চোয়াল্লিশ বাজে। চোখ ঘোরালো সারা ঘরে। মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো শান্ত। হৃদস্পন্দনটা মাত্রাহীনভাবে বাড়লো। এই গভীর রাতে মেয়েটি কোথায় গেলো?

পিনপতন নীরবতা, ঘরের প্রতিটি প্রাণ এখন গভীর ঘুমে। হেনা বেগম হাই ডোজের ঘুমের ঔষধ খান, ফলে এই সময় তার নাকডাকার শব্দ ব্যতীত কিছুই শোনা যাবে না। ঘরে আজ মেহমানের ঢল, কিন্তু সবাই ক্লান্তির চাদরে ঘুমকে বরণ করেছে। রেবার স্থান হয়েছে রান্নাঘরের ফ্লোরে। ঘরের প্রতিটি ঘরে একবার চোখ বুলিয়েছে শান্ত কিন্তু নবনীতা নেই। শান্তর মুখখানা কঠিন হয়ে উঠলো। কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়লো। বিরক্ত লাগছে, নিজের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এতো গভীর কেনো হতে হলো তার ঘুম। নিজের ঘরে যাবে তখন ই চোখে পড়লো সদর দরজাটা হাট করে খোলা। বুঝতে বাকি রইলো না বাকিটুকু। সাথে সাথেই নিজের ঘরে ছুটলো শান্ত। ল্যাপটপ বের করে জিপিএস ট্রাকারে নবনীতার লোকেশন দেখলো। সে এই মূহুর্তে বনশ্রী রোড নং ২০ এ আছে। সাথে সাথেই শান্তর মনে পড়লো বিভার বাসা বনশ্রী রোড নম্বর চারে। এক সেকেন্ড দেরি না করেই ফোন করলো নির্ভীককে। তিনবার বাজার পর ফোনটি ধরলো নির্ভীক। ঘুমে মোড়ানো ক্লান্ত কণ্ঠ,
“গুড ইভিনিং স্যার”
“নিকুচি করেছে তোমার ইভিনিং, এখন কোথায় আছো?”
“রামপাল থানা, কেনো স্যার?”
“এখন ই বনশ্রী চারে পৌছাও, কুইক।“

বলেই ফোন কেটে দিলো শান্ত। মোবাইল এ ট্রাকারটা অন করেই ছুটে বেড়িয়ে গেলো। তার বুটের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো রেবার। একেই মশার যন্ত্রণাতে নাজেহাল। তার উপরে এমন ধপ ধপ করে ছোটার শব্দ। রেবা চোখ কচলে দেখলো শান্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে ডাকল ও,
“ভাইজান, কই যান”

কিন্তু শান্ত শুনলো না। তড়িৎ গতিতে ছুটে বেড়িয়ে গেলো। রেবা বেচারি মাথা চুলকে দরজা লাগিয়ে দিলো।

শান্তর বাসা থেকে বনশ্রী ত্রিশ মিনিটের দূরত্ব। যেহেতু এখন গভীর রাত, সুতরাং পথ সম্পূর্ণ ফাঁকা। তাই একশত বিশের স্পিডে চালাতে পনেরো মিনিটেই পৌছে যাওয়া যাবে। শান্ত তাই করলো। হৃদয়টা বিশ্রী ভয়ে জর্জরিত। সে জানতো এমন কিছুই হতে চলেছে। নবনীতা আবারোও শিকারে বের হবে। সেই সুযোগে সুপ্ত হায়েনা তার কাজ করবে। দোষ পড়বে নবনীতার উপর। তাই তো নবনীতার আংটিতে জিপিএস ট্রাকার লাগিয়েছিলো সে। যেন নবনীতার প্রতিটি মুহূর্তের খোঁজ তার থাকে। শান্তর ইচ্ছে ছিলো আজ নবনীতাকে পাহারা দিবে। কিন্তু ম/রা/র ঘুম পিছুই ছাড়লো না। উদ্ভ্রান্তের মতো বাইক ছোটালো সে।

