#আসক্তি২
পর্বঃ৪৫
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
রনি-রখির বিয়ের আর মাত্র দুটো দিনই বাকি।শান অনেক বেশি ব্যস্ততার মাঝে সময় পার করছে।একদিকে রনির বিয়ের বন্দোবস্ত আরেকদিকে বাৎসরিক মিটিং এর ডেটও পরে গেছে।চিকিৎসা সেবায় কর্মরত দেশ বিদেশের অনেক মানুষের আগমন ঘটবে সে সিটিং এ।মিটিং এর স্থান হিসেবে শানের মেডিকেলকেই নির্বাচন করা হয়েছে।এর পিছনে যথেষ্টই কারন রয়েছে।বেশ পরিপাটি,পরিচ্ছন্ন,মনোরম শানের মেডিকেল।যেটা ভিজিটরদের বেশ নজর কেড়েছে।
দিনের বেশিরটা ভাগ সময় শানকে মেডিকেলে কাটাতে হচ্ছে।ফোনের মাধ্যমেই বিয়ের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সাথে।এতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
আজকের দিনটাকে মেহেদী ফাংশন হিসেবে ঠিক করা হয়েছে। পাখির শরীর অনেক বেশি দূর্বল হওয়া সত্ত্বেও বাড়ির সকল মহিলাদের সাথে নিয়ে চলে যায় রাখিদের ফ্ল্যাটে।বিয়ে উপলক্ষে অনেক মেহমান এসেছে এখানেও।পার্লারের মেয়েরা রাখির হাত সাজিয়ে দিচ্ছে নানান রঙ্গের নকশায়।
মাঝখান থেকে কেউ একজন বলে ওঠে,”হাতের মাঝে আর(R) লিখে দিন আপু”
কথাটা কানে আসতেই লজ্জায় মিইয়ে যায় রাখি।
দূর থেকে পাখি সেসব দেখে মিটিমিটি হেসে ওঠে।
মেহেদীর ফাংশন শেষ করে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় ।ভীষণ ক্লান্ত সবাই।যে যার মতো ঘরে গিয়ে শুয়ে পরে।পাখি হাতের টুকিটাকি কাজ শেষ করে সদর দরজার দিকে একনজর তাকায়।সবার অগচোরে মনের মধ্যকার সারাদিনের অপেক্ষাটা এবার আর সময়ের গতি মানতে চায় না। সারাদিনে খুব একটা কথা বলার সুযোগ হয় নি শানের।মনের মাঝে হাজার অভিমান জমছে পাখির। আবার নিজে থেকেই সে অভিমানগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে।সদর দরজাটা লাগিয়ে খুব ধীর পায়ে পাখি উপরে নিজের ঘরে চলে যায়।ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালাতেই মুচকি হেসে ওঠে নিজের ঘর টা দেখে।মূহূর্তেই সারাদিনের জমানো অভিমান ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে যায়।খুব ধীরপায়ে এগিয়ে ছুঁয়ে দেয় দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিগুলো।গাছ গুলো ছুঁতেই যেন একরাশ মুগ্ধতা এসে গ্রাস করে।বেলকোনিতে বসে গ্রিল টা দুহাতে চেপে নিচের দিকে চেয়ে থাকে পাখি।একে তো দূর্বল শরীর তারউপর সারাদিনের ক্লান্তি। ওভাবে থাকতেই কখন চোখ লেগে আসে বুঝতে পারে না।
ঘুম ভেঙ্গে যায় কারো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়ার মিষ্টি অনুভূতিতে।মন না চাইলেও চোখদুটো টেনে খোলে পাখি।চিরচেনা সেই সুগন্ধটা নাকে আসতেই ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির রেখা ফুটে ওঠে।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আকাঙ্খিত মানুষটাকে।
“উঠলে তবে!”
পাখির ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে শান।কোলে থেকেই গলার কাছের শার্টের বোতাম দুটো খুলতে খুলতে মুচকি হেসে পাখি জবাব দেয়,”হুমম”
“সারাদিনে একটা ফোনও দিলেন না।আমি ফোন দিলে দু এক মিনিট কথা বলে রেখে দিলেন।আমার খুব রাগ হয়েছিল”,ঠোঁট উল্টে বলে পাখি।
শান কোন জবাব না করে সোজা বিছানায় শোয়ায় পাখিকে।কপালের কাছের চুলে হাত বুলিয়ে শান স্থীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পাখির দিকে।
” কীইইই”,ঘুম জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি।
“মিটিং পরে গেলো আগামি পরশু দিন।এদিকে বিয়ের আয়োজন।অনেক বেশিই ব্যস্ত জানপাখি”, পাখির পাশে বসতে বসতে শান বলে।
পাখি ভ্রুকুটি করে বলে,” মানে কি!আগামি পরশু না বিয়ে?আর আপনার মিটিং মানে!
“হুমম,সেটাই তো।কিন্তু কিছু করার নাই।ফরেইন ডক্টররা আসছে। মিটিং পিছানো সম্ভব না।”
শান কাবার্ডের দিকে এগোতে এগোতে বলে,”সমস্যা নেই।কমিউনিটি সেন্টারে সবকিছুর বন্দোবস্ত আমি করেছি।খাবার থেকে শুরু করে বিয়ের শেষ অবধি সবটা আমি এরেইঞ্জ করেছি।এতো দূঃচিন্তা করতে হবে না”
“তারমানে বিয়েতে আপনি থাকবেন না?”, হতাশ কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি
শান একটা ঢিলেঢালা টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করে নিয়ে আসে।ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,”মিটিং সারাদিন চলবে।আনুমানিক রাত ৮ টার পর শেষ হতে পারে।তার আগেও শেষ হতে পারে।তো তখন আমি অন্যান্য কলিগদের নিয়ে ডিরেক্ট কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছাব”
পাখি আর কিছু বলতে পারে না।তার আগেই শান ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।বড্ডো ক্লান্ত শরীর তার।গোসল টা সাড়তে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।
কিছুসময় পর শান তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়।পাখি সেদিকে এক ধ্যানে চেয়ে থাকে।
শান সামনে তাকিয়ে এগিয়ে আসে পাখির কাছে।তোয়ালেটা এগিয়ে দিয়ে বিছানায় পাখির সামনে মাথা এলিয়ে বসে পরে।মুচকি হেসে পাখি সোজা দাঁড়িয়ে মাথাটা মুছে দেয়।
“এতো রাত হলো আজ?কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে?দরজা কে খুলে দিয়েছে?”
“আম্মা”
“বাবু তো তার বাবাকে খুব মিস করছিলো “,বলেই নিঃশব্দ হেসে দেয় পাখি।
শান ক্লান্ত শরীরে নোয়ানো মাথাটা ঠেকিয়ে দেয় পাখির পেটে।দুহাতে জড়িয়ে ধরে কোমড়।অস্ফুটস্বরে বলে,” আই মিস ইউ”
শানের কন্ঠে কিছু তো একটা ছিলো যা পাখির মধ্যকার নারীত্বকে জাগিয়ে তোলে।বুঝতে অসুবিধা হয় না শানের না বলা কথাটা।ভেজা তোয়ালেটা রাখতে সরে আসার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই শান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাখির কোমর।ক্ষীণ শব্দে হেসে পাখি তোয়ালে টা ছুড়ে মারে চেয়ারের উপর।
স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে শানের চুলে বিলি কেটে দেয় পাখি।কিছুক্ষন পরে শান মাথাটা উঠিয়ে পাখির দিকে তাকায়।চোখে চোখ পড়তেই ও চোখে আটকে যায় পাখি।কি গহীন সে চাহনী!যা উপেক্ষা করা পাখির সম্ভব না।শানের মুখটা দুহাতে ধরে কপালে গাঢ় চুমু দেয়।প্রশ্নাতুর অসহায় চোখে তাকায় পাখি।
শান সেদিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে।মুচকি হেসে দেয় শান।পেটে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
চট করে কোলে তুলে নেয় পাখিকে।একটা নিষ্পলক চাহনীতে চেয়ে পাখি বলে,”ডাক্তার সাহেব”
“হুমম”
“আমার মনটা কেন এমন করে? চারপাশে এতো মানুষ থাকে সারাদিন তবুও নিজেকে খুব একা লাগে কেন?”
