আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -০৮+৯+১০

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-০৮]

আচমকা কেউ হাত ধরায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। ভরকে গিয়ে নুরা ও রিমির দিকে তাকালো। অবাক হয়ে অসহায় চোখেমুখে বললো, ‘তোরা যাস নি?’

রিমি মাথা এপাশ থেকে ওপাশ দুলিয়ে বললো, ‘নাহ্। তুই নাস্তা করবি না; তোর ঘাড় করবে। আয় তাড়াতাড়ি।’

অসহায় হলো দীবা। কাদুকাদু গলায় বলে উঠলো, ‘আমি নিচে যাবো না।’

রিমি নুরা কেউ তার কথার গুরুত্ব দিলো না। জোরপূর্বক দীবার হাত ধরে নিচে নিয়ে আসলো। দীবা প্রথমে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু নিচে আসায় হাত মোচড়ামুচড়ি করা থামিয়ে দিলো। দীবার এক হাত ধরে নুরা ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলে রাইমা বলে উঠলো, ‘কিরে? এতো লেইট করে আসলি কেন তোরা?’

রাইমার কথা শুনে টেবিলে থাকা সবাই তাদের দিকে তাকালো। আবরার তাকাতেই দীবার দিকে চোখ আটকে গেলো তার। তখন দূর থেকে দেখেছিলো। কিন্তু এখন কাছ থেকে দেখলো। ইউনিফর্মে মেয়েটাকে প্রচুর কিউট লাগছে। তার উপর আবার এখন মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। সবার সামনে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো না আবরার। চোখ ফিরিয়ে নিলো। তবে চোরা চোখে তাকাতে ভুললো না একদম।

দীবা মুখ কালো করে নুরার হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিলো। ক্ষুব্ধ চোখে নুরার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হা’রা’মি দুইটা।’

টেবিলের এক পাশে সে চুপচাপ বসে পরলো। তার ঠিক সামনের চেয়ারে আবরার। চেয়ারে বসার পর আবরারকে দেখে অসাড় হলো দীবা। ইশ! কি ভুলটা করলো সে। ভালো করে দেখে পাশের চেয়ারটায় বসতে পারতো। মনে মনে নিজের বোকামোতে শখানেক গালি দিলো। নিঃশব্দে খাওয়া শুরু করলো সে। কিছুক্ষণ পর আবরার চোখ তুলে দীবার দিকে তাকালো। পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো দীবাকে। গোলগাল চেহারা! ঠোঁট একদম পাতলা গোলাপি আস্তরণ! সিল্কি কালো চুল! গায়ের রঙ উজ্জ্বল! সব চেয়ে সুন্দর টানা টানা চোখ দুটো আর গোল গোল গাল দুটো। মিষ্টি লাগছে একদম। খাবার চিবুতে চিবুতে দীবার দিকে তাকিয়ে আছে আবরার। দীবা খাওয়ার ফাঁকে চোখ তুলে সামনে তাকাতেই আবরারের চোখে চোখ পরলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো দীবা। চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। কিন্তু আবরার চোখ ফিরালো না। তাকিয়ে রইলো একমনে। অস্বস্তিতে মিহিয়ে এলো দীবা। আবরারের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলো তারই দিকে তাকিয়ে আছে আবরার। জড়তা এসে গ্রাস করলো দীবাকে। দ্রুত খাবার খেতে লাগলো। এখান থেকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে পারলেই বাঁচে!

দীবাকে এতো তাড়াতাড়ি খেতে দেখে সাবিত বললো, ‘কিরে পাকনি। এতো তাড়াতাড়ি খাইতাছোস ক্যান? তোর খাবার কি কেউ নিয়া যাইতেছে? আস্তে খা!’

সবাই দীবার দিকে ফিরে তাকালো। তাদের চাহনীতে দীবা ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। দ্রুত চালিত হাত ধীর হলো। আস্তে আস্তে কোনো মতে অর্ধেক খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়াল। এতো তাড়াতাড়ি উঠতে দেখে রাইমা অবাক হয়ে বলে উঠলো, ‘উঠলি কেন? কিছুই তো খেলি না।’

দীবা ঠোঁট টেনে হাসি দিয়ে উত্তর দিলো, ‘আপু আমার ক্ষিদে নেই। আর খাবো না। রিমি আমি গাড়িতে যাচ্ছি। তোদের শেষ হলে চলে আসিস।’

কারোর প্রতিত্তুরের অপেক্ষা করলো না দীবা। দ্রুততার সাথে টেবিল থেকে চলে আসলো। রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে বাগানে গেলো। এবার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো দীবা।

আবরারের কি হলো কে জানে! দীবার এমন কান্ডে সকলের অগোচরে আলতো ভাবে হাসলো। মেয়েটিকে কিউটের অতিরিক্ত মাত্রায় ফেলে দিলো সে। আর ক্যারিয়ারে অনেক তারকাদের সাথে দেখা হয়েছে। তারা সবাই যথেষ্ট সুন্দরী। কিন্তু কাউকে দিকে অন্য নজরে দেখেনি আবরার। তবে দীবাকে এক পলক দেখার পর থেকেই অদ্ভুত রকমের ভালোলাগা কাজ করতে মনে। ভীষণ ভাবে দীবার মায়ায় আটকে পরেছে সে। তবে এটাই কি পবিত্র বন্ধনের শক্তি? মনে মনে এইসব ভাবতে ভাবতেই খাবার শেষ করলো আবরার।

সকালের নাস্তা শেষে রিমি ও নুরা বেরিয়ে গেলো কলেজের উদ্দেশ্যে। অন্যসময় রাইমাকে ভার্সিটিতে আরিয়ান নামিয়ে দিতো। কিন্তু আজ রাইমা একা ভার্সিটি গেছে। আরিয়ান, সাবিত মিলে আবরার ও অভ্রকে নিয়ে বের হবে ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
___________________