নির্ভীক জিপ নিয়ে পৌছালো বনশ্রী চারে, বিভা এখানে পাঁচ ছয় জন মেয়ের সাথে একসাথে থাকে। পড়ালেখার পাশাপাশি সে একটি চাকরিও করে। তাই বনশ্রীর এদিকেই তার বাসা। যদি কলেজ অনেক দূর কিন্তু তাতেও তার আপত্তি নেই। ফ্লাটের সামনের সিসিটিভিটি তখন ও চলছে। নির্ভীক রাস্তার ওপারেই থাকলো। এমন সময় একটি সিএনজি থামলো বিভার বাসার ঠিক সামনে। নির্ভীককে অবাক করে দিয়ে সিএনজি থেকে নামলো নবনীতা। নির্ভীক হতভম্বের মতো চেয়ে আছে, এখন সে বুঝতে পারলো কেনো শান্ত তাকে বিভার বাসার সামনে যেতে বলেছিলো। সিএনজি ওয়ালাকে কচকচে পাঁচশত টাকার নোট ধরালো নবনীতা। তারপর ফোনটা বের করে কাউকে ফোন দিলো। ফোন দেওয়ার ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায় বিভা নেমে গেলো। তার ভীত, সন্ত্রস্ত দেখালো। নির্ভীক এর ই মাঝে শান্তকে জানিয়ে দিয়েছে সবকিছু। শান্ত শুধু বলেছে দেখে যাও, কিছু না হলে কিছু করার প্রয়োজন নেই। ফলে সেও অসহায়। হাত বাঁধা তার। নবনীতা এবং বিভার মাঝে কথোপকথন হল, কিন্তু সেটা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। নবনীতাকে দেখে খুব স্বাভাবিক ঠেকলো নির্ভীকের। একেবারে নিরস্ত্র একটি মেয়ে। তার পরণে লেমন কালারের সালোয়ার কামিজ। চুলগুলো বেনীতে বাধা। কিন্তু মুখখানা কঠিন। বিভা অপরদিকে তাকে অনুরোধ করে কিছু বললো। ঠিক তখন ই নবনীতা তার গ/লা চে/পে ধরলো। মুখে বিজয়ের হাসি। নির্ভীক অবস্থার অধঃপতন দেখে সেদিকে পা বাড়াতেই দেখলো শান্তর বাইক সেখানে উপস্থিত। শান্ত বাইক থেকে নেমেই নবনীতার হাত থেকে বিভাকে ছাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু নবনীতার হাতে যেন দশটি পুরুষের জোর। শান্তকে সে তোয়াক্কা করছে না। মুখে বিকৃত হাসি। শান্ত জোরপূর্বক তাকে ছাড়াতেই সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। বিভা এতোটা সময় শ্বাসরোধে কাশতে থাকলো। তার মুখখানা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। নির্ভীক তাকে সামলালো। এদিকে শান্ত নবনীতার কাছে ছুটে গেলো। অজ্ঞান নবনীতাকে কোলে তুলে নিলো সে। শান্ত স্বরে নির্ভীককে বললো,
“বিভার সাথে কথা বলে তুমি আসো, আমি নবনীতাকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি”
“স্যার জিপটা নিয়ে যান”

জিপ এবং বাইকের চাবি অদলবদল করে শান্ত জিপে তুললো নবনীতাকে। কালো পিচের রাস্তা চিরে গাড়ি এগিয়ে গেলো গন্তব্যে_______

নবনীতার জ্ঞান ফিরলো পরদিন দুপুরে। চোখ মেলতেই স্বাভাবিকভাবে উঠে বসলো সে। তার মুখখানা মলিন। সম্পূর্ণ ঘরে দৃষ্টি ঘোরাতেই দেখলো শান্ত তার সম্মুখে বসে রয়েছে। কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ, দৃষ্টিতে অদ্ভুত চাঞ্চল্য। যেন অনেক প্রশ্ন দাবিয়ে রেখেছে মনের ভেতর। নবনীতা উঠে বসতেই পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো সে। গাঢ় স্বরে শুধালো,
“এখন কেমন লাগছে?”