শান মুচকি হেসে বিছানাতে শুয়ে দেয় পাখিকে।নিজেও গিয়ে পাশে শুয়ে বলে,”আগের মতো তোমায় সময় দিতে পারছি না জান।আমিও বুঝি তুমি আমায় কতোটা মিস করো।কি করব বলো,ব্যস্ততা……”
“না সে কারণে নয়”, শানের কথার মাঝেই বলে ওঠে পাখি।
শান পাশ ফিরে মাথার ভার এক হাতে ঠেকিয়ে ভ্রুকুটি করে বলে,” তাহলে!”
পাখি শানের দিকে ফিরে এক ধ্যানে চেয়ে থাকে।অস্পষ্ট স্বরে বলে,”আজকের রাতটা যদি আমাদের শেষ রাত হয়!”
“হোয়াট?…দেখি এদিকে আসো”,
হকচিয়ে ওঠে পাখি। বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে চাপাস্বরে ধমকিয়ে শান বলে,” একটু আগে কি বললে তুমি?”
“নাহহ কিছু না”
শান বুঝতে পারে না পাখি হঠাৎ কেন এভাবে বললো।
কিছুক্ষন পর পাখি আবার বলে,”আমার কেন জানি না মনে হয় আমি বেশি দিন বাঁচব না ডাক্তার সাহেব।তবে আল্লাহ্’র কাছে একটাই চাওয়া আমি যেন আপনাকে বাবা বানিয়ে তবেই পৃথিবী ছাড়তে পারি”
শান পাখিকে তুলে বসায়।নিজে সামনে বসে বলে,”এসব কি ধরনের কথাবার্তা পাখি।এধরনের হাজারও কথা একজন অন্তঃসত্তা নারীর মনে উদয় হয়।তবে সেটা ডেলিভারির আগে আগে।আর তুমি……
তুমি খুব অভার থিংকিং করো।এটাই তোমার প্রবলেম। বুঝেছি এমডির পদ থেকে সরে আসতে হবে।আমি হাজারও তালে বেতাল থাকি;তোমার খোঁজ রাখতে পারছি না ভালো করে।আর সে সুযোগে আজেবাজে চিন্তা মাথায় ঢুকে গেছে তোমার”
পাখি ছলছলে চোখে মাথা তুলে শানের দিকে তাকায়।এগিয়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে,”আমার অতো বেশি টাকা পয়সার দরকার নাই ডাক্তার সাহেব।আমার শুধু আপনাকেই দরকার।আপনার সঙ্গ দরকার”
শান বুঝতে পেরেছে পাখির মনের অবস্থা একদমই ভালো না।চুলে হাত বুলিয়ে বলে,”আচ্ছা এই মিটিং টা হয়ে যাক তারপর আমি সবটা আগের মতো করে দিবো। কেমন!”
শানের গলা ছেড়ে পাখি সোজা হয়ে বসে।শান চোখের পানি মুছিয়ে বলে,”আমার পুতুল”
শানের কথায় লজ্জামিশ্রিত মুচকি হাসি উপহার দেয় পাখি।শান দুই গালে চুমু খেয়ে বলে,”বাচ্চার বাবা তে চলেছি অথচ এখনো আপনি আজ্ঞে ছাড়লে না, না?”
শানের দিকে চেয়ে পাখি বলে,”আপনি টাই বেষ্ট”
“না না, আমার ভালো লাগছে না আর।নতুন নতুন ভালো লাগত।এখন কেমন যেন আপনি ডাকটা ভালো লাগছে না। তুমি করে ডাকবা”, ছোটবাচ্চাদের মতো একরোখা জিদ করে শান।
পাখি হেসে দিয়ে বলে,” এমন ছোট বাচ্চাদের মতো করছেন কেন?হুমমম!আপনি টা কতো ভালো!কতো সম্মানের তা কি আপনি জানেন?”
গম্ভীরকন্ঠে শান জবাব দেয়,”আমার জানতে হবে না”
এরপর পাশ ফিরে শুয়ে পরে।পাখি বুঝতে পারে শানের অভিমানটা কোথায়।একটু এগিয়ে শানের গালে চুমু এঁকে বলে,”এভাবে রাগ করো না প্লিজ”
পাখির কথা শানের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তড়াক করে উঠে বসে শান।পাখি ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে শানের দিকে।
“কি বললে, আবার বলো?”অবাক হয়ে প্রশ্ন করে শান।
পাখি বুকের কাছে দুবার থু থু ছিটিয়ে বলে,” আপনি কি মানুষ?এতোটা ভয় কেউ দেখায়?”
