#আমি_ফাইসা_গেছি(১৮)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
গভীর রাত।বাসার সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।শুধুমাত্র তোড়া আর কুশানের চোখে ঘুম নেই।বেডের দুই প্রান্তে দুইজন শুয়ে আছে।তাদের মাঝখানে দেয়াল হিসেবে একটা কোলবালিশ রাখা হলো।যাতে কেউ কারো কাছে না আসতে পারে।কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে না পারে।দুইজনের মনের মধ্যেই অনেক ব্যাথা জমে আছে। তাদের অভিমান গুলো জমা হতে হতে আজ চোখ বেয়ে বেয়ে পড়ছে।কুশান আর তোড়া কেউই কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছিলো না।কারণ তারা যে দুইজনই কোনো না কোনো ভাবে দোষী।কুশান মনে করে তোড়ার জন্য এসব অশান্তি হচ্ছে আর তোড়া মনে করছে সবকিছু কুশানের জন্যই হচ্ছে।
কুশান চোখ বন্ধ করে আছে আর ভাবতেছে তোড়ার এতো অত্যাচার সহ্য করেও সে কেনো কিছু বলে না তাকে?কেনো তাকে শাসন করে না?কেনো তার থেকে মুখ ফিরে নিতে পারে না?কেনো তাকে এখনো সেই আগের মতোই ভালোবাসে?কুশান এতোদিন ধরে জানে যে সয় সে রয়,কিন্তু তার ক্ষেত্রে ঘটছে উলটো ঘটনা।সে তোড়ার এসব অত্যাচার সহ্য করতেছে বিধায় তার সাথে তোড়া বার বার এই ধরনের আচরণ করছে?তাহলে কি কুশানের এখন নিজেকে চেঞ্জ করার সময় এসেছে?অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে সে যে তোড়ার কাছে একদম হাসির পাত্র হয়ে গেছে,তার নিজের আত্নসম্মান টুকুও শেষ করে ফেলছে।
অন্যদিকে তোড়াও চোখ বন্ধ করে ভাবতেছে সে নিজের রাগ কে কেনো কন্ট্রোল করতে পারতেছে না?কেনো এখনো কুশানের সাথে বাজে আচরণ করছে?কেনো তাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে?কামিনী আর তার মেয়েদের উপর করা রাগ কেনো কুশানের উপর ঝাড়ছে সে?যদি কুশান তার এসব অত্যাচার সহ্য করতে করতে একসময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে?তখন কি হবে তার?তখন যদি সে আর আগের মতো তাকে ভালো না বাসে?কথায় আছে অতিরিক্ত অবহেলাই প্রিয় মানুষ টা একদিন এতো বেশি কঠিন হয়ে যায় যে তার ভালোবাসার মানুষের দিকে ভুল করেও আর তাকায় না।
আবার তোড়া এটাও ভাবতেছে সে কি এমনি এমনি কুশানের সাথে এমন দুর্ব্যবহার করে?কুশান যে তার মনের কষ্ট বুঝতেই পারে না?তার মন কি চায় সে কেনো সহজে ধরতে পারে না?কুশান কি কোনোদিনই বুঝবে না তাকে?সে যে নিজেও তাকে সত্যি অনেক বেশি ভালোবাসে।
একদম নির্ঘুমেই কেটে গেলো তাদের সারারাত।তবুও একটিবারের জন্য কেউ কারো সাথে কথা বললো না।কুশান ভাবলো তোড়া আগে কথা বলবে আর তোড়া ভাবলো কুশান আগে।কিন্তু দুইজনই তাদের ইগো নিয়ে থাকলো।
রাত প্রায় শেষের দিকে।এখনো দুইজন অন্য মুখ হয়ে শুয়ে আছে।আর এখনো সেই কোলবালিশ টা তাদের মাঝখানে।তারা দুইজন শুধু বার বার এপাশ ওপাশ হতে লাগলো।
হঠাৎ করে কুশানের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তোড়া ভাবলো সে ঘুমিয়ে গেছে সেজন্য তোড়া ধীরে ধীরে কুশানের পাশ ফিরলো।ঠিক সেই সময়ে কুশানও পাশ ফিরে দেখলো তোড়ার দিকে।সেও ভেবেছে তোড়া ঘুমিয়ে গেছে।কিন্তু দুইজন যখন চোখাচোখি হলো আর তাদের চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলো না।এক অন্যরকম মায়ায় পড়ে গেলো দুইজন।তাদের মনের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি গুলো নড়েচড়ে উঠতে লাগলো।দুইজনই চাচ্ছিলো কিছুটা সময় ভালোবাসার অতল গহবরে তলিয়ে যেতে।তারা যে দুইজন দুইজনকে কত টা ভালোবাসে নিজেও জানে না।কিন্তু তাদের ভালোবাসা গুলো প্রকাশ করার আগেই যেকোন কারণে তাদের মধ্যে দ্বন্দের সৃষ্টি হয়,যার কারনে ভালোবাসার আবেগগুলো চাপা পরে যায়।আর তারা পড়ে থাকে তাদের ঝগড়াঝাটি নিয়ে।
কুশান হঠাৎ কোলবালিশ টা জড়িয়ে ধরে তোড়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।বেড ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলোয় তোড়াকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।কুশানের কাছে মনে হচ্ছে কোনো স্বপ্নের পরী তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এমন মাতাল করা চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।তোড়ার সামনের চুলগুলো একদম এলোমেলো হয়ে আছে।যা দেখে কুশানের শান্ত মন টা একদম অশান্ত হয়ে গেলো।
তোড়া হঠাৎ নিজেও কোলবালিশ টার কাছে গিয়ে কুশানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
কুশান তখন কোনো কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে চোখ দুটি দিয়ে ইশারা করে বললো কি?
