আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -০৪+৫

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশারুল_মিহির

[পর্ব-০৩]

জৈষ্ঠমাসের শেষের দিকে সূর্যের অসহনীয় তাপ। গমগমে হয়ে আছে পরিবেশ। প্রচন্ড গরমে হাহাকার করছে চারপাশ। ভোর হতে না হতেই যেন সূর্য তার রশ্মি দিয়ে চারপাশে উত্তপ্ত করে দিয়েছে। এখন বোধহয় সকাল আটটা কি সাড়ে আটটা বাজে । আবরার হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বনানীর ক্লাবের সামনে চলে এসেছে খেয়ালই নেই তার। বনানী ১৮ নাম্বার সড়কে এই পার্কটি অবস্থিত। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো একবার। অনেক সময় বাহিরে কাটিয়েছে। এবার যাবার পালা। পকেট থেকে মোবাইল বের করে অভ্রকে লোকেশন সেন্ড করে দিলো। এতোক্ষণ হাঁটার ফলে বেশ হাঁপিয়ে গেছে সে। রাস্তার অপর পাশে দোকানের দিম্র এগিয়ে গিয়ে একটা পানির বোতল কিনলো। তারপর দোকান থেকে একটু দূরে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে মাথা থেকে হুডি ফেলে মাক্স খুলে পানি খেয়ে নিলো। তারপর আবার তাড়াতাড়ি করে মক্স পরে নিয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ খেয়াল করে নি তাকে। ফুঁশ করে স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো একটা। হঠাৎ-ই তারই পাশে দাঁড়ানো একটা পিচ্চি ছেলের দিকে নজর গেলো তার। খেয়াল করে দেখলো ছেলেটি তার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি তার দিকে সন্দেহপ্রবন চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি আবরার জুহায়ের? সিঙ্গার রাইট?’

আবরার প্রথমে অবাক হলো পিচ্চির এমন ভাব দেখে। পরোক্ষনে এক গাল হেসে উঠলো। হাঁটু গেড়ে বসে পিচ্চির গুলুমুলু গাল টেনে বললো, ‘ইয়াহ লিটল বয়। আই এম।’

গাল টানায় বাচ্চাটা বিরক্তি হলো সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ছেলেটি বুকে হাত গুঁজে গম্ভীর কন্ঠে বললো, ‘আই এম নট লিটল বয় এন্ড উইথ আউট মাই পারমিশন আমার গালে নেক্সট টাইমে হাত দিবে না।’

আবরার এবার বিস্ময় হয়ে গেলো। এইটুকু বাচ্চার চরম লেভেলের এটিটিউট। আবরার ঠোঁট আরো প্রসারিত করে হাসলো। বললো, ‘তোমার নাম কি?’

ছেলেটা গম্ভীর মুখে উত্তর দিলো, ‘সুফিয়ান। আই’ম সুফিয়ান রয়। একদিন তোমার মতোই বড় সিঙ্গার হবো।’

আবরার আদর করতে আবারো গাল টান দিতে হাত আগালো। সুফিয়ান চোখ পাকিয়ে তাকালো তার দিকে। আবরার হেসে হাত থামিয়ে বললো, ‘বাহ্ সুফিয়ান রয়। দোয়া করি তুমিও একদিন বড় নামকরা গায়ক হবে।’

তখনি কুর্তি পরা এক অর্ধবয়সের নারী এসে সুফিয়ানের হাত ধরলো। অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো, ‘সুফি তুমি এখানে কি করছো? কখন থেকে তোমাকে খুঁজছি।’

সুফিয়ান বিরক্ত হয়ে মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিলো। চেহারা বিবর্ণ করে বললো, ‘উফফ মাম্মাহ্ আই’ম নট সুফি। সুফিয়ান রয়। বলতে কষ্ট হলে এসআর ডাকতে পারো লাইক এবির মতো। তাই না এবি?’