“কথা কাটাবা না একদম, বলো কি বললে একটু আগে”
পাখি চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে বলে,”আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি”
তৎক্ষনাৎ শান পাখির কন্ঠনালিতে চুমু খেয়ে বলে,”আমিও তোমাকে অনেক বেশিই ভালোবাসি পাখি।সারাটা জীবন ভালোবেসে যাব একই ভাবে”
🌸🌸
সকালের সবটাই আজ আগের মতো মনে হয় পাখির।নিজের উপর জড়িয়ে রাখা শানর হাতটা সরিয়ে আস্তে করে উঠে যায় ওয়াশরুমে।গোসল সেড়ে ভেজা চুল গুলো তোয়ালেতে পেঁচিয়ে বাহিরে আসে পাখি।চোখ পড়ে বিছানার উপর;শান নেই।বেলকোনিতে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে শান।সেদিকে একনজর তাকিয়ে শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে গুঁজে নেয় পাখি।এরপর বিছানাটা গুছিয়ে রাখতেই শান পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।ভেজা চুলে শ্যাম্পুর গন্ধ নিতে থাকে লম্বা শ্বাসে।
“কি করছো?”, হেসে বলে পাখি।
নিরুত্তর শান আপনমনে নিজের কাজ করে চলছে।
” ছাড়ো….অনেক মেহমান বাসায়।নিচে যেতে হবে”
“উুহু,তোমার যাওয়া লাগবে না।ওখানে তোমার কোন কাজ নাই।হসপিটালে ফোন দিছিলাম।কাল সারাদিন মিটিং। তাই আজ ছুটি দিলাম অনেককে।নিজেদের মতো প্রেজেন্টেশন গুলো তৈরী করুক বাড়িতে বসে বসে।”
পাখিকে বুকের সাথে পিষে বলে,”আমারও ছুটি”
“সবটাই আমার জন্যে, না?”,প্রশ্ন করে পাখি।
নিঃশব্দে হেসে শান জবাব দেয়,” হুমমম।আমার বউয়ের মন খারাপ।কাল সারাদিনই প্রায় থাকব না।তাই আগের দিনটা পুরোটাই বউয়ের জন্যে লিখে দিলাম”
“বউ মা, বউ মা নিচে আসো একটু৷ কিছু দরকারি কাজ আছে মা”, নিচ থেকে শর্মিলা ডেকে ওঠে গলা ছেড়ে।
শানের বাহুডোরে থেকেই পাখি জবাব দেয়,” আসছি মা”
“ছাড়ো এবার।মা ডাকছে”, পিছনে সামান্য ঘুরে বলে পাখি।
মুখে বিরক্তিসূচক ” চ” শব্দটা বের করে শান ঠোঁট উল্টিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।পাখি সেদিকে চেয়ে বলে,”এমন বাচ্চদের করো না। আমি কাজ সেড়ে আসছি”
বলে মুচকি হেসে চলে যেতেই পাখির হাত ধরে ফেলে শান।
“আরেকটু শুকি না চুলের গন্ধটা। বেশ ভালো লাগছিলো”,
” ওয়াশরুমে শ্যাম্পু টা রাখা আছে।”,বলেই পাখি একগাল হেসে দৌঁড়ে নিচে চলে যায়।
“পাখি সাবধানে।দৌঁড়াবা না”, রেগে গিয়ে শব্দ করে বলে শান।
যেতে যেতে গলা উচিয়ে পাখি বলে,” আপনি আছেন না, আর কিছু হবে না আমার”
🌸🌸
সারাদিনে এটা নাতো ওটা কাজে বেশ সময় কাটছে পাখির।শানও ছুটিটার বিনিময়ে স্বশরীরে বিয়ের আয়োজনে থাকার সুযোগ পাচ্ছে।আর রনি তো সেই যে ফোন কানে তুলেছে নামানামির নাম গন্ধও নেই।শান রনিকে দেখে বলে,”সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে না গর্দভ। ”
এরপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে,”রাত পোহালেই মেয়েটা তোর।এখন অন্তত নিজের বিয়ের কাজে একটু হাত লাগা”
হন্তদন্ত হয়ে রনি জবাব দেয়,”সময় নেই ব্রো, সময় নেই। আমার বিয়ের কাজ আমিই করলে তোমরা আছো কি করতে”
বলেই হনহন করে উপরে চলে যায়।
শান সেদিকে তাকিয়ে রনির কথা ভেবে হেসে ওঠে।
“কতো ছোট ভাই আমার ,অথচ আজ তারও বিয়ে”
“এই যে এটা খেয়ে নাও।স্বস্তি পাবা”, বলেই পাখি সরবতের গ্লাস টা শানের দিকে এগিয়ে দেয়।শান পাশ ফিরে নিচের ঠোঁট কামড়ে তৃপ্তির হাসি হেসে ওঠে।আশপাশে তাকিয়ে দেখে ড্রয়িং রুমে তেমন কেউই নেই।মহিলারা সবাই রান্নাঘরে হরেকরকম পিঠা বানাতে ব্যস্ত।
শান ফট করে পাখিকে একহাতে জড়িয়ে বলে,” আমার তো অন্যকিছু খেতে ইচ্ছে করছে। লাইক সুইট টাইপ”
পাখির ঠোঁটের দিকে দুষ্টু চাহনী দিয়ে শেষের কথাটা বলে শান।
চারপাশে তাকিয়ে পাখি বলে,”তুমি একটা নির্লজ্জ।ছাড়ো বলছি।কেউ এসে গেলে!”
“কেউ আসবে না।আমজাদ আঙ্কেল আর কাকাকে পাঠিয়েছি সেন্টারে,মহিলাগন রান্নাঘরে আর তোমাকে আমার ঘরে।জাস্ট দু মিনিটের মাঝেই চলে আসবা।নো এক্সকিউজ। ওকে!”
“আমি তোমায় কাছে চাই মানে এই না সারাক্ষন তুমি দুষ্টুমি করবে।তোমাকে চোখের সামনে রাখতে চাই আর তুমি তো কাছে আসলেই…..”
“আর আমি বার বার হাজার বার দুষ্টুমি করতে চাই। এখন ঘরে চলো কথা আছে”
“নাউজুবিল্লাহ্,কিরে তোদের ঘর নাই”, বলতে বলতে চোখ চেপে ধরে রোশনি।
পাখি শানের থেকে সিটকে সরে আসতেই শান বলে ওঠে,” কাকি, আসার আর টাইম পাইলা না, না?”
“ঐ হারামি তোদের ঘরে যা, যা বলছি”
পাখি ভীষণ লজ্জায় পরে যায়।দ্রুত পায়ে অন্যদিকে চলে যায়।শান মাথা চুলকে বলে,”দিলে তো লজ্জা পাইয়ে!এবার আর সারাদিনেও এই মেয়ের ধরা পাবো না”
“হ্যা রে বাবু,মেয়েটা কোথা থেকে পেয়েছিস?খুবই মিশুকে আর ভালো একটা মেয়ে”
শান মুচকি হেসে বলে,”ওর মাঝে আমার জান লুকিয়ে আছে কাকি।আমার আঁধার জীবনের আলো সে।আমি পাইনি ওকে, ও আমায় খুঁজে নিয়েছে।আর শেষমেশ আমি হেরে গেছি ওর কাছে”
হতাশকন্ঠে রোশনি বলে,”তোর মায়ের কপাল রে বাবু, এমন একটা বউ পেয়েছে।আমার যে কি হয়!”
শান রোশনির কাছে এসে বলে,”এভাবে কেন বলছো কাকি।রাখি অনেক ভালো মেয়ে।আর রাখিতো পাখিরই বেষ্ট ফ্রেন্ড”
“বলিস কি?কেউ তো বলিস নি আগে”
স্বগতোক্তি করে রোশনি বলে,”তাহলে আর কোন চিন্তাই নেই রে বাবু। বউ মার একটু হলেও ছোঁয়া আমার বউ মার মাঝে থাকবেই তাহলে!কি বলিস?”
“একদম চাচি”
🌸🌸
সারাদিনে একটি বারের জন্যেও পাখি আর শানের কাছাকাছি যায় নি।দূর থেকে দেখা হলে চোখ রাঙ্গিয়েছে শুধু।আর শান মুচকি হেসে পাশ কাটিয়েছে।
পুরো বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে।বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হলেও বাড়ি সাজাতে কোনরূপ কার্পন্য শান করে নি।মনের মতো করে সাজিয়েছে নিজের বাড়ি।তার ধারনা কেউ যেন বলতে না পারে কাকাত ভাইয়ের বিয়ে বলে খরচাপাতি কম করেছে।
আজ আরো অনেক আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভরে গেছে।বাড়ির মেয়েরা সবাই পাখিকে সাথে নিয়েছে।শান অগত্যা একাই ঘরে শুয়ে আছে।হঠাৎ মনে হয় মেডিকেলের কিছু কাজ রেডি করতে হবে। ল্যাপটপ নিয়ে বসে পরে।কিছুক্ষন কাজ করতেই মাথাটা ঝিমঝিম করে। দুহাতে চেপে ধরে মাথা নুয়ে থাকে।
“হুমম এটা নাও,খেলে মাথা ধরা কমে যাবে”
হঠাৎ পাখির কন্ঠে মাথা তুলে তাকায় শান।হাত বাড়িয়ে কফির মগটা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে শান বলে,”সবাই ঘুমিয়েছে?”