আকাশটা মেঘলা। থোকায় থোকায় কালো মেঘ ভাসছে। প্রবল বাতাস প্রভাহমান। চারপাশ নিঝুম নিস্তর থাকলেও কলেজ ছুটি শেষে শিক্ষার্থীদের কোলাহলে জমজমাট হয়ে গেছে। বৃষ্টি নামার আগে বাড়ি ফিরার তাড়া শিক্ষার্থীদের। সকলের মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে দীবা। দুই হাতে ব্যাগের ফিটা টেনে ধরে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে।তার সামনেই নুরা রিমি কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। দীবা আস্তে আস্তে হাঁটার কারণে পিছিয়ে পরেছে তাদের থেকে। সে দিকে ধ্যান নেই তার। অন্যমনস্ক হয়ে আছে মন। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। দ্বিতীয়বার লোকটার সামনে পরতে চায় না সে। ভয়, জড়তা, অস্বস্তি লাগে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ-ই কারোর সুঠাম দেহের সাথে ধাক্কা লাগায় হকচকিয়ে গেলো দীবা। ধ্যান ভাঙ্গলো তার। বাহুতে হাত রেখে সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে দেখে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠলো, ‘স্যরি স্যার। আই’ম রিয়েলি স্যরি। আসলে আমি..!’

দীবার কথা সম্পূর্ণ হতে দেয়নি রাজ। তার আগেই কথার পিঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ‘ইট’স ওকে। ব্যাথা পেয়েছো?’

ডান হাতের কব্জি বরাবর ব্যাথা পেয়েছে দীবা। কিন্তু স্বীকার করলো না। মাথা নাড়িয়ে মুখে বলে উঠলো, ‘না স্যার।’

‘ঠিক আছে। সাবধানে যাও।’

দীবা মাথা হালকা কাত করে সম্মতি দিলো। তারপর রাজকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। স্থির দাঁড়িয়ে রইলো রাজ। এক দৃষ্টিতে দীবার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সবসময় হাস্যউজ্জ্বল থাকা মেয়েটি হঠাৎ এতো অন্যমনস্ক হলো কেন? দীবা কলেজ আসা থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্লাস ও এখন অব্ধি রাজ নোটিস করেছে। মেয়েটার মন আজ অন্যমনস্ক। অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু ভার মন। কিন্তু কেন? কিছু হয়েছে কি? চিন্তিত হলো রাজ। তারপর হঠাৎ-ই মনে পরলো কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া আকস্মিক ঘটনার কথা। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার মেয়েটির স্পর্শ পেয়েছে সে। প্রথম স্পর্শ ছিলো মেলাতে। আর আজ! দীবার শরিরের মিষ্টি ঘ্রাণে আবারো নতুন করে প্রেমে পরতে বাধ্য হলো রাজ। আনমনে আলতো ভাবে বাঁকা হাসি দিলো একটা।

দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো দীবা। কিছুসময় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য এখনো হতভম্ব সে। ধা’ক্কা লাগার জন্য আর কেউ ছিলো না? স্যারের সাথেই ধা’ক্কা লাগতে হলো। ব্যাপারটা লজ্জাজনক লাগলো দীবার কাছে। নিজের উপর নিজেরই বিরক্ত লাগছে। কলেজ থেকে নেমে সামনে খোলা মাঠে আসার পর নুরা ও রিমিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো দীবা। তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই নুরা তাৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করে উঠলো, ‘স্যারের সাথে কি কথা বলছিলি এতোক্ষণ?’

এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হলো দীবা। তার থেকেও বেশি বিরক্ত হলো এতোক্ষণ কথাটা শুনে। নুরার দিকে অপ্রসন্ন চোখে তাকিয়ে ত্যাঁছড়া গলায় বলে উঠলো, ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচছিলাম। দেখিস নি?’

রিমি হেসে উঠলো। নুরা কলেজের দ্বিতীয় তলায় তাকিয়ে দুইজন কে ইশারা করে বললো, ‘বোইন দেখ, স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয় আমাকে দেখছে।’ চোখেমুখে মুগ্ধতা এনে বললো।

নুরার কথা অনুসরণ করে দ্বিতীয় তলার বারান্দার দিকে তাকালো রিমি দীবা। রাজকে পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। দৃষ্টি তাদের দিকে। কিন্তু আদৌ কি তাদের দেখছে? আশেপাশে তো কতো শিক্ষার্থী আছে। নুরা সবসময় একটু বেশি নেগেটিভ ভাবে। তাই রিমি বললো, ‘তোর চিন্তাভাবনা ফেনার লগে ভাইসা গেছে। পাগল মাইয়া। স্যারের আর কাম কাইজ নাই? তোরে দেখতে যাইবো কোন দুঃখে?’

নুরা বললো, ‘কারণ স্যারের চোখে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে আমি। সুতরাং আমাকেই দেখবে। এটা স্যারের সিক্রেট তাই কেউ জানে না। শুধু আমি জানি।’

রিমি নুরার মাথায় গাট্টা মেরে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘তোর ছাগলামি বাদ দে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ। বৃষ্টি নেমে যাবে।’

নুরা ও রিমি বকবক করতে করতে গেইটের দিকে এগিয়ে গেলো। দীবাও তাদের পিছু হাঁটতে লাগলো। কি মনে হতে যেন পিছু ফিরে একবার দ্বিতীয় তলায় তাকালো। দেখলো রাজ তারই দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপার টা কেমন অদ্ভুত লাগলো দীবার কাছে। অপ্রীতিজনক! চোখ দিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। দ্রুত পা চালিয়ে গেইটের বাহিরে চলে আসলো। দীবা বেড়িয়ে যেতেই নড়েচড়ে দাঁড়ালো রাজ। চলে যাওয়ার আগে দীবা পিছু ফিরে তার দিকে তাকিয়েছে। এই চাহনীটা রাজের বুকে গিয়ে বাধলো। মনে ভালো লাগা কাজ করতেই এক হাতে মাথা চুলকে মৃদু হাসলো।
___________________