শেষের কথা গুলো আবরারের দিকে তাকিয়ে বললো সুফিয়ান। আবরার মাক্সের ভিতরে নিঃশব্দে হাসলো। তারপর সুফিয়ানের সাথে তাল মিলিয়ে বললো, ‘অফকোর্স মিঃ এসআর।’

মহিলাটি আবরারের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বললো, ‘সরি আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। আসলে সুফিয়ান একটু বেশি দুষ্টু।’

আবরার দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘ইট’স ওকে। এসআর উরফে সুফিয়ান রয়ের সাথে কথা বলে আমার নিজেরও ভালো লেগেছে। তা সুফিয়ান রয় আপনার যদি সময় হয় তাহলে এক কাপ কফি হবে এই এবির সাথে। কি বলেন?’ বলেই ডান হাত বাড়িয়ে দিলো সুফিয়ানের দিকে। সুফিয়ান হেসে হ্যান্ডসেক করে বললো, ‘ইয়াহ্! ওয়ান ডে ইনশাআল্লাহ!’

ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসায় আবরারের কথোপকথন এখানেই সমাপ্তি ঘটলো। সুফিয়ানকে হাত উঠিয়ে টাটা দিয়ে চলে গেলো আবরার। মহিলাটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কারণ আবরার গাড়িতে উঠার আগে মাক্স খুলেছিলো। এতো বড় একজন গায়ক অহংকার ছাড়া রাস্তায় বসে কথা বলছিলো ভাবতেই অবাক লাগছে তার। সে নিজেও তো এবির অনেক বড় ফ্যান।
_________________

কলেজে প্রথম ক্লাস শেষে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে রিমি, নুরা আর দীবা। কারনটা হলো কলেজের ম্যাথম্যাটিক্যাল টিচার মুফতাহির রাজ! বয়স বেশি না। সাবিতের সসমবয়সী হবে বোধহয়। প্রচুর রাগি, গম্ভীর্যপূর্ন মানুষ। এখন তারই ক্লাস হবে তাও আবার হায়ার ম্যাথম্যাটিকস। পড়াবে যতোটুকু তার তিন গুন বেশি ধ’ম’কা’বে। উনাকে রীতিমতো সকল স্টুডেন্টস ভয় পায়।

নুরা গালে হাত রেখে বসে আছে। অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে তার চেহারায়। মলিন কন্ঠে বলে উঠলো, ‘দোস্ত আয় টিসি নিয়ে নেই। এই আলুর দমের ক্লাস আর ভাল্লাগে না।’

রিমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। ভ্রুঁ নাচিয়ে বললো, ‘কেনো কেনো? এখন ভাল্লাগে না কেনো? তুই না উনার উপর ক্রাশ খাইছিলি? প্রথম দিন তো রীতিমত লাফালাফি করছিলি। এখন সেই লাফ গেলো কই?’

নুরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো রিমির দিকে। পাশ থেকে দীবা ঠোঁট চেপে হাসলো। নুরাকে পচাঁনি দিয়ে বললো, ‘সেই লাফ স্যারের ধমকে ফুড়ুৎ হয়ে গেছে।’ রিমি উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। নুরা ঠোঁট উল্টে বসে আছে। মুনতাহির রাজ স্যারের উপর ক্রাশ হয়ে বহুত জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল করেছে সে। তবে যাই হোক, লোকটা মাত্রারিক্ত কিউট। উফফফ’

বেশকিছু সময় পর মুনতাহির রাজ ক্লাসে আসায় সকল শিক্ষার্থী তাকে সম্মান জানানোর জন্য উঠে দাঁড়ালো। রাজ এক পলক সবার দিকে তাকিয়ে ক্লাস করানো শুরু করলো। মনোযোগী হয় সকল শিক্ষার্থী। কিন্তু নুরা মনোযোগ সহকারে রাজকে দেখতে ব্যস্ত।
___________________

সন্ধ্যার আকাশে গোধূলির আবিরে রাঙ্গা স্নিগ্ধ পরিবেশ মাতিয়ে তুলছে চারপাশ। দিনের আলো নিভে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসলো ধরনীতে। আকাশে বিশাল থালা ন্যায় চাঁদটা উঁকি দিয়ে তার জ্যোৎস্নায় মাখিয়ে রেখেছে রাত্রী। আকাশে উড়ন্ত কিছু পক্ষী ঢানা ঝাপটিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে। আর কিছু পক্ষী তার নিজ গন্তব্যস্থলে বসে কিচিরমিচির ডাকছে। সোডিয়ামের রঙবেরঙের কৃত্তিম আলো ছাদের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অপরাহ্নে অম্বরে স্বচ্ছন্দ চাঁদটা তার আপন জ্যোৎস্নায় ছাদের আনাচে কানাচে মিশিয়ে দিয়েছে। চারপাশ নিরব নিস্থব্ধ হলেও মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে ‘শান্তিনিবাস’ থেকে। ছাদে পাটি বিছিয়ে বসে আছে বাড়ির ছোটরা। নিশিতা তাদের পপর্কন, ঝালমুড়ি দিয়ে গেছে কিছুক্ষন আগে। কেউ পপর্কন খাচ্ছে; তো কেউ ঝালমুড়ি।