“হুমম ঘুমিয়ে গেছে।তুমিও ঘুমাও এবার । আর কাজ করতে হবে না”, বলতে বলতে পাখি বিছানার উপর ছড়ানো ছিটানো সব কাগজ সমেত ল্যাপটপ টা উঠিয়ে রাখে।
” আরে আরে করছো কি?কাজ তো এখনো অনেক বাকি?”,চমকে প্রশ্ন করে শান।
রাগি চোখে তাকিয়ে পাখি বলে,”কাজ কাল করো।আজ ঘুমাও।দেখেছো কি অবস্থা হয়েছে চোখ মুখের।এই তুমি এই পদ ছেড়ে দাও তো।এতো খাটা লাগবে না তোমার”
শান কফির কাপটা হাত থেকে টেবিলে রেখে পাখিকে কোলে বসায়।
“এদিকে আসো।আজ যদি কাজ গুলো শেষ না করি তাহলে কাল সকাল সকাল হাসপাতালে পৌঁছে কাজগুলো শেষ করতে হবে। মিটিং শুরু হতে হতে লেইট হবে তাহলে। আর মিটিংটা শেষ করতে করতেও রাত হয়ে যাবে।”
“হোক, তবুও তুমি এখন ঘুমাও”,বলতে বলতে পাখি শানের মাথাটা আলতো হাতে মেসেজ করে দেয়।
ব্যপার টা মন্দ লাগছে না শানের।পুরো দুনিয়া ভুলে ঘুমের রাজ্যে চলে যায় কয়েক মূহূর্তেই।
🌸🌸
সকালে হকারের কড়া ডাকে সবার আগে ঘুম ভাঙ্গে শানের।তড়িঘড়ি করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৭.৩০ বাজে।চোখ কপালে উঠে যায় যেন।ফোন হাতরিয়ে দেখে পরপর অনেকগুলো মিসড গুলো।ফোন সাইলেন্ট করা দেখে খুব একটা অবাক হয় না শান।বুঝতে পারে পাখিই সাইলেন্ট রেখেছে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাখির দিকে তাকাতেই ঘুমন্ত মলিন মুখটা নজর কাড়ে শানের।এগিয়ে গিয়ে কপালে, গালে,চোখে অজস্র চুমু দিতেই চোখ খোলে পাখি।
শান উঠে দাঁড়িয়ে পাখিকে ঘড়ির দিকে ইশারা করে বলে,”দেখো কতোটা বেজে গেছে।আর ফোন সাইলেন্ট রাখছো কতো জরুরী কল এসেছিলো দেখো।”
পাখি চোখ পিটপিট করে বলে,”আপনি গভীর ঘুমে ছিলেন। বার বার ফোন আসলো তাই…..”
“আচ্ছা বাদ দাও। একটু কষ্ট করে উঠো।কেউ মনে হয় উঠে নি এখনো।কিছু খেতে দাও।তাড়াতাড়ি মেডিকেলে যেতে হবে।”
শান দ্রুত পোশাক হাতে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়।
পাখি লম্বা পা ফেলে নিচে নেমে আসে।সত্যিই কেউ এখনো উঠে নি। কাল রাতে বেশ রাত হয়েছে ঘুমাতে ঘুমাতে।বিয়ে বাড়ি বলে কথা। তাই আর পাখি কাউকে না ডেকে নিজেই রান্নাঘরে চলে যায়।শানের জন্যে পাস্তা, জেলি সমেত পাউরুটি,এক গ্লাস কফি হাতে উপরে চলে যায়।
“এসবই করতে পেরেছি, এইটুকু সময়ে”, বলতে বলতে পাখি শানের কাগজ পাতি গুলো গুছিয়ে দেয়।
শান হাত টেনে কপালে চুমু দিয়ে বলে,”এনাফ। আর লাগবে না কিছু”
শান বসে পাস্তা মুখে দিতেই আবারও কল আসে।
“হ্যা রিশাদ বলো”
…..
“ওকে আমি দশ মিনিটের মাঝেই চলে আসছি।ডোন্ট ওরি”
বলেই কল কেটে দেয় শান।পাখির দিকে ব্রেড তুলে বলে,”তুমিও খাও”
“আগে তুমি খেয়ে যাও।আমি সারাদিনেও খেতে পারব”, শানের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে পাখি।
শান নাছোড়বান্দার মতো ব্রেডটা ধরে থাকে।
” কি যে পাগলামি করছো কাল থেকে”,বলে অগত্যা ব্রেডটা খেয়ে নেয় পাখি।
“শোন, সকালের খাবার টা কমপ্লিট করে তোমরা সবাই বাড়িতে তালা মেরে চলে যাবে কমিউনিটি সেন্টারে।ওখানে আমি সবটা সেট করে দিয়েছি।তোমরা যাবা রাখিরাও চলে আসবে। সন্ধ্যার পর পরই বিয়ের কার্যাক্রম শুরু হবে।আমি তাড়াতাড়ি ওখানে পৌঁছানোর চেষ্টা করব। আর হ্যা যাওয়ার সময় আমার একটা ড্রেস নিও তো।রাত হতে হতে এ ড্রেসে বিয়েতে থাকা যাবে না”, খাবার চিবোতে চিবোতে কথাগুলো বলে শান।
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় পাখি।
খাওয়া শেষে শান উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে আরেকবার আয়নায় সেট করে নিয়ে বলে,” সাবধানে চলাফেরা করবা।ওখানে খারাপ লাগলে মা অথবা রাহেলা চাচিকে বলবা।আমি মিটিং এ থাকব সারাদিন।ফোন হয়ত সাইলেন্ট থাকবে নয়ত বন্ধ থাকবে। আর আমি সুযোগ পেলে তোমায় কল করব কেমন?”
বলতে না বলতে পাখি শানের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে।
“আরেকটু পরে গেলে হয় না!”, অবুঝের মতো আবাদার করে পাখি।
শান একগাল হেসে বলে,” কাল রাতে কাজটা কমপ্লিট করলে আজ দেরিতে গেলেও প্রবলেম হতো না জান।”
বুক থেকে পাখিকে আস্তে উঠিয়ে বলে,”,আমি মিটিং তাড়াতাড়ি শেষ করেই ওখানে যাবো।চিন্তা করো না ”
#আসক্তি২
পর্বঃ৪৬
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
[গতানুগতিক নিয়মের বাহিরে যারা ব্যতিক্রমী কিছু গ্রহনে অনাগ্রহী তাঁরা দয়া করে আমার গল্পটা এভোয়েড করবেন]
____________
বাড়ি ভর্তি মানুষ অথচ সবার মাঝেও নিজেকে কতোটা একা লাগছে পাখির।শান চলে যাবার পর থেকে বুক টা ধুকপুক করছে ভীষণ।একধ্যানে বেলকোনিতে বসে গেইটের দিকে উদাস মনে চেয়ে আছে পাখি।দৃষ্টি আজ স্থীর।কেন জানে না মনে আজ হাজারও কথা জেগে উঠছে।জেগে উঠছে বিষাদের নীল রেখা।চারপাশের কোলাহল কোনভাবেই সে বিষাদকে ছাপিয়ে যেতে পারছে না।
“ও মুন সাইন যাবে না তুমি?এখনো রেডিই হও নি?”,বলতে বলতে ঘরে ঢোকে ইনায়াহ্।
পাখি ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে মুচকি হেসে ইনায়াহ্’কে ডেকে নেয় কোলের কাছে।
“না যাবো না দিদা বলেছে বোনু কষ্ট পাবে, তোমার কোলে ওঠা যাবে না”,থমথমে মুখে জবাব দেয় ইনায়াহ্।
পাখি স্মিত হেসে বলে,”কে রেডি করালো তোমায়?”
