#আরো_একটি_বসন্ত
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_৬
-”পৃথিবীর কোনো পুরুষই তার বউয়ের কাছে শুদ্ধ থাকে না।
আমিও এর ব্যতিক্রম হবো না।”
শুদ্ধর কথা শুনে শীতলের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বিয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই এত পরিবর্তন! শীতলের মুখভঙ্গি দেখে শুদ্ধ মনে মনে হাসছে। দীর্ঘ পথটা যেতে যেতে বউকে রাগিয়ে দিলে মন্দ হয় না। ঝগড়া করতে করতেই নাহয় শুরু হোক এই দীর্ঘ পথ। শীতল শুদ্ধর ভাবনা আন্দাজ করে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তারপর কিছু একটা ভেবে জানলার বাইরে তাকিয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলো। বসন্তের আগমনে প্রকৃতি নতুন রুপে সেজেছে। থোকায় থোকায় কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া জানান দিচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা। বাস দ্রুত গতিতে চলার কারণে বাতাসে এলোমেলো করে দিচ্ছে চুল সহ শাড়ির আঁচল। অবাধ্য হয়ে সেটা আছড়ে পড়ছে শুদ্ধর মুখে। শীতল সেটা দেখেও না দেখার ভাণ ধরে চুপ করে বসে
আছে। শুদ্ধ এবার শীতলকে সরিয়ে জানালাটা টেনে অর্ধেক
বন্ধ করে দিলো। এবার বাতাসটা কম লাগছে। নয়তো তীব্র বাতাসের গতিতে নিঃশ্বাস নেওয়াও যাচ্ছিল না। তার এহেন কাজে শীতল মুখ ভার করে বলল,
-”গ্রামে থাকতে হবে কতদিন?”
-”যতদিন না তোমাদের বাসাটা ঠিকঠাক হয়।”
শীতল খেয়াল করল শুদ্ধ ‘তুমি’ করে সম্মোধন করছে। বাড়ি যাচ্ছে সকলের সামনে ‘তুই’ করে বলা দৃষ্টিকটু তাই বোধহয়। তবে এই সুযোগেই তার সম্মোধনেও পরিবর্তন আনলে মন্দ হয় না। একথা ভেবে শীতল মুখভর্তি হেসে বলল,
-”তোমার পরিবারে মা আর বোন ছাড়া আর কে কে আছে? যদিও ভাইয়া একদিন বলেছিল তবে এখন মনে পড়ছে না।”
-”তার আগে তোমার গোবরভরা মাথায় এটা গেঁথে নাও। বাড়ি গিয়ে আমাকে ভুলেও ‘ শুদ্ধ ভাই’ ডাকবে না। নয়তো আম্মু ভীষণ রাগ করবে।”
-”আপনার আম্মু ভীষণ রাগী তাই না?”
-”হুম, আগ বাড়িয়ে কেউ কিছু করলে ভীষণ রেগে যান। তাই তোমাকে যতটুকু বলবে তুমি ততটুকুই করবা।”
-”আচ্ছা।”
এভাবে অনেকক্ষণ গল্প করে ঘুমিয়ে খেয়ে তারা মিঠাপুকুর পৌঁছাল। তখন বাজে রাত সাড়ে আটটা। শুদ্ধর মা একজন ভ্যান ওয়ালাকে ঠিক করে রেখেছেন শুদ্ধদের আনার জন্য।
নয়তো এখন কোনো গাড়ি ঘোড়া পাবে না তারা। এমনিতেই গ্রাম তার উপরে রাত আটটা। আর গ্রামে রাত আটটা মানে অনেক রাত। ভ্যান ওয়ালা এখন দাঁড়িয়ে শুদ্ধর অপেক্ষায়।
একটুপরে বাস থেমে শুদ্ধদের নামতে দেখেই ভ্যান ওয়ালা এগিয়ে গেলেন। শুদ্ধ উনাকে দেখে কুশল বিনিময় করে পা বাড়াল ভ্যানের দিকে। শীতলও তাকে অনুসরণ করে গিয়ে দাঁড়াল ভ্যানের পাশে। তারপর শুদ্ধর বলার আগেই সে ধপ করে ভ্যানে বসে পা দুলাতে লাগল। এর আগে ভ্যানে উঠে নি তা নয়। তবে অনেকদিন পর ভ্যানে চড়তে পেরে মন্দ লাগছে না। দু’জন বসলে ভ্যান ওয়ালা চলল শুদ্ধদের বাড়ির দিকে।
চারদিকে অন্ধকার দেখে শীতল সরে গিয়ে শুদ্ধর গা ঘেষে বসল।কোথাও হয়তো শেয়াল নয়তো কুকুর মারামারি করে
উচ্চশব্দে ডাকছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভয়ও লাগছে। একটু পর বড়বড় পুকুর পার হতে হচ্ছে। কেমন যেনো গা ছমছমে রাস্তাঘাট। এদিকে, ভ্যান ওয়ালা গ্রামের গল্প জুড়ে দিয়েছে। শুদ্ধ উনার কথা শুনে দু’একটা জবাবও দিচ্ছে। হঠাৎ ঠান্ডা একটা হাত শীতলের আঙুল স্পর্শ করল। ধীরে ধীরে হাতের আঙুলে গুজেঁ দিলো তার হাতের আঙুল। শীতলের হতবাক