তোড়া নিজেও কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে বললো কিছু না।
কুশান হঠাৎ কোলবালিশ টা সরে দিয়ে তোড়ার কাছাকাছি চলে গেলো।তোড়া তা দেখে মুচকি একটা হাসি দিয়ে অন্য পাশ হলো।
কুশান তা দেখে তোড়াকে পিছন পাশ দিয়েই জড়িয়ে ধরে থাকলো কিছুক্ষণ। কুশানের হঠাৎ এমন স্পর্শ পাওয়ায় তোড়ার পুরো শরীর একদম কেঁপে উঠলো।কুশান তা দেখে আরো জোরে জড়িয়ে ধরলো তোড়াকে।তোড়া একটুও বাঁধা দিলো না কুশানকে।সে বরং কুশানের ভালোবাসার স্পর্শে নিজেকে নিমজ্জিত করতে লাগলো।
হঠাৎ কুশান তোড়ার ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে তার মুখ ডুবিয়ে দিলো ঘাড়ে।আর নাক দিয়ে ঘষতে লাগলো।তোড়া কুশানের এরকম স্পর্শ কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না।সে তাড়াতাড়ি করে কুশানের পাশ হলো।আর কুশানকে আটকিয়ে দিলো।কুশান তখন তোড়ার মুখটি উপরে তুললো।কিন্তু তোড়া তার আগেই তার চোখ দুটি বন্ধ করে নিলো।
কুশান হঠাৎ তোড়ার ঠোঁট দুটি মুখে পুরে নিলো।এই প্রথমবার তোড়ার পারমিশন ব্যাতিত কুশান এইরকম একটা সাহসের কাজ করলো।তোড়া কুশানকে আটকাতে গিয়েও আর আটকালো না।সে বরং নিজে কুশানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকলো।
এই কিছুক্ষন আগে দুইজন দুইজনকে কিছুতেই সহ্য করতে পারতেছিলো না।মনে হচ্ছিলো দুইজন দুইজনার অনেক বড় শত্রু।এতোটাই রেগে ছিলো দুইজন।কিন্তু ভালোবাসার সেই অপরিসীম শক্তির কাছে বার বার যে যেকোন রাগ,অভিমান দূরে সরে যায় আর ভালোবাসার জয় হয় তা আবার প্রমাণিত হলো।
দুই মানব মানবী সবকিছু ভুলে কিছুক্ষনের জন্য স্বর্গের রাজ্যে বিচরণ করতে লাগলো।যে রাজ্যে একবার গেলে বার বার যেতে মন চাইবে।
🖤
সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে শেষ রাতের দিকে তোড়া আর কুশান দুইজন দুইজনার কাছে এসে ভালোবাসার বন্ধনে নিজেদের আবদ্ধ করে নিলো।এখন দুইজন দুইজনকে জড়িয়ে ধরে শান্তির এক ঘুমে আচ্ছন্ন আছে ।যে ঘুম শুধু প্রশান্তি দেয়।।আজ আর ঘুম ভাঙানোর এলার্ম তাদের জাগাতে পারলো না।এলার্ম বেজে উঠলে সেটা অফ করে দিয়ে দুইজনই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো আবার।তারা ভুলেই গেলো তাদের অন্য আরেকটা লাইফ আছে।কিন্তু এই মুহুর্তে তারা ভাবছে এই দুনিয়ায় মনে হয় তারাই শুধু বসবাস করছে।আর কেউ নাই তাদের।
তোড়ার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো।সে জাগা পেয়ে দেখে এখনো কুশান তাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে।তোড়া সেজন্য ধীরে ধীরে কুশানের হাত সরাতে লাগলো তখন কুশান আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তোড়াকে।
তোড়া তা দেখে কুশানের কপালে তার নরম ঠোঁট দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললো, ছাড়ো আমায়।উঠতে হবে তো?
কুশানের কোনো সাড়াশব্দই নাই।সে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরে আছে তার প্রিয়তমা বউকে।মাঝেমধ্যে যে প্রিয় থেকে অপ্রিয় হয়ে যায়।সেজন্য এ মুহুর্ত টা কিছুতেই নষ্ট করতে চাইছিলো না কুশান।
তোড়া তখন জোরে ধমক দিয়ে বললো, এই কুশান ছাড়ো আমাকে।কয় টা বাজে দেখেছো?ভার্সিটিতে যাবে কখন?
কুশান সেই কথা শুনে এক লাফে বিছানা থেকে উঠলো।আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ও মাই গড।এতো বেলা হয়ে গেছে?
–হুম।বেলা হয়ে গেছে।এই বলে তোড়া মুচকি একটা হাসি দিয়ে তার জামা ঠিক করতে করতে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। কুশান হঠাৎ তোড়ার হাত টেনে ধরে বললো,
আই লাভ ইউ।
তোড়া তখন বললো, কুশান ছাড়ো এখন।বাসার সবাই মনে হয় নাস্তা করার জন্য বসে আছে।এখন এসব বাদ দাও।
এরই মধ্যে কে যেনো তাদের রুমের দরজা ধাক্কাতে লাগলো।কুশান তখন দিয়ে ছেড়ে দিলো তোড়াকে।আর তোড়া কুশানের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া মাত্র ওয়াশরুমের দিকে দৌঁড়ে গেলো।
এদিকে কেউ একজন দরজা ধাক্কাতেই আছে।
কুশান তখন তার গায়ে একটা টি শার্ট পড়ে নিলো।আর লুঙ্গি টা ঠিক করে দরজা খুলে দিলো।
কুশানকে দরজা খোলা দেখে কামিনী বললো,
তোড়া কই?সকাল কয় টা বাজে সেদিকে কি খেয়াল আছে ওর?সবাই নাস্তা খাওয়ার জন্য টেবিলে গিয়ে বসে আছে।আর এদিকে শুনি নাস্তা এখনো বানানোই হয় নি?
কুশান তখন বললো আম্মু এ বাসায় কি রান্না করার আর কেউ নাই?যে তোড়ার জন্যই ওয়েট করে থাকতে হবে?টুনি আর জয়া কি করে?
কামিনী সেই কথা শুনে বললো, বাবু?তুই আমার মুখে মুখে তর্ক করছিস?তোড়া কই সেটা আগে বল?