“দিদা করিয়েছে”
“মা শা আল্লাহ্, আমার মেয়েকে কতো সুন্দর লাগছে”,বলেই ইনায়াহ্’কে শক্ত করে জড়িয়ে কপালে গালে চুমু এঁকে দেয় পাখি।
“হয়েছে তোমাদের?”,পাখি আর ইনায়াহ্’র আলিঙ্গন দেখে স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বলে শর্মিলা।
ইনায়াহ্’র সাথে পাখি এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে বেলকোনির দরজায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতে পারে নি সে।
শর্মিলার দিকে চেয়ে শব্দহীন হেসে দেয় পাখি।
“চলো চলো চলো,আর কখন যাবে বলো তো”,বলে দ্বিতীয় দফা তাড়া দেয় শর্মিলা।
“একটু পরে যাই মা, শরীরটা ভালো ঠেকছে না”,দূর্বল কন্ঠে বলে পাখি।
শর্মিলা দ্রুত এসে পাখির কপাল গালে হাত রাখে,”কি হয়েছে বউ মা? খুব কি খারাপ লাগছে?বাবুকে কল করব?”
শর্মিলাকে মিছে আস্থা দিয়ে পাখি বলে,”না মা তেমন কিছু না।আপনার ছেলেকে ফোন দিতে হবে না। আপনি যান আমি রেডি হয়ে আসি”
🌸🌸
এমনিতে কোথাও গেলে পাখির রেডি হতে মোটেও তেমন সময় লাগে না।আর আজ যেন হাতই চলছে না তার।কাবার্ড থেকে জাম রঙ্গের হালকা কাজের শাড়িটা বের করে।আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের খোলা পেটের দিকে একবার তাকায়।হাত চলে যায় পেটের উপর।মুচকি হেসে ওঠে পাখি।ফোনটা এনে পরপর কতোগুলো ছবি তোলে।পাঠিয়ে দেয় শানের বার্তাকক্ষে।এরপর শাড়িটাকে অগোছালো হাতে সেট করে নেয় নিজের শরীরে।আবার পর পর কতোগুলো ছবি উঠিয়ে, পাঠিয়ে দেয় শানের কাছে।
চুল আঁচড়ে ছেড়ে দিতেই শানের কথা মনে পড়ে।লম্বাচুল গুলো দুইদিকে ছড়িয়ে বিভিন্ন এঙ্গেলে কয়েকটা ছবি তোলে, সেগুলোকেও পাঠিয়ে দেয় ভালোবাসার মানুষটার কাছে।কিছুক্ষন পরে বেশ অগোছালো হয়েই ঘর ছাড়ে পাখি।
একে একে সবাই গাড়িতে বসে পরে।পরপর চারটা গাড়ি দাঁড়ানো সদর দরজার বাহিরে।একটা বরের জন্যে বাকি তিনটা অন্যান্যদের জন্যে।শানের নিজস্ব গাড়িতে বাড়ির সদস্যরা উঠেছে আর বাকি ভাড়া গাড়িগুলোতে অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরা।পাখি অন্য গাড়ির দিকে এগোতেই রাফি বলে,”ভাবি ভাইয়া আপনাকে এ গাড়িতে যেতে বলেছে”
চমকে পিছু ফেরে পাখি।ক্ষীনস্বরে “আচ্ছা”বলে গাড়িতে বসে।জানালার পাশে গিয়ে বসে পাখি।
“নিজে নেই অথচ আমার খেয়াল ঠিকই রেখেছে”,শানের কথা ভাবতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে পাখির।ফোনের পাওয়ার বাটনে চেপে স্ক্রীনে শানের ছবিটায় হাত বুলিয়ে নেয়।
🌸🌸
কমিউনিটি সেন্টার বাড়ি থেকে ততোটাও দূরে নয়।কিছুক্ষনের মাঝেই সবাই এসে পৌঁছায় সেখানে।শান যে বেশ খরচা করেছে এই বিয়েতে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।চারদিকে টা ভালো করে দেখে পাখিরা ভিতরে ঢোকে।একে একে আমন্ত্রিত সকলেই চলে আসছে।রাখিরা চলে এসেছে একটু আগে।পার্লার থেকে মেয়েরা সাজাচ্ছে তাকে।পাখি আর সেদিকে পা বাড়ায় না।পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকায় পাখি।
“রাফি তুমি!”,অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পাখি।
সহাস্যে রাফি জবাব দেয়,”স্যার আপনাকে দেখে রাখতে বলেছে ভাবি।কখন আপনার কি প্রযোজন হয়!”
পাখি হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।নিজেকে কোনমতে ধাতস্থ করে বলে,”তুমি যাও আমার কোন প্রয়োজন হলে আমি ডেকে নিবো তোমায়”
“ভাবি আপনাকে খুব দূর্বল লাগছে।চাইলে আপনি রেস্ট নিতে পারেন”
“কিভাবে রেস্ট নিবো রে ?”,সন্দিহান চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে পাখি।
“স্যার আপনার রেস্টের জন্যে এখানে একটা রুমও বুক করেছে।বলেছে আপনার খুব বেশি খারাপ লাগলে ঐ রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে”,গড়গড় করে কথাগুলো বলে রাফি।
এতোটা ভাবে শান ওর জন্যে এটা ভাবতেই চোখের কোণে জল জমে যায় পাখির।ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি খেলে ওঠে।নিজের ভাগ্যের উপর নিজেরই বড্ডো হিংসে হচ্ছে আজ।
“তুমি যাও রাফি।লাগলে ডেকে নিবো”,বলে রাফিকে পাঠিয়ে দেয় পাখি।
🌸🌸
বিয়ে বাড়িতে যতোই সবকিছু সময় ধরে করা হোক না কেন শেষ পর্যন্ত কোনটাই নির্দিষ্ট সময়ে করা হয় না।দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পরে যায়।তবুও বিয়ের কাজ শুরু হয় না।বিয়ের আয়োজনে তাড়া দিতে থাকে আগত মেহমানরা।ঘন্টা খানিক পর শুরু হয় বিয়ের কার্যক্রম। সময় তখন বিকেলে ৫.৩০.
পাখি একবার ফোনের দিকে তাকাতেই দুজনের খুঁনসুটি মাখা মূহূর্তের ছবিটা ভেসে ওঠে।তখনি মনে পড়ে শান সকালে তাকে কি বলেছিলো!
“এটা কি করে ভুললাম আমি?উনি তো ড্রেস আনতে বলেছিলেন আর সবার শেষে তো আমিই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি।তালাও তো দেই নি দরজায়”
ভাবতেই গায়ের সবগুলো লোম যেন দাঁড়িয়ে যায় পাখির।এদিকে সন্ধ্যা নামার আগেই চারদিকে ঘনকালো আঁধারে ঢেকে গেছে। হয়ত অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির পূর্বাভাস।পাখি ভাবতে থাকে এখন তার কি করা উচিত!