দৃষ্টি তখন তার হাতের দিকেই। এই প্রথম শুদ্ধ তাকে স্বেচ্ছায় স্পর্শ করল। হয়তো এই স্পর্শই জানান দিচ্ছে ‘ভয় পাস না আমি আছি।’
একথা ভেবে শীতল শুদ্ধর হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মৃদু হাসল। চোখ বন্ধ করে শুধু অনুভব করতে লাগল শুদ্ধ কে।একটুপরে ওরা বাড়িতে পৌঁছাল। ভ্যান গিয়ে থামল উঠানে
লাগানো মেহেদী গাছটার পাশে। শীতল নেমে দাঁড়াতেই এক এক তরুণীর উৎফুল্ল স্বর শোনা গেল,
-”আম্মা! ওহ আম্মা, ভাইয়া আইয়া পরছে, বাইরে আহেন। লগে নতুন ভাবিও আইছে। ”
শীতল মেয়েটাকে দেখে হাসল। তাকে সে ভালো করেই চেনে, এটা শুদ্ধর ছোট বোন শখ। ভারি মিষ্টি মেয়েটা। শুদ্ধর মতো
মুখের গড়ন। শখ ততক্ষণে দৌড়ে এসে শীতলকে জাপটে ধরে গদগদ হয়ে বলল,
-”কত্তদিন পর তোমারে দেখলাম। তা কেমন আছো বলো দেহি?”
-”আমি ভালো আছি, তুমি?”
-”মুই সব সময়ই ভালা থাকি, চলো চলো ঘরে চলো।”
অতঃপর শখ শীতলকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। ততক্ষণে শুদ্ধ ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে হাঁটা দিয়েছে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে সে দাঁড়িয়ে গেল। পকেট থেকে ফোন বের করে শিশিরের থেকে জেনে নিলো ওখানকার খবরাখবর। সবটা ঠিকঠাক মতো হয়েছে কী না। শিশির সবুজ স্যারের গোপন ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে জানাল, এখন অবধি সব ঠিকঠাক। এবার সবুজও বুঝবে হিটলারী বুদ্ধি কাকে বলে। শিশিরের কথা শুনে শুদ্ধর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। যদিও এই পরিকল্পনার মাস্টার মাইন্ড সে। শুদ্ধ এটাও জানে তার পেছনে লোক লাগানো হয়েছে নয়তো হবে। তাই তাকেও খুব সর্তক থাকতে হবে। নয়তো সকলেই বিপদে পড়বে। একথা ভেবে সে বলল,
-”ডকুমেন্ট দুই তিনটে কপি করে রাখিস।”
-”আচ্ছা।”
-”আমি এখানে কিছুদিন থেকে তারপর ঢাকায় ফিরবো। তুই ভুলেও বাইরে বের হবি না। তোর যা যা কিছু প্রয়োজন মতি দিয়ে যাবে। এখন রাখছি আমি।”
-”হুম।”
একথা বলে শুদ্ধ কল কেটে ভেতরে প্রবেশ করল। শীতলকে নিয়ে বাকিরা গল্পে মজে আছে। তাই কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। শিশির বর্তমানে ঢাকায় শুদ্ধ ফ্ল্যাটে। সেখানে
বসে সে সবুজের বিরুদ্ধে একটা ভিডিও তৈরি করেছে। আর মুহূর্তেই ভিডিও ভাইরাল হওয়াতে সকলের চক্ষু চড়ক গাছ। যেখানে সবুজের গুরুদায়িত্ব ছিল গোপনীয়তা বজায় রেখে অনৈতিক কাজ বন্ধ করার। সেখানে উনিই টাকার বিনিময়ে অপরাধীদের সাহায্য করেছে। এমনকি নিজে হাতেই উনার স্ত্রীকে খুন করেছে। এর কারণ অবশ্যই এখনো জানা যায় নি। খুব তাড়াতাড়ি জেনে যাবে। শিশির হাতের কাজটা সেরে জানালা দিয়ে ওর বাসার দিকে তাকাল। পোড়াবাড়ি দেখে ওর বুকটা হুহু করে উঠল।খুব শীঘ্রই ওদের বাসা মেরামতের কাজ শুরু করবে সে। ওর বাবার মুখের হাসি ফুটিয়ে তুলবে। পূর্বের মতো গুছিয়ে দিবে তার মায়ের ভরা সংসার। আবার আগের মতো স্বপ্নগাঁথাকে সাজাবে স্বপ্ন দিয়ে। এসব ভেবেই সে ফ্রেশ হওয়ার জন্য শুদ্ধর ড্রেস নিতে ওয়ারড্রোপ খুলতেই একটা ফটোফ্রেম পেলো। ফ্রেমে শীতলের ছবি বন্দী করে নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লিখা, ”শ্রেয়সী”