নুরা হাল্কা কেশে উঠলো সবার দৃষ্টি আকর্ষন করতে। সবাই তার দিকে তাকাতেই সে বললো, ‘এভাবে বোরনেন্স ফিল না করে আসো গেমস খেলি।’

আরিয়ান ত্যাচ্ছিল্য ভাবে হাসলো। পাটিতে আধশোয়া অবস্থায় বসে ত্যাঁছড়া ভাবে বললো, ‘তোরা যেমন গাদা তোদের বলা গেমসও আবলা মার্কা। পারবো না কোনো গেমস টেমস খেলতে। চুপ যা।’

তেঁতে উঠে রিমি। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘খেলতে পারো না সেটা বলো শুধু শুধু গেমসের দোহাই কেনো দিচ্ছো?’

আরিয়ান মুখ ত্যাড়া করে ভেংচি কাটলো। রাইমা দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো, ‘কথায় আছে না নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা।’

আবারো হাসিতে মুখরিত হলো সবাই। আরিয়ান চোখ পাকিয়ে তাকালো রাইমার দিকে। সাবিত নড়েচড়ে বসে নুরার উদ্দেশ্যে বললো, ‘কি খেলা?’

নুরা বললো, ‘চুর পুলিশ খেলবো। ভালো হবে না?’ নুরা কে থামিয়ে আরিয়ান আড় চোখে তাকিয়ে বললো, ‘এহ চুর ডাকাত হওয়ার সখ নাই। আজাইরা খেলা।’

দীবা অনুনয় স্বরে বললো, ‘আরু ভাইয়া প্লিজ অনেক মজা হবে। না করো না।’

আরিয়ান লম্বা হাই তুলে বললো, ‘দীবা বলেছে তাই রাজি হয়েছি ওকে? নাহলে তোদের এই ফালতু খেলায় আরিয়ান জুবাইদ কখনোই রাজি হতো না।’

রিমি ভেংচি কেটে বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ দীবাই তো তোমার বোন। আমরা তো কেউ না।’

আরিয়ান প্রতিত্তুরে দাঁত কেলিয়ে বললো, ‘আসলেই তো। তোদের শীতাকুন্ড পাহারের নিচ থেকে পেয়েছিলো আব্বু। তোরা আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া বোন। কি সাবিত ভাই?’

সাবিত স্বজোড়ে হেসে ফেলে। এক হাতে আরিয়ানের পিঠে চাপড় বসালো। রাইমা রাগান্বিত হয়ে পপর্কনের বাটি মেঝে রেখে বলে উঠলো, ‘রিমি অফ যা। এই হাদারাম গুলার সাথে কথা বলার চেয়ে কচুগাছে লেপ্টে থেকে কথা বলা ভালো।’

ফোঁড়ন কাটলো দীবা, ‘কিন্তু নুরা চুর পুলিশতো চার জন খেলে। আমরা মোট ছয় জন।’

নুরা বললো, ‘তাহলে রাজা রানী খেলি। ছয় জনই থাকবে। রাজা, রানী, মন্ত্রী, সেনাপতি, প্রহরী, প্রজা। রাজার পয়েন্ট বেশি থাকবে, রাজার থেকে কম রানীর, তার থেকে কম মন্ত্রীর, এভাবে সিরিয়ালে পয়েন্ট কমবে। খেলা শেষে যে প্রজা হবে মানে যার পয়েন্ট কম হবে সে হারবে। আর যে হারবে সে উইনার দের কথা অনুযায়ী শাস্তি পাবে। কেমন হবে??’

সবাই একসাথে বলে উঠলো, ‘বেশ হবে!’