আষাঢ়মাসের অম্বর কালো কাদম্বিনীতে ঢেকে আছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ আর আড়ম্বর জানান দিচ্ছে কিয়ৎক্ষণ পর চট্টগ্রাম শহর বর্ষণমুখর হবে। পিচ ঢালা রাস্তা ভিজে একাকার। বর্ষণের ভাড়ি ফোটাতে কৃষ্ণচূড়ার ফুল গুলো নুইয়ে পরেছে। কদমফুল ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে আছে। ক্ষীণ সময় পরপর আকাশ আলোকিত করে গর্জে উঠছে চারপাশ। ঘুরাঘুরি শেষে বিকেলের শেষাংশে বাড়ি ফিরলো চারজন। আবরার, অভ্র, আরিয়ান ও সাবিত। বাহিরে ঝিরঝির বৃষ্টি ছিলো। তাই আবরারের শার্টের কাধের অংশবিশেষ ভিজে আছে। বর্ষণে মুখরিত চট্টগ্রামের পরিবেশ দেখার মতো। বেশ উপলব্ধি করেছে সে। এক হাতে ভিজে যাওয়া চুল গুলোতে আঙুল চালিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো আবরার। দরজা খুলে রুমে পা রাখবে এমন সময় দীবা কে তার রুম থেকে বের হতে দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো সে। দীবা আবরার কে দেখেই তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। বুকে হাত রেখে জুড়ে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। দীবার এহেন কান্ডে আবরার অবাকের শেষ প্রান্তে। ভয়াংকর রকমের রাগ হলো তার। সে কি বাঘ নালি ভাল্লুক যে তাকে দেখে দরজা লাগিয়ে ফেলবে? নাকি সে দেখতে খারাপ? আবরার এবার এক প্রকার জগন্য প্রতিজ্ঞা করে ফেললো। সে ভুলেও আর দীবার দিকে তাকাবে না। তাকানোর দরকারও পরে না। মনে মনে ক্রোধ দমিয়ে রেখে রুমে প্রবেশ করলো। দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাঁড়াল আবরার। এই মুহূর্তে ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর প্রয়োজন তার।

চলমান..#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-০৯]

‘চট্টগ্রামের পরিবেশ এতো সুন্দর আগে জানা ছিলো না। তার উপর আবার আজ বৃষ্টির দিন ছিলো।’

ঘুরাঘুরি শেষে অভ্র আরিয়ান এক সাথে নিজেদের রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। তখন অভ্র কথাটি বললো। আরিয়ান প্রতিত্তুরে গর্বিত কন্ঠে শুধালো, ‘চট্টগ্রাম মানেই প্রকৃতির রানী। হোক সেটা বৃষ্টিতে ভেজা পরিবেশ কিংবা গ্রীষ্মের কাঠ ফাটা রোদের দৃশ্য। এমন পরিবেশে প্রেম প্রেম পায়। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে আমার একটাও গফ নাই।’

আরিয়ানের কথায় হেসে ফেললো অভ্র। ঠোঁট প্রসারিত করে আক্ষেপের কন্ঠে ‘হায় হায়’ করে উঠল। অতঃপর আরিয়ানের উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমার মতো এতো সুন্দর একটা ছেলের গফ নেই বিশ্বাস হয় না ভাই।’

‘ভাই, তুমি নিজেও তো সুন্দর। তাহলে তোমার গফ নেই কেন?’ কথার পিঠে প্রশ্ন ছুড়ে মারলো আরিয়ান। তার এমন কথা শুনে ভিমরি খেলো অভ্র। ঠোঁট টেনে ফিচেল গলায় বলল, ‘আসলে এইসব নিয়ে কখনো ভাবি নি তাই।’

‘না মূল বিষয় টা হচ্ছে আমাদের মতো এত্ত ইন্টেলিজেন্ট কিউট হ্যান্ডসাম ছেলেদের গফ হবার যোগ্যতা কারোর নাই।’ আরিয়ানের কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো অভ্র। আরিয়ান নিজেও হাসলো। তখুনি কানে আসলো অন্য কারোর কন্ঠস্বর।

‘আসলে মেয়েরা তোমাদের পাত্তা দেয় না তাই তোমরা সিঙ্গেল। শুধু শুধু ঢাক ঢুল পিটিও না।’

রিমির কথা কর্ণগোচর হতেই পিছনে ফিরে তাকালো দুইজন। অভ্র ভ্রুঁ কুঁচকে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে রিমিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো একবার। পরনে তার হুয়াইট কালার শার্ট সাথে জিন্স। ক্যারামেল কালার করা চুল গুলো পিঠ পর্যন্ত ছুঁই ছুঁই। ধবধবে ফর্শা গায়ের রঙ, উজ্জ্বল বর্ণের অধিকারিণী এই রমনী। চোখের কালো মনিতে চোখ পরতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল অভ্র।

‘হুয়াট ডু ইউ মিন বাই মেয়েরা পাত্তা দেয় না? মেয়েদের পাত্তা পেতে আমরা বসে থাকি না। আসলে এতো সুন্দর ছেলেদের তারা ডিজার্ভ করে না।’ আরিয়ান ত্যাঁছড়া ভাবে প্রতিত্তুর করলো।

রিমি কূটস্থ করে বললো, ‘মেয়েদের চয়েজ এতোটাও খারাপ না। আর ডিজার্ভ তো শত মাইল দূরের কথা।’

দুজনের পাশ কাটিয়ে দীবার রুমে চলে গেলো রিমি। অভ্র রিমির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো, ‘তোমার বোন?’