তোড়া তার শাশুড়ীর কন্ঠ শোনামাত্র তাড়াতাড়ি করে গোসল করতে লাগলো।
এদিকে কামিনী শুধু চিৎকার করে করে ডাকছে তোড়াকে।
কুশান তখন বললো আম্মু,তোড়া আজ অসুস্থ।সেজন্য সকালবেলা উঠতে পারে নি।
–অসুস্থ?তা তোড়া যে অসুস্থ সেটা তুই আগে বলবি না?তাহলেই তো জয়া আর টুনি রেডি করে নাস্তা।
এখন কি হবে?মেয়েরা আমার কি তাহলে না খেয়েই অফিস চলে যাবে?এই বলে কামিনী চলে গেলো।
এদিকে তোড়া ওয়াশরুম থেকে তাড়াতাড়ি করে বের হয়েই রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলো।আর ভাবতে লাগলো শর্টকাটে কি নাস্তা বানানো যায় কারণ ইতোমধ্যে যে তার অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোড়া এখন নিজের ইচ্ছামতো ঘুমাতে পারে না।রাতে সে যতই না ঘুমাক সকালে তাকে উঠতেই হবে।পুরো পরিবারের লোকজনের জন্য নাস্তা রেডি করতেই হবে।
তোড়াকে এভাবে রুম থেকে বের হতে দেখে কুশান বললো, এই কই যাচ্ছো আগেই।এখন বাহিরে গেলে কিন্তু সবার বকুনি খেতে হবে।তার চেয়ে বরং শুয়ে থাকো বিছানায়।
তোড়া সেই কথা শুনে বললো, ঘড়িতে দেখছো কয় টা বাজে?এখন কি ঘুমানোর সময় কুশান?
–হ্যাঁ ঘুমানোর সময়।কারন তুমি অসুস্থ আজ।
–আমি অসুস্থ?কখন অসুস্থ হলাম?তোড়া কুশানের এমন কথায় সত্যি আশ্চর্য হয়ে গেলো।
কুশান তখন তোড়াকে টেনে এনে বিছানায় শুয়ে দিয়ে বললো, আমি আম্মুকে বলেছি তুমি অসুস্থ।সেজন্য উঠতে দেরি হয়েছে তোমার।সেজন্য কিছুক্ষন একটু শুয়ে থাকো।
তোড়া সেই কথা শুনে বললো এটা কি করেছো কুশান?মিথ্যে কথা কেনো বলেছো?এখন যদি উনি কপাল চেক করে দেখেন?
–আমি কি জ্বরের কথা বলেছি যে কপাল চেক করবে?আমি শুধু বলেছি তুমি অসুস্থ। আর অসুখ তো শুধু জ্বরই না।কত ধরনের অসুখ আছে।
ঠিক সেই সময়ে কুশানের মোবাইলে রিং বেজে উঠলো। শাওনের কল দেখে কুশান তাড়াতাড়ি করে রিসিভ করলো।অপর পাশ থেকে শাওন বললো,এই দোস্ত কখন আসবি?আর তুই এতোক্ষন কল রিসিভ করলি না কেনো?সেই থেকে দিচ্ছি?
কুশান শাওনের কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে বেড থেকে নেমে গেলো।ইতোমধ্যে সে ফাস্ট ক্লাস টা মিস করে ফেলেছে।শাওন আর রিয়ান যে তাকে কতবার কল দিয়েছে তার ঠিক নাই।কিন্তু কুশান সেটা শুনতেই পারে নি।
কুশান তাড়াতাড়ি করে বেড থেকে নেমে গেলো।আর ওয়াশ রুমে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে গোসল টা সেরে রেডি হয়ে নিলো।কারণ যে করেই হোক দ্বিতীয় ক্লাস টা মিস করা যাবে না তার।
এদিকে আজ আবার লুতফা চৌধুরীও অসুস্থ।সুমন আর সোনিয়া অনেক আগেই কলেজে গিয়েছে।
সেজন্য নাস্তা বানানোর জন্য টুনি আর জয়া কে নির্দেশ দিলো কামিনী।কামিনী কি হেল্প করবে সে শুধু একাধারে বকে যাচ্ছে টুনি আর জয়াকে।
কেনো তারা নিজেরা শুরু করে নি রান্নাবান্না? কেনো তোড়ার আশা করে বসে ছিলো?
টুনি বললো, ভাবি না থাকার কারণে আমরা নিজের থেকে শুরু করে নি নাস্তা বানানো।তাছাড়া আজকে কি কি রান্না হবে সেই মেন্যুও ভাবি দিয়ে যায় নি আমাদের।
–রাখ তোর মেন্যু।পরোটা আর অমলেট রেডি হলেই আজ বাছি।কখন যে মেয়েরা আমার রাগ করে না খেয়েই অফিস চলে যায় আমি আছি সেই চিন্তায়।
হঠাৎ তোড়া আসলো রান্নাঘরে। এসে দেখে কামিনী নিজে রুটি বেলছে।আর বিড়বিড় করে কি যেনো বলছে?
তোড়া তখন টুনি আর জয়া কে বললো তোরা এটা কি করেছিস আজ?আমার উঠতে দেরি হচ্ছে দেখে কি তোরাও এভাবে হাত পা গুঁটিয়ে বসে থাকবি? এখন থেকে আমার উঠতে দেরি হলে তোরা কাজকর্ম শুরু করে দিবি।আমার জন্য খবরদার অপেক্ষা করে থাকবি না।একটা মানুষ তো আর প্রতিদিন এক সময়ে উঠতে পারে না।মাঝেমধ্যে তো লেট হবে তাই না?
–জ্বি ভাবি।
কামিনী তোড়াকে দেখে বললো, তুমি বলে অসুস্থ?তাহলে রান্নাঘরে কি করো?
তোড়া কামিনীর প্রশ্ন শুনে বললো হ্যাঁ আম্মু।কিন্তু এখন একটু ভালোবোধ হচ্ছে সেজন্য আসলাম এখানে। আম্মু আপনি রুমে গিয়ে রেস্ট করুন।আমি বেলে দিচ্ছি রুটিগুলো।
–লাগবে না।যাও তুমি নিজে গিয়ে শুয়ে থাকো।
কামিনী কথা টা রাগ করে বললো না ভালোভাবে বললো সেটা তোড়া বুঝতে পারলো না।
এদিকে এখন পর্যন্ত নাস্তা রেডি না হওয়ার কারণে ইরা,মিরা,আর লিরা এক গাদা কথা শোনাতে লাগলো।সবাইকে।
হঠাৎ কুশান এলো সেখানে।সে ভার্সিটিতে যাবে বলে একদম রেডি হয়েই বের হয়েছে রুম থেকে।
কুশানকে দেখে কেউ আর কিছু বললো না ।সবার মুখের বুলি একদম থেমে গেলো।
তোড়া এবার জোর করেই কামিনীর হাত থেকে বেলুন কেড়ে নিয়ে নিজেই ঝটপট করে বেলতে লাগলো রুটি।কারণ কামিনী রুটি করার বদলে যে মানচিত্র আঁকাচ্ছে এই মানচিত্র শেপের পরোটা কিছুতেই খাবে না ইরা,মিরা,লিরা।
তোড়ার পরোটা করা প্রায় শেষ।এখন অমলেট করলেই হয়ে যাবে।কিন্তু ইরা,মিরা,লিরা সেই অপেক্ষায় না থেকে না খেয়েই অফিস চলে গেলো।
কামিনী তা দেখে বললো, হায় আল্লাহ! মেয়ে গুলো আমার না খেয়েই চলে গেলো।এতো গুলো মানুষ থাকতে এখন পর্যন্ত সকালের নাস্তা রেডি হয় নি?