নুরা উঠে নিজের রুম থেকে খাতা কলম নিয়ে আসলো। সাদা কাগজ ছিঁড়ে ছয়টা ছোট ছোট টুকরা করে তাতে নাম লিখে ভাজ করে নিলো। তারপর খেলা শুরু হলো। নুরা কয়েকবার রাজা পেয়েছে তো কয়েকবার বাকি গুলো। সাবিত, রাইমা, রিমি, দীবাও রাজা পেয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু বেচারা আরিয়ান প্রহরী আর প্রজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মুখ ফুলিয়ে বারবার কাগজ উঠাচ্ছে। অবশেষে খেলা শেষ হলো। সাবিত কে কত পয়েন্ট পেয়েছে তা গুনছে। সবাই অধিক আগ্রহ নিয়ে বসে আছে রেজাল্ট জানতে।

আরিয়ান হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমি যে লাড্ডু পাইছি সেটা আগে থেকেই জানি।’

নুরা বললো, ‘এতো আগ্রহ নিয়ে পরিক্ষার রেজাল্টের জন্যও অপেক্ষা করি নি।’

অবশেষে সাবিত গণনা শেষে সবার পয়েন্ট বললো। রাজা হয়েছে নুরা, রানী দীবা, মন্ত্রী সাবিত, সেনাপতি রিমি, প্রহরী রাইমা আর প্রজা হয়েছে আরিয়ান। নুরা দীবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ওহ বেবি তুমি আমার রানী; আমি তোমার রাজা। আহ আসো জমিয়ে রোমান্স করি।’

‘ভাইয়ের শাস্তি কি হবে এবার?’ বললো রাইমা। তারপর সকলে ভাবতে লাগলো আসলেই আরিয়ানকে কি শাস্তি দেয়া যায়? পাঁচজন কিছুক্ষন আলোচনা করার পর রিমি আরিয়ানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ভাই তোর শাস্তি হলো তুই একা হাতে, কারোর সাহায্য না নিয়ে আমাদের বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াবি। তোর হাতের রান্না সেই ভাই।’

সবাই সাথে সম্মতি জানালো। আরিয়ানের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো তাৎক্ষনাৎ। নাঃকোচ করে বলে উঠলো, ‘জীবনেও না। কারোর সাহায্য ছাড়া কিভাবে করবো? এটলিস্ট রেসিপি গুলা তৈরি করতে আম্মু নাহয় ছোট আম্মুকে, নয়তো কমলা আন্টির সাহায্য নেই।’

‘না মানে না।’ সবাই এক সাথে বললো। অগ্যত রাজি হতে হলো আরিয়ান কে।
#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-০৪]

‘শান্তিনিবাস’ সর্বদা প্রাণোচ্ছল থাকে। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা মিলেমিশে হাস্যউজ্জল করে রাখে শান্তিনিবাস। একে অপরের প্রতি অঢেল আন্তরিকতা প্রবল সবার। বাড়ির পরিবেশটা কোলাহলে ভরপুর। অভিজাত্য ড্রয়িংরুমে বসে জমিয়ে আড্ডা হচ্ছে। অন্যদিকে টুংটাং ধ্বনি রান্না ঘর থেকে ভেসে আসছে। বড়দের জোরপূর্বক তাদের নিজেদের কক্ষে পাঠিয়ে দিয়েছে সবাই। খেলায় হেরে যাওয়ায় আরিয়ান এখন রান্না ঘরে ব্যস্ত। এতো বড় কাজ করার জন্য তাকে সাহায্য করা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বেচারা এক হাতে পেঁয়াজ কুচি করছে তো অপর হাতে চোখের পানি মুছচ্ছে। আর বাকিদের অবস্থা হেসে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়ার মতো। দীবা অসহায় মুখে বসে রইলো। আরিয়ানকে সাহায্য করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু তাকে সাহায্য করতে দিচ্ছে না কেউ। তাই মন ক্ষুন্ন। কিছুসময় পর রান্না ঘর থেকে আরিয়ানের করুন কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘তোরা এতো নি’র্দয়, পা’ষাণ আগে জানতাম না। একটু তো সাহায্য করে পারিস নাকি?’

রিমি ঠোঁট চেপে হাসলো। ঠাট্টার ছলে চেঁচিয়ে বললো, ‘আর কতোক্ষন আরু ভাই?’