‘আরিয়ান সামনে এগুতে এগুতে শুধালো, ‘না। ছোট বেলায় আম্মু পাহাড়ের নিচ থেকে কুড়িয়ে এনেছিলো।’

আরিয়ানের কথা শুনে আবারো উচ্চস্বরে হেসে উঠলো অভ্র। হাসতে হাসতে নিজের রুমে চলে আসলো।
________________

দুই হাত গালে ঠেকিয়ে বিছানায় বসে আছে দীবা। একটা বালিশ কোলে রাখা। ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইলো সে। এই মুহূর্ত তার নিজেকে প্রচন্ড অসহায় লাগছে। আবরার আসার পর থেকে বেশ অস্বস্তিতে পরেছে সে। কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না। আবরারের সেই ভয়াংকর রাগ দেখে দীবার মনে এক প্রকার ভয় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। কোনো ভাবেই এই ভয় থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক ভাবে থাকতে পারছে না। এই লোকটা নাকি তার হাসবেন্ড? ভাবা যায়? একে তো বাড়িতে এই লোকের আগমন। তার উপর আবার আজ কলেজের ঘটনা। স্যারের সাথে ধাক্কা লাগার মতো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে এই জীবনে পরেনি দীবা। সব মিলিয়ে বিব্রতবোধ করছে সে।

‘হেই জান্টুস, কিয়া করো?’

দীবার পাশে ধপাস করে বসে বলে উঠলো রিমি। ভাবনার মাঝে হঠাৎ রিমির আকস্মিক আগমনে ভড়কে গেলো দীবা। বুকে এক হাত রেখে বললো, ‘তুই কখনো ভালো হবি না? এভাবে কেউ আসে?’

ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো রিমি। তাচ্ছিল্য করে বললো, ‘বাহ্, তুমি এতো টাই কল্পনায় ব্যস্ত ছিলে যে আমি এসেছি তা দেখতে পাও নি? কি কল্পনা করছিলে জানু? নিশ্চয় বাসর রাত নিয়ে ভাবছিলা? আরব ভাই তো এসেছে। ভাবতে তো হবেই। তাই না?’

শেষের কথা গুলো ভ্রুঁ নাঁচিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো রিমি। বিরক্ত সহিত তাকালো দীবা। শক্ত গলায় বললো, ‘তোর মাইন্ড খারাপ, যা এখান থেকে।’

রিমি বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে বললো, ‘ফিকার নট বেবি, তোর বাসর রাতে লুকিয়ে লাইভ দেখবো সব। তখন তোমার লজ্জা কোন দরজা দিয়ে পালায় দেখবো!’

‘অফ যা, নুরা কোথায়?’

‘হ্যালো জান্স, আই’ম হাজির।’

রুমের দরজা ঠেলে নুরা দুইহাত দুই দিকে মেলে নিজেকে প্রেজেন্ট করে বলে উঠলো। পরনে খয়েরী রঙের টি-শার্ট, সাদা প্যান্ট। বিচ ব্রাউন কালারের ঢেউ খেলানো চুল গুলো উঁচু করে জুটি করা। মহা খুশিতে হেলে দুলে এসে দুজনের সামনে আরাম সহিত বসলো নুরা। অতঃপর বলে উঠল, ‘উইথ আউট মি, কার বাসরের প্ল্যান করা হচ্ছে শুনি?’

দীবা বললো, ‘তোর টার কথাই ভাবছিলাম।

নুরা কিছুটা লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললো, ‘রাজ স্যারের সাথে?’

দীবা রিমি চোখ বড়বড় তাকালো নুরার দিকে। প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হয়ে রিমি বলে উঠলো, ‘পাপ হবে পাপ। স্যার কে নিয়ে এইসব চিন্তা করলে পাপ হবে বুঝছোস ফহিন্নি?’

দীবা তাচ্ছিল্যের সাথে বললো, ‘ছিঃ নুরা। স্যার কে এইসব ভাবে কেউ?’

বিরক্ত হলো নুরা। বিরূপ চোখেমুখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য এমন ভাবে বলছিস যেন স্যার রা কখনো বিয়ে করে। আজন্ম আবিয়াইত্তা থাকে। শুন, তারাও বিয়ে করে। হয়তো নিজের স্টুডেন্টস কে। নয়তো অন্যের স্টুডেন্টস কে। ওকে?’

রিমি বললো, ‘তোর লাফানি এই পর্যন্তই দেখা যাবে। কয়দিন পর আরেক জনকে নিয়ে শুরু করবি।’

নুরা শব্দ করে হেসে উঠলো। তারপর চোখেমুখে মুগ্ধতা প্রকাশ করে আনমনে বলে উঠলো, ‘নেভার! দিছ উইল বি মাই ফাস্ট এন্ড লাস্ট লাভ।’
___________________

রাতে বাহিরে ঝুম বৃষ্টি আচঁড়ে পরছে চট্টগ্রাম শহরে। আষাঢ় মাসে যখন-তখন ধরনীর বুকে বৃষ্টি পরাটা স্বাভাবিক। শুঁ-শুঁ বাতাস প্রভাহমান। ‘শান্তিনিবাস’ এর ড্রয়িংরুমে যে যার মতো বসে মেতে আছে আড্ডায়। নিশিতা আয়েশা মিলে তাদের নাস্তা দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে নিজেদের রুমে। দীবা এখানে আসতে চায় নি। রিমি নুরা জোড় পূর্বক নিয়ে এসেছে তাকে। সে কিছুতেই আবরারের সাথে মুখোমুখি হতে চায় না। অবশ্য আবরার বিকেলে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়েছিলো বিধায় এখানে অনুপস্থিত। দীবা স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো। নিশ্চিন্তে সবার সাথে আড্ডায় মশগুল হলো। অপরদিকে ঘুম থেকে উঠে গায়ে কালো হুডি জড়িয়ে নিচে আসলো আবরার। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় দীবার হাসি মুখ দেখে পা থেমে গেল তার। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পরলো আবরার। এক হাত পকেটে গুঁজে দীবার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। দীবা ব্লু কালারের কুর্তি পরে আছে। কোমড় পর্যন্ত কালো চুল গুলো বেনি করে এক পাশে এনে রাখা। বেবি হেয়ার গুলো কপালে আচঁড়ে মুখের উপর পরে আছে। সেগুলোকে পরম যত্নে দীবা কানের পিছনে গুঁজে দিচ্ছে বারবার। তাকে মুগ্ধকর চোখে তাকিয়ে দেখছে আবরার। চোখ সরানো কষ্টসাধ্য হয়ে পরেছে বোধহয়। অথচ বিকেলে প্রতিজ্ঞা করেছিলো দীবার দিকে ভুলেও তাকাবে না। ভঙ্গ হলো প্রতিজ্ঞা, প্রবিত্র সম্পর্ক বোধহয় এমনি হয়।

‘ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নিচে আয়!’