শিশির এবার শব্দ করে হেসে উঠল। কারণ এটা দেখেই সে শুদ্ধকে শীতলের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। ঠান্ডা মাথায় সে টোপ ফেলেছিল। ভেবেছিল শুদ্ধ সহজে টোপ গিলবে। কিন্তু না, শুদ্ধ তা করে নি। বরং চতুরতার সাথে ফিরিয়ে দিয়েছে
বারবার। মুখ্য কথা শুদ্ধ প্রথমবার শীতলের ছবি দেখে মন হারিয়েছিল।
এই তো সেদিনের কথা শিশির একটা কাজের ব্যস্ত থাকায় শুদ্ধকে পাঠিয়েছিল শীতলের ফ্রম ফিলাপের টাকা জমা দিতে। শুদ্ধ সেটা করে ফিরতে না ফিরতেই শিশির পুনরায় ওকে পাঠায় পিকনিকে তোলা শীতলের ছবি বড় করে বাঁধাই করতে আনতে। শীতল নাকি আবদার করেছে। না করলে সে প্রচুর প্যারা দিবে। একথা শুনে শুদ্ধ সরল মনে কাজটা করে করতে যায়। তাছাড়া শখের বশে কেনা ওর ক্যামেরাটাও সে ফেরত নিবে।নয়তো শিশির এটার দশা বেহাল করে ছাড়বে।
কিছুদিন আগে শিশির ক্যামেরাটা নিয়ে গিয়েছিল জরুরি কাজের কথা বলে। আজ সেটা ফিরিয়ে দিয়ে একটা ছবি দেখিয়ে দেয় যেটা বাঁধাই করতে হবে। শুদ্ধ বিরক্তের নজরে দেখতে গিয়ে তার নজর আঁটকে যায় একটা লাল ড্রেস পরা পরীর দিকে। সে আনমনে দেখতে থাকে একটার পর একটা ছবি। ধীরে ধীরে তার বিরক্তির নজর সরে ভর করে মুগ্ধতা।সেদিনই একটা ছবি রেখে দেয় নিজের কাছে। অনেকদিন
পর শিশির ফাইল খুঁজতে গিয়ে দেখে ফেলে ছবিটা। সেদিন কিছু না বললেও পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে বন্ধুর মনের কথা। তারপর এমন ভাবে থাকত যেনো কিচ্ছু জানে না। দিন যায়, মাস যায়, শুদ্ধর অনুভূতিও গাঢ় হয়। এরপর হঠাৎ সে শীতলের বিয়ের প্রস্তাব রাখে শুদ্ধর কাছে। চতুর শুদ্ধও বেশ হেয়ালি করে পরে ওর মাকে জানিয়ে বিয়ে পাকাপোক্ত করে রাখে। আর বোঝায় বন্ধু কথা রাখতেই সে এ বিয়েতে রাজি। এসব মনে মনে ভেবে শিশির হেসে বলেই ফেলল,
-”শালা, প্রেম পড়েও এমন ভাব করতো যেনো প্রেমবিরোধী
স্যান্নাসী সে। নে তোর স্যান্নাসীর ব্রত ভেঙে প্যারাকে ঝুলিয়ে দিয়েছি। লেও এবার ঠ্যালা সামলাও, বন্ধু এবার বুঝবা বউ কাকে বলে, হা হাহাহা।”
_________________________
ওইদিকে শীতল হাত মুখ ধুঁতে গিয়ে কলপাড়ে আছাড় খেয়ে খুঁটিয়ে হাঁটছে। বাম পায়ে প্রচন্ড ব্যথাও পেয়েছে। প্রথমদিনে এসে এভাবে পড়াতে লজ্জাও পেয়েছে।শখ কোনোমতে ধরে তাকে শুদ্ধর রুমে রেখে গেল। শুদ্ধ তখন তার রুমে টানটান হয়ে শুয়ে ছিল। কিছুক্ষণ আগে সে রাতের খাবার শেষ করে রুমে এসেছে। হঠাৎ কারো উপস্থিত টের পেয়ে শুদ্ধ দু’চোখ
দেখে শীতল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।পরনের কামিজে শ্যাওলা লেগে আছে। শুদ্ধরও বুঝতে বাকি রইল না ঠিক কী ঘটেছে। সে অহেতুক কথা না বাড়িয়ে উঠে শীতলকে ধরে বিছানার বসিয়ে বলল,
-”এবার শান্তি হয়েছে?”
শীতল উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইল। পায়ের ব্যথায় সে কাবু। পরনের কামিজটারও যাচ্ছে তাই অবস্থা। তখন শুদ্ধ আরেকটা ড্রেস এনে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-”আসছি আমি, তুমি ড্রেস বদলে নাও।”
একথা বলে কয়েক পা বাড়িয়েও সে পুনরায় পিছু ফিরে বলল,
-”ব্যথাযুক্ত পায়েই আমি বাসরটা সেরে ফেলব। এটাই হবে আমার কথা অমান্য করার শাস্তি। ”
To be continue……!!