আরিয়ানের চাপা কষ্টসহিত কন্ঠে ধমকে উঠলো, ‘কেন খাওয়ার জন্য আর তর সইছে না?’

সাবিত ফাজলামো করে বললো, ‘আরু আজ মেনো তে কি কি আছে রে?’

আরিয়ান কটাক্ষ করে বললো, ‘হাহ্ একটা রান্না করতেই আমার বারোটা বাজতাছে। আর উনি বলতাছে কি কি আছে। মেঘ নাই আবার জল খুঁজে।’

দীবা সবার দিকে অসহায় মুখে তাকালো। তারপর মলিন কন্ঠে বললো, ‘আমি একটু হেল্প করি? ভাইয়ার একা একা করতে বেশি কষ্ট হবে।’

রাইমা তাৎক্ষনাৎ দীবাকে শাসিয়ে বললো, ‘চুপ থাক তুই। আরু যখন একা একা মিশেলিন স্টার শেফদের রেসিপি ট্রায় করে তখন? তখন একা পারলে এখনো একা পারবে। সাহায্যের দরকার নেই।’

হতাশ হলো দীবা। সাহায্য করতে না পারায় আফসোস হচ্ছে তার। নুরা উৎসুক গলায় বললো, ‘এতো সুন্দর একটা সময়ে আরব ভাই মিসিং। ভাইয়াকে ভিডিও কল দিয়ে কথা বলি কি বলো?’

সবাই সম্মতি জানালো তার কথায়। রিমি চটজলদি উঠে রুম থেকে ল্যাপটপ এনে আবরারকে কল দিলো। সন্ধ্যার পরের সময় আবরার রুমে বসে কাজ করে। তাই কল আসায় তাৎক্ষনাৎ রিসিভ করতে পেরেছে। রিসিভ করার পর ল্যাপটপের স্কিনে পরিচিত প্রিয় মুখ গুলো ভেসে উঠতেই প্রসন্ন হাসি দিল আবরার। রিমি, নুরা আর সাবিত এক পাশে আর তাদের বিপরীত পাশের সোফায় রাইমা, দীবা। তাই তাদের দুজনকে আবরার দেখতে পায়নি। প্রথমে নুরা রিমি একে একে আজকে সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলতে লাগলো আবরারের কাছে। তিনজন মিলে আরিয়ানকে সেই লেভেলের প’চাঁ’নি দিচ্ছে। আবরারও আজ মন খুলে হাসছে তাদের সাথে। তাদের হাসাহাসির শব্দ শুনে রান্না ঘর থেকে আরিয়ান ক্ষুন্ন মনে চেঁচিয়ে বললো, ‘ভাই তুমিও এদের দলে? আমি একা একা সব করছি। মায়া হচ্ছে না?’

আবরার কন্ঠে আফসোস প্রকাশ করে বললো, ‘না না। আমি একদম তোর দলে। ওরা রীতিমতো তোর সাথে অন্যায় করছে। আহারে ভাই আমার একা একা কষ্ট করছে।’

আবরারের করা টিটকারি খুব সহজে আরিয়ান ধরে ফেললো। কপাট রুক্ষতার সাথে কিছু বলার আগেই রাইমা উঠে রিমির পাশে বসে বললো, ‘আরু ভাইয়ার রান্না কিন্তু অনেক ভালো। তুমি আজও মিস করবে।’

আবরার আলতোভাবে হাসলো। বললো, ‘হ্যাঁ জানি। রিমি নুরা ছবিও দিয়েছিলো।’

সাবিত বললো, ‘তুই মিস করছোস ভাই। একবার লম্বা ছুটি নিয়ে আসিস। তখন তোকে আরিয়ান নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে।’

নুরা হেসে বললো, ‘বেশি প্রশংসা করলে পরে ফোলে উড়ে যাবে।’

আরিয়ান রান্না ঘর থেকে অত্যন্ত অসহায়ত্ব কণ্ঠস্বরে বললো, ‘কেউ তো আমাকে সাহায্য কর। এতো নি’ষ্ঠু’র কেনো তোরা? রান্না শেষে সব তো ঠিকি পেটে ঢুকাবি। তাহলে এখন একটু সাহায্য করতে পারছিস না?