আবরার কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাবিত বলে উঠলো। চোখ ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালো সবাই। দীবা তাকাতেই আবরারের চোখে চোখ পরলো দুজনের। আবরার দীবার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচে নামতে লাগলো। ধাতস্থ হলো দীবা। চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। অশান্ত হয়ে উঠলো মন। অস্বস্তিতে আরো মিহিয়ে এলো। আবরার এগিয়ে দীবার সামনে সাবিতের পাশে এসে বসলো। সবার সাথে হাসিখুশি আড্ডায় মশগুল হলো। কিন্তু দীবা আবরার কে দেখার পর থেকেই তার হাসিখুশি মুখ মুহূর্তে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে। কাচুমুচু হয়ে রাইমার সাথে আরো চেপে বসে রইলো সে। অন্যদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত থাকলেও দীবার অস্বাচ্ছন্দ্য হওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছে আবরার। এতোক্ষণ সবার সাথে হেসে কথা বলা মেয়েটি তাকে দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। নিরবে চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে।

অন্যদিকে অস্বস্তি ধরে রাখতে না পেরে এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে পরলো দীবা। সবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘আমার একটা নোট বানাতে হবে। ভুলেই গেছি আমি। তোমরা কথা বলো আমি যাই।’

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে উপরে চলে গেল দীবা। আবরারের রাগ এবার আকাশচুম্বী হয়ে গেলো। আর কেউ না জানুক সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে দীবা তার উপস্থিতির কারনে এখান থেকে চলে গেছে। চুপচাপ দাঁতে দাঁত পিষে বসে রইলো আবরার। সে এমন কি করেছে যে দীবা তাকে এভাবে এড়িয়ে যাবে? কথাও তো বলে তাহলে এমন বিহেভিয়ারের মানে কি? ইগোতে লাগলো আবরারের।

উপস্থিত সবার মাঝে রাইমা দুজন কে ঠিক-ই খেয়াল করেছে। ব্যাপার টা তার কাছে ভালো ঠেকলো
না। সেও চায় আবরার আর দীবা এক সাথে থাকুক। সুন্দর জীবনযাপন করুক দুজন। ভাবি হিসেবে দীবাকে তাদের ভীষণ পছন্দের। কিন্তু এখন দুজনের মাঝে আকাশ সমান দূরত্ব রয়েছে। দূরত্ব ঘুচাতে হবে। যে করেই হোক দুজনকে এক করতেই হবে।
______________

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর যে যার রুমে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু ঘুমাতে গেলো না হোসেন। বড় ভাইয়ের রুমে জরুরি আলোচনার জন্য বসেছে। রুমের এক পাশে গম্ভীর মুখে ইজি চেয়ারে হেলান বসে আছে রোশান। চিন্তিত তার মুখখানি। তারই পাশে বেতের মোড়ায় বসে আছে হোসেন। নিশিতা বিছানায় বসে চক্ষুশূন্য দৃষ্টিতে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। নিরবতা ভেঙ্গে আড়ষ্ট কন্ঠে বলে উঠল হোসেন, ‘ভাই, এভাবে চললে তো হবে না। ওদেরও একটা ভবিষ্যত আছে।’

রোশান সক্রিয় হয়ে গম্ভীর্যপূর্ন কন্ঠে ক্রোধ প্রকাশ করে বলল, ‘আবরারের খেয়ালিপনা একদম ভালো লাগছে না আমার। সে কোনো বাচ্চা ছেলে না যে তাকে ধরে বেধে সংসারের গুরুত্ব বুঝাতে হবে।’

নিশিতা পাশ থেকে ছেলের পক্ষ নিয়ে শুধালো, ‘ছেলের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিলে কেন? দীবা আমার অপছন্দের না। আমিও দীবাকে রিমি রাইমার মতোই ভাবি। কিন্তু আবরার যেহেতু রাজি ছিলো না সেখানে জোড় করা মোটেও উচিত হয় তোমার।’

‘তুমি আমাকে শিখাবে কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত?’

‘না আমি তা বলছি না। যেহেতু জোড় করে বিয়ে দিয়েছো সেহেতু আবরারের এমন ব্যবহার অস্বাভাবিক কিছু নয়।’

নিশিতার ঝাঁঝ মেশানো কন্ঠে নিভলো রোশান। স্ত্রীর কথা ফেলে দেবার মতো নয়। তখন গ্রামবাসী এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছিলো যে সে বাধ্য হয়েই বিয়ে দিয়েছে। গ্রামবাসীর কথাতেও যুক্তিযুক্ত ছিলো। দুজন পূর্ন বয়সের যুবক যুবতী একি ঘরে থাকাটা দৃষ্টিকটু। সে তার ছেলেকে ভালো করে চিনে। কখনোই খারাপ দিকে যাবে না। কিন্তু সেটা তো আর বাহিরের মানুষজন জানে না। তাছাড়া দীবাকে সে তখন হোক কিংবা এখন তার পুত্রবধূ বানাতো। সেটা নাহয় পরিস্থিতি ঘুড়ে আগে হয়েছে। এবার আবরার ভালোই ভালোই বিয়েটা মেনে নিয়ে আটপাঁচজন স্বাভাবিক দাম্পত্যর মতো জীবনযাপন করলেই চলে।

