আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -০১+২

‘আমি আবরার জুহায়ের যার জন্য হাজার টা মেয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে আমি কিনা ওই মেয়ের মতো সাধারন একটা মেয়ে কে মেনে নেবো? শুধু মাত্র মা’য়ের জন্য বিয়ে টা করতে হয়েছে।’ বিছানায় শুয়ে সিলিং’য়ের দিকে তাকিয়ে দুই হাত দু দিকে মেলে স্বাভাবিক গলায় বললো আবরার।

পাশে দাড়িয়ে থাকা আবরারের বিশিষ্ট সেক্রেটারি অভ্র সরফরাজ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কণ্ঠস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, ‘তার মানে আপনি ম্যাম কে ভালোবাসেন না?’ উষ্ঠধয় প্রসারিত করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আবরার। যেনো এটা পৃথিবীর সব থেকে বেশী হাস্যকর বাক্য ছিলো। এবির হাসার কারন বুঝতে না পেরে ভ্রুঁ জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে তাকিয়ে রইলো অভ্র।

‘ভালোবাসা হলো মায়া জাল। এই মায়া জালে ফেঁসে যাওয়া মানে সারাজীবনের জন্য নিজেকে অন্য কারোর কাছে হস্তক্ষেপ করে দেওয়া। এমন ভুল এবি কখনো করবে না। ভালোবাসি না কাউকে, আর না কাউকে ভালোবাসবো।’

এবি’র কথা শুনে তার উপর রাগ হচ্ছে অভ্রর। ভালোই যদি না বাসে তাহলে বিয়ে করার কি দরকার ছিলো? তখন পরিবার কে বারণ করতে পারে নি? মেয়েটার তো কোনো দোষ ছিলো না। তাহলে? ক্রোধ মনে দমিয়ে রাখলো সে। কিছু বলার সাহস নেই তার। কারন সে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এবি উরফে আবরার জুহায়ের এর পারসোনাল সেক্রেটারি। তাই নিরবে রাগ দমিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে ঠিক কি বলার জন্য এখানে ডাকা হয়েছে তা জানার অপেক্ষায় আছে সে।

অন্যদিকে আবরার তার কক্ষে আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার উপর থাকা সাদা সিলিং’য়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। কিয়ৎক্ষণ পর অভ্রকে ডাকার মূল কারণ মনে পরার পর বললো, ‘অভ্র? আজকে সন্ধ্যায় যে গান রেকর্ডিং করার কথা ছিলো সেটা আজ ক্যান্সেল করে দাও। আমি অনেক টায়ার্ড আপাতত আমার কিছু রিফ্রেশমেন্ট চাই।’

হঠাৎ রেকর্ডিং ক্যান্সেল করায় অবাক হলো অভ্র। বললো, ‘কিন্তু স্যার হঠাৎ ক্যান্সেল করবেন কেন? গত সাপ্তাহ থেকেই ডিরেক্ট আজিজ গানটা রেকর্ড করার জন্য পিছু ঘুরছে। আজ করার কথা তাও ক্যান্সেল করছেন কেন?’

আবরার লম্বা একটা হাই তুললো। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে অভ্র। তুমি ক্যান্সেল করে দাও। পেইন্ডিং ওয়ার্ক গুলো একটু চেক করে নিও।’

অভ্র প্রতি উত্তরে অভ্র মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ সম্মতি দিলো। তারপর নিরবে দরজা ভিড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। রুমের বাহিরে এসে একবার পিছু ফিরে তাকালো। এবি বরাবরই অদ্ভুত। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা কাজও করবে না। হোক সেটা প্রয়োজন কিংবা অহেতুক।
______________

‘শান্তিনিবাস’
রাত্রি প্রায় ছয়টা পঁচিশ ছুঁই ছুই! বাহিরের পরিবেশ নির্জন। পরিচ্ছন্ন অম্বরে মিটমিট করে তারা জ্বলছে। এক পাশে চাঁদ তার শুভ্র আলোতে ধরনী আলোকিত করে রেখেছে। রাস্তায় সোডিয়ামের কৃতির আলোর নিচে বসে থাকা ঘুটঘুটে কালো কুকুরের আর্তনাদ চারপাশ ভয়াংকর করে তুলছে। শান্তিনিবাসের ড্রয়িংরুম থেকে আড্ডায় মেতে উঠা একদল যুবক যুবতীর হাসি ঠাট্টার ধ্বনি চারপাশ জমিয়ে রেখেছে। রান্না ঘর থেকে সদ্য বানানো গরমাগরম খাবারের সুভাশ সন্ধ্যার পরিবেশ করেছে মুখরিত। বাড়ির গৃহিণী নিশিতা আর আয়েশা এক সাথে হাতে ট্রে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলেন। তাদের দুজনের আগমনে উপস্থিত সবার মুখ উল্লাসিত হয়ে উঠলো। সবাই হাতে গরম পাকড়া নিয়ে কামড় বসিয়ে ‘ইয়াম্ম’ সুর তুললো।