শত ভেবেও কোন উপায় না ;স্বশরীরে বাড়ি যাওয়া ছাড়া।যেই ভাবা সেই কাজ। মাথা উঠিয়ে দেখে তার আশেপাশে বাড়ির কেউ নেই।সবাই হয়ত বিয়ে দেখছে।পাখি উঠে এসে রাফিকে খোঁজে চারদিকে। কোথাও পায় না।অগত্যা ফোনটা হাতে নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় গাড়ির জন্যে।
কিছুক্ষনের মাঝে গাড়িও পেয়ে যায় একটা।এদিকে ইতোমধ্যেই আকাশে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শুরু হয়ে গেছে।পাখির মন বলছে তাকে বাড়িতে যেতেই হবে, শানের ড্রেস আনতেই হবে, তালা দিতেই হবে।কথায় বলে বিপদ থাকলে সেখানে যাওয়ার জন্যে মন ব্যকুল হয়ে ওঠে।
গাড়িতে চড়ে সোজা চলে আসে বাড়ির গেইটে।গেইট খোলা অথচ দারোয়ান নেই।গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে সবখানে চোখ বুলিয়ে নেয় পাখি।মনে অজানা ভয় গ্রাস করে।
“বাড়িতে চোর ডাকাত পরে নি তো”
শুকনো ঢোক গিলে দোকানের দিকেও তাকায় পাখি।কোথাও দারোয়ান নেই।ঝড়ের পূর্বাভাস দেখে দোকানপাট সব বন্ধ করার প্রস্তুতি চলছে।গাড়িওয়ালাকে ভাড়াটা মিটিয়ে পাখি গেইটের ভিতরে পা রাখে।কোন জনমানব নেই বাড়িতে আজ।দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে সদর দরজার সামনের লাইটটা জ্বলছে ;হয়ত দারোয়ানই জ্বালিয়েছে।পাখির মনে ভয় হচ্ছে বাড়িতে ঢুকেই যদি চোর ডাকাতের মুখে পড়তে হয়।
মনে সাহস সঞ্চার করে বাড়ির দরজায় পা রাখে পাখি।অন্যরকম একটা গন্ধ এসে নাকে ঠেকে।চারপাশে তখন মাগরিবের আজান পরে যায়।শাড়ির আঁচলটা মাথায় টেনে ড্রয়িংরুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয় পাখি। চারিদিকের সবটাই ঠিক আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।কিছুক্ষনের মাঝেই ঝুম বৃষ্টি সাথে বাজ পরার কর্কশ শব্দে না চাইতেও গা হিম হয়ে আসে পাখির।ড্রয়িং রুমের চারদিকে ভালো করে দেখে নিয়ে পাখি উপরে নিজের ঘরে চলে যায়।উদ্দেশ্য শানের ড্রেসটা নিয়ে তালা চাবি সমেত নিচে নেমে আসা।
পাখি দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায় উপরে।ঘরের দরজায় পা রাখতেই বিকট শব্দ করে উঠে।অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে মূহূর্তেই।হঠাৎ ছাদের দরজার কথা মনে হতেই সেদিকে পা বাড়ায় পাখি।কিন্তু আজ তো দরজা বন্ধ শব্দ টা কিসের হলো তাহলে।
শব্দের উৎস না খুঁজে পাখি নিজের ঘরে চলে আসে।দক্ষিনের জানালাটা খোলা।বৃষ্টির পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে সোফাটা।পাখি ফোনটা দরজার কাছের ওয়ারড্রোবের উপর রেখে এগিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দেয়।এরপর কাবার্ড খুলে শানের হালকা বেগুনি রঙ্গের পাঞ্জাবিটা বের করে নেয়।কারণ এই পাঞ্জাবিটা বেশ মানায় শানের শরীরে।মুচকি হেসে সেটা আলতো ছুঁয়ে দেয়।
ঠোঁট এগিয়ে চুমু দিতেই হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায়
দ্বিতীয় দফা ভয়ে কেঁপে ওঠে পুরো শরীর।জানালা ভেদ করে বজ্রপাতের আলো ঘরে ঠিকরে ঢুকছে।সে আলোতে পাখি সন্তোর্পনে এগিয়ে যায় ফোনের কাছে।
ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে আড়চোখে দেখে নেয় পুরো ঘরটা।এরপর পাঞ্জাবির সেটটা নিজের সাইড ব্যাগে ভরে নেয় পাখি।তালা চাবি বের করে দরজা টা ভিড়িয়ে বাহিরে চলে যায়।ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না যেন।ফোনের আলোয় নির্দিষ্ট একটা স্থান আলোকিত হলেও চারপাশটা অন্ধকারই রয়ে যায়।গা ছমছমে একটা পরিবেশ তৈরী হয়।বাহিরে বৃষ্টির শব্দে অন্য কিছু শোনার জো নেই।পা টিপে টিপে পাখি সিঁড়িতে চলে আসে।চোখে পড়ে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকা মানুষটার উপর।অবয়ব স্পষ্ট না হলেও তার গাতিবিধিই বোঝাচ্ছে সে মানুষ।
আগত মানুষটাকে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয় পাখির।
“কে ওখানে?”,মনে ভয় কিন্তু কন্ঠে কাঠিন্য বজায় রেখে প্রশ্ন করে পাখি।আর তখনি থেমে যায় মানুষটার গতিবেগ। কোন জবাব ছাড়াই ফোনের লাইট অফ করে নেয় লোকটা।পরোক্ষণে মনে পড়ে রনির আসার দিন এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো।
মনে কিছুটা সাহস ফিরে পায় যেন
“আমি জানি আপনি রনি ভাইয়া।প্লিজ ভাইয়া এভাবে মজা করবেন না”,হেসে হেসে বলে পাখি নিচে নেমে আসে।
অথচ সে বেমালুম ভুলে যায় আজ তো রনিরই বিয়ে। তার এখানে থাকার কথা নয়।
যখন কথাটা মাথায় আসে ততোক্ষনে নিজেকে একদম সিঁড়ির দোরগোড়ায় আবিষ্কার করে পাখি।শিড়দাড়া বেয়ে শীতল কিছু একটা বয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।কাঁধে ব্যাগ,হাতে ফোন অন্যহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে কান্না সংবরনের চেষ্টা করে।
“কেকে ওওখানে?”,জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি।
বৃষ্টির বেগ যেন সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।ঘরে ফিরে যাওয়াকে বুদ্ধিমতির কাজ ভেবে হাতে ফোনটা চেপে উপরে দ্রুত উঠতেই বিদ্যুৎ চলে আসে।থমকে যায় পাখির পা।আগত লোকটাকে দেখার অদম্য ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিয়ে একটিবারের জন্যে পিছনে ফিরে তাকায় পাখি।আর তখনি পুরো শরীর যেন অসাড় হবার উপক্রম। হাত থেকে ফোনটা পরে যায়।এক সিঁড়ি থেকে আরেক সিঁড়িতে বারি খেয়ে গড়িয়ে পরে একদম নিচে।আগত লোকটা সেদিকে একবার তাকিয়ে পূনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পাখির দিকে।
চোখের সামনে নিজের বিপদ ছাড়া কিছুই নজরে আসে না পাখির।
“ভুল হয়ে গেলো,বড্ডো ভুল হলো বুঝি!আল্লাহ্ সহায় হও…..এইই কই তুমি? কেন আসছো না? আজ বুঝি তোমার জানপাখির শেষ দিন হতে চললো”,আপনমনে ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে পাখি।
আগন্তুক লোকটা দিগ্বিদিক না ভেবে পাখির উদ্দেশ্যে দৌঁড় দেয়।কাঁধের ব্যাগ ফেলে দৌঁড়াতে শাড়ির আঁচল গিয়ে আটকে যায় পায়ের সাথে। সকালে অগোছালো হয়ে শাড়িটা পড়ায় আঁচলটা একটু বেশিই লম্বা হয়ে যায়।মুখ থুবড়ে পরে যায় পাখি।ব্যথায় নীল হয়ে যায় পুরো মুখ।উঠে দাঁড়াতেই বুঝতে পারে শাড়ির আঁচলে কারো টান।পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে পুরো আঁচলটা লোকটার হাতের মুঠোয়।খানিক পরেই নিজের অবস্থার কথা ভেবে চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসে পাখির।করূনদৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকাতেই কটাক্ষের হাসি উপহার দেয় লোকটা।বুকের কাছের আঁচলটা চেপে টান দিয়েও কোন লাভ হয় না।
“আল্লাহ্”,অস্ফুট স্বরে বলে শাড়ির কুচি দ্রুত খুলে পুরো শাড়িটা খুলে লোকটার মুখে ছুড়ে মারে।এরপর প্রাণপনে ছুটে চলে আসে নিজের ঘরে।খুব দ্রুত দরজা লাগিয়ে হাফাতে থাকে পাখি।বুকের ছাতি যে হাঁফরের ন্যায় ওঠানামা করছে।হার্টবিট বেড়ে গেছে অনেকগুন।পেটের চারপাশে হাত চেপে চেপে বোঝার চেষ্টা করে কোথাও অজান্তেই ব্যথা পেয়েছে কিনা!