দীবা এতোক্ষণ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলো। স্থান প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ আসতেই চটজলদি দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, ‘আমি ভাইয়া কে হেল্প করে আসি।’

রিমি রাইমা বিজ্ঞব্যক্তিদের মতো ভ্রুঁ কুঁচকে বললো, ‘বাবাহ্, আরুর জন্য মায়া উতলে পরছে তোমার।’

আরিয়ান রান্না ঘর থেকে গর্বিত কন্ঠে দীবার হয়ে উত্তর দিলো, ‘আমার বোন হয় বোন। ভাইয়ের জন্য মায়া থাকবে তো কার জন্য থাকবে? তোরা যে আমার কুড়িয়ে পাওয়া বোন সেটা এখন আবারো প্রমান হলো দেখ।’

দীবা এক গাল হেসে বললো, ‘আমি যাই!’

দীবা রিমিদের পিছনের দিক দিয়ে রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। আবরার ল্যাপটপ থেকে শুধু মাত্র লাল কুর্তি পরনে কোমড় পর্যন্ত ছাড়া সিল্কি চুল ওয়ালী দীবার পিছনের দিকটা দেখলো। প্রতিটি কদমের সাথে সাথে দীবার চুল গুলোও ঢেউয়ের মতো দুল খেয়েছে। আবরার পলকহীন দৃষ্টি মেলে দেখেছিলো। চেহারা দেখে নি। তবুও কেন জানি অদ্ভুত মায়া কাজ করলো মনে। ঢেউ হেলানো চুল গুলোতে দৃষ্টি আটকে গেলো। এতো সুন্দর লম্বা চুল? হঠাৎ নিজের এমন ভাবনার কারণে হকচকিয়ে গেলো। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে মাথা থেকে দীবা নামক চিন্তা ঝেড়ে ফেললো তাৎক্ষনাৎ। অতঃপর ভাই বোনদের সাথে আড্ডায় মশগুল হয়।

অবশেষে দীর্ঘ তিন ঘন্টা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরিয়ান বিরিয়ানি, বোরহানি, গ্রিন সালাত। রান্নার ব্যাপারে বেশ আগ্রহ আরিয়ানের আর ভালো রাঁধুনিও বটে। রোশান আর হোসেন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে রাত আটটায়। আরিয়ানের বিরিয়ানি করেছে শুনে খুশী হলো তারা। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। নয়টায় ডাইনিং টেবিলে সবাই এক সাথে বসে খেতে লাগলো। নিশিতা, আয়শা, রোহানা খাবার সার্চ করে দিচ্ছে সবাইকে। তৃপ্তি সহকারে খেয়েছে সবাই। প্রশংসামুখর হলো প্রত্যেকে। আরিয়ানের খাবার বরাবরই পারফেক্ট হয়।
_____________

গভীর রাত! পিনপিন নিরবতা চারদিকে। আকাশে বোধহয় মেঘ জমেছে তাইতো চাঁদ কিছুক্ষণ পরপর উঁকি দিচ্ছে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে পরিবেশ ঢেকে আছে। বারান্দার ডিভানের উপর বসে গিটারে টুংটাং সুর তুলছে আবরার। রিমিদের সাথে কথা বলার পর থেকে কেনো যেনো ভালো লাগছে না তার। বারবার লাল কুর্তি পরা মেয়েটার কথা মনে পরছে। মনে পরছে প্রতিটি পদচরণের সাথে সাথে দুল খাওয়ানো সেই কালো চুল গুলো। শুধু তো মেয়েটার পিছনের দিকটা দেখেছিলো সে। মুখটাও ভালো করে দেখেনি। তবুও কেন বারবার মেয়েটির কথা মনে পরছে? মনটা বিষন্নতায় ছেঁয়ে এলো। কারনটা তার জানা নেই।

চোখ বন্ধ করলো। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে উপভোগ করতে লাগলো নিরব পরিবেশটা। গিটারে আঙ্গুল চালিয়ে টুংটাং শব্দ তুললো। সাথে নিজেও গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো….