কুশান তখন কামিনী কে বললো, আম্মু তুমি দেখলেই তোড়ার উঠতে দেরি হচ্ছে তখন টুনি আর জয়াকে বললেই তো ও নাস্তা বানানো শুরু করে দিতো।
–এটা তোর বউ কে জিগা।ও নাকি বলেছে সে ওঠার পর নিজের হাতে সবার নাস্তা বানাবে।বেশি মাতব্বরি করতে গিয়ে আজ আমার মেয়েরা না খেয়েই চলে গেলো।
কুশান সেই কথা শুনে তোড়ার দিকে তাকালো।কিন্তু তোড়াকে কিছু না বলে টুনি আর জয়াকে বকতে লাগলো।
টুনি তখন বললো, ভাইয়া আমাদের বকছেন কেনো?আমরা কি করলাম?
কুশান তখন বললো, কাল থেকে সকাল সকাল তোরা দুইজন উঠে নাস্তা বানাবি।বুঝেছিস?তোদের ভাবির জন্য খবরদার অপেক্ষা করে থাকবি না?
জয়া তখন বললো কিন্তু ভাবি যে বলেছে উনি ওঠার পর নাস্তা বানানো শুরু করতে হবে।
–আমি যেটা বলছি সেটাই হবে।এই বলে কুশান চলে যেতে ধরলো।
তোড়া তখন ডাক দিয়ে বললো, হইছে তো এখন।খেয়ে যাও কিছু।
কুশান পিছন ফিরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কি করবে সে?খাবে না চলে যাবে?তার যে ইতোমধ্যে অনেক লেট হয়ে গেছে।
তোড়াকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে কামিনী বললো, ওভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?কুশানের খাবারগুলো টেবিলে রেখে তাড়াতাড়ি করে আমার নাস্তা রেডি করো।আমি কিন্তু এসব পরোটা আর অমলেট খেতে পারবো না।
তোড়া সেই কথা শুনে পরোটা আর অমলেটের পিরিচ টেবিলের উপর রাখলো।
কিন্তু কুশান সেগুলো রেখেই চলে যেতে ধরলো। কামিনী কুশানকে এভাবে চলে যাওয়া দেখে বললো বাবা যাচ্ছিস কেনো?খেয়ে যা।
–আম্মু সময় নেই এখন।দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কামিনী সেই কথা শুনে কুশানকে টেনে এনে বসালো চেয়ারে।আর বললো, নিজের চেহারার দিকে দেখেছিস? কেমন শুকায় গেছিস?চোখ মুখ কেমন যেনো কালো হয়ে গেছে।তোর যে খাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে সেটা আমি বুঝতে পারছি।
তোড়া সেই কথা শুনে বললো, খাওয়ার অনিয়ম নয় আম্মু।রাতে আপনার ছেলে সময়মত ঘুমায় না।সময়মত না ঘুমানোর জন্য এরকম দেখাচ্ছে ওকে?
–ঘুমায় না?কেনো ঘুমাস না বাবা?কিসের টেনশন তোর যে ঘুম হবে না?
কুশান কামিনীর কথা শুনে তোড়ার দিকে তাকালো।আর ভাবতে লাগলো আমি কেনো ঘুমাতে পারি না তা তো তোমার থেকে ভালো কেউ জানে না।
অর্ধেক রাত পার করো নাটক করতে করতে আর বাকি অর্ধেক রাত পার করো সিনেমা করে।
হঠাৎ যুথি পিছন দিক থেকে ডাক দিয়ে বললো, কুশান ভাইয়া?একা একাই নাস্তা করছেন?
কুশান সেই কথা শুনে তোড়াকে ডাক দিয়ে বললো এই তোড়া?যুথিকে নাস্তা দিয়ে যাও।
তোড়া সেই কথা শুনে যুথির জন্য দুইটা পরোটা আর একটা অমলেট নিয়ে আসলো।
–পরোটা আর অমলেট?আর অন্য কিছু নাই?এই বলে যুথি তোড়ার দিকে তাকালো।
–না নেই।এই বলে তোড়া আবার রান্না ঘরে চলে গেলো।আর কামিনীর জন্য সবজি কাটতে লাগলো।
হঠাৎ তোড়া উহঃ করে ওঠাতে কুশান খাওয়া বাদ দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো রান্নাঘরে।
আসলে তোড়া সবজি কাঁটতেছিলো ঠিকই কিন্তু তার চোখ দুটো ছিলো কুশানের উপর।কুশান আর যুথি কি নিয়ে গল্প করছে সেটা শোনার চেষ্টা করছিলো সে?
তোড়ার চিৎকার শুনে কুশান বললো,কি হয়েছে?আঙুল কেটে ফেললে নাকি আবার?
তোড়া আঙুল টা তার ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে বললো,না কাটে নি।তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে ভার্সিটিতে চলে যাও।
কুশান তখন বললো, দেখি? আমাকে দেখাও তো হাতটা?
তোড়া তখন বললো কিছু হয় নি আমার
তুমি চলে যাও এখন।এই বলে তোড়া তার রুমের দিকে চলে গেলো।
কুশান তোড়ার কথা না শুনে নিজেও তোড়ার সাথে সাথে রুমে চলে গেলো।
কামিনী তা দেখে জয়া কে বললো, কি হয়েছে রে? ওরা দুইজন ওভাবে দৌঁড়ে রুমে গেলো কেনো?
–ভাবির আঙুল কাটা গিয়েছে।
কামিনী সেই কথা শুনে বললো,আঙুল কেটেছে তোড়ার, কুশান ওভাবে দৌঁড়ালো কেনো?