ভাই ভাবির কথার মাঝে হোসেন তার মতামত জানালো। ভাবির কথার সম্মতি দিয়ে বলে উঠলো, ‘আবরার যেহেতু এখানে আছে সেহেতু ওকে আর জোড় করা ভালো সিন্ধান্ত হবে না। দুজন একি বাড়িতে আছে, থাকুক, জানুক। আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে। সেই পর্যন্ত দুজনকে সময় দেওয়া উচিত।’
_______________

মধ্যরাত্রি! ঘড়ির কাটা রাত একটা বিয়াল্লিশ। চারদিকে পিনপিন নিরবতা হলেও বাহিরে ভাড়ি বর্ষণের ঝমঝম ধ্বনি আর অম্বর আলোকিত করে আসা বজ্যপাতের তীব্র আড়ম্বর ভেসে আসছে। আবরার কানের হেডফোন খুলে পাশে রাখলো। বিছানায় শুয়ে সিলিং’য়ের দিকে এক ধ্যানে তাকালো। ড্রিমলাইটের নিভু নিভু নীল আলোতে অন্ধকার কক্ষ আবছায়া আলোকিত। থাইগ্লাসের কাচ বেদ করে কিয়ৎক্ষণ পর পর বজ্যপাতের শুভ্র আলো এসে আবরারের মুখ আলোকিত করছে। কিন্তু আবরার তার নিজস্ব চিন্তায় ব্যস্ত। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই মুখটি। ভয়ার্ত চোখের চাহনিটা আবরারের ভীষণ ভাবে মনে পরছে। সে ভাবছে সব। কি অদ্ভুত তাই না? এটাই তাহলে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনের শক্তি? যাকে সে বিয়ের দিন রাতে ফেলে চলে গিয়েছিল; আজ সেই তাকেই দেখতে ইচ্ছে করছে। এই মেয়ের মাঝে জাদু আছে বৈকি। নাহলে আবরারের মতো একটা ছেলেকে কিভাবে এক দিনে এমন মাতোয়ারা বানিয়ে ফেললো?

চলমান…#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-১০]

আষাঢ়মাসের সপ্তম দিন আজ। তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশে শীতল হাওয়া প্রভাহমান। রাস্তাঘাটের গর্ত ভর্তি বৃষ্টির পানি। বারান্দায় লাগানো ফুল গাছ গুলো ভিজে আছে বৃষ্টির পানিতে। সদ্য ফোটা বেলীফুলের ঘ্রাণে পুরো বারান্দা মুমু করছে। শেষ রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ভোরের পরিবেশটা আজ স্নিগ্ধ, কোমল। রেলিং’য়ে দুইহাতের ভর দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা ভোরের দৃশ্য দেখছে দীবা। হঠাৎ মনে হলো এক কাপ চা হলে কেমন হয়? যদিও প্রতিদিন সকালে সাত টায় সবাইকে চা দেওয়ার দায়িত্ব দীবার। এখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। তাই নিজের জন্যই চা বানাতে রুম থেকে বের হলো। আবরারের রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় খেয়াল করলো রুমের দরজা হাল্কা খোলা। কৌতুহলবশত উঁকি দিলো রুমের ভিতরে। না কেউ নেই। ফুঁশ করে নিশ্বাস ফেললো। কেমন চোর চোর লাগছে নিজেকে। পাশের বাসার আন্টিরা যেমন অন্যের বাড়ি উঁকিঝুঁকি মারে ঠিক তেমনি লাগলো ব্যাপার টা তার কাছে। ভেবেই নিশব্দে হেসে ফেললো। চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ভরকে গেলো দীবা। তার ঠিক পেছনেই আবরার দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে দীবা বুকে হাত রেখে জুড়ে জুড়ে কয়েকবার নিশ্বাস নিলো। তারপর ভয়ার্ত চোখে তাকালো আবরারের দিকে। আবরার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে দীবার দিকে। এই মেয়ে এতো ভয় পায় কেন? আর রুমের ভিতরে উঁকি দিয়ে কি দেখছিলো? ভয়ে দীবা শুকনো ঢুক গিললো। আড় চোখে আশেপাশে একবার তাকালো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আবরার ধমকে উঠলো, ‘খবরদার পালাবে না!’

ধমক শুনে ভয়ে চুপসে গেলো দীবা। দাঁড়িয়ে পরলো তাৎক্ষনাৎ। ঘন চোখের পাপড়ি ফেলে পিটপিট করে তাকালো আবরারের দিকে। দীবার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে আবরারের। আর এখন যেহেতু হাতের কাছে পেয়েছে, সেহেতু একটু হ্যানস্তা করা-ই যায়। এই কয়েকদিন দীবা আবরারকে দেখলেই পালাই পালাই করেছে। গতকাল সকালে তো বাগান থেকে আবরার কে দেখে দীবা এমন ভাবে দৌড়ে চলে গেছে সবার সামনে যেন আবরার ধরতে পারলে খেয়ে ফেলবে তাকে। অথচ দীবাকে দেখার জন্য দুপুরে ঘুম থেকে উঠা ছেলেটা ভোরে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর দীবার তাকে নিরবে উপেক্ষা করে। তার এমন আচরনে রাগ হয়েছে আবরারের। সে তো একটু দীবাকে দেখার আশায় ব্যাকুল থাকতো। মেয়েটাকে দেখতে তার ভীষণ ইচ্ছে করে। তাহলে দীবা তাকে দেখলে এমন কেন করবে? এই কয়দিনে আবরার খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছে যে দীবাকে তার চায়। মানে দীবাকে তার লাগবেই।

‘সমস্যা কি তোমার?’