গরম গরম পাকড়া তে কামড় বসিয়ে আরিয়ান বললো, ‘আহঃ এ যেনো এক অমৃত! তোমাদের হাতের পাকড়া খেতে হলেও আজীবন বেঁচে থাকতে হবে!’

‘খাওয়ার সময় বেশি কথা বলতে নেই আরু! খিচকি উঠবে পরে!’ আবরারের চাচি আয়েশা চা’য়ের কাপ আরিয়ানের হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো। একে একে সবাইকে কাপ দেওয়ার পর রাইমা চা কাপে চুমুক বসিয়ে বললো, ‘আম্মু তোমার হাতের চা পৃথিবীর সেরা চা! আমার ভালো থাকার ছোট্ট একটা প্রান!’

রাইমার বড় ভাই সাবিত আড় চোখে তাকালো রাইমার দিকে। কন্ঠস্বর ত্যাঁছড়া করে বললো, ‘ আর কত চা খাইবি? চা খাইতে খাইতে তো শরিরের অবস্থা বারো টা বাজাইছোস। একদম কাইল্লা ট্যাংরা মাছ! পরে তোরে বিয়া দেওয়ার লাইগা দুনিয়া খুইজ্জাও জামাই পাওয়া যাইবো না।’

উপস্থিত সবাই সাবিতের কথায় হেসে উঠলো। রাইমা কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমাকে এতো চিন্তা করতে হবে না। নিজের চর্কায় আগে তেল দাও।’

সাবিত সিঙ্গারায় কামড় দিয়ে চিবুতে চিবুতে বললো, ‘আমার চর্কায় যেই পরিমানের তেল। ওই তেল বেইচা বড়লোক হইতে পারমু। তোর জ্ঞান দেওয়া লাগবো না।’

রিমি ভ্রঁজোড়া কুঁচকিয়ে সাবিতের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ট্যাংরা মাছ কাকে বলছো? তুমি একবার নিজের অবস্থা দেখেছো? ফু দিলেই তো উড়ে যাবে। আবার আসছো অন্য জনকে ট্যাংড়া বলতে হুহ!’

‘তুই জানিস তোকে মাথায় তুলে আছাড় দেওয়া আমার বাম হাতের কাজ? খালি শরিরে একটু মাংস কম তাই এমন দেখায়। কিন্তু শক্তি তার জায়গা মতো আছে!’ শার্টের কলার টেনে ভাব নিয়ে বললো সাবিত।

রিমি এক গাল হেসে টিটকারি জায়গা মতো ছুঁড়ে বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ! তোমাকে দেখলে না অনেক মায়া হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে তোমাকে দিয়ে দেই।’

নুরা হাসতে হাসতে সোফায় হেলান দিলো। তার মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা প্রায়। সবাই এক এক করে সাবিতের দিকে তাকালো। প্রত্যেকের এমন চাহনীতে সাবিত নিঃশব্দে হাসতেই সবাই এক সাথে হেসে ফেললো। কিছুক্ষণ হাসি তামাশা চলতে থাকে তাদের মাঝে। এরই মাঝে আরিয়ান প্রশ্ন করেছিলো, ‘কিরে দীবা কোথায়? সন্ধ্যায় নিচে নামলো না যে।’

রাইমা চায়ের কাপ টি-টেবিলের উপর রেখে উত্তর দিয়েছিলো, ‘দীবার নাকি মাথা ব্যাথ্যা করছে তাই মেডিসিন খেয়ে ঘুমিয়ে আছে।’