এমনিতেই আজ দেরি করে উঠেছে তার উপর এখন আঙুল কেটে ফেললো।আজ আর আমার পেটে খাবার যাবে না।
টুনি তখন বললো খালামনি আজ একটু পরোটা আর অমলেট খেলে কি হয়?আপনার খাবার রেডি হতে আরো অনেক সময় লাগবে।
কামিনী সেই কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো টুনির দিকে।
টুনি তা দেখে বললো,তাহলে আরেকটু অপেক্ষা করো খালামনি।সবজি বসিয়ে দিচ্ছি আমি।ভাবি মনে হয় আজ আর কিছু করতে পারবে না।অনেক খানি কাটা গিয়েছে।
কামিনী সেই কথা শুনে বললো,অতিরিক্ত নাটকবাজ এই মেয়েটা।তখন বললো অসুস্থ।আর এখন শুনছি আঙুল কেটে গেছে।আর আঙুল কেটে গেলেই কি আর রান্না করা যায় না?সংসার জীবনে ওরকম কত কাটা গিয়েছে আমাদের।তাই বলে কি আমরা রান্নাবান্না করি নি?কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম আজ এখন পর্যন্ত খেতে পারলাম না।
জয়া তখন বললো কার আবার?আপনার মুখই হয় তো দেখেছেন?
–কি বললি তুই?
–বললাম খালুর মুখ ই হয় তো প্রথম দেখেছেন?সেজন্য এরকম বিপদ আর বিপদ।
–চুপ?বেশি কথা বলিস কিন্তু তুই।খাবার রেডি হলে ডাক দেস আমাকে।
এই বলে কামিনী তার রুমের দিকে চলে গেলো।
চলবে,#আমি_ফাইসা_গেছি(১৯)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
তোড়ার আঙুল কেটে যাওয়ায় কুশান আজ আর ভার্সিটিতে গেলো না।সে তোড়ার সেবা করতে লাগলো।যেহেতু তোড়া এখন তার ডান হাত দিয়ে কোনো কাজই করতে পারবে না সেজন্য আজ তো তোড়ার কুশানকে ভীষণ প্রয়োজন।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো।
কিন্তু তোড়ার আঙুল কেটে যাওয়ার খবর তার পরিবারের কাছে কুশান এমন ভাবে বর্ণনা করেছে যে তোড়ার বাবা, মা, দাদী,চাচা,চাচী,কাজিন সবাই এলো তোড়াকে দেখার জন্য।তোড়া নিজেও জানে না তার হাতের এতই খারাপ অবস্থা হয়েছে।সে তো জানে সামান্য একটু কাটা গিয়েছে,আর তাতে স্যাভলন দিয়ে ব্যান্ডেজ করার ফলে আর কোনো অসুবিধায় হচ্ছে না তার।না কোনো রক্ত পড়ছে,না কোনো ব্যাথা আছে।
তোড়ার ফ্যামিলির লোকজনও ভীষণ অবাক হলো।তারা তো ভেবেছিলো তোড়ার হাত বাজে ভাবে কেটে গিয়েছে।
চামেলী বেগম তোড়ার কথা শুনে পুরো রাস্তা কান্দাকাটি করতে করতে এসেছেন।তার একটিমাত্র মেয়ে।কেনো যে তাকে আগেই বিয়ে দিতে গেলো।যে মেয়ে নিজের বাড়িতে এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় নি সে আজ শশুড় বাড়ি গিয়ে বাবুর্চিদের মতো দিন রাত রান্না করছে।এখন কি হবে তার মেয়ের?এই হাত যদি ভালো না হয় সে কিভাবে চলবে এখন?গোলাপ সাহেব অনেক বোঝানোর ফলে চামেলি বেগম চুপ হয়ে গেলো।সবাই বেশ চিন্তার মধ্যে ছিলো। তারা যখন সবাই কুশানদের বাড়ি এসে তোড়ার আঙুলে ব্যান্ডেজ করা দেখলো চামেলি বেগম একটা চিৎকার করে উঠলো। তিনি ভাবলেন সত্যি সত্যি তোড়ার আঙুল টা মনে হয় পুরাই কাটা গিয়েছে।চামেলি বেগমের সাথে সাথে তোড়ার দাদী আর আব্বুও ভয় পেয়ে গেলেন।
তোড়া সবাইকে এভাবে দেখে নিজেও আতংকের মধ্যে পড়ে গেলো।হঠাৎ সবাই তার শশুড় বাড়ি কেনো?একটিবার তো একটা খবর দিতে পারতো?
চামেলি বেগমের এমন কান্দাকাটি দেখে আর তার পরিবারের বাকি সদস্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে না হেসে থাকতে পারলো না।তোড়া হাসতে হাসতে বললো,তোমরা এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো আমার দিকে? কি হয়েছে আমার?
চামেলি বেগম সেই কথা শুনে তোড়ার পাশে এসে বসলো আর বললো,মা এখন কেমন আছিস?
তোড়া সেই কথা শুনে বললো,আমি তো ভালোই আছি।কিছুই হয় নি তো আমার।
–তুই বুঝবি না মা তোর কি হয়েছে?এই বলে চামেলি কুশানকে বললো,
বাবা এখন কি অবস্থা? ডাক্তার কি বলেছে?
কুশান সেই কথা শুনে বললো, আম্মু মারাত্নক কিছু হয় নি।সেজন্য ডাক্তার ডাকার প্রয়োজন পড়ে নি।
–মানে কি কুশান?ডাক্তার ছাড়া কিভাবে ট্রিটমেন্ট করলে তুমি?
তোড়া তখন চামেলি বেগমকে বললো, বিশ্বাস করো আম্মু।আমি ঠিক আছি।শুধু একটু ছিলে গিয়েছে।এতে ডাক্তার ডাকতে হবে কেনো?আর তোমরা সবাই এতো ভয় পাচ্ছো কেনো?