পকেটে দুই হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো আবরার। দীবা পিটপিট করে তাকিয়ে শুকনো ঢুক গিলল। আমতা আমতা করে মিনমিনে গলায় প্রত্যত্তর করলো, ‘কোনো সমস্যা নেই।’

‘তাহলে আমাকে দেখলে পালাও কেন? আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক? খেয়ে ফেলবো তোমায়?’ রুক্ষভাষী কন্ঠে বলে উঠলো আবরার। ধাতস্থ হলো দীবা। আড় চোখে আবরারের দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবছে সে কিভাবে এখান থেকে পালাবে। দৌড় দিয়ে নিজের রুমে যাবে? নাকি নিচে? দৌড় দিলে যদি হাত ধরে ফেলে? নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো দীবা। রুম থেকে বের হওয়া মোটেও উচিত হয়নি তার। দীবাকে চুপ থাকতে দেখে আবরার আবারো শক্ত গলায় বললো, ‘উত্তর দাও!’

‘না, মানে এমনি।’ শুকনো ঢুক গিলে বললো দীবা। ভয়ে শরিরে মৃদু কম্পমান বিরাজ করছে তার। আবরার দীবার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলো। আরো ভয় দেখানোর জন্য দীবার দিকে এক কদম এগিয়ে এলো। দীবা যেন এবার আরো গুটিয়ে গেলো। চোখ বড়বড় করে তাকালো আবরারের দিকে। পিছনে দরজা থাকায় দীবা পিছাতে পারলো না। আবরার বললো, ‘নেক্সট টাইম আমাকে দেখে পালানোর চেষ্টা করবে না। নাহলে কোলে তুলে বসিয়ে রাখবো। গট ইট?’

আহাম্মকের তাকিয়ে রইলো দীবা। কথাটা বলেই আবরার দীবাকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেলো। ভিতরে গিয়ে দরজাটা ধিরিম করে লাগিয়ে দিলো। বিস্ময়ের কারণে দীবার মুখ কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে। এটা কি বললো? কোলে তুলে বসিয়ে রাখবে মানে? হতভম্ব হয়ে পিছু ফিরে দরজার দিকে তাকালো। আবরারের কথাটা ভাবতেই মুহূর্তেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো দীবা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দ্রুত নিজ কক্ষে চলে গেলো সে।
________________

গতকাল সকালের মতোই আজ সকালে কলেজে যাওয়ার আগে ওয়াশরুমে বসে ছিলো দীবা। নাস্তার টেবিলে কিছুতেই যাবে না সে। আবরারের মুখামুখি হওয়ার চেয়ে বাথরুমে বসে থাকা ভালো। যেই ভাবা সেই কাজ! কলেজ ড্রেস পরে ওয়াশরুমে বসে রইলো। নাস্তার সময় শেষ হলে বের হবে। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? রিমি ও নুরা তৈরি হয়ে দীবার রুমে আসলো এক সাথে নাস্তা করবে ভেবে। পুরো রুম জুড়ে দীবাকে না পেয়ে ওয়াশরুমে নক করলো। সন্দেহ মোতাবেক গতকালের মতো আজও নাস্তা না করার জন্য দীবা ওয়াশরুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বিরক্ত হলো নুরা রিমি। হাজারটা প্ল্যান বানিয়ে ঠিকই দীবাকে বের করলো। অসহায় হলো দীবা। ঠোঁট উলটে কাদুকাদু চেহারায় তাকিয়ে রইলো শুধু। রিমি নুরা দুজন দীবার দুই হাত ধরে জুরপূর্বক টেনে নিচে নিয়ে এলো। ডাইনিং টেবিলের কাছে আসার পর রাইমা তাদের দেখে অবাক হয়ে তাকালো। তারপর খাবার মুখে নিয়ে বলে উঠল, ‘কি হইছে? এভাবে আসার কারণ কি?’

নুরা ফিশফিশ করে দীবার কানে কানে বললো, ‘তুই যে কালকের মতো আজকেও বাথরুমে সংসার পেতেছিস। বলবো?’

পাশ থেকে রিমিও নিচু আওয়াজে বলে উঠেলো, ‘আরেকটু দেড়ি হলে বাচ্চা ফুটিয়ে ফেলতো।’

বিরক্ত হলো দীবা। দুজনের দিকে কড়া চোখে তাকালো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো, ‘অসভ্যের দল!’

চাপা শব্দে হাসলো নুরা। দীবার দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ নাচালো। অতিরিক্ত হতাশ হয়ে বিরক্তির নিশ্বাস ছুড়লো দীবা। চোখমুখ কালো করে রাইমার পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো। মুখ ফুলিয়ে খাবার খাওয়া শুরু করলো দীবা। এতোক্ষণে আবরার দীবার দিকে চোখ তুলে তাকালো। কলেজ ড্রেস পরা মেয়েটিকে দেখে আবরার আরেকবার খোঁচট খেলো। বেনী করা চুল দুই পাশে এনে রেখেছে। গোলগাল চেহারায় অতিরিক্ত কিউট লাগছে। চোখ সরানো কষ্টসাধ্য হয়ে পরেছে আবরারের। আবার সরাসরি তাকিয়েও থাকতে পারছে না। তাই বারবার আড় চোখে দীবার দিকে তাকাচ্ছে সে। অনিচ্ছা থাকা শত্বেও চোখ দীবার দিকে চলে যাচ্ছে। দীবা খুব দ্রুততার সাথে খাবার খেতে লাগলো। এখানে বসে থাকতে তার অস্বস্তি লাগছে। লোকটা সকালে কি বললো? মনে পরতেই আরো আড়ষ্টভাব আসলো তার মাঝে। খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ সামনে তাকাতেই আবরারের চোখের সাথে চোখ মিলে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আববার। তাৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিলো দীবা। এবার যেনো অস্বস্তি আরো বেড়ে গেছে। এভাবে তাকিয়ে কি দেখছিলো লোকটা? মনে আবরারকে বেহায়াদের তালিকায় ফেলে দিলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাবার শেষ করে যেতে পারলেই বাঁচে।

‘আস্তে খা, নয়তো খিচকি উঠবে।’

দীবার উদ্দেশ্যে বললো আরিয়ান। দীবা প্রত্যত্তরে কিছু না বলে ধীরে স্বস্থিতে খেতে লাগলো। রিমি ভ্রুঁ কুঁচকে আরিয়ানকে বলে উঠল, ‘বাহ বাহ, এখানে তো শুধু দীবাই তোমার বোন। ‌আঁরা তো ফেনালল্ব ভাসি আ‌ইশ্যি!’