পরোক্ষণেই কান্নায় ভেঙ্গে পরে পাখি।মেঝেতে বসে দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে কেঁদে ফেলে।
বার বার শানের কথা মনে আসছে,শানের মুখটা চোখে ভাসছে।
“কোথায় তুমি?আমাদের মনে হয় আর দেখা হবে না গো….আচ্ছা আমি কি আজ মরে যাবো?মরলেও কোন আফসোস নাই কিন্তু লোকটা যদি দরজা ভেঙ্গে আমার সাথে মন্দ কিছু করে! সহায় হও হে মালিক।”
ভাবতেই দরজায় পরপর কতোগুলো লাত্থির শব্দ স্পষ্ট হয়।ভয়ে আড়ষ্ট হয় পাখির পুরো তনুমন।
গা গুলিয়ে আসে পাখির।বুক ফেটে চিৎকার চলে আসছে যেন।কিন্তু চিৎকারে খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হয় না।তবুও পরপর কতোগুলো চিৎকার দেয় পাখি।কিন্তু বৃষ্টির শব্দের কাছে সে চিৎকার ঘরের চারকোণাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।একেতো শরীর অনেকটা দূর্বল তারউপর এতোটা ধকল শরীর নিতে পারে না।চিৎকার গুলো দেয়ার পর বুঝতে পারে তলপেটে চিনচিনে ব্যথা করছে।বৃষ্টির ধারার ন্যায় চোখের পানি ফেলে পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”শান”
নিজের দিকে তাকাতেই চোখ মুখ মুছে দ্রুত কাবার্ড থেকে জামা বের করে গায়ে জড়িয়ে নেয়
“দরজা খোল”,দরজা ধাক্কার সাথে বলিষ্ঠ কন্ঠের কর্কশ আওয়াজে চমকে ওঠে পাখি।সেদিকে কান না দিয়ে দ্রুত ঘরের চারদিকে নিজের ফোন খোঁজা শুরু করে।মনে পড়ে যায়, “ফফোন তো সিঁড়িতে পরে গেছ,….আল্লাহ্ সহায় হও”
কাঁদতে কাঁদতে জানলার কাছে চলে যায় পাখি।নিচে তাকিয়ে আশপাশে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করে।আবাসিক এলাকা হওয়ার দরূন মানুষের সমাগম বরাবরই কম এখানে।আর এমন প্রবল বেগে বৃষ্টিতে তো অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও খুঁজে পাওয়া ভার।অন্যদিকে দরজায় সমান তালে লাত্থি, ধাক্কা দিয়েই চলেছে লোকটা।
ঘরের সব ড্রয়ার তন্য তন্য করে খুঁজেছে পাখি কোথাও কিছু নেই যার দ্বারা কারো কাছে সাহায্য পাওয়া সম্ভব।
___________
“কি ওটা রাখলেন?”
“আগের সিম কার্ডটা”
“চেঞ্জ করলেন?”
“হুমম কয়েকটা মেয়ে খুব জ্বালাচ্ছিলো”
হঠাৎ সেদিনের কথা মাথায় আসে পাখির।চোখের পানি মুছে দ্রুত উঠে যায় সাইড টেবিলের প্রথম ড্রয়ারটার কাছে।টেনে খুলেই ড্রয়ারের সবকিছু বের করে পাখি।সিম টা হাতে উঠে আসে খানিক বাদেই।
চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে খুশিতে।মূহূর্তে সে খুশি গায়েব হয় ফোনের কথা ভেবে।
কিছু একটা ভেবে শানের টুলস বক্সটা হাতে নেয় পাখি।দৃঢ় বিশ্বাস এখানে কোন না কোন পুরোনো ফোন থাকবেই।যেই ভাবা সেই কাজ।অনেক খুঁজে একটা পুরোনো বাটন ফোন পেয়ে যায় পাখি।ঘাবড়ানো চোখ দুটো দরজার দিকে বার বার তাকাচ্ছে।একদিকে ভয় অপরদিকে বিপদ কাটানোর অদম্য ইচ্ছা।এ দুয়ের মাঝে পিষ্ট হচ্ছে পাখির তনু মন।
ফোনে সিম টা উঠানো হলেও খোলে না সে ফোন।দ্রুত চার্জিং এ লাগায়।কানেকশন পেয়ে যায়।শখের বশে মুখস্ত করা শানের নম্বরটায় ডায়াল করে পাখি।
🌸🌸
“ড.শান প্লিজ প্রেজেন্ট ইওর প্রেজেন্টেশন। ইট’স ইওর টার্ণ ইয়াংম্যান ”
“ইয়াহ্ শিওর”
সন্ধ্যা ৭ টা বাজছে। সবার প্রেজেন্টেশন শেষে ক্রম আসে শানের।সৌজন্যমূলক হেসে মাউথস্পিকার টা ঠিক করে নিয়ে মনিটরে সকলের উদ্দেশ্যে প্রজেক্টের প্ল্যান গুলো দেখাতে শুরু করে শান।
সাউন্ডপ্রুভ ঘরটায় বৃষ্টির শব্দ ঢুকতে পারছে না। ফোন টা ভাইব্রেট করছে অনবরত।পিনপতন নীরবতায় ভাইব্রেশনের কম্পিত শব্দটাই বিরক্তির কারণ হচ্ছে সকলের।সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় শানের ফোনে। শান সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পরে যায়।ফোনের স্ক্রীনে ভেসে ওঠে অজানা একটা নম্বর।ভ্রু কুচকে কেটে দেয় সাথে সাথেই।
“এক্সট্রিমলি সরি “,অনুরোধের স্বরে বলে শান পূনরায় মনোযোগী হয় মিটিং এ।
এদিকে দরজায় বিকট শব্দ হতেই ভয়ে পাখির হাত থেকে পরে যায় ফোনটা।পাখি ধরেই নেয় দরজা ভেঙ্গে ফেলেছে লোকটা।কিন্তু না পাখিকে অবাক করে দরজা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে নিজের অবস্থানে।নিজেকে বড্ডো বেশি অসহায় লাগে মূহূর্তেই।ভিতর যে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।গলা শুকিয়ে আসছে বার বার।বার বার ঢোক গিলেও গলাটা ভিজছে না।কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে দেখে বন্ধ হয়ে গেছে।ফোন টা আবারও চার্জে লাগিয়র খোলার চেষ্টা করে পাখি।এবং দ্বিতীয় বার খুলেও যায় ফোনটা।হাজার বিপদের মাঝেও চোখ ঝলমলিয়ে ওঠে যেন।
সময়ের ব্যয় না করে আবারও শানের নম্বরে ডায়াল করে।
________
“ড.ফ্যায়সাল, প্লিজ পিক আপ দ্যা কল। উই উইল ওয়েট.রাইট?”,হাস্যোজ্বল মুখে সবার দিকে একবার তাকিয়ে কথাটা বলে ইন্ডিয়া থেকে আগত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ মনোজ শেঠি।
তার কথায় সবাই সম্মতি দিলেও ব্যপার টা যে মোটেও ভালো হলো না তা শানের বুঝতে অসুবিধা হয় না।বিরক্তি ভরা মুখে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,”এক্সকিউজ মি প্লিজ!”