শেষ মেষ তোড়া ব্যান্ডেজটি খুলেই দেখালো।
সামান্য একটু ছিলে গেছে তার। ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করা কুশান আর যুথির দিকে তাকিয়ে সবজি কাটতে গিয়ে এই অবস্থা হয়েছে তোড়ার।
এতোক্ষন দিয়ে সবার বিশ্বাস হলো কিছুই হয় নি তোড়ার।হেনা বেগম হঠাৎ কুশানের কান টেনে ধরে বললো,এই ফাজিলের ফাজিল!কি বলেছিস তোর শশুড়কে?তোড়ার নাকি আঙুল পুরোটাই কেটে গিয়েছে।
–দাদী ব্যাথা পাচ্ছি আমি।ছেড়ে দাও।
–ব্যাথা পাওয়ার জন্যই তো ধরেছি।এইভাবে কেউ বলে?সবাই তো একদম ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
কুশান সেই কথা শুনে বললো আসলে দাদী ও যেভাবে চিৎকার করে উঠেছিলো আর যেভাবে ওর আঙুল বেয়ে বেয়ে রক্ত পড়ছিলো তা দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।আমি ভেবেছিলাম ওর মনে হয় আঙুল টা পুরোই কেটে গিয়েছে।সেজন্য আপনাদের খবর দিয়েছিলাম।পরে তো নিজেরাই বলতেন এতো কিছু হয়ে গেলো আর আপনাদের জানালাম না।
গোলাপ সাহেব আর চামেলি বেগম কুশানের এমন কর্মকান্ডে হেসে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।তারা কাকে কি বলবেন বুঝতেই পারছেন না।সত্যি কুশান এতো ভালোবাসে তাদের মেয়েকে?সামান্য একটু কেটে যাওয়ায় সবাইকে জড়ো করেছে।আর সেই ছেলেটাকে তারা ভুল বুঝেছিলো এক সময়।
এদিকে কামিনী চৌধুরী তার ছেলের এমন কর্মকান্ড দেখে আর তোড়ার পরিবারের সবাইকে এভাবে আসা দেখে মুখ ভেংচিয়ে বললো,আর কত ঢং দেখবো খোদা!এই টা দেখার জন্য বুঝি বাঁচিয়ে রেখেছিলে আমাকে?আমার ছেলেটার এতো অধঃপতন হয়েছে?সামান্য হাত কাটাকে কেন্দ্র করে এতো কাহিনী শুরু হয়ে গেলো?ও মোর আল্লাহ বাঁচাও আমাকে।এই বলে কামিনী রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।আর নিজের রুমে গিয়ে চুপটি করে বসে রইলেন।
হেনা এবার স্বর্ণাকে বললো চল আমরাও একটু বাহিরে থেকে ঘুরে আসি।এই প্রথমবার নাতনির বাড়ি আসলাম।একটু ঘুরে ঘুরে দেখি চারপাশ।
— তুমি যাও দাদী।আমি একটু আমাদের দুলাভাই এর সাথে মজা করি।এই বলে স্বর্ণা কুশানের হাত ধরে বললো,
ভালো আছেন দুলাভাই?
কুশান স্বর্ণাকে তার এভাবে হাত ধরা দেখে তাড়াতাড়ি করে হাত সরিয়ে নিয়ে বললো,জ্বি ভালো আছি।তা আপনি ভালো আছেন?
আপনি করে বলায় হেনা বেগম হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।আর মনে মনে ভাবলেন তোড়ার জামাই যে এতো সহজ সরল হবে ভাবতেই পারছি না।আমাদের তোড়া কত চঞ্চল?আর কুশান হইছে একদম তার উলটো।
স্বর্ণা একদম হা হয়ে রইলো।সে ভাবলো দুলাভাই এর সাথে একটু মজা করবে কিন্তু তার দুলাভাই তো তাকে আপনি বলে মজা করা থামিয়ে দিলো।
তোড়া তখন কুশানকে বললো,ওকে আপনি করে বলছো কেনো?
স্বর্ণা আমার ছোটো হয়।তোমার ছোটো শালি সে।
–ওহ,সরি।বুঝতে পারি নি।
–ঠিক আছে দুলাভাই।কিছু মনে করি নি।ভুল হতেই পারে।তাছাড়া যেভাবে দেখতে এসেই হঠাৎ করে তোড়া আপুর বিয়েটা হয়ে গেলো না চেনারই কথা।আপনার সাথে তো ঠিক করে এখনো পরিচয়ই হয় নি কারো।
কুশান মাথা নাড়িয়ে বললো জ্বি।সে তখন বললো, তোমরা গল্প করো আমি একটু আসছি।
স্বর্ণা তখন আবার কুশানের হাত ধরে বললো আরে দুলাভাই কই যাচ্ছেন এভাবে?বসেন একটু।আপনার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করি।
কুশান তখন তোড়ার দিকে তাকালো।
তোড়া কুশানের মুখ চোখ দেখে অন্য মুখ হলো।আর মিটিমিটি করে হাসতে লাগলো।কারণ স্বর্ণা তার হাত ধরায় কুশান ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলো।
কুশান মেয়ে মানুষ দেখলে আসলেই দশ হাত দূরে দূরে থাকে।
সেই লাজুক কুশান তার সাথে প্রেম করেছে এক বছর।ব্যাপার টা কিন্তু বেশ অদ্ভুত।কুশানের ফ্যামিলির কেউ শুনলে জীবনেও এটা বিশ্বাস করবে না।তবে কুশান কে তোড়া এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কুশান জানায় এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র ফোনে ফোনে প্রেম টা শুরু হওয়ার কারণে।কারণ কুশান তোড়ার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই ভালোবেসে ফেলে।সেজন্য প্রেম টা কন্টিনিউ করতে পেরেছে।সামনাসামনি সে তো কোনো মেয়ের চোখের দিকেও তাকাতে পারে না।
কুশানকে এভাবে দূরে দূরে সরতে দেখে স্বর্ণা বললো, আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন দুলাভাই?কই শালির সাথে একটু মজা করবেন,মজার মজার গল্প করবেন তা না করে চুপচাপ বসে আছেন?
কুশান তখন বললো আমার একটু দরকারী একটা কাজ আছে।আমি পরে এসে গল্প করবো।এই বলেই কুশান চলে গেলো।
স্বর্ণা এবার তোড়ার কাছে গিয়ে বললো,আপু?দুলাভাই কি একটু বেশিই লাজুক।
তোড়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো হুম।
স্বর্ণা সেই কথা শুনে বললো সো সেড।দুলাভাই যদি এমন লাজুক হয় তাহলে তোকে সে ভালোবাসে কেমনে না মানে বোঝাতে চাচ্ছিলাম সে তোকে আদর করে কেমনে?না সেটাও পারে না?
তোড়া স্বর্ণার মুখে এমন কথা শুনে ওর মাথায় একটা চড় দিয়ে বললো, বেশি পেকে গেছি দেখছি তুই?কি সব বলছিস?