~

শান্তিনিবাসের বড় ছেলে হলো আবরার জুহায়ের। আবরারের বাবা হলেন রোশান মাহমুদ আর মা নিশিতা। আরিয়ান আর রিমি তার ছোট দুই ভাইবোন। ছোট কাকা হোসেন মাহমুদ আর চাচিমা আয়েশা। চাচাতো ভাইবোন সাবিত, রাইমা, নুহা। সাবিত আবরারের সমবয়সী। আরিয়ান রাইমার থেকে এক বছরের বড়। রিমি, নুরা আর দীবা সমবয়সী।

দীবা সানজিদাহ! তার মা হলেন রোহানা শেখ। দীবার বাবা আর রোশানের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। দীবার বাবা মা*রা গেছে দেড় বছর আগে। তার পর থেকে সে তার মায়ের সাথে শান্তিনিবাসে থাকে।
________________

জৈষ্ঠমাসের শেষের দিকে এক প্রকার অসয্যকর গরম পরে বাংলাদেশে। আজকেও পরিবেশটা কেমন গুমোট বেধে আছে। সন্ধ্যার অসহ্য তপ্ত গরমে মাথা ঘুরিয়ে ফেলার উপক্রম। বাহিরের অসহনীয় গরম থাকলেও রুমের ভিতর এসি থাকায় শীতল হাওয়া বিদ্যমান। তাই এই অসহ্য গরম অনুভব করতে হয়নি। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভেঙ্গেছে আবরারের। অলস শরির টেনে ওয়াশরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। ল্যাপটপ হাতে নিয়ে রুমে থাকা ডিভানের উপর বসে নিজের গাওয়া একটা গান প্লে করলো। মন তার প্রফুল্লিত, বেশ আনন্দিত। কারন রিসেন্টলি তার গাওয়া গানটি বেশ ভালো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মনে মনে নিজেকে বাহ্ বাহ্ দিচ্ছে সে। ফুরফুরে মনে পূর্ণ মনোযোগ সহকারে গান শুনছে ও ল্যাপটপে কিছু ইমেইল চেক করছে। তখন ডিভানের উপরে থাকা মোবাইলের কর্কষ রিংটোনের ধ্বনি কর্ণপাত হতেই মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটলো তার। ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি তুলে মোবাইলের দিকে তাকালো। স্কিনে ডিরেক্টের নামের অক্ষর দেখে চোখে মুখে তার বিরক্ত এসে হানা দিলো। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মোবাইল হাতে নিয়ে কল রিসিভ করলো আবরার। রিসিভ হওয়ার পর অপর প্রান্ত থেকে ডিরেক্টরের অস্থির কন্ঠ ভেসে আসলো, ‘হ্যালো এবি? হুয়াট’স রং উইথ ইউ? আজকে গান রেকর্ডিং ক্যান্সেল করছো কেনো?’

‘আই’ম নট রেডি ফর দ্যাট টুডে!’ ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো আবরার। তেঁতে উঠলেন ডিরেক্ট। এমন সিরিয়াস একটা কাজে আবরারের এমন অন্যমনস্ক দেখে মোটেও সন্তুষ্ট নন তিনি। তাই কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলেন, ‘মানে কি? তোমার এমন গা ছাড়া ভাবের জন্য আমাদের কত বড় ক্ষতি হবে তুমি জানো?’

‘ইট’স ডাজন’ট ম্যাটার টু মি! আমার আজ গান রেকর্ডিং করতে ইচ্ছে করছে না দ্যাট’স মিনস আমি আজ করবো না। আপনার সমস্যা হলে আমার সাথে ডিল ক্যান্সেল করতে পারেন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। গট ইট মিঃ আজিজ!’ বলেই কল কেটে দিয়ে মোবাইল টা সামনে থাকা টি-টেবিলের উপর ছুঁড়ে মারলো আবরার। বিরক্ত লাগলো বেশ। বিবর্ণ মুখে ল্যাপটপ হাতে নিলো।

অর্ধবয়স্ক ব্যক্তি আজিজ মুখখানি থমথমে হয়ে গেলো। চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ভেসে উঠলো। তার ক্যারিয়ার জীবনে বহুত অনেক সেলিব্রেটির সাথে কাজ করেছে। কিন্তু আবরার জুহায়ের মতো এমন ঘাড় ত্যা’ড়া তার এতো বছর ক্যারিয়ার জীবনে দেখে নি। আবরারের সাথে যতোদিন কাজ করেছে ততো দিনে এইটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছে সে। আবরার একবার কিছুতে না বললে সেটাকে কাঠখড় পুড়িয়েও হ্যাঁ করাতে পারবেন না কেউ। নিঃশব্দে তপ্ত শ্বাস ফেললো ডিরেক্ট আজিজ।