বাহিরে বেরিয়ে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে শান।
“হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো কে বলছেন?”,রেগে গিয়ে বলে শান।
শানের কথায় বুক ছিঁড়ে কান্না আসে পাখির।মুখ চেপে কান্না সংবরন করে বলে,”
“হহহ্যাহহহ হ্যালো হ্যালো, আআামি বলছি”
“আজ যাচ্ছি তারমানে এটা না আমি আর আসব না।আজকের ফল মোটেও ভালো হবে না পাখি “,পাখির কথার মাঝেই দরজার বাহিরে থেকে কর্কশ গলায় শাসায় লোকটা।কথা বলা রেখে পাখি কান পাতে বাহিরে থেকে আসা কন্ঠটার দিকে।মূহূর্তেই দরজায় সজোড়ে ধাক্কা মারার কারণে খানিকটা নড়ে ওঠে কাঠের মোটা দরজাটা।
পাখি দ্রুত বলে,”আমি পাখি, তুমি কই গো?প্লিজ বাড়ি আসো”
কিন্তু ওপাড় থেকে কোন আওয়াজ আসে না।দরজার ওপাড়েও সবটা নীরব।কেউ বলতেও পারবে না এতোক্ষণ দরজার উপর দিয়ে কি ঝড়টা বয়ে গেলো।
পাখি ফোনটা কান থেকে চোখের সামনে এনে দেখে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে।দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে ব্যাটারি ডাউন হয় ফোনের।
🌸🌸
ফোনের দিকে তাকিয়ে চোখে মুখে না বুঝার ছাপ চলে আসে শানের।বোধগম্য হয় না কে ছিলো, কারণ তখন বৃষ্টিটা ছিলো মুষলধারে।ফোনটা সাইলেন্ট মুডে টেবিলের উপরে,উপর করে রেখে শান দ্বিতীয় বারের মতো মিটিং এ মনোনিবেশ করে।
পাখি দরজায় কান দিয়ে পদধ্বনি বোঝার চেষ্টা করে।সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়ার শব্দ বুঝতেই হাফ ছেড়ে বাঁচে পাখি।বাম হাত বুকে চেপে দরজায় ঠেস মেরে নিচে বসে পরে।একটু আগের কথা ভাবতেই চোখে ঝরনার ধারার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।ঘামে ভিজে একাকার পুরো শরীর।কেটে যায় পনের থেকে কুড়িটা মিনিট।তবুও বৃষ্টি থামার কোন নাম গন্ধ যেন নেই।নিজেকে বিপদ মুক্ত ভেবেই সন্তোর্পনে দরজাটা খোলে পাখি।আড়চোখে দরজার এপাশ ওপাশ তাকায় সে;কেউ নেই।শুকনো গলায় কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে এক পা বাড়ায় পাখি।উদ্দেশ্য যে করেই হোক বাড়ির কাউকে জানাতেই হবে।
চারদিকে ভালো করে দেখে পা টিপে টিপে আগে যে ঘরে ছিলো ইনায়াহ্ সহ সে ঘরে ঢোকে পাখি।দ্রুত দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ইনায়াহ্’র ফোন খুঁজতে থাকে বিছানা আর টেবিলের ড্রয়ারে।অবশেষে ফোনটা খুঁজে পায় খাটের একদম পিছনের ফাঁকা জায়গায়।হাতে নিয়ে দ্রুত ডায়াল করে শানের নম্বরে।রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন টা ধরছে না শান।
“ধরছে না?”,
নিজের পিছনে সেই চেনা কন্ঠটা কর্ণকুহরে ঢুকতেই বুকের ভিতর আবারও তোলপাড় উঠে যায়।খুব সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় পাখি । চোখ পিটপিট করে তার।
“আরে ধরবে না, মিটিং এ ব্যস্ত আছে”,খুব শান্ত অথচ ধারালো একটা কথা।দরজার দিকে চোখ পড়তেই পাখি বুঝতে পারে আবারও কতো বড় ভুল সে করলো দরজার ছিটকিনি টা নিজেই লাগিয়ে।কিন্তু সে তো লাগিয়েছিলো বিপদ থেকে বাঁচতে, সেই বিপদ কিনা ঘরের ভিতরেই!
হুহুস্বরে ডুকরে কেঁদে ওঠে পাখি।
🌸🌸
“কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার শান”
মিটিং শেষ করে ধপ করে পিছনের চেয়ারে বসে পরে শান।টাই টা টেনে ঢিলে করে চশমা টা খুলে টেবিলে রাখে।ফোনটা উল্টিয়ে দেখে ৮.৩০ বেজে গেছে।সাথে একটা মিস্ড কল ইনায়াহ্’র নম্বর থেকে।প্রথমে ভ্রুজোড়া কুচকালেও পরোক্ষনে মুচকি হেসে ব্যাগ প্যাক করে আমন্ত্রিত কলিগদের নিয়ে বের হয় কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে।
পথে কয়েকবার পাখিকে ফোন করা হলেও ফোনটা সুইচ অফ পায় শান।মুচকি হেসে আনমনে বলে,”এতো অভিমান আমার বউটার।”
স্ক্রীনে পাখির হাস্যোজ্বল মুখটা আঙ্গুলে ছুঁয়ে বলে “পুতুল বউ আমার”
🌸🌸
“ম্যাডাম বউ মা কোথায়?”,
“আছে হয়ত কোথাও।আমিও দেখছিনা অনেক্ষন ধরে।বউ মার শরীর টা খারাপ বুঝেছি।হয়ত রেস্ট নিচ্ছে”,বলেই শর্মিলা রাহেলাকে বলে ইনায়াহ্’কে নিয়ে বিয়ের অতিথীদের সাথে কুশল বিনিময় করে।
“বড় মা, ভাবি কোথায়?”,রাফি হন্তদন্ত হয় বলে।
পিছন ফিরে শর্মিলা অবাক হয়ে বলে,”কী রে, সবাই বউ মাকে খুঁজছিস মানে।আছে হয়ত কোথাও। দেখ না বাবা খুঁজে।”
“আমি পুরো সেন্টার তন্নতন্ন করে খুঁজলাম বড় মা।ভাবি কোথাও নেই।ভাইয়া বলেছে ভাবিকে চোখে চোখে রাখতে”,অপরাধীর ন্যায় কথাগুলো বলে রাফি।
শর্মিলার গায়ের লোম শিউড়ে ওঠে মূহূর্তেই।
“নেই মানে,কি বলিস এসব?”
চলবে…….
[