আষাঢ় নামে সন্ধ্যে খামে শেষ পর্ব

আষাঢ় নামে সন্ধ্যে খামে – ৩
____________
হৃদস্পন্দনে যন্ত্রণারা খুঁড়ছে অবিরাম।মন আকাশে বৃষ্টির ধারার মতো বিষণ্নতা আছড়ে পড়ছে। বিষন্নতার বিষবাষ্পে ভেতর চেঁচাচ্ছে।চোখ কার্ণিশে জল এসে থেমে যাচ্ছে।তবুও দুজনের কেউ নিজ থেকে বলার সাহস পাচ্ছেনা, চলোনা আবার নতুন করে শুরু করি।আমিরাহ বাইরে তাকিয়ে ঢোক গিলে।গলাটা জ্বলছে খুব।আর পাঁচ-ছয় মিনিট।তারপরই….পথচলার সমাপ্তি!অথচ,কথা ছিল মৃত্যুর আগ অব্দি একজন আরেকজনের। রওশান আড়চোখে একবার তাকায়।আমিরাহ সবসময় শাড়ি পরে।নিজেকে পরিপাটি রাখে।এখনকার মেয়েরা শাড়ি পড়ে দু’পাও এগোতে পারেনা।সেখানে আমিরাহ চব্বিশ ঘণ্টা শাড়ি পরে থাকে।নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে।প্রতিদিন প্রেমে পড়ার মতো একটা মেয়ে।অথচ,তার মেজাজ, স্বভাব! রওশান চোখ ফিরিয়ে নেয়।যথাসময়ে বাস স্টেশনে চলে আসে।আমিরাহ লাগেজ নিয়ে গাড়ি থেকে নামে।রওশানের বুক ছ্যাৎ করে উঠে।
আমিরাহ ছলছল চোখ নিয়ে রওশানের দিকে তাকায়।রওশান মুখ ভঙ্গি শক্ত করে দূরে তাকিয়ে আছে।আমিরাহ আস্তে করে বলে,
— “আসি।”
কথা শেষ করে সামনে হাঁটে।শাড়ির আঁচল সন্ধ্যে হওয়ার পূর্ব মুহূর্তের মিষ্টি বাতাসে মৃদু উড়ছে।রওশানের চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।দ্রুত চোখের জল মুছে গাড়ি ঘুরায়।আমিরাহ পিছন ফিরে তাকায়।রওশান চলে যাচ্ছে তাকে একা ফেলে!
আংশিক হলেও আশা ছিল রওশান তাকে যেতে দিবে না।আমিরাহ পিছুটান ছেড়ে টিকেট কাউন্টারে আসে।টিকিট কাটে।আরো ত্রিশ মিনিট পর বাস ছাড়বে।আমিরাহ সিটে গিয়ে বসে।জানালার বাইরে তাকায়।বিয়ের পর একা প্রথম জার্নি। পাশে রওশান নেই।চোখ বেয়ে টুপ টুপ করে জল পড়তে থাকে। ভেতরের আমিরাহ আর্তনাদ করে বলে,
— “একটাবার সরি বলে বুকে টেনে নিতে পারলে না।আমি জানি আমার দোষ ছিল।তোমাকে বোঝার চেষ্টা করিনি।তুমিও তো রাগারাগি করেছো। একবার বুকে টেনে নিয়ে দেখতে, আমি আমার ভুল স্বীকার করে নিতাম।আমি কীভাবে থাকবো তোমাকে ছাড়া।”

রওশান ভাবছে খুব ভাবছে।সে কি ভুল করছে? কোনোদিন এজন্য আফসোস হবে না তো? একটা মানুষের কি সব গুণ থাকে? দোষ থাকতে পারে না?সূর্য পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিম দিকে ডুবে এটি যেমন চিরন্তন সত্য, তেমনি চিরন্তন সত্য আমিরাহ তাকে পাগলের মতো ভালবাসে। এবং এখনো তার কথায় ভাবছে।এখনো ভালবাসে।রওশান তা বিশ্বাস করে।শুধু রাগ, জেদ বেশি। নিজের মতো কিছু না হলে রেগে যায়, মুখ দিয়ে যা আসে বলতে থাকে।শুধু মাত্র এই দোষের জন্য কাউকে ছাড়া যায়? রওশানের মনে পড়ছে গত বারের কথা।দশ দিন সে বিছানায় দূর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিল।এই দশ দিনের একটা সেকেন্ড ও তাকে একা ফেলে রাখেনি আমিরাহ। আচ্ছা, এখন কি সকালে কেউ টাই বেঁধে দিবে? প্রতি রাতে বাড়ি ফেরে দরজার ওপাশে কাকে দেখবে? তারপর ঘামে দুর্গন্ধ হওয়া শার্টের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কে বলবে?
— ” সারাদিন কয়টা মেয়েটার সাথে কথা হইছে হা?”

রওশান ভাবতে পারছে না।বুক দুরু দুরু করছে।প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফিরে আর কি দেখা হবে, টেবিল জুড়ে সাজানো তার সব পছন্দের খাবার। কাপড় চেঞ্জ করে খেতে না বসাতে কেউ কি খুন্তি হাতে নিয়ে হুমকি দিবে? এইযে এই…. এই বা পাশের বুকটা কি এখন শূন্যতায় খাঁ খাঁ করবে? ফজরে মুখে পানি ঢেলে কেউ ঘুম ভাঙাবে? রিমোট নিয়ে মারামারি কেউ করবে? সারাক্ষণ কে জ্বালাবে? কে এতো ভালবাসবে? কারো কি সেই সাধ্যি আছে? রওশান গাড়ি থামিয়ে হাঁপাতে থাকে।একা লাগছে, বড্ড একা লাগছে।কেউ নেই, নেই, আমিরাহ নেই।ওই বাসা মরুভূমি হয়ে গেছে।ওই বাসায় একা গেলে সে কিছুতেই বাঁচবে না।কিছুতেই না।এতকাল যখন সে সরি বলতে পেরেছে,আজও পারবে।পারতে হবে।রওশান গাড়ি ঘুরায়।