চলমান..#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-০২]

রাত্রির অন্ধকার কে আড়াল করে ভোরের স্নিগ্ধ আলোর রেশ ফুটে আলোকিত করছে পরিবেশ। সূর্য পূর্ব আকাশে উকি দিয়ে তার হলুদ লালচে আভা ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দূরদুরান্তের পাহাড়ি গাছপালার আড়াল থেকে সূর্যোদোয় দেখার মাঝে এক প্রকার আলাদা ভালোলাগা আছে। গাঢ় বেগুনী রঙের পাতলা শাল গায়ে পেছিয়ে বারান্দায় রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে দীবা। সূর্যোদোয়ের মুহূর্তটা মনের মাঝে একরাশ মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিচ্ছে তার। দীবার প্রতিদিনকার কর্মের মাঝে একটি হলো সূর্যোদয় দেখা।

সূর্যোদয়ের পর চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে। দীবা বারান্দা ছেড়ে রুমে এসে চুল আঁচড়ে নিল। গায়ে ওড়না ভালো ভাবে পেঁচিয়ে বেরিয়ে গেলো রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে। ‘শান্তিনিবাস’ বাড়ির প্রত্যেকের সকাল সাতটার আগে ঘুম থেকে উঠা আবশ্যক। ইতিমধ্যে হয়তো সবাই নিদ্রা ভেঙে জাগ্রত প্রায়। দীবা রঙ চা বানিয়ে বাড়ির প্রতিটা সদস্যের জন্য কাপে ঢেলে নিল। একে একে সবার রুমে চা দেওয়া তার দায়িত্ব। এই কাজটা করতে তার বেশ ভালো লাগে। তাই নিজ ইচ্ছায় প্রতিদিন সকালে সবাইকে চা দেয়।

‘রোশ আঙ্কেল আসবো?’

আবরারের বাবা রোশান মাহমুদ কে দীবা রোশ আঙ্কেল বলে ডাকে। এখন তারই রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দীবা। অনুমিত চাওয়ার পর এক মুহূর্তও দেড়ি হয় নি উত্তর আসতে। এতোক্ষণ বোধহয় তারই অপেক্ষা করছিলো তারা। দীবা মুচকি হেসে রুমে প্রবেশ করলো। রোশান আর নিশিতার হাতে চা কাপ দিতে দিতে বললো, ‘শুভ সকাল!’

চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে সন্তুষ্ট হলো রোশান। ঠোঁট টেনে পরিতৃপ্তি হাসি দিলেন একটা। পাশ থেকে নিশিতা বললেন, ‘তুই প্রতিদিন সকালে কেনো কষ্ট করতে যাস বলতো? কমলা কে বললেই তো সে দিয়ে যাবে।’

‘বড় মা তুমি জানো এই কাজটা আমার ভালো লাগে। তাই সবসময় এই চা দেওয়ার দায়িত্ব টা আমি পালন করি।’

‘যাই বলো নিশিতা, দীবার হাতের চা কিন্তু তারই মতো মিষ্টি।’ বলেই চা কাপে আবারো চুমুক বসালেন রোশান। প্রতি উত্তরে নিশিতা আলতো হেসে বললো, ‘তা ঠিক বলেছো।’

দীবা তার নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জিত হলো কিছুটা। মুচকি হেসে বললো, ‘আমি বাকিদের চা দিয়ে আসি।’

রোশানের কক্ষ ত্যাগ করে সাবিত আর রাইমা কে চা দিয়ে আসলো দীবা। সব শেষে আরিয়ানের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আরিয়ান প্রতিদিন সকালে দেড়ি করে উঠে। নয়তো তাকে টেনে টুনে তুলতে হয়। আজও তাই হলো। দীবা আরিয়ানের রুমে এসে দেখে সে বিছানায় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

‘আরু ভাইয়া উঠো। দেখো সকাল হয়ে গেছে।’ টেবিলে চা রাখতে রাখতে বললো দীবা। আরিয়ান ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো, ‘দীবা বইন রাতে অনেক দেড়ি করে ঘুমাইছি। এখন একটু ঘুমাইতে দে প্লিজ। ডাক দেইছ না।’

‘না এখন উঠো। রোশ আঙ্কেল জানতে পারলে বকাবকি করবে তোমাকে। উঠো তাড়াতাড়ি!’