–চড় দিলি কেনো আমাকে?আমি খারাপ কি বললাম?দুলাভাই রোমান্টিক না আনরোমান্টিক সেটা শুধু জানতে চাচ্ছি।
তোড়া সেই কথা শুনে বললো রোমান্টিক আছে?
স্বর্ণা তখন অবাক হয়ে বললো মানে?
–হ্যাঁ।মানে আবার কি?
–কিন্তু ওনাকে দেখ তো বোঝা গেলো না।উনি রোমান্টিক একজন মানুষ, সেটা আমার বিশ্বাস হয় না।
তোড়া তখন আবার স্বর্ণার মাথায় একটা চড় দিলো আর বললো,ও কি তোর সামনে বউ এর সাথে রোমান্স করবে?যার সাথে করার দরকার তার সাথে ঠিক করে।অন্য মানুষ দের সামনে হাবলু,তবে আমার কাছে একজন রোমান্টিক মানুষ সে।
স্বর্ণা সেই কথা শুনে তোড়াকে জড়িয়ে ধরে বললো সত্যি বলছিস আপু?ইসঃ আমার জামাই টাও যদি এমন হতো।সবার সামনে এমন ভাবে থাকবে যে কিছুই বোঝে না সে, আর আমার সাথে ঠিকই রোমাঞ্চ করবে।
জানি না কি আছে কপালে আমার।তবে অন্য দিক দিয়ে পারফেক্ট হোক বা না হোক শুধু একটু রোমান্টিক হলেই চলবে।
ঠিক সেই সময় সুমন আর সনিয়া ভাবি ভাবি বলে রুমে প্রবেশ করলো।
সনিয়া তোড়ার পাশে বসলো আর সুমন দাঁড়িয়ে থেকেই বললো, কি হয়েছে ভাবি তোমার?বাসায় এতো লোকজন কেনো?
–কই কি হয়েছে?কিছুই হয় নি।শুধুমাত্র একটু ছিলে গেছে।আর তাতে তোমার পাগল ভাই সবাইকে বলেছে আমার আঙুল একদম হাত থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে।আর সেটা শুনে সবাই এভাবে দেখতে এসেছে আমাকে।
সুমন তোড়ার কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো আহারে! আমার ভাইটা যে তোমাকে এতো বেশি কেয়ার করে সত্যি আমরা বুঝতে পারি নি।কই আমার বউ সোহাগী ভাই টা?এই বলে সুমন এদিক ওদিক তাকিয়ে কুশানকে খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ সুমনের স্বর্ণার দিকে চোখ গেলো।আর স্বর্ণার দিকে চোখ যেতেই সুমন একদম লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।মুহুর্তের মধ্যে সুমনের হাস্যোজ্জ্বল মুখটি মলিন হয়ে গেলো।
স্বর্ণা হঠাৎ করে সুমনকে বললো আমাকে কি আপনি চিনতে পেরেছেন?
সুমন ডাইরেক্ট বললো না তো।আপনাকে আমি কিভাবে চিনবো?
সুমন বেশি ভাব দেখাতে গিয়ে আরো বেশি ধরা খেয়ে গেলো।
কারণ স্বর্ণা তখন বিস্তারিত ভাবে বলতে লাগলো তাদের প্রথম কোথায় দেখা হয়েছে?যে দিনটির কথা সুমন আজও ভোলে নি।এরকম দিন মনে হয় তার জীবনে কোনোদিন আসে নি আর আসবেও না।সুমন আর বেশিক্ষন থাকলো না তোড়ার রুমে।সনিয়াকে রেখেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
তোড়া তখন স্বর্ণাকে বললো, কি হয়েছে রে স্বর্ণা?সুমন তোকে দেখে ওভাবে চলে গেলো কেনো?
স্বর্ণা তখন হাসতে হাসতে বললো আপু যেদিন তোকে সবাই দেখতে গিয়েছিলো সবার যে একসাথে পেট খারাপ হয়েছিলো ভুলে গেছিস সেটা?
–ভুলি নি তো?কি হয়েছে?
স্বর্ণা তখন বললো এই ছেলেটি তার মায়ের সাথে আমাদের ওয়াশরুমে গিয়েছিলো।কিন্তু আব্বু ওদের আগেই ওয়াশরুমে থাকায় ইনি বাচ্চাদের মতো বেশ কান্নাকাটি করছিলেন আর ওনার মাকে চিৎকার করে বলছিলেন তাড়াতাড়ি একটা ওয়াশ রুমের ব্যবস্থা করো।আমার না ওনার কান্দাকাটি দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো সেদিন।সেজন্য ওনার ফেস টা বেশ ভালোভাবেই মনে আছে আমার।
তোড়া সেই দিনের কথা মনে করে নিজেও হেসে উঠলো।কি একটা অবস্থা হয়েছিলো সবার?শেষমেষ বুদ্ধি করে সে তার পরিবার কে অপবাদ আর অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।
সোনিয়া নিজেও হো হো করে হেসে উঠলো।সেদিন সত্যি তার সুমন ভাইয়ের এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে তারও ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো।শুধু সুমন নয় পরিবারের সবার অবস্থা একদম নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলো।
অন্যদিকে কুশান তো একদম ভয়ের মধ্যে ছিলো।এই বুঝি তোড়া তাদের প্রেমের কথা প্রকাশ করে।আর তার বাবা মা রাগ করে বাসা থেকে বের করে দেয় তাকে।
সোনিয়া আর স্বর্ণা গল্প করতে করতে দুইজন বেশ ফ্রি হয়ে গেলো।তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করতে লাগলো।আর গল্প করতে করতেই একসাথে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
ওরা চলে যাওয়ার পর তোড়া বেড থেকে উঠে কুশানকে খুঁজতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো না জানি কুশান কই চলে গেলো?
হঠাৎ কুশান কই থেকে যেনো পাখির মতো উড়ে এসে তোড়াকে বেলকুনির দিকে টেনে নিয়ে গেলো।হঠাৎ আকস্মিক ভাবে পিছন দিক থেকে তোড়াকে ধরায় তোড়া একদম চমকে উঠলো আর নিজের বুকে থু থু ছিটিয়ে দিয়ে বললো,
এইভাবে কেউ ধরে নাকি কুশান।আমি তো একদম ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
কুশান তখন তোড়াকে জড়িয়ে ধরে বললো আমি ছাড়া আর কার সাহস আছে তোমার ধরার?
তোড়া তখন বললো কি জন্য এখানে নিয়ে আসলে?কেউ দেখলে কি বললে?