বাস ছেড়ে দিতেই আমিরাহর পা কাঁপতে থাকে। এই পা যখন, তখন হোঁচট খায় তখন রওশান সামলায়। তার যত আবদার সব পূরণ করে রওশান।চাওয়ার আগে সব এনে হাজির করে।জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডের পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত তাকে না জানিয়ে নেয় না।বিয়ের প্রথম বছরই ভীষণ বাজে জ্বরে আক্রান্ত হয় আমিরাহ। রওশানের শার্টে, শরীরে বমি করে।রওশান তার জন্য একটুও রাগে নি।নিজেকে সহ আমিরাহকে পরিষ্কার করেছে। এরপর বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। যতদিন অসুস্থ ছিল রওশান কোম্পানির কোনো কাজে মাথা ঘামায় নি।লস হয়েছে কিছু।তবুও রওশানের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।তার কাছে ইম্পোরটেন্ট ছিল আমিরাহর সুস্থতা। কথায়, কথায় সন্দেহ করার পর ও রওশান হাসিমুখে প্রমাণ দিতো সে নির্দোষ। এমন একজন মানুষ কয়দিন দেরি করে ফিরাতে সন্দেহবশত রাগারাগি করে খারাপ কথা বলাটা কি ঠিক হলো? না হয় নি।হয় নি ঠিক।আমিরাহ চোখের জল মুছে ফোন বের করে।এইবার সে-ই সরি বলবে।কিছুতেই রওশানকে ছাড়া থাকা যাবে না।কিছুতেই না।আমিরাহ টাইপিং করতে করতে রওশানেত মেসেজ আসে,
” আমি সরি।প্লীজ আমাকে ক্ষমা করো।আমি রাগারাগি করে ভুল করেছি।তোমাকে বরাবরের মতো বোঝানো উচিৎ ছিল।আমি জানি তুমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারো না। আমাকে সামলাতে হয়। তবুও বকে ফেলেছি।প্লীজ যেও না, প্লীজ।আমি কিভাবে কি বলবো বুঝতেছি না।তুমি জাস্ট যেও না।ফিরে আসো প্লীজ।”

আমিরাহ এক হাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠে।বাসের কয়েকজন যাত্রী হা করে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।তখনি ফোনের রিংটোন বেজে উঠে।স্ক্রিনে নাম উঠে – শান!আমিরাহ দ্রুত রিসিভড করে।ওপাশ থেকে কাঁপা কন্ঠ স্বর ভেসে আসে,
— “সরিহ!”
আমিরাহ প্রতিউত্তরে কিছু না বলে কল কাটে।কাঁপা হাতে ফোন দ্রুত ব্যাগে ঢুকিয়ে লাগেজ নামায়।এরপর ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে,
— “প্লীজ বাস থামান।আমি নামবো।”
বাসের যাত্রীরা একস্বরে বলে উঠে,
— ” না না থামানো যাবে না।বললেই হলো।”
আমিরাহর মাথার রক্ত টগবগ করে উঠে। ড্রাইভারকে হুমকি দেয়,
— “এখুনি বাস না থামালে আমি ঝাঁপ দিবো।কাউকে শান্তি দিবোনা।”
ড্রাইভার বিড়বিড় করে,
— “কী পাগলের পাল্লায় পড়লাম।”
এরপর আমিরাহকে বলে,
— “থামাচ্ছি।”
বাস থামতেই তড়িঘড়ি করে নামে আমিরাহ।অনেকটা দূরে চলে এসেছে বাস।দ্রুত হাঁটতে থাকে।সন্ধ্যার আযান পড়ছে।আমিরাহ শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নেয়।সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আষাঢ়ের বৃষ্টি। বৃষ্টি বাড়ছে।রাস্তা খালি হচ্ছে।এরি মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।

রওশানের বুক উত্তেজনায় কাঁপছে।আজ রাত টা আমিরাহর সাথে কাটানো যাবে তো? আমিরাহ ফিরবে?চোখ যায় দূরের রাস্তায়, শাড়ি পরা একটি মেয়ে দ্রুত হেঁটে এদিকটায় আসছে।গাড়ি থেমে যায়। রওশান বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে।মুখখানা অকস্মাৎ হা অবস্থায় স্থির হয়ে গেল, দৃষ্টি গেল আমিরাহতে থমকে।পিল চমকে উঠলো।অনুভূতি সেই প্রথম দেখার মতো।আমিরাহর মুখ বৃষ্টিতে ভিজে চোখের কাজল গেছে লেপ্টে। রওশানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে যায়।কোনো এক মাতাল নেশায় বিভোর হয়ে লাগেজ রেখে ছুটে আসে রওশানের দিকে।মাথা থেকে আঁচল পড়ে যায়।ঝাঁপিয়ে পড়ে রওশানের বুকে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।রওশান লোক সমাজের দৃষ্টি উপেক্ষা করে দু’হাতে আমিরাহকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
— “সরি রাহা।তোমাকে কাঁদানোর জন্য খুব সরি।”
আমিরাহ রওশানের মুখে নিজের নিকনেম শুনে আপ্লুত হয়ে রওশানের চোখে চোখ রেখে আদুরে গলায় বলে,
— “আমিও সরি, তোমার মতোই খুউবব সরি।”
দুজন একসাথে হেসে উঠে।

সমাপ্ত।
@ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here