আরিয়ান ঘুমের কারনে চোখ মুখ খিঁচে শুয়া থেকে উঠে বসলো। চোখে তার আকাশ সমান ঘুম। কাচা ঘুম ভাঙ্গার কারনে বিরক্ত হলো বেশ। অপ্রসন্ন চোখে মুখে বললো, ‘ সমস্যা কি তোর? প্রতিদিন আমার ঘুমের বারো টা না বাজালে হয় না?’

দীবা ভেংচি কেটে বললো, ‘হুহ রোশ আঙ্কেলের বকা থেকে বাঁচাই তাও ভালো লাগে না? নাও চা খাও।’

আরিয়ান প্রসন্ন হয়ে হাসলো। এগিয়ে দীবার হাত থেকে চা কাপ নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে বললো, ‘তোর হাতের চা সত্যি সেরা হয়।’

আরিয়ান দীবার হাতের চা অনেক পছন্দ করে। দীবাকে নুরা, রিমির মতোই ছোট বোনের মতো অনেক আদর করে। আরিয়ানকে চা দিয়ে দীবা মুচকি হেসে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।

ছুটির দিনে অর্থাৎ শুক্রবার রিমি, নুরা আর দীবা প্রতিদিন ভোরে ছাদে বসে গল্প করে আর স্নিগ্ধ সকাল উপভোগ করে। আজকেও ছাদের এক পাশে উঁচু করে ইট দিয়ে বাধানো ব্যাঞ্চে বসে আছে তিন জন। সাথে আছে দীবার বানানো চা। ওরা তিন জন সমবয়সী। দীবা পরিবারের সাথে যখন আগ্রাবাদ থাকতো তখন নুরা রিমির সাথে তার পরিচয় হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তারা তিন জন খুব ভালো বন্ধু।

‘ভাইয়ার নতুন গান টা সেই মার্কেট পাইছে রে। আমার তো অনেক ভাল্লাগে গানটা।’ উল্লাসিত কন্ঠে বলে উঠলো নুরা। রিমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো, ‘হুম সুন্দর ছিলো গানটা।’

দীবা গানটা শুনে নি। তাই সরল মনে প্রশ্ন করে বসলো,’কি গান?’ বিস্মিত চোখে তাকালো নুরা রিমি। ওদের এমন চাহনীতে দীবা কিছুটা হকচকিয়ে যায়। নুরা অবাক হয়ে বললো, ‘তুই শুনিস নি?’

দীবা ঘাড় নাড়িয়ে ‘না’ সম্মতি জানালো। রিমি দীবার বাহুতে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘কোন গ্রহে থাকিস তুই? রিলিজ হওয়ার সাত দিনেই ফেসবুক ইউটিউব কাপাচ্ছে গান টা। ওয়েট শুনাচ্ছি!’

মোবাইল বের করে ‘#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ – আবরার জুহায়ের’ গানটা প্লে করে রিমি। মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো তারা তিনজন। উপভোগ করলো প্রতিটা লাইন।
_________________

মিউজিক স্টুডিও তে বসে আছে আবরার। গায়ে নরমাল ব্ল্যাক হুডি। চোখেমুখে তার প্রাপ্তির হাসি। প্রতিবারের মতো এবারও বেশ দক্ষতার সাথে গান রেকর্ড করেছে সে। সামনে বসে থাকা ডিরেক্টর আজিজ অতিমাত্রায় খুশিতে তাকে হাত তালিয়ে দিয়ে ‘শাবাশ’ দিচ্ছে বারংবার। নিজেকে প্রশংসামুখর হতে দেখে বাঁকা হাসলো আবরার। যদিও এই লোকের সাথে কাজ করতে একদম ইচ্ছে নেই তার, কারন বরাবরই একটু বেশি আদিক্ষেতা করে।

‘বাহ্ আবরার বাহ্! তোমার গানের গলা সত্যি প্রশংসাযোগ্য। বরাবরই ফাটিয়ে দিয়েছো। এই রেকর্ড টাই ফাইনাল।’ উল্লাসিত হয়ে বলে উঠলো ডিরেক্টর আজিজ। প্রতিত্তুরে আবরার নিরবে হাসলো কেবল। ডিরেক্টর গান টা আবার প্লে করে শুনতে লাগলো।