হঠাৎ শহরে, বৃষ্টি এলো যে,
প্রথম পলকে ছুঁয়ে যায়,
অচেনা চোখের, অল্প কাহিনী,
বৃষ্টির ফোটারা লিখে যায়।

ঝোড়ো হাওয়া, বেপরোয়া,
নৌকো ভাসায় মেঘেরা,
চোখে চোখে, কিছু কথা,
কি যেনো বলে আমায়।

শুধু শুধু মন আমার,
কেনো যে তোমাকেই কাছে চাই।
বারে বারে কেনো যে,
তোমার দিকে এভাবে তাকাই।

শুধু শুধু মন আমার
কেনো যে তোমাকেই কাছে চাই।
বারে বারে কেনো যে
তোমার দিকে এভাবে তাকাই।
_______________

প্রতিদিন সকালের মতো আজও রোশান বারান্দার ইজি চেয়ারে আয়েশী ভঙিতে বসে আছে। হাতে তার দৈনিক পত্রিকা। যার ‘প্রথম আলো’ সংবাদ পড়ছে তিনি। গম্ভীর তার মুখখানি। রোশানের পাশে বসে চা’য়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে নিশিতা। বেশ কিছুসময় পত্রিকা পড়ার পর নিরবতা ভেঙ্গে চোখে মুখে গম্ভীরতা বিদ্যমান রেখে রোশান বললো, ‘নিশিতা তোমার ছেলেকে বুঝাও যে বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা না।’

স্বামীর কথা শুনে ধাতস্থ হলো নিশিতা। নিশব্দে চা’য়ের কাপ টি-টেবিলের উপর রাখলো। বারান্দায় ঝুলন্ত টবে লাগানো বেবি টিয়ারসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষুন্ন মনে বললো, ‘কি করবো বলো। আজকালকার ছেলে মেয়েরা এমনই। কেউ হুটহাট করা বিয়ে মেনে নেয় না। সময় লাগে খুব।’

সংবাদপত্র থেকে চোখ তুলে নিশিতার দিকে তাকালো রোশান। টেবিলের এক পাশে পত্রিকা ভাজ করে রেখে বললো, ‘দেখো নিশিতা, দীবার বাবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে উনি নিজের প্রান দিয়েছে। এই কৃতজ্ঞতা আমি কখনোই পূরণ করতে পারবো না। দীবার প্রতি আবরারের এমন অবহেলায় আমি রোহানার কাছে লজ্জিত। ধর্মীয় ভাবে ওদের বিয়ে হয়েছে। আবরার তার স্ত্রীকে তার হক থেকে বঞ্চিত করছে।’

নিশিতা আহত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আল্লাহ দীবার বাবাকে জান্নাতবাসী করোক। আমিন!’

রোশান এবার বেজায় জোড় গলায় বলে উঠলো, ‘আবরার কে চট্টগ্রামে আসতে বলো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশিতা। ভড়াট কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘কত বছর হলো ছেলেটা রেগে বাড়ি ছেড়ে গেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রাজি করিয়ে বাড়িতে এনেছিলাম। আবার হুট করে বিয়ে দেওয়ায় ছেলেটা রাতে না খেয়ে চলে গিয়ে গেছে। প্রায় তিন মাস হলো। আর আসবে বলে মনে হয় না।’

রোশান দৃঢ়রূপে অপ্রসন্ন গলায় বললো, ‘প্রথম থেকেই আমার দীবাকে ভালো লাগতো। বিয়েটা আমি আজ নাহয় কাল দিতামই।’

‘হুট করে বিয়েটা মেনে নিতে পারে নি ছেলেটা। সময় হোক মানিয়ে নিবে সব।’

ক্রোধান্বিত হলো রোশান। কন্ঠস্বরে রুক্ষতা বজায় রেখে গম্ভীর মুখে বললো, ‘বিয়ের তিন মাস হয়েছে এখনো বলছো সময় হোক? বিয়েটা কি ছেলেখেলা মনে করে তোমার ছেলে? তুমি তোমার ছেলেকে বুঝাও নিশিতা। মেয়েটাকে মেনে নিতে বলো।’

হতাশ হলো নিশিতা। জীর্ণ কন্ঠে আশ্বাস দিয়ে বললো,’ঠিক আছে। আমি আবরারের সাথে কথা বলবো।’ বলেই খালি কাপ হাতে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। ছেলের এমন খেয়ালিপনায় নিশিতা নিজেও অসন্তুষ্ট।

চলমান…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here