আরিয়ান ত্যাছড়া কন্ঠে উত্তরে বললো, ‘হ্যাঁ তোকে তো চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নিচ থেকে কুঁড়িয়ে এনেছে। জানিস না?’

অভ্র ফিক হেসে ফেললো আরিয়ানের কথা শুনে। কোনো রকমে হাসি আটকে সামনে তাকিয়ে দেখলো রিমি তার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ হাসার অপরাধে তাকে চোখ দিয়ে জ্বালিয়ে দিবে। রিমির এমন চাহনীতে অভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। পরোক্ষনে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে খাবারে মনোযোগ দিল। খাওয়া দাওয়া শেষে ছেলেরা সবাই ড্রয়িংরুমে বসে পরিকল্পনা করছিলো কোথায় ঘুরতে যাবে তা নিয়ে। তখন রিমি, নুরা, দীবা কলেজে যাবার জন্য ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো। আবরারের চোখ আবারো আটকে গেল কলেজ ড্রেস পরা মায়াবী মুখশ্রীর অধিকারিণীর দিকে। মেয়েটাকে ইউনিফর্মে এতো কিউট লাগছে। সে সরাসরি না তাকিয়ে কৌশলে আড় চোখে বার বার দীবার দিকে তাকাচ্ছে। এতো বছর জীবনে সে এমন বেহায়ার মতো কোনো মেয়ের দিকে তাকায় নি। আর আজ? কি বেহায়া তার মন। পরোক্ষণে আবারো ভাবলো। বউ তো তারই। সুতরাং সে সারাদিন তাকিয়ে থাকতেই পারে। তাতে কার কি?

তিন জন নিচে এসে জানতে পারলো আরিয়ান বাহিরে ঘুরতে যাবে আবরার আর অভ্রকে নিয়ে। তাই রিমি বলে উঠল, ‘তোমরা ঘুরতে যাবে তাহলে আমরাও যাবো। অনেক দিন ঘুরতে যাওয়া হয় না।”

দীবা রিমির হাত টেনে গলার আওয়াজ নামিয়ে বললো, ‘আল্লাহ চুপ কর, যেতে হবে না।’

রিমি চোখ পাকিয়ে তাকালো দীবার দিকে। দাঁত কটমট করে বললো, ‘বেশি কথা বলিস না। সুযোগ বার বার আসে না।’ তারপর আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে উল্লাসিত গলায় বললো, ‘আমরা গেলে সমস্যা হবে ভাইয়া?’

আবরার চুপচাপ বসে রইলো। আরিয়ান রিমির সাথে সম্মতি দিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ চল, সমস্যা নেই।’

নুরা তাৎক্ষনাৎ নাঃকোচ করে বলে উঠল, ‘না না, আজকে ফিজিক্স ক্লাস আছে। যেতে পারবো না।’

দীবা রিমি চোখ বড় বড় করে তাকালো নুরার দিকে। যেই মেয়ে ফিজক্স শব্দ টাকেই ভয় পেতো সেই মেয়ে কেনো আজ ফিজিক্স ক্লাস করতে এতো এক্সাইটেড তা এক মাত্র রিমি আর দীবা জানে। তাই তো নুরার কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দুজন। নুরা কিছুটা হকচকিয়ে গেলো তাদের এমন চাহনীতে। হাল্কা আওয়াজে ইতস্ততবোধ করে বললো, ‘এভাবে হায়ানার মতো কি দেখছিস? খেয়ে ফেলবি নাকি?’

রিমি লম্বা হাই তুলে বললো, ‘ লাভ নেই, ছেলে হলে ভেবে দেখতাম।’

দীবা নুরার দিকে চোখ ছোট ছোট করে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘তুই ক্লাসের জন্য ঘুরতে যাওয়া ক্যান্সেল করছিস? তাও আবার ফিজিক্স ক্লাসের জন্য?’

নুরা কিছুটা বিব্রতবোধ করে বললো, ‘সামনে এক্সাম। পড়ায় কনসেন্ট্রেট দে। হুদাই কেন টাইম ওয়েস্ট করবি?’

রিমি কিছুটা কূটস্থ করে বললো, ‘হ্যাঁ আপনার কনসেন্ট্রেট মানে চোখ দিয়ে আরেক জনকে গিলে ফেলা।’

রিমির কথায় দীবা মুখে হাত দিয়ে শব্দ করে হেসে ফেললো। এই হাসিতে যেন আবরার আবার মুগ্ধ হলো। মেয়েটির হাসি টাও মারাক্তক সুন্দর। হায়! এটা তো অনেক সাংঘাতিক একটা ব্যাপার।

তিনজন কে এভাবে ফিশফিশ করতে দেখে আরিয়ান ভ্রুঁ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি পটরপটর করছিস?’

দীবা নুরা এক সাথে ‘কিছু না!’ বলে বেরিয়ে গেলো। রিমি যাবার আগে অভ্রের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে মারলো। তারপর হনহন পায়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। অভ্র হতভম্ব হয়ে গেলো রিমির এমন চাহনীতে। এভাবে তাকানোর মানে কি? বেচারা কিছু বুঝতে না পেরে বোকা বনে গেলো কেবল।

চলমান..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here