রেকর্ড শেষে ডিরেক্ট কে বিদায় দিয়ে অভ্র কে নিয়ে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে আসলো আবরার। বাহিরে আসার আগেই মাথায় হুডি উঠিয়ে চোখে কালো সানগ্লাস, মুখে কালো মাক্স পরে নিলো। গাড়ির কাছাকাছি এসে আশেপাশে তাকালো সে। তারপর অভ্রের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘অভ্র তুমি চলে যাও। আমি একটু মর্নিং ওয়ার্ক করবো।’

অভ্র দাঁড়িয়ে পরলো। এবির এমন কথায় অবাক হলো কিছুটা। এই অবস্থায় বাহিরের কেউ দেখে ফেললে পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে যাবে। সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে পরবে তার জন্য। তাই অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো, ‘কিন্তু স্যার আপনাকে কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে। গার্ড বেশি নেই এখানে। সবাইকে সামলানো পসিবল হবে না।’

‘ফিকার নট ব্রাদার। মাক্স পরে রেখেছি কেউ চিনতে পারবে না। সারাদিন নিজেকে আড়াল রাখতে রাখতে বিরক্ত হয়ে গেছি। এখন একটু খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করবো। তুমি যাও আমি পরে ইনফর্ম করে দিবো তোমাকে।’

চোখ বন্ধ করে দুই হাত দুইদিকে মেলে আড়মোড় ভেঙ্গে আবরার। আজকের স্নিগ্ধ সকালটা উপভোগ্য। কিছুতেই মিস দেওয়া যাবে না। মনের খুশিতে মৃদু হাসলো আবরার। অভ্র চুপচাপ সম্মতি দিলো। তারপর নিরবে গাড়িতে উঠে চলে গেলো। আবরার আশেপাশে আরো একবার সতর্ক মূলক দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে নিলো। তারপর দুইহাত পকেটে গুঁজে শীষ বাজাতে বাজাতে রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করলো। মনে মনে গুন গুন করে গান গাইছে সে। আজকে মন বেশ ফুরফুরে কারণ টা জানা নেই তার।

রাস্তার পাশ ধরে অনেকেই ব্যস্ত পায়ে চলছে। পিচ ঢালা রাস্তায় অল্পসংখ্যক গাড়ি তুমুল বেগে চলছে। আবরার আশেপাশে দেখতে দেখতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ-ই তার দৃষ্টি গেলো রাস্তার অপর পাশে। তাৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পরলো সে। কৌতুহল বশত তাকিয়ে রইলো সেদিকে। দেখলো একটা যুবকের বাহু ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতি। মেয়েটির হাতে কয়েকটা গোলাপ ফুল। ছেলেটির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। মেয়েটি অনেক খুশি সেটা তার চোখমুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আবার ঠিক তাদের পাশে দুইজন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা। বৃদ্ধা তার স্ত্রীর হাত ধরে স্বযত্নে সিএনজি তে উঠতে সাহায্য করছে। মৃদু হাসলো আবরার। মুগ্ধ হলো সে। একজনের পথচলা শুরু তো অপর জনের শেষ অব্ধি চলা। তাহসানের একটা গানের লাইন মনে পরলো তার। ‘আমার বেঁচে থাকার প্রার্থনাতে, বৃদ্ধ হতে চাই তোমার সাথে।’

তখুনি মনে পরলো তারও তো একটা বউ আছে। বৈধভাবে বিয়ে হয়েছে তার। হালাল সম্পর্ক। সেই মেয়েও কি তার হাত ধরে বৃদ্ধ হবে? সারাজীবন পাশে থেকে ভালোবাসবে? নাকি অন্যান্য নারীদের মতো লোভী হবে? টাকার লোভে পরে অন্যের হাত ধরে চলে যাবে? মুহূর্তেই বিরক্তি চলে আসলো তার মাঝে। রাগ উঠলো তার। নারীদের প্রতারক মনে হয় তার কাছে। অবশ্য এমন মনে করার অনেক কারণও আছে। তারই কাছের বন্ধুর লাইফের লাভ স্টোরি অনেক করুণ। তাছাড়া বিভিন্ন তারকা, গায়ক, চিত্রনায়ক, শিল্পী কারোর বিবাহিত সম্পর্ক দীর্ঘক্ষণ ছিল না। কোনো এক পর্যায়ে এসে বিচ্ছেদ হয়েছেই। যার ধরন তার মাঝে এই ধারনা তৈরি হয়েছে। তাই এইসব প্রেম ভালোবাসার আদিক্ষেতায় নিজেকে জড়াতে চায় না সে। ফালতু চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে হাঁটতে লাগলো আবার। আপাতত সকালটা উপভোগ করা দরকার।
_________________

আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার অন্তর্গত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সুবিশাল জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রতিষ্ঠানটি। দীবা, নুরা, রিমি এই কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। সকালে কলেজের ইউনিফর্ম পরে তৈরি হয়ে নিলো তিন জন। নাস্তা করার জন্য টেবিলে গিয়ে দেখলো সবাই উপস্থিত প্রায়। রোশান আর হোসেনের অফিস আছে বলে তারা দুই জন সাতটায় নাস্তা করে আটটায় বের হয়ে চলে যায়। পরে বাড়ির ছোটরা বসে নাস্তা করে। এখন নিশিতা, আয়শা, রোহানা আর কমলা মিলে টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে আর সবাইকে বেড়ে খাওয়াচ্ছে। সব টেবিলে ঘুছিয়ে দেওয়ার পর রান্না ঘরে চলে যায় তারা। দীবা, নুরা রিমি পাশাপাশি চেয়ারে টেনে বসে পরলো।

আরিয়ান আড় চোখে তাকালো তিনজনের দিকে। পরোটা মুখে দিয়ে বলে উঠলো, ‘কিরে? কলেজেই তো যাচ্ছিস এতো সাজার কি আছে?’

রিমি কপাল কুঁচকে আরিয়ানের উদ্দেশ্যে ভেংচি কেটে উঠলো। নুরা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো, ‘তোমাদের মতো হাবলা সেজে যাবে কারা? আমরা সাজি বলে হিংসে হয়? সাজবে?’

প্রতিত্তুরে আরিয়ান ত্যাঁছড়া ভাবে হাসলো। তিরস্কার করে বললো, ‘এতো ঢং আমাদের নাই। আমরা এমনিতেই হ্যান্ডসাম। এতো আটা ময়দা মাখা লাগে না।’

রিমি বললো, ‘এ্যাঁ আসছে আমাদের হ্যান্ডসাম। দেখতেও তো সুন্দর না তার উপর আবার তোমাদের সাজা তো বিলাসিতা। এমন করলে আমাদের আর এই জন্মে ভাবি দেখা হবে না।’

নুরা, দীবা, রাইমা হেসে ফেলে। আরিয়ানের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। মুখখানি কালো করে আফসোস স্বরে বলে উঠলো, ‘দেখো দেখো আজ সিঙ্গেল বলে কেমন অপমান সহ্য করতে হচ্ছে।’

সাবিত আরিয়ানের কাধে চাপড় বসালো। তারপর ভাব নিয়ে বললো, ‘একদিন হুট করে বউ নিয়ে আসবো দেখিস। ওইদিন ওদের মুখে কস্টেপ লাগিয়ে দিবো।’

রাইমা তার ভাইয়ের কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে উত্তরে বললো, ‘ওই দিন দেখতে আমাদের দশ বার জন্ম নিয়েও লাভ হবে না।’

আয়শা রান্না ঘর থেকে বের হতে হতে ধমকে উঠলেন। বললেন, ‘খাওয়ার সময় এতো কথা কিসের হ্যাঁ? কি নিয়ে আলাপ করছিলি তোরা শুনি?’

নুরা দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো, ‘মা তোমার ছেলে তার ব..”

কথা সম্পূর্ণ করার আগেই সাবিত তার মুখ চেপে ধরলো। চোখ বড়বড় করে তাকালো নুরা। সাবিত আয়শার দিকে তাকিয়ে ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বললো, ‘ভালো রান্না করো সেটাই বলছিলাম। তাইনা নুরা।’ শেষের কথাটা নুরার দিকে চোখ পাকিয়ে বললো সাবিত। মুখ টিপে হাসলো সবাই।

নাস্তা শেষে নুরা, রিমি আর দীবা বাড়ির গাড়ি দিয়ে একসাথে কলেজে চলে যায়। আরিয়ান রাইমা কে তার ভার্সিটিতে নামিয়ে নিজে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এ চলে যায়। সাবিত আপাতত তাদের নিজস্ব ব্যবসায় সামলাতে ব্যস্ত। আবরার না থাকায় এখন পারিবারিক ব্যবসা তাকেই সামলাতে হচ্ছে।

চলমান…

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[সূচনা পর্ব]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here