শান্তর প্রশ্নে হতবাক চোখে তাকালো নবনীতা। প্রশ্নটা যেন হজম হলো না তার। সে তো ঘুমিয়ে ছিলো, তার কি হবে? নবনীতার মুখশ্রীর বিস্ময় শান্তকে বুঝিয়ে দিলো সবকিছু। শান্ত ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। খুব স্তিমিত স্বরে বলল,
“কাল স্বপ্ন দেখেছিলে?”

নবনীতার মুখশ্রী এবার কিছুটা বদলালো। মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। ইতস্তত স্বরে বলল,
“অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি”
“বিভার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে, তুমি বিভার গ/লা চে/পে ধরেছো। স্বপ্নটা কি এমন ই?”
“হ্যা, কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?”

নবনীতার বিস্ময় আকাশ ছুলো। শান্ত এবার তার পাশে এসে বসলো। নরম হাতটা আলতো করে নিলো হাতের ভাঁজে। খুব শান্ত হয়ে বললো,
“নবনীতা, তোমাকে কিছু সত্য বলবো। কঠিন সত্য। মানুষ কঠিন সত্য সইতে পারে না। তোমার ও কষ্ট হবে। কিন্তু একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, আমি আছি তোমার সাথে।“

নবনীতা দিশেহারার মতো চাইলো শান্তর দিকে। শান্ত খুব স্থির কন্ঠে বললো,
“স্বপ্নে ভবিষ্যত দেখার ক্ষমতাটি তোমার নেই নবনীতা। তুমি তাই স্বপ্নের আদলে দেখো যা তোমার অবচেতন সত্তা তোমাকে দিয়ে করায়। এতোকাল তুমি যা দেখেছো সব ই তোমার অবচেতন সত্তার কারসাজি। স্প্লিট পারসোনালিটি রয়েছে তোমার। তুমি নিজেও জানো তা, তাই না?”

নবনীতা উত্তর দিলো না। নতমস্তক বসে রইলো। শান্ত আবার বললো,
“এই সমস্যা তোমার শুরু হয়েছিলো যখন তুমি কেবল কলেজের ছাত্রী। ঠিক সেই সময়ে যখন তুমি প্রথম স্বপ্ন দেখা শুরু করলে। তাই না নবনীতা?”

নবনীতা এখনো চুপ। শান্ত ম্লান হাসলো। নবনীতার হাতটা চেপে ধরলো মৃদুভাবে। তারপর প্রগাঢ় স্বরে বললো,
“এই নির্লজ্জ, অসহ্য লোকটা সব জেনেশুনেই মরণখাদে পা দিয়েছে। তাই তোমাকে মধ্যরাস্তায় একা ছেড়ে যাবার কথা আমি কল্পনাতেও আনি না”