–আমার বেলকুনিতে কে আসবে?এই বলে কুশান তোড়ার ঘাড়ে তার মুখ রেখে বললো,
এখন কি ব্যাথা একটু কমছে তোড়া?
তোড়া সেই কথা শুনে বললো আচ্ছা কুশান!তুমি এরকম পাগলামি টা কেনো করছো বলো তো?আমার কত টুকু কেটে গিয়েছে?সামান্য একটু কেটেছে?আর তুমি যে কান্ড শুরু করেছো না জানি সত্যি সত্যি আঙ্গুল টা কেটে পড়লে কি করতে?
কুশান সেই কথা শুনে বললো তখন আমি আর ঠিক থাকতে পারতাম না তোড়া?তোমার একটু ব্যাথা লাগলেই কেনো জানি আমার বুকের ভিতর টা চড়াৎ করে ওঠে।মনে হয় ব্যাথা টা তুমি পাও নি আমি পেয়েছি।এমন কেনো হয় বলতে পারো?
তোড়া তখন বললো, সামান্য ব্যাথা পাওয়াতেই তোমার যখন এতো কষ্ট হয় তাহলে যদি আমিই না থাকি তখন কি হবে?
কুশান তোড়ার মুখে এই কথা শোনার সাথে সাথে তার মুখ টিপে ধরলো।আর কোনো কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে বললো, আর যেনো না শুনি এমন কথা।তুমি না থাকলে আমিও থাকবো না।তুমিহীনা এই শূন্য জীবন দিয়ে আমি করবো টা কি?
তোড়া কুশানের এমন কথা শুনে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।আর ভাবতে লাগলো সে কত খারাপ আচরণ করে কুশানের সাথে?একটু রেগে গেলে মারধরও করে।আর সেই কুশান তাকে কত ভালোবাসে?কুশান আসলেই তোড়াকে অনেক অনেক ভালোবাসে।কিন্তু সে তার অনুভূতি পুরো টা প্রকাশ করতে পারে না।মুখ ফুটিয়ে বলতে পারে না তোড়া আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।আমি সত্যি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।
হঠাৎ রুমের মধ্যে টুনি চলে আসলো।সে তোড়া ভাবি বলে বলে ডাকতে লাগলো।
তোড়া টুনির কথা শোনামাত্র তাড়াতাড়ি করে কুশানকে ছেড়ে দিয়ে তার রুমে চলে গেলো আর বললো কি হয়েছে রে?ডাকছিস কেনো?
টুনি তখন বললো, ভাবি আপনার যে বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে তাদের জন্য খাবারদাবার করতে হবে না?কি কি নাস্তা বানাবো?
কুশান টুনির কথা শুনে ওকে ধমক দিয়ে বললো, মেহমানের জন্য কি কি নাস্তা রেডি করতে হয় তা তুই জানিস না?সেটার জন্যও কি তোর ভাবির কাছে আসতে হবে?
টুনি তখন বললো আমাকে এতো ধমক দিয়ে কথা বলেন কেনো কুশান ভাইয়া?খালামনি বললো তোর ভাবিকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর তার মা বাবার জন্য কি কি আইটেম করবে?সেজন্য জিজ্ঞেস করতে আসলাম।
তোড়া তখন কুশানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,এই তুমি কিন্তু টুনির সাথে সবসময় ধমক দিয়েই কথা বলো।আমি নিজেও শুনেছি।ও তো ভালো কথা বলার জন্যই এসেছে।এই চল।এই বলে তোড়া টুনিকে নিয়ে চলে যেতে ধরলো।
কুশান তখন বললো তুমি এই হাত নিয়ে রান্না করবে তোড়া?
–হ্যাঁ করবো।আমার কোনো অসুবিধা হবে না কুশান।এই বলে তোড়া টুনিকে সাথে করে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।তোড়ার পিছু পিছু কুশানও যেতে ধরলে তোড়া বললো,
তুমি আবার এখানে আসছো কেনো?তোমাকে কেউ রান্নাঘরে দেখলে কি বলবে?
–না মানে তুমি রান্না করলে তো হাতে ব্যাথা পাবে।সেজন্য বলছিলাম,
তোড়া তখন বললো কুশান আমি রান্না করবো না।ওরা করবে আমি শুধু দেখিয়ে দিবো।এতে আমার কোনো কষ্ট হবে না।তুমি এখন যাও তো।
হঠাৎ সুমন এসে বললো, ভাবি এই দিকে একটু এসো তো।
কুশান তখন এগিয়ে এসে বললো, কি দরকার ওর সাথে?
–সেটা আমি ভাবিকেই বললো।তোকে বলতে যাবো কেনো?
এই বলে সুমন তোড়ার কাছে গিয়ে বললো,সোনিয়া কোথায় ভাবি?ওকে দেখছি না যে?
–স্বর্ণার সাথে কই যে গেলো?
–স্বর্ণা?তোমার ওই কাজিন টার নাম বুঝি?
–হ্যাঁ।
–দূর কি এক বিপদে পড়লাম বাবা।যতই চাচ্ছি ওই মেয়ের সামনে আর যাবো না ততই যেতে হচ্ছে আমাকে?
সুমন কে বিড়বিড় করা দেখে তোড়া বললো, কিছু বললে তুমি?
–না ভাবি।এই বলে সুমন চলে গেলো।
🖤
তোড়ার মা বাবারা সেই কখন এসেছে এখন পর্যন্ত তাদের কে এক গ্লাস পানি পর্যন্ত দেয় নি কেউ।কামিনী তো মেহমান দেখেই তার নিজের রুমে গিয়ে বসে থাকলো।এতোদিন সারাক্ষণ পিছু পিছু থাকে আজ একদম হাত পা গুটিয়ে বসে আছে নিজের বিছানায় আর চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।কামিনী এমনই।তিনি নিজে কখনোই এক গ্লাস পানি ঢেলে খান না।আর করবেন মেহমানের সেবা?কামিনী এতোদিন শুধুমাত্র কুশানের দেখভালো করলেও তোড়া আসার পর থেকে সেটুকুও আর করেন না।তিনি তো বসে থেকে শুধু ভাবতেছেন কুশানের ভবিষ্যৎ নিয়ে।কুশান তো দুইদিনেই একদম বউ পাগল হয়ে গেছে ভবিষ্যৎ এ যে আর কি কি করবে কে জানে?
চলবে,