এবার মুখ তুলে চাইলো নবনীতা। বিষন্ন চোখজোড়া হাতড়ালো ভরসা। নিচের ঠোঁটখানা কাঁমড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা চালালো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। তার এই মানসিক সমস্যাটি তার জানা। এর জন্য কম ডাক্তার তাকে দেখানো হয় নি। তার মাঝেই একজন সিফাতুল্লাহ আকবর। তুষারের কেসটির সময় ই নবনীতার ফাইলটি হাতে পড়ে শান্তর। বিয়ের দিন সে সিফাতুল্লাহ এর সাথে এই বিষয়েই কথা বলতে গিয়েছিলো। জসীম সাহেব সকলের আড়ালে শান্তকে রুমে নিয়ে নবনীতার এই সমস্যাটির কথাই জানিয়েছিলেন। নবনীতার অবচেতন মাইন্ডের স্মৃতিগুলো স্বপ্নের রুপে তার মস্তিষ্কে থাকতো। সে ভাবতো এগুলো স্বপ্নে হয়েছে। ঘরের ছোটখাটো ব্যাপার এমনকি দাদাজানের মৃত্যুও। দাদাজানকে অবচেতন মনেই বহুবার মা/র/তে চেয়েছে নবনীতা। শেষ পর্যন্ত অবচেতন মনের সেই ভয়ংকর তাণ্ডবে প্রাণ হারান দাদাজান। জসীম সাহেব ব্যাপারটি জানতেন। তাই তিনি চিকিৎসা শুরু করেন নবনীতার। যতই হোক, মেয়েকে কারাগারে তো নিতে পারছিলেন না। ধীরে ধীরে নবনীতার মাঝে পরিবর্তন দেখা যায়। তাই চিকিৎসায় ক্ষান্ত দেন জসীম সাহেব। কিন্তু সেই সমস্যাটি তুষারের মৃত্যুতে আবারো মাথাচড়া দিয়ে উঠে। শান্তর বিশ্বাস তুষারের মৃত্যুটা স্বচক্ষে দেখেছে নবনীতা। এতো ভয়ানক সত্য গ্রহণ করতে পারে নি সে। তাই স্বপ্নের মোড়কে মস্তিষ্কে রেখে দিয়েছে। এতোদিনের সকল মৃত্যুগুলোও নিজের চোখেই দেখেছে নবনীতা। প্রতিটাকে স্বপ্নের নামে বলেছে সে। সময়ের মৃত্যুর সময় সে সেখানেই উপস্থিত ছিলো বলেই তার হাতের ছাপ সেখানে পাওয়া গিয়েছে। এমন নবনীতার গায়ে রক্ত লেগে ছিলো। দিপার ক্ষেত্রেও একই ঘটনাই ঘটেছে। শান্তর মতে এই সব কিছু তাকে অবচেতন মন করাচ্ছে। তুষারের মৃত্যুর বদলা নিতেই কি এসব! প্রশ্নটা এখনো ধোঁয়াশা। তবে এটাতে সন্দেহ নেই, যে নবনীতার এই রোগের সুযোগ নিচ্ছে খু/নী।

নবনীতা ব্যাথাতুর নয়নে তাকিয়ে আছে শান্তর দিকে। কান্নার দমকে কন্ঠ দলা পাকাচ্ছে, তবুও সাফাই এর স্বরে বলল,
“আমি কিছু করি নি”
“আমি জানি শ্যামলী। আমি তোমায় বিশ্বাস করি”
“আমি ওদের ঘৃণা করি, তুষারের মৃত্যুর জন্য প্রতিটি মানুষ দায়ী। ওরা তুষারকে মরতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আমি ওদের মা/রি নি”

নবনীতার কান্নারত মুখশ্রীটা বড্ড আঘাত দিলো যেন। নিরুপায় হয়ে তাকে আগলে ধরলো বুকে। সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
“কেঁদো না, প্লিজ কেঁদো না। আমার তোমাকে জ্বালাতে ভালো লাগে, কাঁদাতে নয়”

নবনীতার হৃদয় বেসামাল হলো। ডুকরে কাঁদলো সে। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। এর ই মাঝে রেবা এলো। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলল,
“ইরশাদ স্যার আইছে। আপনাদের দুজনরেই ডাকে”

ড্রয়িং রুমে লেডি কনস্টেবল সহ ইরশাদ দাঁড়িয়ে আছে। নবনীতা শান্তর পিছনে জবুথুবু হয়ে দাঁড়ালো। শান্ত এখানে আসার হেতু জিজ্ঞেস করতেই ইরশাদ থমথমে স্বরে বললো,
“সরি স্যার, বিভাকে হ/ত্যা করার অপরাধে আমি নবনীতা ম্যাডামকে এরেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি”

||সমাপ্ত||

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here